#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)
পর্ব→১৯
হঠাৎ বিকেল বেলায় কিছু মানুষের আগমনে শিকদার বাড়ির বাকি সবাই বাদে শুধু আনায়াই যেন প্রচন্ড সারপ্রাইজড হয়ে গেলো।
রাত জেগে রেহানের সাথে সময় পার করে দেরীতে ঘুমিয়ে আজ সকালে দেরীতেই জেগেছে আনায়া। তবে এতোদিনের মনমরা মেজাজ হুট করেই গায়েব হয়ে গিয়েছে। যে কারণে সকাল সকাল একদম ফ্রেশ মনে নিচে নিচে নেমে দেখে ফরিদা আর তার বোন মিলে বিশাল এক তোড়জোড় শুরু করেছে।
হঠাৎ এমন আয়োজনের কারণ খুঁজে না পেয়ে আনায়া অনেকটাই অবাক হয়ে ফরিদা আর ইনায়াকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় আজ নাকি কোন অতিথি আসবে। সঙ্গে আজ দিনটাও অনেক বিশেষ।
কিন্তু আনায়া এই বিশেষ দিন আর অতিথির বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারলো না।তাদের আত্মীয় বলতে তো সে কাউকেই চেনে না।আদোও কেউ আছে কিনা সেটাও তো জানা নেই।
আনায়া এই নিয়ে ফরিদা আর ইনায়াকে অনেক জোড়াজুড়ি করলে তারা শুধু এতটুকু জানায় যে, বিশেষ দিনটা তার জন্যই সঙ্গে এসব নাকি রেহানের কথামতোই হচ্ছে।
আনায়া খেয়াল করে দেখলো,রাতে রেহান একবার তাকে বলেছিলো যে আজ নাকি সে কোনো বড় সারপ্রাইজ পেতে চলেছে। কিন্তু সেটা আসলে কি তা আন্দাজ করতে পারলো না। পরক্ষণে এসবকে রেহান আর তার পরিবারের পাগলামি ছাড়া তার কাছে কিছুই মনে হলো না।
আনায়া আর বেশি কিছু না বলে উল্টো তাদের সাথেই কাজে হাত বাড়িয়ে দিলো।
____________
বিকেলের দিকে আনায়াকে জোর করে বেবি পিংক কালার আর হালকা সোনালী সুতোয় কাজ করা একটা শাড়ি পড়িয়ে সঙ্গে কিছু প্রসাধনী লাগিয়ে একদম ফিটফাট করে সাজিয়ে দিয়েছে ফরিদা আর ইনায়া। ওরাও আবার কি কমতি রাখবে। সেজন্য ফরিদা সেভাবে কিছু না করলেও ইনায়া একদম সেজেগুজে ফিটফাট। মনে হচ্ছে তার ঈদ লেগে গিয়েছে।
এদিকে আনায়া আন্দাজ করতে পারছে না রেহান আদোও ঠিক কি করতে চাইছে। তবে যখন বিকেলের দিকে রেহান ওর পুরো ফ্যামিলি নিয়ে শিকদার বাড়িতে হাজির হলো, তখনই আনায়ার মাঝে সম্পূর্ণ বিস্ময়ের জোয়ার বসে গেলো।
সবার এতো হাসিখুশি চেহারার মাঝে আনায়া পুরো বিস্মত চেহারা নিয়ে সবাইকে দেখছে। এদিকে রেহান তার শাড়ির কালারে মতোই একদম হালকা বেবি পিংক কালারের মধ্যে হালকা সোনালী কারুকাজ করা পাঞ্জাবি পড়ে হাজির। চোখেমুখে অমায়িক মুচকি হাসি। সে হাসি যেন আনায়াকে বারবার আড় চোখে তাকিয়ে দেখে আরো বিস্তৃত হচ্ছে।
রেহানের সাথে তার মা, বাবা সঙ্গে তার ভাই রোহান আর ইমনও সেজেগুজে চলে এসেছে। রেহানের মা বাদে সবাই খুব হাসিখুশি প্রকৃতির । তার মানে এই না যে রেহানের মা শিউলি বেগম খুব রূঢ় প্রকৃতির মানুষ। সে এমনিতে খুব স্বাভাবিক আর নরম স্বভাবের মানুষ হলেও তার জীবনের সবটুকুই যেন তার পরিবার। বিশেষকরে ছেলেদের নিয়েই তার যত সব চিন্তা ভাবনা। ছেলেদের প্রতি তার আবেগ, স্নেহ এতোটাই প্রবল যে সামান্য অসুখ কিংবা দূর্ঘটনাতেও সে প্রচন্ড রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার দিনদুনিয়া যেন ঘুরে যায়। আর সে কারণেই মা হয়েও নিজের ছেলের এক্সিডেন্টের খবরটাও সে পায়নি।
এক্সিডেন্টের কারণে রেহানের কপালের উপরের অংশে অনেকটাই ক্ষ*ত সৃষ্টি হয়েছিলো যার দাগ এখনোই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু মায়ের নজর থেকে বাঁচতে তাকে নিজের বড় বড় চুল গুলো দিয়ে সেই স্থান ঢেকে রেখেছে। কিন্তু কখন যে সেটা তার মায়ের নজরে পরে যায়, সেই ভয়েই আছে রেহান।
অন্যদিকে তার বাবা রিফাত আহমেদ হাসিখুশি প্রকৃতির। তার জীবনে প্যারা বলতে মনে হয় কিছুই নেই। সবসময় হাসিখুশিতেই তার দিন যায়।
ফরিদা প্রথমের সাবইকে দেখেই দ্রুত গতিতে গিয়ে তাদের সালাম দিয়ে সম্মানের সাথে ভেতরে আসতে বলে৷ অন্যদিকে আনায়াও বেশি দেরী হওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে গিয়ে সালাম জানায় সঙ্গে ইনায়াও বাদ যায় না।
সবাই গিয়ে সোফায় একসঙ্গে বসলে ফরিদা আনায়ার মাথায় ছোট করে ঘোমটা টানিয়ে সোফায় একপাশে বসিয়েই চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুইলচেয়ারে বসা তারেক শিকদারকে সবার মাঝে নিয়ে আসে।
আনায়ার একপাশে রেহান আর তার মা বসা। অন্যপাশে ইমন আর রোহান। এবং একদম মুখোমুখি বসা রেহানের বাবা। আনায়ার নজর প্রথমে গিয়ে সরাসরি রিফাত আহমেদের উপর পড়লো। লোকটির প্রফুল্ল মুখটাকে দেখে এটা বুঝতে বাকি নেই তিনি নিতান্তই অনেক বন্ধুসূলভ কিংবা হাসিখুশি প্রকৃতির।কিন্তু তার প্রশ্ন হচ্ছে এখানে হচ্ছেটা কি? সে আন্দাজ করছে এমনটা কি করে হয়। রেহান তো বলেছিলো তাদের রিলেশনের কথা বিয়ের আগেই তার পরিবারকে জানাবে তবে আজ সবাইকে নিয়ে এমন আয়োজন…
আনায়া একবার নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো তারেকের চোখে মুখে যেন খুশির জোয়ার বইছে। আনায়া মনে মনে ভাবছে কয়েকদিন ঘরবন্দী ছিলো তাতেই মনে হয় পুরো দুনিয়া ঘুরে গিয়েছে।
এরই মাঝে হুট করেই শিউলি বেগম আনায়াকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করলো। আনায়াও ধীরে ধীরে সেসব প্রশ্নের উওর দিতে লাগলো। শিউলি বেগম তাকে ঘরের কাজকর্মের পাশাপাশি পড়ালেখা, পরিবার নিয়েও অনেক কিছু গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করতে করতে একটা পর্যায়ে আনায়ার মাঝের মাধুর্যতায় সে প্রফুল্ল চিত্তে আনায়ার সাথে হাসিখুশি ভাবে কথা বলতে লাগলো। অন্যদিকে রেহানের বাবাও বা কম কিসে। আনায়াকে নিজের মেয়ে ভেবে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে সে পারলে আনায়াকে নিজের বান্ধবীই বানিয়ে ফেলে।
এদিকে রোহান যদিও কিছু বলতে পারছে না তবে সে আনায়া আর ইনায়া দুজনকেই দেখে যাচ্ছে।
আনায়ার সাথে কথাবার্তা শেষে ইনায়া আর ফরিদার সাথেও সৌজন্যে মূলক কথাবার্তা শেষে রিফাত আহমেদ হাসতে হাসতে তারেকের উদ্দেশ্যে বললো,
—“তো শিকদার সাহেব, আপনার মেয়েকে আমার মেয়ে বানানোর জন্য রাজি আছেন তো? না.. না..আপনার মেয়েকে কিন্তু একেবারে নিয়ে নেবো না।মেয়ে আপনারও থাকবে সাথে আমারও। আপনার দুইটা মেয়েই কিন্তু অনেক মিষ্টি। হিরের টুকরো পেয়েছেন আপনি।”
এই বলেই সে আবারও হাসতে লাগলো সঙ্গে তার এসব কথাবার্তা শুনে তারেকেও অমায়িক মুচকি হাসলো। আনায়া খেয়াল করে দেখলো তার বাবা প্রচন্ড খুশি। সাথে আশেপাশের সকলেই। আনায়ার বুঝতে বাকি রইলো না এই বিষয়ে সে বাদে বাকি সবাই আগে থেকেই এই বিষয়ে অবগত।
কিন্তু আনায়ার মনে তো চলছে অন্যসব প্রশ্ন। সবার এতো হাসিখুশির মাঝেও সে তার বাবা আর বোনের কথা ভেবে খুশি হতে পারছে না। এখন তার বিয়ে হয়ে গেলে পরিস্থিতি ঠিক কোথায় যাবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না।
আনায়া খুব করে চাইছে রেহানের সাথে আলাদা করে কথা বলতে। কিন্তু এতো মানুষের মাঝে কিভাবে কি সম্ভব। তার এই ইচ্ছে এই মূহুর্তে সবার মাঝে প্রকাশ করাটাই তো মস্ত বড় বোকামি। কিন্তু তাকে আর বেশিক্ষণ এই নিয়ে ভাবতে হলো না।
আনায়ার চেহারা, ভাবসাবে চিন্তার আভাস প্রথমে রেহানের সেভাবে নজরে না এলেও আনায়া যখন স্তব্ধ চোখে অনবরত ঠোঁট ভিজিয়ে বারবার রেহানকে দেখতে লাগলো তখন বিষয়টি রেহান ঠিকই আন্দাজ করে ফেললো। সেই মূহুর্তেই রেহান নিজের পাশে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো। তার মা এসব জিনিস এতো খোলামেলা পছন্দ করে না।অনেকটা ব্যাকডেটেট টাইপের তিনি।
তাই সরাসরি বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। এদিকে বিচক্ষণ মানুষ রিফাত আহমেদের আর বুঝতে বাকি রইলো না তার ছেলে কি চাইছে। তাই খানিকটা কেশে নিয়ে, গলা ঝেড়ে বললো,
—“আমরা বড়রা না হয় কথা বলতেই থাকবো। তার আগে ছেলে আর মেয়ে বরং আলাদা কথা বলে আসুক। বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ডিসিশনে ওদের আলাপ আলোচনাই তো আসল।”
তার এই কথাতে আর কেউ দ্বিমত পোষণ করলো না। সবার মতামতেই আনায়া আর রেহানকে আলাদা কথা বলার অনুমতি দেওয়া হলো। তখনই ফরিদা আনায়ার উদ্দেশ্য বললো,
—“আনায়া মা! রেহান বাবাকে তোর রুমটাতেই নিয়ে যা।”
এটা শুনতেই আনায়া ফরিদার দিকে করুন চোখে তাকালো। সারপ্রাইজ দিবে ঠিক আছে তবে এমন সারপ্রাইজ কে দেয়? এসব বিষয়ে তো আগাম প্রস্তুতি না নিলে হয় নাকি! আনায়ার ওমন চাহনিতে ফরিদাও চোখের ইশারায় বোঝালো যে, কোনো চিন্তা না করতে। সব কিছু স্বাভাবিক হচ্ছে আর হবে। আনায়াও ছোট করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রেহানকে ইশারায় তার রুমের দিকে যেতে বললো।
_________________
—“এসব কি রেহান? তুমি তো আমাকে কিছুই জানাও নি। আর তুমি……
বদ্ধ রুমে গম্ভীর মুখে বলতে থাকা আনায়ার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার আগেই রেহান মুচকি হেসে দুহাতে আনায়ার কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। এরপর ধীরগতিতে মুচকি হেসে বললো,
—“আবার কি হতে যাবে! নিজের অতিথি পাখিটাকে এবার সত্যিকারের বউ পাখি বানানোর সময় চলে এসেছে। যেন আমার অতিথি পাখিটা আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে না যায়।”
আনায়া বিস্ময় নিয়ে বললো,
—“কিন্তু তুমি তো বলেছিলে আমাদের…..
—“হ্যাঁ,আমি বলেছিলাম যে আমার তোমার ক্যারিয়ার ঠিকঠাক মতো না গড়ে ওঠা পর্যন্ত আমরা এমন কোনো ডিসিশনে যাবো না। তবে কতদিন আর এই হারাম কাজে পড়ে থাকবো। এরচেয়ে বিয়ে করে ফরজ কাজটা সেরে নিলেই হয় না! ”
—“তুমি তো ঠিকই বলছো কিন্তু এই মূহুর্তে এসব কিভাবে সম্ভব রেহান। একে তো তুমি আবারও আমেরিকায় ফিরে যাবে। আর এখন আমার দায়িত্বে শুধু আমার ফ্যামিলি কিন্তু বিয়ের পর তোমার ফ্যামিলিও তো আমার আরো এক নতুন ফ্যামিলি হবে তাই না? এই মূহুর্তে যা সিচুয়েশন তাতে বাবাকে ছেড়ে…. ইনায়া তো ছোট মানুষ। ওকে সব দায়িত্ব দিয়ে…. কিভাবে কি সম্ভব…. আমি বুঝতে পারছি না।”
আনায়ার এতো চিন্তিত হয়ে বলা কথাবার্তা শুনেও রেহান আবারও হেসে আনায়ার খোঁপা করা চুলের স্টাইলে, কপালে দিকে দুপাশে কিছু ছড়িয়ে দেওয়া চুল একহাতে কানের পিছনে ঠেলে দিতে দিতে বললো,
—“তোমাকে এতো কিছু ভাবতে কে বলেছে? তোমার প্রবলেমের সলিউশনের জন্য তো আমি আছি। আর তোমাকে কে বললো যে এখনি বিয়ে করে তোমায় সংসারী হতে হবে। তুমি যখন ফোন ধরছিলে না তখন আমি পুরো পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ইমন, রোহান আর ইনায়াকে তো আমি পুরো নাজেহাল করে তুলেছিলাম। কি করবো না করবো তাই বুঝতে পারছিলাম না। পরে অনেক হিসাবনিকাশ করে আমাদের বিয়ের ডিসিশন নিলাম।
আর এটাকে বাস্তবায়ন করতে ফোন লাগালাম বাবাকে। বাবাকে রাজি করাতে আমার বেশি কষ্ট হয়নি। সে তার ছেলের বিয়ের কথা শুনেই খুশিতে গদগদ। তবে চিন্তা ছিলো মাকে নিয়ে। কিন্তু আমার বলার পর বাকিটা বাবাই মাকে রাজি করিয়ে নিয়েছে। এরপর আমি এখানে আসার আগেই তারা সব প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে।
আর শুনো, তোমাকে বিয়ের পর একদম আমার বাড়িতে গিয়ে থেকে সংসারী হতে হবে এমন কিছু নয়। আমাদের শুধু বিয়েটাই হবে আর সপ্তাহ খানেক বাদে আবার আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছি।যাস্ট বিয়ের জন্যই আসা। আর আমার পড়াশোনা কিংবা আমাদের ক্যারিয়ার ঠিকঠাক না গড়ে ওঠা পর্যন্ত আমরা এখন যে যেমন আছি ঠিক সেভাবেই থাকবো। এমুহূর্তে বিয়ে করার কারণ হলো এই তুমিটাকে আমার পার্মানেন্ট বউ পাখি বানানো। সো, এতো প্যারা নেওয়ার কোনো কারণ নেই।”
রেহানের এতোসব কথা শুনে আনায়া আবারও বিস্মিত সুরে বললো,
—-“আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, কি হতে চলেছে!”
রেহান আনায়ার কপালে ছোট করে চুমু এঁকে বললো,
—“যা হবে ভালোই হবে, তুমি যাস্ট আমার উপর ভরসা রাখো।”
_________
রেহান আর আনায়া রুম থেকে আবারও সবার মাঝে ফিরতেই দেখতে পেলো সবাই বিয়ের আয়োজনের কথাবার্তা প্রায় শুরু করে দিয়েছে। আর আনায়কে দেখেই রিফাত আহমেদ আনায়া উদ্দেশ্যে বললো,
—“তো মা, বিয়েতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?”
আনায়া মাথা নিচু করে বসেই ছিলো হঠাৎ এহেন প্রশ্নে খানিকটা চমকে গিয়ে রিফাতের দিকে তাকিয়ে এরপর তার বাবা আর রেহানের দিকে তাকালো। তারা দুজনেই ইশারায় আনায়াকে আশ্বস্ত করতেই আনায়াও অস্ফুটস্বরে মাথা নাড়িয়ে বললো,
—“জ্বী, নাহ।”
তার এই কথাতেই সবার মাঝে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠলো। রিফাত আহমেদ গিয়ে তারেকের হাত ধরে তাকে কোলাকুলির উদ্দেশ্যে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো,
—“চিন্তা করবেন না। আমার আর আমার স্ত্রীর সবসময় একটা মেয়ের অভাব ছিলো। আশাকরি খুব শীঘ্রই তা পূরণ হয়ে যাবে। আপনার মেয়ে মানেই আমার মেয়ে। আর আপনার মেয়ে যদি হিরা হয় তবে আমার ছেলে কিন্তু প্লাটিনাম। দুজনের কম্বিনেশন কিন্তু সেই জমবে।”
একটা সময় সবার মাঝে নানা সৌজন্যে মূলক সংলাপ শেষে রেহানের বাবা আবারও বললো,
—“ছেলে তো আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে। সাত দিনের ছুটি নিয়েই বিয়ে করতে চলে এসেছে। প্রথমে তো ভেবেছিলাম শুধু পারিবারিক ভাবে বিয়ে পড়িয়ে রাখবো। কিন্তু পরে ভাবলাম, বড় ছেলের বিয়ে যখন, তখন তো ধুমধাম করে না হোক, তবে কিছুটা আয়োজন তো করতেই হবে।
পরেরবার না হয় একদম ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা যাবে। এখন বলুন, তারিখ কবে ঠিক করা যায়। যেহেতু সময় কম সেহেতু সব তাড়াতাড়িই করতে হবে।”
রিফাতের কথা শুনে তারেক তার আধভাঙ্গা ভাষায় কথা বলতে লাগলো। তার ভাষা যেহেতু তারা বুঝবে না সেজন্য ফরিদাই তারেকের কথা শুনে বললো,
—“আপনারা যেটা ঠিক মনে করেন। আমাদের মেয়ের যেহেতু কোনো আপত্তি নেই সেক্ষেত্রে আপনারা যখন বলবেন আমরা সেভাবেই আমরা আয়োজন শুরু করবো।”
রিফাত আহমেদ বললো,
—“আহা… আমাদের তো সবকিছু প্রস্তুতি নেওয়াই আছে। সেক্ষেত্রে আপনাদের কোনো কষ্ট করতে হবে না। যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে দুদিন পর ছোট করে একটা গায়ে হলুদ করে সেদিনই বিয়ের কাজ না হয় সেরে ফেলি। যদি আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকে। ”
—“না, না, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপনারা যা ঠিক মনে করেন তাই হবে। ”
—“ঠিক আছে, তাহলে কাল সারাদিন ধরে বিয়ের শপিং চলতে থাকবে আর পরদিন বিয়ে। বিয়ে যেহেতু পারিবারিক ভাবেই সেক্ষেত্রে আমাদের থেকে তেমন কোনো আত্নীয় নেই। তবে আপনারা যদি…
এবার ইনায়া ফট করে বলে ফেললো,
—“আমাদের তো আত্নীয়ই নেই। আর এই এলাকার লোকদের বিয়েতে ডাকার তো কোনো মানেই নেই। সবগুলোই বদলাক……সরি,ভুল করে বড়দের মাঝে বলে ফেলেছি।”
ইনায়ার হুট করে হুস হতেই দাঁত খিঁচে নিজের ভুলের জন্য মাফ চেয়ে চুপ হয়ে গেলো। তবে তার এমন কাজে রিফাত হেসে বললো,
—“হা হা, তুমি মনে হয় অনেক মজার মেয়ে। তোমাকেও আমার পছন্দ হয়েছে….তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমাকেউ কিন্তু আমার ছেলে……
রিফাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনায়া আঁতকে উঠে বিস্ফো*রিত সুরে বললো,
—“নাহ আঙ্কেল, আমি বিয়ে করবো না।”
ইনায়ার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো।
—“আরে আমি তো মজা করছিলাম, হা হা।”
ইনায়া ইতস্তত হয়ে বললো,
—“তাহলে ঠিক আছে।”
ওর এহেন হাবভাবে সবাই পুনোরায় হাসতে লাগলো এদিকে ইনায়া তব্দা খেয়ে সবাইকে দেখছে। সে এমন বললোইটা কি যাতে এভাবে হাসতে হবে। তবে রোহানকে আড়চোখে দেখে বিড়বিড় করে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“এই মৃগীকৃমির বডিগার্ড আর আমি? অসম্ভব!”
_______
সবার কথাবার্তা শেষে আনায়া আর রেহানের আংটিবদল হলো। এরপর হালকা কিছু নাস্তা আর গল্পগুজবের পর রেহানের পরিবার মিলে শিকদার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে নিলো। এরই মাঝে রোহান আর ইনায়ার এক কথার সংঘ/র্ষ সৃষ্টি হলো।
—“কি ইরাবতী বেয়াইন সাহেবা, খোঁজ খবর তো কিছুই নেন না।”
ইনায়া চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—“আমি বলেছিলাম, আমাকে এসব উল্টো পাল্টা নামে না ডাকতে।”
ইনায়ার কথা শুনে রোহান হেসে বললো,
—“আরে এসব বেয়াই বেয়াইনের মধ্যে হয়েই থাকে।”
—“ভালো কথা, তবে আমাদের এখনো এই সম্পর্ক হয়নি। আগে বিয়ে হোক, তারপর…
—“তুমি কি আমার সাথে কথা বলে বিরক্ত হচ্ছো?”
ইনায়া নির্বিকারে বললো,
—“হু…! ”
রোহান কিছুটা কেশে বললো,
—“এর কারণটা…?”
—“জানি না…?”
—“আচ্ছা তুমি সেদিন মিতুকে ওসব বললে কেনো। তুমি জানো এই নিয়ে ও আমাকে কত কথা শুনিয়েছে।”
এবার আনায়া বাঁকা হেসে বললো,
—“ওহ, এবার বুঝছি হঠাৎ এখানে টপকানোর মানে কি? আমি সোজাসাপটা উত্তর দিচ্ছি, আমার যেটা ঠিক মনে হয় আমি তাই করি, তাই বলি। কে কি ভাবলো কিংবা বললো তা আমার ভাবনার বিষয় না।”
—“তাই বলে তুমি আমার সামনে ওকে ওসব বলবে….!”
রোহানের ইনোসেন্ট মুখের কথা শুনে ইনায়া হেসে, বুকে হাত গুঁজে রোহানের দিকে কিছুটা মুখ বাড়িয়ে বললো,
—“কষ্ট পেলে সরি, বাট নট সরি। আমি সত্যি বলতে কখনো দ্বিধাবোধ করি না। এখন সত্যি যেমনটাই হোক, নিজের মনের বিরুদ্ধে যাওয়াটা আমার পছন্দ নয়। আমার মন যা চায়, আমি তাই করি।”
এই বলেই ইনায়া আর একমুহূর্তেও দেরী না করে তাচ্ছিল্যের সাথে হেঁসে চলে গেলো। ইনায়াকে ফাঁকা পেয়েই রোহান গিয়েছিলো কথা বলার জন্য আর বাকিটা ইনায়াই এভাবেই ধুয়ে দিয়েছে।
_________________
ইনায়া, আনায়া, রোহান, রেহান আর ইমন ;এই পাঁচজন মিলে একসাথে বিয়ের মার্কেট করতে বেড়িয়েছে। বিয়ের খরচ যেহেতু আনায়াদের পক্ষ থেকে দেওয়া সম্ভব নয় তাই সব আয়োজনই আহমেদ পরিবার থেকে হবে। আর রিফাত আহমেদ চায়ও না যে আনায়ারা এতে কোনো খরচ করুক। ওদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে রেহানের পরিবার ভালো করেই জানে আর এসব নিয়ে কোনো চাপ সৃষ্টি করার মতো লোক তারা নয়।
আনায়া, ইনায়া দুজনেই কালো রংএর লং কুর্তি পড়ে এসেছে। অন্যদিকে ছেলে তিনজন টিশার্ট, প্যান্ট পড়ে পুরো সেজেগুজে চলে এসেছে।
এদিকে আনায়া ইমনের সাথে চাকরি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলো পরবর্তীতে ভাবলো ওসবের আর প্রয়োজন নেই। আপাতত বিয়ের জন্য সেসব বন্ধ রাখাটাই ভালো। এই ভেবে আনায়া পুরো পরিবেশটাকেই স্বাভাবিক রেখেছে।
মোটামুটি সব কেনাকাটা শেষে এবার তোরজোর চলছে আনায়ার কেনাকাটার জন্য। খুব ভারী কাজে কিংবা জমকালো বিয়ের পোশাক হবে না৷ খুব স্বাভাবিক একটা লেহেঙ্গা। কিন্তু সেটাই কারো মনে ধরছে না। যদিও রেহানের মন আকুপাকু করছে নিজের আনায়াকে পুরো জমকালো সাজে দেখতে কিন্তু একটু বেশি খরচ করলেই আনায়া পুরো হামলে পড়বে তার উপর। এখানে আসার আগেই আনায়া রেহানকে অনেকটা শাসিয়ে জানিয়ে দিয়েছে।
বিয়ের ড্রেস লাল হতে হবে এটা পারিবারিক ভাবে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে জুতো সহ সকল জুয়েলারি কিংবা বরেরে ড্রেস সেই হিসেবেই নেওয়া হয়েছে। মাঝখান থেকে কনের ড্রেস খুঁজতেই সবাই আঁটকে গিয়েছে। আনায়া তো চাইছে এমনি একটা লাল রং-এর নিয়ে নিলেই হয় কিন্তু রেহান তাতে রাজি নয়।
কিন্তু এরই মাঝে তাদের সবার সাথে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। যাকে সর্বপ্রথম নজরে আসে ইনায়ার।
ইনায়া একাই গিয়ে পাশের একটা জুয়েলারি শপে নানা জিনিস ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। তখনই সেই শপেই তার নজর যায় কেনীথের মতো গায়ের গঠনের মাক্স আর কালো হুডি পড়া একজন লোককে। কোনো প্রকার নিশ্চিত না হয়েই ইনায়া ওকেই কেনীথ মনে করে ফেলে। আর তার ধারনাই ঠিক হয়। আনায়া ত্বরিত পিছন থেকে বললো,
—“ভিকে….! ”
তার কথা শুনে কেনীথ পিছনে ফিরে ইনায়াকে দেখলো। তবে কিছু বললো না। আর এদিকে ইনায়া আবারও অবাক সুরে বললো,
—“তুমি এখানে কিভাবে?”
কেনীথ ইনায়ার কাছে এসে বললো,
—“আস্তে বলো, কেউ বুঝে গেলে প্রবলেম হবে।”
ইনায়ার কথার উদ্দেশ্য বুঝতেই তড়িঘড়ি করে ফিসফিসিয়ে বললো,
—“হু, হু,সরি খেয়াল ছিলো না। কিন্তু তুমি এখানে কি করছো?”
কেনীথও ধীরে সুরে বললো,
—“কাজে এসেছিলাম তবে তুৃমি কি করে চিনলে আমায়? আর একাই এসেছো?”
ইনায়া কিঞ্চিৎ হেসে বললো,
—“হাহ, তোমাকে চিনবো না এটা কি করে হয়। আর আমি এখানে একা আসিনি। আপুর বিয়ের শপিং করতে এসেছি।”
—“তোমার আপু বলতে….
—“হ্যাঁ,হ্যাঁ, তোমার পিএ আনায়া। আচ্ছা তুমিও চলো না ওখানে।…. যদি তুমি কিছু না মনে করো…”
কেনীথ নির্বিকারে বললো,
—“চলো তবে।”
ইনায়া বিস্ফোরিত সুরে বললো,
—“সত্যি!, তুমি না অনেক ভালো।”
এই বলেই কেনীথকে নিয়ে ইনায়া আনায়াদের দিকে যেতে নিলো। ইনায়া সামনে আর কেনীথ পেছন পেছন পকেটে দু হাত গুঁজে ওকে অনুসরণ করে কালো মাক্সের আদলেই হেঁসে এগিয়ে যাচ্ছে।
_______________
হঠাৎ কালো মাক্স, হুডি, প্যান্ট পড়া লোকের পরিচয় জেনে সবাই চমকে গেলো। রেহান, রোহান, ইমন কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না এটা স্বয়ং ভিকে তাও আবার এই শপিং মলে। সত্যিই অনেক আশ্চর্যের বিষয়।তারা বাদে যেন অন্য কেউ জানতে না পারে তাই ইনায়া চুপ করেই শুধু ওদের কেনীথের কথা জানিয়েছে।
এদিকে সবার মাঝে কেনীথকে নিয়ে আগ্রহ, বিস্ময়, আন্দনের জোয়ার থাকলেও আনায়ার মাঝে চলছে অন্যকিছু। তার মাঝে বিস্ময় আর আ*তংক দুটোই কাজ করছে। এই মূহুর্তে সে কখনোই কেনীথকে আশা করেনি।
আনায়া চোখমুখ অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। এদিকে আবার রেহান কেনীথের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবেই পরিচত হওয়া পর বিয়ে নিয়েও নানা কথা বলতে লাগলো।
এদিকে আনায়া এই সময়টুকু পর্যন্ত নিরবে কেনীথের সবকিছু কপাল খানিকটা কুঁচকে দেখতে লাগলো। মূলত কেনীথের আসল হাবভাব বোঝাটাই তার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সে লক্ষ করে দেখলো কেনীথ একবারও আনায়ার দিকে ফিরেও তাকায়নি। সামান্য চোখাচোখি হওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি করেনি।
আনায়া প্রায় অনেকটাই অবাক হলো কেনীথের এমন হাবভাব দেখে। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সঙ্গে এমন একটা জায়গায় তার আগমনও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। কেনীথকে তার অনেকটা অসহ্যও লাগছে। তাই বিরক্ততে ইনায়াকে চুপ করে জানালো যে সে অন্য দোকান গুলোতে একবার ঘুরে দেখার বাহানায় ওখান থেকে সেরে এলো।
___________
আনায়া প্রায় কিছুক্ষণ ফিরে আসতেই দেখলো, কেনীথ নেই। সে চলে গিয়েছে জেনে যতটা না খুশি হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি বিস্মিত হলো অন্য এক ঘটনা জেনে। রেহান আনায়ার জন্য পুরো শপের সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ গাঢ় লাল আর জমকালো লেহেঙ্গা কিনে নিয়েছে। কিন্তু এটা জেনে যেই না রেহানের সাথে রাগারাগি করতে যাবে তখনই জানতে পারলো লেহেঙ্গাটা নাকি সে কেনীথ তার পক্ষ থেকে গিফট হিসেবে কিনে দিয়ে গিয়েছে। বলেছে তার পি.এ. হিসেবে সে এতোটুকু গিফট দিতেই পারে।
আনায়ার যেন বিস্ময় কাটছেই না। কিছুটা ঝাঁঝালো আর অবাক সুরে রেহানকে বললো,
—“সে দিলো আর তুমি নিয়ে নিলে?”
রেহান অপারগ মুখে বললো,
—“আমি কি করবো, সরাসরি লেহেঙ্গাটার পেমেন্ট করে, দিয়ে গিয়েছে। জোড়াজুড়ি তো আর কম করিনি কিন্তু লাভ কি হলো। তুমি থাকলেও তো একটা কথা ছিলো। কোথায় যে গায়েব হলে কে জানে।”
আনায়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। মনে মনে ভাবছে এই কেনীথ আদোও চায়টা কি? সে কোনো নতুন গেম খেলছে না তো! আনায়ার চিন্তায় চোখমুখ খানিকটা কুঁচকে গেলো। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়লো। তখনই কি যেন ভেবে সেলস্ মেনদের কাছে এক অদ্ভুত আবদার করতে লাগলো। সে তোরজোর লাগিয়ে অনুরোধ করলো যেন লেহেঙ্গাটা তারা ঘুরিয়ে নেয় আর লেহেঙ্গার জন্য যা পেমেন্ট করা হয়েছে তা যেন ভিকের নামে তার অফিসে পাঠিয়ে দেয়। এমনকি ভিকের অফিসের কার্ডও পর্যন্ত দিয়ে অনুরোধ করেও লাভ হলো না। তাদের একটাই কথা, তাদের শপের একবার পেমেন্ট হওয়া জিনিস কখনোই তারা রিটার্ন নেবে না। কেনার শুরুতেই সবকিছু দেখে নিতে হবে।
আনায়ার মাথাটা রাগে গিজগিজ করছে। ওই লোকটার জিনিস সে কখনোই নেবে না। কিন্তু এখন করবে কি! এদিকে রেহান সহ বাকিরা আনায়ার এতো বেশি রিয়েক্ট করার কারণ খুঁজে পেলো না। যেখানে ভিকের মতো কেউ তাদের এতোবড় গিফট দিয়েছে, সেট নিত্যান্তই অবিশ্বাস্য। তবে আনায়ার এতো রিয়েক্ট করা যেন আরে বেশি অবাক লাগছে সবার। একটা সময়ে রেহান এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে, আনায়া নিজেকে সামলে নেয়।
এরপর অবশ্য রেহান আনায়ার জন্য আলাদা করে কোনো বিয়ের ড্রেস না নিলেও হলুদের জন্য লেহেঙ্গা সঙ্গে আরে কিছু দামী শাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে নিজেরের গাড়ি করে রওনা দেয়। তবে এর মাঝে আরো এক খবর শুনে আবারও বিস্মিত হয় যখন রেহান তাকে বললো কেনীথকে তারা তাদের বিয়েতে ইনভাইট করেছে সঙ্গে কেনীথ নাকি এতে রাজিও হয়েছে। আর এটা শুনে আনায়া বিস্ফোরিত সুরে বললো,
—“কিহ…!”
আনায়াকে আবারও এতোটা অবাক হতে দেখে রেহান বললো,
—“কেনো, তুমি খুশি হওনি। লেহেঙ্গা না হয় বেশি এক্সপেন্সিভ তাতে রিয়েক্ট করছো কিন্তু ভিকে তো তোমার বস। সেক্ষেত্রে তার মতো মানুষ আমাদের বিয়েতে আসতে রাজি হয়েছে এটা অকল্পনীয় ব্যাপার। তোমার তো খুশি হওয়ার…আচ্ছা আনায়া, সত্যি করে বলো তো কোনো প্রবলেম…..
রেহানের এহেন কথার সুর দেখে আনায়া নিজেকে দ্রুত তটস্থ করে ইতস্ততভাবে বললো,
—“না,না, আমার কি সমস্যা থাকতে পারে। আমি বলছিলাম যে ওনার মতো এতো বড় মাপের মানুষ কিভাবে…..
এরই মাঝে গাড়ি চালাতে থাকা ইমন বললো,
—“আমিও তো এটাই ভাবছি। আজ পর্যন্ত যে ভিকের সাথে কাজ করলাম তাকে তো আমি চিনতেই পারছি না।”
এটা শুনে পেছনের সিটে আনায়ার পাশে বসে থাকা রেহান মুচকি হেসে বললো,
—“আমিও কিন্তু কম অবাক হয়নি। লোকটিকে আমরা সবাই যেভাবে দেখি তিনি মোটেও হয়তো ওরকম নয়। সেলিব্রিটি হলে যা হয়, ভারী অদ্ভুত জীবনযাপনের নিয়ম এদের।”
এতোসব আলোচনার মাঝে আনায়া শুধু এটাই ভাবছে কেনীথ ঠিক কি গেম খেলতে চাইছে। যতটুকু কেনীথকে জেনেছে সে তাতে এতোটুকু নিশ্চিত যে কেনীথ স্বাভাবিক কিংবা সাধারণ কেউ না। তার উদ্দেশ্য নিশ্চিত ভিন্ন কিছু। তবে মনে মনে এটাও বললো যে,
—“যদি বিয়েতে কোনো ব্যাঘাত ঘটানোর উদ্দেশ্য থাকে, তবে মিস্টার ভিকে! আই সয়ার, আমি আপনাকে ভুলেও ছেড়ে দেবো না। আমার লাইফ ব্যাঘাত ঘটালে আপনার লাইফ আমি একদম শেষ করে দেবো।”
________________
নিত্যদিনের মতো কেনীথ ক্লারা আর কেনেলকে তার স্পেশাল মাংসের স্টেক রেঁধে খাওয়াচ্ছে।হাঁটু গেঁড়ে বসে ওদের খাবার খাওয়া দেখতে দেখতে একটা সময় কেনীথ কেনেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“জানিস তোরা, কাল তারার বিয়ে। আমাকে আবার দাওয়াতও দিয়েছে। আচ্ছা বলতো, আমার কি করা উচিত?”
ওর এই প্রশ্ন শুনে কুকুর দুটো নিজেদের খাবার খাওয়া বন্ধ করে নিজেদের ভাষায় কেনীথকে কিছু বললো। যা মনোযোগ দিয়ে কেনীথ শোনার পর বললো,
—“আরে নাহ! আমি আকাশের তারা নয়, আমার তারার কথা বলেছি।”
কুুকুর দুটো আবারও শব্দ করে আওয়াজ করলো। তখন কেনীথ মুচকি বাঁকা হেসে বললো,
—“উহু, আমি তো এমন কিছুই করবো না। ও যদি বিয়ে করে নিজের সুখ খুঁজে নিতে চায়, তবে তাই হোক। আমি কেনো শুধু শুধু বাঁধা দেবো। তবে আমি ওকে কাল একটা গিফট দিতে চাই। একটা স্পেশাল গিফট। যা ওর লাইফের জন্য এতোটাই স্পেশাল হবে যে…
বাকিটা অসমাপ্ত রেখেই কেনীথ আবারও বাঁকা হেসে বললো,
—“গিফটা আদোও কি হতে চলেছে, এটা নিশ্চয় তোরা জানিস!”
কেনীথের কথা শুনতেই কেনেল আর ক্লারা জোরে জোরে আওয়াজ করে ডাকতে লাগলো। তাদের আওয়াজের শব্দ এতোটাই প্রকট হলো যে কেনীথের সেই বিশাল ভবনের চারপাশ সম্পূর্ণ রুপে তা ছড়িয়ে পড়লো।
এরই মাঝে কেনীথ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো,
আকাশে এতো তারার ভিড়ে
যে তারাটা ছিলো শুধু কেনীথের জন্য বরাদ্দ,
সেই তারাই কিনা হতে যাচ্ছে অন্য কারো!
হাস্যকর!”
#চলবে
#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)
পর্ব→২০
—“কিহ…!তোর বিয়ে? কখন, কিভাবে, কারসাথে…মানে রেহান ভাই তো বিদেশে।তুই রেহান ভাইকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছিস? এটা তোর কাছে মোটেও আশা করিনি রে আনায়া।”
কথা শেষ করেই শিখা হাহুতাশ করতে লাগলো। অন্যদিকে তার আর পাঁচ জন বন্ধু বান্ধবীও বা কম কিসে, প্রত্যেকের মাঝে বিস্মিতয়। সাবা তো কয়েকটা কড়া কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে ভিডিও কলে এদের এতো সহ কাহিনি দেখে আনায়া তড়িঘড়ি করে বললো,
—“আরে থাম তোরা! আমাকে তো আগে কিছু বলতে দে…
আনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই তাজিম বললো,
—“তুই আর কি বলবি,শুধু শুধু রেহান ভাইয়ের জীবন নিয়ে এভাবে খেলার কি দরকার ছিলো। তোরা মেয়েরা সব এমনই হোস।”
তাজিমের কথায় আনায়া প্রথমে তব্দা খেয়ে পরবর্তীতে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“চুপ কর গাধা, বিয়ে আমার তোদের রেহান ভাইয়ের সাথেই হচ্ছে।”
এটা শোনা মাত্রই সবাই বিস্ময় নিয়ে জোরে বলে উঠলো,
—“কিহ…! এটা কিভাবে, কখন…..
—“এখন নিশ্চয় এটা বলসি না যে কার সাথে?”
এরপর আনায়া একে একে তাদের ফ্রেন্ডদের সবাইকে সব ঘটনা জানাতে থাকে। তারপর আগামীকাল সকালের গায়ে হলুদ আর বিয়েরও আমন্ত্রণ জানিয়ে দিলো । সঙ্গে এটাও বলে দেয় যে বিয়েটা ঠিক কেমন হবে, যে সেই অনুযায়ী ওরা প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পারে। নয়তো ফ্রেন্ডের বিয়ে মানে তো এরা সব না খেয়েদেয়ে শপিং করে হাতিঘোড়া-বজরাপানসি নিয়ে চলে আসবে।
_____________
চারপাশে বিয়ের তোরজোড় লাগিয়ে কাজ চলছে। সকাল বেলাতে হলুদের আয়োজন আর দুপুর গড়াতেই বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যাবে।আনায়ার ফ্রেন্ডরা সব চলে এসেছে। খুব ছোটখাটো আয়োজন। মহল্লার কাউকেই সেভাবে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। নয়তো তারা শিকদার বাড়ির শুভাকাঙ্ক্ষী কম শত্রু বেশি। এবারের বিয়েতে কোনো ঝামেলা চাইছে না বিধায় এমন আয়োজন। কয়েকবছর পর না হয় আবারও বড়সড় করে আয়জন করা যাবে। তখন শত্রু আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে না।
এছাড়া এখন এদের সবাইকে বিয়ের কথা জানালে বিয়ের পর আনায়ার বাপের বাড়ি থাকা নিয়ে তারা হাজারও কাহিনি বানাবে। কিভাবে মানসিক অশান্তি করে জীবনকে ঝালাপালা করতে হয় তা যে তার বাড়ির আশেপাশের মানুষগুলোর খুব ভালো করেই জানা আছে।
Mehndi te vavi malvene
ano rang gayo gujarat re,
Mehndi rang lagiyo re
Mehndi te vavi malvene….
—“এটা কি গান দিয়েছিস। বাংলা গান লাগা গাধী!”
রনকের ধমক শুনে আলো গান চেঞ্জ করতে গেলে সাবা বলে উঠলো,
“কি বাংলা গান লাগাবি। তারচেয়ে আমি ইংলিশ সং দিচ্ছি।”
ওর এ কথা শোনা মাত্রই তাজিম ক্ষেপে গিয়ে বললো,
—“গায়ে হলুদ হচ্ছে বাঙ্গালির সেখানে গান দিবি ইংরেজি? ইংরেজদের চামচী নাকি তুই?”
—“তাজিম, বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
—“কিছু বেশি হচ্ছে না। দিলে বাংলা গান নয়তো কোনো গানের প্রয়োজন নেই।”
হলুদ পাঞ্জাবি, শাড়ি, গাউন পড়ে আনায়ার ফ্রেন্ডগুলো সব সকাল সকাল হাজির হয়ে গিয়েছে। সাবা শুধু গাউন পড়েছে আর আলো, শিখা দুজনেই হলুদ শাড়ী। অন্যদিকে ছেলে তিনজনে হলুদ সাদা পাঞ্জাবি পড়ে আনায়ার আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে।
বাড়ির ঠিক মাঝেই ছোট করে একটা স্টেজের মতো বানিয়ে তাতে আনায়া বড়সড় এক জমকালো হলুদ লেহেঙ্গা পড়ে বসে রইছে। তার একপাশে হলুদ গাউন পড়া আনায়া অন্যপাশে শাড়ি পড়া শিখা; দুজনে বসে বসে আনায়ার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।
যেহেতু বিয়েতে হলুদের আয়োজন ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না তাই হলুদের মাঝেই মেহেদীর আয়োজন করে ফেলেছে তারা। কিন্তু হঠাৎ গান সিলেক্ট করা নিয়ে এদের ঝামেলা বাঁধলে ফরিদা এসে ওদের থামিয়ে কিছু নাস্তা দিয়ে আবারও কাজে চলে গেলো।
সবার এতো আনন্দ উল্লাসের থাকলেও আনায়ার মাঝে তেমন কিছুই নেই। সে বর্তমানে প্রচন্ড মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। মনের মধ্যে সেই কেনীথকেই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। এই লোকটি যে কোনোভাবেই সুবিধার নয় তা তো আনায়ার জানা। কিন্তু বিয়েতে কি কোনো ঝামেলা করার উদ্দেশ্য আছে তার?থাকলেও সে এমন কি করবে। তারই আন্দাজ করে যাচ্ছে আনায়া।
এরেই মাঝে হঠাৎ সাবা এসে আনায়ার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
—“আনায়া, তুই হুট করে বিয়েটা করলি তো ঠিক আছে। কিন্তু এসব কোনো বিয়ের আয়োজন হলো? কোনো মিউজিক ব্যান্ড নেই, প্রফেশনাল ডান্সার নেই। কেমন সব বোরিং ব্যাপার স্যাপার। অবশ্য তোদের মতো এসব মিডেল ক্লাস ফ্যামিলি বিয়েতে এরচেয়ে করবেওটা কি? বাট তুই দেখিস, আমি আমার বিয়েতে ভিকেকে ইনভাইট করবো। ওকে আমার বিয়েতে এনে গান গাওয়াবো।”
ওর এমন কথা শুনে আনায়ার মাঝে কোনে হেলদোল হলো না তবে কেনীথকে কথার মাঝে টেনে আনায় আনায়া মনে মনে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“শয়তানের কথা চিন্তা করতে করতেই শয়তানের চামচা হাজির। ওই শয়তান শুধু তোর বিয়ে কেনো আরো হাজারটা বিয়ে কিংবা জাহান্নামে যাক তবুও যেন আমার বিয়েতে না আসে।”
তবে এরই মাঝে ইনায়া কিছু কড়া কথা বলার জন্য উদ্বেগ হলে তাজিম কিছু বলতে শুরু করায় ইনায়া কিছু না বলেই থেমে গেলো। তাজিম সাবার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
—“তোর বিয়েতে আবার ভিকে?…গান গাইবে… জেগে জেগে সপ্ন দেখতে থাক। ”
—“তুুই আমাকে কি ইনডিরেক্টলি ইনসাল্ট করলি?”
তাজিম হেসে বললো,
—“তুই আসলেই একটা গাধী। আমি তোকে ইনডিরেক্টলি নয় বরং একদম ডিরেক্টলি ইনসাল্ট করেছি।”
তামিজের কথায় সাবা ফুঁসে বললো,
—“তুই দেখেনিস, আমি আমার বাবাকে বলে এটা করিয়েই ছাড়বো। নয়তো আমি বিয়েই করবো না।”
—“তবে তো আলহামদুলিল্লাহ, একটা নিষ্পাপ জীবন বেঁচে যাবে….! ”
সাবা রেগেমেগে দাঁত খিঁচে চিল্লিয়ে বললো,
—“তাজিম……!”
তাজিম নিজের পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে বললো,
—“শেখ…তাজিম শেখ আমার নাম।”
ওদের এই ঝামেলা কোনোমতে মিটে গেলে পাশ হঠাৎ ইনায়া চেঁচিয়ে উঠে বললো,
—“আপু…”
ওর কথা শুনে সবার পাশাপাশি আনায়াও পাশে ফিরে ওর অস্থির চিন্তিত চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর নজর অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে তাকাতেই ওর মাথাটা যেন ঘুরে গেলো। ইনায়ার ওর বাম হাতের মাঝে ওর নাম “Anaya” না লিখে “Kenneth”লিখে রেখেছে।
আনায়া ত্বরিত নিজের ডান হাতটার দিকে তাকিয়ে দেখলো তাতে “Rehan”লেখা। মেহেদীর ডিজাইন অনুযায়ী কথা ছিলো ডানহাতে রেহানের নামটা শিখা লিখবে যা ও আগেই লিখে ফেলেছিলো আর বাম হাতে থাকবে আনায়ার নাম। কিন্তু সাবাকে কিছু কড়া কথা না শুনাতে পেরে মনে মনেই বিরবির করছিলো আর ভাবছিলো আজ যখন বিয়েতে কেনীথ আসবে তখন সাবার ঠিক কি অবস্থা হবে কিন্তু এরই মাঝে কেনীথ কে নিয়ে ভাবনা চিন্তার মাঝে যে কখন আনায়ার হাতে কেনীথের নাম লিখে দিয়েছে তা ওর খেয়ালও নেই।
আনায়া তো পুরো স্তব্ধ হয়ে নিজের হাতে লেখা কেনীথের নামটাকে দেখছে। আর ইনায়া তো পুরো হতভম্ব, এটা সে কি করে ফেলেছে। এরই মাঝে পাশ থেকে সাবা এসব দেখে বললো,
—” ওহ গড, আনায়া তোর বোন দেখছি একটা কাজও ঠিকমতো পারে না। কনের মেহেন্দিতে ভিকের নাম লিখে রেখেছে। হাউ ফানি….!”
এই বলেই সাবা হাসতে লাগলে রনক ধমকের সুরে বললো,
—“চুপ কর সাবা, সব সিচুয়েশনে তোর এই লেইম কথাবার্তা গুলো বলা বন্ধ কর।”
—“আরে আমি তো সত্যি…
—“যাস্ট স্টপ!”
এদিকে শিখা আবার কিছুটা স্তব্ধ সুরে ইনায়ার উদ্দেশ্য বললো,
—“এটা কি করেছো ইনায়া, এখন কি করবো?”
ইনায়া একবার শিখার দিকে তাকিয়ে,পুনরায় অস্তির হয়ে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
—“আপু সরি, আমার সত্যি খেয়াল ছিলো। কি করতে গিয়ে….
—“ইনায়া সরে যাও এখান থেকে…
হঠাৎ আনায়া নিস্তব্ধ সুরে বলতে লাগলে ইনায়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো,
—“আপু….
—“ইনায়া আমি সরতে বলেছি।”
এতোক্ষণ আনায়া নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে কথা বললেও এবার ইনায়ার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো সুরে কথা বলতেই, ইনায়া ওখান থেকে কিছুটা সরে যেতেই আনায়া ত্বরিত কাউকে পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটতে লাগলো।
দুহাতে মেহেদী আর এই ভারী লেহেঙ্গা সামলানোর মতো কোনো উপায় নেই।আনায়া এমন ভাবে ছুটছে যে কখন যেন আবার পড়ে না যায়। এরই মাঝে ওকে যে কেউ আটকাবে অথবা সাহায্য করবে সে উপায়ও নেই।
আনায়া ওয়াশরুমে যেতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ইচ্ছে মতো কেনীথের নামটার জায়গায় ঘষামাজা করতে লাগলো। সাবান, জালি,নখ যেভাবেই পারছে সেভাবেই ঘষাঘষি করতে করতে একসময় দুহাতের মেহেদী ধুয়ে গেলে। আনায়া নিজের হাতের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালো। কেনীথের নাম উঠছে না।
অবশ্য উঠবেও বা কিভাবে? এমনিতেও আজকালকার ইনস্টান্ট মেহেদী তার উপর ইনায়া নামটা লিখেছে প্রায় কয়েক মিনিট অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। এছাড়া তার দু’হাতের মেহেদীও দেওয়া প্রায় শেষ শুধু হাতের মাঝে নাম লেখার জন্য জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছিলো। আর সেখানেই গোলমালটা বাঁধিয়েছে ইনায়া।
এতোকিছুর পরও যখন কোনো কাজ হলো না তখন আনায়া রাগে ক্ষোভে জায়গায় এতো পরিমাণ ঘষাঘষি করলো যে একটা পর্যায়ে হাতের তালু লাল হয়ে গেলো তবুও আনায়া থামলো না। আনায়া আর উপায় না পেয়ে ত্বরিত বাহিরে এসে পাগলের মতো বলতে লাগলো,
—“তাড়াতাড়ি এটাকে কেউ ঠিক কর। এই নাম সরা আমার হাত থেকে।”
ওর এ কথা শুনে শিখা, আলো ত্বরিত ওর কাছে এলো।
—“এটা কিভাবে ঠিক করবো। এমনিতেই হিবিজিবি ব্রাইডাল ডিজাইন তার উপর….
—“আমি জানি না। এটার উপর কিছু একটা করে দে তবুও এটা সরিয়ে ফেল।”
শিখার কথার উত্তরে আনায়ার এমন ঝাঁঝালো কথায় আলো বলতে লাগলো,
—“দেখ আনায়া, এখন এটাতে কিছু করতে গেলে পুরো জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিতেও তুই ঘষামাজা করে ডিজাইনের বারোটা বাজিয়েছি।”
আনায়া ঠোঁট ভিজিয়ে অস্থির হয়ে বললো,
—“তোরা বুঝতে পারছিস না….”
আনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই সাবা বললো,
—“এখানে বোঝার কি আছে আনায়া। যাস্ট একটা মিস্টেক হয়েছে, এমন তো নয় যে ভিকের নাম তোর হাতে লিখলেই ওর সাথে তোর বিয়ে হচ্ছে। তবে এতো রিয়েক্ট করার কি আছে?”
সাবার কথার উত্তরে আনায়া কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে নিলো। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে সঙ্গে মাথাটা তার প্রচন্ড ধরেছে। এখনই কেনো যেন সব কিছু অসহ্য লাগছে।
—“আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।”
আনায়া শুধু কোনোমতে এতোটুকু বলেই নিজ রুমে রেস্ট নিচে চলে গেলো।
_________________
মেহেদী, গায়ে হলুদের সব আয়োজন শেষে এবার বিয়ের পালা। কেনীথের দেওয়া সেই গাঢ় লাল কালো রং-এর জমকালো লেহেঙ্গা পড়ে মুখে খুব সামান্য মেক-আপের আস্তরণ লাগিয়ে একদম বিয়ের কনে সেজে তৈরি আনায়া। খোঁপা করা চুলে কয়েকটা লাল রং-এর গোলাপের পাশাপাশি কালো রংএর গোলাপ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কপালের সামনে দুটো ছড়িয়ে দেওয়া চুলগুলোকে কিছুটা কার্লি করা হয়েছে। গহনা গিসেবে রেহানের বাড়ি থেকে কিছু গহনা পাঠানো হয়েছিলো সেগুলো এবং তার বাবার জুয়ার খেয়া থেকে রক্ষা পাওয়া আনায়ার মায়ের কিছু গহনা।
এছাড়া সেসব গহনার নিচে ঢাকা পড়ে থাকা আনায়ার সেই সী-শেল আর স্টার শেইপের দুটো চেইন।
আনায়া তখন কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর চুপচাপ নিজেকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছে।এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যতযাই হোক, আজকের মতো দিনটাকে সে কোনোভাবেই কেনীথের মতো জঘন্য লোকটার কথা ভেবে নষ্ট করবে না। সেক্ষেত্রে কেনীথ যদি তার বিয়েতে, তারই চোখের সামনে স্ব শরীরেও উপস্থিত থাকে, তবু না। এই ভাবনাতেই আপাতত ইনায়া সবার আনন্দ ফুর্তিতে নিজেও আনন্দে মেতে উঠছে।
বিয়ের আয়োজন তারা পারিবারিক ভাবে করলেও মহল্লার লোকজন তা টের পাবে না এই চিন্তা ভাবনা করাও হাস্যকর। যথারীতি চারদিকে খবর প্রায় ছড়িয়ে গিয়েছে যে আজ শিকদার বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে। যদি এই বিয়েতে তাদের অশান্তি করা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য যেহেতু নেই সেক্ষেত্রে তারা কেউ দাওয়াত বিহীন নিজ ইচ্ছেতেও বিয়েতে উপস্থিত না হলেও, শিকদার বাড়িতে প্রবেশপথে যাকে পাচ্ছে তার কাছেই বিয়ে নিয়ে তাদের আগ্রহের ঝুলি খুলছে।
যদি বর্তমানে শিকদার বাড়িতে লোকজনের পরিসংখ্যান কম। কিছু কাজের জন্য বাড়তি লোকজন ছাড়া তেমন কেউই নেই। তবুও যখনই আনায়ার ফ্রেন্ডদের হাতের নাগায় পাচ্ছে তখনই তাদের কাহিনি শুরু। যা রীতিমতো বিরক্তিকর বিষয়। আর এটা সামলাতে ইনায়া বাড়ির বাহিরে মেইন গেইটে পুরো লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে। অবশ্য সে একা নয় তার সাথে তার পুরো ভিকু গ্যাং-ও রয়েছে।
ইনায়া ঠিক কেমন এটা সবারই জানা। হলুদে ইনায়ার ফ্রেন্ডরা না এলেও বিয়েতে ওর ভিকু গ্যাংএর সবাই সেজেগুজে উপস্থিত। যদিও এর কারণ হলো ওর ফ্রেন্ড’দের পরিবারে সাথে আনায়ার পরিবারেও ঠিক এই সমস্যা। শুধু তারা নয় বরং পুরো মহল্লার লোকজনের চোখের কাটা যেন এই শিকদার বাড়ি। কিন্তু এর ঠিক আসল কারনটাই আজ পর্যন্ত আনায়া ইনায়া খুঁজে পায়নি। তবে তারা এতোটুকুই ধারনা করেছে যে, এসব তার বাবার বদঅভ্যেস কিংবা পূর্ববর্তী কোনো ঘটনার ফলাফল। কিন্তু এটা আদোও কতদূর সত্যি তা তাদের জানা নেই।
বিকেল হতে চললো অথচ বর আসার কোনো নামগন্ধ নেই। বাড়ির বাহিরে মেইন গেইটে তো ইনায়ার পাহারা চলছে কিন্তু এদিকে বাড়িতে ঢোকার সদর দরজায় আনায়ার ফ্রেন্ডরা গেইট সাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইছে।
ইনায়া বর আসার সিগনাল দিলেই ওরা আরো তোড়জোড় লাগিয়ে দেবে। কিন্তু সমস্যা হলো বিকেল হয়ে যাচ্ছে অথচ বর আসার কোনো খবর নেই। ইনায়ার আর ওর ফ্রেন্ডগুলো যেমন অপেক্ষা করতে করতে অস্থির, তেমনি আনায়ার ফ্রেন্ডগুলোও।এরই মাঝে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবা পিছনে ফিরে বলতে লাগলো,
—“এই আনায়া,রেহান ভাই এতো দেরী করে কেনো। বিয়ে করার কি ইচ্ছে নেই নাকি।”
সাবার এমন বিরক্তির সুরে বলা কথা শুনে সায়েম বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“আজব কথাবার্তা, বিয়ে করার ইচ্ছে থাকবে না কেনো। তুই সবসময় এমন ফালতু কথাবার্তা কোথায় পাস রে?”
সাবা হাই তুলে বললো,
—“আমি যেটাই বলি, সেটাই তোদের ভুল মনে হয়। এটা তোদের প্রবলেম, আমার না।”
এদিকে বাড়ির ভেতরে একপাশে হলুদের স্টেইজকে আরেকটু বড়সড় করে সাজিয়ে, ওখানে সোফায় বর কনের বসার কিংবা বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সেখানেই সোফায় বসে থেকে লেহেঙ্গা চুমকি পাথর গুলো না চাইতেও আনমনে টেনে তুলে ফেলছে আনায়া। সঙ্গে তার মাথায় চলছে আবারও নানা টেনশন। যা না চাইতেও বারবার কোথা থেকে যে হাজির হচ্ছে কে জানে। একদিকে কেনীথের চিন্তা তো ছিলোই আর এখন রেহান এখনো আসছে না দেখে চিন্তা যেন আরো বেড়ে চলেছে।
কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ বাহিরে চিল্লাচিল্লি শুনে আনায়া কিছুটা মুচকি হাসলো। ধরেই নিলো যে রেহানরা হয়তো চলে এসেছে।
________
রাস্তা দিয়ে তিনটা চারটা গাড়ি নজরে এলেই ইনায়া তার দলবল নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে আলোদের দিকে যেতে লাগলো আর বলতে লাগলো,
—“বর এসেছে, বর এসেছে… ”
ওদের এই চিৎকার শুনে কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না যে রেহান চলে এসেছে। ইনায়ার চিৎকার তারেক, ফরিদা কিংবা আনায়া দুজনের কানেই চলে গিয়েছে। এদিকে পরপর তিনটে কালো কুঁচকুঁচে তিনটে গাড়ি এসে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই ইনায়ারা গিয়ে আনায়ার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে সাজানো গেইটে দাঁড়িয়ে পড়লো।
সদর দরজায় ছোট একটা টেবিল বসিয়ে তাতে সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু মিষ্টি আর শরবত রাখা বরের স্বাগতম জানানোর জন্য। খুবই সাদামাটা আয়োজন যতটা তারা করতে পেরেছে।
এদিকে সবার মাঝে টানটান উত্তেজনা। বর যেহেতু আমেরিকার বাসিন্দা সেক্ষেত্রে গেট ধরায় তাদের দাবি লাখ টাকা। কিন্তু বরের গাড়ি এমন সাদামাটা দেখে কেউ তেমন অবাক হলো না। যেহেতু বিয়েটা সাদামাটা সেক্ষেত্রে গাড়িও না সাজানোরই কথা।
কিন্তু যখনই গাড়ি থেকে বরের জায়গায় অপ্রত্যাশিত মানুষটি নেমে এলো তখন আর কারো বিস্ময়ের সাগরে ভাসতে দেরী হলো না।
কালো টিশার্ট আর ব্লাক ডেনিম,এলোমেলো চুল গুলো বরারের মতোই এলোমেলো সঙ্গে কালো চোখে কালো সানগ্লাস ;সেই একই চিরপরিচিত বর্ণনার সাজে সেজেগুজে বিয়েতে হাজির কেনীথ। বিয়ের জন্য তার আলাদা কোনো পরিবর্তন নেই তবে সবসময় একা চলাচল করা লোকটা আজ তার সাথে পিছনের দুটো গাড়ি ভর্তি বডিগার্ড নিয়ে এসেছে। দুই গাড়িতে মোটামুটি সব মিলিয়ে আট-দশ খানেক কালো পোশাক পড়া তার বডিগার্ড রয়েছে।
আশেপাশে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামতে চললো অথচ বিয়ের বর না এসে তার জায়গায় চলে এসেছে কেনীথ। কিন্তু তাকে দেখে ইনায়া ব্যতীত দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বাকি সবার চোখেমুখে অবাধ বিস্ময়। তারা যেটা দেখছে এটা কি আদোও সত্য নাকি পুরোটাই তাদের চোখের ভুল।
সবাই যখন বিস্মিত নিরব চোখে কেনীথের দিকে তাকিয়ে তখন ইনায়া দৌড়ে কেনীথের কাছে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললো,
—-“ভিকে…তুমি! আমারা জানতাম তুমি আসবেই।”
শিরদাঁড়া সোজা করে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে থাকা কেনীথ ইনায়া হাসোজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ বাঁকা হেসে বললো,
—“আমাকে তো আসতেই হতো।”
এই বলেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে নিলে ইনায়াও কেনীথের সাথে সাথে বাড়ির ভেতরে দিকে অগ্রসর হলো। তবে বাড়ির ঠিক সদর দরজার কাছে এসেই কেনীথ টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে পাশে ফিরে ইনায়ার উদ্দেশ্য জিজ্ঞেসাসূচক ভাবে বললো,
—“এসব কি?”
—-“ওহ, এগুলো….এগুলো বরের জন্য। দাঁড়াও আমি এগুলো সরিয়ে দিচ্ছি।”
ইনায়া ছোট টেবিলটা খানিকটা সরিয়ে দেওয়ার আগেই শিখা অস্ফুট স্বরে বললো,
—-“হ্যা রে… আমি যা দেখি তোরাও কি তাই দেখিস।”
সাবা বাদে সবাই একই সাথে হাবলার মতো মুখে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললো,
—“তাই তো দেখছি।”
ওদের এসব কথা শুনে কেনীথ পাশে তাকিয়ে একবার ভ্রু কুঁচকে দেখতে নিলেই তখন সাবা বললো,
—“এতো অবাক হচ্ছিস কেনো। এগুলো সব প্লাস্টিক সার্জারির খেলা। আ’ম ড্যাম সিওর, দেখ গিয়ে ইনি হয়তো ভিকের বড় কোনো ফ্যান হবে তাই ভিকের মতো নিজের চেহারায় প্লাস্টিক সার্জারি করে নিয়েছে।
সাবার কথা সবার বিস্ময়ের মাঝে জাগয়া না পেলেও কেনীথ ওর কথা শুনে কয়েক কদম ওদের দিকে এগিয়ে গেলো। এরপর মুচকি হেসে টেবিল থেকে কাঁটাচামচ দিয়ে একটা মিষ্টি উঠিয়ে যাস্ট একবার বাইট দিয়ে মিষ্টিটা পুনোরায় বাটিতে রেখে দিলো। এরপর সাথেই রাখা পানির গ্লাস উঠিয়ে এক ঢোক পানি খেয়েই পুনোরায় সেটাকেও রেখে দিয়ে সাবা সহ বাকি সবার দিকে তাকালো।
সবার হাবভাব একই রকম থাকলেও সাবা কেনীথকে সম্পূর্ণ ভ্রু কুঁচকে তীব্র সন্দিহান দৃষ্টিতে ওর কাজকর্ম দেখছে। ও ভেবেছিলো তার সামনে থাকা লোকটি হয়তো কিছু বলবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না।কেনীথ একবার সাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মহূর্তেই পাশে ঘুরে শিরদাঁড়া সোজা করে বড় বড় পা ফেলে ওদের পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সঙ্গে কেনীথের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে তার পাশে ইনায়া আর পেছন পেছন চারজন লোক কেনীথের পেছন পেছন বাড়িতে প্রবেশ করলো। আর বাকি লোকগুলো বাড়ির বাহিরেই পাহারার জন্য দাঁড়িয়ে রইলো।
______________
রেহানের জায়গায় হঠাৎ কেনীথের আগমনে আনায়া সহ তারেক আর ফরিদাও বিস্মিত হলো। তারেক আর ফরিদা জানে না কেনীথ কে? কিন্তু আনায়ার তো জানা। তার এবার মনের মধ্যে নানান সন্দেহ জাগছে সঙ্গে চিন্তার পাহার । রেহান আদোও এলো না কেনো। এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা ছিলো। অথচ রেহান আসেনি কিন্তু কেনীথ এসে হাজির।
কেনীথ ভেতরে যেতেই ইনায়া তাকে নিয়ে সোফায় বসতে বললে কেনীথও পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসে পড়লো। অন্যদিকে ওর বডিগার্ড গুলো গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ইনায়া ত্বরিত ফরিদার কাছে গিয়ে কেনীথের কথা জানালো। ফরিদাকে ও আগেই বলেছিলো আজ বিশেষ মেহমান আসবে আর সেই মেহমান কেনীথই।
ফরিদাও খুশি হয়ে তড়িঘড়ি কিছু কিছু হালকা খাবারের ব্যবস্থা করে কেনীথের সামনের সাজিয়ে দিলো। যদিও কেনীথ সেভাবে কিছুই খেলো না। পায়ের উপর পা তুলে মোবাইল স্ক্রোল করতেই ব্যস্থ হয়ে পড়লো। আদোও সে মোবাইলে কাজের কিছু করে কিনা কে জানে। অন্যদিকে মুখোমুখি সাজানো স্টেজে বসে থাকা আনায়া সন্দিহান চোখে কেনীথকে দেখলেও কেনীথ একবারের জন্য আনায়ার দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না। তার চোখ সেই ফোনের স্ক্রিনেই। আর আনায়ার সন্দেহ ঠিক এখানেই। কেনীথর এমন অদ্ভুত পরিবর্তন তার বোধগম্য হচ্ছে না বরং না চাইতেও উল্টো নানা সন্দেহের সৃষ্টি করছে তার মাঝে।
এদিকে ইনায়া কিছু বলার আগেই ওর ফ্রেন্ড আর আনায়ার ফ্রেন্ডগুলো অবিশ্বাস চোখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা আবস্থাতেই ইনায়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিখা ফিসফিস করে বললো,
-“এই ইনায়া, ইনি কি সত্যি ভিকে? প্লিজ সত্যি করে বলো না।”
ইনায়া নিজের কথা বলা থামিয়ে পাশে তাকিয়ে ধীর সুরেই বললো,
—“আপু, এটাই ভিকে।”
এদিকে পেছন থেকে আলো বললো,
—“কিন্তু ভিকে কেনো, এখানে আসবে। উনি কি তোমাদের পরিচিত…?”
—-“হুম, তবে পুরোপুরি না। মানে হলো….
ইনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আবার ওর আরেকপাশে বুকে হাত গুঁজে কপাল কুঁচকে কেনীথকে দেখতে থাকা সাবা ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“প্লিজ এসব মিথ্যা বলো না। আমি ভালো করেই জানি এটা ভিকে নয় বরং অন্যকেউ। আফটার অল, ভিকে কেনো এখানে আসবে?”
সাবার এমন কথায় কিছুটা তীক্ষ্ণ কন্ঠ ইনায়া বললো,
—“এক্সকিউজ মি, সাবা আপু। প্রথমত আমি কোনো মিথ্যা বলছি না আর দ্বিতীয়ত তোমার বিশ্বাস করায় বা না করায় আমার কিছু যায় আছে না। চোখের সামনে জলজ্যান্ত ভিকে কে যদি তোমার ভিকে না মনে হয় তবে আমার আর কিছু বলার নেই।তুমি বরং…”
—“ইনায়া তুমি সাবার কথা বাদ দেও। তুমি আমায় এটা বলো যে ভিকের সাথে আনায়ার কোনো কানেকশন রয়েছে…আই মিন ভিকে….
—“হুম রনক ভাইয়া,আপু ভিকের পি.এ.। শুধু তাই নয়, রেহান ভাইয়ার ভাই ইমন ভাইয়াও ভিকের পিএ ছিলো।”
ইনায়ার নির্বিকার বলা কথাগুলো শুনে রনক বাদে বাকি সবাই বিস্মিত হলো। এদিকে তাজিম রনককে জিজ্ঞেস করলো,
—“তুই এই বিষয়ে আগে থেকেই জানতি?”
—“পুরোপুরি নয় তবে কিছুটা।”
ওদের এসব ফিসফিসানি কথা চুপচাপ শুনতে শুনতে সাবা একটা পর্যায়ে ভিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঠোঁট উল্টিয়ে বলতে লাগলো,
—“দ্যাটস মিন, এটাই ভিকে…এই আমাকে কেও ধর।
এই বলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করে তাজিমের উপর পড়তে নিলে তাজিম খানিকটা সরে গিয়ে বললো,
—“দূরে গিয়ে ম*র!”
★
—“আরে আমাকেও তো কেউ স্বাগতম করো।”
হঠাৎ রেহানের কথা শুনে সকলে পিছনে তাকিয়ে দেখলো রেহান একদম লাল আর অফ হোয়াইট কালারের শেরওয়ানি পড়ে মাথায় পাগড়ি পড়ে ফিটফাট বর সেজে হাজির। সঙ্গে তার বাবা, ইমন, রোহান,কাজী সহ আরো কয়েকজন লোক।
ওরা প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিলো যে এই বাড়িতে বরের আপ্যায়নের কোনোকিছুই না দেখে। তবে বাড়িতে ঢোকার পর বুঝতে বাকি রইলো না যে এর কারণ কি। সবাই যে এখন কেনীথ কে নিয়ে ব্যস্ত সঙ্গে বাহিরে কতোগুলো আর লোকজন দেখেও বিষয়টি ধারণা করেছিলো। এই নিয়ে অবশ্য রেহান কিংবা ওর পরিবার কোনো কিছুই মনে করলো না। বিষয়টিকে তারা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে।
এতো বড় সেলিব্রিটিকে সবাই যে বরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আনায়ার সবকিছু বিরক্ত লাগছে। কেনীথকে বিয়ের কাটা মনে হচ্ছে। দূর থেকে সবকিছুই ঘোমটা মাথায় দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলো তখনই রেহানকে দেখে যতটা খুশি হয়েছিলো এখন নিজের ফ্রেন্ডগুলো আর বোনের প্রতি ততটাই বিরক্ত।
তবে মূহুর্তেই যখন রেহানকে দেখে সবাই ওর কাছে ছুটে গেলো তখন অবশ্য রাগটা কিছুটা কমতে শুরু করলেও কেনীথের উপস্থিতি তার কাছে বরাবরের মতোই গা জ্বালানো অসহ্যকর লাগছে। কিন্তু কিছুই করতে পারবে না বিধায় বিয়ে ঠিকঠাক সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে নিজেকে কন্ট্রোল করছে।
সবার আগে মেরুন কালারের বিশাল গাউন পড়া ইনায়া দুহাতে জামাটা কোনো মতে ধরে দৌড়ে রেহানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,
—“বরের আসতে এতো দেরী লাগে নাকি? সেই কখন থেকে দই, মিষ্টি, শরবত নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম জানা আছে? সেই বিকেল থেকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে গিয়েছিলো। আর এখন বলো যে, তোমার স্বাগতম করতে! স্বাগতম কি করবো মেয়েই দেবো না, হু!”
ইনায়ার কথা শুনে আনায়ার ফ্রেন্ডগুলো সহ আশেপাশে সবাই হেসে ফেললো। সবাই জানেই যে ইনায়া মজার ছলে কথা গুলো বলছে। যে কারণে ইনায়া উদ্দেশ্যে রেহান হেসে বলতে লাগলো,
—“এ কথা বলবেন না, শালিকা সাহেবা। আপনারা মেয়ে না দিলে এই অধমের জীবনটা দেবদাসে পরিণত হবে। এরপর আপনার বোনের বিরহে সারাজীবন দেবদাস হয়েই পার করে দিতে হবে। সামান্য দেরীর জন্য এতো বড় শাস্তি কেম্নে সইবো।”
এরই মাঝে শিখা বলতে লাগলো,
—“বরের দেখি লজ্জা সরমের ভারী অভাব। বাপ-ভাই, হবু শ্বশুর বাড়িতে এসে এমন কথা…? এখন তো দেখছি আমাদের মেয়ে দেওয়াই যাবে না।”
ওর কথার উত্তরে এবার রিফাত আহমেদ হেসে বলতে লাগলো,
—“শুনো মেয়ে, এসব বিষয়ে শুধু বরের নয় বরং বরের বাপ-ভাইয়েরও লজ্জা কমই আছে। আমরা আমাদের মেয়ে নেবো সেখানে তোমরা বাঁধা দেওয়ার কে? বেশি বাঁধা দিলে তোমাদেরকেও নিয়ে যাবো।”
তার এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেঁসে ফেললো। এদিকে রনক আবার বলতে নিলো,
—“নিয়ে যান,আঙ্কেল। কিন্তু আদোও এগুলো কোনো কাজে লাগবে কিনা কে জানে? সব তো মাথামোটা।”
রনকের কথা শুনে মেয়েগুলো ক্ষেপে যেতে নিলে রিফাত আহমেদ আবারও বললো
—“আরে…আরে…এখন আর কেউ ঝগড়াঝাটি না করে আমাদের তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজ শুরু করতে দেও। তোমাদের কোম্পানি দেওয়ার জন্য স্বয়ং আমি আছি।”
এই বলেই সবাই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে নিলে ইনায়ার ফ্রেন্ডসহগুলো সহ আনায়ার ফ্রেন্ডরাও ত্বরিত সবাই লাইন ধরে রেহানদের আঁটকে দাঁড়ালো। হঠাৎ এমন করায় রোহান কপাল কুঁচকে বললো,
—“এখন আবার কি হলো…! ”
ইনায়া এবার বাঁকা হেসে বললো,
—“বেয়াই সাহেব,মেয়ে নিতে এসেছেন ভালো কথা। কিন্তু এতো সহজে কিভাবে মেয়ে নিয়ে যেতে দেই বলেন তো।”
—“মানে কি? এখন আবার কোন কাহিনি…”
—“কোনো কাহিনি না। আগে আমাদের গেইট ধরার টাকা দিন তারপরই যেতে দেব।”
—” ওহ…! আমাদের যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে তাই কোনো ঢং না করে সরাসরি বলেন যে, কত চাই…? ”
রোহানে ত্যারাব্যাকা কথা শুনে ইনায়া চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—“আমরা মোটেও ঢং করছি না। যাই হোক, বেশি না… একলাখ দিলেই হবে। ”
ইনায়ার কথা শুনে রিফাত আহমেদ কেশে উঠলে আলো বাঁকা হেসে বললো,
—“কি আঙ্কেল… এক মেয়ের গেইট ধরার টাকার অঙ্ক শুনেই কেশে উঠছেন। বাকি মেয়েদের কিভাবে নিয়ে যাবেন।”
রিফাত কিছু বলার আগেই ইনায়া আবারও বললো,
—“আর কোনো কথা না, তাড়াতাড়ি টাকা দেন, মেয়ে নিয়ে বাড়ি যান।
রোহান এবার তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
—“এ্যাহ….তা মেডাম, টাকা কি গাছে ধরে? এক লাখ টাকা চিনেন…বোঝেন এক লাখ টাকা মানে কত টাকা?কয়টা ৫ টাকার নোট মিলে এক লক্ষ টাকা হয়?
ইনায়া ভাব দেখিয়ে বললো,
—“বিশ হাজারটি পাঁচ টাকার নোটে এক লক্ষ টাকা হয়। ক্লাসের টপার আমি। আর শুধু আমি কেনো… এখানকার সবাই একেকটা টপার। সো আমাদের এসব সামান্য টাকার হিসেব শিখাতে আসবেন না।”
ওর এই কথাই সবাই হো হো করে সায় দিলো। কিন্তু এবার ইমন বললো,
—“এক মিনিট, টাকা দেবে ঠিক আছে কিন্তু টাকাটা কিসের জন্য দেবো? গেইট ধরার জন্য? এই তোমাদের গেইট? ইতিহাসে কার বিয়েতে কোনো আপ্যায়ন-আয়োজন ছাড়া এমন হাত দিয়ে ঘিরে গেট ধরে। আর এই গেইট ধরার জন্যই নাকি লাখ টাকা চাচ্ছো? ”
ইমনের কথা শুনে ইনায়া একটু কেশে বলল,
“গেইট তো আমরা সুন্দরভাবেই ধরেছিলাম কিন্তু আপনারা দেরি করেছেন এতে আমাদের কি দোষ।”
—“না না তোমাদের কি দোষ থাকবে? তোমরা তো সব ধোয়া তুলসী পাতা।”
—“দেখেন ভাইয়া এটা কিন্তু ঠিক না। আপনি বরপক্ষ বলে আমাকে ভুলে যাবেন? আমি না আপনার বোন হই!”
ইনার কথা শুনে ইমন হেসে বলল,
—“এখন ভাই বোনের সম্পর্ক টেনে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবে নাকি? এটা কিন্তু আরো অন্যায় ইনায়া।”
ইনায়া এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল,
—“এটা কিন্তু ঠিক না ভাইয়া, টাকা চেয়েছি তো টাকা দিন।”
—“কিসের টাকা? কোন টাকা দেবো না। ভাইয়াকে কোন মিষ্টি, শরবত খাওয়ানো হয়নি। সুন্দর করে কোনো গেইট ধরানো হয়নি। তবে কিসের টাকা দিব?”
ইনায়া এবার কিছু বললো না। পাশ থেকে শিখাকে ইশারা দিলে শিখা মুচকি হেসে দ্রুত পায়ে ভেতর থেকে বাটিতে করে মিষ্টি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। এরপর ইনায়া মিষ্টির বাটিটা হাতে নিয়ে রেহানের সামনে ধরে বললো,
—“ভাইয়া তাড়াতাড়ি মিষ্টি খান। দেরী করবেন না কিন্তু!”
ইনায়ার এমন ধমকের সুরে বলা কথা শুনে রেহান খানিকটা ঢোক গিলে চামচ ধরতে নিলে পাশ থেকে রোহান বাঁধা দিয়ে বললো,
—“ভাইয়া খবরদার তুমি মিষ্টি খাবা না। আমাদের বলার পর কেনো মিষ্টি দিবে মিষ্টি তো….
রোহানের কথা এবার আর ইনায়া শেষ হতে দিলো না। বরং তার আগেই ইনায়া নিজেই কাঁটা চামচ দিয়ে মিষ্টি তুলে, রোহানকে থামানোর জন্য উদ্বেগ হওয়া রেহানের মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলো। শুধু তাই নয়, একবারে রোহানের মুখেও অনেকটা রাগের সাথেই মিষ্টি ঢুকিয়ে দিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
—“এখন আশাকরি সব কথা শেষ। যত তারাতাড়ি মিষ্টি খেয়েছেন এবার তত তাড়াতাড়ি আমাদের দাবি মেনে নিন। নয়তো পরবর্তীতে মোটেও ভালো হবে না।”
এদিকে ইনায়ার কাজে সবাই যতটা অবাক তারচেয়ে বেশি প্রত্যেকের কাছে বিষয়টি হাস্যকর। এই ইনায়া এমনিতেই একটা বো/মা, তা সবারই জানা। কিন্তু কখন যে ব্লাস্ট হয়ে যাবে এটাই কেউ টের পায় না।
অন্যদিকে রোহান কোনোমতে মিষ্টিটা চিবিয়ে বলতে লাগলো,
—“তাই বলে এভাবে?”
—“সবকিছুর একটা সীমা থাকে। তেমনি ইনায়ার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করালে এর চেয়ে ভালো ফলাফল সম্ভব নয়।”
__________
এদিকে এতোক্ষণ ধরে এসব হয়ে যাচ্ছে বিধায় আনায়াও কিছুটা বিরক্ত। একে তো কেনীথকে সামনে দেখে পুরো অসহ্য লাগছে অন্যদিকে তার এই ছাগলের দল গিয়ে কাহিনি শুরু করেছে। কেনো জানিনা, রেহান তার সামনে থাকা স্বত্বেও সে খারাপ কিছু হওয়ার আভাস পাচ্ছে। আনায়া চুপচাপ একবার ফরিদাকে ইশারা করে নিজের কাছে ঢেকে এনে বললো,
—“খালা ওগুলো পাগলামো শুরু করেছে। তুমি প্লিজ ওগুলোকে থামিয়ে ওদের ভেতরে আসার ব্যবস্থা করো।”
ফরিদা ওর কথায় মুচকি হেসে কিছু বলতে নিলে উদ্বেগ হলে আনায়া ফরিদাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—“খালা তুমি যেমন ভাবছো তেমন কিছুই না। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। সিচুয়েশনটা আমার মোটেও ঠিকঠাক মনে হচ্ছে না। প্লিজ আমাকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না, যা বলছি তা একটু শোনো।”
ফরিদা আনায়ার গম্ভীর কথাবার্তা শুনে কপাল কুঁচকে আনায়ার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বললো না।তার মনে হচ্ছে আনায়া হয়তো কিছু লুকাচ্ছে। তবে সে যাই হোক, আনায়া যেটা বলেছে সেটা করাই উচিত। ফরিদা দ্রুত পায়ে ওদের মাঝে গিয়ে বললো,
—“আচ্ছা তোমাদের এসব তো অনেক হবে। এখন তারাতাড়ি ওনাদের ভেতরে আসতে দেও। বেশি দেরী করা ঠিক হবে না।”
কিন্তু ফরিদার কথা আর কেউ মানতে রাজি হলো না।উল্টোপাল্টা তর্ক বির্তক লেগে গেলো একপক্ষ অন্যপক্ষের। রেহান আর রিফাত আহমেদ আর দেরী করতে চাইলো না বিধায় বিশ হাজার টাকা ক্যাশ ধরিয়ে বাকি ত্রিশ হাজারের মতো রনকের একাউন্টে ট্রান্সফার করলো। পরবর্তীতে যেন তা ওরা মিলে ভাগ করে নেয়। আপাতত ৫০ হাজার পেয়েই ওরা মোটামুটি খুশি।
এদিকে রেহান বাড়ি ঢুকে আগে একবার কেনীথের দিকে অগ্রসর হলো। আগে একবার কেনীথের সাথে দেখা করেই আনায়ার দিকে যাবে। আনায়ার থেকে প্রায় খানিকটা দূরে সোফায় কেনীথের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানেই পায়ের উপর পা তুলে অনবরত ফোনে স্ক্রল করে যাচ্ছে। সঙ্গে ওর সাথে ও পেছনে দুজন দুজন করে চারজন লোক পেছনে হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে।
রেহান আর ভাই গিয়ে কেনীথের সাথে দেখা করতে গেলে কেনীথ বসা থেকে দাঁড়িয়ে যেতে উদ্বেগ হলে রেহান বললো,
—“আরে না… না…ওঠার প্রয়োজন নেই। মিঃ কেনীথ আপনি যে আসবেন তা সত্যিই কল্পনা করিনি।থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ ফর কামিং হিয়ার।”
রেহানের বাঁধায় কেনীথ আর উঠে না দাঁড়িয়ে ওভাবেই বসা থাকা অবস্থাতেই বললো,
—“ইটস মাই প্লেজার, আমাকে আসতেই হতো।”
এরপর সাধারণ কিছু কথাবার্তা শেষে কেনীথের কাছ থেকে ফিরে এসে রেহান আনায়ার কাছে চলে গিয়ে ওর পাশেই বসে পড়লো।
রেহান আসতেই আনায়া ওকে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো,
—” এতো দেরী করলে কেনো?”
আনায়াকে এমন অস্থির হতে দেখে রেহান মুচকি হেসে বললো,
—“বাপ রে… আমার বউ তো দেখি বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছে। অথচ বিয়ের কথা শুনে…
—“রেহান প্লিজ মজা করো না। এতো দেরী করলে কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছিলো?”
—“হুম… তবে তেমন কিছু না। আমাদের গাড়ির সামনে একটা এক্সিডেন্টে হয়ে গিয়েছিলো। তখন…
—“তোমার কিছু হয়নি তো?”
আনায়ার চিন্তিত সুরে বলা কথা শুনে রেহান হেসে বললো,
—“আরে আমাদের গাড়ির সাথে নয়, ভিন্ন দুটো গাড়ির এক্সিডেন্ট হওয়াতে রাস্তায় লোকজন দিয়ে একটু সমস্যা হয়ে গিয়েছিলো বিধায় আসতে এতো দেরী। এতে আমার কি হবে বলো?”
আনায়া শুকনো মুখে বললো,
—“কিছু হওয়ারও প্রয়োজন নেই। তোমার কিছু হলে আমি কখনো সহ্য করতে পারবো না।”
—“আচ্ছা তুমি কি কোনো বিষয়ে চিন্তিত? তোমার মুখ এমন শুকনো লাগছে কোনো?”
—“নাহ…তেমন কিছু না।”
____________
আনায়া আর রেহানের কথার মাঝেই হঠাৎ রেহানের বাবা আর তারেককে নিয়ে ফরিদা সেখানে উপস্থিত হলো। কাজী যেহেতু বেশি দেরী করবে না সেহেতু দ্রুত বিয়েটা পড়িয়েই সে চলে যাবে। তাই বিয়ে এখনই পড়ানো হবে।
বিয়ে পড়ানো হবে বিধায় আশেপাশে সবাই ওদের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লো। সবার মাঝে টানটান উত্তেজনা। কাজী বিয়ে পড়ানোর সকল প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। রেহানের পাশে তার বাবা-ভাই অন্যদিকে আনায়ার পাশে ইনায়া, হুইল চেয়ারে বসা তারেক আর ফরিদা। সবার মাঝে আনন্দের পাশাপাশি বর্তমানে কিছুটা কষ্টের আভাসও মিলছে। বিশেষ করে আনায়ার কেনো যেন কষ্ট হচ্ছে। যদিও তাকে এখন তার পরিবার ছেড়ে যেতে হবে না তবুও আনায়ার এক অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে।
এরই মাঝে কাজী রেহানকে কবুল বলতে বললে রেহান অকপটে তিনবার বলে ফেললো,
—“কবুল, কবুল,কবুল।”
তার এতো তাড়াহুড়ো দেখে চারপাশের সবাই হেসে ফেললো। এরপর এলো আনায়ার পালা তখনই। কাজী আনায়াকে কবুল বলতে, আনায়া খেয়াল করলো ওর গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরোচ্ছে না। যেন গলায় কাটা বিঁধে আছে অথচ সে তো এই বিয়েটা করতে চায়। আনায়া বহু কষ্ট করে অস্ফুটেস্বরে বলতে লাগলো,
—“ক..বু…
বাকিটা আর সম্পূর্ণ হলো না। তার আগেই কেউ একজন জোর আওয়াজে বললো,
—” স্টপ দিস…!”
এই বলেই সানগ্লাসটা চোখে আরো খানিকটা ঠেলে দিয়ে পা থেকে পা নামিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো কেনীথ। এরপর প্যান্টের পকেটে এক হাত গুঁজে শিরদাঁড়া সোজা করে স্টেজের দিকে অগ্রসর হল।
এদিকে কেনীথের এমন বিহেভে বাকি সবাই যতটা না অবাক হলো তারচেয়ে বেশি অবাক আনায়া হলো। এই ভয়ই সে করছিলো। কেনীথ কিছু তো একটা ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা করবেই। এইজন্য তো তার এই লোককে কোনোভাবেই সুবিধার মনে হয়নি। কিন্তু এখন সে করতে চাইছেটা কি?
কেনীথ মুচকি হেসে স্টেজের সামনে এসে দাঁড়ালে রেহান কিছুটা অবাক সুরে বললো,
—“মিঃ ভিকে, এনি প্রব…
রেহানের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কেনীথ বাঁকা হেসে বললো,
—“নাও ইট’স মাই টার্ন!”
#চলবে