অন্তঃশূন্য পর্ব-০৩

0
143

#অন্তঃশূন্য
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৩
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)

সকালের ব্রেকিং নিউজ সরকারি হাসপাতালের পিছনে রক্তাক্ত চারটা লাশসহ বেশ কিছু দেশি অস্ত্র পাওয়া গেছে। ধারনা করা গেছে গভীর রাতে সেই চারজন লোক অস্ত্রগুলোই লুকাতে এসে খুন হয়েছে। চারজনের মধ্যে তিনজনই হাসপাতালের কর্মচারী বলে জানা গেছে। একজন অপরিচিত লোক আছে। যার পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি।

তায়িবা রুটি চিবোতে চিবোতে খবরটা দেখে চ্যানেল পাল্টালো। সকালেও বৃষ্টির বেগ না কমায় ভার্সিটির পথে সে যাবেনা বলে মনস্থির করেছে। তাই তো ভাবলেশহীন ভাবে তখন থেকে রুটি চিবিয়ে যাচ্ছে আর টিভির চ্যানেল পাল্টাছে। খারাপ লাগছেনা তেমন একটা। কারণ তার ফোন বর্তমানে চার্জে বসে নাচতেছে।

এরমাঝেই একটা নেভিব্লু রঙের ফর্মাল শার্ট আর খাকি কালার প্যান্ট, চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা,কাধে অফিস ব্যাগ ঝুলিয়ে একদম ফিটফাট হয়ে সে রওনা হচ্ছে দেখে তায়িবা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাতেই তামিম বাইকের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে তায়িবার মাথায় গাট্টা বসিয়ে বলল,
“এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?”

“তুমি এই বৃষ্টির ভিতরে অফিস যাবে?”

তামিম হাসলো। কিছু টাকা তায়িবার হাতে দিয়ে বলল,
“চাকরি মানেই চাকর রে পাগলি। যেতে তো হবেই। সাবধানে থাকিস আর নানুকে দেখে রাখিস। বাহিরে বের হওয়া লাগবে না। আজ বৃষ্টি থামবে বলে মনে হয় না।”

তায়িবা মাথা নাড়াতেই তামিম একগাল হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তামিমের পিছু পিছু দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তায়িবা। তামিমের হাতে ছাতা ধড়িয়ে দিতেই তামিম সেটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো।

তায়িবা দরজা লাগিয়ে রান্নাঘরে গেলো চা বানাতে। কড়া করে এককাপ চা নিয়ে বসবে সে বারান্দায়। এই ভাবনায় সে চা বানাতে লাগলো।

চা বানিয়ে রানু বেগমের ঘরের দিকে টুকি দিলো একবার। রানু বেগম বসে বসে সেলাই করছিলেন। তা দেখে তায়িবা নিজের রুমে চলে গেলো।

বৃষ্টি জোরে বিধায় আর বারান্দায় যাওয়া হলো না। রুমের ছোট্ট জানালাটা খুলে দাঁড়ালো। বৃষ্টির পানি ছিটকে ছিটকে আসছে তার চোখে মুখে। জানালাটা বন্ধ করলো না আর। আস্তে দিলো বৃষ্টির কণাগুলোকে। চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে গলির মাথার দিকে তাকাতেই দেখলো তামিম এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তায়িবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চার্জ থেকে ফোনটা খুলে তামিমের নাম্বারে কল করলো।

দুইবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো।
“কি বলবি বল?”

তায়িবা গম্ভীর গলায় বলল,
“উঠে আসো উপরে। অফিসে বলে না হয় একটু পরে যাবে। এখন যেতে পারবে না এমন অবস্থায়। পরে জ্বর ঠান্ডা লাগিয়ে আরো সমস্যা হবে।”

তামিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল কেটে দিলো। তায়িবা ফোনটা বিছানার উপরে রেখে গেলো দরজা খুলতে। সে জানে তামিম ফিরে আসবে। তায়িবার ভাবনা মতো তামিম ফিরে এলো। অনেকাংশ ভিজে গেছে সে। তায়িবাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তামিম হাসলো।
“আজ আর যাবো না বুঝলি। কল করেছিলাম ম্যানেজার সাহেবকে বললেন এই অবস্থায় আর যেতে হবে না।”

তায়িবা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। তামিম মাথা চুলকে রুমে গেলো। তায়িবা রুমে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো। সকাল দশটা মতো বাজে। এই দুইঘন্টা পড়তে হবে তাকে। সে এবার অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে বদরুন্নেসা কলেজে। পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও চান্স হয়নি তার। পড়াশোনা নিয়ে বেশ সিরিয়াস হওয়া সত্ত্বেও ভাগ্যের কাছে হেরে গেছে সে। তাতে কি সে ভেঙে পড়েছে? না একদম না তার ইচ্ছা সে প্রফেসর হবে। নিজের স্বপ্ন নিয়ে সে ব্যস্ত। কে কি বললো বা কে কি মনে করলো তাতে তার কিছু আসে যায় না।

তায়িবা পড়ছিলো হুট করেই তার মনে পরলো সকালের নিউজটার কথা। আচ্ছা ওই চারজনকে কে মারলো? আর ওখানে সেখানে অস্ত্রগুলোই বা কোথায় থেকে এলো? বিষয় টা নিয়ে ভাবতে না চাইলেও মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে হাজারো প্রশ্ন।

তায়িবা কলম কামড়াচ্ছিলো আর ভাবছিলো তখনি সেখানে এসে হাজির হলেন রানু বেগম। তায়িবার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,
“কিরে কি হয়েছে? কি এতো ভাবছিস তখন থেকে?”

নানুর কথায় ভাবনায় ছেদ ঘটলো তায়িবার। মনে ভিতরকার ভাবনাগুলো ঝেড়ে ফেলে মুচকি হেসে বলল,
“ভাবছিলাম তোমাকে আরেকটা বিয়ে দিবো। তারপর তুমি আর তোমার নতুন বর মিলে হানিমুনে যাবে সাজেক। তুমি লালটুকটুকে একটা গাউন পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেঘ দেখবে আর তোমার বর তোমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে। অফ কি যে রোমান্টিক ব্যাপার, ভাবতেই আমার লজ্জা লাগছে।”

নানু তায়িবার মাথায় গাট্টা বসিয়ে ফুসতে ফুসতে বললেন,
“তোর সাহস তো কম না ছেমরি! আমার উনি আজ থাকলে তোরে তুলে আছাড় দিতো। উনি আমার সাথে কেউ কথা বললেই রাগ করতেন আর তুই আমারে অন্য বেডার সাথে বিয়ে দিতে চাস। বেশি পেকেছিস তোরে বিয়ে দিতে হবে।”

তায়িবা হাসলো। নানুর গাল টেনে বলল,
“আহা কতো ভালোবাসাই না ছিলো। আমার বিয়ের ভাবনা বাদ দেও তো। নানাজানের মতো কাউকে পেলে তবেই বিয়ে করবো।”

নানু হেসে তায়িবার থুতনিতে হাত রাখলেন।
“আমার সতীন হওয়ার দেখি বহুত শখ তোর ছেমরি!”

তায়িবা হাসলো কিছু বলল না আর। তামিম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আলতো হাসলো। নিজ মনেই বিরবিরালো,
“নানাজানের থেকেও বেশি ভালোবাসবে তোকে।”

আবারো হেসে পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। আজ সে খিচুড়ি, ডিম আর বেগুন ভাঁজা করবে। মোটামুটি রান্না সে পারেই। বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়া আছে আজকে না হয় সেই রান্না করবে। শখের বশে মায়ের কাছে থেকেই রান্না করা শিখেছে সে।

রান্নাঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ পেয়ে তায়িবা রান্নাঘরে আসতেই দেখতে পেলো তামিম একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে খুনতি চালাচ্ছে। তায়িবা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কি করছো?”

তামিম কিছুটা ব্যস্ত ভঙ্গিতেই বলল,
“তুই গিয়ে পড়তে থাক। আজ রান্না আমি করবো।”

তায়িবাকে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তামিম ভ্রুকুচকে বলল,
“তোকে যেতে বলেছি।”

তায়িবা একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেলো।

———————

দুপুরের খাবার শেষ করে নিজের রুমে আসতেই তামিমের ফোনটা বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার দেখে প্রথমে ধরলো না। কিন্তু অনবরত বাজতেই লাগলো দেখে বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে ওর বন্ধু রাসেল বলল,
“বিকালের দিকে একটু ভার্সিটির পিছনের টং দোকানে আসিস।”

তামিম বিছানায় টানটান করে শুয়ে বলল,
“হঠাৎ!”

“আয় পরে বলছি।”

“বৃষ্টি কমলে যাবোনি।”

“হ আসিস আমরা সবাই ওখানে থাকবো।”

“সববাদ দিয়ে আজকের দিনটাই তোদের ঠিক করতে হবে। যে বৃষ্টি হয়েছে রাস্তায় পানির অভাব নাই।”

রাসেল বিরক্তি নিয়ে বলল,
“চুপচাপ আয় আবিরের না হওয়া বউয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমাদের কিছু করতে হবে এই নিয়ে।”

“আগে বলবিনা এসব হয়েছে। আমি যাবোনি।”

তামিম কল কেটে একটা লম্বা ঘুমের প্রস্তুতি নিলো সে।

——————–

বিকালের দিকে টং দোকানে বসে চা খাচ্ছে তামিম, রাসেল, আবির আর নিরব। বর্তমানে তাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে আবিরের প্রেমিকা ইশাকে নিয়ে। ইশার বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী। সে তার বন্ধুর ছেলের সাথে ইশার বিয়ে ঠিক করেছে। এদিকে আবির সবে দুইমাস হলো একটা স্কুলে পড়ানো শুরু করেছে। আবির তো দেবদাস হয়ে বসে হায় হায় করছে।

আবিরের এই দেবদাসের মতো হায় হায় করা দেখে ওরা তিনজন হাসবে নাকি কাঁদবে তা ঠিক বুঝতে পারছেনা। রাসেল আবিরের পিঠ চাপড়ে বলল,
“তোর বাবা মাকে জানিয়েছিস?”

আবিরের সোজাসাপ্টা উত্তর,
“না এখনো জানাইনি।”

তামিম এবার বেশ বিরক্ত হলো।
“তো কখন জানাবি ইশার বিয়ের পর। আগে নিয়ের বাপ মারে মানা ব্যাটা। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যা। ইশার বাপের সঙ্গে কথা বল। এমন করে বসে থাকলে ইশার বিয়ে কিভাবে তোর সাথে হবে?”

“তুই গিয়ে আমার বাপরে বল যাহ। আমার বাপরে চিনিস না ব্যাটা। জানিস না বাপের সামনে কথা বলতে গেলে আমার আত্নার পানি শুকিয়ে যায়।”

তামিমসহ বাকিরাও এবার ভাবনায় পরলো। তখনি পাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসলো,
“প্রেম করার সময় মনে ছিলো না যে এই কথা নিজের বাবার সামনে গিয়ে বলতে হবে।”

আবির সহ সবাই পিছু ফিরে তাকালো। তাদের ঠিক উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছে একটা লোক। পরনে তার সাদা রঙের পাঞ্জাবী, ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল, বলিষ্ঠ দেহ।

তাদের ঘুরতে দেখে লোকটাও ঘুরলো। এবার তার মুখটা দৃশ্যমান হলো। শ্যামবর্ণের এক হাস্যোজ্জ্বল পুরুষ, গভীর চাহনি, খয়েরি রঙের সিগারেটে পোড়া ঠোঁট, দাঁড়ি গোফে গাল ঢাকা। ঠোঁটের কোণে জ্বলন্ত সিগারেট।

“আমাকে পর্যবেক্ষণ করা হলে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি।”

লোকটা কথায় ওরা চোখ সরালেও তামিম চোখ সরালো না। কেন যেন বেশ চেনাচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আগেও লোকটাকে দেখেছে সে। লোকটা এবার বসে থাকা চেয়ারটা তাদের দিকে আরো একটু টেনে এনে বলল,
“দেখো ভালো যখন বেসেছো তখন সাহসী তোমাকে হতেই হবে। তার আগে বলো তুমি কি ওই মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারবি কি না? হ্যাঁ বা নায়ে উত্তর দিবে।”

আবির কোনো সংশয় ছাড়াই বলে উঠলো,
“আমার ইশাকেই লাগবে।”

“এইতো পুরুষ মানুষের কথা। প্রথমে তুমি গিয়ে পরিবারকে মানাও যদি না মানে তবে পালিয়ে যাও।”

লোকটার কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আবিরের। লোকটা তা দেখে হাসলো। আবিরের পিট চাপড়ে বলল,
“রিলাক্স,আগেই তো পালাতে বলছিনা। আগে মানানোর চেষ্টা করো। যদি না মানে তবে প্লান টু ভাববে।”

আবির কিছু বলতে নিবে তার আগেই তামিম বলে উঠলো,
“আপনাকে কেন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে!”

লোকটা এবার চোখ ফিরিয়ে তামিমের দিকে তাকালো। আবারো ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“রুহুর জগতে হয়তো একসাথে ছিলাম।”

লোকটা হেয়ালি কেন যেন পছন্দ হলো না তামিমের। অদ্ভুত লাগছে তার লোকটাকে। তবুও চুপ করে রইলো। লোকটা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্লান এ কাজে না আসলে আবার এখানে এসো। আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য আছি।”

বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটা ঘাড় দুইপাশে দুইবার কাত করে সোজা সামনের দিকে চলে গেল।

তামিম তার গমন পথের দিকে কপাল গুটিয়ে তাকিয়ে রইলো। এরমাঝেই রাসেল বলল,
“আবির আজকে রাতে গিয়েই আঙ্কেলকে তাহলে সাহস করে বল।”

আবির মাথা নাড়ালো।

#চলবে