অন্তঃশূন্য পর্ব-০১

0
23

অন্তঃশূন্য
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০১

পাঁচ বছর পর জেলখানা থেকে মুক্ত বাতাসে ছোঁয়া পেলো ইহসান সায়েফ। কারাগারের ছোট গেটটা পেড়িয়ে বের হতেই হাত দুটো উপরে উঠিয়ে অলস ভঙ্গিতে নিজের মেরুদন্ড টানটান করলো। জীর্ণশীর্ণ কালো রঙের পাঞ্জাবীটা টেনেটুনে ঠিক করলো। দারোয়ানের ধোঁয়া উঠা সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে নিজের শুষ্ক ঠোঁটে চেপে বাঁকা হাসলো।

দারোয়ান রমিজ আলী কপালে ভাঁজ ফেলে একবার ইহসান সায়েফের পা থেকে মাথা অব্দি দেখে নিলেন। আগের তুলনায় একটু শুকিয়ে গেলেও ভিতরে রাজকীয় ভাবটা এখনো স্পষ্ট তার। দাঁড়ি গোফ তুলনার চেয়ে অনেকটাই বড়। চুলগুলোও কপাল ছুঁয়ে ঘাড়ের নিচ অব্দি নেমে এসেছে। কপালের নিচে মোটা ভ্রুর আর রহস্যময় চোখ জোড়ার দিকে আবারো তাকালেন রমিজ আলী।

“আপনি কি আসলেই অপরাধী আছিলেন?”

সায়েফ একগাল ধোঁয়া আকাশের দিকে ছেড়ে হাসলো। রমিজ আলীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“অপরাধী না হলে কখনো জেলের ভাত খেতে হয় রমিজ ভাই। তুমিও না কি সব বলো? আমি এতো ভালোমানুষ না। সে যাইহোক তোমার সাথে আমার দেখা হবে।”

রমিজ আলী কিছু বলতে নিবেন তার আগেই সায়েফ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কি গরমটাই না লাগছে! থাকো তাহলে।আবার দেখা হবে।”

রমিজ আলীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘাড় এলিয়ে সামনের দিকে রওনা হলো সায়েফ। আর গাইতে লাগলো,
♪♪তবু আমার, ফিরে আসার
সত্যিই নেই উপায়
তুমি আমার জিতের বাজি
তুমিই আমার হার♪♪

রমিজ আলী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ইহসান সায়েফের যাওয়ার দিকে। মনের মধ্যে এখনো খুঁত খুঁত করতে লাগলো। আসলেই কি ছেলেটা আপরাধী ছিলো?

—————————

পড়ন্ত বিকেলে একটু হাওয়া খেতে বের হয়েছে তায়িবা। মনটা বেশ ফুড়ফুড়ে থাকলেও আচমকা মাথার উপরে একটা পানিপূর্ণ বোতল পড়তেই চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো তায়িবার। চমকিত হয়ে উপরে তাকালো সে। কিন্তু উপরে কাউকে চোখে পড়লো না। আঙুল তুলে বলল,
“কেরে আমার মাথায় পানির বোতল ফেললি। একবার তোরে পাই, তোরে আমি মরিচ, লবণ ছাড়ায় ভেজে খাবো। আমারে দেখে কি ময়লার ঝুড়ি মনে হয়।”

তায়িবা তবুও কাউকে দেখতে পেলো। সে নিজের দিকে তাকালো। বোতলে অর্ধেকের মতো হয়তো পানি ছিলো। যা তার হিজাব ভিজিয়ে ফেলেছে। আজকেই নতুন হিজাবটা পড়েছে। ভেবেই আবারো রাগ লাগলো তায়িবার।ফুড়ফুড়ে মেজাজের উপরে পানি পড়ে সবটা ঘেটে যাওয়ার মতো কাজ হলো একদম।

নিশ্চয়ই কোনো বাচ্চার কাজ ভেবে যেই না আবারো তাকালো তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।

কারণ একটা ছেলে তারদিকে তাকিয়ে বোকামির হাসি দিচ্ছে। চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা ওই ছেলেটারই কাজ।

তায়িবা পরক্ষণেই কটমটিয়ে তাকালো ছেলেটার দিকে। কিছু না ভেবেই বাসাটার গেট পেড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। আজ একটা দফারফা সে করবেই। কাঁধের ব্যাগ কাঁধে আরো একটু টেনে তুললো। তিনতালার বাম সাইডের বাসাটার দরজার উপরে বড় বড় করে লেখা “আনোয়ার খন্দকার”। তায়িবা কিছু না ভেবেই দরজা ধাক্কাতে লাগলো। তীব্র বেগে ধাক্কার ফলে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন মিসেস খন্দকার। দ্রুত হাতে দরজা খুলতেই বোরখা পরিহিত এক অপরিচিত নারীর মুখোমুখি হলেন তিনি। যার পরনের বেগুনি রঙের হিজাব সহ নিকাব পুরোটাই ভিজে আছে। চোখে তার একধরণের ক্ষিপ্ততা।

তায়িবা আশপাশ তাকালো মিসেস খন্দাকারকে এড়িয়ে। যখন কাউকে দেখতে পেলো না তখন গম্ভীর মুডেই বলে উঠলো,
“আপনার বাসার বারান্দায় দিয়ে কি মেইন রাস্তা দেখা যায়?”

মিসেস খন্দকার অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই তায়িবার চোখ পরলো সেই ছেলেটির দিকে। যাকে সে নিচ থেকে দেখতে পেয়েছিলো। পরনে হাঁটু অব্দি কালো রঙের প্যান্ট আর কালো টিশার্ট। তায়িবা আঙ্গুল তুলে চোখ গরম করে বলল,
“এই যে মিস্টার, চোখ নেই আপনার। মেইন রাস্তায় কিছু ফেলার আগে দেখবেন না কে যাচ্ছে না যাচ্ছে। চোখে তো ওই মোটা ফ্রেমের চশমা তাও দেখতে পান না নাকি।”

ছেলেটা এবার আর চুপ না থেকে তেড়ে এলো। সেও একই ভঙ্গিতে আঙ্গুল তুলে বলল,
“এই মেয়ে তখন থেকে দেখছি কথা বলেই যাচ্ছেন। পানিই তো পড়েছে। এমন তো না যে উপর থেকে ড্রেনের ময়লা তুলে এনে ফেলেছি।”

মিসেস খন্দকার একবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন তো একবার অপরিচিত মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি আসলে কি বলবেন তা বুঝতে পারছেন না।

“পানি ফেলে আবার মুখে মুখে তর্ক করছেন। বড্ড অভদ্র মানুষ তো আপনি।”

ছেলেটা কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর চিত্তে বলল,
“বাড়ি বয়ে এসে আপনি যে তর্ক করছেন এটা মনে হয় খুব ভদ্রতা।”

“দেখুন নিজে তো একে ভুল করেছেন এখন আর গলাবাজি করবেন না। ক্ষমা চান আমার কাছে।”

মিসেস খন্দকার এবার তায়িবার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন,
“কি হয়েছে একটু বলবে ক্লিয়ার করে!”

তায়িবার থেকে উত্তরের আশা না করে নিজের ছেলের দিকে তাকালেন।
“কি করছিস কি? এভাবে তর্ক করছিস কেন?”

ছেলেটা মায়ের দিকে তাকিয়েও কিছু বলল না। চুপ করে অন্যদিকে তাকালো।ছেলেটা এমন ভাবে মুখ ঘুরালো যেন তার সাথে যে তায়িবা কথা বলছে তা বোঝায় যাচ্ছে না। তায়িবা আরো কিছু বলতে নিবে তার আগেই তার ফোন বাজতে লাগলো। তায়িবা কথা থামিয়ে ফোন বের করে কানে ধরতেই চেহারার রঙ পাল্টে গেলো তার। সে কিছু না বলেই কল কেটে সেখান থেকে রওনা হলো।

তায়িবাকে যেতে দেখে কপাল কুচকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো ছেলেটা। পরক্ষণেই দরজা থেকে সরে এসে গুনগুন করতে করতে চলে গেলো নিজের রুমে। মিসেস খন্দকার কিছুই বুঝতে পারলেন না। খানিক আগেই ঝড় উঠেছিলো। এখনি আবার পিনপতন নিরবতা। সেসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি দরজা লাগিয়ে নিজের কাজে গেলেন।

____________

তায়িবা হন্তদন্ত পায়ে হাঁটা দিলো। অস্থির চিত্তে মেয়েটা চারপাশ দেখছে শুধু। গলা শুকিয়ে আসছে যেন ক্রমেই। একটা রিক্সায় ও নেই। যা আসছে সবগুলোতেই মানুষ।

হাত ঘড়িতে দেখলো সে, পাঁচটা চল্লিশ বাজে। হাসপাতালে যেতে হবে তাকে। যেতে মিনিমান বিশ মিনিট লাগবেই। তায়িবা কিছু না ভেবেই হাঁটার গতি বাড়ালো। হাঁটছে বললে ভুল হবে রীতিমতো দৌড়াচ্ছে সে। শরীর বেয়ে ঘাম পড়ছে টুপটাপ। ঘাম দিয়ে হিজাবের যে অংশ দিয়ে মুখ বাঁধা সে অংশ ভিজে উঠেছে। খানিকটা এগোতে একটা রিক্সা পেলো সে। কথা না বাড়িয়ে রিক্সায় উঠে পরলো।

পাক্কা পঁচিশ মিনিট পর তায়িবা হাসপাতালে পৌঁছালো। ভাড়া মিটিয়ে কোনোমতে তার পরিচিত কেবিনটায় প্রবেশ করলো।

সাদা বিছানার ছোটরুমটায় গোমট ভাব ছাড়িয়ে আছে। তার মাঝেই সাদা চাদরে আবৃত বিছানায় শুয়ে আছে একটা মহিলা। মুখে একপ্রকার ফ্যাকাশে ভাব। শরীরে মাংস বলতে কিছু নেই বললেই চলে। চোখের পাশে দাগ হয়ে গেছে পানির। তবে পানি নেই। বয়স কি হবে এই ৪৫ বা তারও কম। কিন্তু অবস্থা দেখলে মনে হবে আরো বেশি হয়েছে। মহিলাটা ঘুমাচ্ছে। ঘুমানোর কথা না হয়তো ঘুমের ঔষধ পড়েছে আবারো।

তায়িবাকে দেখে পাশে দাঁড়ানো নার্সটা ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“কেবলি ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। তাছাড়া সমস্যা করছিলো। তোমাকে খুঁজছিলো অনেকক্ষণ ধরে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই তোমাকে কল করেছিলাম।”

তায়িবা ক্লান্ত পায়ে এসে বসলো বেডের পাশের টুলটাতে। মহিলাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

নার্স তায়িবার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তায়িবা অনেকক্ষণ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো মহিলাটার ফ্যাকাশে মুখটার দিকে।

মহিলাটা তায়িবার খালা হয়। দীর্ঘ আটবছর ধরে হাসপাতালেই দিন কাটাচ্ছে উনি। উনার নাম তাসফিয়া আহমেদ।

তায়িবা তাসফিয়া বেগমের ডানহাতটা নিজের দুইহাতের মাঝে মাঝে নিয়ে তা ঠেকালো কপালে। নিজের শক্ত আবরণ থেকে বের হয়ে হুট করেই তায়িবা হু হু করে কেঁদে উঠলো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো সে। তবুও চোখের পানি গুলো কেন যেন এখানে এসেই বেইমানি করে তার সাথে।

“মামুনি তুমি কবে ঠিক হবে বলো তো। দেখো আমি এখনো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। দম বন্ধ লাগে আমার। দেখো আমার পাশে তো তুমি, নানিমনি আর তামিম ভাই ছাড়া কেউ নেই। দেখো তোমার প্রিন্সেস কান্না করছে। তুমি বকবে না আমাকে মামুনি। আম্মু তো পালালো আমাকে না জানিয়েই। আর…!”

তায়িবা মাথা দুপাশে নাড়ালো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো মেয়েটা।

“মামুনি আট বছর হতে চলল তোমার এমন অবস্থা। একবার কি আমার কথা ভেবে নিজেকে ঠিক করতে পারো না। আচ্ছা আমার কথা নাই বা ভাবলে তোমার ছেলের কথা তো ভাববে। সে তো সবকিছু মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠছে।”

তায়িবা তাসফিয়া বেগমের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এখন উঠতে হবে তাকে। যাওয়ার আগে ব্যাগ থেকে একখানা কাগজ বেডের পাশের ছোট টেবিলটায় রাখলো। যাওয়ার আগে আবারো ফিরে তাকালো তাসফিয়া বেগমের দিকে। যেতে মন না চাইলেও যেতে হবেই। ওদিকে তার নানি অপেক্ষা করছে।রান্না তাকেই করতে হয়।

ঘড়িতে সাতটা বাজে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সে রওনা হলো বাসার উদ্দেশ্য। মনের ফুড়ফুড়ে ভাব আগেই চলে গেছে। এখন শুধু চোখেমুখে ক্লান্তি আর বিষন্নতা।

খানিকটা আনমনেই হাঁটছিলো তায়িবা। কখন যে রাস্তার মাঝে চলে এসেছে বুঝতে পারেনি। একটা পুরুষালি চিৎকারে তায়িবার ভাবনায় ছেদ ঘটলো। সামনে তাকাতেই থমকে গেলো সে। একটা ট্রাক ছুটে আসছে তার দিকে। তায়িবার পা যেন থেমে গেছে।

ঠিক সেই মুহুর্তেই একটা হেচকা টানে কারো বুকে এসে পরলো তায়িবা। পুরুষালি শক্ত বুকটায় মাথা লাগতেই তায়িবা অনুভব করলো লোকটার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত চলছে। অনুভূতি গুলো ভোতা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। তাই তো এই মুহুর্তে এসেও তার হৃদস্পন্দন একদম স্বাভাবিক।

নিজের জগত থেকে ফিরতেই তীব্র ধাক্কা দিলো লোকটার বুকে। সরে এলো খানিকটা দূরে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো।

তায়িবা তাকালো সামনের দিকে। তামিমের পরিচিত মুখটা ভেসে উঠতেই তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো।

তামিম আরো একটু এগিয়ে এলো। কপালের ভাঁজ দৃঢ় করে কর্কশ কন্ঠে বলল,
“রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কি এতো ভাবিস? আজ আমি না আসলে কি হতো? এতো কেয়ারলেস কেন তুই?”

তায়িবা স্বাভাবিক ভাবেই তামিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি আর হতো মরে যেতাম! তোমার উপর থেকে একটা বোঝা কমে যেতো।”

তামিম নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো তায়িবার গালে। তায়িবা নিচের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গালে হাতটাও পর্যন্ত ঠেকালো না। তামিম রাগে কাঁপছে রীতিমতো।

“আমি কখনো বলেছি তুই আমার বোঝা। কথা শিখে গেছিস খুব। দুইপাতা পড়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিস?”

তায়িবা চুপ করেই রইলো। তামিম তায়িবার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে চারপাশে তাকালো। বুকের কাছের শার্টের দুটো বোতাম খুলে শার্ট ঝাঁকালো। ঘামে ভিজে গেছে শার্ট খানা। হৃদস্পন্দন এখনো স্বাভাবিক হয়নি তার।

#চলবে কি?