একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-২১

0
53

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#পর্বঃ২১
#তুশকন্যা

–“নাও, ইট’স মাই টার্ন! ”

কেনীথের এমন হাবভাব দেখে কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ এসব কি বলছে কেনীথ। সবাই যখন বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে তখন কেনীথ কালো সানগ্লাসের নিচ হতে একবার তারেক শিকদারের দিকে নজর ফেলে কিছুক্ষণ স্তব্ধ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। যা কারো নজরেই পরলো না।

কিছুসময় অতিক্রম হওয়ার পর কেনীথ পুনোরায় সরাসরি আনায়া আর রোহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর পেছনের দিকে একবার তাকিয়ে তার লোকদের কিছু একটা ইশারা করতেই বাড়ির ভেতরে থাকা চারজনের মাঝে একজন দৌড়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেলো।

এদিকে কেনীথ ধীর পায়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো। একটা সময় পর ঠিক আনায়া আর রেহানের সামনে এসে সটানভাবে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। তার এই হাবভাবে প্রত্যেকেই এখন ধীরে ধীরে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইছে। সঙ্গে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বলার জন্য উদ্বেগ,সেই মূহুর্তেই কেনীথ নির্বিকারে বলতে লাগলো,

—“সবার সাথে দেখা করে ভালো লাগলো। কিন্তু আজ এই পর্যন্তই….

তার এই অসম্পূর্ণ কথায় সবার কপাল আরো খানিকটা কুঁচকে গেলো৷ তবে কিছুক্ষণের মাঝেই তা স্বাভাবিকও হতে লাগলো। যখন বাহির থেকে কেনীথের বডিগার্ড এসে কেনীথকে একটা গিফট পেপারে মোড়ানো ছোট বক্স দিতেই কেনীথ তা হাতে নিয়ে রেহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

—“বেস্ট উইশেস ফর ইউর নেক্সট লাইফ। এই ছোট্ট গিফটটা আমার পক্ষ থেকে। আর বেশি দেরী করা ঠিক হবে না। তাই এখনই দিয়ে দিলাম।”

কেনীথের এমন কথায় সকলেই তটস্থ হয়ে মুচকি হেসে ফেললেও আনায়া বরাবরের মতো কেনীথের দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে। অন্যদিকে রেহান হুট করে ত্বরিত দাঁড়িয়ে গিয়ে কেনীথের উদ্দেশ্যে মুচকি হেসে বললো,

—“আপনি আর কিছুক্ষণ থাকলে খুশি হতাম। তবে…ইট’স ওকে, আপনি আপনার ব্যস্থ সময় থেকে যে আমাদের জন্য এইটুকু সময় বের করেছেন এটাই অনেক। ইউ আর রিয়েলি সো হাম্বেল ম্যান।”

রেহানের কথা শুনে কেনীথ শুধু মুচকি হাসলো। তবে সেখান থেকে এক পাও নড়লো না। এইবার কেনীথ একহাতে নিজের কালো সানগ্লাসটা খুলে টিশার্টের সাথে ঝুলিয়ে আনায়ার দিকে তাকিয়ে অকপটে বললো,

—“এবার তবে যাওয়া যাক?”

কেনীথের কথায় আনায়া আরো খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেললো। মনে মনে বলতে লাগলো, চলে যাচ্ছে তো ভালো কথা তবে এতো কাহিনির কি রয়েছে। আবার কাহিনি করে তাকেও জানিয়ে যাচ্ছে। তবে কেনীথের এই কথার উদ্দেশ্য আনায়া ঠিক বুঝতে পারেনি। সবার মতো সেও ভেবেছে যে কেনীথ চলে যাচ্ছে বিধায় তাকে জানালো অথচ কেনীথ চাইছে তো অন্যকিছু। আর সবার এই ভুল ধারণা তখন ভাঙ্গতে লাগলো যখন কেনীথ আচমকা, আনমনে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা আনায়ার হাত ধরে হেঁচকা টানে নিচের কাছে নিয়ে গেলো।

হাতে এতো জোরে টান দেওয়ায় আনায়া নিজেকে ব্যালেন্স করতে না পেরে কেনীথের টার্গেট অনুযায়ী সোজা ওর বুকে আঁচড়ে পড়লো। মূহুর্তেই প্রত্যেকের চোখ ছানাবড়া। রেহান ত্বরিত কপাল কুঁচকে কেনীথের উদ্দেশ্যে খানিকটা গর্জে উঠে বলতে লাগলো,

—“হোয়াট দ্য হেল… এসব কোন ধরণের অসভ্যতা?”

রেহানের কথায় তাচ্ছিল্যের সুরে কেনীথ বললো,

—“আই সেইড, নাও ইট’স মাই টার্ন।”

এদিকে আনায়া কেনীথের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে ছুটবার চেষ্টা করছে। কেনীথ একহাতে আনায়ার দুহাতকে পেছন থেকে শক্ত করে ধরে রইছে। এমন ভাবে ধরেছে যেন আরেকটু হলেই হাতটাই ভেঙ্গে দিবে। একদিকে নিজের সব রাগগুলোকে আনায়ার হাতের উপর ফেলছে অন্যদিকে স্বাভাবিক থাকতে মুচকি হাসছে। এই হাসি যে নির্ঘাত শয়তানি কুমন্ত্রণার ফল তা আর কারো বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু কেনীথ সঠিক উদ্দেশ্য কি করতে চাইছে, তাই কেউ বুঝতে পারছে না।

অন্যদিকে আনায়া যেমন বিস্মিত চোখে আশপাশ দেখছে তেমনি ওর ভেতরের রাগটা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। যার দরূন প্রথম দিকে বিস্মিত চোখে কেনীথের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেও মূহুর্তেই ওর কাছ থেকে ছাড়া পেতে হাত মোচড়া মুচড়ি করতে লাগলো।

রেহানের বাবা কিংবা ফরিদা-তারেক সহ বাকি সকলেই অবাক। তারা এই মূহুর্তে ঠিক কি রিয়েক্ট করবে তাও বুঝতে পারছে না। এরই মাঝে রেহান আনায়ার দিকে অগ্রসর হতে নিলে হঠাৎ সাবার কিঞ্চিৎ চিৎকার শুনে রেহান সহ বাকি সকলেই পাশে ফিরে তাকালো। এরপর ওরা যা দেখলো তাতে স্টেজে থাকা প্রত্যেকেই চরম বিস্ময় নিয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়লো।

স্টেজের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা রোহান, সাবা, ইমন, রনক সহ আনায়া আর ইনায়ার সকল ফ্রেন্ডেরদের পেছনে কেনীথের সেই কালো পোশাক পড়া বডিগার্ড গুলো তাদের মাথার পেছনে গান ঠেকিয়ে ট্রিগারে আঙ্গুল ছুঁয়ে সটানভাবে দাঁড়িয়ে। যেন আদেশ পাওয়া মাত্রই তারা প্রত্যেকের মাথায় গুলি ঢুকিয়ে দিতে কিঞ্চিৎ পরিমানও দ্বিধাবোধ করবে না। তবে অবাক করা বিষয় হলো, বাড়িতে এতোক্ষণ চারজন লোক থাকেও বর্তমানে ১২-১৪ জন লোক চারপাশে নজরে পড়ছে। কিন্তু বাকি লোকগুলো ঠিক কখন আর কিভাবে ভেতরে এলো তাই কেউ খেয়াল করেনি।

কেনীথের লোকগুলোর কিছুজন বাহিরে পাহারা দিচ্ছিলো আর কিছুজন গাড়িতেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। কেনীথের সামান্য ইশারা পাওয়া মাত্রই তারা সকলের বিস্ময়ের ঘোর কেটে ওঠার আগেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে নিয়েছে।

রেহান এবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে চাইলো। সহজে খুব বেশি রেগে গিয়ে সিনক্রিয়েট করার মতো লোক রেহান নয় কিন্তু কেনীথ যেসব করছে তাতে সবার মতো এসব কিছু ওর মাথার উপর দিয়ে গেলেও প্রচন্ড রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে দাঁত খিঁচে বলতে লাগলো,

—-“মিস্টার কেনীথ! এসব কি হচ্ছে প্লিজ বলবেন? আপনি কি এসব আমাদের সাথে মশকরা করছেন?আর যদি করেই থাকেন তবে এসব কেমন তামাশা ?”

রেহানের কথায় কেনীথ মুচকি হেসে অকপটে বললো,

—“উহু, আমি তো মশকরা করছি না। আমি যা করছি তা সব ভেবে চিন্তেই করছি।”

—“তবে আপনি চাইছেন টা কি? ”

রেহানের চিৎকারের আওয়াজ শুনে কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে বললো,

—“ডোন্ট শাউট। আই ডোন্ট লাইক ই্যালিং।”

—“আপনার পছন্দ অপছন্দতে আমার কিছু যায় আসে না। আপনি আনায়াকে ছাড়ুন…

এই বলেই রেহান আনায়া ছাড়িয়ে নিতে অগ্রসর হলে পেছন থেকে বডিগার্ডদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠলো,

—“একপা-ও কেউ নড়াচড়া করলে একটা গুলিও মাটিতে পড়বে না।”

রেহান পেছনে তাকিয়ে সেই লোকটাকে দেখে তীব্র রাগান্বিত চোখে কেনীথের দিকে তাকাতেই কেনীথ বলতে লাগলো,

—“আমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য এখানে আসিনি। যেটা আমার সেটা শুধু আমারই। অবশ্য আমাকে আমার প্রাপ্যটা নিতে এতো কিছু আয়োজনের প্রয়োজন ছিলো না কিন্তু সবাই যেখানে এতো আয়োজন করেছে সেখানে আমি তো সামান্য আয়োজন করতেই পারি।”

এরই মাঝে রিফাত আহমেদ কপাল কুঁচকে বললো,

—“আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে? কখন থেকে এসব কি বলে যাচ্ছেন। যা বলার সরাসরি বলুন।”

কেনীথ মুচকি হেসে বললো,

—“আমার আর কিছু বলার নেই। এখন যাবার সময় এসেছে।”

এই বলেই কেনীথ সামনে থেকে পেছনের দিকে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে, স্টেজ থেকে নিচে উল্টো হয়ে লাফিয়ে পড়ে। অন্যদিকে আনায়ার হাত কেনীথের হাতে মুষ্টি বন্ধ থাকায় কেনীথ নিচে নামতে থাকা অবস্থাতেই আনায়ার হাত ধরে সজোড়ে টান দিলে, আনায়া সোজা কেনীথের বুকের উপর তাল সামলাতে না পেরে পুনোরায় আঁচড়ে পড়ে।

এদিকে রেহান আটকাতে এলে পেছন থেকে ওকে সহ বাকি সবাইকেও কেনীথের আরো কিছু লোক গিয়ে ওদের মাথায় গান ঠেকিয়ে ধরে।

অন্যদিকে কেনীথ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল টাইপের একটা লম্বা শক্ত কাপড় বের করে পেছন দিক থেকে আনায়ার বেঁধে দিতে দিতে বলতে লাগলো,

—“প্রত্যেকটা গানে সাইলেন্সার লাগানো রয়েছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু সোজা….

এটুকু বলেই যখন কেনীথের হাত বাঁধার কাজ হয়ে গেলো তখনই আনায়াকে একহাতে নিজের কাঁধে তুলে ঝুলিয়ে নিয়ে, অন্যহাতটা একটু স্টাইলের সাথে ঝেড়ে দিয়ে নিজের সানগ্লাসটা চোখে পড়ে নিলো। এরপর হাত দিয়ে উপরের দিকে ইশারা মুখ দিয়ে শিশ বাজিয়ে সবাইকে শেষ করে দেওয়ার ইঙ্গিত দিলো।

এদিকে আনায়া গলাকাটা মুরগির মতো ঝটফট করছে। প্রথমে সেভাবে চিল্লাচিল্লি না করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও বর্তমানে কেনীথ যখন তাকে ওভাবে উল্টোকরে ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হতে নিলো, তখন যতটা পারলো রেহান আর ওর বাবাকে ডেকে চিৎকার করতে লাগলো।

কিন্তু একদিকে নিজের দুহাত শক্ত করে পেছনে বাধা তার উপর পরনে তার ভারী গয়না, জামা,দোপাট্টা যেগুলো এলোমেলো ভাবে কখনো মুখে আঁচড়ে পড়ছে তো কখনো এসবের জন্য সে অস্থির হয়ে পড়ছে।

বাকি সকলে বন্ধুকের ভয়ে চুপ করে রইলেও রেহান অনবরত আনায়ার নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলো। একটা পর্যায়ে আনায়া আর রেহানকে থামাতে টিশার্টের নিচে অর্থাৎ প্যান্টের পেছনে গুঁজে রাখা গানটা বের করে সরাসরি পেছনে ঘুরে শক্তমুখে রেহানের পায়ের কাছে স্টেজ বরাবর দুটো গুলি ছুঁড়তেই প্রত্যেকেই আকস্মিকভাবে নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো।

অন্যদিকে পেছনের দিকে মুখ করে থাকা আনায়া তো ভেবেই নিলো কি না কি হয়ে গিয়েছে। তবে কেনীথ যখন সময় নষ্ট করতে না চেয়ে পুনোরায় উল্টো ঘুরলো তখন রেহানের সেই স্তব্ধ অশ্রুসিক্ত চেহারের দিকে চেয়ে আনায়া চোখের জল ফেলতে লাগলো। সে কোনোদিনও কল্পনাতেও এমন দিনের কথা ভাবেনি। এ কেমন বিচ্ছেদ হচ্ছে তাদের।

মূলত তাদের প্রত্যেকের কাছেই এই সকল কিছু কাল্পনিক মনে হচ্ছে। কেউ এখনো বুঝতে পারছে না এগুলো তাদের সাথে কি হচ্ছে আর কেনো হচ্ছে।

এদিকে সবার যেখানে বিস্ময়ের ঘোরই কাটেনি সেখানে ইনায়া তাকে ধরে রাখা লোকটির থেকে নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে কেনীথের যাওয়ার পথে বাঁধা দিয়ে হুশিয়ারি গলায় বললো,

—“এসব কেনো করছো ভিকে? আমার বোনকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”

তার কথা শুনে কেনীথ নিজের পা জোড়া থামিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো,

—“কোনো বাচ্চাকে কৈফিয়ত দেবো না আমি।”

এটা শুনে ইনায়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে কেনীথকে দেখে পুনোরায় তীব্র রাগান্বিত সুরে বললো,

—“আমাকে তোমার বাচ্চা মনে হয়?….মনে হলে হোক,কিন্তু আমার বোনকে খবরদার কোথাও নিয়ে যাবে না নয়তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”

কেনীথ ইনায়ার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে পাশে মুখ ঘুরিয়ে দুটো লোককে ইশারা করলে দুজন লোক এসে ইনায়াকে পেছন থেকে শক্ত করে ধরে ফেললো।

এদিকে ইনায়া আনায়ার নাম ধরে চিল্লাচ্ছে তো অন্যদিকে আনায়া ইনায়ার নাম ধরে। কিন্তু এতোসবকিছুর কোনোটাতেই কেনীথ ভ্রুক্ষেপ না করে নিজ গতিতে ধীরে ধীরে বাড়ির বাহিরে চলে গেলো। তবে পেছন থেকে ইনায়ার সর্বশেষ কথা কানে এলো আর যা শুনে কেনীথ আবারও তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হেসে ফেললো।

—“আই সয়ার, আমার বোনের কিছু হলে আমি কখনো তোমায় ছেড়ে দেবো না ভিকে। তোমার পুরো লাইফ আমি হেল করে দেবো।”

_____________

আনায়া বাহিরে আসতেই চমকে উঠলো। আশেপাশে তার জানামতে কেউ নেই। চারপাশে কালো সন্ধ্যার ঘোরে ঢেকে গিয়েছে। রাস্তার ল্যাম্প পোস্টগুলো পর্যন্ত বন্ধ। আর সবচেয়ে বড় বিষয় মহল্লার এতো লোকজন যাদের সবসময় আনায়ার বাড়ির সামনের রাস্তায় যাতায়াত চলে, তাদের কেউই নেই। চোখ যতদূর যাচ্ছে ততোদূর পর্যন্তই শুধু কেনীথের লোকজন দিয়ে পূর্ণ।

আনায়ার হুট করে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,

—“এখন চেচাচ্ছিস না কেনো? চিল্লাতে থাক, বেশি বেশি চিল্লাতে থাক। কেউ আসবে না। সবগুলোকে সীমানার বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

কেনীথের কথা শুনে আনায়া আবারও ক্ষিপ্ত সুরে বললো,

—“ছেড়ে দে আমায়, কেনো আমার সাথে এমন করছিস।”

আনায়ার কথা শেষ হওয়ার মাঝেই কেনীথ নিজের গাড়ির দরজা খুলে আনায়া ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিলো। এরপর নিজেও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে দরজাটা সজোরে বন্ধ করে আনায়ার দিকে মুখ এগিয়ে, গাড়িতে জ্বলতে থাকা সামান্য আলোয়ও ওর ক্ষিপ্ত মুখটাকে কিছুক্ষণ দেখে মুচকি হেসে বললো,

—“ছেড়ে দেওয়ার জন্য তো ধরে আনিনি বেবস্। অবশ্য ছেড়ে তো আমি আগেই দিয়েছিলাম কিন্তু নিজেকে শেষ করতে তো ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত আমার কাছেই এলি।”

আনায়া কেনীথের কথার উদ্দেশ্য না বুঝতে পারলেও কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে রাগান্বিত স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকার পর কেনীথ যখন আনায়ার ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে নিজের হাত অগ্রসর করলো, তখনই আনায়া নিজের পা দুটো একসাথে করে আচমকা কেনীথ পেটের একপাশ বরাবর সজোরে আঘাত করলো।

এতে কেনীথ খানিকটা ব্যাথা পেলেও তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে আনায়ার কাছ থেকে মুচকি হেসে সরে গিয়ে স্টিয়ারিং-এ দুহাত রেখে বললো,

—“আমি ওতোটাও অ্যাগ্রেসিভ নই। ওসব করার জন্য অনেক সময় পরে আছে। এখন তো চাইলেই প্রতিনিয়ত ওসব হতে পারে।”

এই বলেই কেনীথ আনায়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে, একচোখ মেরে মুচকি হেসে ত্বরিত গাড়ি স্টার্ট দিলো। অন্যদিকে কেনীথের উলটোপাল্টা ইন্টেশন ঠিকই বুঝতে পেয়ে চোখমুখ শক্ত করলেও, আদতে কেনীথ এই মূহুর্তে তেমন কিছুই করতে চায়নি। শুধু আনায়া ঠোঁটের ক্ষতটা একটু ছুঁয়ে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিলো।

_____________

যখনই গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিলো তখনই আনায়া প্রায় অনেকক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করেছে। আর কেনীথ মুচকি হেসে বিনোদন নিয়েছে। কারণ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর যখন ও আনায়াকে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে গাড়ির ভেতরের আওয়াজ বাহিরে যাবে না তখনই ও চুপ করে গিয়েছে।

প্রায় অনেকটা রাস্তা অতিক্রম করার পর কেনীথ তার নিজের গন্তব্যে পৌঁছালো। চারপাশে অন্ধকার থাকায় সেভাবে কিছু খেয়াল না করলেও মাঝ রাস্তার কিছু অংশে পর্যাপ্ত আলোর দেখায় মেলায় আনায়া এতটুকু বুঝেছিলো যে তারা কোনো জনবহুল এলাকার রাস্তায় রয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কেনীথ যখন পুনোরায় এক অজানা অন্ধকার রাস্তার দিকে অগ্রসর হলো তখন আর আনায়া ঠিকমতো কিছুই বুঝতে পারলো না।

একদিকে তার যেমন ভয় করছিলো তেমনি তার পরিবারের জন্য হচ্ছিলো প্রচন্ড কষ্ট। বিশেষ করে রেহানের জন্য। আনায়া এখনো জানে না সে কাকে দোষারোপ করবে। নিজের এই দুভার্গ্য নাকি কেনীথকে। কেনীথের উদ্দেশ্য যে বরাবরই ভালো ছিলো না তা আনায়ার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু যখন তার মনে হচ্ছে কেনীথ শুধু তাকে পাওয়ার জন্যই এসব করছে তখনই আবার মনে হচ্ছে আদতে এমন কিছুই নয়। কেনীথের কিছু কথা তাকে পুনোরায় ভাবাচ্ছে। একে তো কেনীথকে সে না চিনলেও কেনীথ তাকে ঠিকই আগে থেকে চেনে। অন্যদিকে কেনীথের কিছু কিছু কথা শুনে তার মনে হচ্ছে কেনীথ তাকে কষ্ট দিতে চাইছে। প্রচন্ড কষ্ট যা হয়তো তার প্রতিশোধ। কিন্তু আদতে আনায়া এমন কি করেছে যার কারণে কেনীথ এমন কিছু করছে।

কেনীথ যখন তার সেই চিরপরিচিত বিলাসবহুল বাড়ির অগোচরে ঢাকা নৃ*শংস মৃত্যুর কার*খানায় পৌঁছালো। তখন গাড়ি থেকে নামা মাত্রই আনায়া চারপাশে চেয়ে দেখতেই ও অজানা শিহরণে চমকে উঠলো। নিশুতি রাত, সঙ্গে চারপাশে জ্বালিয়ে রাখা সামান্য আলোয় তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

চতুর পাশে অসাধারণ সব ফুলের গাছ তবুও পরিবেশটা অতন্ত্য শিহরণ জাগানোর মতো। ফুল ফলের গাছ ছাড়াও বিশাল বড় এরিয়ায় জুড়ে অবস্থানরত বাড়ির চারপাশে বিশাল বড় প্রাচীরের চার পাশে আকাশ ছোঁয়া গাছপালা। এমন জায়গাও যে এই শহরে রয়েছে তা আনায়ার কাল্পনিক মনে হচ্ছে।

আনায়াকে এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্য বললো,

—“একা একাই যাবি নাকি কোলে তুলতে হবে।”

আচমকা নিজের ধ্যানের মাঝে কেনীথের আওয়াজ শুনে আনায়া চমকে উঠে ঢোক গিললো। পরক্ষণেই কেনীথকে জিজ্ঞেস করলো,

—“এটা কোন জায়গা।”

—“এটা সেই জায়গা যে জায়গা থেকে তোর পালানোর কোনো উপায় নেই। চারপাশের প্রাচীরে ইলেক্টিক শক্ এর ব্যবস্থা রয়েছে। আমার অনুমতি ব্যতীত কেউ এই বাড়িতে না ঢুকতে পারে আর না বের হতে। আর আগামী ততদিন তোকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে যতদিন পর্যন্ত না আমার মুড চেঞ্জ হয়।”

আনায়া বিস্ময়ের সঙ্গে কেনীথের কথা গুলো শোনার মাঝেই কেনীথ একা একাই বাড়ির ভেতরের দিকে অগ্রসর হলো। অন্যদিকে আনায়া কিছুক্ষণ থমকে দাড়িয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখার পর, কেনীথ পেছন পেছন বাড়ির ভেতরের দিকে যেতে লাগলো। একদিকে যেমন ভারী লেহেঙ্গা অন্যদিকে হাতদুটো পেছনে বাঁধা। চলতে খানিকটা কষ্টও হলো ঠিকই কিন্তু কেনীথের কাছে সাহায্য চাওয়ার কোনো মানে নেই।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অটোমেটিক পেছন থেকে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনায়া চমকে উঠলো। তা দেখে কেনীথ নির্বিকারে বললো,

—“ভুতের বাড়ি ভাবার প্রয়োজন নেই… রিমোট কন্ট্রোল।

ততক্ষণে আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে দেখলো কেনীথ একটা ছোট রিমোট সদৃশ কিছু একটা ছোট টেবিলের উপর রাখলো।

বাড়ি তো নয় যেন রাজ প্রাসাদ। তবুও চারপাশে ডিজাইন আর লাল-হলুদ ডিম লাইটের আলোয় ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করছে। হুট করে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনায়া তো প্রায় ভেবেই নিয়েছিলো কেনীথ মানুষ নয় অন্যকিছু। কিন্তু এখন নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে মনে মনে ভাবলো কেনীথ হলো মানুষ রুপী এক শয়তান। তা ছাড়া কিছু নয়।

আনায়া আরো খানিকটা চারপাশে তাকিয়ে দেখলো বিশাল বড় ডাইনিং রুমে অনেকগুলো সোফা সহ আরো নানা শৌখিন জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা। আবার বাড়ির ঠিক মাঝখান বরাবর বিশাল বড় সিঁড়ি। আনায়া কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো পাশে থাকা সুইমিংপুলের দিকে। বাড়ির মাঝে এমন সুইমিংপুলে নীল পানিগুলোর উপর আলোর প্রতিফলনে পানিগুলো চিকচিক করার পাশাপাশি সামান্য ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

এতোটুকু দেখেই আনায়া আর বেশি কিছুতেই নজর দিতে পারলো না। তার আগেই সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,

—“এসব দেখার জন্য আরো অনেক সময় পড়ে আছে। আগে উপরে চল।”

কেনীথের কথার উত্তরে আনায়া ঠোঁট ভিজিয়ে শক্ত গলায় বললো,

—“আমার হাতটা খুলে দিন।”

কেনীথ কেনীথ সিঁড়ি বেয়ে যেতে নিলেও পুনোরায় আনায়ার কথা শুনে ফিরে তাকিয়ে বললো,

—“বললাম তো,কোনো উপায়েই এখান থেকে পালাতে পারবি না।”

—“আমার এভাবে চলতে প্রবলেম হচ্ছে। হাত ব্যাথা হয়ে গিয়েছে আমার।”

কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে বললো,

—“আগে উপরে চল, তারপর খুলে দিচ্ছি।”

এই বলেই কেনীথ উপরে যেতে লাগলো অন্যদিকে আনায়াও কেনীথকে অনুসরণ করে ওর পেছন পেছন যেতে লাগলো। এরই মধ্যে দেওয়ালের মাঝে সাজিয়ে রাখা নানান ভিন্টেজ স্টাইজ কিংবা মর্ডান স্টাইলের অদ্ভুত সব পেইন্টিং নজরে এলো।

আনায়া এখানে আসার পর খেয়াল করলো পুরো জায়গাজুড়ে ভিন্টেজ স্টাইলের অদ্ভুত এক আবহ বিদ্যামান। কেমন যেন আধুনিক আর ভিন্টেজ, দুটোর খুব কৌশলে সংমিশ্রণ করে পুরো জায়গাটা সাজানো। নিত্যান্তই এসব কিছু আনায়ার জীবনের প্রথম দর্শন।

আনায়া কেনীথকে অনুসরণ করে যেতে কয়েকবার পেইন্টিং গুলো কাছ থেকে যতটা পারলো কপাল কুঁচকে দেখে নিলো।অদ্ভুত ভাবে কিছু চোখ, অদ্ভুত সকল ফুল, চিত্র নয়তো মেয়েদের মুখশ্রী খুব নিপুণ হাতে তৈরি করা হয়েছে। সবগুলো পেইন্টিং যদিওবা দেখতে যথেষ্ট সুন্দর কিন্তু এসব দেখে আনায়ার মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। কেমন যেন বারবার তার মাঝে অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠছে।

আনায়া আর বেশি দেরী না করে কেনীথকে যথারীতি অনুসরণ করতে লাগলো। যেহেতু চিল্লাচিল্লি করে কেনীথের কাছ থেকে পার পাওয়া যাবে না সেক্ষেত্রে নিজের শক্তি অপচয় না করে কৌশলে কাজ করাটাই শ্রেয়।

এরই মাঝে কেনীথ একটা রুমের সামনে এসে থেমে গেলে আনায়াও থেমে যায়। এরপর কেনীথ দরজা খুলে দিয়ে আনায়াকে ভেতরে যেতে বললে আনায়া থমকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আনায়া মনে মনে ভাবছে কেনীথ হয়তো বা তাকে আটকে রাখতে চাইছে। কিন্তু কেনীথ তাকে রুমের মধ্যে আঁটকে রাখলে সে এখান থেকে বাহিরে বের হবে কি করে।

এদিকে কেনীথ হয়তো বিষয়টি বুঝতে পারে তাই আনায়ার উদ্দেশ্যে বলতে লাগে,

—“বন্দীদের জন্য জেলখানা হয় খুব ছোট একটা জায়গায় কিন্তু আমার এখানে যারা আসে তারা খুব স্পেশাল হয়। যে কারণে আমার সম্পূর্ণ বাড়ি আর যাস্ট স্পেসিফিক একটা রুমের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। পুরো বাড়িটাই একটা বন্দিশালা।
যদিও পূর্বে যারা এসেছে তারা তোর মতো কোনো সুযোগ সুবিধা না পেলেও তুই যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা পাবি। যা যা প্রয়োজন সবকিছু। শুধু আমার ইচ্ছে ব্যতীত পালাতে পারবি না।
তাই বেশি না ভেবে যা করতে বলছি কর। তোকে যাস্ট রুমে আঁটকে রাখার নিয়তে আমি নিয়ে আসিনি। ”

আনায়া কেনীথের কথামতো রুমে ভেতরে প্রবেশ করলো। রুমের ভেতরে গিয়ে আরেক দফায় অবাক হলো। বিশাল বড় রুমটার একপাশে বড়সড় এক বারান্দা। চতুর পাশে দেওয়াল আর আসবাবপত্র গুলোতে কালচে লাল-কালোর ছোঁয়া। আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না সে আদোও কোথায় এসে পরলো। কখনো চারপাশ সম্পূর্ণ ভুতের আস্তানা মনে হচ্ছে তো কখনো মনে হচ্ছে তেমন কিছুই নয়। শুধু ডিজাইন গুলোই এমন ভাবে করা হয়েছে।

আনায়া ভেবে পায় না একটা লোক এতোটা অদ্ভুত হয় কি করে। তার ব্যক্তিত্ব, পছন্দ সবকিছুই এতো অদ্ভুত। আর তার মাথায় যে আদোও চলছেটা কি তা তো আনায়ার কল্পনাতেও খেলছে না।

হুট করে তার পেছনে বেঁধে রাখা হাত জোড়ায় কারো হাতের ছোঁয়া মিলতেই আনায়া নিজের ধ্যান থেকে বেড়িয়ে চমকে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে নিলেই কেনীথ গম্ভীর কন্ঠে বললো,

—“নড়াচড়া করবি না।”

আনায়া কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়লে সেই মূহুর্তের মাঝেই কেনীথ আনায়ার হাত দুটো খুলে দিলো। আর আনায়া হাত খুলে দেওয়ার ফলে, ছাড়া পেতেই ত্বরিত ছিটকে কেনীথের কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়ে তীব্র রাগান্বিতস্বরে বলতে লাগলো,

—“এখন বলুন, কেনো নিয়ে এসেছেন আমায়। কি চাই আপনার, সরাসরি উত্তর দেবেন।”

আনায়ার রুপ হটাৎ এভাবে চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় কেনীথ কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর, ফিক করে বাঁকা হেসে নিজের ঠোঁটের নিচে স্লাইড করতে করতে বললো,

—“যাস্ট হাত ছাড়া পেয়েছিস বলে এতো সাহস জেগে উঠলো?”

এই বলেই কেনীথ আনায়াকে আরো কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই বললো,

—“যতক্ষণ না আমি আসছি এখানেই থাকবি। পালানোর যে কোনো উপায় নেই তা আশাকরি এখন প্র্যাকটিক্যালি দেখাতে হবে না।”

এতোটুকু বলেই কেনীথ আর কিছু না বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো। তবে যাওয়ার আগে দরজাটাও লাগিয়ে গেলো।

এদিকে আনায়া এমন অদ্ভুত ঘরটার চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিলো। বড় বেড, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, টি টেবিল সহ মোটামুটি সব কিছুই রয়েছে। আবার বারান্দায় কিছু গাছও দেখা যাচ্ছে।

কেনীথ দরজা বন্ধ করেছে বিধায় সে ক্ষিপ্ত হলো। মনে মনে ভাবলো একটু আগে কত ভাষণ দিলো অথচ এখন ঠিকই দরজা বন্ধ করে গিয়েছে। আনায়া উপায় না পেয়ে সোজা বারান্দায় যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো।

এমন নয় যে, তার এই অদ্ভুত বাড়িটাতে এসে এই মূহুর্তে কোনো ভয়ডর লাগছে না। মনের মাঝে অবাধ ভয় থাকলেও তা পরিবারের চিন্তায় আর সে মাথাটাকে ঠিক কিভাবে কাজে লাগালে এখান থেকে সহজে মুক্তি পাবে এই চিন্তাতেই পার হচ্ছে। কেনীথ যেহেতু সাধারণ কেউ নয় সেক্ষেত্রে আনায়া কান্নাকাটি চিৎকার চেচামেচি করেও কোনো লাভ নেই। কিন্তু করবেটা কি তাও তো বুঝে উঠতে পারছে না।

এরই মাঝে আনায়া বারান্দায় যেতেই দেখলো চারপাশ ঘনকালো অন্ধকারে ঢাকা। শুধু বাগানের মাঝে ছোট ছোট লাল আর হলুদ রংএর আলো জ্বলছে। সে আলোতে উপর তলা থেকে স্পষ্ট করে কিছু দেখাও যাচ্ছে না। রাত যে এখন কত তা আনায়ার আন্দাজে নেই। এখানে আসার পর আরো একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছে যে কোথাও কোনো ঘড়ি নেই। এতো বড় বাড়ি অথচ সময় দেখার জন্য কোনো ঘড়ি রাখেনি তা সত্যিই অদ্ভুত।

আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিত। কখনো মনে হলো এখান থেকে চিৎকার করে ডাকলে কি কেউ শুনবে। কেউ কি তার সাহায্যর জন্য আসবে? না আসুক,তার আওয়াজ যদি কেউ শুনে ফেলে তবে সে নিশ্চিত অন্যকাউকে জানাবে। একটা সময় হয়তো এমন কেউ তো নিশ্চিয় মিলবে যে এখানকার ঘটনা পর্যবেক্ষণে আগ্রহী হয়ে চলে এলো। এমনটা কি হওয়ার কোনো সম্ভবনা রয়েছে?

আনায়া জানে না। তার এখন কান্না পাচ্ছে। চোখে পানি ছলছল করছে। আদতে এই কেনীথ কে? তার কি উদ্দেশ্য? কি চায় সে, কিছুই তো তার জানা নেই। এতোবার কেনীথকে জিজ্ঞেস করেও তো কিছু জানতে পারেনি।

আনায়া এবার নিজের ঠোঁট চেপে ধরে নিজেকে শক্ত করলো। এই জায়গায় কেঁদে কেঁদে নিজেকে দূর্বল করার কোনো মানে নেই। ও এবার চিৎকার করার প্রস্তুতি নিলো। যা হবার দেখা যাবে। তবে কোনো চেষ্টাই বাদ রাখা যাবে না।

—“কেউ আছেন?… কেউ আমার কথা শুনতে পারছেন?…সাহায্য করুন আমায়… আমার সাহায্য প্রয়োজন…

কয়েকবার চিৎকার করেও কোনো লাভ হলো না। গলা শুকিয়ে গিয়েছে তার। খাবারের কথা না হয় বাদ দেওয়া যাক, প্রায় কয়েক ঘন্টায় পানি দিয়ে গলা ভেজানোর মতোও সুযোগে হয়নি তার। উল্টো এখন হতাশ হয়ে চোখ বেয়ে আপনা আপনি পানি ঝড়ছে।

এরই মাঝে হুট করে আনায়া পাশে তাকিয়ে আচমকা ভয়ের কারণে আকস্মিকতায় হকচকিয়ে পড়ে যেতে নিলে পুনোরায় নিজেকে সামলে নিলো। স্বল্প আলোও পাশের বারান্দার গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাতগুজে অনবরত তার দিকে চেয়ে থাকা কেনীথকে তার এতোক্ষণে নজরে না পড়লেও, যখন আচমকা সেদিকে নজর পড়লো তখন পুরো হকচকিয়ে গিয়েছে। অবশ্য হঠাৎ ভয়ের পাশাপাশি স্বল্প আলোতে কেনীথকে প্রথমে দানবীয় লেগেছে তার। যে কারণেই এমন অবস্থা।

এদিকে কেনীথ ওর অবস্থা দেখে শুধু একবার বাঁকা হেসে বারান্দা থেকে চলে গেলো। অন্যদিকে আনায়াও এসব কিছু আনায়ার নজর থেকে না এড়িয়ে গেলেও বেচারি পুরো স্তব্ধ মূর্তির মতো খানিকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

_________

রুমের মাঝে কিছুক্ষণ হা হুতাশ করলো আনায়া। পরনের এতো ভারী লেহেঙ্গা আর গহনা অসহ্য লাগছিলো বিধায় গহনাগুলো খুলে ফেললেও লেহেঙ্গার কোনো উপায় বের করতে পারিনি। কেনীথের কাছে প্রথমে এই বিষয়ে সাহায্য চাইতে গিয়েও নিজেকে থামিয়েছে। আবার পরক্ষণে ভেবেছে এভাবে আর কতক্ষণ। সে নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে এসবের জ্বালায়।

এই ভেবে আনায়া নিজের মাথার ঘোমটা, ফুল যা ছিলো তা খুলে ফেলে রুম থেকে বাহিরে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিলো। দরজার কাছে এসে ঠকঠকাতে গিয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই খেয়াল করলো দরজা খোলা। এর মানে কেনীথ দরজা খুলেই রেখে গিয়েছিলো? হতে পারে… তবে আনায়ার জানা নেই।

আপাতত পেটের ক্ষুধা সহ্য করার ক্ষমতা তার রইলেও এই ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে আর থাকা যাচ্ছে না। আনায়া আশেপাশে না তাকিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এলো। তবে আশায় আগে পাশে রুমটায় খেয়াল করে দেখেছিলো যে সেই রুমের দরজা পেছন থেকে লাগানো। এরমানে রুমে কেনীথ নেই।

যে কারণে আনায়া নিচে এসেই কেনীথকে খুঁজতে লাগলো। উদ্দেশ্য তার সাধারণ রইলেও যখন আশেপাশে চেয়ে কোথায়ও কেনীথ তার নজরে এলো না তখন আনায়া কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো কেনীথ কি এই বাড়িতে আদোও আছে নাকি চলে গিয়েছে?

মনে মনে খানিকটা খুশিও হলো। ত্বরিত বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। এতো বড় বিশাল কালো কাঠের দরজায় আনায়ার মতো মেয়ের ভেঙ্গে বের হওয়া অসম্ভব। তাই দরজা ধাক্কানোর মতো বোকামি কাজ সে এখন করবে না। ত্বরিত তার মাথায় এলো দরজা খোলার রিমোটের কথা। আনায়া দ্রুত বাড়ির চারপাশটায় খোজাখুজি করতে লাগলো।

প্রথমে কেনীথের রাখা সেই টেবিলের কাছে, পরবর্তীতে সোফা, আশেপাশের ছোট বড় সব টেবিলে খুঁজেও কোনো লাভ হলো না। চারপাশের কোথাও রিমোট নেই। এরই মাঝে হতাশা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লে তার নজর পড়লো সুইমিংপুলের পাশে একটা টেবিলের উপর।

মাঝারি আকারের টেবিলের মাঝ বরাবর লাল আর কালো রংএর গোলাপ ফুল সাজিয়ে রাখা একটা ফুলদানিতে আর চারপাশে ঝুড়িতে সাজিয়ে রাখা নানান ফল। তবে এসবের মাঝে চোখ পড়ছে তার সেই ছোট রিমোটটার দিকে।

আনায়া খানিকটা খুশিতে মুচকি হেসে দ্রুত সেখানে গিয়ে রিমোটাকে হাতে নিয়ে দরজার কাছে যাওয়ার কথা ভাবলেই হঠাৎ তার মনে হলো তার আশেপাশে কেউ রয়েছে। তবে সেদিকে তাল না দিয়ে আনায়া দ্রুত কৌশলে রিমোটাকে গোপন করার ব্যবস্থা করলো।

ছোট রিমোট সে তার পেটের কাছে লেহেঙ্গা কাপড়ের মাঝে রেখে উল্টিয়ে রেখে দিলো। আর ত্বরিত তার নজর ফলের ঝুড়িতে থাকা ছুরির দিকে যাওয়ার সর্বপ্রথম সেটাকে নেওয়ার জন্য অগ্রসর হলো। তার খুব করে মনে হচ্ছে কেউ খুব দ্রুত কেউ তার পেছন দিক থেকে এগিয়ে আসছে।
আনায়া দ্রুত ছুরিটা শক্ত হাতে তুলে নিয়ে পেছনের দিকে ঘুরে কোপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে শূন্যে হাত তুলতেই আচমকা তার ছুরি ধরা হাতটা কেউ খপ করে শক্ত হাতে মুঠো করে ধরে ফেললো। সঙ্গে একই সাথেই আনায়ার বাম হাতের আঙ্গুলের মাঝে পাঁচ আঙ্গুল ঢুকিয়ে তা ধীরেধীরে আনায়ার সামান্য উন্মুক্ত পেটের কাছে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে আনায়াকে তার বলিষ্ঠ দেহের মাঝে আবদ্ধ করলো।

আনায়ার আর বুঝতে বাকি নেই এই লোকটা কে। তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিলো যে কেনীথ চলে গিয়েছে এটা ভাবা।কিন্তু আপাতত কেনীথের হাত থেকে দরজার রিমোটটাকে গোপন করতে চাইছে। কিন্তু আদোও সেটা সম্ভব কিনা আনায়ার তা জানা নেই। আনায়া খানিকটা ঢোক গিয়ে বুক ফুলিয়ে কিছু একটা বলতে নিলেই তার শ্বাস আঁটকে গেলো।

কেনীথ যথারীতি তার ঘারের কাছে নিজের চোয়াল ঠেকালো। এরপর আনায়ার সম্পূর্ণ কানের কাছে গিয়ে খুব ধীরে তাচ্ছিল্য, গম্ভীর আর হাস্কির এক অদ্ভুত মিশ্রণের সুরে বলতে লাগলো,

“গেম তো যাস্ট শুরু হলো। এতো তাড়াতাড়ি পালাতে চাইলে কি করে হবে? পুরো আয়োজন তো এবার সব তোর জন্যই। তোকে ছাড়া এবারে গেম তো জমবে না, মাই ব্লাড।”

#চলবে