একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৩৯(২য় অংশ)

0
14

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
পর্ব→৩৯(২য় অংশ)

“আনায়া, আমার ধূসর আকাশের একমাত্র আগুনপাখি।

তুই রাগ করে আছিস, না অভিমান?…আমি তা জানি না। জানি শুধু, তুই নিঃশব্দ হলে আমার ভেতরে সব শব্দ মরে যায়।
তোর চোখের চাহনি ব্যতীত,আমি পৃথিবীর বুকে হারিয়ে যাওয়া এক দিকভ্রান্ত পথিক।
তুই আমার চোখে আঙুল দিয়ে পথ দেখানো আগুন। তুই ছাড়া আমি অন্ধ, হাওয়ায় ভাসা শুধু একটা পোড়া কাগজ মাত্র।

আমি জানি, তোর কাছে আর কোনো অধিকার নেই আমার। তবু, আজ এই চিঠি লেখার সাহস করছি, শুধু একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে।তোর কাছ থেকে ক্ষমা চাইবার জন্য। ক্ষমা কি পাওয়া যায়? আমি তো জানি না। কিন্তু যদি সামান্যও সুযোগ থাকে। আমি আবার চাই,তুই মুখে নয় বরং মন থেকে আনায় ক্ষমা করে দে। যেন আমার ভুলগুলো কিছুটা শোধরানো যায়।

তুই যখন চলে গেলি, আমি তখন জানলাম, আমি আসলে কী ভয়া”নক একটা অপ”দার্থ ছিলাম।আসলে আমি শুধু এক অপ”দার্থ নয়,বরং গাধা,সাই’কো.. যাকে ভালোবাসার মতো একটি অনুভূতি কখনো বুঝতে দেওয়া হয়নি।শুধু নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছি…সামান্য কিছু প্রাপ্তির জন্য…নিজের অহংকারের খাঁচায় নিজেই বন্দী হয়ে গিয়েছি।
এখন ভাবলে মনে হয়, তুই আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করলি, কিন্তু আমি তো শুধু নিজের ন”ষ্ট চিন্তা আর আত্মকেন্দ্রিকতা দিয়ে তোর সবটা নষ্ট করে ফেলেছি।

তুই চলে যাওয়ার পর থেকে আমি বুঝেছি, আমি কিছুই ঠিক করতে পারি না। ভেবেছিলাম তোকে ছাড়া আমি ঠিকই বাকিটা জীবন একাই কাটিয়ে দিতে পারব, কিন্তু নাহ! আমার সমস্ত চেষ্টা, সমস্ত পুরনো গর্ব, সব কিছু যেন হারিয়ে গিয়েছে।আমার বেঁচে থাকাই এখন মুশকিল হয়ে দাড়িয়েছে। আমি নিজেকে কখনো এতটা অ”পদার্থ, এতটা ন”ষ্ট, এতটা শূন্য মনে করি নি। যতটা তোর থেকে দূরে সরে গিয়ে অনুভব করছি।

আনায়া! তুই জানিস না, আমি প্রতিদিন কিভাবে তোকে হারিয়ে আবার খুঁজে বেড়াই।তোকে ছাড়া আর আমার জীবন দমবন্ধকর। তুই ছাড়া আমার দিনগুলো সব ফাঁকা খাম এর মতো।যার না আছে কোনো চিঠি, আর না আছে কোনো ঠিক ঠিকানা।
আমি হয়তো আর সবার মতো ভালোবাসা দেখাতে পারিনা…কিন্তু আমি তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি।

আজ এই চিঠিতে আমি আর পেছন ফিরতে চাই না।আমি চাই তুই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, রাগে ভ”রা চোখ নিয়ে বলিস,

“আপনি কিছুই বোঝেন না,আপনি একটা গা”ধা,আপনি একটা অ’পদার্থ, কিন্তু তবুও আমি আপনাকে ভালোবাসি!”

আমি সেই কথাটাই শুনতে চাই—বারবার, প্রতিবার।অনুগ্রহ করে তুই আবারও আমার জীবনে ফিরে আয়।না রাগ ভেঙে, না ভুল ভুলে… শুধু সেই এক চিলতে ভালোবাসা নিয়ে।আমি প্রমিজ করছি, আর কখনো ক”ষ্ট দেব না তোকে।

আনায়া,তুই আসবি?তুই এসে শুধু একবার বলিস,তুই আমায় একটু হলেও ভালোবাসিস।
আমি আকাশ খুলে দেব, সব পাখি উড়িয়ে দেব, শুধু তুই উড়ে আসিস… আমার বুক ঝাপটে জরিয়ে ধরিস। আমার আর কিছু চাইনা আমার।

প্রেমিক নামক তোর অপদার্থ স্বামী
তবুও তোরই—কেনীথ ”

কাগজে লেখা প্রতিটা কথার সম্পূর্ণটাই আনায়া যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পড়ে। এবং পড়া শেষে কাগজটা খানিক উলোটপালোট করে দেখে নেয়। সে এটা পড়া ঠিক কিভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। তবে অজান্তেই এক অপ্রস্তুত হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে। আদতে এই হাসি কিসের প্রতিক, তা ঠিকঠাক বোঝা গেল না।

এরইমাঝে আনায়া খামের ভেতর আরো একটা ছোট কাগজ খুঁজে পায়।আনায়া সেটি খুলতেই দেখে,তাতে টরন্টোর একটি ক্যাফের ঠিকানা লেখা। যেটা মূলত প্রায় তার বাসার কাছেই। এছাড়া সেই ছোট্ট চিরকুটে আরো দুটো লাইন স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছে। আনায়া সেটাও মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“এই ব্যাগে রাখা জামাটা পরে আসিস। আমি অপেক্ষায় থাকব।…তোর সিদ্ধান্তই আমার শেষ আশ্রয়।”

হাতের কাগজটা কাঁপছিল কিনা,আনায়া তা জানেনা।
তবে ইনায়া তখনো চুপচাপ বসে। অবুঝ শিশুর ন্যায় তাকিয়ে রয়েছে আনায়ার দিকে।আর ওদিকে জানালার ওপার থেকে সূর্যের শেষ আলোটা তখন ফিসফিসয়ে বলছে,
কিছু সিদ্ধান্ত রোদ ঝিমিয়ে যাওয়ার পূর্বেই নিতে হয়।”

আনায়া ভারী শ্বাস ফেলে। এই সবকিছু ছাড়িয়ে একটা বিষয় তার মাথায় ঘুরতে থাকে। ছোট চিরকুট আর বড় চিঠিতে থাকা হাতের লেখা দুটোই একদম ভিন্ন। আনায়া শুরুতেই বুঝে গিয়েছিল, মূল ঘটনা কি! যার ফলে, আবারও একটা মলিন হাসি তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে।

________________

আনায়া ঠিক সময়মতো ক্যাফের সামনে এসে পৌঁছায়। গেটের কাছে এসে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। চারপাশে বিকেল গড়িয়ে পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমেছে। পরনে তার কালচে লাল রাঙা ভেলভেট গাউন। যেটাই কিনা লাইব্রেরিতে কেনীথ দিয়ে গিয়েছিল। গাউনটা তার শরীরের গড়নে এমনভাবে খাপ খেয়েছে। যেন এটা শুধুই ওর জন্যই বানানো হয়েছে। এই ব্যাপারটায় আনায়া কিছুটা অবাক হয়েছে। এতোবছর পরও এতো খাপেখাপ ড্রেস কিভাবে এনেছে, তা কিছুটা ভাববার মতো বিষয়।

আনায়া নীরবে ক্যাফের ভেতর প্রবেশ করে। আলো-আঁধারিতে তার চলার ভঙ্গিমা আরও রহস্যময় লাগে। মুখে কোনো সাজ নেই, এমনকি ঠোঁটে এক ফোঁটা লিপস্টিক পর্যন্তও নেই। তবু তার চেহারায় এক অভিজাত নির্লিপ্ততা, একধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হিসেবে জ্বলজ্বল করে।

চুলগুলোও তার সাধারণভাবে এলোমেলো ভাবে খোঁপা করে বাঁধা। সবমিলিয়ে দেখলে মনে হবে,আনায়া নিজের মতো করে নিজেকে তৈরি করেছে।অন্য কারও জন্য না বরং নিজের জন্য।

তবে এসব ব্যতীত নজরকাড়া জিনিসটা হলো তার কানে ঝুলতে থাকা দুটো আস্ত চেরির মতো দেখতে ছোট দুল। বাতাসে দুলগুলো হালকা দুলছে, আর সেই দুলের টুকটাক শব্দে যেন সন্ধ্যার ঘন নীরবতা ভেঙে যাচ্ছে। এই ইয়ার রিং গুলো আনায়ার আগেও পড়া হয়েছে, কিন্তু আজকেটা সেই কেনীথের দেওয়া জামার সাথেই রাখা ছিল।

আনায়া ক্যাফেতে ঢুকে প্রথমেই খানিকটা থমকে যায়। এই জায়গাটা সন্ধ্যার পর বেশ জমজমাট থাকে, অথচ এখন যেন একদম শুনশান। মৃদু হলুদ আলোয় এক দু’জন কর্মী টেবিল গোছাচ্ছে। তবে কাস্টমার বলতে কেউ নেই। পরিবেশে একধরনের নীরব চাপা কল্পনাময়তা ছড়িয়ে রয়েছে।

আনায়া একবার চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশে। একদম নিরবতা। ভেতরে থাকা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে। এবং ধীরে ধীরে পা বাড়ায় আরো ভেতরের দিকে।

ঠিক তখনই একটা ক্যাফে কর্মী হাসিমুখে তার কাছে এগিয়ে আসে। তার চোখে মুখে অদ্ভুত এক আন্তরিকতা।

“ম্যাডাম, আপনি দয়া করে ছাঁদে চলে যান। স্যার অপেক্ষা করছে।”

আনায়া একটু অবাক হয়, কিন্তু কিছু না বলে মাথা হেলে সম্মতি জানায়। হাটার তালে জুতোর হালকা শব্দ ঠকঠক করে বেজে ওঠে মেঝেতে।

ছাঁদের দিকে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে আসতেই আনায়া অকস্মা কেঁপে ওঠে।ওপরে থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। গিটারের নরম টুংটাং শব্দ আর এক পুরোনো গানের সেই স্নিগ্ধ সুর…।গান কিংবা গানের কন্ঠ… দুটোই তার একসময়ের অত্যন্ত পরিচিতি ও প্রিয় ছিল।

“ও ভ্রমর রে________”

আনায়া দাঁড়িয়ে পড়ে সিঁড়ির গোড়ায়। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয়। নিজের বুকের ভেতরে ঝড়টা অনুভব করে, যেন বহুদিনের চেপে রাখা কিছু একটা আজ খুলে যাচ্ছে।

তারপর নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙে। প্রতিটি ধাপে গানের সুর আরও স্পষ্ট হয়। গিটার আর কণ্ঠের মিশ্রতায়, ছাঁদ যেন এক অপার্থিব জগতে রূপ নিয়েছে।

গেটের কাছে পৌঁছানো মাত্রই হঠাৎ গান থেমে যায়। থেমে যায় গিটারের টুংটাং আওয়াজ।
আনায়া একটু থমকে দাঁড়িয়ে, তাকায় সামনের দিকে। তরতাজা টাটকা গোলাপের সুভাসে চারপাশ মুখরিত। টেবিল থেকে শুরু করে ছাঁদের ফ্লোর… সবজায়গা আস্ত আস্ত কালচে লাল গোলাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুছিয়ে রাখা। একই সাথে নানান রঙের লাইটিং ও ছোট বড় মোমবাতি তো রয়েছেই। আর এসব ছাড়িয়ে ছাঁদের এক কোণায় চুপচাপ বসে রয়েছে কেনীথ। পরণে কালো রংএর ট্রেঞ্চ কোট, ভেতরে হয়তো টিশার্ট কিংবা হাই নিক সোয়েটার। দূর হতে খুব একটা স্পষ্ট নয়।এছাড়া না রয়েছে তার আলাদা কোনো সাজগোছ। চুলগুলোও সবসময়ের মতোই এলোমেলো, তবে আজ কিছুটা গুছানো লেগেছে আনায়ার।

এদিকে কেনীথ তখন গিটারটা পাশে নামিয়ে রেখেছে। মুখ তুলে আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে কোনো চমক নেই, কেবল একরাশ প্রশান্তি।যেন সে জানত, আনায়া ঠিক আসবে।

আনায়া তখনো চারপাশটা দেখতে ব্যস্ত। তার চোখে কিছুটা বিস্ময়।ছাঁদের প্রতিটি কোণে কালচে লাল গোলাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। তার মাঝখানে টেবিল আর মোমের সজ্জা। মৃদু বাতাসে কাঁপতে থাকা লাল-হলুদ আলোর ঝলক। কিছু ছোট ফেয়ারি লাইটের রেখা মাথার ওপর। যেন কোনো রোমান্টিক মুভির সেটআপ বানিয়ে ফেলেছে।

এতকিছুর মাঝেও, কেনীথ তখনো তাকিয়ে আছে শুধু আনায়ার দিকে। নিঃশব্দে অপলক তার চাহনি।

এটা কোনো নব প্রেমিক প্রেমিকার প্রণয়ের সূচনা নয়।এটা একটা নীরব আহ্বান।নিজেদের অনুভূতিকে একে-অপরকে প্রকাশ করতে না পারা দুটো পাগলাটে পাখির কাছে আসার আহ্বান। এটি সেই অদৃশ্য সুরের টান।যার মাঝে কথা কম, অনুভব বেশি।

কেনীথ ঠোঁট ভিজিয়ে আনায়ার দিকে এগিয়ে আসে। আচমকাই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। তবে নিজেকে যথাসাধ্য দৃঢ় গম্ভীর রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেনীথ আনায়ার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। আনায়া নির্লিপ্ত চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কেনীথ ভেতরে ভেতরে আকস্মিক অস্থির হয়ে উঠেছে। আনায়া যেন তা স্পষ্ট বুঝতে পারে।

এদিকে অবশ্য আনায়ার ডানহাতটা মুষ্টিবদ্ধ। দেখে মনে হচ্ছে, হাতের মধ্যে কিছু একটা রয়েছে। দু’জনে এমন চুপচাপ নীরবতা শুধু সময়টাকেই থামিয়ে দিচ্ছে। এ ব্যতীত আর কিছুই ঘটছেনা। এবার আনায়া নিজেই কেনীথের উদ্দেশ্যে বলল,

“গান থামিয়ে দিলেন যে?”

কেনীথ প্রথমে কিছু বলে না। খানিকটা সময় নিয়ে পরবর্তীতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“মনে হয় না গানের আর প্রয়োজন রয়েছে।… প্রাকটিস করছিলাম, এছাড়া আর কিছুই না।”

কেনীথ কথাটা আনমনে বলতেই থমকে যায়। মনে মনে ভাবে, কথাটা হয়তো এভাবে বলা উচিত হয়নি। ভিন্নভাবে বলার প্রয়োজন ছিল। সে নিজের প্রতি কিছুটা বিরক্ত হলো। ওদিকে আনায়া যেন ওর অব্যক্ত অভিব্যক্তি সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা করে ফেলেছে। নিজের অজান্তেই খানিকটা মুচকি হেসে ফেলল। তবে তা অন্ধকারে ওতো বিস্তৃত না হওয়ায় কেনীথের নজরে পড়ল না। সে ভাবতে বসেছে, এরপর কি কি করবে।

এদিকে আবারও দুজনের মাঝে নীরবতায় জমায় আনায়া কেনীথের উদ্দেশ্যে বলল,

“চিঠিটা কি আপনি লিখেছিলেন?”

আকস্মিক এ প্রশ্নের জন্য যেন কেনীথ প্রস্তুত ছিল না। সে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতাআমতা করতে লাগলে,আনায়া আবারও নির্লিপ্ত স্বরে বলল,

“পাভেল ভাইয়ের হাতের লেখার ধরণ কিন্তু আমার চেনা। ভালোই লেখেন উনি, তবে এবার একটু গড়মিলে লেগেছে।”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ আকস্মিক কেশে উঠল। পাশে মুখ ফিরিয়ে নিজেকে কোনোমতে শান্ত হয়ে বলল,

“চিঠি পাভেল-ই লিখেছে, বুদ্ধিটাও ওর। তবে অনুভূতি গুলো আমার।”

আনায়া আনমনে কেনীথের দিকে তাকিয়ে। তার কথার প্রতিত্তোরে আনায়া আবারও শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

“অনুভূতি আপনার…তবে আপনি লিখলেন না কেনো?”

কেনীথ যেন আবারও অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিছুটা ইতস্ততভাবে জবাব দেয়,

“লিখতে নিয়েছিলাম, তবে হাত কাঁপ…কাঁপছিল, তাই ওকে দিয়েই লিখে নিয়েছি।”

—“ওহ আচ্ছা।”

কেনীথ ইতস্ততভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তবে আনায়ার চাহনি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেনীথের দিকেই। আনায়া আবারও কিছুটা ভারী শ্বাস ফেলে বলল,

“আপনি কি, চিঠিটা আমাকে দেওয়ার আগে নিজে একবার পড়েছিলেন?”

কেনীথ আনায়ার দিকে কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে তাকায়।ওমনি আনায়া তার ডান হাতে থাকা ভাজ করা কাগজটা কেনীথের দিকে এগিয়ে দেয়। তার অভিব্যক্তি স্বাভাবিক। ঠোঁটেট কোণায় কিঞ্চিৎ হাসিও ঝুলছে। ওদিকে কেনীথের কপাল আরো কিছুটা কুঁচকে যায়। চোখে-মুখে গম্ভীর্যের ছাপ পড়ে। আনায়ার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে, পড়তে শুরু করে। নিমিষেই বিস্ময়ে তার মুখ কিঞ্চিৎ হা হয়ে যায়। এসব কি! অপ”দার্থ, গা”ধা, তারপর কিসব উদ্ভট লাইন…এতোকিছু তো কেনীথ কখনোই বলেনি।

কেনীথ পুরোটা পড়া শেষ করে, আনায়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

“এস…এসব আমি লিখতে বলিনি। আমি তো…”

—“হ্যাঁ,আমি জানি।… সে যাই হোক,কিছু উদ্ভট লাইন ব্যতীত, বাকি সব অনুভূতিগুলোই হয়তো আপনার।

কেনীথ মেজাজ ধীরে ধীরে বিগড়ে যায়। দাঁত খিঁচে শক্ত হাতে চিঠিটা আঁকড়ে ধরে। আনায়ার ওর ভাবগতিক বুঝতে পেরে নির্লিপ্ত স্বরে বলে,

“থাক হয়েছে,পাভেল ভাইকে শুধু শুধু ঝেড়ে লাভ নেই। আপনার একবার পড়ে নেওয়া উচিত ছিল।”

কেনীথ দাঁত খিঁচিয়ে বলল,”গাধাটা লেখা শেষে আমাকে পড়িয়ে শুনিয়েছে। অথচ ও যে এসব…”

—“থাক, চিঠির আলাপ বাদ দিন। এখানে কেনো নিয়ে ডেকেছেন তা বলুন।”

কেনীথ আবারও অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কি থেকে কি বলবে সব গুলিয়ে ফেলে। কাল আনায়ার বাড়ি থেকে রাতে হোটেলে ফেরার পর, দুজন মিলে সারারাত প্ল্যান করেছে। বেশির ভাগই, পাভেলের বুদ্ধি নয়তো ওর সাজানো উপায়৷ নয়তো কেনীথ যে কোন অজানা জড়তার সাগরে ডুবেছে সে নিজেও বুজে উঠতে পারছে না। এখানে আসার পূর্বেও পাভেল সবকিছু তাকে গুছিয়ে বলে দিয়ে গিয়েছে। টেবিলের পাশে গোলাপের তোড়া, কিংবা কোটের আদতে থাকা আংটি—সবই রয়েছে। কিন্তু তার মাঝথেকে এই অজানা জড়তা কেটে কোনোভাবেই সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। উল্টোসব গুলিয়ে ফেলছে।

—“দেখুন, আপনাকে কোনো স্ক্রিপ্টভিত্তিক কিছু বলতে হবে না। আপনি যাস্ট নিজের মনের কথা শুনন, যা বলতে চান তা নিরদ্বিধায় বলুন৷ এলোমেলো অগোছালো হলেও কোনো প্রবলেম নেই। আপনি শুধু বলে ফেলুন।”

আনায়ার এসব বলেও তেমন কোনো লাভ হয়না। কেনীথের বারবার সব গুলিয়ে ফেলছে। চেয়েও একটা কথাও মুখ থেকে বের করতে পারছে না। শেষমেশ নিজের উপর চরম বিরক্ত হয়ে, রাগে মেজাজ খারাপ হচ্ছে।অথচ আনায়া অপলকভাবে তার দিকে তাকিয়ে। খানিকটা হতাশ হয়েই কি যেন ভাবতে লাগল। শেষমেশ চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠল,

“আপনি যখন কিছু বলতেই পারছেন না, তখন না হয় আমি কিছু বলি?”

কেনীথ আনায়ার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। আনায়ার কথাতে সম্মতি জানিয়ে বলে,

“আচ্ছা ,তুই বল!”

আনায়া দীর্ঘ ভারী শ্বাস ফেলে, চোয়াল শক্ত করে বলে,

” আমাকে পাওয়ার জন্য যে এতসব পাগলামি গুলো করছেন, তার সবটাই বৃথা যাবে। যখন আপনি… একটা নি”র্মম সত্য জানতে পারবেন।”

কেনীথের কপাল খানিকটা কুঁচকে যায়।চোখেমুখে গম্ভীর্যের ছাপ পড়ে। নিরেট কন্ঠে বলে ওঠে,

—“মানে?

—“আমি আপনার সন্তানকে ন”ষ্ট করে ফেলেছি।…হ্যাঁ,আপনার সন্তান!”

কেনীথ আকস্মিক ঢোক গিয়ে ফেলল। কপাল আরো খানিকটা কুঁচকে যায়। তাদের প্রথম সন্তান যে আনায়ার জন্যই ন”ষ্ট হয়েছে তা তো কেনীথের জানা। ঐ সময় তো আনায়ার মানসিক অবস্থাই ঠিক ছিল না। তবে হঠাৎ আজ কেনো সেই কথা…আনায়া কি এটা বলতে চাচ্ছে যে, ও জেনে বুঝে সুস্থ মস্তিষ্কেই ওই কাজ করেছে? নাহ্,এটা কি করে হয়। ডাক্তার তো নিজেই বলেছে, ওর অবস্থা নিত্যন্তই ক্রিটিকাল ছিল।

—“হ্যাঁ,আমি জানি আমাদের প্রথম সন্তানের মৃ’ত্যুটা…”

—“প্রথমটার কথা বলিনি আমি।…পার্টির রাতের কথা ভুলে গিয়েছেন?”

কেনীথ ভাবগাম্ভীর্যে অন্ধকার ছায়া নেমে পড়ে। আনায়া বোঝাতে চাইছেটা কি? আর এসব কথার মানেই বা কি? নিমিষেই কেনীথ চিন্তাভাবনা গুলিয়ে যায়।দুহাতের শক্তভাবে মু”ষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখেমুখে ভয়ং”কর রাগের আভাস ছড়িয়ে পড়ে। কোনোকিছু না ভেবেই আকস্মিক আনায়ার দিকে তেড়ে এসে, ডানহাতে ওর গলা চেপে ধরে। আর বামহাতে শক্ত ভাবে চেপে ধরে আনায়ার বাহু।

কেনীথ যে হঠাৎ এমন কিছু করে বসবে, আনায়া নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। সে নিজেকে সামলাতে না পেরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আনায়া ছিটকে কয়েকপা পিছিয়ে যায়। বাকিটা কেনীথের জোরে পিছিয়ে গিয়ে তার পিঠ ঠেকে যায়, পেছনে থাকা একটা টেবিলের সাথে। কিন্তু কেনীথ তাতেও থেমে থাকেনা। এতো শক্তভাবে ওর গলা চেপে ধরে যে,আনায়া শ্বাস নেওয়াও মুশকিল হয়ে যায়। কেনীথের হাত থেকে আনায়া ছাড় পেতে, নিজের দু’হাত দিয়ে কেনীথকে দূরে সরাতে চাইলেও, কেনীথেরর শক্তির সাথে পেরে ওঠে না। উল্টো টেবিলের উপর আধশোয়া হয়ে পড়ে থাকে।

—“তোর সমস্যাটা কি?জানো”য়ার বলিস আমাকে,তুই নিজেই আমার চেয়ে ব”ড় জা’নো’য়ার।তুই তোর বাপের চেয়েও বড় জা”নো’য়ার। কেনো করিস বারবার এমন? পা”প না হয় আমি করেছি,আমার সন্তান কি করেছে তোকে? এতোই যখন আমার প্রতি ক্ষো”ভ, তখন একেবারে কেনো আমায় শেষ করে দিস না? এটা কোন উপায়ে তুই আমাকে সাজা দিচ্ছিস?”

এদিকে কেনীথের যেন হুঁশ জ্ঞান সব উড়ে গিয়েছে। ক্ষি”প্ত হয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। কথাগুলোও সব এলোমেলো। কন্ঠস্বরও ভারী হয়ে ওঠেছে।তবে আনায়ার অবস্থা বেগতিক দেখে, সে নুজেকে কিছুটা সামলাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আকস্মিক ওর গলা ছেড়ে দিয়ে দূরে এসে সরে দাঁড়ায়। কেনীথ তার অতিরিক্ত রাগ সামলাতে না পে”রে হাঁপাতে শুরু করে। মাথা ঝুকিয়ে রাখায়, চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়েছে। একহাত অন্য এক টেবিলের সাথে ঠেকানো। অন্যহাত বুকের বা পাশে৷ পেছন থেকে আনায়ার অনবরত কেশে ওঠার শব্দে, কেনীথ যেন আরো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এমনই সময় পেছন থেকে আনায়ার এলোমেলো স্বরে বলতে লাগল,

“তুই আসলেই একটা বলদ!…অপদার্থ তুই!…গাধা তুই!”

আনায়ার কথা শোনামাত্রই কেনীথ পেছনে ফিরে তাকায়। চোয়াল শক্ত, চোখের দৃষ্টি যেন র”ক্ত গরম।

—-“চুপ থাক, নয়তো মে”রে এখানেই শেষ করে রেখে যাব।”

কেনীথের ক্ষি”প্ত স্বরের হুমকিতেও, আনায়ার যেন তাতে কিছুই এসে যায় না। সে দৃঢ় চোখে, কঢ়া কন্ঠে কেনীথের উদ্দেশ্যে আবারও বলে,

“আগে তো আমার সব কথা শুনে নিতি গর্দভ। বাচ্চা কি হাওয়ায় ভেসে আসে?”

এবার কেনীথ যেন কিছুটা চমকে ওঠে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বিস্ময়ের সাথে আনায়ার দিকে তাকায়। আনায়া অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবে তার চোখজোড়ার অভিব্যক্তি এখনও ক্ষি”প্ত। কিন্তু কেনীথের বিস্ময়ের চাহনি দেখে আনায়া খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে তীর্যক হাসল।

ওদিকে কেনীথ প্রায় অনেকটাই স্বাভাবিক গিয়েছে। কিছু বলার চেষ্টায়, আনায়ার দিকে খানিকটা এগিয়ে যেতে নিলে… আনায়া জোর গলায় বলে উঠল,

“খবরদার! আমার কাছে আসবেন না!”

কেনীথ এবার শান্ত ও করুন স্বরে বলল,

“তারা!”

—“আপনার চাঁদ তারা আপনার কাছেই রাখুন।আর সাথে রাখুন, আপনার ঐ আবেগের ভালোবাসা। তামাশা লাগিয়ে রেখেছেন?আমাকে পাওয়ার জন্য এতোসব পাগলামি করছেন, অথচ আমি কি বলতে চাইছি…আদোও ওটা কতটুকু যৌক্তিক কিংবা আমি সিরিয়াসলি বলছি কিনা, তাও বোঝার ধ্যান, জ্ঞান, সময় নেই আপনার! পারবেন শুধু যখন তখন না বুঝেই রিয়েক্ট করা,আর গায়ে হা”ত তুলতে । তারপর আসবেন ন্যাকা আদর দেখাতে? আপনার কচুর ভালোবাসা,ঐ মেয়েদের গিয়ে দিন…যারা আপনার বডি ফিটনেস,চেহেরা দেখে উঠতে বসতে ফিদা হয়। নয়তো আমি কোনো বলদ, অপদার্থের সংসার করব না। মে’রে কে”টে নর্দ”মায় ফেললেও নয়৷”

এই বলেই আনায়া আর এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না। ত্বরিত ছাঁদ থেকে বেড়িয়ে, সিঁড়ির বেয়ে নামতে শুরু করে। ওদিকে কেনীথ অনবরত ঢোক গিলে, অবস্থার বেহাল করে ফেলেছে। এটা কি ছেড়ে কি করে বসল। অবশ্য তারও বা কি দোষ…আনায়াই তো ওমন একটা…হুস্! তার তো একটু খেয়াল রাখা উচিত ছিল। অকারণে এভাবে রিয়েক্ট কে করে?

—“আনায়া, লিসেন প্লিজ! ভুল হয়ে গিয়েছে আমার। হ্যাঁ,আমি গাধা! আমি অপ’দার্থ! কিন্তু শেষের লাইনটাও তো বলে যা! হাহ্… হোয়াট দ্য অ্যাকচুয়াল ফা””ক ইজ গোয়িং অন?কেনো হচ্ছে এসব? আর কেনোই বা… হোয়াই দা ফা””ক ডাজ ইট অলওয়েজ হিট মি?হোয়াই! হোয়াই! হোয়াই!”

কেনীথের একবার তীব্র হতাশায় চিল্লাতে ইচ্ছে তো একবার চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে এসব ছাড়িয়ে শেষে মাথায় শুধু একজনের নামই এলো। আর কেনীথ সঙ্গে সঙ্গে আ”ক্রোশে চিল্লিয়ে বলে উঠল,

“পাভেল!!!”

_____________

সন্ধ্যায় বাসায় ইনায়াকে একা না রেখে এসে,আনায়া ওকে নিজের সাথে করেই নিয়ে এসেছে। ক্যাফের কাছে পৌঁছাতেই তার দেখা হয়ে যায় পাভেলের সাথে। যেন সে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে যেটাই হোক না কেনো, তাদের দুজনকে দেখে পাভেল তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসে। আর ইনিয়েবিনিয়ে ইনায়াকে নিয়ে আশেপাশে হাঁটতে বেড়িয়ে যায়।

সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত, পাভেলের পাশাপাশি ইনায়া হেঁটে চলেছে। তবে এরমাঝে একবারও তার ইনায়ার সাথে কথা হয়নি। অর্থাৎ সে নিজে নানান কথা বলার চেষ্টা করলেও, ইনায়া কোনো জবাব দেয়নি। এছাড়া ইনায়ার প্রতি না চাইতেও অদ্ভুত এক ভয় কাজ করছে। কিছুক্ষণ পরপর আকস্মিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। অথচ ইনায়া বরাবরই নির্বিকার। খুব বেশি হলে পাভেলের দিকে খানিকটা সময় পরপর পাভেলের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। তবে কিছুই বলছেনা।

এদিকে ক্যাফের চারপাশে কয়েকবার কয়েক চক্কর দেওয়ার পর, তারা দুজন আবারও ক্যাফের কাছে এসে পৌছায়।আর ঠিক তখনই শুনতে পায় কেনীথ চেঁচানোর আওয়াজ। কেমন যেন মনে হলো, কেনীথ স্পষ্ট তার নাম ধরে ডেকেছে। কিন্তু বুঝতে পারল না, এতো তাড়াতাড়ি হলোটা কি! সে ক্যাফের ছাঁদের দিকে একপলক তাকিয়ে, পুনোরায় নিচের দিকে তাকাতেই নজরে এলো আনায়া। আনায়া হাভভাব অস্বাভাবিকও নয়, আবারও একদম স্বাভাবিকও নয়। মন বলছে, কিছু একটা ভেজাল তো হয়েছে।

এরইমাঝে আনায়া তাদের কাছে আসতেই, পাভেল কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“কিছু কি হয়েছে? আপনাকে…”

আনায়া পাভেলকে কিছু বা বলে সরাসরি ইনায়ার উদ্দেশ্য বলল,

“ইরা,চল! দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আনায়ার নিরেট কন্ঠস্বরেই পাভেল যা বোঝার বুঝে গেল। বাকিটা আনায়া নিজেই যাবার সময় জোরপূর্বক তাচ্ছিল্যের সহিত মুচকি হেসে বলল,

“অপ”দার্থের সঙ্গ ছেড়ে কিছু পদার্থের সন্ধান করুন৷ দিনশেষে ভালোকিছুই পাবেন, আশা করি।”

পাভেলের যেন সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।কিসের পদার্থ আর কিসের অপ”দার্থ। এরইমাঝে আনায়া আবারও বলল,

হোয়াট এভার,আপনার ভ্রাতা সমতুল্য ব্রো আপনাকে খুঁজছে। সম্ভব হলে, তার সাক্ষাৎ নেবার পূর্বে,বেঁচে ফিরে আসার প্রস্তুতিও নিয়ে যাবেন। মাথা স্ক্রু তো আজীবন ঢিলা করেই রেখেছে। না জানে, কখন আবার কি করে বসে। দেখা যাবে,দিনশেষে আপনাকে মে”রে, আপনারই লা”শ কোলে নিয়ে বসে থেকে বলছে,’ভাই আমার উঠে যা, আর জীবনেও তোকে মা’রব না।”

এসব বলে আনায়া তো চলে গেল ঠিকই, কিন্তু এদিকে পাভেল সম্পূর্ণ হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে। এমন কি হলো যে, আবার দুজনের অবস্থার এতো অব”নতি…!

_________________

কেনীথ গাড়ির স্টিয়ারিং এ মাথা ঠুকে বসে রয়েছে। কোনো কথাবার্তা, নড়চড় নেই। বরং একদম চুপচাপ সে। আর তার পাশের সিটে চুপটি করে বসে পাভেল। কেনীথ কিছু বলছে না দেখে, সে-ও আগ বাড়িয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। এদিকে বাহিরে আবার টুপটাপ বৃষ্টি ঝড়ছে। সবমিলিয়ে অনুভূতি ভালোমন্দ কিছুই নয়।

অনেকটা সময় এভাবেই অতিক্রম হবার পর, পাভেল কিছুটা অস্থির হয়ে উঠল। সে দৃঢ় সাহস নিয়ে কেনীথের উদ্দেশ্যে মিনমিনিয়ে বলে উঠল,

“ব্রো! সেই কখন থেকে চুপচাপ বসে রয়েছো। এবার তো কিছু বলো?”

কেনীথ মাথা তুলে পাভেলের দিকে সরু চোখে তাকায়।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পুরো পাখির বাসার মতো দেখাচ্ছে। যেন কেনীথ নিজেই টেনে হিঁচড়ে চুলের এই অবস্থা করেছে। এদিকে কেনীথের এহেন চাহনিতে পাভেল কিঞ্চিৎ ঢোক গিলল।তবে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কেনীথ সোজা হয়ে বসে, খানিক কঢ়া কন্ঠে বলে,

“আর কি বলব!”

পাভেল কিঞ্চিৎ হেসে, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ব্রো! যা বুঝলাম… এরমানে… মানে আরকি…”

—“কি শুরু করেছিস? যা বলবি তা বল না!”

—“নাহ্, বলছিলাম যে…এরমানে তো ঐ রাতে পার্টিতে… তোমাদের কিছুই হয়নি?”

কেনীথ ছোট ছোট করে পাভেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

“নাহ্!”

—“কিন্তু তুমি তো পুরো… আরেহ্…হা…হা…হা…আউচ!”

অকস্মা কেনীথের পায়ের সজোরে লা”থি খেতেই পাভেলের কথা আর হাসি দুটোই থেমে যায়। ব্যাথার দরূন কেনীথের দিকে করুন চোখে তাকালেও, কেনীথের মেজাজ একটুও কমেনা। উল্টো আরো বেশি রেগে দিয়ে বলে উঠল,

—“একদম চুপ থাকবি! শুরু থেকে এখন অব্দি, সব গ্যা”ঞ্জাম তো তোর বুদ্ধিতেই হয়েছে।”

—“আরেহ,আমি আবার কি করলাম?আমার বুদ্ধি ঠিকই ছিল, কিন্তু সব ভেজাল তো তুমিই লাগিয়েছো।”

—“চুপ থাক তুই।…তোরা আমার মাথাটা শেষ করে দিচ্ছিস পুরো।”

—“আচ্ছা শোনো এতো হাইপার হবার কিছু নেই।”

—“কিছু নেই মানে? দেখেছিস, ঐ শা”লী কি তেজ নিয়ে চলে গেল। তোর কি মনে হয়, ও আর আমার কথা শুনবে। ইচ্ছে করছে, ওটাকে মে”রে নিজেও ম”রে থাকি।”

—“হোয়াট শা”লী?কিসের শা”লী? কোন শা”লী? তোমার শা”লী… আই মিন, ইনায়া তো আমার সাথেই ছিল। ও আবার কি কখন কি করল? ঐ মেয়ে তো মনে হয়, এখন আর কথাই বলতে পারেনা।”

কেনীথ এবার খানিকটা চুপসে যায়। তবে পরবর্তীতে আরো বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,

“চুপ কর গাধা,আমি ইনায়ার কথা বলিনি। আনায়ার কথা বলেছি।”

—“ওহ! তো তা না বলে, শা”লী শা”লী কেনো করছো? ভুলে যেও না, তোমার শা”লী কিন্তু শুধু তোমার বউ না বরং তোমার চেয়েও একধাপ এগিয়ে। যাই হোক, আস্তে নাম নেওয়াই ভালো। না জানি কখন আবার ডাইনীর মতো উড়ে এসে,গাড়ির জানালায় উঁকি দিকে বসে। যে স্টাইলে তাকায়…,ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে!”

এই বলতে না বলতেই পাভেল কিঞ্চিৎ ঢোক গিলল। তবে পাশে ফিরে তাকাতেই গলাটা একদম শুঁকিয়ে গেল। কেনীথ তীব্র ক্ষি”প্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। পাভেল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“এভাবে তাকিও না, প্লিজ।”

—“বাজে কথা বন্ধ কর, তবে।”

—“শা”লীর প্রতি এতো দরদ। কই কখনো তো আমার প্রতি…”

—“পাভেল!”

—“আচ্ছা, ঠিক আছে। আর এমন কিছু বলব না।”

তবুও যেন কেনীথের রা”গ কমে না।মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। পাভেল তা ঠিকই বুঝতে পেরে বলে,

“শোনো ব্রো! আমার কাছে একটা উপায় আছে।”

কেনীথ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,

“রাখ তোর উপায়!”

—“আরেহ, শোনো তো আগে।এটা উপায় না মন্ত্র। কানে কানে বলতে হবে। নয়তো যে কেউ এই মহামূল্যবান মন্ত্র শুনে নিতে পারে।”

কেনীথ তার কপালটা খানিক কুঁচকে ফেলে। পাভেলের অভিব্যক্তি কিছুটা অদ্ভুত। ওর কথামতো কেনীথ নিজের মাথাটা খানিক এগিয়ে দিতেই, পাভেল বলতে লাগল,

“আমার বিশ্ববিখ্যাত মহাগুরু কবি কেনীথন্দ্রনাথ ভিকেটার্য মহাশয় একবার বলিয়া ছিলেন,’বউ মানুষদের রাগ-অভিমান ভাঙ্গাতে, তাদের বেশি বোঝাতে নাই।স্বামী হইয়া প্রধান ও উত্তম কাজ হইলো গিয়া, বাচ্চা একটা পেটত ধরায় দিলেই হয়। আর কিছু লাগে না। এরপর দেখবা, সংসার করার লাগিয়া বউ তোমার পুরো ডিপ্লোমা করতে উতলা হইয়াছে।”

পাভেলের এমন সাধু, চলিত মিশ্র ভাষার খিচুড়িতে, সবকথা কেনীথের মাথার উপর দিয়ে গেল। অদ্ভুত চোখে পাভেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল,

“আমার এই সিচুয়েশনেও তোর মজা পাচ্ছে? এসব কি…!”

—“আরেহ, আগেই এতো রেগে যাও কেনো? এটাই তোমার সমস্যা। সবজায়গায় রাগ জোর খাটিয়ে কিছু হয়না।”

—“আমিও সেটাই বলছি, তুই যা বলছিস ওটা এখন কোনো মতেই সম্ভব না। ওকে কি তুই আগের আনায়া পেয়েছিস যে আমি…যাই হোক, এসব জোর-জবরদস্তির মাঝে আমি আপাতত নেই। অতিষ্ঠ আমি ওর উপর। থাকলে থাকুক, না থাকলে নেই। আমি আর ওর আশেপাশে নেই।”

এবার পাভেল যেন কেনীথের কথায় কিছুটা বিরক্ত হলো।

—“ভাবলাম তোমার সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। এখন তো দেখছি আবার ঢং এর আলাপ শুরু করেছ। ভুলে যেও না, একমাসও ঠিকতে পারোনি। শুরুতে কঢ়া ভাষণ দিলেও, শেষে ঠিকই আমাকে টেনে নিয়ে এখানে এসেছো।”

কেনী রাগী চোখে পাভেলের দিকে তাকাতেই, পাভেল নির্বিকারে নিরদ্বিধায় বলল,

“চোখ গরম করে লাভ নেই। যা সত্যি তাই বলেছি।”

—“তো এখন কি করতে বলিস আমায়।”

—“এখন আর কি! চলো তোমার, ফায়ার বার্ডের বাড়ি যাই। আদোও বাড়িতে ঢুকতে দেবে কিনা, সন্দেহ। কি কপাল আমার, তোমার জন্য আমার সম্মানটাও চলে যাচ্ছে।”
_____________

বাইরে তখন প্রকৃতি যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
গগনবি”দারী শব্দে মেঘ গর্জে উঠছে।আর তারই মাঝে মুষলধারায় ঝরছে বৃষ্টি। যার থামার কোনো ইঙ্গিতই নেই। আনায়ার ছোট্ট বাড়িটার চারপাশে কেবল জলের ঝমঝমে শব্দ।

আর কেনীথ এই বৃষ্টির মধ্যে একটানা দাঁড়িয়ে রয়েছে। গায়ে বৃষ্টির পানিতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে থাকা, কালো রংএর ট্রেঞ্চ কোট জড়ানো। এছাড়া কালো প্যান্ট, ভেজা জুতো, আর বুকের ভেতরে একরাশ ঝড়। তার মুখটা পাথরের মতো গম্ভীর। চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, তবু দৃঢ়তায় একটুও নড়চড় নেই। হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে বারবার শুধু একটা নামই ভেসে উঠছে—”Anaya”।

শুরুতে কেনীথের সাথে পাভেলও ছিল। কিন্তু আচমকা জোরে বৃষ্টি নামায় কেনীথ ওকে হোটেলে ফিরে যেতে বলে। কেনীথের জোরালো আদেশে পাভেলের আর কিছুই করার থাকে না। মূলত সমস্যা ঘটেছে পার্কের সে ঘটনার পর, আনায়ার পরপর কেনীথরাও চলে আসে। কিন্তু কোনোমতেই আর দোতলায় যাওয়ার সুযোগ পায়না। আনায়া বাড়িওয়ালাকে বলে বাড়ির ভেতরের গেট তালা দিয়ে রেখেছে। সেই সাথে কোনো অপরিচিতকেও ভেতরে আসার অনুমতি দিতেও নিষেধ করেছে। যার ফলে অনেক বলে কইয়েও কোনোভাবেই সে বৃদ্ধা বাড়িওয়ালাকে তারা ম্যানেজ করে দোতলায় যাওয়ার অনুমতি পায়নি। শেষমেশ পাভেল চলে যাওয়ার পর হতে, প্রায় আধঘন্টার বেশি সময় ধরে আনায়াকে ফোন, মেসেজ করেও কোনো উত্তর পায়নি কেনীথ।

আর এখন তো প্রায় ঘন্টাখানেক সময় কেটে গিয়েছে।তবে কেনীথ থেমে থাকেনি। ফোন করেছে, এসএমএসও পাঠিয়েছে।কিন্তু আনায়ার তাতে কোনো সাড়া নেই। কেনীথ বুঝতে পারছে না কাহিনি কি! এই মেয়ের এতো জেদ কেনো। অন্যকেউ হলে এতোক্ষণ তাও ফোনটা সুইচঅফ করে রাখত কিন্তু আনায়া তো সেটাও করেনি। এতোক্ষণে ধরে ফোনে রিং হচ্ছে অথচ একেবারের জন্যও ফোন ধরছে না।

কেনীথ বেজায় বিরক্ত হলো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জামাকাপড়, শরীরের বেহাল অবস্থা বানিয়ে ছেড়েছে। সবকিছু একদম বৃষ্টির পানিতে চুপসে গিয়েছে। মাথার বড়বড় চুলগুলো হতে বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে কপাল বেয়ে নিচে পড়ছে।কিন্তু কেনীথের এসবে হেলদোল নেই। সে ভাবছে একখ কি করা যায়। কি যেন ভেবে কেনীথ বাড়ির পেছনের দিকটায় এগিয়ে যায়। শুরুতেই নরম ভেজা মাটিতে কালো বুটজোড়ায় কাঁদায় মেখে যায়। কিন্তু কেনীথ তাতেও নির্বিকার। যদিও কিছুটা বিরক্ত তবে তা আনায়ার উপর।

শেষমেশ ভেজা শরীর নিয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আরো কিছুটা সময় বৃষ্টিতে জুবুথুবু হয়ে ভিজতে হয় তাকে। তবে সে ভাবছে অন্যকিছু। দোতলার দুটো বারান্দার একটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। অন্যটাতে অল্প আলো জ্বলছে। যেহেতু ইনায়ার এতোক্ষণে ঘুমিয়ে থাকার কথা তাই,আলো জ্বলতে থাকা বারান্দাটাযুক্ত রুমটাকেই কেনীথ আনায়ার ভেবে নেয়।

এরপর আর কোনো যুক্তির ধার ধরে না। বুকের ভেতরকার অস্থিরতাকে বাড়িয়ে, দোতলার বারান্দায় ওঠার সিন্ধান্ত নেয়। কোনোমতে দেওয়ালের নানান পিলার আর বিটগুলোর সহায়তায়, অবশেষে রেলিং বেয়ে বারান্দায় উঠে পড়ে। তবে বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া বারান্দার রেলিং এর কারণে, এরমাঝেই হাত ফসকে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে।যার ফলে পাশে থাকা খানিকটা সরু ম্যাটাল দিয়ে বলিষ্ঠ বাহুর একটা পাশে বিঁধে যায়। এবং ততক্ষণে ভেতর নরম চামড়ার অনেকটাই ছিঁ”ড়ে যায়। হয়তো অনেকটা র”ক্তও বেরোচ্ছে, তবে কেনীথের সেসবে নজর নেই।

সে সোজা বারান্দার দরজা ঠেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করে। তার বুটজুড়ে কাদা, প্যান্ট আর কোট থেকে থেকে পানি সমানতালে ঝরছে। ভিজে চুল কপাল বেয়ে নুইয়ে পড়েছে চোখের পাশে।আর তা থেকে ঝড়তে থাকা পানি পড়ছে নিচে।এরপর সবমিলিয়ে মেঝেতে মেখে হচ্ছে একাকার। কিন্তু কেনীথ এসবরেও কোনো খেয়াল রাখল না।

সে খুজতে ব্যস্ত আনায়াকে।তবে ঘরের ভেতরে শুধুই স্তব্ধতা। বইয়ের তাক, আনায়ার চেয়ার,টেবিল, বিছানা—সবকিছুই গোছানো। কিন্তু কোথাও আনায়া নেই।

নিমিষেই কেনীথের ভ্রু কুঁচকে যায়। আকস্মিক উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেই, হঠাৎ ঘরের এক কোণ থেকে হালকা জলভেজা শব্দ কানে আসে। কেনীথ সেদিক নজর ফেরাতেই বুঝতে পারে পানির আওয়াজ বাথরুম থেকে আসছে।

ততক্ষণে তার ভেজা কাপড়ের পানি গড়িতে কার্পেটে, মেঝেতে জুবুথুবু হয়ে গিয়েছে। জুতোয় লেগে থাকা কাদা চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নোংরা হয়ে গিয়েছে। জায়গাটা যেন এক বিশৃঙ্খলার প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিয়েছে।
কেনীথের নজর এবার সেদিকে পড়তেই খানিকটা বিরক্ত হয়। তাড়াহুড়ো করে কি যেন করতে চেয়েও আর তার করা হয়না। কেনীথ একবার মাথা তুলে জানালার বাইরে তাকায়। বৃষ্টির শব্দ যেন তার বুকের ভেতরের অস্থিরতার সাথেই তাল মিলিয়ে বেড়ে চলছে।

আর ঠিক তখনই, আনায়া বের হয় বাথরুম থেকে।
সাদা তোয়ালে শরীরে পেঁচানো, মাথায় আরেকটা তোয়ালে জড়ানো। একদম নিঃস্তব্ধ, বিধ্ব”স্ত দেখাচ্ছে ওকে। চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপ, বুকের ভারী নিঃশ্বাসে যেন কোনো পাহাড় চাপা পড়ে রয়েছে।

সে আশেপাশে না তাকিয়ে সোজা চলে যায় আলমারির দিকে। তার হুঁশই নেই যে এই মূহুর্তে সে ব্যতীত রুমে আর কেউ আছে। প্রচন্ড ক্লান্তিতে হাত পা অবশ হয়ে আসছে। যেন আশেপাশে দেখার আর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কেনীথ ঠিকই পেছন থেকে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। এবং এটাও বুঝতে পারে যে, আনায়া ওকে দেখেনি।

– “আনায়া!”

কেনীথ পেছন হতে হঠাৎ ডাক দিতেই, আনায়া সম্পূর্ণ চমকে ওঠে। মুহূর্তেই পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। আকস্মিক কেনীথকে তার সামনা-সামনি দেখে, বিস্ময়ে চোখ তার ছানাবড়া। কি করবে না করবে কিছুই মাথায় আসে না। তবে নিজের এই বেহাল অবস্থা নিয়ে কেনীথের সামনে থাকারও কোনো মানে নেই।

এই ভেবে তাড়াতাড়ি আবার বাথরুমের দিকে ছুটতে গিয়ে,তার ভেজা পা পিছলে যায়। কিন্তু ঠিক তখনই কেনীথ দৌড়ে এসে ওকে ধরে ফেলে।একহাতে কোমড় পেঁচিয়ে নিজের কাছে টানে। যদিও কেনীথের উদ্দেশ্য ছিল ওকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো। কিন্তু বিব্রতকর অস্বস্তিতে আনায়ার শ্বাস-প্রশ্বাস থমকে গিয়েছে। আনায়া আঁচ করে তার তোয়ালে খানিকটা খুলে এসেছে। আর এই ভয়েই মুচড়ে ছাড়াতে চায় নিজেকে। কোনমতে কেনীথের বাহু শক্ত করে খামচে ধরে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু ঠিক সেই জায়গাতেই কেনীথের কে”টে যাওয়ায় র”ক্তপ্রবাহ আবারও শুরু হয়। কেনীথের তাতে ব্যাথা লাগলেও সে নির্বিকারে আনায়ার দিকে তাকিয়ে। অথচ আনায়া যথাসাধ্য চেষ্টা করছে কেনীথের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার।

আনায়া রেগে হোক কিংবা বিব্রত হয়ে…কোনোমতে ছুটে বেরোতে চায় কেনীথের বাঁধন থেকে। না জানে কখন তার গায়ের তোয়ালে খুলে যায়। তবে কেনীথ সেটা মোটেও বুঝতে পারেনা।সে ভাবে, আনায়া হয়তো তাকে হঠাৎ এখানে দেখে, রেগে গিয়ে তার থেকে দূরে সরতে চাইছে। যে কারণে সে নিজেই ভুল বুঝে আনায়ার হাত দুটো পেছনের দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে। সেই সাথে আনায়াকেও এবার পুরোপুরি নিজের বন্ধনে আটকে ফেলে।

আনায়ার পিঠ ঠেকেছে দেয়ালে। চোখ মুখে আতঙ্ক। বুক উঠছে নামছে তীব্র ভয় ও লজ্জায়। কখন কোন অঘটন ঘটে নিজেও বুঝতে পারছে না। কেনীথকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না।এদিকে মাথায় পেঁচানো তোয়ালেটাও খসে পড়ে। ভেজা চুল ছড়িয়ে যায় কাঁধ সহ চারপাশে।

আনায়ার শরীর যেন জমে গিয়েছে। তবুও কেনীথকে বোঝাতে পারছে না কিছুই। আতঙ্ক, লজ্জা, রাগ—সবকিছুতে মিশে এককার তার অবস্থা। মুখেও কিছু বলতে পারছে না।আর গলা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে।

কেনীথ কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে ওর চোখের দিকে।আনায়ার ভাবভঙ্গিতে অভিব্যক্তিতে এটুকু বুঝতে পারছে যে, কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।

“তারা মাই ব্লাড! প্লিজ আমায় একটু সময় দে! আমি মোটেও তখন তোকে ওভাবে মা” রতে চাইনি৷ কিন্তু তুই হঠাৎ ওসব কথা বলায়…”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করেই আনায়ার শরীর ঝিমিয়ে পড়ে। এতোক্ষণ ছাড় পাওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে যে তার তোয়ালেটাও ঢিলে হয়ে গিয়েছিল তা সে ঠিকই বুঝেছে। কিন্তু কেনীথকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারেনি। আর শেষমেশ অঘটনটা ঘটেই যায়। আনায়ার পরনের তোয়ালেটা আকস্মিক খুলে গিয়ে মেঝেতে পড়ে । আনায়ার বিস্ময়াবিষ্ট চোখ…অনবরত কাঁপছে ঠোঁট।দুজনে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে।

অথচ হঠাৎ আনায়ার চেহেরার রং উড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কেনীথের জন্য এখনও বোধগম্য নয়।সে বিষয়টা বোঝার জন্য খানিকটা নিচের দিকে তাকাতেই সম্পূর্ণ হতভম্ব। আকস্মিক তার ঠোঁটজোড়া বিস্ময়ে কিঞ্চিৎ হা হয়ে যায়।

তবে কেনীথ একমুহূর্তও দেরী না করে, তার নজর মাথা ঘুরিয়ে পাশে সরিয়ে নেয়। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলতে লাগে,

“আনা…”

কিন্তু সে ঠিকঠাক ভাবে কিছু বলার আগেই আনায়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আর সোজা অচেতন হয়ে কেনীথের বুকের বা’পাশে হেলে পড়ে। কেনীথও তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে,আনায়াকে নিজের বড়সড় কোটের আদলে ঢেকে, শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে।

এক হাতে আনায়ার মাথার পেছন, আরেক হাতে ওর শরীর…এমন শক্ত করে আঁকড়ে ধরে যেন এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর ভার তার উপর এসে পড়েছে।

একদিকে বাইরে তখনো মুষলধারায় বৃষ্টি ঝড়ছে।আর অন্যদিকে এক নির্জন রাতে, টরেন্টোর দোতলার সেই নিস্তব্ধ অ্যাপার্টমেন্টে—আবারও একজোড়া আগুন পাখির সম্পর্কের নতুন চূড়ান্ত মোড় নিচ্ছে। সেই সাথে বৃষ্টির শব্দে ঢেকে যাচ্ছে সব উচ্চারিত না হওয়া সকল অনুভব।

চলবে________________