অন্তঃশূন্য পর্ব-০২

0
29

#অন্তঃশূন্য
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০২
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)

জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে তামিম নিজেকে শান্ত করলো। তায়িবা চুপচাপ মাথা নিচু করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তামিম ওর হাত ধরে নরম গলায় বলল,
“অনেকটা দেড়ি হয়ে গেছে। চল বাসায় যাই। মায়ের ওখানে গেছিলাম ওনারা বলল তুই নাকি কেবলি বের হয়েছিস ওখান থেকে। তাই দেড়ি না করে চলে এলাম। ভালো যে এসেছিলাম। আল্লাহ বাঁচাইছে।”

তায়িবার দিকে একপলক তাকালো তামিম।
“কিছু খাবি?”

তায়িবা মুখ ফুঁটে কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। তামিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইকে উঠে পরলো। তায়িবা কথা ছাড়াই উঠে বসলো।

খানিকক্ষণের মধ্যেই তারা পুরান ঢাকার একটা গলির মাঝে এসে দাঁড়ালো। একটা চারতালা বিল্ডিং এর দরজার সামনে বাইক থামাতেই তায়িবা নেমে পরলো। ভাড়া বাসায় তারা বর্তমানে থাকছে। শ্যাওলা ধরা পুরোনো একটা বাসা। আলো বাতাস তেমন একটা আসে না। তবুও মাস শেষে বাসার ভাড়া দিতে তামিমের অনেকটাই বেগ পোহাতে হয়। ওরা তিন তালার দক্ষিণ পাশটায় থাকে। তিন রুমের ছোট্ট বাসাটা তায়িবাই গুছিয়ে রাখে।

তামিম বাইকটা গেটের ভিতরে নিয়ে রাখলো। তায়িবা আগেই চলে গেছে। বাইকের চাবি পকেটে রেখে তামিম ও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো।

দরজায় কড়া নাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো তায়িবার। ওর নানি বয়স্ক মানুষ আসতে একটু সময় তো লাগেই। দরজা খুলে নাতনিকে দেখে রানু বেগম একগাল হেসে বললেন,
“তোর অপেক্ষায় কতক্ষণ ধরে বসে ছিলাম জানিস!”

তায়িবা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“মামুনি কাছে গেছিলাম। সেখানেই দেড়ি হলো। দরজা লাগিয়ে দিও না তামিম ভাই আসছে।”

রানু বেগম তায়িবার কথা মতো দরজা না লাগিয়ে তায়িবার পিছন পিছন সোফায় এসে বসলেন। হাঁটুর ব্যথাটা বেশ বেড়েছে কয়েকদিন যাবত। হাঁটুতে হাত দিয়ে তায়িবার দিকে তাকালেন। মেয়েটা নিকাব খুলে পানি খাচ্ছে। মুখের দিকে তাকালেন রানু বেগমের নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটার মুখে কি মায়াটাই না আল্লাহ দিয়েছে! এই মেয়েটার দিকে তাকালেই বড্ড মায়া লাগে তার। কতই বা বয়স হবে সবে সবে ভার্সিটিতে উঠেছে। এখনি তার বাবা মা নেই। এতিম সন্তান সে আরো আগেই হয়েছে। তাই হয়তো এতো মায়া লাগে মেয়ের জন্য।

তামিম ভিতরে ঢুকতেই দেখলো নানি হাঁটুতে হাত ঘষছে। নিজের জুতো জোড়া পা থেকে খুলে দরজাটা লাগিয়ে দ্রুত নানির পায়ের কাছে গিয়ে বসলো তামিম।
“আবার কি হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে নানু?”

রানু বেগমের ভাবনায় ছেদ ঘটলো। তিনি একগাল এসে তামিমের মুখের দিকে তাকালেন। ডান হাত তামিম সিল্কি চুলগুলোতে রাখলেন।
“নারে আমি ঠিক আছি। ফ্রেশ হয়ে আয় তো তাড়াতাড়ি ভাত ভর্তা করেছি। খাবো তিনজনে মিলে।”

তায়িবা কপালে ভাঁজ ফেলে নানুর দিকে তাকালো। কড়া গলায় বলল,
“তোমাকে কে রান্না করতে বলেছে? আমি কি আসতাম না?”

রানু বেগম আমতা আমতা করতে লাগলেন। তামিম সেদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নরম গলায় বলল,
“তুই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হ। নানু আর করবে না। এটাই লাস্ট বার। কি বলো নানু?”

রানু বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল তামিম। তামিমের কথায় রানু বেগম দ্রুত মাথা নাড়ালেন। যার অর্থ হ্যাঁ সে আর করবে না। এটাই লাস্ট।

তায়িবা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। সে জানে এই মহিলা কথা শোনার মানুষ না। সে আবারো একি কাজ করবে।

তায়িবা যেতেই তামিম আঙুল তুলে কপালে ঘষে বলল,
“নানু আমি না থাকলে কিন্তু তোমার খবর হয়ে যেতো। এতো বকা খাও তা কেন করো বলো তো?”

রানু বেগম হাসলেন। তামিম একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

তায়িবা রুমে গিয়ে বোরখা হিজাব খুলে ফ্রেশ হতে গেলো। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে এসে সবকিছু গুছিয়ে নিলো। চুলগুলো হাত খোঁপা করে ওড়না ঠিক করে খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে এলো। মুরগির তরকারি আগেই রান্না করে রেখেছিলো। গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা বানিয়ে রানু বেগম আর তামিমকে ডাক দিলো।

তামিম ঝটপট প্লেট নিয়ে বসে পরলো।
“তাড়াতাড়ি খেতে দে তো। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।”

তায়িবা ভাত তুলে দিলো। রানু বেগমের খাবার এগিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পরলো।

খাবারের পর্ব শেষ করে তায়িবা সবকিছু গুছিয়ে রুমে গেলো। রুমের লাইট না জ্বালিয়েই ধীর পায়ে বারান্দায় চলে গেলো। বৃষ্টি শুরু হয়েছে একটু আগেই। দুইদিন প্রচন্ড গরমের পরে এই বৃষ্টিটা দরকার ছিলো। তায়িবা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।

——————-

তুমুল বর্ষণে শহরের অলিগলিতে পানি জমে গেছে। বৃষ্টি হলে এই এক সমস্যা। তবুও রাত হওয়াতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। ঘড়ির কাটায় রাত একটা ছুইছুই। চারপাশে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না তেমন। এরমাঝেই সরকারি হাসপাতালের পিছনের নির্জন জায়গায় গুটি কয়েক মানুষ মিলে মাটি খুঁড়ছে। তার মাঝেই একজন তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
“তাড়াতাড়ি কাজ কর। কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”

একজন হেসে বলল,
“আরে ভাই এই বৃষ্টিতে কে আইবো এনে।”

এরমাঝেই একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসতেই লোকগুলো চমকে উঠলো। চমকিত হয়ে তাকাতেই মেয়েটা আবারো বলে উঠলো,
“কে ওখানে?”

লোকগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো,
“ম্যাডাম আমি মন্টু। আপনি এনে আইছেন কেন? আপনি ভিতরে যান।”

মেয়েটা বৃষ্টির কারণে কিছু দেখতে পাচ্ছে না ঠিকমতো।
“ওও মন্টু আমি বাসায় যাবো। গাড়ির ব্যবস্থা করো তো।”

“আইচ্ছা ম্যাডাম। আমি আনতাছি।”

মেয়েটা চলে গেলো। লোকগুলো তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। মন্টু হিসহিসিয়ে বলল,
“সমস্যা নাই রিমা ম্যাডাম কিছু দেখতে পায় নায়।”

হুট করেই বেলিফুলে কড়া গন্ধ নাকে এসে আঘাত করতে লাগলো। একজন আরেকজনের সাথে ফিসফিস করতেই পানির মধ্যে কাউকে দৌড়ে আসতে দেখা গেলো। পানিতে দৌঁড়ানো ফলে একটা শব্দ তৈরি হচ্ছে। যা এই অবস্থায় বেশ লোমহর্ষক পর্যায় চলে গেছে।

চারজনই কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। লোকটা এতো জোরে দৌঁড়াচ্ছে যে জমে থাকা পানিগুলোও বেশ উপরে ছিটকে উঠছে। অন্ধকারে চোখের পলকেই ওই চারজনের সামনে এসে দাঁড়ালো সুঠাম দেহে এক পুরুষ।

আবছা আলোতে লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবুও মন্টু সহ বাকিরা কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিলো। তা দেখে হয়তো সামনের লোকটা বেশ খুশি হলো।

মন্টু কাঁপা গলায় বলল,
“ভাই আপনে এনে?”

সায়েফ একগাল হাসলো। মন্টুর কাঁধে একটা চাপড় দিয়ে বলল,
“কেন রে শালা আমারে দেখে বুঝি তোরা খুশি হোসনি। আমি কিন্তু তোগো দেখে মেলা খুশি হইছি।”

মন্টু হাসার চেষ্টা করতেই পাশ থেকে কাশেম বলল,
“ভাই আমরাও অনেক খুশি হয়েছি। এতোদিন পরে আপনি বাসায় না গিয়ে এখানে আসছেন যে!”

সায়েফ আবারো হাসলো। এবার জোরে জোরে হাসতে লাগলো। সায়েফ হাসলেও মন্টুদের মুখে হাসি নেই বরং ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

সায়েফ পাঞ্জাবীর পকেটে হাত রাখতেই কাশেম বলে উঠলো,
“ভাই ভাই আপনি দেখেন আমরা কিছুই করছিনা। আমাদের ক্ষমা করে দেন। আমরা আপনারে না বলে আর কিছু করবোনা।”

সায়েফ পকেট থেকে একটা গান বের করে কপালে ঘষতে ঘষতে হাসলো।
“আরে পাগলা তোরা হয়তো আমার চরিত্র ভুলে গেছিস এতোদিনে। আমি ইহসান সায়েফ আমি কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেই না।”

বলেই চারটা গুলি করে দিলো চারজনকে। চারজনই অবাক হওয়ার ও সুযোগ পেলো না। তার আগেই ধপাস করে পড়ে গেলো খুঁড়ে রাখা কাঁদার মধ্যে। কাঁদায় মিশানো পানি গুলো দিয়ে ঢেকে যেতে লাগলো তাদের দেহ। সায়েফ সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। রক্ত আর কাঁদা পানি একসাথে মিশে ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সায়েফ নিজের কপালে পড়ে থাকা ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে ঠেলে পিছনে রাখলো।

আবারো দৌঁড়ে যেতে লাগলো নিজের গন্তব্যে। নিরব পরিবেশে ক্রমেই হারিয়ে যেতে লাগলো সায়েফের লম্বাটে দেহটা।

———————-

তায়িবা বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখলো। চোখটা লেগে এসেছে তাই আর অপেক্ষা না করে সে পা বাড়ালো রুমের দিকে। রুমের ফ্যানটা আস্তে করে ছেড়ে কমফোর্টার জড়িয়ে শুয়ে পরলো। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় তায়িবার চোখে একরাশ ঘুম নেমে এলো।

তায়িবা ঘুমাতেই তামিম রুমের ভিতরে আসলো। ধীর পায়ে বিছানার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। তাকালো তায়িবার ঘুমন্ত মুখের দিকে। গালে বাম হাত ঠেকিয়ে বেশকিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তায়িবার দিকে। ধীর গলায় বলতে লাগলো,
“তুই এমন কেন বল তো? আজ তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো বল তো! কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি জানিস তুই! একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো নিজের আত্নাকে হারিয়ে ফেলেছি। তুই কিভাবে বললি যে, তুই আমার বোঝা!”

একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে উঠে পরলো তামিম। তায়িবার গায়ের কমফোর্টার টা ভালো করে টেনে দিয়ে চলে গেলো রুম ছেড়ে। রুম থেকে বের হতেই মুখোমুখি হলো রানু বেগমের। রানু বেগমকে দেখে কিছুটা চমকালেও নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“নানু তুমি এখানে?”

রানু বেগম পানির বোতল দেখিয়ে বললেন,
“পানি নিতে এসেছিলাম। তুই এখনো ঘুমাসনি যে!”

তামিম একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আসলে আমার একটা বই তাইয়ুর কাছে ছিলো। সেটা নিতে এসে দেখি ও ঘুমিয়ে পড়েছে তাই নিজের রুমে ফিরে যাচ্ছি। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।”

রানু বেগম চলে গেলেন। তামিমও চলে গেলো নিজের রুমে। রুমে এসে চেয়ার টেনে বসলো টেবিলে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসলো একটা ডায়েরি নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যাসটা আছে তামিমের। নিজের মনের কথাগুলো ডায়েরির পাতায় বন্ধ করে রাখে সে। আগে আম্মুকে বলতো কিন্তু বর্তমানে তো সেটাও হয়ে উঠেনা। নিজের অনুভূতি গুলো লুকিয়ে ফেলতে পারে সহজেই। বাসার আপনজন ছাড়া সে কারো সাথে তেমন একটা কথা বলে না। চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির মানুষ সে। ঝামেলা সবসময় এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে।

তামিম আজকের তারিখটা লিখে আজকের ঘটে যাওয়া সবকিছু ধীরে ধীরে ডায়েরি বন্ধ করতে লাগলো।

লেখা শেষে ডায়েরিটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে লক করে রাখলো।

একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বিছানায় বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসলো।হুমায়ন আহমেদ এর লেখা অন্যভুবন উপন্যাসটা বর্তমানে সে পড়ছে। বই পড়া তার কাছে একধরনের নেশা। সময় পেলেই সে বই নিয়ে বসে। আগে ওর মা এইজন্য অনেক বকতেন। কিন্তু সে কখনোই এই অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। পারবে বলে মনেও হয় না। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে পড়তে লাগলো সে।

#চলবে