একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪২ (সমাপ্তি পর্ব→(০২ অংশ) )

0
24

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

সমাপ্তি পর্ব (২য় অংশ)

রোজ আর ইনায়া দুজনে মিলে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে বেড়োয়। কখনো হাঁটতে হাঁটতে, আবার কখনো বা তাদের নিজস্ব ঘোড়া নিয়ে। বেশিরভাগ সময়টাই হয় ভোর সকাল কিংবা সন্ধ্যায়।যেহেতু বিশাল বড় এরিয়ার পুরোটাই তাদের। তাই এই পুরো জায়গায় একবারের জন্য হাঁটতে নিলেও, একদিন তো এমনিতেই লেগে যাবে। বরাবরের মতো আজও দুজনে ভোর সকালে হাঁটতে গিয়েছিল। আজ ফিরতে ফিরতে প্রায় অনেকটা সকালই হয়ে এসেছে। তবে আজ তাদের হাঁটতে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল খানিকটা ভিন্ন।

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, তাদের একটা নিজস্ব বাগান করা হয়েছে। যে বাগানের বিশেষত্ব হলো, সেখানে প্রচুর পরিমাণে বিশেষ ডার্ক ব্লাড রোজের গাছ রয়েছে। যেহেতু বাগান করাটা কেনীথের বরাবরই একটা প্রিয় কাজ…সেই সাথে অরিনও এসব খুব বেশিই পছন্দ করে; তাই সেই বাগানটা রোজ, অরিন কিংবা কেনীথ তিনজনই বলা চলে।তবে বাগানের দেখাশোনার কাজ, বেশিরভাগ সময় রোজেরই করা হয়। আর আজকে দুজনে মিলে সেই গাঢ় কালচে লাল রং-এর গোলাপ গুলোই আনতে গিয়েছিল। যেটা বিশেষত কেনীথ এবং অরিন, দুজনেরই সবচেয়ে প্রিয় ফুল।

রোজ আর ইনায়া দুজনেই হেটে হেটে বাড়ির সামনে এলো।ইনায়ার পরনে কালো ও রোজের পরনে লাল রঙের গাউন। যেটা দেখতে হুবহু অরিনের গাউনের মতোই। অরিন আর রোজ বেশিরভাগ সময়ই একই রকম জামা পড়ে। দুজনের সাজগোছও অনেকটা একই।তবে স্পেশাল একটা ব্যাপার… যেমন কেনীথের মতো অরিনের চোখের মণিও কিছুটা লালচে। অন্যদিকে ইনায়া সেই আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। যবে থেকে সে ইনা হয়ে ছিল, তবে থেকেই যেন সেই প্রানবন্তর চঞ্চল ইনায়ার দাফন হয়ে গিয়েছে। আজও অত্যন্ত চুপচাপ,এক অদ্ভুত জীবন পাড় করছে। প্রয়োজন ব্যতীত দু একটার চেয়ে বেশি কথাও তার মুখ থেকে বেড়োয় না। যতটা সম্ভব পারে সে নিজেকে সবার থেকে আড়াল করতে চায়। তবুও রোজ যেন ইনায়াকে নিজের ছোট বোনের নজরেই দেখে আসছে। ইনায়া না চাইলেও সবসময় তার সাথে মেলামেশা কিংবা গল্প করা চেষ্টা করে। যাতে ইনায়ার সংকোচ আর ভয়টা দিন দিন সহজতর হয়। বয়সে অবশ্য খুব বেশি পার্থক্য নেই তাদের। দুজনকে সমবয়সীই বলা যেতে পারে।

বর্তমানে দুজনের পাশে এবং পেছনে দুজন দুজন করে মূলত চারজন গার্ড রয়েছে। এবং তাদের হাতে বড় বড় দুটো ফুলের ঝুড়ি। হাঁটার মাঝে দুজনে টুকটাক গল্প আলাপও করছিল। যদিও বা তা জীবন জটিলতার বিষয় সম্মন্ধে।

—“রোজ! আমাদের জীবনটা আর সবার মতো স্বাভাবিক হলেও তো পারতো। প্রত্যেকের জীবনের গল্পটা এতো বি”ষাক্ত কেনো হলো?”

ইনায়ার চোখে মুখে সেই ইনার ন্যায় আজও গম্ভীর্যের স্পষ্ট ছাপ কিংবা দৃঢ়তা বিরাজমান। তবে তার বলা প্রতিটা কথায় এক আকাশস্পর্শী হতাশা, দীর্ঘশ্বাস অনুভূত হয়। যথারীতি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে, যেন অসীম নীলিমার গভীর থেকে কোনো উত্তর টেনে আনতে চাইছে। হয়তো সে এটাও জানে,তার প্রশ্নের উত্তর নেই। অথবা উত্তর থাকলেও তা শূন্যতার চেয়েও অধিক গুনে ভারী।

ইনায়ার কথা শুনে রোজ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। চারপাশের আবহে এক ধরনের স্তব্ধ নীরবতা; শব্দহীনতার মাঝেও গুঞ্জন তুলছে। রোজ গভীর এক শ্বাস নেয়।ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা টেনে বলে,

“স্বাভাবিক জীবন? সেটা আসলে কারো থাকে না, ইনায়া। আমরা শুধু ভাবি, অন্যরা সুখে আছে,তাদের জীবনটা হয়তো সহজ। কিন্তু সত্যটা কি জানো?
প্রত্যেকটা মানুষের ভেতরে প্রতিনিয়ত একেকটা ঝড় বয়ে চলেছে।প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে জীবন যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করতে ব্যস্ত। কারো যুদ্ধটা চোখে দেখা যায়, কারোটা অন্তরের গভীরে দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে যায়।
কেউ তা প্রকাশ করে। কেউ বা অন্তঃস্থলের গহীনে লুকিয়ে রাখে;কাউকে বুঝতে দেয় না।আবার কেউ এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে, তার আর এসব প্রকাশ করার শক্তিও থাকে না।

এছাড়া জীবন চলে তার নিজের নিয়মে। আর মানুষ শুধু সেই নিয়মের ঘূর্ণিপাকে ধরা পড়ে।শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করে। আমরা ভাবি, সুখ একটা স্থায়ী কিছু। কিন্তু আদতে সুখ হলো এক নির্লিপ্ত মরীচিকা। দৌড়ে চলার মাঝে এক ঝলক অনুভূতি মাত্র।”

রোজের কথায় ইনায়া যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। সে চোখ নামিয়ে নিয়ে নির্বিকার স্বরে বলে ওঠে,

“তবে আমরা কি কেবল অনবরত ছুটতেই থাকব?…সেই মরীচিকার পেছনে?”

রোজ হালকা হাসে। খানিকটা সময় নিয়ে দীর্ঘ ফেলে বলে,

“মানুষ শুধু ছুটে না। কেউ ছুটে স্বপ্নের পেছনে—কেউ দুঃস্বপ্নের হাত থেকে পালাতে। কেউ অতীতের ছায়া এড়িয়ে বাঁচতে চায়।কেউ বা চায়, ভবিষ্যতের আলো ধরতে।
কিন্তু একসময় সবাই বুঝতে পারে, কোনো পথই মুক্তির দিকে যায় না। প্রতিটা রাস্তার শেষে নতুন এক যন্ত্রণার অধ্যায় অপেক্ষা করে।”

ইনায়া রোজের দিকে একপলক চেয়ে দেখে। পরক্ষণেই মাথা ঝুকিয়ে মাটির দিকে তাকায়। তার অদ্ভুত লাগে এই জীবন। একটা অজানা আ”তংকের ছায়া যেন সর্বত্র তার পেছনে তাড়া করে চলেছে। এতো বছরে খুব বেশি উন্নতি হয়নি তার। সর্বদাই এক জোড়ালো অগোছালো ঝড় তার অভ্যন্তরীণ অস্তিত্বকে এলোমেলো—তোলপাড় করে দেয়। আর যখনই সে কোনো বিষয়ে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে, তখনই যেন তার অন্তরালের ঝড়টাকে, ক্ষণিকের জন্য হলেও দমিয়ে রাখার দায়িত্বটা পড়ে রোজের হাতে।

—“তাহলে এই বিষাক্ত গল্প থেকে আমাদের মুক্তি কোথায়, রোজ?”

রোজ মাটির দিকে তাকিয়ে, পায়ের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতাটাকে আলতো করে পায়ের আঙুল দিয়ে সরিয়ে দেয়। অতঃপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে ওঠে,

“মুক্তি বলতে কিছু নেই। আমরা শুধু অভ্যস্ত হয়ে যাই। প্রথমবার বিষ খেলে মানুষ ছটফট করে, শরীর প্রতিরোধ করতে চায়। কিন্তু ধীরে ধীরে, সে বিষকেই নিজের রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। ততদিনে বিষ আর বিষ থাকে না, জীবন হয়ে যায়।”

ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তার প্রশ্ন গুলো যেমন প্রতিবার অগোছালো হয়। তেমনি রোজের প্রতিটা উত্তরের গভীরতাও হয় বিস্তৃত—অমেয়।

—“তুমি বলতে চাইছো, আমরা শুধু সহ্য-ই করব? তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে…কোনো আশার আলো ছাড়াই?এভাবে কি আদৌও বাঁচা সম্ভব?”

ইনায়ার আচমকা উদ্বিগ্নতায়, রোজ মুচকি হেসে আলতোভাবে মাথা নাড়ায়।

—“আশা তো সবসময়ই থাকবে। কারণ মানুষ কখনো আশা করা বন্ধ করতে পারে না। এক অন্ধকার থেকে আরেক আলোতে যেতে চায়। আর যাত্রার মাঝখানে ভুলে যায়—আলো আর অন্ধকার তো একে অপরের ছায়া মাত্র। আমরা মুক্তির পথ খুঁজি ঠিকই, অথচ ভুলে যাই, মুক্তি মানেই শূন্যতা। তুমি কি সত্যিই শূন্য হতে চাও?”

ইনায়া এবার কিছু বলে না। নিজের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর না পেলেও,বহু প্রশ্ন এখন মিলিয়ে গিয়েছে। তার কি জিজ্ঞেস করা ছিল,সেসবও হয়তো ভুলে গিয়েছি।ইনায়া শুধু আড়ালে খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তবে কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে, ধীরে ধীরে নিমজ্জিত স্বরে বলতে লাগে,

“তাহলে আমাদের গল্পের শেষ পাতায় কী লেখা থাকবে?”

রোজ এবার গভীরভাবে তাকায় ওর চোখের দিকে, যেন হাজার বছরের ক্লান্তি নিয়ে হেঁটে চলছে।সেই সাথে ওর নির্বিকার প্রশ্ন শুনে খানিকটা মুচকি হাসে।এই মেয়েটার প্রতি তার অদ্ভুত একটা টান রয়েছে। কেমন যেন বাচ্চা স্বভাবের। মূলত তার কথাবার্তা কিংবা প্রশ্নগুলো। অথচ তার উপরোক্ত আবরণটা যেন এক শক্ত খোলসে ন্যায় গড়া।

—“আমাদের গল্পের শেষ পাতাটা আমরা নিজেরাই লিখব, ইনায়া। হয়তো সেখানে লেখা থাকবে—’সবই ছিলো কেবল মরীচিকা।’ অথবা লেখা থাকবে—’শেষ বলে কিছু নেই, শুধু এক অধ্যায় থেকে আরেক অধ্যায়ে নতুন যাত্রা শুরু হলো মাত্র।’ তবে একদিন ঠিকই আমরা পেছন ফিরে দেখব এবং ভাবব—আমরা আসলে কখনোই বেঁচে ছিলাম না। কেবল অস্তিত্বের ছায়ায় হাঁটছিলাম।”

ইনায়া কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হেসে ফেলে। রোজ অদ্ভুত ভাবে সব কথাই অনেক বেশি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলে। তবে যদি তার অর্থ বুঝে নেওয়া যায়,তাহলে তার সব কথাই সহজ। কিন্তু কেউ তার কথার গভীরতা বুঝতে পারলেও,স্বয়ং রোজকে বুঝে উপলব্ধি করাটা ভারী মুশকিল। কেন যেন, ইনায়ার কাছে সবচেয়ে রহস্যময় ব্যক্তিটা…এই রোজকেই মনে হয়।এতো বছর ধরে তার সাথে থেকেও,সে যেন আজও রোজকে একাংশও উপলব্ধি করতে পারেনি। ইনায়া সবমিলিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। খানিকটা মিনমিন করে আওড়ায়,

“এর মানে আমাদের এই বিষাক্ত জীবন গল্পের কোনো শেষ নেই। আচ্ছা এই শেষ বলতে আদোও কিছু রয়েছে নাকি এটাও মিথ্যে? এটিও তবে মানুষের বানানো এক মিথ্যে আশ্বাসের নাম মাত্র, তাই না?

রোজ আবারও হালকা হেসে উত্তর দেয়,

“হুম! শেষ বলে কিছু নেই, ইনায়া। গল্পগুলো কেবল বদলে যায়। এক বিষের জায়গায় আরেক বিষ এসে বসে। এক দীর্ঘশ্বাসের জায়গায় আরেক দীর্ঘশ্বাস। আর আমরা ভাবি, মুক্তি পাব। কিন্তু আসলে জীবন আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। যেখানে পুরোনো কষ্টগুলো শুধু ছোট মনে হয়। অথচ মুক্তির সন্ধান মেলে না।”

—“তবে আর মুক্তির আশা করেই বা কি লাভ। এই বিষাক্ত জীবন থেকে মুক্তি তো আর পাওয়া হবে না।”

—“হাহ্,মুক্তি? হয়তো পাবে, যদি বিষ”কে গ্রহণ করতে শেখ। যদি মেনে নেও যে বেদনা, হতাশা, দুঃখ—এসবই আমাদের জীবনের অংশ। তবেই হয়তো কোনো একদিন বিষ আর যন্ত্রণা দেবে না, কেবল একটা পুরনো স্বাদের মতো মনে হবে।”

এই কথাগুলো শুনে ইনায়া নিঃশব্দে হাসে। সেই হাসির মাঝে কি বিদ্রুপ, না বেদনা লুকিয়ে আছে,তা বোঝা যায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে নিঃশ্বাস ফেলে, মনে মনে আওড়ায়,

“এই গল্পের শেষটা এবার, হওয়া উচিত।”

—“ফুপিইইইই,ইনু মামুনিইইই!”

বাড়ি থেকে দৌড়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে অরিন। সে কি তার দৌড়ের বেগ। যেন হাওয়ার সাথে মিশে বাতাসের তালে ছুটে আসছে। হাত দুটো দুদিকে ছড়ানো। কোমড় অব্দি লম্বা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে; একইসাথে জামাটাও।

অরিনকে দেখমাত্রই রোজ তার হাত থেকে ফুলের ঝুরিটা নিচে রেখে দেয়। অতঃপর সবকিছু ভুলে, সে দু’হাতে ছড়িয়ে অরিনের দিকে এগিয়ে যায়।

—“আমার আম্মা!”

অরিন তার গায়ে ঝাপটে পড়তেই, সে তাকে দুহাতে আঁকড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গোল গোল দু-তিন পাক ঘুরে যায়। অতঃপর দুজনেই খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। রোজ থেমে গেলেও, অরিনকে কোল থেকে নামায় না৷ বরং তার দুগালে আলতোভাবে চুমু একে দিয়ে বলে,

“আম্মা! শুভ সকাল! সরি, আজ তোমাকে ছাড়াই বাগানে গিয়েছিলাম।”

—“ইট’স ওক্কে,ফুপ্পি। শুভ সকাল! যদিও মাম্মামের কাছে এটা নাকি দুপুর।…হোয়াট এভার, আমাকে না হয়, অন্য কোনো একদিন নিয়ে যেও।”

এই বলেই অরিন রোজের গালে শক্ত করে চুমু খেয়ে, পাশে ফিরে তাকায়। ইনায়া নিশ্চুপ চাহনিতে, তার দিকে তাকিয়ে। ইনায়া বাচ্চাদের থেকে সবমসময় নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে এসেছে। বাচ্চারা তার আশেপাশে থাকলে,তার ভেতরের অস্থিরতা যেন আরো বেড়ে যায়। নিজেকে সামলাতেও হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু একই বাড়িতে অরিন থাকায় না চাইতেও কিছু করতে পারেনা। তবুও সে অরিনের সাথে মিশতে পারেনা। অবশ্য এই ব্যাপারটা অরিনও খানিক বুঝতে পারে। সবার বলা কথা অনুযায়ী সেও জানে, তার ইনু মানুনি সুস্থ নয়। যখন সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে তখন আর সে তাকে এড়িয়ে চলবে না।তার ফুপির মতোই নাকি তার সাথে আদর কিংবা খেলা করবে।

অরিন বিস্তৃত হাসে। তার দুগালে স্পষ্ট দুটো টোল ভেসে ওঠে। ইনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“ইনু মামুনি! গুড মর্নিং!”

—“গুড মর্নিং।”

ইনায়া শুধু এইটুকুই বলে। আর বেশিক্ষণ এখানে স্থির থাকতে পারবে না সে। এখনই কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছে।

—“আ…আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

এই বলেই ইনায়া বাড়ির ভেতরের দিকে চলে যায়। এদিকে পেছন থেকে তাকে অপলক দেখতে থাকে রোজ আর অরিন। ইনায়া আরো খানিকটা ভেতরের দিকে চলে যেতেই, অরিন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“হাহ! এই ইনু আন্টিটা কবে পুরোপুরি সুস্থ হবে? আমার আর ভালো লাগে না।”

অরিনের কথা শুনে, রোজ কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বলে,

“খুব শীঘ্রই, তোমার ইনু আন্টি সুস্থ হয়ে যাবে। তুমি দেখে নিও।”

—“হুম তাই যেন হয়। নয়তো পাভলু আঙ্কেলের সাথে ইনু আন্টির বিয়ে দিতে হবে।”

রোজ বিস্ময়ের সাথে হেসে ফেলে। কিছুটা অবাক স্বরে বলে, “কিহ?”

অরিন খানিক অভিজ্ঞের ভঙ্গিতে চোখের চশমটা ঠেলে দিয়ে বলে ওঠে,

“হুম, পাপাকে বলে এটাই করতে হবে। দুষ্টু পাভলু আঙ্কেল বিয়ের পর যখন, ইনায়া মামুনির সাথে সারাদিন উল্টোপাল্টা মজা করবে, পাগলামি করবে।এরপর তাদের যখন অনেকগুলো বেবি হবে। তখন দেখবে ইনু আন্টিও পাভলু আঙ্কেলের মতো হয়ে গিয়েছে।”

রোজ অরিনের কথাবার্তা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল। ওর হাসি দেখে রোজ কপাল কুঁচকে বলল,

“হাসছো কেনো? আমি মোটেও হাসির কথা বলিনি।”

—“আচ্ছা, আমার অরিন আম্মা! আপনি কি বোঝেন, বিয়ে কি?”

—“বুঝব না কেনো? বিয়ে হলো একটা ছেলে আর মেয়েকে বিয়ে দেওয়া। আর বিয়ে হলেই নাকি সবাই চেঞ্জ হয়ে যায়। আর তাদের অনেকগুলো করে বেবি হয়৷ এরপর বেবিগুলো বড় হয়ে, তারাও বিয়ে করে। আবার তাদেরও বেবি হয়। আর এই বেবি হওয়ায় ফ্যাক্টরি বানানোর রিচুয়াল ফর্মুলার নামই হলো বিয়ে।”

অরিনের একদমে বলা কথাবার্তাগুলো শুনে, রোজ তার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ে,এসব কোথায় থেকে শিখেছে?

—“কিহ্! বেবিদের ফ্যাক্টরি বানানোর রিচুয়াল ফর্মুলার নাম বিয়ে? এসব কে বলেছে তোমাকে?”

—“কে আবার! মাই সুপার-জিনিয়াস পাপা!”

—“কিহ্,এসব তোমার পাপা বলেছে?”

—“হুম, হুম,আমিই জানতে চেয়েছিলাম। তখন পাপাই তো আমাকে এসব বলল।”

—“তোমার পাপা যে তোমাকে এসব শিখিয়েছে, এসব কি তোমার মাম্মাম জানে?”

—“নাহ তো!”

—“শোনো,তোমার মাম্মামকে এসব বলার প্রয়োজন নেই। নয়তো সে তোমার পাপাকে সাবান ছাড়াই ধুয়ে দেবে।”

—“মানে? পাপা কি আমায় ভুল কিছু শিখিয়েছে?”

—“আ…বিষয়টা তা নয়। আচ্ছা, আম্মা। তুমি কেনো এখনই এসব জানার জন্য আগ্রহী হচ্ছো? তুমি আগে বড় হও, তারপর না হয়…”

—“না, না,আমার এখনই জানতে হবে।আমিও তো বিয়ে করব৷”

—“কিহ,এতোক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু এখন সোজা বিয়ের ভুত?”

অরিন কিছুটা দুষ্টমি করে, লাজুক হেসে বলে,

“ভুত কেনো হবে ফুপ্পি! আমি তো তোমার ছেলেকেই বিয়ে করব।”

রোজ খানিকটা থমকে যায়। স্তব্ধ স্বরে বলে ওঠে,

“আমার ছেলে?”

—“হুম, তোমার যখন একটা ছেলে হবে, তখন ওটা আমাকে দিয়ে দিবে। আমি তোমার ঐ ছেলে বিয়ে করে নিজের বর বানাবো। এরপর আমাদের অনেকগুলো বেবি হবে। তারপর ওদের বিয়ে দেব,তখন ওদেরও বেবি হবে। আর এভাবেই আমরা একটা বেবির ফ্যাক্টরি বানিয়ে ফেলব।”

—“তবে তো আমার ছেলে, তোমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হয়ে যাবে।”

—“তাতে কি হয়েছে?পাপা বলেছে, ভালুবাসা, বিয়েতে বয়স, ক্লাস এসব ম্যাটার করে না।”

—“হয়েছে, হয়েছে, থামো এবার। এসব আনায়া জানতে পারলে, তোমার পাপার সাথে বিতিকিচ্ছিরি কাহিনি হয়ে যাবে।”

কে শোনে কার কথা। অরিন তার নিজের খেয়ালে হারিয়ে গিয়েছে। সে নিজের মনের মতো আরো বলে,

“শুনো ফুপি, তোমার ছেলেটাকে বলবে অনেক সুন্দর হতে।একদম পাপার মতো। পাপার চেয়ে একটু কম হলেও চলবে, কিন্তু বেশি হওয়া যাবেনা। আমার পাপাকেই সবার চেয়ে বেস্ট হতে হবে।”

রোজ আর কিছুই বলে না। হতাশায় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“হে খোদা! এই মেয়ে আর তার বাপকে বুঝ দান করো।”

____________

কেনীথকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখেই, আশেপাশের সব সার্ভেন্ট যেন আসল ঘটনার সবটাই বুঝে যায়। রান্নাঘরে যে আটা ময়দার তৃতীয় বিশ্বযু”দ্ধটা ঘটে গিয়েছে, তা আর কারো বুঝতে বাকি নেই। তবে কেউ কোনো কথা না বলে,যে যার মতো কাজে লেগে পড়ল। এদিকে কেনীথ এলোমেলো চুল,আর আদা ময়দায় মাখানো শরীর ঝাড়তে ঝাড়তে দোতলার দিকে এগোতে লাগল। চোখে মুখে তার প্রচন্ড বিরক্তির ছাপ। কিন্তু যেই না সিঁড়ি বেড়ে উঠতে যাবে, ওমনি পাশ থেকে ডাক এলো,

“হেই ব্রো! থামো! থামো! থামো!”

কেনীথ কপাল কুঁচকে পাশে ফিরে তাকায়। কিছু ফাইল নিয়ে পাভেলকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে, তার কপালটা আরো খানিক কুঁচকে যায়। বি”রক্তিতে দোতলায় না গিয়ে, সিঁড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে পড়ে। পাভেল তার কাছে এলেই কঢ়া স্বরে বলে,

“এভাবে ছাগলের মতো চেচাচ্ছিস কেনো?”

নিমিষেই পাভেলের মুড অফ হয়ে যায়। চোখমুখ ছোট করে আওড়ায়,

“আমাকে তোমার কবে মানুষ বলে মনে হয়েছে? সারাজীবন তো ছাগল,গরু,গাধা হিসেবেই চোখে পড়েছে।”

কেনীথ গম্ভীরতার মাঝেও কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

“তা ঠিকই বলেছিস।”

এটা শোনামাত্রই পাভেলের চোখমুখ একদম চুপসে যায়।তবে কেনীথ সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলে,

“কিসের জন্য চেঁচাচ্ছিস, এখন তা বল।”

পাভেল নিজেকে সামলে, একটা ভারী শ্বাস ফেলে বলে,

“এই ফাইলগুলোতে দ্রুত সাইন করে দেও। অনেক কাজ আছে সারাদিন। ঐ জেনোভেসের সাথে আমাদের ডিলটা নিয়ে কিছুটা প্রবলেম হয়েছে। ওরা শেষ মূহুর্তে এসে কাহিনি শুরু করে দিয়েছে।”

কেনীথের কপাল অনেকটা কুঁচকে যায়। চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ পড়ে।

—“মানে? সেদিনই তো ওদের সাথে কথা হলো। তখন তো কোনো….”

—“আরেহ,সেটাই তো ঘটনা। ব্রো, বলছি আমি আর এসব কত করব। এবার তুমি একটু সিরিয়াস হও। ওদের ছেড়ে দিতে দিতে, এখন আমাদের সাথেই গেইম খেলার ট্রাই করছেন।”

কেনীথ খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলে বলে,

“ঠিক আছে। আর ক’টা দিন সামলে নে। এমনিতেও আমার আলাদা কিছু প্লানিং রয়েছে।”

—“মানে?কিছু কি ভেবেছো…”

—“হুম, আচ্ছা তোকে এসব পড়ে বলছি। আগে গোসলটা সেড়ে আসি।”

এবার গিয়ে পাভেলের নজর কেনীথের দিকে পড়ে।ওকে এই অবস্থায় দেখে কপাল কুঁচকে বলে,

“আজ, আবারও?”

—“কি আর করব। শাঁকচুন্নি পালি একটা।যাই হোক, আমি শাওয়ারটা নিয়ে…”

—“ব্রো! আমায় যেতে হবে আবার।”

কেনীথ পাভেলের দিকে তাকিয়ে বোঝে, বেচারা আসলেই তাড়ায় রয়েছে। কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“দে কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে!”

এি বলেই সে পেপারস্ গুলো পাভেলের কাছ থেকে নিয়ে নিজেই সাইন করা শুরু করে দেয়।এদিকে পাভেল তড়িঘড়ি করে বলে,

“ব্রো! একটু দেখেশুনে। একবার দেখে নিলে ভালো হতো। এমনিতেও কয়েকদিনের তাড়াহুড়োয় কি রেখে কি করেছি, নিজেও জানিনা।”

কেনীথ ওর কথায় কিছুটা মুচকি হাসে। অনবরত পেপার গুলোতে সাইন করতে করতে, পাভেলের উদ্দেশ্যে বলে,

“যত যাই বলি, দিনশেষে তুই ছিলি বলেই আমি এতো নিশ্চিন্তে থাকতে পারছি।নয়তো…”

এই বলতে না বলতেই, আচমকা কেনীথের নজরে কিছুটা পড়ে যায়।সে একটা পেপার ঠিকমতো দেখতে নেবে, এমন অবস্থায় পাভেল আবারও বলে,

“ওতো কিছু জানিনা আমি। বিয়ের ব্যবস্তা করো আমার। আর কত সিঙ্গেল থাকব।”

পাভেলের কথা শুনে, কেনীথ সবকিছু রেখে তার দিকে বিস্ময়ের চাহনিতে তাকায়। চোখ বড় বড় করে অবাক স্বরে বলে,

“বিয়ে করবি?”

পাভেল কিছুটা লাজুক হেসে, কোঁকড়া চুলগুলো পেছন হতে চুলকানো অবস্থায় বলতে থাকে,

“হ্যাঁ, আর কত সিঙ্গেল থাকব? আমারও তো মন চায়,তোমার মতো একটা বম্ব,কা”মান টাইপের বউ এনে মা”রামারি করতে।”

কেনীথ কিছুই বলে না। বরং পাভেলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পরও, কেনীথ কিছু বলছে না দেখে পাভেল তার দিকে ইনোসেন্ট মুখে তাকাতেই…কেনীথ বিস্তৃত হেসে বলে ওঠে,

“তোর মতো হাঁদারামকে কে বিয়ে করবে?”

—“ব্রো!”

পাভেল অবলার মতো চেহেরা বানাতেই, কেনীথ আবারও হেসে বলে,

“গাঁধা,আগে তুই নিজে বড় হো। আমিই এখনো একটাকে ঠিকঠাক সামলাতে পারিনা। উনি এসেছেন, বিয়ে করে বউ পালার স্বপ্ন দেখতে।”

—“কিন্তু ব্রো! মন তো আমারও চায়…”

—“তোর ঐ মনকে, উ’ষ্টা দিয়ে ব্ল্যাকহোলে পাঠা। নয়তো এ জালে একবার ফেঁসে গেলে, আর বের হতে পারবিনা।”

—“হাহ্!ইনিয়েবিনিয়ে অপমান করছো তো! দেখো, আমি তোমার চেয়েও ইয়া বড় এক শাঁকচুন্নিকে বিয়ে করে… তোমায় দেখিয়ে দেব, কিভাবে এই পাভেলও বউ পালতে পারে।”

____________

আনায়া খাবার নিয়ে রুমে এসে দেখে,বিছানায় কেনীথ-অরিন পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে শুয়ে রুবিক্স কিউব মেলানোয় ব্যস্ত। দুজনের চোখে-মুখে যেন রাজ্যের গম্ভীরতা এসে ভীর করেছে। তারা নিজেদের ধ্যানে এতোই মত্ত যে, এই মূহুর্তে দিনদুনিয়া উল্টে গেলেও হয়তো তা টের পাবে না। আনায়া শুধু খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে যায়।

আনায়া খেয়াল করে দেখে, কেনীথ এসেই হয়তো গোসল সেরে নিয়েছে। চুলগুলো হালকা ভেজা দেখাচ্ছে। জামাকাপড় দেখে তো আর বোঝার উপায় নেই। পড়ে তো সেই এক কালো রংএর প্যান্ট আর টিশার্ট।

অবশ্য কাজের ব্যস্ততায় আনায়ার আর গোসল করার সুযোগ হয়নি। আটা ময়দা গুলো কোনো মতো ঝেড়ে ফেলে খাবার নিয়ে চলে এসেছে। নয়তো আবার দুজনের চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে যাবে। এদের খাবার দেওয়ার পর হয়তো একটু সুযোগ হবে। তখন না হয় গোসলটা সেরে নিবে। অবশ্য আজ কাজও অনেক।

আনায়া অরিন আর কেনীথের জন্য আলাদা আলাদাভাবে খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে এনেছে। দুজনের কাছে এগিয়ে গিয়েই অরিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“কেনায়া! খাবার কি খাইয়ে দেব, নাকি তুমি হাত দিয়ে খাবে, মাম্মাম?”

অরিন নিজের কাজের ব্যস্ততার মাঝেই বলল,

“তুমি খাইয়ে দেও, মাম্মাম। আ’ম ইজি কাজে ভেরী বিজি।”

মেয়ের কথা শুনে আনায়া কপাল কুঁচকে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে।অন্যদিকে কেনীথ খানিকটা আনমনে মুচকি হাসে। আনায়া গিয়ে কেনীথের খাবারটা বিছানার পাশে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে , অরিনের জন্য বাটিতে আনা খাবার… চামচে তুলে নিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলে,

“এদিকে আসো মাম্মাম, আমি কিন্তু বেশি দেরি করব না।”

আনায়ার কথা শুনে অরিন বাধ্য মেয়ের মতো আধশোয়া থেকে উঠে এসে, কেনীথের পাশে বিছানায় বসে পড়ল। তবে সেই সঙ্গে তার রুবিক্স কিউব নিয়েও পুনোরায় খেলতে শুরু করে। এই রুবিক্স কিউব মেলানোর অভ্যাসটা কেনীথই তৈরি করেছে। যা অরিনের এখন নিত্যদিনের নেশায় পরিণত হয়েছে। যখনই একটু সবসময় সুযোগ হয় তখনই সে এটা নিয়ে খেলতে বসে যায়।

এদিকে আনায়া অরিনকে খাওয়াতে নিলে পাশ থেকে কেনীথও উঠে বসে।এবং আনায়ার হাত থেকে খাবারের বাটিটা নিয়ে বলে,

“তুই রাখ, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

আনায়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর বলল,

“আচ্ছা, ঠিক আছে। থাংক ইউ সো মাচ। অনেক কাজ পড়ে আছে, আমি যাই তবে।”

—“ঐ কই যাস তুই!”

আনায়া খুশি মনে যেতে নিয়েছিলো তো ঠিকই। কিন্তু কেনীথের কথা শুনে খানিকটা তব্দা খেয়ে বলে,

“কেনো, আর কি কোনো প্রয়োজন আছে?যেহেতু তুমি অরিনকে খাইয়ে দিচ্ছো, তবে আর আমি এখানে থেকে কি করব?”

—“অরিনকে না হয় আমি খাইয়ে দেব। আমাকে কে খাইয়ে দেবে?”

আনায়া এইবার কেনীথের কথার অর্থ বুঝতে পেরে কপাল কুঁচকে, কিছুটা কঢ়া স্বরে বলে উঠল,

“মানে কি? আমার হাল দেখেছো? এই অবস্থায় এখন তোমাকে খাইয়ে দেব আমি?”

—“কই,ভালোই তো দেখাচ্ছে।আমার কোনো সমস্যা নেই। তুই নিরদ্বিধায় খাইয়ে দে।”

—“দেখো, পাগলামি করো না। আমার অনেক কাজ আছে। এখন দয়া করে পাগলামি না করে যেতে দেও।”

—“রাখ তোর কাজ। আমার কোন ঠেকা পড়েছিল,তোর মেয়েকে খাইয়ে দেওয়ার।”

কেনীথের কথায় আনায়া স্তব্ধ।নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে, তার দিকে পুরোদমে তেড়ে এসে আনায়া বলল,

“আমার মেয়ে মানে? আমি কি ওকে গাঙ্গের পানি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি।”

আনায়ার কথায় কেনীথ নির্বিকারে বলে,

“তা হবে কেনো!ওতে আমার অবদান আছে।”

আনায়ারও আর বুঝতে বাকি রইলো না কেনীথ এসব উল্টোপাল্টা কথা বলে কি করতে চাইতে। এই লোক দিনে দিনে যেন আনায়ার কাছে পুরো অসহ্যকর হয়ে উঠছে। সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই, অতচ ইনি চলে আসে যখন তখন তাকে ক্ষেপানোর পায়তারা করতে। আনায়া জোরে নিশ্বাস ফেলে চাপা স্বরে বলতে লাগল,

“যথেষ্ট হয়েছে, এবার রহম করো আমার উপর। তোমার অসময়ে মেজাজ বিগড়ানো কথাবার্তা আমার আর সহ্য হয় না। আরেকবার এসব শুরু করলে আমি কিন্তু সোজা বাড়ি-সংসার ফেলে রেখে ,সবকিছু ছেড়ে চলে যাব।”

কেনীথ এবারও গা দুলিয়ে দুলিয়ে নির্বিকারে বলে উঠল,

“যেখানে ইচ্ছে,চলে যা।তবে যাওয়ার আগে আমায় খাইয়ে দিয়ে যা। খুব ক্ষিদে পেয়েছে আমার।”

আনায়া কেনীথের কথায় চোখমুখ ছোট করে ফেলে। এদিকে কেনীথ চামচ দিয়ে অরিনকে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিচ্ছে। আনায়াও চামচ দিয়ে কেনীথকে খাইয়ে দিতে নিলে কেনীথ জোর গলায় বলে উঠল,

“চামচ রাখ, যা গিয়ে হাত ধুয়ে আয়। নয়তো খাবো না আমি।”

আনায়া বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,

“না খেলে নাই, আমি চললাম।”

—“গিয়ে দেখ শুধু, ঠ্যাং ভেঙ্গে ছাড়ব তোর।”

এরই মাঝে অরিন বলে উঠলো ,”পাপা, এই ঠ্যাং মানে কি?”

অরিনের কথায় খানিকটা ইতস্তত হয়ে কেনীথ বলে,

“ও কিছু না, তুমি খেতে থাকো লেডিবাগ। বড় হলে ঠিক বুঝে যাবে।”

—“ও আচ্ছা, তোমাদের মতো বড় হতে হবে?”

—“হুম।”

এদিকে আনায়া রাগে চোখ ছোট ছোট করে কেনীথের দিকে তাকাতেই, কেনীথ পুনোরায় নির্বিকারে বলতে লাগল,

“যা বলছি, তাই কর। নয়তো… উহুম উহুম…রাতে সব সুদে আসলে ফেরত দেব। তখন আর কেঁদেও কূল পাবি না।”

কেনীথের চোখের ইশারা আর কথার ধরনে ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছে, তা আর বুঝতে বাকি নেই আনায়ার। এই ব্যাপারটায় সে খানিকটা বিরক্তি আর রাগ মিশ্রিত চাপা স্বরে বলে,

“কখন কোথায় কি বলছো,একটু তো হুঁশ রাখো।”

কেনীথ আনায়ার কথা শুনে একবার অরিনের দিকে তাকায়।

—“টেনশন নেই, বুঝবে না।”

—“বুঝবে না ছাই।ও তোমার মেয়ে,ইঁচড়েপাকা।আজ না বুঝুক,তোমার স্বভাব ঠিক না হলে দু’দিন বাদে ঠিকই বুঝবে।”

—“মেয়ে আমার হলেও, ইঁচড়েপাকা হয়েছে তোর জন্য। নয়তো আমি তো ভাই, আলাভোলা এক নিষ্পাপ।”

—“হাহ্ হাস্যকর…কচু তুমি।”

—“হুঁশ, এতো সমস্যা হলে চল চাইনিজ শিখি। তাহলে আর কথা বলতে গিয়ে এতোকিছু ভাবতে হবে না।”

—“পারবো না আমি ওসব চিং চ্যাং,বগের ঠ্যাং শিখতে।”

এরই মাঝে অরিন খাবার খেতে খেতে এবং রুবিক্স কিউব মেলানোর তালের মাঝেই,উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল,

“পাপা জানো! ফুপি বলেছে আমায় চাইনিজ লেঙ্গুয়েজ মান্দারিন শেখাবে।”

কেনীথ এবার চোখ ছোট ছোট করে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“এই রোজের জ্বালায় আর বাঁচা যাচ্ছে না। এক জীবনে ওর কত ভাষা শেখা লাগবে? আগে নিজে শিখতো এখন আমার মেয়েকে বানিয়েছে শিষ্য।”

কেনীথ বিড়বিড় করে বললেও,আনায়া তা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। তাই খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে ওঠে,

“তাই তো বলি নিজে ভালো হও। নয়তো আমার মতে রোজ তো ভুল কিছু করছে না!”

—“তুই চুপ কর। সকালের খাবার চাইতে চাইতে দুপুর বানিয়ে ছেড়েছে, তবুও পেটে খাবার পড়েনি। ঘরে জলজ্যান্ত বউ রেখেও যদি এই হাল হয়, তবে এই জীবন রেখেই আর কি লাভ।”

—“তবে ম’রে যাও।”

—“চিন্তা নেই, তোকে সাথে নিয়েই ম”রব।”

আনায়া আর নিজের মেজাজ খারাপ না করিয়ে সোজা গিয়ে হাত ধুয়ে এলো। অতঃপর কেনীথকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল,

“আর কত জ্বালাবেন আমাকে?”

কেনীথ খেতে খেতেই উত্তর দেয়,

“যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন। নাহ্, ভুল হয়েছে। আমি মরে গেলেও তোর পিছু ছাড়ব না। তখন ভুত হয়ে জ্বা’লাতে আসব।”

আনায়া আর কিছু বললো না। বরং শুরুতে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেও,অরিন আর কেনীথের দিকে আনমনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বিস্তৃত মুচকি হাসে। এদিকে খাবার খাওয়ানো শেষ হতেই শআনায়া সরে আসতে নিলে, কেনীথ ওর হাত টেনে ধরে। আনায়া শুরুতে কিছুটা চমকে উঠলেও, পরবর্তীতে বুঝে যায় যে কেনীথ এখন কি করবে।

আনায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে,তার হাতের পাঁচ আঙুলে লেগে থাকা খাবারগুলোও চেটেপুটে খেয়ে ফেলে। অতঃপর খানিকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে ঢেঁকুর তুলে বিস্তৃত হেসে বলে,

“যাই হোক, সকালের খাবার দুপুরে পেলেও—বউয়ের হাতে খাওয়ার মজাই আলাদা।”

___________

“ওহে কি করিলে বলো পাইবো তোমারে,
রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে……..
ওহে এতো প্রেম আমি কোথা পাবো না
ওহে এতো প্রেম আমি কোথা পাবো না,
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে….
আমার সাধ্য কি বা তোমারে…
দয়া না করিলে কে পারে….
তুমি আপনি না এলে,কে পারে হৃদয়ে রাখিতে…
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই…
চিরদিন কেনো পাই না….
মাঝে মাঝে তব….

আনায়া খাবার খাইয়ে রুম থেকে বের হয়ে বেলকনিতে এলে, হঠাৎ পরিচত কন্ঠস্বরে গাওয়া গানের সুরে… আকস্মিক থমকে যায়। পাশে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখে, কিছুটা সমানেই বারান্দার গ্রিল ধরে উদাসীন হয়ে, নিদারুণ কন্ঠে গুনগুন করে গান গাইছে রেহান। সময়ের ব্যস্ততায় রেহানের সাথে এখনো কথা হয়ে ওঠেনি আনায়ার। এদিকে হঠাৎ আনায়াকে চোখে পড়তেই রেহানের গান গাওয়াও থেমে গিয়েছে। আনায়া তার সামনা-সামনি হলে রেহান খানিকটা মুচকি হেসে বলে,

“ভালো আছো?”

রেহানের প্রশ্নের জবাবে আনায়াও মুচকি হেসে জবাব দেয়,

“এই তো ভালোই…তুমি কেমন আছো?”

—“যেমনটা থাকা যায় আরকি।”

আনায়া রেহানের বিধ্বস্ত চেহেরার দিকে তাকিয়ে আড়ালে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সেই একই চোখজোড়া; যা সবসময় থাকতো প্রানবন্ত চমৎকার, আজ তা নিদারুণ বিধ্বস্ততায় জরাজীর্ণ। চোখের নিচে পড়ে গিয়েছে খানিকটা কালচে দাগ। যে মানুষটার ঠোঁটের কোণায় সর্বক্ষণে হাস্যজ্জ্বল হাসি ঝুলে থাকতো, আজ সেই ঠোঁটে এক রুক্ষতায় মোড়ানো মিথ্যে হাসি। চুলগুলোও কত এলোমেলো, তেল পানি আদোও চুলে পড়ে কিনা সন্দেহ। মনে তো হয় না, নিজের একটু হলেও যত্ন নেয় সে। অথচ নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর কত-শত প্রচেষ্টা তার। সবসময় সাজানো গোছানো ব্যক্তিটাও আজ কত অগোছালো।

সবকিছুর জন্য আনায়া যেন আজও নিজেকেই দায়ী করে। এই মানুষটার তো আজ এই হাল হওয়ার কথা ছিলো না, যদি না সে তার জীবনে প্রবেশ করতো। যতবার সে রেহানকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখেছে ততবার আনায়া নিজেকে এক বিষা”ক্ত অভিশাপ মনে করেছে। আজও নিজেকে ঠিক তাই মনে হচ্ছে।

এতোক্ষণের নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতাকে ভেঙ্গে আনায়া নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল। খেয়াল করে দেখল তার শ্বাস-প্রশ্বাস অনবরত থেমে যাচ্ছে। বুক ভারী হয়ে আসছে।গলায় অজানা কষ্ট গুলো কাঁটার মতো বিঁধছে। আকস্মিক চোখের কোণায় জমে থাকা জলগুলো যেন বৃষ্টি হয়ে ঝড়তে চাইছে। তবে আনায়া নিজের এই অনুভুতির খুব বিশেষ একটা পাত্তা না দিয়ে বিস্তৃত মুচকি হাসে। এদিকে আনায়ার অনুভূতির প্রতিটা সুক্ষ্ম প্রতিক্রিয়াই যেন রেহানের বোধগম্য। সে নিজেও যে একই অনুভূতিতে জর্জরিত। যে নারীতে শুধুমাত্র তার অধিকার থাকার কথা ছিলো, সেই নারীটিই কিনা আজ অন্য কারো। আনায়ার হাসিতে রেহান নিজেও একই ভাবে মুচকি হাসল। আর সেই হাসিটাই যেন আনায়ার অন্তঃস্থলে তীরের মতো বিঁধল।

এই

নাহ্,আর সম্ভব হচ্ছে না। এতো বছরের বিচ্ছেদের পরও তাদের বেহায়া অনুভূতি গুলো যেন একই রয়ে গিয়েছে। দুজনেরই এখন বুক ভারী হয়ে আসছে। দুজনেই চাইছে পরিবেশটা যেন স্বাভাবিক হোক। তবে অনুভূতিকে ধরে বেঁধে কবর দেওয়া শক্তপোক্ত আনায়াও এখন আর চাইলেও স্বাভাবিক হয়ে কথা বলতে পারছে না। তার গলা হতে আওয়াজ বের হচ্ছে না। রেহান বিষয়টা ঠিকই বুঝতে পারল, সে নিজেই বা আর কতটা স্বাভাবিক থাকতে পারছে। সবকিছু ছাড়িয়ে রেহান এই রুদ্ধশ্বাস আবহটাকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠল,

“তুমি কি ব্যস্ত?”

আনায়া এখনও সহজতর হয়ে কিছু বলতে পারল না। তবুও কষ্ট করে হলেও মাথা নাড়িয়ে বলল,

“নাহ!”

—“তবে কি একটু সময় হবে? দুটো কথা বলার ছিলো। আর কখনো দেখা হবে না কিনা কে জানে।”

রেহানের অভিব্যক্তি আনায়ার কাছে ঠিক বোধগম্য হলো না। আর কখনো দেখা হবে না ,এর মানে কি? রেহান মাঝেমধ্যেই এখানে এলে তো তার সাথে টুকটাক দেখা সাক্ষাৎ হয়েই যায়।

—“তোমার কথা ঠিক বুঝলাম না। আর কখনো দেখা হবে না মানে?”

আনায়ার বিচলিত স্বরে রেহান কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে।

—“ভাগ্য কোথায় কাকে,কোন পরিণতিতে নিয়ে ঠেকায়, তা তো কেউ জানে না। আজ আছি, কাল তো না-ও থাকতে পারি।”

—“যা বলতে চাইছো, পরিষ্কার করে বলো।”

—“আহ্,বউ পা…সরি, আনায়া…তুমি কেনো এতো বিচলিত হচ্ছো।আমি বলতে চাইছি, এরপর আর কখনো রাশিয়া কিংবা এখানে আসা হবে না। আমি কাজের জন্য একেবারে জার্মানিতে চলে যাচ্ছি। তাই বলছিলাম হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।”

আনায়া রেহানের বউ পাখি বলতে চাওয়াটাকে নিয়ে আর বেশি ভাবতে চায় না। বরং কিছুটা অবাক স্বরে বলে ওঠে,

“কিন্তু একেবারে কেনো?”

—“একেবারে নয় কেনো? দেশে আর আমার কেউই নেই। ওখানে গেলে শুধু আকাশস্পর্শী হাহাকার অনুভূত হয়, এছাড়া আর কিছুই নয়।”

—“দেশে কেউ নেই কিন্তু এখানে তো আছে। রোজ তোমার… ”

আনায়ার কথা সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই রেহান মুচকি হেসে বলতে লাগল,

“রোজ আর আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন, তার আন্দাজ তো তোমারও থাকার কথা। সে নিজেও এক ভাঙা হৃদয়ে মানুষ। শুধু বিয়ে হলেই তো আর সবাই স্বামী স্ত্রী হয় না। স্বামী স্ত্রী হওয়ার প্রথম শর্ত থাকে একটা ভালো বন্ধুত্ব,একে-অপরের প্রতি হৃদয়স্পর্শী অনুভূতি।
আমরা যখন একসাথে হই তখন না আমাদের মাঝে বিশেষ কোনো অনুভূতি থাকে, না আমরা এতো বছরেও আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক হতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, আমাদের মাঝের সম্পর্কটাকে একটা সম্মানজনক বন্ধুত্ব বলা যায়।
যে বন্ধুত্বে একে অপরের প্রতি অগাধ সম্মান রয়েছে, তবে এরচেয়ে বেশি কিছু নয়।

আর রোজ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। একইসঙ্গে এতো দীর্ঘ সময়ে যতটুকু বুঝেছি,তার হৃদয়ের গহীনে বদ্ধ খাঁচায় আবদ্ধ রাখা অবাধ্য অনুভূতি, ইচ্ছে,আকাঙ্খা গুলো আমাদের চাইতেও বহুগুণে বেশি।তবুও সে জানে, সেই অনুভূতি,ইচ্ছে, আকাঙ্খা গুলোকে কিভাবে দুমড়েমুচড়ে হলেও নিজের ভেতর আঁটকে রেখে, সবার চোখে স্বাভাবিক হয়ে থাকা যায়; একটা বি’ধ্বস্ত ভাঙা হৃদয়কে আঁকড়ে ধরেও দিনের পর দিন বেঁচে থাকা যায়।”

আনায়া রেহানের প্রত্যেকটা কথাই অতিশয় মনোযোগী হয়ে শুনল। কথা গুলো মিথ্যে নয়। রোজকে বোঝার সাধ্য তার নিজেরও হয়নি। একটা দুটো বছর নয়,অনেকটা বছর কাটিয়েছে সে রোজের সাথে। তবুও রোজের হৃদয়ের গহীনতার পরিধিকে সে আন্দাজ করতে পারেনি। এতো চাপা স্বভাবের মেয়ে আর দুটো দেখেনি আনায়া। কত সুন্দর বছরের পর বছর একতরফা ভালোবাসা নিয়ে সে দিব্যি হাসি মুখে বেঁচে রয়েছে।অথচ তার অন্তঃস্থলের হাহাকার বোঝার সাধ্য কারো নেই।

—“রোজ হলো বাগানের হাজারো গোলাপের মাঝে ফুটে থাকা এক নিঃসঙ্গ গোলপ। যার অস্তিত্বে শুধুই হাহাকার। কিন্তু তা বোঝার সাধ্যও যে কারো নেই।”

এরই সাথে আনায়া খানিকটা তাচ্ছিল্য আর রাগ সহিত…, মনে মনে আরো বলে উঠলো ,

“এরপরও কি, নিজের এই বি’ষাক্ত জীবনকে অভি”শপ্ত বলা,ভুল হবে আমার? কেউ তো ভালো নেই, কেউ না! আমি না থাকলে হয়তো এতোগুলা মানুষের জীবনের গল্পগুলো এতোটাও করুণ হতো না।
আফসোস, আজ কেউ সুখী নয়। প্রত্যেকেই যেন মিথ্যে অভিনয়ে মেতে উঠেছে। কি নিদারুণ তাদের অভিনয়।”

এদিকে রেহান স্বাভাবিক ভাবেই বলে ওঠে,

“অরিন কিন্তু একেবারে তোমার মতোই হয়েছে। যদিও মাঝেমাঝে রোজের মতোই মনে হয়,তবে সবমিলিয়ে ও কিন্তু ভারী মিষ্টি।
মেয়েটাকে সাবধানে রেখো। ওকে মানুষের মতো মানুষ বানিও। পৃথিবীর সকল অন্যায়গুলো থেকে দূরে রেখো। আর যাই হোক, ওর বাবার মতো হতে দিও না। ওকে এটা শিখিয়ে দিও যে, পৃথিবীতে নিজের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যেন অন্যকারো জীবন ধ্বং”স না করে। নয়তো তার শেষ পরিণতি, একটা না একটা সময় পর—খারাপই হয়।”

আনায়া কিছু বলে না, বরং রেহানের অকপটে বলতে থাকা কথাগুলো চুপচাপ শুনতে থাকে। একটা সময় এই রেহানই তাকে বলতো, তাদের একটা রাজকন্যার মতো মেয়ে হবে। দেখতে নাকি একদম আনায়ার মতোই হবে। বাবা মেয়ে মিলে দুজন অনেক আনন্দ-মজা করবে। কত-শত সপ্ন বুনে রাখা ছিলো তার। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ সব সপ্ন চুরমার করে দিয়েছে। প্রত্যেকের জীবন ধ্বং’সা’ত্মক বানিয়ে ছেড়েছে। পুনোরায় দু’জনকে নিস্তব্ধতা এসে আবদ্ধ করে। কিছুই সময় একই ভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর আনায়া আবারও বলে,

“তুমি হয়তো কিছুটা ব্যস্ত। চাইলে যেতে পারো,আর বিরক্ত না করি।”

—“তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে রেহান।”

আনায়ার চাতকের ন্যায় চাহনি আর অভিব্যক্তিতে, রেহান কিঞ্চিৎ মলিন ভাবে মুচকি হাসে।

—“বলার মতো আরো কিছু অবশিষ্ট রয়েছে?আমার তো মনে হয় না।”

আনায়ার বলার মতো এবারও কিছু খুঁজে পেলো না। একমনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রেহান আনমনেই পুনোরায় মুচকি হাসে। সেই সাথে কিছুটা মলিনতার স্বরে,আনমনে বলে ওঠে,

“যে প্রেমে বিচ্ছেদ নেই, তা কখনোই পূর্ণতা পায় না। কেননা বিচ্ছেদই প্রকৃত প্রেমের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা, যেখানে ভালোবাসার পরিসমাপ্তি থাকে।”

আনায়া মুখ ফিরিয়ে রেহানের দিকে তাকায়।তার দিকে চেয়ে থেকেই, কিছুটা স্তব্ধ স্বরে বলে ফেলে,

“তবে কি আমাদের ভালোবাসাও পূর্ণতা পেয়েছিল?”

—“হুম, অবশ্যই! এই যে তুমি আমাকে ছাড়াও মেয়ে, স্বামী, সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে রয়েছ।প্রেমিক হিসেবে তো, এটাই আমার প্রাপ্তি।”

—“………

—“প্রতিবার শুধু আমিই বলে যাচ্ছি। তুমি কেনো বারবার চুপ হয়ে যাচ্ছো ?”

—“তোমার শব্দ ভান্ডারের সাথে লড়বার মতো আমার নূন্যতম শব্দ সংখ্যাও নেই। বহু পূর্বেই সব ফুরিয়ে গিয়েছে।”

—“তোমার মতো এতো কঠোর ব্যক্তিত্ববান নারীর মুখে এমন কথা মানায় না। বি স্ট্রং…আমি তোমাকে কখনো দূর্বল হিসেবে দেখতে চাই না।”

—“বিচ্ছেদের এতো বছর পরও,তোমার সহজ অভিব্যক্তি, ভালোমানুষি গুলো আমায় বড্ড বেশি পোড়ায়। যদি আমায় একটু ঘৃণা করতে, তবে হয়তো অবশিষ্ট জীবনটুকু বড্ড শান্তিতে বাঁচতে পারতাম।”

—“তুমি পারবে আমায় ঘৃণা করতে?”

আনায়া জলে সিক্ত ছলছলে চাহনিতে পাশে ফিরে রেহানের দিকে তাকায়। আনায়ার ছলছলে চোখ দেখে রেহানের আকস্মিক দম হয়ে এলো। আনায়ার চোখের প্রতিটা জলের কণা যেন তার হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। রেহান আড়ালে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চায়। এদিকে আনায়া ঢোক গিয়ে কিছুটা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে ওঠে,

“কখনোই না।”

—“তবে একাই স্বার্থপরের মতো কিভাবে চাইছো যে, আমি তোমায় ঘৃণা করি। এমন স্বার্থপর তো তুমি ছিলে না!”

রেহানের তেজী কন্ঠে আনায়া অপলক তার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের পলক ফেললেই যেন জমে থাকা জলগুলো ঝড়ে পড়বে। আকস্মিক শ্বাস নিতেও অনেকটাই কষ্ট হচ্ছে। আবারও বুক ভারী হয়ে আসছে। এসবের কোনোকিছুই রেহানের নজরের অগোচর হলো না। আনায়ার প্রত্যেকটা অনুভূতি যেন সে নিজে অনুভব করতে পারছে। অথচ দুজনের মাঝে আকাশস্পর্শী অদৃশ্য দূরত্ব একটি বারের জন্যও দুজনকে এক হতে দিচ্ছে না। রেহানের অবাধ্য ইচ্ছেগুলো প্রেমিক রূপে, প্রতিনিয়ত চাইছে আনায়ার কাছে গিয়ে নিজ স্পর্শে সামলাতে । কিন্তু রেহান একমনে দৃঢ়তার সাথে এক জায়গায়তেই এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কষ্ট তার যতই হোক,সে কখনো তার এইসকল অবাধ্য ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দেবে না। রেহান জানে আনায়া আর এই মূহুর্তে কিছু বলতে পারবে না। তাই নিজেই পুনোরায় বলে উঠল,

“তোমাকে ঘৃণা করার সাধ্য যে আমার নেই। প্রানবন্ত, নিষ্পাপ, চমৎকার—এক মেয়েকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। কোনো ছলনাময়ীকে নয় যে আমি তাকে ঘৃণা করবো।”

—“……….

—“প্রেমের সবচাইতে অদ্ভুত দিক হলো, যখন আমরা কাউকে ভালোবাসি, তখন আমরা একে অন্যের সব কিছু মেনে নেই।কিন্তু যখনই বিচ্ছেদ আসে, তখনই যেন সব কিছুই বেমানান হয়ে যায়।”

—“……..

—“বারবার আমিই শুধু বকবক করে যাচ্ছি। এভাবে চুপ থেকে নিজেকে কষ্ট না দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো। তোমাকে নিয়ে আমার কোনো কালেই কোনো অভিযোগ নেই। যতটুকুও আমি তোমায় জেনেছি, চিনেছি তাতে হলফ করে বলতে পারি, মায়ের পর তুমিই ছিলে আমার চোখে দেখা সবচেয়ে সেরা অতুলনীয় নারী। তোমাকে অবিশ্বাস করার মতো পাপ আমি করতে চাই না।”

—“এতোটাও বিশ্বাসের যোগ্য নই আমি৷ কোনো ছলনাময়ীর চেয়েও কম কিছু নই।”

—“আমরা ভালোবাসি বলেই আমাদের বিচ্ছেদ কষ্টকর হয়। কিন্তু এই কষ্টই আমাদের শেখায়, ভালোবাসা একমাত্র সে শক্তি, যা কখনো হারায় না। শুধু রূপ বদলায়।”

—“……..

—“তাই নিজেকে এভাবে মিথ্যে দোষারোপ করো না। ভালোবাসা রূপ বদলিয়েছে, আমরা নই।”

আনায়া আকস্মিক তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হাসলো। এবার অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

“দোষারপ মিথ্যে নয়, বরং সান্ত্বনাটা মিথ্যে।”

পুনোরায় দু’জনের মাঝে নিরবতা জমে। মুখে যা বলছে তার সবই যেন যান্ত্রিক কিংবা মাত্র একাংশ। নয়তো অন্তর্দেশের গহীনে জমে থাকা অপ্রকাশিত কথাগুলো তো আজ পাহাড় সমান উঁচু । তবে এহেন নিরবতা ভেঙে হুট করেই রেহান বলে উঠল,

“বিচ্ছেদে অনেক কিছুই হারাতে হয়।কিন্তু সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা হারাতে হয়, তা হলো আমাদের সেই বিশ্বাস। যে বিশ্বাসে আমরা একে অপরকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম।”

রেহানের কথা শুনে আনায়া খানিকটা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। হঠাৎ তার এমন অভিব্যক্তি আনায়ার কাছে অনচ্ছ লাগল।

—“হঠাৎ এই কথা? তারমানে তুমি বলতে চাইছো, আমাদের বিচ্ছেদেও …”

—“নাহ্, এমনটা লোকে বলে… সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও,আমাদের ক্ষেত্রে নয়।আমরা ছিলাম অনন্য, তেমনি আমাদের প্রেমও ছিলো চমৎকার, অতুলনীয়। যেখানে বিশ্বাসের পরিধি ছিলো আকাশস্পর্শী।আমাদের প্রেম এতোটাও ঠুনকো ছিলো না যে, একটা সমান্য বিচ্ছেদ সেই আকাশস্পর্শী বিশ্বাসকে নিঃশেষ করবে।”

—“রেহান! তুমি অত্যন্ত চমৎকার একজন মানুষ। খুব বেশি ভাগ্যবান না হলে, যে কারো তোমাকে পাওয়া অসম্ভব। সচারাচর কোনো আটকপালে তোমার মতো অতুলনীয় ব্যক্তি জুটবে না।”

—“উপহাস করলে নাকি?”

রেহানের আকস্মিক হাসিতে, আনায়াও কিঞ্চিৎ হেসে ফেলল।

—“মোটেও না, তোমাকে নিয়ে উপহাস করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। তুমি আদতে কি, তা হয়তো তুমি নিজেও জানো না।আর…সে সব অভাগার মাঝে হয়তো আমি নিজেও একজন…অন্যতম একজন।”

আনমনে কথাটা কোনোমতে বলতেই আনায়া আকস্মিক ঢোক গিলল। মাথা উঁচিয়ে পাশে ফিরতেই খেয়াল করে,রেহান তার দিকে অপলক তাকিয়ে।চোখাচোখি হতেই, নিমিষেই দুজনে বিস্তৃত মুচকি হাসে। অথচ সেই হাসি টুকুতেও রয়েছে দুজন দুজনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা,সন্মান, ভালোবাসা এবং পাহাড় সমতূল্য হতাশা ও মলিনতা। দু’জনেই তাদের ভাগ্যের পরিহাসকে নির্বিকারে গ্রহণ করেছে বহু পূর্বেই। এখন এই সম্পর্কে নতুনত্ব বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।কিছুই না!

_______________

রোজ তার রুমের, বারান্দার এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতে তার একটা কালো রাঙা চিঠির খাম। তার উপর ছোট একটুকরো লাল রাঙা মমের প্রলেপ। তার মাঝে স্পষ্ট আঁকা বিচ্ছু কিংবা স্করপিয়নের সদৃশ এক চিহ্ন।

রোজের চোখেমুখে নির্লিপ্ততার মাঝেও মৃদু আতং”কের ছাপ। খামটা খোলার সাহস জাগাচ্ছে না তার। তবে একবার খুলে না দেখলেও নয়। রোজ কিঞ্চিৎ ঠোক গেলে। এমন কালো রাঙা চিঠির খাম সে নতুন দেখছে না। বছরে সৌভাগ্যবশত তার কাছে দু একবার এমন চিঠি চলেই আসে। কিন্তু আজকের দিনে সে যেন, কোনোমতেই এই চিঠিকে প্রত্যাশা করেনি।

সকাল বেলায় ইনায়ার সাথে হাঁটতে গিয়ে…একজন প্রহরী তাকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করে। রোজেরও বুঝতে বেশি সময় লাগে না, ঘটনা কি। আর ঠিক তখনই খুব কৌশলে, সকলের চোখের আড়ালে সে চিঠির খামটা নিয়ে, নিজের গাউনের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। কিন্তু সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত একবারও তার এই খামটা খুলে দেখার সুযোগ হয়নি। সে ইচ্ছে করেই যেন এই সুযোগটা হতে দেয়নি।

রোজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। খামটা এবার খুলে দেখার জন্য উদ্বিগ্ন সে। তবে মন বলছে, এই অসময়ে এমন চিঠি ভালো কিছুর পূর্বাভাস নয়৷

—“ভেতরে আসতে পারি?”

রোজ যেই না খামটা খুলতে নেবে, ওমনি পেছন থেকে পরিচিত এক কন্ঠস্বরে সে খানিকটা চমকে ওঠে। দ্রুত চিঠির খামটা, বারান্দার ফুল গাছের আদলে লুকিয়ে ফেলে। পেছন ঘুরে ফিরে তাকাতেই, রুমের মাঝ বরাবর রেহানকে দেখতে পায়। চোখেমুখে মলিন হাসি। তাকে দেখামাত্রই রোজ বারান্দা থেকে রুমে দিকে কিছুটা এগিয়ে এলো। হাসি মুখে বলে উঠল,

“জ্বী,অবশ্যই! ভেতরে আসুন।”

রেহান আবারও কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে রোজের উদ্দেশ্যে বলে,

“সরি,দরজায় কয়েকবার নক্ করেছিলাম।আপনি হয়তো খেয়াল করেননি। তাই পারমিশন ছাড়া রুম অব্দি আসতে হলো।”

—“সরি বলছেন কেনো? কোনো সমস্যা নেই, আমি কোনোকিছু মনে করিনি।”

রেহান আর রোজের একটা অদ্ভুত বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে। হ্যাঁ,অদ্ভুতই বটে। আজ থেকে কিছু বছর পূর্বে হুট করে তারা বিয়ের সিন্ধান্ত নেয়।অথচ তখন তারা একে অপরকে ঠিকঠাক চেনেওনা।

ঘটনার সূচনা হয়,রোজের বাংলাদেশে যাবার মাধ্যমে। অরিনের জন্মের পর মাঝেমধ্যে তার বাংলাদেশে যাওয়া হতো।সেই সূত্রে কয়েকবার সে আনায়াদের পুরোনো বাড়িতেও থেকেছে। আর সেখানেই, রেহানের সাথে রাস্তায় একদিন হুট করে তার প্রথম দেখা হয়। রোজের পরনে তখন বড়সড় আলখাল্লা সরূপ জামা।সে পরিবেশে সবার চেয়ে কিছুটা আলাদা হওয়ায়, তাকে লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে হয়েছে। সবসময় ঘরের ভেতর ভালো লাগছিল না বিধায়, নিজেকে খানিকটা আড়াল করে বিকেলে হাঁটতে বেড়িয়েছিল। আর ঠিক তখনই এক অপরিচিতর সঙ্গে ধাক্কা লাগে… যে কিনা ছিল রেহান।

অতঃপর রোজের মাথা হতে স্কার্ফটা সরে যেতেই, দৃশ্যমান হয় একগোছা কালচে লাল চুল। তার চেহেরাটাটাও যেন আর সবার চেয়ে খানিকটা ভিন্ন। এদিকে রেহানের হাতে ছিল কয়েকটা কাগজের ফাইল। সেগুলো হাত থেকে পড়ে যেতেই, সে তা দ্রুত মাটি থেকে উঠিয়ে নিতে নিতেই… রোজকে না দেখেই অনবরত সরি বলতে থাকে। এতে রোজ খানিকটা অবাক হয়। এই অপরিচিত লোকটিকে তার ভীষণ অমায়িক মনে হয়।

সে আনমনে হাঁটছিল বিধায়,ধাক্কাটা লাগে।এতে কেউ দোষী হলে,তা সে নিজেই। অথচ লোকটি তাকে না দেখেই যেভাবে ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছে, তা ভারী আশ্চর্যের। রেহান পেপারগুলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়াতেই, রোজের হুঁশ ফেরে। সে দ্রুত নিজেকে সামলে আলখাল্লা আর স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢেকে নেওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।কিন্তু তার পূর্বেই রেহান তাকে সম্পূর্ণ রূপে দেখে ফেলে।

এই এলাকায়, হঠাৎ এমন অপরিচিত বিদেশি মুখ, সত্যিই কিছুটা অবাক করার মতো। রেহানের ভ্রু কুঁচকে যায়। ওদিকে রোজ কোনোমতে ইতস্ততভাবে আওড়ায়,

“সরি,দোষটা আমার ছিল।”

এই বলেই রোজ চলে যেতে নিলে, পাশ থেকে রেহান বলে ওঠে,

“আপনি বাংলা বলতে পারেন?”

রোজ যেতে নিয়েও আর চলে যায় না।বরং পেছনে পাশে ফিরে রেহানের মুখোমুখি হয়। অতঃপর ধীরে ধীরে তাদের পরিচয়। এক কথায়, দু কথায় সে জানতে পারে,রোজ আনায়াদের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য থাকতে এসেছে। এর পর রেহানের আরো কিছুটা আগ্রহ জাগে। পরবর্তী মোটামুটি দুজন রাস্তার ধারে হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক অনেক গল্পই করে ফেলে। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, তাই রেহান সৌজন্যতার খাতিরেই তাকে আনায়ার বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়।

এদিকে বাড়ি অব্দি আসতে আসতেই সেদিন বাড়ির সামনে আনায়ার সাথেও তার ছোট্ট একটা সাক্ষাৎ হয়ে যায়।যা প্রায় অনেকটা দীর্ঘ সময়ের পর। এই এলাকায় তার প্রয়োজন ছাড়া আসা হতো না।যেহেতু রেহান দেশ ছাড়ার নিয়তে ছিল, সে কারনেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য তাকে এখানে আসতে হতো। কিন্তু এর আগে কখনো আনায়ার সাথে তার দেখা হয়নি।আর সে নিজ ইচ্ছেতেই দেখা করেনি। তবে ঠিকই সে মাঝেমধ্যে ইমনের কাছে আনায়ার সম্পর্কে কথার ছলে টুকটাক খবর নিয়েই নিতো। না চাইতেও তার ধ্যানজ্ঞান যেন সেদিকেই পড়ে থাকত৷ আর এদিকে ইমনও ব্যাপারটা ভালোই বুঝতে পারত। সেও যথাসাধ্য চেষ্টা করত, টুকটাক খবর জেনে নেওয়ার ।

তবে যেদিন রেহান জানতে পারল যে, আনায়া প্রেগন্যান্ট… সেদিন থেকেই সে যেন নিজেকে যথাসাধ্য গুটিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে। তবে এতেও পুরোপুরি সফল হয়নি।এরপর একবার দূর থেকে আনায়ার প্রেগন্যান্সির সময় কেনীথ আর আনায়াকে একসাথে দেখেছিল। রোহানের মৃ’ত্যুর পর সেটিই তার প্রথম দেখা ছিল। কেনীথের প্রচন্ড যত্নশীলতা, আনায়ার ছেলেমানুষী, সবকিছুই দূর থেকে ভীষণ উপভোগ করেছিল সে। একবার ভেবেছিল, আনায়ার কাছে গিয়ে দুটো কথা বলে আসবে। এই নতুন জীবনের জন্য একবার শুভকামনা জানাবে। অথচ সেদিন কি যেন ভেবে আর তাদের কাছে যাওয়া হয়নি।হয়তো ভেবেছিল তার জন্য, তাদের সুন্দর মূহুর্তটা ন”ষ্ট হয়ে যাবে। শুধু শুধু কারো জীবনে কাঁটা হবার কি প্রয়োজন।

সেই থেকেই দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিল,আর আনায়ার সাথে হয়তো তার দেখা হবে না। সে যতদ্রুত সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। সে না হোক, আনায়া হয়তো তাকে একটা না একটা সময় ঠিকই ভুলেই যাবে৷ তাকে পুরোপুরি ভুলতে পারলেই তো আনায়া সুখী।আর আনায়ার সুখে রেহান খুশি।

অথচ ভাগ্য তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে আনায়ার সামনেই আবারও টেনে আনে। রেহান ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখে আনায়ার কোলে একটা ছোট্ট বাচ্চা।পরনে লাল টুকটুকে একটা জামা। ছোট ছোট চুলগুলোতে মাথার ঠিক মাঝ বরাবর একটা ঝুঁটি গাঁথা। অদ্ভুত ভাবে চুলগুলো রোজের মতোই। সে কপাল কুঁচকে পাশে ফিরে রোজকে দেখে, পুনোরায় দেখে সেই এক কিংবা দেড় বছরের বাচ্চাটাকে।

এদিকে আনায়ার তার দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে। তার অভিব্যক্তিতে কোনো নড়চড় নেই। আনায়ার এহেন অভিব্যক্তিতে রেহান কিঞ্চিৎ মলিন ভাবে মুচকি হাসে। চলে না গিয়ে বরং আনায়ার দিকে এগিয়ে যায়। বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বলে,

“কেমন আছো?”

আনায়ার গলার স্বর থেমে গিয়েছে। শুরুতে কিছুই বলতে পারেনা। খানিকটা ঢোক গিলে পরক্ষণেই দৃঢ় প্রচেষ্টায় বলে ওঠে,

“হু…ভালো। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

রোহান বাচ্চাটার থেকে নজর সরিয়ে আনায়ার দিকে তাকায়। তার বিস্তৃত মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে খানিকটা মুচকি হাসে। পুনোরায় আনায়া থেকে নজর সরিয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকায়।

—“এই তো ভালো। মেয়ের নাম কি রেখেছো?”

—“অরিন…”

রেহান কিছুটা স্তব্ধ চাহনিতে, আনায়ার দিকে ফিরে তাকায়। আনায়া তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবারও বলে,

“কেনায়া শিকদার অরিন।”

রেহানও তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বিস্তৃত মুচকি হাসে। এদিকে অরিন তখন খিলখিল করে হেঁসে উঠেছে। নিমিষেই দুগালে দুটো টোল ফুটে ওঠে। রেহান তা দেখে বিস্ময়ের চাহনিতে তাকিয়ে,হেসে ফেলে। অরিনের দিকে দু’হাত এগিয়ে দিতেই সে তার কোলে চলে আসে। রেহান আবারও প্রফুল্লচিত্তে বিস্তৃত হেসে বলে,

“মাশাল্লাহ! একদম মায়ের মতোই হয়েছো। ডিম্পল প্রিন্সেস! তবে চুলগুলো হয়তো ফুপির মতো।… অনেক বড় হও মা। মানুষের মতো মানুষ হও।”

আনায়া অপলকভাবে রেহানের দিকে তাকিয়ে।আনায়ার ঠোঁটে তখনও কোনো কথা আসে না।
তবে চোখের কোণে একচিলতে জল চিকচিক করে ওঠে। যেটুকু সে লুকিয়ে ফেলতে চায়, কিন্তু রেহান ততক্ষণে দেখে ফেলেছে।

রেহান আর কিছু না বলে পেছন ঘুরে হাঁটা দেয়।
চলে যেতে যেতে বলে,

“তোমার জীবনে যা এসেছে, তা তোমার প্রাপ্য। কদর করতে শেখো। হারিয়ে ফেলো না।”

আনায়া কিছু বলতে চায়।হয়তো রেহানের চলে যাওয়া থামাতে চায়। কিন্তু শব্দগুলো গলার কাছে এসে থেমে যায়।একটা দীর্ঘ নীরবতা জমে ওঠে চারপাশে। আনায়ার পাশেই দাঁড়ানো রোজ। আনায়ার কাছে রেহানের ব্যাপারে সে আগেই শুনেছিল৷ কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি। অথচ আজ সে সৌভাগ্যও হয়ে গেল। একইসাথে দুজনের এই রুদ্ধশ্বাস সমরে চোখাচোখি, কিংবা ইতস্তত হবার ব্যাপারটাও রোজ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। নিমিষেই সে আড়ালে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

সেদিন রেহানের কাছে অরিনকে দেবার মতো কিছুই ছিলনা। তবে পরবর্তীতে সে তার মায়ের একটা চেইন অরিনকে উপহার দিয়ে দেয়। কোনো এক কারণ বশত সে অরিনকে নিজের মায়ের জায়গায় স্থান দিয়েছে। এই মেয়েটার প্রতি তার বিশেষ একটা টানও রয়েছে।

ঘটনার ইতিটা সেখানেই ঘটেনা। তার কয়েকমাস পর আবারও রেহানের সাথে রোজের দেখা হয়।খুব স্বভাবিকই তাদের সাক্ষাৎ। কোনো বিশেষত্ব নেই, শুধু সম্মানজনক এক ভালো বন্ধুত্ব ব্যতীত। ওদিকে কেনীথের কাছে এইসব ছোটখাটো ব্যাপারের বেশিরভাগটাই ছিল অজানা। এতোদিনে তার ধ্যান জ্ঞান সবকিছুতে তার মেয়ে দখল বসিয়েছে। রাতদিন তার মেয়ে নিয়েই কেটে যায়। আনায়াও একই সাথে সংসারী হয়ে ওঠে।

যে কারণে কোনোমতেই তারা রেহান কিংবা রোজের ব্যাপারটা বুঝতে পারেনা। দু একবার দেখায় দুজনের মাঝে কি এমন হয় তা কেউ জানেনা। কিন্তু একদিন হুট করেই তারা বিয়ের সিন্ধান্ত নিয়ে হাজির হয়৷ বিষয়টা সবার মতো কেনীথ আনায়ার কাছেও অদ্ভুত লেগেছিল। তবে তাদের বিয়েতে আরো একজন উচ্ছ্বসিত হয়ে বসে ছিল।আর সে হলো,রোজের দাদি লুসিয়া।

লুসিয়া অরিনের জন্মের পর খুব অল্প কয়েকবার সবার সাথে দেখা করতে এসেছে। বেশিরভাগই অরিন কিংবা রোজের সাথে দেখা করার জন্য। আর সে-ও তখন রোজের এই বিয়ের বিষয়ে প্রচন্ড আগ্রহ দেখায়। পরবর্তীতে আনায়া কেনীথ এইটুকু জেনেছিল যে, লুসিয়াই নাকি রেহানকে বিয়ের জন্য মানিয়েছে। একপ্রকার অনুরোধ ছিল তার। কিন্তু লুসিয়াই বা কখন রেহানের সাথে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ… কিংবা তার বিষয়ে আগ্রহী হলো, তা কিছুটা ধোঁয়াশাই রয়ে গিয়েছে।আর সবকিছু এতো দ্রুত ঘটে যে, কেউ যেন কিছু ঠিকঠাক বুঝে উঠতেই পারেনি। রোজ তার ধর্ম পরিবর্তন করে ফেলে, এরপর খুব অল্প আয়োজনে রেহানের সাথে বিয়েটা হয়ে যায়৷ আর তারপর থেকে পুনোরায় দুজন বন্ধুত্বের এক নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে যায়। যেটাকে নাম মাত্র বিয়ে বলা চলে, অথচ না তারা কখনো স্বামী স্ত্রীর মতো একে অপরের উপর অধিকার ফলিয়েছে, আর না কখনো স্বামী স্ত্রীর মাঝে থাকা দায়িত্বগুলো পালন করেছে।

দুজনকে দেখলে কখনোই মনে হবে না তারা স্বামী স্ত্রী। খুব বেশি হলে, এই সম্পর্কটাকে একটা সম্মানজনক বন্ধুত্বই বলা চলে। বছরে দু-একবার রেহান এখানে এলেই হয়তো রোজের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়। নয়তো তারা কে কোথায় থাকে তার খোঁজখবরও কখনো, একে অপরের কেউ নেয় না। আজও তাদের এই সম্পর্কের বিষয়টা, আনায়া কিংবা কেনীথ… দুজনের কাছেই রহস্য হয়েই থেকে গিয়েছে৷

রোজকে কিছুটা বিব্রত হতে দেখে রেহান ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আগে তো কখনো সে রোজকে এমন বিহেভ করতে দেখেনি। রোজ বরাবরই তার সাথে স্বাভাবিক আচরণই করে। রেহান কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে,

“সব ঠিক আছে?”

রোজ অজান্তেই কিছুটা চমকে ওঠে। খানিকটা ঠোঁট ভিজিয়ে, রেহানকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বোঝাতে চায়। তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরোচ্ছে না।তবে মাথাটা হালকা এপাশ ওপাশ করা আর উদ্বিগ্নতার চাহনিতে, রেহান যেন অনেক কিছুই বুঝে ফেলে। সে খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলে, উদ্বিগ্নতার স্বরে বলে,

“কিচ্ছু হবে না। এতো চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই।”

চলবে_____________