অন্তঃশূন্য পর্ব-০৪

0
24

#অন্তঃশূন্য
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৪
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)

রাত আটটার দিকে তামিম বাসায় ফিরতেই দেখলো, ঘরের ভেতর নানু আর তায়িবা ছাড়া আরো লোকজন আছে । কলিংবেল বাজাতেই এক তরুণী দরজা খুলে দিলো। তামিম কপাল কুঁচকে তাকালো, কিছু না বলে চোখ ফিরিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো।

মেয়েটি নিচু গলায় বলল,
“ভিতরে আসুন ভাইয়া।”

তামিম পাত্তা না দিয়ে গলা ছেড়ে ডাকল,
“তাইয়ু! এই তাইয়ু, কোথায় গেলি তুই?”

রানু বেগম রুম থেকে বেরিয়ে এলেন, সাথে আরেকজন মহিলা। যাকে দেখেই তামিমের মুখ বিরক্তি ভাব ফুটে উঠলো। মহিলাটা তায়িবার চাচি। তার মানে, দরজা খুলে দেওয়া মেয়েটা নিশ্চয়ই তায়িবার কাজিন।

তামিম যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই চাচির কথা শুনে পা থেমে গেলো তার।

“খালাম্মা, তায়িবাকে আর কতদিন এভাবে রাখবেন? বিয়ে দিয়ে দিন। এক বাসায় প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে একসাথে থাকে, ভালো দেখায় না। বুঝতেই পারছেন, মন ঘুরতে তো সময় লাগে না! যতই হোক, আপন ভাইবোন তো না! তাছাড়া আমার ছেলেটা তো…”

বাকিটুকু বলার আগেই হঠাৎ কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দে ঘর কেঁপে উঠলো।

তামিম দাঁতে দাঁত চেপে, গলাটা ভারি করে বলল,
“তাইয়ু যখন ছোট ছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? ও যখন চুপচাপ কোণে বসে কাঁদতো, তখন কোথায় ছিলেন? যখন একটু আদরের, একটু সাহসের দরকার ছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? তখন এই আমি এই আপন ভাই না,মাত্র দশ বছরের বড় একটা ছেলে, নিজের কোলে-পিঠে করে ওকে মানুষ করেছি। তখন তো মনে হয়নি ও আমার আপন বোন না।আমি আর আম্মুই ওর পাশে ছিলাম, ওর অভিভাবক ছিলাম। ওর ভালো-মন্দ, ওর ভবিষ্যৎ সেসব নিয়ে ভাবার দায়িত্বও আমাদের। তাই দয়া করে এরপরে কথা বলার আগে একশবার ভেবে বলবেন। আর একটা কথা আপনার ছেলের ব্যাপারে সবটাই আমার জানা। কিজন্য তাইয়ুর সঙ্গে বিয়ে দিতে চান তাও জানি। সরি টু সে, আপনার পরিকল্পনা কখনোই পূরণ হবে না।”

তামিমর কথায় রুমজুড়ে কিছুক্ষণ নিরবতা বিচরণ করলেও চাচির কটাক্ষ হাসির শব্দে সেই নিরবতার ছেদ ঘটলো।
“বাহ ছেলে ভালোই তো কথা বলতে পারো দেখছি। এতোই যখন দায়িত্ববোধ তাহলে ওর বাপের সম্পদ এখনো খাচ্ছো কেন?”

তামিম এবার হেসে উঠলো। বিকট এক হাসি। যা নিরব ঘরে ঝংকার তুলছে। হাসি থামিয়ে রক্ত লাল চোখে চাচির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি হয় তো ভুলে যাচ্ছেন একাউন্টের সব টাকা তায়িবার। সেটা তার অধিকার। আমি আল্লাহ রহমতে পরিশ্রম করে খাই। তায়িবার বাবার সম্পদে খাই না আমি। আপনাদের মুখে এই কথাগুলো বেশ হাস্যকর লাগছেনা। আপনারা তো খালা খালুর করা বাড়িতেই থাকছেন।”

মহিলা দমে গেলো। তামিম নানুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“আমার নিজের ইনকামে করা টাকায় ওদের রাতে খাবার খাইয়ে পাঠিয়ে দিও। আর যাইহোক মেহমান বলে কথা।”

বলেই গটটিয়ে রুমে চলে গেল তামিম। তামিম যেতেই আয়শা মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এতো বছর পর এসেছো এগুলো বলতে। কোথায় কোন কথা বলবে তা বুঝে বলবেনা।”

চাচি মেয়ের দিকে না তাকিয়েই হনহনিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেলো।

তায়িবা নামাজে বসেছিলো। তামিম দরজা আটকিয়ে বসে আছে। তামিম বাসা থেকে বের হওয়ার পরেই চাচি আর আয়েশা এসেছিলো। এর আগে কখনোই আসেনি। হঠাৎ করে ওদের দেখে তায়িবা চমকিত হলেও আয়েশাকে দেখে তার বেশ ভালো লেগেছে। মেয়েটা ওর বাবা মার মতো হয়নি। যাওয়ার আগে ফোন নাম্বার নিয়ে গেছে। মেয়েটা তায়িবা দুই বছরের ছোট। আয়েশারা তিন ভাইবোন বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আরো আগে। স্বামী আর বাচ্চাদের নিয়ে জাপানে থাকে। বড় ভাই মাস্টার্স পরীক্ষা দিবে। রাজনীতির সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত সে। চরিত্রের সমস্যা সহ সব খারাপ গুনই তার আছে। আয়েশা সবার ছোট। এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে উঠবে।

তায়িবা সবকিছু নানুর কাছ থেকে শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নানু ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তামিমের দরজায় কড়া নেড়েছেন কিন্তু তামিম দরজা খোলেনি। তায়িবা নানুর খাবার বেড়ে দিয়ে এক প্লেটে ভাত আর মাছের তরকারি নিয়ে নানুকে খেতে বলে ও গেলো এবার তামিমের দরজার সামনে। কোনো কথা ছাড়াই একবার টোকা দিতেই দরজা খুলে গেলো। তায়িবা তাকালো তামিমের গম্ভীর মুখের দিকে। রাগের কারণে ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আছে। তায়িবাকে দরজা খুলে দিয়ে তামিম আবারো রুমের ভিতরে চলে গেলো চুপচাপ। তায়িবা এবার রুমটার দিকে তাকালো। একেবারে অন্ধকার করে রেখেছে রুমটা। রুমটা ছোট হলেও তামিম সবসময় সবকিছু গুছিয়ে রাখে। তবে আজ একটু এলোমেলো মনে হচ্ছে। কারণ রুমে পা রাখতেই মাটিতে পড়ে থাকা কিছুর সঙ্গে পা লেগে গেলো তায়িবার। তায়িবা তা বুঝতে না দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। সত্যিই রুমটার বেহাল দশা। মাটিতে কাপড় জামা সহ বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। টেবিল ক্যালেন্ডারটা ছিড়ে কুটিকুটি করা। টেবিল ল্যাম্পের কাঁচের আবরণ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তায়িবা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তামিমের দিকে।

এমনটা তো কখনোই হয়নি। তামিম তো অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছেলে। রাগ করলে দরজা বন্ধ রাখতো কিন্তু ঘরের অবস্থা তো এমন করতো না। তাছাড়া তামিম তো ভালো করেই জানে চাচির কথা।

তায়িবা ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপরে খাবার প্লেটটা রাখলো। আস্তে আস্তে কাপড় গুলো তুলে হ্যাঙ্গারে রাখলো। বইগুলো গুছিয়ে কিণারায় রাখা ছোট্ট বুকশেলফটায় রাখলো। টেবিল ল্যাম্পের দিকে এগোতে যাবে তখনি বারান্দা থেকে তামিম হুট করে এসে তায়িবার ডান হাতটা শক্ত করে ধরলো। তায়িবা ভ্রুকুচকে তাকালো। তামিমের মুখে এখনো সেই আগের মতোই গম্ভীরতা।
“তোর কি মনে হয় আমি তোর বাবার সম্পদের জন্য তোকে আমার কাছে রেখেছি?”

তায়িবা অবাক হলো না কাঁচের দিকে বাম হাত দিতে চাইলে সেই হাতটাও তামিম নিজের পুরুষালি হাতের মাঝে বন্ধ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
“কি প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দে?”

তায়িবা এবার তাকালো তামিমের দিকে। ফর্সা মুখের গম্ভীরতার ছাপটা বেশ গাঢ়। স্থির চোখের কালো মণিগুলো জানান দিচ্ছে ভিতরের রাগ ক্ষোভ। লম্বাটে নাকটা লাল হচ্ছে ক্রমশ সাথে তিরতির করে কাঁপছে পুরুষালি ঠোঁট জোড়া। স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ অন্য রকম লাগছে। তায়িবা একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আমরা বরং কাল সকালে কথা বলবো। কাঁচগুলো পরিষ্কার করে আমি চলে যাচ্ছি। খাবারটা মনে করে খেয়ে নিও ভাইয়া। তাছাড়া নানু রাতে ঘুমাতে পারবেনা তোমার টেনশনে।”

তামিম তায়িবার হাত জোড়া আরো জোরে চেপে ধরে বলল,
“আমার প্রশ্নের আগে উত্তর দে স্টুপিড।”

তায়িবা একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো।
“যেখানে আমি লোকটাকে নিজের বাবা স্বীকার করতেই চাই না তার সম্পদ তো আমার নিজেরই না। সেখানে তুমি আবার কোথায় থেকে পাবে। আর যা টাকা আছে ওটা আমার মায়ের। যা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।”

তামিম তায়িবার মুখপানে তাকালো। তায়িবা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। তামিম ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই চমকে উঠলো। সাদা মেঝেতে রক্তের দাগ স্পষ্ট। তায়িবার পায়ে কি তাহলে লেগেছে। মুহুর্তেই গম্ভীর মুখে আতঙ্ক ভর করলো। অস্থির কন্ঠে বলল,
“তাইয়ু তোর পায়ে কি হয়েছে? কাঁচ দিয়ে কেটেছে তাই না।”

তায়িবা কিছু বলল না। তামিম তায়িবাকে ধরে বিছানায় বসালো। নিজের বুকশেলফের পাশ থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা টেনে আনলো। পায়ের কাটার জায়গাটা ধুয়ে সাবধানে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বলল,
“ব্যথা করছে?”

তায়িবা মুখ না তুলে ধীরে মাথা নাড়ল,
“না, তেমন কিছু না।”

তামিম থেমে গেল। ওর কপাল ভাঁজ হয়ে গেল গভীর চিন্তায়। তায়িবার চুপচাপ মুখ, নরম সুর, “ভাইয়া” বলা,এইসব শব্দ আজকে কেমন কাঁটার মতো বুকে বিঁধছে।

সে জানে, তায়িবার কাছে সে শুধুই একজন দায়িত্ববান ভাই। তায়িবার চোখে সে কখনোই ভিন্নভাবে আসবে না।

কিন্তু তবুও,তার মন চায়, অন্তত একবার ওর মনের কথাটা বলতে। কিন্তু এখন?

এখন তো সে নিজেই অস্বীকার করেছে। সমাজের কাছে নিজের ভালোবাসাকে কখনোই সে কলঙ্কিত হতে দিতে পারে না। তার ভালোবাসা সবসময়ই পবিত্র ছিলো। সে নিজ হাতে তায়িবার বিয়ে দেবে। অন্য কোনো ছেলের হাতে তুলে দেবে। নিজের অনুভূতিকে বালিচাপা দিয়ে সে তার ভালোবাসাকে কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচাবে। সে আগেই জানতো সে ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসার পূর্ণতা দেওয়া এতো সহজ না।

হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। জানালার দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে চুপ করে রইল।

পেছন থেকে তায়িবা বলল,
“তুমি ঠিক আছো, ভাইয়া?”

তামিম ঘুরে তাকাল না। বরং নিঃশ্বাস টেনে ধীরে বলল,
” তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর। তোর বিয়ে আমি নিজে ঠিক করবো। এমন কাউকে তোর জন্য ঠিক করবো, যে তোকে সম্মান করবে,ভালোবাসবে,তোর স্বপ্নের রাস্তায় তোর বিশ্বাস যোগ্য সঙ্গী হবে, তোর পাশে থাকবে সব সময়। আমার মতো না…”

শেষের কথাটা যেন নিজের মনের অজান্তেই বলে ফেললো তামিম।

তায়িবা তখন বইগুলো তুলে রাখছিল। শেষ কথাটা তায়িবার কানে পৌঁছায়নি।

তায়িবা আবারও মাথা নিচু করে বলল,
“তুমি সব সময় আমার জন্য অনেক বেশি কিছু করো ভাইয়া। আম্মু থাকলে হয়তো তাও এতটা পেতাম না। কিন্তু তুমিই আছো, বলে মনে হয় আমি একা না। জানো, আমায় কখনোই মনে হয়নি তুমি আমার আপন ভাই না…!”

এই কথায় তামিমের বুকটা যেন চেপে আসলো।

সে ঠোঁট কামড়ে বলল,
“তুই যা, ঘুমা এবার। আমি খেয়ে নেবো।”

তায়িবা কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

তামিম ধীরে দরজাটা বন্ধ করল, এরপর দেয়ালের পাশে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার। মনের ভিতরে ঝড় হলে কি আর খাওয়া যায়? বসে পরলো সে মেঝেতেই। দুইহাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে কাটিয়ে দিলো কয়েক প্রহর। তামিম থেকে থাকলেও সময় তো আর থেমে নেই। রাত গভীর হচ্ছে। তামিমের চোখে ঘুম, পেটে ক্ষুধা কিছুই নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুইটা পনেরো।

নিজেকে কোনো মতে টেনে নিয়ে সে বসলো চেয়ারে। টেবিলের ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটা বের করলো। কলম বের করে কাঁপা হাতে লেখতে লাগলো,

[ডায়েরি: রাত ২:১৭ মিনিট]

আজকে ওর চোখে সরলতা ছিল।
আমার চোখে ছিল পাপ।
এই একটা জিনিস আমাকে শেষ করে দিচ্ছে প্রতিদিন।

তায়িবা আমাকে ভাইয়া বলে ডাকে
আমি ঠোঁটে হেসে উত্তর দিই,
কিন্তু ভেতরে ভেঙে পড়ি প্রতিবার।
ও জানে না,
ভালোবাসা কোনো সম্পর্ক মানে না,
ভালোবাসা শুধু গলা চেপে ধরে
নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়।

আমি তোর গলা ছুঁইনি কখনো,
কিন্তু আমার বুকের ভেতরে তুই এমনভাবে জড়িয়ে আছিস যেমন পাঁজরের হাড়ে হাড়ে গেঁথে আছে বিষ।

আমি তোকে ছুঁই না…
কারণ আমি তোকে ভাঙতে চাই না।
তুই যেভাবে আছিস, সেভাবেই তোকে ভালোবাসি।
ভালোবাসা মানে দখল না,
ভালোবাসা মানে, দরকার হলে চোখের সামনে দাঁড়িয়েও নিজেকে অদৃশ্য করে রাখা।

আজকাল রাতে ঘুম আসে না।
তোকে না পাওয়ার কষ্টে কান্না আসে না,
শুধু কেমন একটা ভার ভার লাগে বুকে।
আমি জানি, তুই আমায় ভালোবাসিস না।
আর আমি জানি, আমি তোকে ছাড়তেও পারি না।

তোর হাসি, তোর চুলের গন্ধ, তোর অভিমানী মুখ
সবই আমার পাপ।
আর তুই…!
তুই আমার পবিত্র শাস্তি।

-তোর প্রেমেতে ব্যর্থ পুরুষ
১৫ জুন ২০১৮

তামিম ডায়েরিটাকে বন্ধ করে ফেলল।

#চলবে