#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২৭
#অনন্যা_অসমি
” উজান আজ যদি সবকিছুর সমাধান না হয় তবে এই সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে মোটেও সম্ভব না। তোমাকে আজ তোমার সব আচরণের উপযুক্ত কারণ বলতেই হবে। আজ একটা ফয়সাল হতেই হবে। যদি তুমি পূর্বের মতো হওয়ায় ভেসে থাকা জবাব দাও তবে আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকব।”
গম্ভীর কন্ঠে জানাল আনন্দি। উপস্থিত সকলে যেন বিচলিত হয়ে পড়ল। সবার মাঝেই চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।
উজান ঢোক গিলে নিজেকে প্রস্তুত করল যেন।
” আনন্দি তুমি হয়ত খেয়াল করেছ বাবা বেশিরভাগ সময়ই বাসায় থাকেন না। উদয়ও অনেক সময় হোস্টেলেই থাকে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়ির পরিবেশ এরকম ছিল না। তুমি তো পিসিকে অনেক সময়ই তাদের বাড়ির বিভিন্ন নিয়মের কথা বলতে শুনেছ৷ পিসি ছিলেন ওনাদের ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এরপর ওনার ৪ ভাই, যার মধ্যে আমার বাবাই সবচেয়ে বড়। আমি বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই সকলকে একসাথে থাকতে দেখেছি। সেই বাড়ির কর্তী ছিলেন আমার ঠাকু’মা। উদয় হওয়ার কয়েকমাস পর তিনি মা’রা যান। আমি তখন হয়ত চার-পাঁচ বছরের। মা ছোট উদয়কে আমার কাছে আমাত রেখে সকল কাজ সামলেছিল। ছোট আমিটার অবুঝপনার কারণে সামলাতে না পেরে তাকে কোল থেকে ফেলে দেই৷ তার কপাল ফুলে ঢোল হয়ে যায়। সেদিন কি মার’টাই না মে’রেছিল মা আমাকে। খুব কান্না করেছিলাম সেদিন, তবে বাইরের চিৎকার চেঁচামেচিতে কান্না বন্ধ হতে বাধ্য হলো৷ ছোট বয়স থেকেই ঝগড়া-ঝামেলায় বেড়ে উঠা আমি সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চাইতাম। এই ঝগড়া-ঝামেলার কারণে আমাদের বাড়িতে যে কত বড় বড় ঘটনা ঘটে গিয়েছিল তা ভাবলে এখনো রু কেঁপে উঠে যেন।”
” উজান এসব পুরোনো কথা এখন বলছিস কেন?”
” মা আমাকে আজ বাঁধা দিও না। ছোট থেকে এসব কথা নিজের মধ্যে রাখতে রাখতে দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ আজ যখন সুযোগ পেয়েছি তখন নিজের কষ্টগুলোকে তোমাদের সামনে রাখতে চাই।”
আনন্দির দিকে তাকাল উজান।
” আমি তোমাকে কখনোই খোঁটা দেয়নি আর সামনেও দেব না৷ আমাদের সেই বড় পরিবারের বেশির ভাগটাই চলত আমার বাবার স্বল্প আয়ে। দেখতাম তিনি বেতনের সেই টাকা মায়ের হাতে দিয়ে চিন্তামুক্ত থাকতেন। তবে মায়ের মুখের চিন্তার ছাপ আর কারো নজরে না এলেও আমার চোখে ঠিকই পড়ল, বিশেষ করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা যেন আরো পীড়া দিত। তখন আমি ক্লাস টুতে, উদয় হাঁটতে শিখেছে তখন। আমার সবচেয়ে ছোট কাকা তখনো অবিবাহিত, চাকরি হয়নি। একদিন তিনি বিয়ে করবেন বলে জেদ করলেন কারণ তার পছন্দের পাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে৷ অনেক ঝামেলা হলো সে সময়, ঘরদোর তোলপাড় হলো। অবশেষে বিয়ে ঠিক হলো, বেশ ব্যস্ততায় সকল ব্যবস্থা হলো৷ বিয়ের প্রায় খরচটাই বাবার কাঁধে পড়ল। মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম বাবার দেনাও নাকি অনেক হয়েছিল।”
” হ্যাঁরে উজান পিঠ পিছে তোর মা তোকে এসব শেখাত? আমাদের নিয়ে তোর মনে বি’ষ ভরেছে দেখি তোর মা।”
শর্মিলা দেবী বলার মতো কিছু পেল না। উজানের বাবা গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
” দুইযুগ আগের কথা এখন বলছ কেন? আর দেনা হলেও আমার ভাইয়ের বিয়েতে হয়েছে। সেই দেনাও পরিশোধ করেছি আমি। এসব নিয়ে তো তোমাদের মাথাব্যথার কারণ দেখছিনা উজান।”
উজান যেন বিদ্রুপ করে হাসল৷
” হ্যাঁ বাবা ঠিকই বলেছেন৷ সেই দেনা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। আমার এখনো মনে আছে বাড়ির শেষ বিয়ে বলে বেশ বড় করেই আয়োজন হয়েছিল। আপনি সবাইকে হাজার হাজার টাকার শপিং করে দিয়েছিলেন। হরেক পদের খাবারেরও আয়োজন হয়েছিল, বিয়ের আগে থেকেই বাড়িতে হইহই রব। সকলে বেশ খুশি। তবে এতো হইচই, খুশীর মাঝে আপনি আমাদের খেয়াল করার সময়ই পেলেন না। আপনি প্রতিবারের মতোন দায়সারা ভাবে মায়ের হাতে কিছু টাকা দিলেন৷ মাকে ফিসফিস করে বলেছিলেন এখন অনেক খরচ, হাতে টাকা নেই। বাকিদের তো উনি তা বলতে পারবেন না, তাই আমরাই যেন মানিয়েনি। মানিয়ে নিয়েছিলাম আমরা, আমাদের মা। সেই টাকা দিয়ে আমার আর উদয়ের জন্য কম দামের দু’টো পাঞ্জাবি কেনা হয়েছিল আর মা কিনেছিল একটা পাতলা চেইন। বিয়ের বাড়ির বাকি বাচ্চারা বাহারি রকমের পোশাকে ছিল, সেখানে আমাদের বেমানানই লাগছিল। তবে মন খারাপ হয়নি, কারণটা যে জানা ছিল৷ তবে ছোট আমিটার সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল আমার মায়ের জন্য। তার আশেপাশে সকলে নতুন কাপড় পড়ে হাসি-মজা করছে অপরদিকে মা পুরোনো শাড়িতে হাসিমুখে বিয়ের সকল কাজ করছিলেন।”
” তো বাড়ির বড় বউ বাড়ির কাজ করবে না? এটা তো তার দায়িত্ব৷ বড় বউ তুমি তোমার ছেলেকে দেখছি কানপড়া দিতে বাকি রাখনি।”
” পিসি জ্ঞান বুদ্ধি থাকলে কাউকে কান পড়া দিতে হয়না। আর দায়িত্ব শুধু মায়ের বেলায় কেন? তিনি বাড়ির বড় বউ বলে? আপনিও তো বাড়ির বড় মেয়ে ছিলেন, আপনাকে তো সেই সময় হুকুম জারি করা ছাড়া কিছুই করতে দেখিনি।”
” উজান দিদির সাথে ঠিক করে কথা বলো।”
” বাবা এখন পর্যন্ত অনেক শান্তই আছি আমি।” তার ধমকের স্বরে কথা শুনে উজানের বাবা যেন থমকে গেলেন।
” বিয়ের কয়েকমাস পর পর্যন্ত ছোট কাকা এবং কাকী আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। এরপর অজানা কারণে বাড়ির সকলে আলাদা হয়ে গেল। আলাদা হওয়ার পর মায়ের মুখে যেন আমি আলাদা একটা প্রশান্তি দেখেছিলাম তবে তার কারণ তখন বুঝতে পারিনি। তবে পরে আমাদের দুইভাইকে নিয়েও একা ভালোই হিমশিম খেল। এভাবেই আমাদের ছোট সংসার চলছিল। বাবা নিজের কাজে, নিজের মতো ব্যস্ত থাকতো আর মা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে। একবার বাবা পিসির জন্য অনেক সিজেনাল ফল এনেছিল। পিসি সেবার ফলগুলো নেওয়ার আগে বাবাকে বলেছি তিনি বাকি ভাইদের ছাড়া একা কিছুই নেবেন না। এরপর থেকেই বাবা যায় আনতো ওনার সকল ভাই-বোন, এমনও হয়েছে আমাদের সামনেই বাবা বাহারী জিনিস ওনাদের দিত। আমরা দুই ভাই অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকতাম। এমনও হয়েছে আমি মাকে লুকিয়ে কান্না করতে দেখেছিলাম।”
” জামাইবাবা তোমার পারিবারিক ব্যপার তুমি এসব আমাদের এভাবে বলছ কেন?” বেশ ইতস্তত হয়ে আনন্দির বাবা বলল।
” ছোট থেকে ভিন্ন পারিবারিক ঘটনা দেখে আমি চেষ্টা করেছি যেসব কারণে আমার মা কষ্ট পেয়েছে সেসব যেন আমি এড়িয়ে চলি। মা তার সংসার জীবনে যা পাইনি তা যেন ওনাকে দিতে পারি। আমার সংসারে আমি মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতে পারি।” একটু থেমে আবারো সে বলল, ” বাবা ওনার পরিবারের লোকদের জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে দিতেন, তা ভালো। তবে বাবা ভুলে যেতেন মায়েরও একটা পরিবার আছে। বাবা হাত ভরে ওনার ভাইদের বিভিন্ন জিনিস দিতেন কিন্তু মা কখনোই নিজের পরিবারকে কিছু দিতে পারতেন না৷ এই নিয়ে মা আজো কষ্টে থাকেন। মায়ের সেই পরিস্থিতি থেকে আমি সবসময় চেষ্টা করেছি তুমিও যেন সেই কষ্টে না থাকো। আমি কখনোই চাইনি তুমি তোমার বাবা-মাকে অবহেলা করার কারণে আমার পরিবারের কারো উপর রাগ পুষে রাখো, তাদের প্রতি তোমার যেন অবহেলা তৈরি না হয় তাই আমি তোমার বাবা-মাকেও সমান চোখে দেখতাম।”
উজান মায়ের ভাঁজ হওয়া কপালটা খেয়াল করল।
” আমি জানি আনন্দি তোমাকে আমার সাথে না নেওয়ার জন্য তুমি রাগ করেছ, স্বাভাবিক। তবে আমি যেই পরিবেশ থাকি সেই পরিবেশ আমি তোমাকে রাখতে চাইনি। তুমি কিছু মনে করো না, আমি খোঁটা দিচ্ছি না। কথা যখন উঠেছে তাহলে সবটাই বলা শ্রেয়। বাড়িতে টাকা দিয়ে, তোমার বাড়িতে টাকা দিয়ে, মাঝেমধ্যে উদয়ের টিউশন ফি, তোমার ফি, ওখানে আমার যাবতীয় খরচ সব মিলিয়ে মাস শেষে আমারো বাবার মতোন অবস্থা। বেশিরভাগ সময় রান্না করি না আমি বা দুই-তিন দিন একই তরকারি দিয়ে চলে যায় আমার। আমার ওই দুই কামড়ার বাড়িতে আমি তোমাকে নিয়ে কষ্টে রাখতে চাইনি আনন্দি।”
আনন্দি যেন অবাক হয়ে গেল। সে কিছু বলবে তার আগেই উজান বলল, ” আমি জানি তোমাকে বললেও তুমি হাসিখুশি আমার সাথে থাকতে কিন্তু আমি একজন আর্দশ স্বামী হতে চেয়েছিলাম। আমি একটা ভালো পরিবেশে তোমাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছি। আমার এতো এতো ব্যস্ততা, তোমাকে সময় না দেওয়া নিয়ে তুমি ক্ষুব্ধ আমি জানি, আমাকে নিয়ে তোমার মনে সংশয় জেগেছিল তাও আমি জানি। তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি প্রায় সময় এক্সট্রা ডিউটি করতাম, এখনো করি। আমি বেশি বেশি প্রজেক্টে কাজ করতাম যেন মাস শেষে কিছু বাড়তি টাকা আয় করতে পারি। আমার মাথা সবসময় একটা সুন্দর ভবিষ্যতের চিত্র ভাসতো, যার জন্য ভালো আয় প্রয়োজন। আমি তোমাদের কাউকে দোষ দিচ্ছিনা। দোষ তোমাদের না, আমি ভয় পেতাম। ভয় পেতাম আমার কোন কাজে কেউ মন খারাপ করল, সংসারে অশান্তি হলো, কারো সম্মান ক্ষয় হলো। আমি সবাইকে তার প্রাপ্য সম্মানটা দিতে চাইতাম।” চোখ বন্ধ করে গড়িয়ে জমে থাকা চোখের জল আটকে রাখল উজান। আনন্দির চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এসব কি বলছে উজান!
বড় একটা নিঃশ্বাস নিল উজান।
” আমি ভেবেছিলাম হয়ত আমি বাবার চেয়ে ভিন্ন হতে পারব। কিন্তু না… আমি ভুল ছিল। নিজের অজান্তেই আমি বাবার পথে হাঁটছিলাম। মায়ের কষ্ট হবে ভেবে ওনার কাজে খুবই কম বাঁধা দিতাম, আমি চাইনি এই বয়সে এসেও মা হিনম্মতায় থাকুক। সবসময় মাকে ভালো রাখতে চাইতাম। তা করতে গিয়েছে যে আমি নিজের স্ত্রীকে অবহেলা করছি সেটা আমি টের পাইনি কিংবা অনুভবই করতে ব্যর্থ হয়েছি।”
সে আবারো বলল, ” রির্টায়ারের পরেও বাবা ঠিক আগের মতোনই রয়ে গেলেন। নিজের মতোন, এই সময়ে এসেও ওনার কাছে পরিবারকে দেওয়ার মতো সময় হয় না। বাড়িতে উনার উপস্থিত এখন যেন অমাবস্যার চাঁদের মতোন। আমি মাকে একা করতে চাইনি। আমি চাইনি একা থেকে মায়ের মানসিক পরিস্থিতিতে চাপ সৃষ্টি হোক। তাই অনেক সময়ই মায়ের অনেক কথায় চুপচাপ মেনে নিয়েছি।”
একটু থেমে উজান এবার চোখ তুলে তাকাল।
” কিন্তু এখন অনেক হয়েছে আর নয়। আমি কাউকে দোষ দেব না। একজন স্বামী এবং সন্তান হিসেবে আমিই ব্যর্থ হয়েছে সংসারে সবাইকে প্রাধান্য দিতে, নিজেদের প্রাপ্য সম্মান দিতে। তাই এবার আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
রুমে একটা চাপা উত্তেজনা চেয়ে গেল। সবাই উজানের পরবর্তী কথার অপেক্ষা করতে লাগল।
” মা, আমি আনন্দিকে নিজের সাথেই নিয়ে যাব।”
তার একটা কথায় যেন পুরো পরিবেশ পাল্টে দিল। পুষ্প পিসি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন,
” এতো কাহিনী না করে প্রথমেই বলতে পারতি বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবি। মাঝে আমার ভাইদের দোষারোপ করলি কেন? বোঝো এখন ছেলেকে মাথায় তোলার ফল। আমার মায়ের শাসনে কেউ আলাদা হওয়ার সাহস করেনি।”
” কোন কথা বলতে সাহস পাইনি বলে আমার মায়ের সংসার জীবনটা এতোটা বিভীষিকাময় ছিল। আমি আমার স্ত্রীকে সেই পরিস্থিতিতে রাখতে চাইনা।”
” উজান! তুই সত্যিই বাড়ি ছেড়ে যাবি? আমি কি খুব খারাপ?”
” না মা,তুমি কখনোই খারাপ ছিলে না। কিন্তু আমাদের চারিপাশে পরিবেশ, তোমার সাথে হওয়া ঘটনাগুলো তুমি নিজের অজান্তেই তোমার কাজকর্মে ফুটিয়ে তোল। আমি কোন কালকেই তোমাকে দোষী করিনি আর করবও না। কিন্তু মা আমি আনন্দিকেও কষ্ট পেতে দিতে পারি না। সে আমার স্ত্রী। আমার দায়িত্ব তাকে আগলে রাখা, তার ভরসার জায়গা হওয়া। নাকি সংশয়ের।”
শর্মিলা দেবী এবার হাউমাউ করে কান্না করে উঠলেন। আনন্দির বাবা-মাও বুঝলেন না কি বলবেন তারা। আনন্দিও যেন দ্বিধায় পড়ে গেল। কি করবে সে? একজন মায়ের থেকে তার সন্তান আলাদা করে দেবে নাকি নিজের সুখের কথা আগে চিন্তা করবে? স্বার্থপর হবে নাকি মানিয়ে নেবে?
.
.
.
.
.
.
আনন্দি তাড়াহুড়ো করে রান্না শেষ করে উজানের জন্য লাঞ্চ প্যাক করল। উজান তৈরি হয়ে সোফা বসে মোজা পড়ছে।
” কী হলো, হয়েছে তোমার?”
” এইতো শেষ।” বলতে বলতে লাঞ্চ বক্স ব্যাগে ঢুকিয়ে উজানের সামনে রাখলাম।
” তোমাকে কতবার বলেছি আজ না-হয় বাইরে থেকে খেয়ে নেব। তুমি আরেকটু বিশ্রাম নাও।দেখো তো, সকাল সকাল দৌড়ঝাঁপ করে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছ।”
” আর কী বিশ্রাম নেব। অলরেডি দেরি হয়ে গিয়েছে, কালকের কয়েকটা জিনিস তৈরি করা না থাকলে আজ তোমাকে লাঞ্চও দিতে পারতাম না। ওসব রান্না করলে একটু আকটু হয়। এখন তুমি তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে যাও, দেরি হয়ে যাবে।”
উজান দ্রুত নাস্তা করে, ব্যাগপত্র গুছিয়ে অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে প্রতিদিনের মতো নিয়ম করর আনন্দির কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিতে ভুলল না।
উজান বেরিয়ে যাওয়ার পর ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সোফায় বসল আনন্দি। আপাতত পরবর্তী কোন কাজ করা প্রয়োজন তাই ভাবছে সে।
ফোনের শব্দে মনোযোগ ভাঙন তার। সোফায় পড়ে থাকা ফোনটা উঠিয়ে রিসিভ করল।
” কেমন আছেন মা?”
” বেশ ভালো। তোমাদের কি খবর? উজান কোথায়?”
” আপনার ছেলে কিছুক্ষণ আগেই অফিসের জন্য বেরিয়েছে। আপনাদের ট্যুর কেমন যাচ্ছে?”
” অনেক ভালো। শ্রীমঙ্গলের ঠান্ডা হওয়া, হালকা বৃষ্টি, এখানের পরিবেশ সব যেন মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতোন পরিবেশ। পরিবেশ, প্রকৃতি এতো সুন্দর বলেই না তোমার শশুড় ট্যুরে যাওয়ার জন্য এতো উতলা থাকে।”
” যাক। আপনার ভালো লেগেছে শুনে শান্তি পেলাম৷ এতো দূরের পথ জেনে তো প্রথমে আপনি যেতে রাজিই ছিলেন না।”
” ভাগ্যিস এসেছিলাম, না হলে এতো সুন্দর দৃশ্য কখনোই দেখার সুযোগ হতো না। পরেরবার তোমাদের সাথে নিয়ে আসব।”
আরো কিছুসময় কথা বলল তারা। কথা শেষে আনন্দি স্বস্তির শ্বাস নিল। গ্যালারি থেকে একটা পরিবারিক গ্রুপ ছবি বের করল।
সেইদিনের পর আনন্দি আসলেই সে বাড়িতে থাকেনি। উজান ওইবাড়িতে যাওয়ার আগেই এদিকে সব ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। আনন্দি আসার জন্য শুধু নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসই নিয়ে এ বাড়িতে চলে এসেছে। শর্মিলা দেবীর প্রথম কয়েকমাস বেশ হাউমাউ করেছিলেন৷ তবে এই সময়ে সব ঠিক আছে। সবাই নিজের জায়গায় খুশী। উজান এবং আনন্দি এখন একসাথে উজানের অফিসের কাছে থাকে। উজানের মা এখন আর আলাদা হওয়া নিয়ে কোন কথায় বলেন না। বরং এখন তিনি নিজের অবস্থান নিয়ে ভালোই খুশী। আগে শুধু উজানের বাবা ট্রিপে যেত। এখন প্রায় ট্রিপে দু’জনেই একসাথে যায়, একসাথে ঘুরে ফিরে তাদের সময় এনজয় করে৷ উদয় বাসা-হোস্টেল দুই জায়গায় মিলিয়ে থাকে।
আনন্দি ছবির দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল। সে জানে না এটা ঠিক না ভুল, তবে আলাদা হয়ে সে নিজের একটা সংসার পেয়েছে, সেই সংসারে সম্মানও পাচ্ছে। হয়ত সে নিজের শাশুড়ীকেও সংসারে তার সম্মানটা পেতে একটু সাহায্য করেছে। সে জানে না পরবর্তীতে কি হবে তবে এখন তারা সকলেই নিজ নিজ অবস্থানে সুখী আছে। সবাই সবার সংসারে সম্মান নিয়ে সংসার করছে।
_______________ সমাপ্ত _______________