বেহালার সুর পর্ব-১০+১১

0
21

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১০

বালিশের নীচে আয়েশার মায়ের দেওয়া চেইনটা পড়ে আছে৷ যে চেইনটা সে সুজনকে দিয়েছিলাম বিক্রির জন্য। সুজন সেটা ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা বিক্রি করে তাকে টাকাও এনে দিয়েছিল। যেটা দিয়ে সে সোনিয়ার চিকিৎসা করায়। মেডিসিন আনায় সেই সময় ৷ ঐ সময় এ চেইনটা বিক্রি ছাড়া যদিও তার কোনো উপায় ছিল না৷ তবে বিক্রির পর মায়ের স্মৃতি ধরে না রাখার ব্যর্থতাও তাকে পীড়া দিয়েছিল। কিন্তু এ চেইনটা এখানে কী করে আসলো? ভাবতেই গা শিউরে যাচ্ছে তার। সে চেইনটা কাঁপা হাতে তুলল। চেইনটা তুলে ভালো করে খেয়াল করলো এটা তার চেইন কি’না। সে চেইনের লকেটটা বাঁকা দেখেই বুঝতে পারল এটা তারেই চেইন। সে কিছুটা ভীত হয়ে গেল। বিক্রির তিনমাস পর এ চেইন কী করে এখানে আসলো! পুলিশকে জবানবন্দি দিয়ে এসেছে এ চেইন সে বিক্রি করে দিয়েছিল। এখন তো মনে হচ্ছে এ চেইন তাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে দিবে।

পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে আয়েশা পেছন ফিরল। লতা দাঁড়িয়ে আছে। বয়স আয়েশার মতোই হবে। লতা এ বাড়ির নতুন কাজের লোক। ২ মাস হলো এসেছে। আয়েশা যখন হাসপাতালে ব্যস্ত ছিল তখন লতা বাড়ির কাজ করত। রান্না করে হাসপাতালে পাঠাত। লতার সাথে আয়েশার তেমন কথা হয়নি৷ কারণ সে সোনিয়াকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিল। লতাকে আয়েশা জিজ্ঞেস করল

“কিছু বলবে?”

লতা নম্র গলায় জবাব দিল

“ম্যাডাম চেইনটা স্যার আমাকে বলেছিল আপনার বালিশের নীচে রাখতে। দরজার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম চেইনটা হাতে নিয়ে আপনি কিছু ভাবছেন। তাই ভাবলাম আপনাকে জানিয়ে যাই। এজন্যই এসেছিলাম। আর কিছু না।”

আয়েশা লতার কথায় থমকে গেল। তাহলে কী আরাব তাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। আর ফাঁসানোর জন্যই কী সে চেইনটা বালিশের নীচে রেখে গেছে? যাতে করে স্টেইটম্যানটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আয়েশার কপালে আরও বেশি চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল। আয়েশার চিন্তা দেখে লতা আবারও জিজ্ঞেস করল

“ম্যাডাম কিছু হয়েছে?”

আয়েশা নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিল

” না, কিছু হয়নি৷ তুমি যাও৷ রান্নার ব্যবস্থা করো। আমি এসে রান্না করবো। সবকিছু গুছিয়ে রাখো।”

লতা আয়েশার কথায় রুম থেকে বের হয়ে গেল। এদিকে আয়েশার দুটানা যাচ্ছে না। সে এ দুটানার অবসানের জন্য আরাবের রুমের দিকে গেল। আরাব তখন রুমে বসে সিগারেট টানছিল, আর রকিং চেয়ারে বসে দুল খাচ্ছিল। আয়েশাকে দেখেই সে সিগারেটটা রেখে দিল। আয়েশা আরাবের কাছে অনুমতি চেয়ে বলল

“আপনাকে কিছু বলতে চাই।”

আরাব দুল খেতে খেতে উত্তর দিল

“কী বলতে চাও?”

আয়েশা তখন কিছুটা রাগ, কিছুটা আশঙ্কার সংমিশ্রণ করে উত্তর দিল

“আপনি কী আমাকে ফাঁসাতে চান? আপনার কী ধারণা সোনিয়াকে আমি খু/ন করেছি? আপনি সবার সামনে আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চান তাই তো?”

আয়েশার কথা শুনে বিরক্ত গলায় আরাব আয়েশাকে বলে উঠল

“এত ভূমিকা না করে সরাসরি বলো কী হয়েছে।”

আয়েশা রাগটাকে দমিয়ে রেখে বলল

“আমি পুলিশকে বলেছি আমার চেইনটা আমি বিক্রি করে দিয়েছি। সে চেইনের টাকা দিয়ে সোনিয়ার মেডিসিনের খরচ দিয়েছি। এখানে তো যা বলেছি তা সত্য ছিল। তাহলে সত্যটাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে আমার চেইটাকেও আপনি খুঁজে এনে আমার বিছানার বালিশের নীচে রেখেছেন? কী শত্রুতা আমার সাথে আপনার? কী দোষ আমার? আমি তো এখন আপনাকে জ্বালায়ও না। বারবার আমাকে আপনার স্ত্রী বলেও পরিচয় দিই না। দূরে দূরে রাখি নিজেকে। ঠিক যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন তেমনটা। তাহলে কেন আমার সাথে এমন করছেন।”

আরাব আয়েশার চোখের দিকে তাকাল। গড়গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে। সে আয়েশাকে হালকা সুরে বলল

“নিজে নিজেই যদি সব চিন্তা করে নিজের মতো সব ভেবে নাও তাহলে অন্য একজন মানুষকে প্রশ্ন করো কেন? আমি তোমার চেইনটা কোথায় পেয়েছি, কেন এনেছি, কেন লতাকে দিয়ে বালিশের নীচে রেখেছি সেটা প্রশ্ন না করে নিজের মতো গল্প নিজের মনে সাজিয়ে সেটাই আমাকে বলছো। এখানে তো আমার কিছুই বলার থাকে না।”

আয়েশা রাগে, জিদে বলে উঠল

“আমাকে আর কিছু বলতেও হবে না। আমি জাস্ট আপনাকে এটা জানাতে এসেছিলাম আপনার সকল কারসাজি আমি ধরে ফেলেছি। যাইহোক চেইনটা আমি আপাতত লুকিয়ে রাখব। আর যদি আপনার মন চায় সোনিয়ার খু/নে আমাকে ফাঁসাবেন তাহলে ফাঁসাতে পারেন। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। সত্য একটা সময় প্রস্ফুটিত হবেই। ”

কথাগুলো বলে আয়েশা চলে গেল। আয়েশার যাওয়ার পর আরাব আবারও সিগারেটটা ধরিয়ে টানতে লাগল। আর ভাবতে লাগল নারী সত্যিই অদ্ভুত । তারা ভালোবাসার প্রকাশ করলে সবসময় উল্টোটায় বুঝবে৷ সে আয়েশার মায়ের স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনমাস আগেই সুজনের সাহায্য নিয়ে যে দোকানে চেইনটা বিক্রি হয়েছিল সে দোকান থেকে চেইনটা কিনে নিয়েছিল৷ এরপর তিনমাস এত সমস্যা গেল যে চেইনটা ফিরিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় সে ছিল না। আজকে কিছুটা স্বাভাবিক সবকিছু। তাই আয়েশা থানায় যাওয়ার পর লতাকে দিয়ে চেইনটা বালিশের নীচে রাখে সে। যাতে করে আয়েশা এসেই চেইনটা দেখে খুশি হয়ে যায়। মায়ের স্মৃতি ফিরে পাওয়ার আবেগ যেন তাকে গ্রাস করে। কিন্তু কে জানত সে তার বিপরীতটায় বুঝবে। আরাব সিগারেটে জোরে টান দিতে লাগল।

এদিকে আয়েশা ঘরে এসে বিছানায় উপুর হয়ে কাঁদছে আর আর দাঁত দিয়ে চাঁদর কাটছে। আরাবকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছিল। একটা বিয়েকে জীবনের অভিশাপ মনে না করে সেটা নিয়েই জীবন পার করতে চেয়েছিল। কিন্তু আরাব তাকে যে চোখে দেখতেছে সেটাতে বুঝায় যায় তার প্রতি আরাবের বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই। আজকের পর থেকে আরাবের প্রতি তার কোনো ভালোবাসা কাজ করবে না। যে মানুষ তাকে ফাঁসানোর জন্য এত নোংরা পরিকল্পনা করতে পারে সে মানুষ তার ভালোবাসার যোগ্য না। এসব ভেবেই তার কষ্ট বাড়তে লাগল সে সাথে কান্নার গতিও বাড়তে লাগল।

কিছুক্ষণ কান্না করে সে ঘুমিয়ে গেল। ভীষণ ক্লান্ত শরীর তার। সোনিয়ার ধকলটা তার এখনও যায়নি। আরাব আয়েশার রুমে উঁকি দিয়ে লক্ষ্য করল সে ঘুমাচ্ছে। সোনিয়ার প্রতি আয়েশার তীব্র মানবিকতা আরাবকে আয়েশার প্রতি দুর্বল হতে বাধ্য করেছে। দিনকে দিন সে আয়েশার প্রতি একটা দুর্বলতা অনুভব করছিল। সেও চায়ছে আবার নতুন করে জীবনটাকে সাজাতে। কিন্তু আয়েশার সাথে কথার ভুল বুঝাবুঝিতে তাদের মধ্যে কেবল দূরত্বটায় বাড়ছে।

রাত হয়েছে অনেক। আয়েশাকে লতা কয়েকবার ডেকেছে তবে সে উঠছে না। মাতালের মতো ঘুমাচ্ছে। তাই লতা নিজেই রান্না করে আরাবকে খেতে দিল। খাবার খাওয়ার সময় আরাব লতাকে জিজ্ঞেস করল

“তোমার ম্যাডাম কোথায়?”

লতা মাথা নীচু করে জবাব দিল

“ম্যাডাম ঘুম থেকেই উঠছে না। খাওয়ার জন্য বলেছিলাম বলল খাবে না।”

লতার কথা শুনে আরাব খাবার টেবিল থেকে উঠল। সরাসরি আয়েশার রুমে গেল। আয়েশাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু আয়েশা বারবার জবাব দিচ্ছে তার শরীর খারাপ সে খাবে না। উঠে খাবার টেবিল পর্যন্ত যাওয়ার শক্তিও পাচ্ছে না। আরাব আয়েশার কাপালে হাত দিয়ে লক্ষ্য করল আয়েশার শরীরে জ্বর। সে লতাকে ডাক দিয়ে বলল খাবারের প্লেট এখানে নিয়ে আসতে। লতা খাবারের প্লেট আনল। আরাব আয়েশাকে কোনোরকম খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর ভাত মাখিয়ে আয়েশার মুখে তুলে দিয়ে বলল

“এক, দুই লোকমা খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও। শরীর ভালো লাগবে।”

এভাবে বলে বলে সে আয়েশাকে খাইয়ে দিতে লাগল।।আয়েশার হালকা ঘুম কাটল। সে লক্ষ্য করল আরাব তাকে যত্ন নিয়ে খাওয়াচ্ছে। খাওয়ানোর শেষে ঔষধ খাইয়ে আয়েশাকে শুইয়ে আরাব রুম থেকে বের হয়ে গেল। আয়েশার মন আবারও বিগলিত হতে লাগল। আরাবের প্রতি দুর্বলতা আয়েশাকে আবারও গ্রাস করছে। কিন্তু সে সেটাকে এড়িয়ে যাবার পায়তারা করছে।

পরদিন সকাল ১০ টায় অফিসার নাহিদ আসে বাসায়। আরাব তখন অফিসে ছিল।।আয়েশার কাছে অফিসার নাহিদ এসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করে। আর সেগুলো শুনে আয়েশা আবারও রহস্যে তলিয়ে গেল।

#বেহালার সুর
#পর্ব- ১১
#শারমিন আঁচল নিপা

অফিসার নাহিদ জানাল

“ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী সোনিয়ার মৃত্যুর দুই ঘন্টা আগে জ্ঞান ফিরেছিল। এরপর তার মৃত্যু হয় গলা চেপে ধরায়। এখন হাসপাতালে ছিলেন আপনি আর সোনিয়ার বাবা, মা। আর সোনিয়ার মৃত্যুর ১৫ মিনিটের আশেপাশে আপনি সোনিয়ার কেবিনে গিয়েছিলেন। সেটা আমরা সিসি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করেছি। তবে গলায় যে হাতের ছাপ সেটা কোনো নারীর না, একজন পুরুষের। তাই আপনার উপর উঠে আসা সন্দেহের তীরটা সরে গেছে। এখনও কে এ খু/নটা করেছে বেশ ধোঁয়াশায় আছে। আরাব সাহেবও সে মুহুর্তে হাসপাতালে যায় নি। আর সোনিয়ার বাবা, মাও হাসপাতাল করিডোরে বসেছিল। ”

আয়েশা অফিসার নাহিদের কথা শুনে বলে উঠল

“আমি যখন গিয়েছিলাম তখনও সোনিয়ার জ্ঞান ছিল না। প্রতিদিন ওকে একবার দেখার সুযোগ আমি পেতাম। এটা রোজকার ঘটনা ছিল। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো ওর জ্ঞান ফেরার বিষয়টাও ডাক্তার আমাদের কাউকে জানায়নি। ২ ঘন্টা একটা মানুষের জ্ঞান ছিল আমরা জানি না কোনো ডাক্তার টের পায়নি বিষয়টাতেও খটকা আছে। যাইহোক আপনারা তো এবার নিশ্চিত সোনিয়ার প্রাণ আমাদের কারও মাধ্যমে যায়নি। গেলে বাইরের কেউ নিয়েছে। দয়াকরে এবার একটু ইনভেস্টিগেশন করুন ভালো করে। এতে যদি আসল খু/নী ধরা পড়ে। আমি নিজেও প্রাণ সংশয়ে আছি। কারণ সোনিয়াকে না তারা আমাকে খু/ন করতে এসেছিল।”

অফিসার নাহিদ ঘরের আশপাশ ভালো করে অবলোকন করে আয়েশার কথায় কেবল হুম উত্তর দিয়ে চলে গেলেন। এদিকে লতা আয়েশার কাছে আসলো। আয়েশার পাশে দাঁড়িয়ে বলল

“ম্যাডাম একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

আয়েশা লতার দিকে তাকিয়ে অভয় দিয়ে বলল

“যখন যা ইচ্ছা বলতে পারো অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই। আর আমাকে ম্যাডাম বলো না। ম্যাডাম শব্দটা আমার খুব খারাপ লাগে। সোনিয়া ডাকত। ওর কথা মনে পড়ে যায়। এভাবে কেউ ডাকলে আমার অস্বস্তি হয়। আমাকে তুমি আপু বলে ডাকবে। যাইহোক কী বলতে চেয়েছিলে বলো এবার।”

লতা মাথা নীচু করে বলল

“ম্যাডাম..”

আয়েশা লতার কথা আবারও থামিয়ে দিয়ে লতাকে বলল

“আপু বলো।”

আয়েশা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল

“আপু স্যার আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। না চাইতেও আপনার কথাগুলো কানে চলে এসেছিল। আপনি স্যারকে ভুল বুঝেছেন। স্যার আমাকে যখন চেইন দিয়েছিল তখন বলেছিল এটা আপনার মায়ের চেইন। এ চেইনের জন্য আপনার মন ভীষণ খারাপ করতে দেখেছিলেন তিনি। তাই তিনি চেইনটা যে দোকানে সুজন বিক্রি করে দিয়েছিল সে দোকান থেকে কিনে রেখেছিল আপনাকে সারপ্রাইজ দিবে তাই। কিন্তু আপনি তো স্যারকে অনেক বড়ো ভুল বুঝলেন।”

লতার কথা শুনে আয়েশা চুপ হয়ে গেল। স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। এত বড়ো বোকামি কী করে করল সে। তার মাথায় ইতিবাচক বিষয় না এসে নেতিবাচক বিষয় কী করে আসলো? যদিও এত নেতিবাচক বিষয় ঘটেছে সেখানে ভালো চিন্তা মাথায় আসাও দুষ্কর। তার স্তব্ধতা কাটে লতার কণ্ঠে। লতা বলে উঠল

“আপু কিছু হয়েছে?”

আয়েশা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল

” না তেমন কিছু না। আজকে ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস আর চিংড়ি মাছ বের করো। আমি গরুর মাংস আর চিংড়ির দিয়ে কচুর লতি রান্না করব। তোমার স্যার এটা খুব পছন্দ করে।”

লতা মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে চলে গেল। আয়েশা সরাসরি নিজের ঘরে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে আরাবকে কল দিল। প্রথমবার কল রিসিভ হয়নি। তবে দ্বিতীয়বার কল দিতেই আরাব রিসিভ করে। আরাব হ্যালো বলতেই আয়েশা বলে উঠে

“দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে যাবেন। আমি রান্না করে রাখব। আর অফিসার নাহিদ এসেছিল। ইনভেস্টিগেশনের নতুন মোড় জানিয়ে গেলেন। আমাদের এতে ভয় নেই। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন আমরা এতে জড়িত না। আর এত অশান্তি বয়ে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাপন ভুলতে বসেছি। তাই পেছনের কালো সব অতীত বাদ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। আপনি একটু কষ্ট করে দুপুরে আসবেন। আমি আপনার পছন্দের রান্না করে রাখব।”

আরাব কেবল আচ্ছা উত্তর দিল। এরপর কলটা কেটে দিল। আরাবের এ গা ছাড়া ভাবটা আয়েশাকে একটু কষ্ট দিলেও সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। এরপর সরাসরি চলে গেল রান্না করতে। কাঁঠালের বিচি দিয়ে গরুর মাংস, চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি, সে সাথে পাতলা ডাল, ডালে হালকা বোম্বাই মরিচ দিয়েছে। রান্না থেকে বেশ সুঘ্রাণ বের হয়েছে। যদিও আয়েশা এর আগে আরাবের জন্য অনেক রান্না করেছে তবে আজকে তার বুক ভীষণ ধুকধুক করছে। অসুস্থ একটা অধ্যায় থেকে সুস্থ অধ্যায়ে ফিরে আসার সাঁকো মনে করছে আজকের দিনটাকে।

রান্না শেষ করে সে গোসল করে নিল। তারপর দেয়ালে টানানো তৃষ্ণার ছবির মতো নিজেকে সাজালো। দেয়ালের ছবিটায় যদিও ব্লাউজবিহীন ছিল কিন্তু সে ব্লাউজ পরেছে। নীল শাড়ি, কালো ব্লাউজ, চুলগুলো লম্বা বিনুনি, কপালে কালো টিপ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। এরপর শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে নিল। ভীষণ ভয় লাগছে তার। সে আরাবের রুমে গিয়ে ছবিটাকে দেখতে লাগল আবার নিজেকে দেখতে লাগল আয়নায়। ছবির সাথে নিজেকে মেলানোর অনেক চেষ্টা সে করছে।

একটা পর্যায়ে সে লতাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল

“বল তো লতা ছবির মতো আমাকে লাগছে কি’না।”

লতা আয়েশাকে সাজগোজ অবস্থায় এ প্রথম দেখল। আয়েশা এমনিতেই অনেক সুন্দর। সাজগোজে আয়েশাকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। সে আয়েশার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল

“আপনি ছবির থেকেও সুন্দর আপু।”

লতার কথায় আয়েশার কিছুটা স্বস্থি লাগছে। সে আরাবের জন্য অপেক্ষা করছে। লতার সাথে কথা বলতে বলতেই কলিং বেল বেজে উঠল। আয়েশা দৌঁড়ে গেল। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই আরাব ঘরে ঢুকলো। প্রথমে আয়েশার দিকে আরাবের নজর না গেলেও পরে যখন সোফায় বসে জুতা খুলছিল তখন আয়েশার দিকে আরাবের নজর গেল। তার কল্পনা করা চরিত্রের মতো আয়েশা সেজে আছে। এতে যদিও তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তবে সে চায় না আরাবের জন্য এতকিছু করুক। সে যেমন তেমনেই আরাব তাকে পছন্দ করে। চাকচিক্য এনে তার পছন্দসই হওয়ার কোনো ইচ্ছা আরাবের নেই। সে আয়েশাকে ডেকে বলল

“আয়েশা তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তবে কখনও কারও মনের মতো হওয়ার চেষ্টা করো না। দুনিয়ায় কারও মনের মতো হওয়া যায় না। যে তোমার সে তোমাকে সবভাবে মেনে নিবে। তুমি যেমন আমার কাছে তুমি তেমনেই সুন্দর। আমার জন্য তোমাকে পরিবর্তন করতে হবে না। তবে নিজের জন্য নিজে পরিবর্তন হতে বাঁধা নেই। তোমার জন্য আজকে একটা গুড নিউজ আছে। আমি তোমাকে কলেজে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেছি। শহরের অনেক ভালো একটা প্রাইভেট কলেজে। পরশু তোমাকে এডমিট করাতে নিয়ে যাব। ঐ জায়গার পরিবেশ গ্রামের মতো না। তাই তুমি চেষ্টা করবে ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার। কোনো সাহায্য দরকার হলে আমাকে বলবে আমি করে দিব।”

আরাবের কথা শুনে আয়েশা হেসে মাথা নাড়াল। তারপর নম্র গলায় বলল

“আপনার জন্য আপনার পছন্দের সব রান্না করেছি। ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন।”

আরাব জুতাগুলো খুলে সরাসরি ফ্রেশ হতে চলে গেল। তারপর খাবার খেতে ডাইনিং রুমে আসলো। ততক্ষণে আয়েশা খাবার গুছিয়ে ফেলেছে। পছন্দের সব খাবার দেখে আরাবের মনটা খুশি হয়ে গেল। আরাবের মতে তার মতো মানুষের মন জয় করার জন্য মজার মজার রান্নায় যথেষ্ঠ। সে একটু পেটুক স্বভাবের। খেতে ভীষণ ভালোবাসে। আয়েশা আরাবের পাতে খাবার দিয়ে পাশেই বসে আছে। আরাব আয়েশাকে বসে থাকতে দেখে নিজেই একটা প্লেট নিয়ে খাবার বাড়তে লাগল। আয়েশা অবাক হয়ে আরাবকে জিজ্ঞেস করল

“আরেকটা প্লেটে খাবার নিচ্ছেন কেন?”

“তুমিও খাবে আমার সাথে। তোমাকে ভালো রাখার ওয়াদা করেছিলাম। তোমাকে এখানে আনার পর এত ধকল গেল যে তোমার দিকে নজর দেওয়ার সময়েই হয়ে উঠেনি। অনেকটা সময় পার করে ফেলেছি আয়েশা। তিনটা মাস চলে গেল। অথচ মনে হচ্ছে এই তো কয়দিন হলো। যাক যা হয় ভালোর জন্য। আর আমরা এখন থেকে শত্রু শত্রু না খেলে খুব ভালো বন্ধু হতে পারি। কী বলো?”

আয়েশা হেসে উত্তর দিল

“আপনি যা বলবেন।”

এরপর দুজন খেয়ে নিল। আরাব খাওয়া শেষ করে আয়েশাকে বলল

” রান্না অনেক মজা হয়েছে। অনেকদিন পর ভালো করে খেলাম। অফিসার নাহিদের সাথে কথা হয়েছে কে তোমাকে মারতে চেয়েছিল তারা সেটা খোঁজ নিয়ে তদন্ত করবে। আর সন্ধ্যায় তৈরী হয়ে থেকো। তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। মানে তোমাকে নিয়ে বের হব। ওকে?”

আয়েশা শুধু মাথা নাড়ল। তার ভীষণ ভালো লাগছে আরাব তাকে আস্তে আস্তে মেনে নিচ্ছে এটা দেখে। আরাব চলে গেল পুনরায় অফিসে৷ আর আয়েশা বসে আছে বাসায়৷

আরাব অফিসে যাওয়ার পথে বারবার অনুভব করতে লাগল তাকে কেউ অনুসরণ করছে। কিন্তু পেছনে তেমন কাউকে তার সন্দেহ হচ্ছে না৷ বেশ দ্বিধা নিয়ে সে গাড়ি করে অফিসে গেল। অফিসে গিয়ে নিজের রুমে বসে কাজ করতে করতে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেল।

হঠাৎ করে আরাব কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে হতচকিয়ে তাকাল। আর…

চলবে।