প্রণয়ের মহাকাব্য পর্ব-২২+২৩+২৪

0
23

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২২)
আকাশটা লালকমলা আলোতে রাঙা, দিনভর কড়া রোদের পর হালকা শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে লেকের আশে পাশে। গাছের ডালে ডালে শিমুল-পলাশের লালছোঁয়া, যদিও শহরের কংক্রিটের ভিড়ে তার রঙ ম্লান। তবুও, সন্ধ্যার আলোতে বাতাসে একধরনের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে যেনো,, হিয়া দু হাত দুপাশে মেলে এক গভীর শ্বাস টেনে নিলো এতোক্ষণে যেনো খিটখিটে মেজাজ টা একটু শান্ত হলো, এতক্ষণের জ্যাম ঠেলে এখানে আসার পূর্ণতা যেনো এই নির্মল বাতাস আর এই সুন্দর লেকের পাড়ের দৃশ্য টুকু, হিয়া চোখ মেলে পাশে দাঁড়ানো সোহানার দীকে তাকালো পরপরই চার পাশে তাঁকালো, এখানে সবাই নিজের মতো সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে বেস্ত, হিয়া সোহানার হাত ধরে লেকের পাশ ঘেষে সাজানো বেঞ্চ গুলোর একটাতে বসলো, তখনই আইসক্রিম হাতে সোহান এসে বসলো তাদের পাশে, সোহানা তখন লেকের জ্বল জ্বল করা পানির দিকে তাঁকিয়ে, সন্ধ্যার রঙিন আলো আর লেকের রঙিন কৃত্তিম আলোয় পানি গুলো এক অন্যরকম সৌন্দর্য পাচ্ছে যেনো, এতো ক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে দিলো সোহান,
– ভাই আমি কি এখানে এতো কষ্ট করে জ্যাম ঠেলে তোগো দুই আবা*লের জামাই শোক দেখতে এসেছি নাকি? ঘুরতে আইসা যদি এমন মটকা মাইরা পইড়া থাকস তাইলে হিয়ার এতো নরম গদির বিছানার উপর ই পইড়া থাকতি, বাইরে আইলি কে?
সোহানা রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,,
– ভাষা ঠিক করে কথা বল, এইটা কেমন ব্যবহার?
– এইটা আমার বংশগত ব্যবহার, দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন! আমার এতো শুদ্ধু কথা মুখ দিয়া আসে না বইন, আমি আমার বাপ দাদার মুখের ভাষায় কথা বলাতে বিশ্বাসী, বলেই মুখ ভেঙ্গালো,সোহানের কাণ্ডে হিয়া হাসলো,সোহানের হাত থেকে থাবা দিয়ে দুটো আইসক্রিম নিয়ে একটা সোহানার হাতে গুজে দিয়ে বলল,,,
– আরে ইয়ার জাষ্ট চিল, তোরা দুটো সব সময় এমন লেগে থাকিস কেনো? দেখ কি সুন্দর ওয়েদার আর তোরা এসব উপভোগ না করে ঝগড়া করছিস? আর সোহা ( সোহানার দিকে তাকিয়ে) তুই এমন মুড অফ করে আছিস কেন ভাই? কতবার বললাম সে দিন আমি তোদের উপর যেমন শুধু শুধু রাগ দেখিয়ে ছিলাম ভাইয়ার সাথে ও অনেক রুড হয়েছিলাম তাই হয়তো,, (এই পর্যায়ে হিয়া একটু মিন মিন করে বলে)ভাইয়া সেই রাগ একটু করে তোর উপর ঝেড়ে ফেলেছে, তাই বলে তুই সপ্তা ধরে আমার ভাইকে এভয়েড করবি? রাগ ভাঙ্গানোর সুযোগ টুকু তো অন্তত দিবি নাকি? আচ্ছা যা আমার ভাইয়ের হয়ে আমি মাফ চাইছি তাও আর রাগ করে থাকিস না
– যার মাফ চাওয়ার কথা তার কোনো খবর ননদীনীর ভাবির দুঃখের ঘুম নাই,আইছে আমার মাফ চাওয়ালনি
তোগো এই ভঙ শেষ হলে আমারে ডাকিস বইন তোগো এই ডং দেখলে আমার গাঁও চুলকায় ,,
বলেই আইসক্রিম খেতে সোহান উঠে চলে যায়,,সোহানা তেঁতে ঊঠে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,,
– তুই দেখলি তো কীভাবে,,
সোহানাকে বলতে না দিয়ে হিয়ে তাড়া দিয়ে বলে,,
– ওহ হো সোহা,, আমি তো ভুলেই গেছি
– কি ভুলে গেছিস?
সোহানা ভ্রু কুঁচকে শুধায়, হিয়া বসা থেকে উঠে দাড়ায় দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,,
– আরে তুই এখানেই বোস আমি একটু আসছি,,
বলেই হিয়া চলে যায়, হিয়া যেতেই সোহানা আবারও লেকের পানির স্রোতের দিকে তাকায়, হাতে থাকা আইসক্রিমের প্যাকেট খুলে দেখে গলে গেছে খানিকটা সোহানা তাও গলে যাওয়া আইসক্রিম টা খেতে খেতে ভাবলো,, হিয়া ভূল কিছু বলেনি,, তার উচিত ছিলো তামিমকে সুযোগ দেয়ার, যদি রাগ ভাঙ্গানোর সুযোগই না দেয় তাহলে তামিম তার রাগ ভাঙ্গবে কি করে?ভেবেই সোহানা পার্স থেকে নিজের ফোন টা বের করলো, তারপর একে একে সব জায়গা থেকে তামিমকে আনব্লক করলো,,তামিম তার সাথে অমন করায় অভিমানে সে এতো দিন তামীমের সামনে যায়নি,কলধরেনি, কল না ধরায় এসএমএস দেওয়া শুরু করলে রাগে সব একাউন্ট থেকে ব্লক করে দিয়েছে, আনব্লক করতেই ফোন কল ও মেসেজের নোটিফিকেশানে সোহানার ফোন হ্যাং হবার যোগাড়, তামীমের পাগলামো তে না চাইতেও সোহানা শব্দ করে হেঁসে ফেলে, সোহানা দ্রুত মুখ চেপে ধরে আশে পাশে তাঁকিয়ে দেখে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে কি না,, কেউ তাঁকিয়ে নেই নিশ্চিত হতেই নিজের কাণ্ডে নিজেই হাসলো সোহানা, এই লোক নিজে তো পাগল তাকেও পাগল করে ছেড়েছে,এই বদ লোকের উপর রেগে থাকা যায় বুঝি? যেনো এক নিমিষেই সোহানার অভিমান সব কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেলো।
– ভালোবাসি প্রাণ প্রিয়া!
হঠাৎ কানে কারো ফিসফিসানি শব্দ শুনতেই চমকে উঠলো সোহানা,, দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো তামিম তার পাশে বেঞ্চে গাঁ এলিয়ে বসে আছে,তামিমকে হঠাৎ পাশে দেখে সোহানা একটু ভয় পেলো অবশ্য তবে নিজেকে সামলে নিলো, এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তামীমের দিকে,সোহানার চাহনী দেখে তামিম হেলান দিয়ে বসে বুকে দু হাত গুজে ভ্রূ নাচিয়ে মিটিমিটি হাসতেই ,এক ঝটকায় উঠে যেতে চাইলো সোহানা কিন্তু বাধ সাধলো তামিম পেছন থেকে খপ করে আগলে ধরলো ওর বাঁ হাত, সোহানা ছাড়া পাবার জন্য হাত মোচড়ামুচড়ি করলে , তামিম ওর আঙুলের ভাজে আঙ্গুল গলিয়ে আরও শক্ত করে ধরে,সোহানা পেছন না ফিরেই বলে,,
– ছাড়ুন, মানুষ দেখছে
– দেখুক, এই ডোন্ট কেয়ার !
এই পর্যায়ে তামীমের শক্ত কন্ঠস্বর, হুট করে তামীমের এমন শক্ত কন্ঠ শুনে সোহানা খানিকটা ভয় পেলো কারণ তামিম সাধারণত মিষ্টি, শান্ত ভাষায় কথা বলে, তবে রেগে গেলে এমন কঠিন হয় তামীমের কন্ঠ, কঠিন হয় তাকে শান্ত করা। সোহানা মোচড়ামুচড়ি থামিয়ে চুপচাপ অভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে, তানিমের আড়ালে শুকনো ঢোক গিলে, সে তো শুধু দেখতে চেয়ে ছিলো তামিম কীভাবে তার রাগ, অভিমান ভাঙায় এখন তো উল্টো তামিম নিজেই রেগে বম হয়ে যাচ্ছে!তখনই পেছন থেকে হাতে টান পড়ে শান্ত অথচ গম্ভীর সরে তানিম বলে,,
–বস, কথা আছে,, পালাচ্ছিস কেনো খেয়ে ফেলবো নাকি তোকে,,
তামীমের এহেন কথায় সোহানা কিছুটা লজ্জা পায়, তামিমের গলার সুরটা যেন আজ অন্যরকম, সোহানা তামীমের দিকে আর তাকায় না কিছু বলেও না,চুপচাপ
তামীমের পাশে বসে পড়ে , মুখ ফিরিয়ে রাখলেও ভেতরে যেনো তার এক ধরণের উথালপাতাল শুরু হয়ে গেছে,,
– ফোন কোথায় তোর? ঠিক কত গুলো কল আর এসএমএস তোর ফোনে গেছে ধারণা আছে তোর?
সোহানা নিশ্চুপ, তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তামিম নিজেই যেনো নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলো,,
– অবশ্য জানবিই বা কি করে? তুই তো আমাকে ব্লক করে রেখেছিস তাই না? সোহানা জলে চিকচিক করা দু চোখ নিয়ে তানিমের দিকে তাকাতেই তামিম মলিন হাসলো, নরম হয়ে এলো তামিমের শক্ত কণ্ঠস্বর,,
– জানিস? এই কয়দিন তুই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিস,ব্লক করে রেখেছিস ,,,আমি,, আমি যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না,,
তোর একটা অভিমানের সামনে যেনো আমি পুরো পাগল হয়ে গেলাম সোহানা!
জানিস, এই ক’দিনে আমি নিজেকে শতবার প্রশ্ন করেছি,, সেদিন আমি কি খুব বেশি রেগে গিয়েছিলাম? খুব বেশি কষ্ট কি দিয়েছিলাম তোকে?
তামীম থামল এক মুহূর্ত, তারপর আস্তে করে বলল,
– তুই কি জানিস , সারাদিনে ঠিক কতবার ভাবি তোকে?
সোহানা এবারও কিছু বলল না। তামীম এবার আস্তে করে সোহানার ধরে থাকা হাত টা খানিক টা উপরে তুলে ধরে হাতের দৃঢ় বন্ধনের দিকে দৃষ্টি ঘুড়িয়ে সোহানার চোখে চোখ রেখে বলে ,,,
– আর জ্বালাস না সোহা,,প্লিজ, আর এমন করে দূরে সরে যাস না,, আমি যে তোর অভিমান টানতে পারি না, হয়তো রাগের মাথায় একটু ধমকে দিয়েছিলাম তাই বলে কি আমার এতো বড় শাস্তি পাওয়ার কথা?
সোহানা তড়িঘড়ি করে চোখ ঘুড়িয়ে নেয়,, তামিম যেনো তাও ওর চোখের ভাষা বুঝে নিয়েছে ঠোঁটে খেলে গেল তানিমের হাসির ঝিলিক, মূহুর্তেই যেনো তামিম তার চিরো পরিচিত রূপে গেলো দুষ্টু হেসে ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে গেয়ে উঠলো,,
– লক্ষী সোনা রাগ করো না, একটু হাসো প্লিজ।
-ভাল্লাগে না, আর হবে না, করছি যে প্রমিস!
তামীমের কান্ড না চাইতেও সোহানা হেসে ফেলে,, তানিমের চোখ থেকে মুখ ফিরিয়ে চোখ মুছে নেয়, আহাল্লাদি কণ্ঠে বলে,
– এইবারই কিন্তু শেষ, এর পড় ও যদি আবার কষ্ট দিয়েছেন, পরের বার আর রাগ করব না…সোজা চলে যাব ,,
– সোজা চলে যাবি আমার রুমে বাকিটা পড়ে দেখা যাবে,কি তাই তো?
চোখ মেরে বলল তামিম, ইঙ্গিত ভুজে লজ্জায় সোহানা হাসফাঁস করে উঠলো তামিমের কাঁধে জড়ছে মেরে দু হাতে মুখ ঢেকে ঘুরে বসলো,,তামিম একটু এগিয়ে গিয়ে ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– খুব জলদি ঐ মুখ দুহাতের বদলে আমার বুকে লুকানোর ব্যবস্থা করছি, প্রাণপ্রিয়া!
———–
সন্ধ্যার জমকালো আলোয় ধানমন্ডি লেকের এক বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের এককোণে দাঁড়িয়ে দুরের বেঞ্চে বসে থাকা তামিম আর সোহানার উপর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে হিয়া আর সোহান,, এর মাঝেই ঝোপের আড়ালে থাকা মশারা সোহানের পায়ে কামরাতেই,, সোহান খুব সুন্দর ভাষায় একদম খাঁটি বাংলা ভাষায় একখ্যান গালি দিলো, হিয়া বিরক্ত হয়ে তাকালো ঝাঁঝালো গলায় বলল,,
– মুখের ভাষা ঠিক কর শালা ফালতু,,সোহা ঠিকই বলে,, তোর মুখের ভাষা একদম নাউজুবিল্লাহ,,
– আর তুমার চরিত্র একদম নাউজুবিল্লাহ বান্ধুপি ,,
– কিসব যা তা বলছিস?
হিয়া ঝাড়ি দিতেই সোহান ভাব নিয়ে বলল,,
– একদম ঠিকই বলছি, কারো যোগ্য সম্মানীয় বানী যদি খাঁটি মাতৃভাষায় তাকে বলাতে, আমার মুখের ভাষা নাউজুবিল্লাহ হয়,তাহলে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে বড় ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের রোমান্টিক, সিনেমাটিক সিন দেখার দায়ে তুমার চরিত্র ও একদম নাউজুবিল্লাহ, তুমি নিজে তো দেখছ দেখছ সাথে একেবারে জামাই দেবর ফুল ফেমিলি সহ দেখছ,
সোহানের কথায় যেনো হুস ফিরে হিয়ার, নিজের কথা টা নিজের মাথায় খেলে যেতেই হুস ফিরল সোহানেরও চোখ বড় বড় তাকালো তারা একে অপরের দিকে,, সোহান নিজের বাঁ হাত তুলে গলার সামনে নিয়ে দিলো এক টান, ইশারায় বুঝালো,, আজকে তারা শেষ ! হিয়া ও সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো,, পড় পড়ই দুজন একসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো দৃষ্টি গিয়ে পড়ল,, তাদের থেকে একটু দূরে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীর সামীহ শিকদারের উপর!
সামী কে এমন শান্ত দেখে হিয়া মনে মনে ভাবে,, সামীর এই শান্ত থাকা টা কি ঝড় আসার পূর্বাভাস? নাকি অন্যকিছু?
#চলবে,,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২৩, প্রথমাংশ)
মাথা নিচু করে বসে আছে সোহানা ঘোলা চোখে তাঁকিয়ে আছে নিচের দিকে, তার পাশেই ভাবলেস ভঙ্গিতে গাঁ এলিয়ে বসে আছে তামিম, সামনে তাদের সামীহ শিকদার দাঁড়িয়ে আছে একেবারে নির্বাকভাবে। ওর কপালের শিরাগুলো টনটন করছে রাগে। চোখ দুটো লালচে সেই ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে সোহানা টের পেলো বুকের ভেতর যেন কেউ গলা চেপে ধরছে,শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এদিকে হিয়া এতো চাপ আবার নিতে পারে না সে সোহানের দিকে একটু ঝুঁকে ধীর গলায় বলে,,
– ঝড় যে একটা হবে বেশ বুঝতে পারছি তবে,, এমন দম মেরে না দাঁড়িয়ে থেকে যা বলার বললেই তো পারে, এমন পারমাণবিক বোমার রূপ নিয়ে থম মেরে দাড়িয়ে থেকে ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়? মনটা যা চাচ্ছে না,,,
– আল্লাহর ওয়াস্তে তোর মুখটা একটু বন্ধ রাখ, চিনোছ না তোর জামাইরে? পড়ে দেখা যাবে ওদের রেখে আমাগো উপর ব্লাস্ট হবে,
সোহানের কথা শুনে হিয়া শুকনো দুটো ঢোক গিললো চাইলো তার প্রাণপ্রিয় শিকদার সাহেবের দিকে,সামীর শান্ত মুখ দেখে হিয়ার মনে একটা অদ্ভুত শঙ্কা জাগলো। সোহান আর হিয়া তাকালো একে অপরের দিকে,, সোহান আবারও নিজের বাঁ হাত তুলে গলার সামনে নিয়ে দিলো এক টান, ইশারায় বুঝালো,, আজকে তারা শেষ ! হিয়া ও সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো,, পড় পড়ই দুজন একসাথে আবারও সামনের দিক তাকালো ,,
সামী কে এমন শান্ত দেখে হিয়া মনে মনে ভাবে,, সামীর এই শান্ত থাকা টা কি ঝড় আসার পূর্বাভাস? নাকি অন্যকিছু? তখনই কানে আসে চির পরিচিত সেই গম্ভীর কণ্ঠ,,
– তাহলে এই হচ্ছে আমার বন্ধুত্বের দাম? আমার বিশ্বাসের ফলাফল?”
সোহানা ভয়ে পেয়ে তামিমের কাছ থেকে একটু দূরে সরে বসে,, তামিম তা দেখে সোহানার পাশ ঘেষে বসে ওর কাঁধে হাত রেখে পায়ের উপর পা তুলে বসে,, হিয়া আর সোহান দুজনে নির্বাক দর্শক, তারা চুপচাপ একটু দূরে দাড়িয়ে আছে,
সামী তখন হঠাৎ তামিমের কলার চেপে ধরে বলে,
— কথা বলছিস না কেন?বল, আমার বোনকে নিয়ে এই নাটকটা কত দিন ধরে চলছে?
তানিম ওভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হেঁসে বলে,,
— নাটক কই দেখলি ভাই? আমি তোর বোনকে ঠকাইনি, ভালোবাসার নাম করে ইউজ করি নি, ভালোবেসেছি, শুনেছিস তুই?সত্যি ভালোবেসেছি!
সামীর চোখে রাগ আর অভিমানের মিশেল, অথচ তামিমের মুখে তখনও সেই আত্মবিশ্বাসী হাসি লেগে রয়েছে , তামিম শতভাগ নিশ্চিত সামী আর যাই হোক তার প্রেমের বারোটা বাজাবে না, এখন একটু নাটক অবশ্য করবে তা ভেবে তামিম আরও মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে সামীর দিকে তাঁকিয়ে ছোটো বাচ্চাদের মত পলক জাপটাচ্ছে, যা সামীর রাগে ঘি ঢালছে। সামী কে আরো রেগে যেতে দেখে তামিম গাঁ দুলিয়ে হেসে সামিকে জাপ্টে ধরে বলল,,
– তোর মনে হয় আমি তোর বোনকে ঠকাবো? তুই আমাকে চিনিস না? নাটক করার হোলে তোর বোনের রাগ ভাঙ্গাতে এসে তোকে সাথে নিয়ে আসবো কেন? আমার কি পেছনে মরার পাখনাগজাইছে নাকি? তোর বোনের সাথে উল্টা পাল্টা কিছু করলে তুই আমার কি করবি তাকি আমি জানি না নাকি? তোরে তো নিয়া আসছি কেনো জানিস? তোকে জানাতে যে এতো দিন আমি আমার বোন আর তোর পাহাদার ছিলাম এখন থেকে তুই হবি আমাদের পাহারাদার, বাই দ্যা ওয়ে তোর বোন কে বিয়ে দিবি? একেবারে মীর বাড়ির রাজরানী বানিয়ে রাখবো,! একটা ফুলে ফুলে সাজানো সংসার দিবো,, মাঝে মাঝে সিনেমাটিক ঝগড়া করবো, আবার মিষ্টি করে মান ভাঙাবো,, আর,,
তামিম কে শেষ করতে না দিয়ে সামী তামিম কে ছড়িয়ে বলল,,
– আমার বোন এখনো ছোটো তাই ওর বিয়ের বিষয়ে এখন ভাবছি না সরি, যা দূরে সর,,
সামীর কন্ঠ শুনেই বুঝা গেল তাঁর রাগ গলে ঝোল হয়ে গেছে,, তা দেখে হিয়া সোহানের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙিয়ে চোখ উল্টিয়ে সামীর মতো করে বলে,,
– আমাল বোন এখনো ছুট তাই ওর বিয়ের বিছয়ে এখন বাবছি না সলি ,,যা দূরে সর,, বেটা ভন্ডর ভন্ড হুদাই এতক্ষণ ভয় দেখিয়ে কিডনি কাপিয়ে ফেলছিল,, আবার বলে বোন তাঁর ছোট !তার বোন ছোটো আর অন্যের বোন বুঝি বুড়ি হয়ে গেছে? নিজে যেঅন্যের বোন কে কিডন্যাপ করে বিয়ে করলো তাঁর বেলায় কিছু না? তখনই হিয়া সোহানকে টেনে নিয়ে সামীর সামনে দাড়িয়ে কোমরে দু হাত রেখে বলল,,
– অপনার বোন ছোটো?
– হ্যাঁ, আর তোর ভাই বুড়ো এতো বয়স্ক ছেলের কাছে আমি আমার বোন বিয়ে দিব না?
সামীর কথায় তামিম তেড়ে গিয়ে বলল,,
– ওমনি! ওমনি না রে শালার ভাই সম্মন্ধি? পাল্টি খেলি?আমি বয়স্ক হলে তুই কি? তোর বোন ছোটো হলে আমার বোনকি বুড়ী নাকি? তুই যদি তোর বোনকে না দিস তাহলে আমিও আমার বোনকে তোর হাতে দিবো না,
তামীমের কথায় হিয়াও সুর মেলায় গাল ফুলিয়ে মুখ ভেঙ্গীয়ে বলে,,
– ঠিক একদম ঠিক,, আমারও এমন বুড়ো জামাই লাগবে না,
সামী হিয়ার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনে বলে,,
– তোর না লাগলেও আমার লাগবে,, আমার বউ লাগবে,, তাছাড়া তুই আমার বিয়ে করা বউ এখন কেউ মানলে মানুক না মানলে নাই ,, আই ডোন্ট কেয়ার,,
তানিম ও দ্রুত সোহানার কাছে গেলো সামী যেভাবে হিয়া কে কাঁধ জড়িয়ে ধরে আছে ঠিক ওভাবেই ধরে সামীর দিকে তাঁকিয়ে হেসে বলল,,
– হয়তো কবুল বলা এখনো বাকি, তবে সমস্যা নেই খুব জলদি বলে ফেলব,, কেও হয়তো বিয়ে করে এখন বড়ো গলায় আমার বউ, আমার বউ করছে, সে হয়তো ভুলে গেছে সেও একদিন আমার বোনের জন্য আমার ঠেং হাত ধরে কান্না কাটি করেছিল, আমি নেহাত ভালো মানুষ বলে সেধে সেধে বোন কে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে এসেছি, এখন যদি সে আমার সাথে দুশমনি করে তবে সে ও শুনে রাখুক যদি বন্ধুর জন্য নিজের বোনকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিতে পারি তবে আমার বউ কেও আমি নিজেই তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারবো,আমিও দেখবো কে আমাকে ঠেকায়, যে মানার মানবে না মানলে না নাই অমিও আই ডোন্ট কেয়ার,,
তামীমের কথা শুনে হিয়া সামীর দিকে তাকায় ,,না সামীর চোখে আর রাগ তাপ নেই, হিয়া সামির হাতের মধ্যে বন্দী থেকেই চেঁচিয়ে বলে,,
– আটকাবে মানে যে আটকাবে তাকে একদম বিপত্নী বানিয়ে দিবো,,
সামী ভ্রূ কুচকে মুখ নিচু করে তাকাতেই হিয়া মিনমিন করে বলে,,
– এভাবে তাকান কেন?আপনাকে এমন রূপে দেখলে তো আমার খুব ভয় লাগে,, এমন করছেন কেনো? আমার ভাই কি কোনো দিক থেকে খারাপ নাকি? নাকি নিকম্মা? মানছি একটু তারছিরা তবে আপনার ই তো বন্ধু মেনে নিন প্লিজ,, আমার জন্য,,
হিয়ার নাটক দেখে সোহান নিজে নিজেই আওরালো,,
– জামাই বউ দুটোই নাটকবাজ,
তখনই সামী হিয়ার দিকে শীতল চোখে তাকায়,, মুখে এখনো ঠাণ্ডা ভাব,, সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তামিমের দিকে তাকিয়ে বলে ,,
– শুধু আর শুধু মাত্র আমার বোন আর বউয়ের জন্য যা তোকে বোন জামাই হিসেবে মেনে নিলাম,, তোকে মানার সব থেকে বড় দুটি কারণ হলো এক আমার বোন ও তোকে ভালোবাসে আর দ্বিতীয় কারণ আমার বউ ও তোকে ভালোবাসে আর দুর্ভাগ্যবসত আমি ও তাকে অনেক ভালবাসি,তোর প্রেমে বাধা পড়লে সে কষ্ট পাবে আর আমার বউ কষ্ট পেলে আমি একদম ঠিক থাকবো না,তবে একটা কথা শুনে রাখ ,, এতক্ষণ তো এত বড় বড় কথা বললি, তবে তুই শুনে রাখ যদি ওকে সত্যি ভালোবাসিস, তাহলে আমি তোর পক্ষে তোর পাশে আছি কিন্ত,,,, যদি কখনো ওর চোখে তোর জন্য কষ্ট দেখি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না,,
তামিম এবার আর মুখ খোলে না, সামীর চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়ে। তাঁর চোখে যেনো ভেসে উঠলো আরো প্রায় আট থেকে নয় বছর আগের সেই একই দৃশ্য, একই সংলাপ ,,সেদিন সামীর জায়গায় কঠোর মানবের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো তামিম আর নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য দরখাস্ত দিয়েছিল সামীহ শিকদার নিজে,, সে দিন তানিম বন্ধু বলে সামী কে ছাড় দেয় নি, প্রাণ প্রিয় বন্ধু বলে ও সেদিন তামিম একবাক্যে নিজের একমাত্র বোনের হাত দেয় নি তামিম পরীক্ষা নিয়েছিল সামীর ভালোবাসার কঠোর পরীক্ষা নিয়েছে ,, সে দিন তামিম ও এই একই কথা বলেছিলো,,
– যদি ওকে সত্যি ভালোবাসিস, তাহলে আমি তোর পক্ষে তোর পাশে আছি কিন্ত,,,, যদি কখনো ওর চোখে তোর জন্য কষ্ট দেখি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না,,
সেই দিনের কথা মনে হতেই তামিম সোহানার হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে। সামীর ধীকে চোখে চোখ রেখে ইশারায় যেনো কিছু কথা বলল,,
সামী তার চোখে যেনো তখন সেই আস্থা, মায়া, আর একরাশ ভালোবাসা তার বোনের জন্য দেখলো যা বহু বছর পূর্বে তার চোখে তামিম খুঁজে নিয়েছিল।

#চলবে,,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২৩,দ্বিতীয়াংশ)
সকালটা ছিল একেবারে শান্ত আর সুন্দর। মাঝ বসন্তের সকাল। চারদিকে সবে দিনের আলো ফুটে হালকা মিষ্টি রোদে স্নিগ্ধ হচ্ছে। গাছে গাছে কচি পাতার ফাঁকে নাম জানা অজানা শত পাখির ঝাঁক, হালকা বাতাসে গাছের পাতাগুলো দুলছে, যেন প্রকৃতি নিজেই ঝিরঝির করে গান গাইছে। শিকদার নিবাসের ড্রইং রুমের দক্ষিণ পাশ টা বড় বড় থাইয়ে ঘেরা এই পাশটায় দেওয়াল নেই, থাইয়ের বন্ধ দরজাগুলো খুলে দিতেই বসন্তের সেই মন ভোলানোহাওয়া ছুঁয়ে গেল সোহানার গাঁ, সে চোখ তুলে তাকালো সামনে, সামনের জায়গা টা মূলত শিকদার নিবাসের পেছন দিক, উওর দিকে মুখ তুলে দাড়িয়ে আছে শিকদার নিবাস, আর দক্ষিণ হলো তার পেছনের অংশ, বাড়ির সামনের দিকে সৌন্দর্যে জন্য কিছু সংখ্যক গাছগাছালি থাকলেও, শিকদার নিবাসের বাগান মূলত বাড়ীর পেছনে এই দক্ষিণে, এই বাগানের উপরে ই দোতলায় একে একে তাদের তিন ভাই বোনের ঘর গুলো, সামীর নির্দেশেই এমন করে বাগান করা যাতে করে তারা বারান্দায় বসেই বাগানবিলাস করতে পারে , আর নিচে ড্রয়িং রুমে বসে সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পারে, সেই অনুযায়ীই শিকদার নিবাসের ফুলের বাগান হলো এই বাড়ীর পেছনের পুরো অংশ জুড়ে, সোহানা ধীর পায়ে নেমে এগিয়ে যায় বাগানের দিকে, নতুন একটা বেলি ফুলের গাছ লাগিয়েছে সে ঐটা দেখেই ফিরে আসে,, আগে হলে সোহানা এই ফুলেদের সাথে একটু সময় কাটিয়ে তবে ঘরে ফিরত তবে সামনে পরীক্ষার চিন্তা হতেই সে দ্রুত ফিরে গিয়ে বসলো ডাবল সোফার উপর, পাশের এক সিঙ্গেল সোফায় জাহানারা বেগম তসবিহ হাতে বসে ঝিমুচ্ছে,,সোহান সাইড টেবিল থেকে তুলে নিলো প্রাণীবিদ্যা বইটি, সেই ফাঁকে জাহানারা বেগম কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দুষ্টুমি করে বলল,,
– ঘরে গিয়ে ঘুম দাও বুড়ি, যে ভাবে দুলছ একবার পড়লে সোজা দাদাজানের কাছে, সোহানের কোলে ওঠার আর সুযোগ নেই!
জাহানারা বেগম সব ধরনের রসিকতা সহ্য করতে পারলেও এই একটা জিনিসেই তিনি ক্ষেপে যান, আর বেছে বেছে সোহান আর সোহানা ও তাকে বুড়ি বলেই খেপায়, একে তো সবে চোখ আবার লেগে গিয়েছিলো সেই কাঁচা ঘুম থেকে খুঁচিয়ে তুলল তাঁর উপর বুড়ি ও বলল!যার ফলস্বরূপ এখনও জাহানারা বেগম ক্ষেপে গেলেন ,এক আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলেন,,
– বুড়ি হবি তুই আর তোর বাপ, তোরে কইলো কেঠা আমি বুড়ি? বলেই জাহানারা বেগম উঠে যেতে যেতে বলে,,
– ভাবছিলাম মাইয়্যা ডা ভালো হইবো এখন দেখি এইডা আরো বড় মিচকা শয়তান,,
জাহানারা বেগমের কথায় সোহানা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে,,ঠিক তখনই ড্রয়িংরুমে রাখা শাহানা শিকদারের ফোনটা বেজে ওঠে। উনি তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত,সকালের নাস্তার জন্য কাজ করছেন রান্না ঘরে,তাই সোহানা ফোনটা ধরল স্ক্রিনে লেখা,, বড়ভাই,, এতো সকালে বড় মামার কল দেখে সোহানা ঘাবড়ে যায়,, দ্রুত রিসিভ করে,,
– হ্যালো, মামা?

ওপাশ থেকে শোনায় পরিচিত কণ্ঠ, সিলেট থেকে ফোন এসেছে শাহানা শিকদারের বড়ভাই সৈয়দ আশরাফ। তিনি জানালেন, শাহানার বাবা সৈয়দ আমজাদ আলী মানে সামীর নানাভাই গতরাতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সেই মাঝ রাতেই তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে,কিন্তু বোনকে চিন্তা দেবেন না বলে ওতো রাতে তারা জানাননি। তবে জ্ঞান ফেরার পর থেকে তিনি বারবার মেয়েকে দেখতে চাইছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব সবাইকে নিয়ে সিলেট যাওয়ার জন্য বলেছেন।ফোন রেখে সোহানার চোখে পানি চলে এলো। সে ছুটে গেল শাহানা শিকদারের কাছে খবর দিতে। একটু আগে রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকা শাহানা শিকদার তখনো ডিম পোচটা উল্টে দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় সোহানা তাড়াহুড়া করে ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। চোখে পানি, মুখটা শুকিয়ে গেছে। শাহানা শিকদার একঝলকে তাকিয়েই বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে। সোহানা ছুটে এসে বলে উঠলো,
– আম্মু, ফোন আসছিল সিলেট থেকে বড় মামা,,নানা ভাই অনেক অসুস্থ,,
শাহানা শিকদার থমকে গেলেন। হাতে থাকা চামচটা খসে পড়ল নিচে, কাপা কাপা কন্ঠে বলল
– কী বললি? আব্বা অসুস্থ?
সোহানা এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরে বলল,
– গতরাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হসপিটালে নিতে হয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে বারবার তোমাকে দেখতে চাইছেন,, মামারা বলছে, যতদ্রুত রওনা দিতে
শাহানা শিকদার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না,মুহূর্তেই ভেঙে পড়লো। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
কান্নার শব্দে ছুটে এল সামী, সোহান, জসীম শিকদার আর জাহানারা বেগম। সোহানার কাছে সবটা শুনে সবাইকে নিয়ে দ্রুত পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করল সামী। মাকে ধরে বসিয়ে পানি এনে দিলো, মায়ের কাছে সোহান আর সোহানাকে অন্যপাশে বাবার সাথে আলোচনা করল রওনা দেওয়ার ব্যাপারে। ঠিক হলো আজকেই সবাই মিলে সিলেট রওনা হবে। যেহেতু এমন হুট করেই জসীম শিকদার তার রুগী, ক্লাস রেখে যেতে পারবেন না,, আর সামী ও দেশে আসার পর এখনো নানুর বাড়ী যায়নি তাই ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সামীই সোহান,সোহানা আর শাহানা শিকদার কে নিয়ে বেড়িয়ে যাবে,, আর জসীম শিকদার জাহানারা বেগম কে নিয়ে ধানমন্ডি বোনের বাসায় চলে যাবেন। শাহানা শিকদার তখনও কান্না থামাতে পারেননি, বারবারই চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে ফেলছিলেন। মনের ভেতরে গুমোট একটা যন্ত্রণা জমে আছে,সেই মানুষটার কথা ভেবে, যিনি তার শৈশব, কৈশোর, আর বর্তমানের প্রতিটি অনুভূতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন,,তার বাবা।
সামী, সোহান আর সোহানা একে একে ঘরে ঢুকতেই শাহানা শিকদার ধরা গলায় বললেন,
– বাবাকে দেখতে যেতে চাই আমি সামী, আজই ,, এখনই।
সামী মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও কিছু বলেনি, শুধু মাথা নেড়ে বলেছে,
– যাবো আম্মু,,আজকেই যাচ্ছি আমরা।
চোখের জল মুছতে মুছতে শাহানা শিকদার রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাজ গুলো গোছানোর জন্য, কিন্তু সামী মাকে হাত ধরে থামাল,
– কিছু করতে হবে না, তুমি শুধু রেডি হও। আমি সব ম্যানেজ করছি।
শাহানা শিকদার মাথা নাড়লেন। সোহানা পাশে গিয়ে ওনার ওড়না ঠিক করে দিলো, বলল,
– চলো আম্মু, আমরা ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি।
সবাই যখন যার যার ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ সামীর ঘরে এলো শাহানা শিকদার, তাকে দেখে সামী এগিয়ে এসে ওনাকে ধরে বসলো বেডের উপর, নিজে হাঁটু গেঁড়ে বসলো মায়ের সামনে, ডান হাত তুলে মুছে দিলো গড়িয়ে পড়া চোখের জল, নরম কন্ঠে বলল,,
– চিন্তা করো না নানাভাই একদম ঠিক হয়ে যাবে , আগের থেকে এখন ভালো আছে ছোটো মামার সাথে আমার কথা হয়েছে, আমরা পৌঁছানোর আগেই নানাভাই কে বাড়ীতে নিয়ে আসা হবে,, আর তোমাকে দেখলেই দেখবে একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, দেখো তুমি মিলিয়ে নিয় আমার কথা ! তোমার ব্যাগ গোছানো শেষ?
শাহানা শিকদার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন,,সামী বুঝলো শাহানা শিকদার কিছু বলতে চান তাই মাকে সুধালো ,,
– কিছু বলবে?
– হিয়া কেও আমাদের সাথে নিয়ে চল সামী,, বিয়ে তো হয়েই গেছে তাহলে আগে সবাইকে বললে সমস্যা কি? আল্লাহ না করুক আব্বার কিছু একটা হয়ে গেলে আমার আজীবন আফসোস থেকে যাবে, তুই তো জানিস আব্বার কত সখ তোর বিয়ে দেখার তোর বউ দেখার !
বিয়ে টা যেহেতু তুলে নিয়ে গিয়ে করেছে তাই সামী চাচ্ছিল না এখনই সবাই কে বিয়ের ব্যাপারে জানাতে,, সে চেয়েছিল হিয়ার পরীক্ষা শেষ হোলে একেবারে ধুমধাম করে হিয়া কে তুলে এনে সবাই কে জানাতে,, তবে মায়ের কথায় সামী একটু ভাবলো ,, পরপরই বলল,,
– মামুনি কে কল করে হিয়া কে তৈরি হয়ে থাকতে বলো আম্মু,, আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আমরা সবাই রওনা হবো,,
বলেই সামী নিজের পোষাক নিয়ে চলে গেলো তৈরি হতে।
#চলবে,,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২৪)
ঢাকা শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে সামীর ব্লাক বিএমডব্লিউ গাড়িটা ছুটে চলেছে সিলেটের দিকে। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালে একসময় হাইওয়ের পাশের দালানগুলো সরে গিয়ে জায়গা নিচ্ছে ধানখেত, সরু কাঁচা রাস্তা, দূরে পাহাড়ের রেখা আর সবুজে মোড়ানো চা বাগান। দুপুরের পড়ন্ত রোদে যেন একটানা সবুজের ক্যানভাসে কেউ হালকা রোদ ছুঁয়ে দিয়েছে।
গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে সামী, তার পাশের সিটে বসে সোহান গুগলম্যাপ দেখে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে, ব্যাকসিটে বসে সোহানা আর হিয়া হালকা গল্পে ব্যস্ত শাহানা শিকদারের সাথে যাতে করে তার মনটা ভালো হয়ে যায় তবে অনেক চেষ্টার পরও যখন কাজ হলো না তখন ওরাও চুপ করে গেলো, সোহানার লং জার্নি সহ্য হয়না বিধায় শাহানা শিকদারের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে নেয়, এক পর্যায়ে ঘুমিয়েও যায়, মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শাহানা শিকদার চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখে একরাশ শঙ্কা, পাশে বসা হিয়া কিছুটা গম্ভীর, তার প্রথম সিলেট যাত্রা, তাও সামীর পরিবারের সঙ্গে, সামীর বউ হয়ে। হিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর্চোখে একবার তাকায় ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা সামীর দিকে ঠিক তখনই সামী ও লুকিং গ্লাসে চোখ তুলে তাকায় চোখাচোখি হয় দুজনের সামী ঠোঁট কামড়ে হাসে হিয়া সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে জানালার বাহিরের দিকে তাকায়, গাড়ির ডান পাশে জানালার পাশে বসে আছে হিয়া, চোখ তার বাইরের দিকে, অথচ মন গভীর অভিমানে আটকে আছে। আজ চারদিন হয়ে গেল, সে সামীর সাথে একটা কথাও বলেনি, সে রেগে আছে সামীর উপর কারণ হিয়ার বিয়ের প্রায় তিন মাস হোতে চলল অথচ সামী তাকে এখনো কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় নি, আর না ঠিক মত সময় দেয় শুধু রোজ নিয়ম করে সকাল আর রাতে ফোন করে ভালো আছে কিনা, খেয়েছে কিনা তার খবর নিয়ে প্রকাণ্ড এক ধমক দিয়ে পড়তে বসতে বলে কল কেটে দেয়, তাতেই যেনো সপ্তদোষীর মনে অভিমানের পাহাড় জমে তাই সেদিন রাতে রেগে সামী কে বলে,,

– আপনি আমাকে কখনোই ভালোবাসেন নি শিকদার সাহেব , আমার বান্ধবীদের বিএফ দের দেখি তাদের কত ভালোবাসে তাকে কত জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায় তাদেরকে নিয়ে ফুচকা খায়, সারাদিন কত গল্প করে, ফোন কলে কত কথা বলে, আর আপনি আমার স্বামী হয়েও আপনার দেখা পাই না ঘুরা তো দুর আপনি শুধু কল করে খোঁজ নিয়ে দায় সারেন ,আর শুধু ধমক দেন। ভালোবাসার কথা বলবেন তো দুর আমাকে ধমকে পড়তে বসতে বলেন আপনি ভালো না আমি আর অপনার সাথে কথা বলব না ,,

বলেই খট করে কল কেটে দেয়।ব্যাস তারপর থেকে হিয়া আজ ৪ দিন সামীর সাথে কথা বলে না, কল রিসিভ করে না, এসএমএস দিলে এসএমএস সিন করে না,,সকালে যখন হিয়া মায়ের কাছে শুনল সামী আসছে নিয়ে যেতে তখন একবার ভেবেছিল যাবে না, মুখ ও দেখবে না সে ঐ খারাপ লোকের । কিন্তু পড়ে যখন সোহানা আর সোহান কল করে সব খুলে বলে,আর তাকে বোঝায় তারপর রাজি হয় আসার জন্য ,, কিন্তু এখন পর্যন্ত হিয়া সামীর সাথে একটা কথা বলে নি, মাঝ রাস্তায় সামী যখন গাড়ি থামায় হলকা কিছু খাবার খাওয়ার জন্য , তাকে নামতে বললে তখনও হিয়া চুপ করে মুখ ঘুড়িয়ে বসে থাকে, সামী সরে দাঁড়ালে সোহানকে দিয়ে খাবার আনিয়ে শাহানা শিকদারের সাথে গাড়িতে বসেই খেয়েছে গাড়ী থেকে নামেনি পর্যন্ত ।

এতো কিছু ভাবনার মাঝে গাড়ি যখন মৌলভীবাজারের দিকে ঢুকছে, তখন চা বাগানের ঘন সবুজ ছায়া যেন গাড়ির ছায়াকে গিলে ফেলছে, কি নিদারুণ সুন্দর সেই পড়ন্ত বিকেলের পাহাড়ী দৃশ্য, হিয়ার চোখ যেনো খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো,, মনের যত রাগ অভিমান ক্লান্তি ছিলো এই দৃশ্যের সামনে যেনো সব ফিকে হয়ে গেল, মূহুর্তেই হিয়া উচ্ছসিত হয়ে গেলো ঘার ঘুড়িয়ে প্রফুল্লচিত্তে ঝাঁকিয়ে তুলল সোহানাকে, যদিও সোহানার এসব রাস্তা অনেক আগে থেকে দেখা তবুও কয়েক বছর পর আবারও চোখের সামনে প্রকৃতির এমন রূপ দেখে দুই সখী আনন্দ পেল। সোহানা হিয়ার সাথে ঝুঁকে আঙ্গুল দিয়ে তাক করে দেখাতে লাগলো সবটা, তখনই হালকা কুয়াশায় মোড়া সরু পথে সামীর ড্রাইভ করা গাড়ি ঢুকে পড়ল পাহাড়ঘেরা এক সুনসান অঞ্চলে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, স্নিগ্ধ সবুজের বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক পুরনো বাড়ি,সৈয়দবাড়ী। সামীর নানাবাড়ি, সোহানা বাড়ির গেইট দুর থেকে দেখেই চিৎকার করে উঠলো,,
– ঐ দেখ হিয়া এসেগেছি,
হিয়া সোহানার ইশারা অনুয়ায়ী তাকালো তখনই বাগানের ভেতর দিয়ে যাওয়া লাল মাটির রাস্তা ধরে গাড়িটি সৈয়দবাড়ির মূল ফটকে এসে দাঁড়ায়।গাড়ি থামতেই দূর থেকে বাড়ির কিছু লোক দৌড়ে আসে। এক বৃদ্ধ দারোয়ান সামনে এসে দরজা খোলে,, সামী দেখে চিন্তে না পারায় চোখে বিস্ময় আর চিন্তার রেখা নিয়ে তাঁকিয়ে, তখনই গাড়ী থেকে শাহানা শিকদার হুরমুড়িয়ে বের হোন , তিনি হতেই কেউ আর কিছু বলার সুযোগ পায় না, ওনি ছুটে ভেতরে চলে যান, যেতে যেতে ভাইদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,,মুখে
– আব্বা কেমন আছে?
বলেই তিনি ভাইদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যান। সমীদের চিন্তে পেরে দারোয়ান মূল ফটক খুলে দিল সামী গাড়ী নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ব্রেক করতেই একে একে সোহানা, সোহান আর হিয়া গাড়ি থেকে নামল। হিয়া অবাক চোখে সবটা দেখছে,দুইতলা চুন-সুড়কি দেয়া একটা দালান, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই অন্দর থেকে বেড়িয়ে আসলো দুজন মধ্যবয়স্ক মহিলা তাদের পেছন পেছন এলো তিনজন মেয়ে দেখে মনে হচ্ছে দুজন হিয়াদের ছোটো হবে আর একজন তাদের সমান তারা সামনে আসতেই মেয়েগুলো আপু বলে চিৎকার করে সোহানাকে জড়িয়ে ধরলো,, হিয়া অসস্তিতে একটু সাইডে দাঁড়ালো সোহানা হেসে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে মামীদের দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে বলল,,
– কেমন আছো মামি?
তাদের মধ্যে থেকে সোহানার বড় মামী সালমা বেগম এগিয়ে এলেন সোহানার কাছে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,
– আছি বুড়ি,, তুই কেমন আছিস?
তখনই সোহান গাড়ির ডিক্কি থেকে একটা ব্যাগ এনে রেখে বলে,,,
– আমিও যে এসেছি কেউ হয়তো দেখে নি, সোহানের কথা শুনে সোহানের ছোটো মামি রহিমা বেগম হেসে বলেন,,
– শুরু হয়ে গেছিস তাই না? তাদের কথার মাঝে তখনই হুট করেই অন্দর থেকে দৌড়ে আসলো একমেয়ে কিছু বুঝার আগেই গাড়ি থেকে ব্যাগ নামাতে বেস্ত থাকা সামিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো,, এই দৃশ্য দেখে মামী রা ভেতর চলে যান, বাচ্চাদের নিয়ে,হিয়ার যেনো দুনিয়া দুলে উঠল হিয়া যেনএক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল।
মেয়েটা সামীকে পেছন থেকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছে, যেনো তাদের সম্পর্ক বহু পুরনো, বহু চেনা! সামী প্রথমে একটু চমকে উঠে মূহুর্তেই ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখে মেজাজ গরম হয় তবুও সৌজন্য হেসে বলে উঠল,
– আরে রাইশা যে,বড় হয়ে গেছিস এখনো এমন জড়াজড়ির স্বভাব আছে দেখছি!

মেয়েটা সামীর সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে মুখে উচ্ছ্বাস, একটা খুশির ঝিলিক নিয়ে বলে,
– কেমন আছো ভাইয়া! হায় আল্লাহ কত দিন পর তোমাকে সামনে থেকে দেখলাম,,
উত্তরে সামী নিজের আর হিয়ার ব্যাগ গুলো নিয়ে যেতে যেতে শুধু বলল,,
– ভালো,
এই পুরো দৃশ্যটা দেখে হিয়ার বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক ধাক্কা লাগলো। কে এই মেয়ে? এমন করে জড়িয়ে ধরল সামীকে? বোন নাকি? হলেও বা এতো বড় মেয়ে কাজিন ব্রাদার কে জড়িয়ে ধরবে কেন?তার মনের মধ্যে প্রশ্নের ভিড় কিন্তু মুখে কিছু বলার শক্তি নেই। সে একপাশে দাঁড়িয়ে, চোখের কোণে কেমন যেনো ঝাপসা হয়ে আসে সব।
সোহানা দূর থেকে সবটা দেখে এবং বুঝে হিয়া যে ভালোই জেলাস হচ্ছে তাই সে হিয়ার পাশে এসে হিয়ার কাঁধে হাত রাখে।
– দেখলি ভাবি কি ফালতু মেয়ে টা ,ওর নাম রাইশা, ছোটো মামার বড় মেয়ে। ছোট থেকেই ভাইয়ার পেছনে পেছনে ঘুরতো। ভাইয়া ভাইয়া বলে পাগল ছিল। এখনো সেই রকমই আছে দেখলি না কেমন গাঁয়ের উপর ঢলে পড়লো? এইসব ফালতু মেয়ে থেকে আমার ভাইকে দূরে দূরে রাখিস, এবার চল ভেতরে চল,, সবাই ভেতরে চলে গেছে,
হিয়া কিছু বলে না। শুধু মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করে, সোহানার পেছন পেছন প্রবেশ করলো অন্দরে।

অন্দরে ঢুকতেই হিয়ার চোখ আটকে যায় আশেপাশের সাজসজ্জায়। বাইরে থেকে সৈয়দ বাড়ি যতটা দৃষ্টিনন্দন আর অভিজাত মনে হচ্ছিল, ভেতরে তার চেয়ে ঢের বেশি । লালচে রঙের পালিশ করা মেঝে, প্রতিটি ঘরের দেয়ালে নকশা করা কাঠের কাজ, ঘরের একপাশে পুরোনো স্টাইলের কাঠের বুকশেলফ, যাতে সাজানো অনেক পুরোনো বই সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর লাগলো এই বাড়িটা হিয়ার কাছে।
প্রতিটি ঘরের মাঝে প্রশস্ত বারান্দা, বারান্দার ধারে নকশা করা বেতের চেয়ার। দেয়ালে পুরোনো দিনের সাদাকালো ছবি, যেখানে সৈয়দ বংশের বিভিন্ন সদস্যদের গম্ভীর মুখচ্ছবি এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ঝুলে আছে।
সোহানার হাত ধরে হিয়া একে একে কয়েকটা ঘর পেরিয়ে পৌঁছায় বাড়ির একদম দক্ষিণ পাশে, একটা ঘরে। জানালার পাশে হাওয়ার খেলা, তাতে পর্দা গুলো একটু একটু করে নড়ছে। ঘরটায় একধরনের ওষুধের গন্ধ, এক পাশে মেডিকেল যন্ত্রপাতি, বিছানায় শুয়ে আছেন সৈয়দ আমজাদ আলী,সামীর নানাভাই। চোখ আধা বন্ধ আধা খালো বহু কষ্টে যে চোখ দুটো খুলে রেখেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মুখে তার দুর্বল হাসি।
বিছানার একপাশে বসে আছেন শাহানা শিকদার চোখে পানি, বাবার হাত ধরে বসে আছেন চুপচাপ।
হিয়ারা ঢুকতেই শাহানা চোখ তুলে তাকান, হালকা হাসেন। সোহান, সোহানা এগিয়ে গিয়ে সালাম করে। নানাভাই সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
তখনই ব্যাগগুলো রেখে ঘরে ঢোকে সামী, একপলকে দেখে নেয় সবাই ঠিক আছে কিনা, তারপর এগিয়ে যায় নানাভাইয়ের কাছে। এতো বছর পর সামীকে দেখে আমজাদ আলী যেনো উঠে বসতে চান, সামী মুচকি হেসে এগিয়ে যায় , নরম হাতে বুলিয়ে দেয় নানভাইয়ের মাথা, দুর্বল বোধনেও বৃদ্ধার কত কথা, শাহানা শিকদার, সৈয়দ আমজাদ আলীর একমাত্র মেয়ে আর সেই মেয়ের ঘরের প্রথম সন্তান সামী সেই হিসেবে সামী তার নানাভাইয়ের অনেক আদরের, নানা ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলার পর, হঠাৎ সে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সামী উঠে দাঁড়ায় দরজার সামনে গিয়ে আড়াল থেকে হিয়ার হাত ধরে টেনে নিজের পাশে নিয়ে দাঁড় করায়। দুষ্টু হেঁসে চঞ্চল কণ্ঠে বলে ওঠে,,
– হেই মিস্টার বুড়ো,দেখো তো কাকে নিয়ে এসেছি! মিট মাই লাভিং ওয়াইফ, মিসেস সামীহ শিকদার , তুমি তো হেরে যাচ্ছ ,তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড় তো দেখি,, বউ তো আমি নিয়ে এলাম কিন্তু তুমি আমার বউ কে পটাবে কি যেই ভাবে শুয়ে আছো দেখে তো মনে হচ্ছে নিজের বুড়ির কাছে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করছ!
ঘরের ভেতর হঠাৎ মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এতক্ষণে সবার নজর পড়ে হিয়ার উপর, ওরা আসার পর থেকে সব এতো দ্রুত হলো যে সবাই হিয়াকে খেয়ালই করেনি,শাহানা শিকদার অবাক হয়ে নিজের গম্ভীর ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কত প্রানবন্ধ লাগছে তার ছেলেকে,সোহানার মুখে চওড়া হাসি, সে কনুই দিয়ে সোহানকে খোঁচা দেয়,, সোহান ও হাসি মুখে তাকায় সোহানার দিকে ,,রাইশা তখন দোতলার সিঁড়ি থেকে নিচে তাকিয়ে সবটা শুনে যেনো জমে গেছে। ছোট মামি রহিমা বেগম বিস্মিত গলায় বলেন,,
– বউ ? মানে তোর বউ,তুই বিয়ে করলি কবে? কিভাবে?
ছোটো মামির এতো প্রশ্নে হিয়া তখন ভীষণ অপ্রস্তুত, লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে। গালদুটো তার নিমিষেই হয়ে যায় লাল।
সামী তখনো মুচকি হেসে বলে,
– সে না হয় পরে বলব ছোটো মামী। আপাতত জেনে রাখো (বলেই হিয়ার কাঁধে এক হাত দিয়ে ধরে) এই হচ্ছে আমার বউ আমায়রা মীর হিয়া।
সবটা শুনে নানাভাই দুর্বল হাত বাড়িয়ে হিয়াকে কাছে ডাকেন। হিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, তার গালে নানাভাই কাপা কাপা হাতে হাত রাখেন। দুর্বল কন্ঠে বলে,,
– এইডা তুই কোন আসমানের চান ধরে আনসোস শিকদার? তোর বউ দেখেই তো অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাচ্ছি,, এই সুন্দুরীরে দেখে তো নিজের সুন্ডুরিরে এইবার ধোঁকা দাওয়া লাগে দেখতাছি, পরপরই হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,,অনেক শান্তি লাগছে তোকে দেখে বইন। আমার শিকদারের ঘর আলো কইরা রাখ।
#চলবে,,,