বেহালার সুর পর্ব-০৮

0
26

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮

আমি খাটে হেলান দিয়ে কাঁদতেছিলাম। আমার একটা বদ অভ্যাস হলো আমি রাগে বা কষ্টে বিছানায় চাদর কামড় দিয়ে কাটি আর তুষক ধরে উপরের দিকে তুলতে থাকি আর নামাতে থাকি। আর এ কর্মটি করার সময়েই আমার চোখে অবলোকিত হয় একটি নীল ডায়রি। আমি নীল ডায়রিটা কৌতুহলী হয়ে হাতে নিই। আমি যে রুমটাতে থাকি জানতে পেরেছি এটা আনজুমানের পড়ার ঘর ছিল। তিনি অনেক বই পড়তে এবং লিখতে ভালোবাসতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর উনার বই আর লেখার কাগজগুলো শুধু সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাকিসব একই রয়েছে৷ এ ঘরের প্রাচীরেও আনজুমানের স্মৃতি মিশে আছে।
আমি ডায়রিটা হাতে নিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। উপর থেকে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। তবে ডায়রিটা বেশ পুরনো। আমি বেশ দ্বিধায় ছিলাম ডায়রিটা খুলার ব্যাপারে। তবে সে দ্বিধাটা বেশিক্ষণ নিজের মধ্যে জিইয়ে না রেখে ডায়রিটা খুললাম। ডায়রিটা খুলে বুঝতে পারলাম এটা আনজুমানের ডায়রি৷ ডায়রির প্রথম পাতায় আনজুমানের নামটা বড়ো অক্ষরে লেখা। আর সে সাথে একটা শুকনো গোলাপ ফুল ডায়রির পাতার সাথে লেপ্টে আছে। আমার কৌতুহল বাড়তে লাগল। আমি ডায়রির পাতা উল্টাতে লাগলাম। কিছু লেখা পড়লাম। প্রতিটা লেখা আনজুমান একটি মানুষকে ঘিরে লিখেছে। আর সে মানুষটি হলো সুনীল। সে প্রতিটা লেখায় সুনীলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা প্রকাশ করে গেছে। সে সাথে আরাবের থেকে পাওয়া যন্ত্রণার কথাও উল্লেখ করে গেছে এবং আরাবের অন্য কারও প্রতি আকৃষ্টতাও উল্লেখ করেছে। একটি লেখা এমন ছিল,

আমি আরাবকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম৷ সারাদিন তার ভালোমন্দ খুঁজ নিতাম। তার মনের মতো হওয়ার চেষ্টা করতাম। সেও আমায় সম্মান করত তবে তার ভালোবাসায় একরাশ পরিমাণ অবহেলা ছিল৷ আমি তার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা খুঁজে পেতাম না৷ আমি ভালোবাসা খুঁজে পেতাম অন্য কারও প্রতি৷ তার চোখে মুখে সবসময় আমি তৃষ্ণার জন্য হাহাকার দেখেছি। আমার জন্য যা ছিল সেটা কেবল দায়িত্ব। আমি এ দায়িত্বের সংসার চাই না বরং আমি চাই একটা ভালোবাসার সংসার। তৃষ্ণা অনেক ভাগ্যবান তাই সে আরাবের কাছাকাছি না থেকেও সমস্ত মন জুড়ে আছে৷ আর আমি হতভাগীনি আরাবের রক্তে মিশে গিয়েও কোথাও জায়গা করতে পারিনি।

আরাবের এ অবহেলা গুলোয় আমাকে সুনীলের প্রতি দুর্বল করে তুলছে। আমি সুনীলকে যত দেখি তত মুগ্ধ হই। সুনীল আমার গাড়ির ড্রাইভার হলেও সে ভদ্র, শিক্ষিত। কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালায়, পরিবারের খরচ চালায়। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে সে। টিউশনে মাসিক ফিক্সড ইনকাম নেই বলে গাড়ি চালায়। অবশ্য আরাবও একটু মানবিক। সুনীলের ক্লাসের সময় ফিক্সড করেই গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দিয়েছে। আর দশটা মানুষের মতো আরাবের এ মানবিকতায় আমার প্রতি কাজ করে ভালোবাসা না।

সুনীল আমার প্রতি যতটা কেয়ারিং তার শতভাগের একভাগ আরাবের মধ্যে নেই। আমি আরাবকে অনেকবার বুঝিয়েছি আমাদের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে দিনদিন, একটু বদলাও নিজেকে। কিন্ত তার ধারণা তার জায়গায় সে ঠিক। ছোটো ছোটো ইচ্ছাগুলো সে ভুলে যায়। সে শুধু একটা দায়িত্বের বেড়াজালে আমাকে আটকে রেখেছে। এর বাইরে কিছু না।

মাঝে মাঝে মনে হয় সম্পর্ক থেকে ছুটে যাই, বের হয়ে যাই। কিন্তু ঐ যে আমিও দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে গিয়েছি। এ বেড়াজাল থেকে কখনও বের হতে পারব কি’না জানি না। আমার ভেতরের তীব্র হাহাকার কেউ কখনও নেভাতে পারবে কি’না জানি না। তবে আমি একটু শীতলতা চাই, শীতলতা চাই, শীতলতা চাই।

লেখাগুলো পড়ার পর থেকে আমার ভেতরে অনেক দুটানা কাজ করছে। আনজুমানের চোখে আরাব ভালোবাসে তৃষ্ণাকে। তাহলে তৃষ্ণা কে? আর আমার চোখে আরাবের সকল ভালোবাসা আনজুমানের প্রতি। তাহলে আরাব ভালোবাসে কাকে? আনজুমানকে যদি আরাব ভালোবাসে তাহলে আনজুমান কেন এটা লিখেছে সে অবহেলিত। আর এ অবহেলার জন্যই সে সুনীলের প্রেমে পড়েছে। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় গল্পে ভালোবাসার বেড়াজাল মাপতে গিয়ে এতদিন মনে হয়েছে আনজুমান কতটা ভাগ্যবতী। আর আজকে মনে হচ্ছে সে নিজেও দুর্ভাগা।

আমি আমার চোখ দুটো মুছে ডায়রিটা পূর্বের জায়গায় রেখে আবারও আরাবের রুমে গেলাম। আরাব তখনও শুয়ে ছিল। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি বললেন

“আয়েশা কোনো দরকার? কিছু চাই?”

আমি নম্র গলায় বললাম

“হুম একটু আপনার পাশে বসতে চাই।”

আরাব মোলায়েম কণ্ঠ বলল

“এতে অনুমতি নেওয়ার কী আছে? বসতে পারো।”

আমি আরাবের পাশে গিয়ে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম

” এ মুহুর্তে একটা কথা জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কি’না জানি না। তবে..”

বলেই থেমে গেলাম। আরাব আমার কথার পরিসমাপ্তিতে কথা শুরু করে বলল

“যা বলার বলে ফেলো। নাহয় বদহজম হবে তোমার।”

“আমার মনে হয় আনজুমান আপনার বাসার ড্রাইভার সুনীলের সাথে পালিয়েছে। সুনীল তো ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিল। তাদের মধ্যে হয়তো প্রেম হয়েছিল। এরপর সুনীল পড়াশোনা শেষ করে স্কলারশিপের জন্য অপেক্ষা করছিল। যেদিন সুনীল স্কলারশিপ পেয়েছে সেদিন একটা কাহিনি করে সমস্ত দোষ আপনাকে দিয়ে আনজুমান পালিয়েছে। দেশের বাইরে চলে গিয়েছে সুনীলের সাথে। আর তৃষ্ণা কে?”

আমার কথা শুনে আরাব চমকাবে মনে করেছিলাম তবে তেমন কোনো হেলদুল তার নেই। সে আস্তে গলায় বলল

“সুনীলের সাথে পালায়নি। সুনীল দেশেই আছে। বিয়ে সাদি করে বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করছে। সুনীলের প্রতি আনজুমান দুর্বল ছিল। সুনীলও ছিল। তবে সুনীলের স্পর্ধা নেই সম্পর্ক তৈরী করার। আনজুমান কোথায় আছে জানা নেই। তবে সুনীলের সাথে নেই। আমি সবই জানতাম। তাদের একে অপরের প্রতি টান মহব্বত আমার চোখ এড়িয়ে যেত! তোমার মনে হয়?”

প্রশ্ন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আাবরও বলল

“কিছুই এড়িয়ে যেত না। আর তৃষ্ণা আমার গল্পের একটা চরিত্র কেবল।”

এরপর হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে দেয়ালের দিকে নির্দেশ করে বলল

” ঐ যে দেয়ালে টানানো একটা তৈলচিত্র দেখো। নীল শাড়ি পরা। চোখে গাঢ় কাজল দেওয়া, কপালে কালো টিপ। ব্লাউজবিহীন নীল শাড়িটা পরে মেয়েটা গাছ তলায় বসে আছে। সেই আমার তৃষ্ণা। কল্পনায় আঁকা এক চরিত্র। একটা সময় লেখালেখি করতাম। তখন এ চরিত্রটা কল্পনা করতাম। আনজুমানকে আমার লেখা শুনতাম। সেখানে তৃষ্ণার প্রতি আকুলতা সে মানতে পারত না। কাল্পনিক একটা চরিত্রকেও সে হিংসা করত। ভালোবাসত আমায় তবে আমার ভালোবাসা বুঝত না। তার কাছে যেটা দায়িত্ব সেটা আমার কাছে ভালোবাসার প্রকাশ ছিল। দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি দুরকম তাই একজন আরেকজনের ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। কিন্তু তুমি এসব জানলে কী করে?”

কথাটা জিজ্ঞেস করে আমার দিকে বেশ প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। ভয়ে বুক শুকিয়ে যেতে লাগল। কী জবাব দিব বুঝতে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে আমতা আমতা করে জবাব দিলাম

“আপনার জ্ঞান ফেরার সময় আমি আপনাকে তৃষ্ণা নামটা নিতে শুনেছি। সে সাথে সুনীল, আনজুমানের এ বিষয়গুলো আওরাতে শুনেছি। এর বেশি কিছু না। তাই কৌতুহল মনে এগুলো জিজ্ঞেস করে ফেলেছি।”

আরাব হালকা সুরে উত্তর দিল

“এত কৌতুহল ভালো না। নিজের জীবনের দিকে মন দাও। তুমি যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলছো এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত।”

“আমি তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতেই পারি। দিনশেষে আমি আপনার স্ত্রী। আপনার ব্যাপারে অবগত থাকার অধিকার আমার আছে।”

তিনি আমার কথা শুনে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। আমার চোখ বরাবর আঙ্গুল তাক করে বললেন

“যেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত সেটা আমার ব্যক্তিগতই। এখানে অধিকার কেউ ফলাতে পারবে না। তুমিও না। নিজের বিষয় নিয়ে চিন্তা করো। আর কথায় কথায় কিসের স্ত্রী? এটা কেবল একটা এগ্রিমেন্ট। আর এগ্রিমেন্টের কারণ ছিল তোমাকে বিপদমুক্ত করা। আমি তোমাকে আবারও বলে দিচ্ছি এ বিয়েটা কেবল তোমার ভালোর জন্য করেছি সারাজীবন বয়ে বেড়াবার জন্য না। তোমার জীবনের রঙ তুমি নিজের মতো করে সাজাও। সে রঙে আমাকে সাজাতে যেও না। এতে হিতে বিপরীত হবে। আর জোর করে কোনো সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। আমার জীবনের বিস্তর জায়গা জুড়ে আনজুমান আছে। আর সেটাকে কখনও মুছা সম্ভব না। মুছা সম্ভব হলে অন্য সব পুরুষদের মতো আনজুমান নিঁখোজের ১, ২ বছর পর বিয়ে করে ফেলতাম, ১৩ টা বছর অপেক্ষা করতাম না। তোমাকে দমানোর অনেক চেষ্টা করেও আমি ব্যার্থ। আর দমাতে চাচ্ছি না। নিজের মতো করে নিজের জীবন গুছাও এটাই বলব। বিয়েটাকে অস্বীকার করতে পারব না। তবে এ বিয়েকে কেন্দ্র করে অধিকার ফলাতে আসবে না। ভালোবাসা মন থেকে আসার বিষয়। সেটা যদি কখনও তোমার প্রতি আসে আমি সেটা প্রকাশ করব আমার কাজে মুখে নয়। অতীত ভুলতে সবাই চায়। আমিও চেয়েছি ব্যর্থ হয়েছি। তুমি যদি পারো আমার অতীত ভুলিয়ে বর্তমান সাজাতে সাজাও। কিন্তু তুমি যা করছো এতে আমার অতীতটাকেই বারবার ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তো দূরে থাক এসব করলে সিমপ্যাথিও কাজ করবে না। এবার নিজের ঘরে যাও। সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমাকেও একটু একা থাকতে দাও।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। নিজের রুমে চলে আসলাম। আমার কানে একটা কথায় বাজছে তুমি যদি পারো অতীত ভুলিয়ে বর্তমান সাজাতে সাজাও।

আমি নিজেকে সামলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে আমার। কাঁদতে কাঁদতে শরীর ক্লান্ত হয়ে ঘুমের প্রকোপটা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার চোখ লেগে আসলো।

সকাল ১১ টা বাজে আমি ধরফর করে চিৎকারের আওয়াজে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। চিৎকারের আওয়াজের উৎসটাকে কেন্দ্র করে বাইরে বের হয়ে লক্ষ্য করলাম সোনিয়া রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। এটা দেখে আমার বুকটা কাঁপতে লাগল। আমি দ্রূত তার কাছে গেলাম। আমি কাছে যেতেই সে সাথে সাথে বলে উঠল

“ম্যাডাম ওরা আমাকে না আপনাকে মারতে এসেছিল।”

….