সংসার নাকি সম্মান পর্ব-২৬

0
2

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২৬
#অনন্যা_অসমি

বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে আনন্দি। বুক ধুকধুক করতে তার। বাবা-মাকেও সাথে নিয়ে এসেছে সে। মনে মনে ঠিক করেই এসে আজ সবকিছু শেষ করেই যাবে।

উজান তাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো।

” ভিতরে এসো আনন্দি, প্লিজ। এইবার অন্তত এসো।”

আনন্দি তখনো দাঁড়িয়ে রইল। পেছন থেকে তার মা হালকা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে যেতে বলল।

আনন্দি সকল দ্বিধা দ্বন্ধ একপাশে সরিয়ে রেখে ভেতরে প্রবেশ করল। বসার ঘরে আসতেই প্রথমে তার চোখে পড়ল পুষ্প পিসিকে। যিনি সোফায় আরাম করে বসে পান খাচ্ছেন।

আনন্দিকে দেখে তিনি যেন খোঁচা দিয়ে বললেন,

” এলে তাহলে। তোমার প্রাণের স্বামী তোমার তোষামোদ করিনি বলে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। দেখো এখন নিজে আমাকে আমার বাড়ি গিয়ে নিয়ে এসেছে।”

তিনি এবার আনন্দির মায়ের দিকে তাকালেন।

” শোনো বউয়ের মা, সংসারে ঝগড়া-বিবাদ হয়ই, সে জন্য কি বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাবে? মেয়ে জাতের মাঝে বিনয়ভাব না থাকলে সে সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে না। এসব মেয়েকে আগের থেকে শেখানো দরকার ছিল।”

আনন্দির মা কিছু বললেন না। আনন্দিই এগিয়ে এসে জবাব দিল।

” বিনয়ের নামে অপমান মেনে নেওয়াও ঠিক না, পিসি। সবসময় চুপ থাকলে অপর মানুষটা মনে করে তার সামনের মানুষটা বুঝি অনুভূতিহীন রোবট। যার সাথে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ব্যবহার করা যায়। একসময় সেই ব্যবহার চিরস্থায়ী, টেকেন ফর গ্রান্টেড হয়ে যায়।”

কিছুসময় পর বসার ঘরে বাকিরাও উপস্থিত হলো। শর্মিলা দেবী আনন্দির বাবা-মায়ের সাথে নাস্তার ট্রে রেখে মিনমিন করে ওনাদের সাথে খোশ আলাপ করলেন।

সবার উপস্থিতে আনন্দি যেন আরো অধৈর্য হয়ে গেল। উজানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,

” যার জন্য ডেকেছ সেই বিষয়ে কথা বলো।”

উজান উশখুশ করতে লাগল। আনন্দি সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল। পুষ্প পিসি চোখেমুখে প্রশ্ন। বাকিদের চোখে দ্বিধা। আনন্দি হঠাৎ খেয়াল করল তার শশুড় রুম থেকে বেরিয়ে সোফায় বসলেন৷

উজান মাথা নিচু করে বলল, ” টাকা নাকি বাবা ওনার এক বন্ধুকে ধার দিয়েছেন আর কিছু টাকা নাকি উদয়কে দিয়েছে।”

পুরো রুম নিঃশব্দে ছেঁয়ে গিয়েছে। আনন্দি কি বলবে খুঁজে পেল না। সে সরাসরি উদয়ের দিকে তাকাল।

” তুমি না সেদিন বলেছিলে তুমি টাকা নাওনি?”

” আব…. আমি সত্যিই আলমারি থেকে টাকা নেয়নি। আমি তো বাবাকে বলেছিলাম, উনিই দিয়েছিলেন। আমি কি আর জানতাম উনিই…..।”

” তোমার সামনেই এতোকিছু হয়ে গেল অথচ তুমি একবারের জন্যও কথাটা বললে না৷ আমি কি ধরে নেব তুমি ইচ্ছে করেই কথাটা বলোনি?”

উদয় জবাব দেওয়ার কিছু পেল না৷ আনন্দি আবারো প্রশ্ন করল, ” এতোদিন পর আপনারা টাকার সন্ধান পেলেন। কি অদ্ভুত তাই না? সেদিন আপনারা বিনা প্রমাণে আমাকে দোষীর জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ অন্যকাউকে কোন প্রশ্ন করাই হয়নি। আমি বাড়ির বউ, পরের বাড়ির মেয়ে বলে কি দোষী শুধু আমি? এই বাড়ির রক্ত কি ধোঁয়া তুলশি পাতা? বাইরে বাকিদের মধ্যে কি শুধুই দোষ?”

আনন্দি কান্না আঁটকে রাখল। আনন্দির বাবা গলা খাকড়িয়ে নড়ে চড়ে বসলেন।

” জামাই বাবা, অনেক ভরসা করে আমার মেয়েটাকে তোমাদের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা, তোমার কাছে তো এটা আমি আশা করিনি। আপনারা তো আমাদের অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন বিয়ের আগে, এতো কম সময়েই সব ভুলে এরকম ব্যবহার করলেন।”

” বাকিসব একপাশে, এতোদিন পর এই ব্যপারটার জানা গেলে। এতো সময় কেন? আগেই কেন সবাইকে ভালো করে জিজ্ঞেস করা হয়নি? কেনই আমার মেয়ের দিকে বিনাপ্রমাণে দোষ দিলেন?”

” বাবাকে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু ট্যুরে যাওয়ার পথে পাহাড়ি রাস্তায় ওনার ফোন হারিয়ে যায়। অন্যের ফোন দিয়ে সে খবর জানানো হলেও বাকিসব তখন ওনাকে বলা হয়নি। কালকেই বাড়ি এসেছেন, আমরা কালকেই জেনেছি।”

আনন্দির বাবা-মা আর কিছু বলার মতো পেলেন না। আনন্দিও নিজের জায়গায় থম মেরে বসে আছে। উজানের বাবা ইতিউতি করলে বললেন,

” বউমা, আমি জানতাম না এতোকিছু হয়ে যাবে। ওখানে যে দিদিরও টাকা ছিল জানা ছিল না আমার। তুমি আর রাগ করে থেকো না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। সংসারে ঝগড়া-ঝামেলা হয়, এতোকিছু মনে রেখে সংসার করার যায় না। যা হয়েছে ভুলে যাও। বাবার বাসায় ঘুরে এসেছ, ভালো কথা। এখন সব ভুলে আবারো সংসারে মন দাও। তোমার বাবা-মাও এসেছেন আজ। তোমার শাশুড়ীর সাথে মিলে ভালো রেখে রান্না করো আজ। সবাই যেহেতু আছে, একসাথে খেয়ে যাক সবাই।”

আনন্দির মনে হলো তার শশুড় একপ্রকার দায়সারা উওর দিয়ে বিষয়টা শেষ করতে চাইছেন।

আনন্দির বাবাই বিপরীতে বললেন,

” বেয়াই আপনার কথা মানলাম। কিন্তু আমার মেয়েটার সাথে যে এতো এতো বৈষম্য হলো তার কি হবে? আপনার হয়ত মেয়ে নেই, আমার মেয়েটাকেও হয়ত আপনারা শুধু বউয়ের নজরেই দেখে গেলেন কিন্তু বেয়াই মেয়েটাতো আমার রক্তের৷ তাকে তো আমি এভাবে হেলাফেলায় রাখতে পারিনা। তাকে অট্টালিকায় রাখতে না পারলেও কষ্টে রাখিনি, তার প্রয়োজনের সব তাকে সময় মতো দিয়েছি। আমার এতো আদর যত্নে বড় করা একমাত্র মেয়েকে এভাবে তো দেখতে পারিনা।”

” কী বলতো চাইছেন আপনি?” পুষ্প দেবী ক্ষেপলেন যেন৷ আনন্দির মা বললেন,

” দাদা আপনাদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসবে এটাই স্বাভাবিক। তারা আমার মেয়েরও আত্নীয়। কিন্তু আত্মীয় যদি পরিবারের মধ্যে বেশি হস্তক্ষেপ করে, সংসারে যদি অন্যের প্রাধান্য বেশি থাকে তবে তা কখনোই মঙ্গলজনক হয় না। আর জামাই তুমি তো বলেছিলে বিয়ের পর আনন্দিকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে। তাহলে অর্ধেক বছর পেরিয়ে গেলও কেন নাওনি? তোমার মাঝে তো আমি এই বিষয়ে কোন তাড়াই দেখলাম না। স্ত্রী হয় স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী। বিয়ের পর যদি তাকে নিজের কাছেই রাখতে না পারো, পরনারীর মতো দূরে ফেলে রাখো তাহলে বিয়েই কেন করলে? শুধুই তোমার পরিবারের মানুষদের অবদার পূরণ করার জন্য?”

” দেখুন বেয়াইন যা হয়েছে তা ভুলে গেলেও সব সমস্যার সমাধান হবে না। জামাইবাবা আমার মেয়েটাকে আমি তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছে। সংসার সে তোমার সাথে করার জন্য এই বাড়িতে এসেছে৷ যেখানে স্বামী’ই নেই সেটা আবার কিরকম সংসার। শুনতে হয়ত খারাপ লাগবে কিন্তু মেয়েটাকে আমি তোমার পরিবারের অবদার পূরণ করার জন্য পাঠাইনি৷ হ্যাঁ এখন এটাও তার একটা পরিবার, সে হয়ত খুশী মনে সব করার চেষ্টা করছে কিন্তু স্বামী ছাড়া এটা কি ধরণের সংসার? তুমি যদি তোমার স্ত্রীকে তার স্ত্রী হওয়ার মর্যাদাটাই দিতে না পারো তবে বিয়েটাই কেন করেছ? তোমার পরিবারের শখ, অবদার পূরণ করার জন্য?”

” বেয়াই আপনি কি কোনভাবে আমার ছেলের কান ভরছেন না তো?” শর্মিলা দেবী বললেন।

” আমার স্বামী কান ভরছেন না বেয়াইন। তিনি তো ঠিক কথাই বলেছেন। আপনার ছেলে যদি সংসারই না করে, স্বামী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন না করে তাহলে তো হবে না। আমাদের মেয়েকে তো আমরা এভাবে হেলাফেলায় রাখতে পারিনা। বিয়ের আগে তো সেই বলেছিল অফিস যেখানে সেখানেই নিয়ে যাবে, চিন্তার কোন বিষয় নেই। কিন্তু হলোটা কি? দিনের বেশিরভাগ সময়ই তো সে নাকি ব্যস্ত থাকে। এটা কোন সংসার?”

আনন্দি এবার মুখ খুলল।

” উজান আজ যদি সবকিছুর সমাধান না হয় তবে এই সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে মোটেও সম্ভব না। তোমাকে আজ তোমার সব আচরণের উপযুক্ত কারণ বলতেই হবে। আজ একটা ফয়সাল হতেই হবে। যদি তুমি পূর্বের মতো হওয়ায় ভেসে থাকা জবাব দাও তবে আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকব।”

গম্ভীর কন্ঠে জানাল আনন্দি। উপস্থিত সকলে যেন বিচলিত হয়ে পড়ল। সবার মাঝেই চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

চলবে……