একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪০(৩য় অংশ)

0
18

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

পর্ব—৪০(৩য় অংশ)

আচমকা আনায়ার ঘুম ভেঙে যায়। আড়মোড় করে উঠতে গিয়ে মাথা ভার হয়ে আসে তার। অনেকটা রাত করে তারা দ্বীপ থেকে ফিরেছে। আর পরবর্তী…আনায়া হুট করে কিছু মনে করতে পারল না। চোখমুখ কপাল কুঁচকে আশেপাশে তাকাতেই বুঝলো, তারা এখনো আন্ডারওয়াটারের সেই বেডরুমেই রয়েছে। ভোরের আলোয় আশেপাশে ছুটে বেড়ানো মাছগুলো এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু নিজের দিকে তাকিয়েই তার হুঁশ উড়ে যায়। কেনীথ তার পাশে উপর হয়ে শুয়ে রয়েছে। তার একহাতে আনায়ার কোমড় আঁকড়ে ধরে আছে। মুখটা বালিশের মাঝে গুঁজে রাখা। বাকিটা, সে রাতের ঝড়ের পর নতুন ভোরের মতোই।

কেনীথের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে তাই, আনায়া আড নড়াচড়া করল না। বরং নিজের একহাত কেনীথের চুলের মাঝে গুঁজে,আঙুলগুলো দিয়ে নাড়িয়ে দিতে লাগল। মাঝেমধ্যে কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে গতরাতের কথা মনে করার চেষ্টা করল। নিমিষেই তার গাল লাল হয়ে ওঠে।
প্রায় অনেকটা রাত হবার পর তারা আবারও রিসোর্টে ফিরে আসে। কিন্তু এসেই দেখে তখনটার চিত্রটা খানিকটা ভিন্ন। শুরুতে ফুল দিয়ে শুধু ফ্লোরে সাজানো রইলেও, পরবর্তীতে এসে দেখে পুরো বিছানা সহ সর্বস্ব জুড়ে ফুল দিয়ে সাজিয়েগুছিয়ে রাখা। আনায়া বুঝতে বাকি থাকে না কাজটা কে করেছে। এবারের বেলীফুলের সুবাসে আনায়া যেন পুরো মাতাল হয়ে হয়ে যায়। এরপর যা হবার তাই হয়। দুটো আত্মা আবারও উম্মাদে পরিণত হয়ে, পাগলামিতে মেতে ওঠে।

____________________

সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল বড় এক জাহাজ। এসকল বিলাসবহুল জাহাজ সরূপ বাহনকে সহজ ভাবে প্রাইভেট ইয়েট বলা হয়ে থাকে। চারপাশে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি আর সকালের রোদের সোনালী আলো। সবমিলিয়ে চারপাশের আবহ অতুলনীয়।

ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে আনায়া আর ইনায়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইনায়ার পরনে কালো গাউন আর আনায়াটা সাদা রঙের। চুলগুলো ছেড়ে রাখা। বাতাসের দরূন জামা, চুল সবই উড়ছে। আনায়া সেই তখন থেকে একটার পর একটা গল্প বলেই যাচ্ছে আর ইনায়া চুপচাপ তা শুনছে। তার নজরও বিস্তৃত সমুদ্রের মাঝে।

এদিকে কেনীথ আর পাভেল সানলাউঞ্জে আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে। দুজনের পরনেই হাফ স্লিভ টিশার্ট আর শর্টস্। পাভেলের হাতে একটা ম্যাগাজিন, চোখে সানগ্লাস মাথায় হ্যাট। কেনীথেরও তাই, তবে পাভেল যতটা মনযোগী হয়ে ম্যাগাজিন দেখছে তেমনটা কেনীথের ক্ষেত্রে নয়। তার নজর আনায়ার দিকে। দূর হতে প্রায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সে আনায়াকে ফলো করছে। আর এতক্ষণ পর এসে সে অনেকটা অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ নিজেকে সামলে সে তার পা দিয়ে পাভেলের পা বরাবর খোঁচা দেয়। পাভেল শুরুতে কোনো সাড়া দেয় না। তার মনোযোগ আঁটকে রয়েছে ম্যাগাজিনে। এদিকে কেনীথ বিরক্ত হলে আরেকটু জোরে পা দিয়ে গুঁতো দিতেই, পাভেল বিরক্তিতে বলে ওঠে,

“কোন শালারেএএএএএ…?”

—“আমি তোর শালা নই, তুই আমার শালা। এদিকে তাকা গাধা।”

কেনীথের কথা শোনামাত্র পাভেল মুখের উপর থেকে দ্রুত ম্যাগাজিন সরিয়ে পাশে ফিরে তাকায়৷ কেনীথের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে, অপ্রস্তুত হয়ে মিনমিনিয়ে বলে,

“কি হয়েছে ব্রো! কোনো সমস্যা?”

কেনীথ কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাভেলর দিকে খানিকটা এগিয়ে বসে। অতঃপর পাভেলকে কিছু একটা বুঝিয়ে বলতেই সে বিস্তৃত মুচকি হাসে। ওর হাসিতে কেনীথ কিছুটা বিরক্ত হলেও কিছু বলে না।

এদিকে কেনীথের কথা অনুযায়ী পাভেল উঠে গিয়ে ইনায়াদের দিকে এগিয়ে যায়। আনায়াকে কিছু একটা বলতেই সে পেছনে ফিরে তাকায়। তৎক্ষনাৎ কেনীথ অন্যমনস্ক হবার ভান করে বসে থাকে। আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে সেখান থেকে সরে কেনীথের দিকে এগিয়ে আসে।

—“কিছু প্রয়োজন? আপনি… ”

আনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই কেনীথ গম্ভীর্যের সাথে উঠে দাঁড়ায়। জাহাজের ভেতরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আনায়ার উদ্দেশ্য নিরেট স্বরে আওড়ায়,

“হেই ব্লাড! ভেতরে আয়।”

এই বলামাত্রই কেনীথ ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে আনায়া কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে এই ভেবে যে, হঠাৎ হলো টা কি?

আনায়া ভেতরের কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। চারপাশে মানুষজন নেই বললেই চলে। প্রাইভেট ইয়েট হওয়ায় তারা সহ প্রয়োজনীয় খুব অল্প মানুষই এখানে রয়েছে।

আনায়া এদিক সেদিক তাকিয়ে কেনীথকে খুঁজতে শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে তাদের কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এরইমাঝে আচমকা হাতে সজোরে টান পড়ায় আনায়া আকস্মিক আঁতকে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে সে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করেছে।

কেনীথ তার সামনে নির্বিকারে দাঁড়িয়ে। একহাত তার কোমড়ে অন্যহাত তার কাঁধের কাছে দেওয়ালের সাথে ঠেকানো। কিন্তু নিজের সামনে হঠাৎ এভাবে কেনীথের উপস্থিত আনায়ার বোধগম্য হলো না। আর না বুঝতে পারল কেনীথের অদ্ভুত অভিব্যক্তি। আনায়া কপালটা খানিক কুঁচকে বলে উঠল,

“এসব কি শুরু করেছেন? এসবের মানে কি?”

আনায়ার ভাবভঙ্গিতে কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হেসে বলল,

“তুমি যা আন্দাজ করছো, তাই?”

আনায়া খানিকটা বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,

“মানেএএএ?”

কেনীথ চোখ মে’রে বলে,

—“মিস করছিলাম তোকে!”

______________________

বিকেলের শেষভাগে, আনায়া বিচের মাঝে হেঁটে বেড়াচ্ছে। চোখে-মুখে নিত্যন্তই বিরক্তির ছাপ। বিরক্তটা মূলত কেনীথকে ঘিরেই। জাহাজে আচমকা ডেকে নিয়ে যে কাজটা করছে… তা আনায়ার ভাবতেই লজ্জার চাইতেও বেশি রাগে শ”রীর জ্ব”লছে। শেষমেশ জাহাজটাকে পর্যন্তও ছাড় দেয়নি। তখন পাভেল ইনায়ার জন্য কিছু বলতেও পারেনি আবার কেনীথের কাছ থেকে ছাড়ও পায়নি। সবমিলিয়ে যা অকাজ ঘটানোর, তা কেনীথ তখনই ঘটিয়ে ফেলেছে। আর এরপর থেকেই সে হয়েছে লাপাত্তা। আনায়া এতো খুঁজেও, তার খোঁজ পায়নি। শুরুতে পাভেলের কাছে জেনেছে কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছে। ফিরতে নাকি সময় লাগবে। আবার সেই পাভেলই কিছুক্ষণ আগে বলল, কেনীথ নাকি দ্বীপে তারজন্য অপেক্ষা করছে। আনায়া শুরুতে রাগে আসতে না চাইলেও শেষমেশ বিরক্তি নিয়েই এখন সমুদ্রের পাড়ে হেঁটে চলেছে। কিন্তু কোথাও কেনীথের দেখা নেই।

আনায়া অনেকটাই বিরক্ত হলো। বিরক্তিতে তার চোখমুখ কুঁচকে যায়। কিছুটা ক্ষি”প্ত হয়ে দ্বীপের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যায়। জঙ্গল হলেও জাগয়াটা একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারপাশে শুধু বড় বড় নারিকেল গাছ। সামনের দিকে কিছুটা ঝোপঝাড়ও অবশ্য রয়েছে।

আনায়া এগোতে এগোতে এই জায়গাগুলোতে আশপাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। ঠিক তখনই তার মনে হয়, কেউ তাকে আশপাশ থেকে দেখছে। আনায়ার কপাল কুঁচকে যায়। এতোবড় দ্বীপে সে ব্যতীত কেউ নেই। যদিও কেনীথের এখানে থাকার কথা কিন্তু তার কোথাও তো দেখাই মিলছে না।

—“হেই ব্লাড! এদিকে আয় তো একটু।”

আচমকা কেনীথের আওয়াজে আনায়া কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। কিছুটা বিস্মিত চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করে। বুঝতে পারছে না আওয়াজটা কোথায় থেকে এলো। ওমনি সে খেয়াল করে ঝোপঝাড়ের ভেতটা কেমন যেন নড়ে উঠল। আনায়া কপাল কুঁচকে বলে,

“আপনি কি এখানেই আছেন? এই ঝোপঝাড়ের মধ্যে… কি করছেন আপনি?”

—“প্লিজ আয় না তাড়াতাড়ি, হেল্প লাগবে তোর।”

আবারও কেনীথের আওয়াজ শোনা যায়।তবে কিছুটা করুন স্বরে। আনায়া কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আশপাশে তাকিয়ে ঝোপঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। শুরুতেই বিশাল বিশাল নারিকেল গাছ দেখে সে কিছুটা আতং”কিত। বুঝতে পারছে না কেনীথ এখানে কেনো, আর সে করছেই বা কি।

কিন্তু যেই না আনায়া ঝোপঝাড় সরিয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে যায় ওমনিই সে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

বাহির থেকে যা ভেবেছিল ভেতরে তা সম্পূর্ণই ভিন্ন। আর কেনীথ!…সে তো দুটো নারিকেল গাছে বাঁধানো হ্যামকে আরামের সাথে শুয়ে দুলছে। পরনে শুধু হাঁটু সমান সর্টপ্যান্ট। উন্মুক্ত বুক অথচ চোখে সানগ্লাস। একহাতে একটা ডাব অন্যহাতটা অবশ্য মাথার নিচে। দোলনায় দুলে দুলে মনের সুখে স্ট্র দিয়ে ডাবের পানি খেয়ে যাচ্ছে। আর গাছের নিচে বিছিয়ে রাখা পাটির উপর খাবার-দাবারের এলাহী আয়োজন করে রাখা৷ বালিশ, কুসন, চাদর কোনটাই বাদ নেই। আনায়া এসব দেখে সম্পূর্ণ স্তব্ধ, বিস্মিত।

তবে আনায়াকে দেখামাত্রই কেনীথের চোখে মুখে বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠল। সে হ্যামক থেকে নেমে হেেলেদুলে আনায়ার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। এদিকে আনায়ার কপাল থেকে কুঁচকানো ভাজ এখনো বিদ্যমান। কেনীথকে এগিয়ে আসতে দেখে কিছুটা কঢ়া স্বরে বলল,

“আপনি নাকি কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছেন? তাহলে এখানে এসব কি করছেন?”

—“এ কথা কে বলেছে,পাভেল? ঠিকই বলেছে তবে কিছুটা ভুল, আমি বাহিরে নয় ভেতরে এসেছি।”

কেনীথের নির্বিকার কথাবার্তায় আনায়া আরো কিছুটা বিরক্ত হয়।

—“তা এখানে এমন কি কাজ করছেন? আর কখন থেকে এখানে পড়ে রয়েছেন?”

—“আমি কি আর এত কষ্ট করে সেধে এখানে পড়ে আছি? শীপে যে ঝাড়িটা দিলি আমায়…আমি তো ভেবেছিলাম আর তোর সামনেই যাব না৷ আমিও দেখি, আমাকে ছাড়া তুই একা একা কতক্ষণ কি করিস!”

আনায়া কেনীথের এহেন কথায় ভ্রু উঁচিয়ে কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল।

—“দেখে তো মনে হয় না খুব বেশি একটা কষ্ট করেছেন। খাবার-দাবার, চাদর বালিশ… সবই তো রয়েছে।”

—“ঐ আর কি! দুপুরের একটু ঘুমিয়েছিলাম, এইজন্য সবকিছুই একেবারে সাথে করে নিয়ে এসেছি।”

আনায়া কেনীথের নির্লিপ্ত কথাবার্তায় কিছুটা বিরক্ত হলো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় একবার। কিঞ্চিৎ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“তবে আর কি! থাকুন আপনি একা একা এই ঝোপঝাড় জ”ঙ্গলের নারিকেল গাছের তলে…, আমি না হয় চললাম।”

আনায়া বিরক্তি নিয়ে কথাটুকু বলেই চলে যেতে নিকে কেনীথ ছুটে এসে,পেছন হতে তার হাত ধরে ফেলে। আনায়া ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

—“কি হলো?”

“কোথায় যাচ্ছিস?”

—“কোথায় যাচ্ছি মানে? আমি কি এখন এই জঙ্গলের মধ্যে আপনার সাথে পিকনিক করব নাকি?”

—“করলে সমস্যা কি? এই নে ডাবের পানি খা! মাথা ঠান্ডা হবে!”

—“এই আপনার সমস্যা কি বলুন তো? এখানে যে আমাকে কিসের জন্য এনেছেন, তা তো এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আগে যদি জানতাম আপনার উদ্দেশ্য এতো…ম”রে গেলেও আসতাম না।আসতাম না আমি এখানে। আবার বলে, ট্যুরে যাব। ফ্যামিলি ট্যুর! এটাকে কোন এঙ্গেলে ফ্যামিলি ট্যুর বলে?”

আনায়ার কথাবার্তা শুনে কেনীথ হেসে ফেলল। আনায়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,

“আমার তো সব এঙ্গেলেই ঠিকঠাক লাগে। কিন্তু তুমিই তো… ”

আনায়ার মেজাজ নিমিষেই বিগড়ে যায়।সে কি বলছে আর কেনীথ কি বলছে! কেনীথের বাহুতে আঘাত করে কঢ়া স্বরে বলল,

“অস”ভ্য লোক! সরুন আমার সামনে থেকে। আপনি এখান থেকে কবে যাবেন, জানি না।আর জানতেও চাই না। পারলে সারাজীবন বাঁদরের মতো এই জঙ্গলের গাছের ডালে ঝুলে থাকুন৷ কিন্তু আমি আর এইখানে থাকব না। আজই আমার আর ইনায়ার যাওয়ার ব্যবস্তা করুন।”

আনায়ার কথায় কেনীথের কোনো হেলদোল নেই। সে হাতে থাকা ডাবটা নিচে রেখে দেয়। একহাতে আনায়ার কোমড় টেনে কিছুটা নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। অতঃপর আনায়ার কপালের আশেপাশে এলোমেলো চুলগুলো আঙুল দিয়ে স্বযত্নে ঠিক করে দিতে লাগে। আনায়া কিছু না বললেও চোখমুখের স্পষ্ট গম্ভীর্যের ছাপ।

কেনীথের কাজ শেষ হলে সে আনায়ার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। অথচ আনায়ার চাহনি নির্বিকার, নির্লিপ্ত। কিন্তু কেনীথ অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আচমকা আনায়ার কপালে কপাল ঠেকায়। নিমিষেই আনায়া কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠতেই সে কেনীথ নিরেট কন্ঠে বলে,

“সবসময় এতো রে”গে থাকিস কেনো, বল তো? এতো মেজাজ ঠিক নয় বউউউউ! তোমার এতো মেজাজে যে আমিই একদিন ঝলসে যাব।”

আনায়া কেনীথের দিকে নির্বিকারে অপলক চেয়ে। মুখে কোনো কথা নেই। ওদিকে কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে আবারও বলে,

“মেজাজ ঠান্ডা হয়নি এখনো? চলে যাবি?”

আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দেয়,”হুম।”

—“আজ বরং থাক, কাল সবাই মিলে চলে যাব।… দ্বিমত নেই তো?”

—“নাহ, আমি থাকব না। আপনি আমার আর ইনায়ার…”

—“হুম, বললামই তো কাল সবাই চলে যাব। আজকের দিনটা একটু মানিয়ে নে।”

আনায়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ভারী শ্বাস ফেলে বলে,

“ঠিক আছে, তবে আমাকে ছাড়ুন৷ আমি রিসোর্টে যাব।”

—“পরে যাই?”

—“কেনো?”

—“তুই চলে গেলে, আমি তোকে মিস করব।”

কেনীথের এহেন হেয়ালি কথাবার্তায় আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে ফেলল। কিছুটা এক ভেবে নিয়ে বলল,

“এই আপনি এমন হেঁয়ালিপানা কথাবার্তা কেনো…”

আনায়া বলতে বলতেই হঠাৎ সে কিছু একটা আন্দাজ করে ফেলল। এদিকে কেনীথ আনায়াকে আরো নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে।আর আনায়া হাত ছোটাছুটি করতে গিয়ে বলছে,

“ছাড়ুন আমায়, দূরে সরুন! দূরে সূরুন। ভুলেও ওসব করার চিন্তা ভাবনা করবেন না৷”

আনায়ার কথাকে কেনীথ পাত্তা না দিয়ে নির্বিকারে জবাব দেয়,

“আশেপাশে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কেউ নেই। কিচ্ছু হবে না।”

আর এ কথা শোনামাত্রই আনায়া দাঁত খিঁচে চেঁচিয়ে ওঠে,

“এই নাহ! ছাড়ুন আমায়, আআআআআআ…”

_________________

চারপাশে শুনশান নিরবতা। সময়টাও রাত নয়টা কি দশটা। চতুর্পাশে সমুদ্র আর মাঝে সুসজ্জায় সাজানো রিসোর্টে। আর একই সাথে নীল জলরাশীতে পরিপূর্ণ ইনফিনিটি সুইমিংপুল। যার কিনারা ঠিক কোথায় গিয়ে মিশেছে তা বোঝা মুশকিল। কেননা এটি এমন ভাবে তৈরি করা যেন সমুদ্র আর পুল দুটোই মিলেমিশে একত্রে মনে হয়।চারপাশে বর্ডার গ্লাসের হওয়াই, এমনটা মনে হবার কারণ।

রাতের বেলায় এইজায়গায় আবহটা নিত্যন্তই শীতলতায় পূর্ণ । চারপাশে হতে ভেসে আসা মৃদু শীতল বাতাস যে কারো গায়ে শিহরণ বয়ে দেবে।অথচ আনায়া এমন আবহের মাঝে চুপচাপ স্থির হয়ে পুলের মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবে বসে রয়েছে। চুলগুলো তার পানিতে চুপসে রয়েছে। পরনের পাতলা গাউনটাও একদম ভিজে জুবুথুবু হয়ে গিয়েছে। এমনটা নয় যে তার ঠান্ডা লাগছে না। কিন্তু সে যে জেদ নিয়ে এই শীতল আবহের মাঝে পানিতে ডুবে রয়েছে, তা এই ঠান্ডার চেয়ে বহু গুনে তীব্র।

প্রায় আধঘন্টা হয়ে গিয়েছে তবুও আনায়ার পানি থেকে ওঠার নাম নেই। চোখেমুখে স্পষ্ট গাম্ভীর্যের ছাপ। চোয়াল শক্ত করে সমুদ্রের দিকে মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে। সমুদ্রের দূর প্রান্তে কিছু একটা আলো মিটমিট করে জ্বলছে। তার নজর সেদিকে রইলেও, আদতে সে ভাবছে ভিন্ন কিছু। মেজাজ তার নিত্যন্তই বিগড়ানো।

এরইমাঝে কোথায় থেকে যেন খুঁজতে খুঁজতে কেনীথ পুলের কাছে এসে থেমে যায়। কপাল কুঁচকে পুলের পাশ দিয়ে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে যায়। চারপাশে নীল রাঙা আলোয়, পানিতে ডুবে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে সে কিছুটা আশ্চর্য। কপাল কুঁচকে আনায়ার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

“ঐ কি রে! তুই এখানে…এভাবে কি করছিস?”

আনায়া কোনো উত্তর দেয় না। তাকে এভাবে চুপচাপ থাকতে দেখে কেনীথের কপাল আরো কিছুটা কুঁচকে যায়।

—“কি রে! তোর কিছু হয়েছে? জানিস, তোকে কতক্ষণ ধরে খুঁজছি। আর এভাবে পানিতে কতক্ষণ ডুবে থাকবি? ঠান্ডা লাগছে না তোর?”

আনায়া কোনো কিছুই বলে না। এমনকি সে চোখ তুলে একবার কেনীথের দিকে তাকানোরও প্রয়োজনও মনে করে না। এদিকে কেনীথ কিছুক্ষণ তার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকার পর বলে,

“আনায়া হেয়ালি করিস না! কি হয়েছে বল নয়তো…রুমে আয়। যথেষ্ট রাত হয়েছে,এখন ঘুমাবি৷”

—“আমার ঘুম পায়নি। আপনার ঘুমানোর হলে, রুমে গিয়ে ঘুমান। আমি এখানেই থাকব।”

এতোক্ষণ পর আনায়ার এহেন কথাবার্তা কেনীথকে নিরাশ করল। ঘুমের ভাবে হায় তুলতে তুলতে বলল,

“মজা করিস না! এখানে সারারাত পানির মধ্যে ডুবে থাকলে, দুদিন বাদে নিউমোনিয়া হয়ে ম” রে যাবি। তখন গিয়ে তোর তেজ কমবে।”

—“আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না।তবে আপনার কিসের সমস্যা? আর এমনিতেও আমি শখে এখানে বসে নেই। আমার গরম লাগছে, তাই…”

—“রিয়েলি?… ঠিক আছে তবে থাক। আমি না হয় ঘুমাতে চললাম।”

কেনীথ আর কথা বাড়াল না। হাই তুলতে তুলতে রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এদিকে কেনীথকে এতো সহজেই চলে যেতে আনায়ার চোখেমুখে খানিকটা সন্দিহান ভাবভঙ্গি ফুটে ওঠে। পরবর্তীতে নিজেই খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আওড়ায়,

“সত্যি সত্যি ঘুমালেই ভালো। নয়তো…হোয়াট এভার, আমার যদি এই ঠান্ডা পানিতে সারারাত ডুবে থাকায়, নিউমোনিয়া হয়ে ম’রতেও হয়, তবুও আমি রাজি। কিন্তু, কোনোভাবেই আজ আর আমি ভেতরে যাব না। আমি কি জানি না, নাকি! কিসের জন্য আমার এতো খোঁজ চালাচ্ছে।”

আনায়া এটুকু বলতে না বলেতই প্রচন্ড বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে আবারও বলে উঠল,

“অসভ্য, শয়”তান একটা! পানির নিচে আর জাহাজ পর্যন্তও ঠিক ছিল। তাই বলে ঐ জঙ্গলের ঝোপঝাড় আর নারিকেল গাছগুলোকেও রেহাই দিল না। আবার বলে ফ্যামিলি ট্যুর, বুড়ো বয়সে কত্তসব ভীমরতি হয়েছে…ঠাডা পরুক!”

—“আমার উপর ঠাডা পড়লে, তোমায় সুদ্ধ পরুক,বউ। একা ম’রে শান্তি পাব না আমি।

আচমকা কারো কন্ঠস্বরে আনায়া বিস্ময়ে আঁতকে উঠল। নিজের এতোকাছে হঠাৎ কারো উপস্থিতি তার কাছে অকল্পনীয়। আনায়া পেছন ফিরে তাকানোর পূর্বেই তার কোমড়ে টান পড়ল। কেউ তার কোমড় পেঁচিয়ে নিচের দিকে টান দিয়েছে।

ঘটনাটা এতে দ্রুত ঘটে যে, আনায়া আর নিজেকে সামলাতে পারে না। বরং তার পূর্বেই সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পানির নিচে চলে যায়৷ নিমিষেই নাক মুখ দিয়ে পানি প্রবেশ করে তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অথচ এমন মহূর্তে সে পানির নিচে স্পষ্ট কেনীথের উপস্থিত টের পায়। কোনোমতে চোখ খুলে তাকাতেই দেখে পানির নিচের কেনীথের ঠোঁটে বিস্তৃত হাসি ঝুলছে। অথচ তার দম বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আনায়া বাঁচার জন্য হাত ছোটাছুটি করতে নিলেও তার মনে হয়… সব শক্তি ফুরিয়ে আসছে। অথচ কেনীথের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়া পাচ্ছে না।

এদিকে আনায়ার এহেন অবস্থা দেখে কেনীথ আনায়াকে নিয়ে পানির উপরে ওঠে। আচমকা শ্বাস ফিরে পেতেই আনায়া যেন নিজের প্রাণ ফিরে পায়। বিস্মিত চোখজোড়া, এলোমেলো নিশ্বাস…এখন শুধুই বাঁচার চেষ্টায় রয়েছে।

অথচ কেনীথের এসবে কোনো হেলদোল নেই। সে মিটমিট করে হেসে চলেছে। আনায়ার হাত দুটো কেনীথ বাহু আর কাঁধের কাছে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে।

আনায়া কিছুটা স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে লাগলে, কেনীথ খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,

“তাই তো বলি, আমার বউ এই রাতের বেলায়, এমন ঠান্ডা মাঝেও কিভাবে পানিতে ডুবে রয়েছে। এখন তো দেখি, বউয়ের তেজে পুলের পানি পুরো টগবগিয়ে উঠতে। আহ্, কখন না জানি আমিই সেদ্ধ হয়ে যাই।”

—“আপনি… আপনি এখা..নে…কখন…?”

—“এই তো একটু আগেই এসেছি। আপনি আমাকে গা’লাগা’লি করতে ব্যস্ত ছিলেন বিধায়,হয়তো টের পাননি ।”

আনায়ার বিস্ময় এখনো কাটেনি। সে আরো কিছু বলতে নেবে এর পূর্বেই কেনীথ আবারও শয়তানি হেসে বলল,

“আয়, আজকে একটা গেইম খেলি। তোর নিউমোনিয়াতে ম” রার খুব শখ না? চল তবে, তোকে আজ পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে মা”রব।”

কেনীথের অদ্ভুত তীর্যক হাসি আর নির্বিকার কথাবার্তায় আনায়ার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার করার মতো কোনো কিছুরই সুযোগ হলো না।বরং তার পূর্বেই কেনীথ আনায়াকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। দু’হাতে আনায়ার কোমড় আর পিঠ আঁকড়ে সোজা পানির নিচের দিকে ডুব দেয়। আনায়া হাত ঝাপটে কেনীথকে দূরে সরাতে গিয়েও পারে না। কেনীথের গায়ে খামচে নখের আঁচড় বসায় তবুও যেন কেনীথের মাঝে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না। আনায়ার অবস্থা যখন আবারও নাজেহাল, ঠিক তখনই কেনীথ তাকে নিয়ে পানির উপরে উঠে আসে।

কিন্তু এবার আনায়ার অবস্থা আগের চেয়েও বেহাল হয়ে গিয়েছে। চোখজোড়া নিভু নিভু নিস্তেজ…শ্বাস নিতেও তীব্র কষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে অনবরত হাঁপিয়ে চলেছে সে৷ অথচ কেনীথ নির্বিকারে বলল,

“এটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলে চলবে? সারারাত তো এখনো বাকি রয়েছে… তারা, মাই ব্লাডডড!”

এই বলতে বলতেই কেনীথ আনায়ার এমন অবস্থার মাঝেও ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। পিঠ থেকে হাত সরিয়ে তা চলে যায় আনায়ার মাথার পেছনে। একইসাথে কোমড়ের বাঁধনটা হয় দৃঢ়। আর সোজা আবারও ডুব দেয় পানির নিচে। এভাবেই পেরিয়ে যেতে থাকে দীর্ঘ একটা সময়। আনায়া যে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত, তার এতো চেষ্টার পরও আজ সে এখান থেকেই বাঁচবে না। শেষমেষ কেনীথ এই শুনশান নিস্ত’ব্ধ জলরাশির মাঝেই শেষ অঘটন টা ঘটিয়ে ছাড়বে।

_______________

এখনো ভোরের আলো ফোটোনি। চারপাশটা এখনও কুয়াশা জড়ানো আঁধারে ঢাকা। ধীরে ধীরে সমুদ্রের এক কোণা হলে সূর্যের মৃদু লালা আভার দেখা মিলছে। এদিকে বেডরুমে বিছানার উপর গুটিয়ে বসে থাকা আনায়ার অবস্থা বেহাল। চুলগুলো এখনো হালকা ভেজা ভেজা। গায়ে জড়ানো ভারী সাদা কম্ফোর্ট। শরীর ঠান্ডায় অনবরত কাঁপছে। মাথা ভারী হয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর হাঁচি দিয়ে চলেছে। নাক ঠোঁট লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। চারপাশের জানালা দরজা সব বন্ধ। যাতে বাহিরের বাতাস ভেতরে ঢুকতে না পারে। এছাড়া রুমের মধ্যে আলাদাভাবে হিটার তো রয়েছেই।

আনায়া এই রাতের কথা আর মনে করতে চায় না। তার মেজাজ গরম করার মতোও পরিস্থিতি আর এখন নেই। কাল রাতে সুইমিংপুলে কেনীথ যে পাগলামি করেছে তাতে আনায়ার দুনিয়াতেই থাকার শখ মিটে গিয়েছে। আপাতত সব চিন্তা বাদ দিয়ে বাঁচার চিন্তা করে যাচ্ছে।

এরইমাঝে কেনীথ দরজা ঢেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করল। রুম জুড়ে গ্লাসের দেওয়াল হওয়ায় আনায়া শুরুতেই তা খেয়াল করেছে। যার ফলে কেনীথ এই আগমন তার পছন্দ নয়। এদিকে কেনীথ রুমে এসে দরজাটা আবার লাগিয়ে দেয়। পরনে কারো রং-এর প্যান্ট আর গলায় একটা সাদা রংএর তোয়ালে ঝুলানো। চুলগুলো ভেজা। সারারাত পানিতে থাকার পর সবেমাত্র দুজনে গোসল সেড়েছে।

কেনীথের হাতে একটা ধোঁয়া ওঠা তরলে পরিপূর্ণ মগ। সে তা নিয়ে আনায়ার কাছে এগিয়ে আসে। নিমিষেই আনায়া রা”গে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেনীথ তা দেখেও না দেখার ভাণ করে।

—“এই নে,এটা খেয়ে নে। কিছুটা ভালো লাগবে।”

আনায়া তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দেয়,”খাব না আমি, নিয়ে যান এসব।”

—“এটা খেয়ে, একটা পেইন কিলার খেয়ে নে। জেদ করিস না।”

—“বললাম তো খাব না আমি।”

এ কথা শোনামাত্রই, কেনীথ আনায়ার মাথার পেছনে হাতের তালু দিয়ে, খানিকটা সজোরে বারি দিয়ে বলল,

“খাবি না কেনো?”

আচমকা এহেন কান্ডে আনায়া নিজেকে সামলাতে না পেরে কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে পড়ে। পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নিয়ে কেনীথের দিকে কঢ়া চোখে তাকিয়ে বলে,

“বেশি হচ্ছে কিন্তু! বারাবাড়ি করলে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি সমুদ্রে ঝাপ দেব।”

—“তো তাতে আমার কি হবে?তুই ম’রে গেলে আমি আরেকটা বিয়ে করে বউ আনব। এবার পুরো লাল টুকটুকে বউ…কোনো রেড কালারের ঝগড়াটে শাঁকচুন্নিকে নয়।”

কেনীথের এহেন নির্লিপ্ত কথা শুনে আনায়া মুখ ফিরিয়ে নেয়। রাগে শরীর তার গিজগিজ করছে। এমন মূহুর্তে কেনীথ কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানায় উঠে বসে। আনায়ার মুখোমুখি হয়ে বিছানার মাঝ বরাবর বসে তার দিকে মগটা এগিয়ে দেয়। অথচ আনায়া ফিরিয়েও সেদিকে তাকায় না। কেনীথ আনায়ার হাত ধরতে নিলেও, আনায়া নিজের হাত সরিয়ে নেয়।

—“তারা মাই ব্লা…ড!

—“রাখুন আপনার আলাপ,না আমি আপনার কোনো চাঁদ-তারা আর না কোনো টলটলে র’ক্ত। এসব ঢং বাদ দিন।”

আনায়ার কঢ়া কথায় কেনীথ কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। অতঃপর আবারও একদম শীতল কন্ঠে বলতে শুরু করে,

“শুন না! আমার দিকে একটু ফিরে তাকা! ঐ আনায়া!”

আনায়া এবারও নিশ্চুপ। কেনীথের কোনে কথাই যেন তার গায়ে লাগছে না। কেনীথ আনায়ার এহেন ভাবগতিকে খানিকটা নিরাশ হয়ে ভারী শ্বাস ফেলে।অতঃপর আনায়ার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে বসে। বাচ্চাদের মতো ভঙ্গিতে ধীরস্বরে টেনে টেনে বলতে শুরু করে,

“বউ! ও বউ! শুন না! আর কত রা’গ করে থাকবি।এবার তো একটু, আমার উপর দয়া মায়া কর। এদিকে একটু চেয়ে দেখ, তোর অবলা নিষ্পাপ বরটা…তার একমাত্র বউয়ের বিরহে আধম’রা হয়ে যাচ্ছে।”

আনায়া এবার মুখ ফিরিয়ে তাকায়। কেনীথের দিকে তীক্ষ্ণ দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠল,

“সবসময় অভিনয় ভালো লাগে না। আর সবকিছুর একটা লিমিট রয়েছে। কিন্তু আপনি সব সীমা অতিক্রম করেছেন।”

এমন সিচুয়েশনেও কেনীথের কেন জানি হাসি পেল। কিন্তু এমুহূর্তে হেসে ফেললে তুলকালাম কান্ড বেঁধে যাবে। কেনীথ নিজেকে কোনো মতে সামলে নিয়ে তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,

“আচ্ছা সরি, আর কখনো এমন কিছু করব না।”

—“সরি বললেই সব মাফ? আপনার সরি আপনি ধুয়ে ধুয়ে খান।”

—“আহা! এতো রাগ তো ভালো নয়।”

—“হ্যাঁ,এতো রাগ যেমন ভালো নয়, তেমনি আমিও ভালো নই। তাই দূরে থাকুন।”

—“সবসময় আমি যদি এতো দূরে দূরে থাকি তবে আমাদের ফুটবল টিমের কি হবে? ওরা তো এইজন্মেও আসতে পারবে কিনা সন্দেহ।”

—“দেখুন, সবসময় এসব মজা ভালো লাগে না। আপনি কি করেছেন, একবার ভেবে দেখুন।”

আনায়ার অভিব্যক্তি নিরেট হলেও কেনীথ মিটমিট করে হাসছে আর কথা বলছে।

—” কি করেছি?”

—“সারারাত আমারকে পানিতে চুবিয়ে আধমরা বানিয়ে, এখন বলছেন কি করেছেন?”

—“শুধু কি পানিতে চুবিয়েছি? আর কিছু করিনি?”

কেনীথ মিটমিট করে ঠোঁট কামড়ে হেসে কথাটা বলতেই, আনায়া জোরে দুবার শ্বাস ফেলল। কেনীথের দিকে কঢ়া চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলল,

“হয় আপনি আমার সামনে থেকে বেড়িয়ে যান, নয়তো আমি চলে যাচ্ছি। আপনার সবসময় এতো রং তামাশা আমার সহ্য হচ্ছে না।”

—“তা সহ্য হবে কেনো! প্রতিবার ঘটানোর পর ভাবটা এমন দেখাও যে সব মনে হয় আমিই জোর করে করেছি। অথচ কিছু সময় পর যখন, গিরগিটির মতো চেঞ্জ হয়ে নিজের আসল রূপটা দেখাও…”

—“আসল রূপ বলতে কি বোঝাতে চাইছেন?”

কেনীথ কিঞ্চিৎ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

“আমার চেয়ে যে,তুই নিজে প্রতিবার বেশি উ”ত্তেজিত থাকিস, এটা কি মিথ্যে?”

নিমিষেই আনায়ার অভ্যিব্যক্তি বি”স্ফোরকের ন্যায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।অথচ একই সাথে তার গালও গরম হয়ে গিয়েছে।ওদিকে কেনীথ তা দেখে, নিজের এ কথা বলা মাত্রই, খিলখিল করে হাসিতে মেতে উঠল। কিন্তু আনায়ার গাম্ভীর্যের ভাবভঙ্গিতে বিষয়টা এখনই থামাতে চাইল। নয়তো পরবর্তী আবার সিচুয়েশন হাতের বাহিরে চলে যাবে।

—“আচ্ছা, আর এসব বলব না। আর প্লিজ, এবারের মতো মাফ করে দে। বিশ্বাস কর, আমি আর কখনো এসব কাজ করব না। একদম ভালো হয়ে যাব,পাক্কা!”

—“হাহ্! আপনি…তাও আবার ভালো!”

—“হুম তো! তুই দেখে নিস, আমি একদিন অনেক ভালো হয়ে যাব।”

—“যেদিন ভালো হবেন, সেদিন বিশ্বাস করব। তার আগে নয়।”

—“আচ্ছা এসব বাদ দে। আগে এটা খেয় নে।”

আনায়া ধোঁয়া ওঠা মগের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,

“কি এটা?”

কেনীথ কিঞ্চিৎ ঠোঁট কামড়ে মুচকি হেসে জবাব দেয়,

“আমার হট বউয়ের জন্য স্পেশাল হট চকলেট। আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। টেস্ট অসাধারণ, কিন্তু তোর চেয়ে বেশি না।”

একথা শুনে আনায়া চোখ রাঙিয়ে দাত কিড়মিড় করে তাকালে, কেনীথ কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে বলে,

“আহ…সরি। আমাকে তো আবার ভালো হতে হবে।”

কেনীথ এটুকু বলেই আলাভোলা চেহেরা বানিয়ে আনায়ার হাতে মগটা ধরিয়ে দেয়। আনায়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে খেতে শুরু করলে, কেনীথ আনায়ার পেছনে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে। নিজের গলা থেকে তোয়ালে টা নামিয়ে, আনায়ার চুলগুলো দুহাতে ধীরে ধীরে স্বযত্নে মুছে দিতে লাগে।

—” কেমন হয়েছে ?”

আনায়া খাওয়ার মাঝে কেনীথের প্রশ্নে কিছুটা থমকে যায়। পরবর্তীতে মাথা নাড়িয়ে বলে,

“ভালো।”

—“শুধু ভালো?”

ওদিকে কেনীথ এখনো নিজের কাজ স্বযত্নে করে যাচ্ছে। এই কাজটা করতে কেনো যেন তার বরাবরই ভালো লাগে। আর আনায়া এবার খানিকটা ঠোঁট উল্টিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,

“নাহ, অনেক ভালো।”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। অতঃপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“হেই ব্লাড!”

—“হুম।”

—“ভেবেছি এখান থেকে সোজা রাশিয়ায় যাব। পরবর্তীতে কি করব জানিনা। তবে তোর কথা ভেবে যতটুকু বুঝলাম… আমার আপাতত ওখানে যাওয়াটাই বেস্ট ডিসিশন হবে।… তোর কোনো সমস্যা নেই তো?”

আনায়া পাশে ফিরে মাথা উঁচিয়ে, কেনীথের দিকে তাকায়। কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে বলল,

“কি হলো? কোনো আপত্তি নেই তো?”

আনায়া কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল,”নাহ, কোনো আপত্তি নেই।”

আনায়ার সম্মতিতে কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হাসে। আনায়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছোট্ট করে চুমু একে দেয়। আচমকা এহেন কান্ডে আনায়া কিঞ্চিৎ চমকে ওঠে চোখের পলক ঝাপটায় । কেনীথ আবারও মুচকি হেসে আনায়ার নাক বরাবর নাক ঘষে দিয়ে, আলতোভাবে ঠোঁট ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

“”নাউ ইট’স টাইম টু স্টার্ট অ্যা নিউ চ্যাপ্টার অফ আওয়ার স্টোরি।”

চলবে___________________