#অন্তঃশূন্য
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৫
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)
তাইরা অবাক হয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“মনি তারপর কি হলো?”
তাসফিয়া বেগম নাতি নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“রাত তো অনেক হলো তোমরা আজই কি সব শুনবে নাকি?”
পাশ থেকে ইলহান বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
“মনি বলো তো তুমি। পুরোটা না শুনলে আমরা কোনো কিছুতেই শান্তি পাবো না।”
ইলহানের কথায় তাসফিয়া বেগম হেসে ফেললেন। তিনি হাসি দমিয়ে তাকালেন সিলিং এর দিকে। মাঝে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। কিভাবে সবকিছু তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো তাই ভাবছেন তাসফিয়া বেগম। এইযে আজ তায়িবা আর তামিমের বাচ্চারা কত বড় হয়ে গেছে। তামিমের মেয়েটারই তো আজ আঠারো হয়ে গেলো। তায়িবার ছেলের বয়সও উনিশ পেড়িয়েছে।
একটা তপ্তনিশ্বাস ছেড়ে তিনি আবারো ডুব দিলেন অতীতে।
——-
তামিম সেদিনের পর থেকে আজ দুইমাস হতে চলল তায়িবার দিকে সেভাবে তাকায় না। যদি দুর্বল হয়ে পড়ে এই ভেবে। তায়িবা আগে থেকেই কম কথা বলে। ভার্সিটি থেকে বাসা, বাসা থেকে হাসপাতাল এইটুকুতেই তার সময় চলে যায়। আর বাসায় এসে নানুর দেখাশোনা করা। তবে ভালো খবর হচ্ছে তাসফিয়া বেগম আগের থেকে সুস্থ হচ্ছেন। ডাক্তারের কথায় বাসায় আনা হয়েছে তাকে সপ্তাহখানিক আগে। চেকআপের উপরে রাখতে হবে। তবে ডাক্তার পরিবর্তন করতে হবে তার। আগের ডাক্তারটা দিনাজপুরে সিফট করেছে।
তাই তো তায়িবা সকাল সকাল রেডি হয়ে গেছে। তামিমের অফিসে কাজ আছে বিধায় তাকেই মামুনিকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। কোনোমতে খেয়ে দুইজন মিলে বের হয়েছে।
হাসপাতালে এসে বেশকিছুক্ষণ বসে থাকার পরে তাদের ডাক পরলো। তায়িবা এগিয়ে গিয়ে দরজায় লেখা নামটা পরলো,
“ইসতিয়াক খন্দকার”
তায়িবা দরজায় নক করতে ভিতর থেকে পুরুষালি ভরাট গলায় ইসতিয়াক বলে উঠলো,
“ভিতরে আসুন।”
তায়িবা তাসফিয়া বেগমকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। লোকটার দিকে তাকিয়ে তায়িবার বেশ চেনা চেনা লাগলো। লোকটা মন দিয়ে কিসব জানি লেখছে। ওদের হাতের ইশারায় বসতে বলতেই ওরা বসে পরলো।
ইসতিয়াক নিজের হাতের কাজ শেষ করে হাসি মুখে সামনে তাকতেই চিনে ফেলল তাকে তায়িবা। এটা তো ওই ছেলে যে তার মাথার উপরে পানি ফেলেছিলো। শেষমেষ এই তারছিড়া নাকি ডাক্তার। ভাবা যায়!
তায়িবা কিছু বলল না। চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। জরুরি কথা বলে তাসফিয়া বেগমকে চেকআপ করে ইসতিয়াক এসে বলল,
“সব ঠিক আছে তবে খেয়াল রাখবেন কোনো রকম চাপ উনি আর নিতে পারবে না।”
তায়িবা মাথা নাড়ালো। ইসতিয়াক আরো কিছু কথা বললো। তায়িবা যেন এই আচরণে বেশ অবাক হচ্ছে। এই লোকই তো ঝগড়া করেছিলো তার সাথে। তায়িবারা চলে যেতে নিবে তখনি ইসতিয়াক পিছন থেকে ডেকে বলল,
“মিস.!”
তায়িবা ঘুরে তাকালো। ইসতিয়াক বাঁকা হেসে বলল,
“ঝগড়া করতে কি ভুলে গেছেন?”
তায়িবা ইসতিয়াকের কথায় বুঝতে পারলো লোকটাও তাকে চিনেছে। তায়িবা হাসলো।
“প্রথমে আপনার আচরণে অবাক হয়েছিলাম। আমি না হয় ঝগড়া পারি। আপনি তো ভালোই নাটক পারেন।”
তায়িবার কথায় হো হো করে হেসে উঠলো ইসতিয়াক।
তায়িবা সেদিকে পাত্তা না নিয়ে চলে গেলো। তাসফিয়া বেগমকে রিক্সা দিয়ে বাসায় নামিয়ে সে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। হঠাৎ করেই মাঝ রাস্তায় আটকে গেল সে। তীব্র জ্যাম লেগেছে। তায়িবা সামনে তাকালো।
“কি হয়েছে মামা?”
“কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে হয়তো! এই জ্যাম আর ছাড়ার না।”
তায়িবা ঘড়ির দিকে তাকালো বারোটায় ক্লাস তার। এখন বাজে ১১:৪৭। তায়িবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরলো। হেঁটেই রওনা হলো। বেশ দূর পর্যন্ত এসে জ্যামের একদম মাথায় এসে দেখলো লোকের ভিড়। হাতে সময় নেই কিন্তু কি যেন মনে করে এগিয়ে গেলো সে। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলো একটা মহিলা পায়ে হাত দিয়ে বসে কাতরাচ্ছে। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। সবাই দেখছে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আর একদল রিক্সা আলাকে বকতে ব্যস্ত। মূলত রিক্সাআলাই জোরে রিক্সা চালানোর কারণে অন্য রিক্সার পিছনে ধাক্কা দেয়। সেই টাল সামলাতে না পেরে মহিলাটি পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার পরে পিছন থেকে একটা গাড়ি ওনার পায়ের উপর দিয়ে চলে গেছে।পায়ের ক্ষত বেশ অনেকটাই। রক্ত ঝরছে। তায়িবার বেশ মেজাজ খারাপ হলো দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর উপর। সে এগিয়ে যেতে নিতেই একটা লোক বলল,
“যাইয়েন না। রক্ত বের হয়েছে অনেকটা এটা তো পুলিশ কেস হয়ে যাবে।”
তায়িবা ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পুলিশ আসার আগে যদি ওনার কিছু হয়ে যায় তখন কি করবেন? একজন মানুষকে এভাবে মরতে দিবেন। ছিহ আপনাদের কথা শুনলে মনে হয় আপনারা মানুষই না।”
তায়িবার কথায় লোকটা চুপসে গেলো। তায়িবা ছুটে গেলো মহিলাটার কাছে। মহিলার কাছে গিয়ে দেখলো পা টা থেতলে গেছে একেবারে। তায়িবাকে দেখে মহিলাটা অস্পষ্ট সুরে বলল,
“হাসপাতাল, আমার ছেলে!”
তায়িবা মাথা তুলে বলল,
“কেউ একটু সাহায্য করুন ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
কেউ আগাচ্ছে না দেখে তায়িবা এবার চেঁচিয়ে বলল,
“কিছু বলছি কারো কানে যাচ্ছে না।”
তখনি ভিড় ঠেলে একটা ছেলে এগিয়ে এলো। ছেলেটা আর কেউ না ইসতিয়াক খন্দকার। ইসতিয়াক ওর ড্রাইভারকে ডেকে বলল,
“রহিম চাচা তাড়াতাড়ি আসো।”
রহিমা চাচা এগিয়ে আসতেই ইসতিয়াক আর রহিম চাচা দুইজন মিলে মহিলাটাকে গাড়িতে তুলল। তায়িবাও উঠে বসলো। ইসতিয়াক ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে কাউকে একটা ফোন দিয়ে বলল,
“ইমার্জেন্সি একটা পেসেন্ট আছে। সবকিছুর ব্যবস্থা করো। আর হ্যাঁ ডাক্তার তামান্নাকে রেডি থাকতে বলো।”
ওপরপাশ থেকে কি বলল তা শোনা গেলো না। তবে কল কাটতেই তায়িবা বলল,
“ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব। ওই অমানুষ গুলোর মধ্যে থেকে এগিয়ে আসার জন্য।”
ইসতিয়াক পিছু ঘুরে তায়িবার দিকে তাকালো। মেয়েটার পরনে কালো বোরখা আর হিজাব বাঁধা। চোখ গুলো ব্যতিত আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সেই চোখে মায়ার সাথে আছে একরাশ দৃঢ়তা আর আত্নবিশ্বাস। ইসতিয়াক চোখ সরিয়ে নিলো,
“এটা আমার কর্তব্য ছিলো মিস!”
তায়িবা নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মহিলাটিকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,
“দ্রুত চলুন তো। তায়িবা আমার নাম। মিস মিস না করলেই ভালো হয়।”
ইসতিয়াক চুপ করে গেলো। খানিকবাদেই তারা হাসপাতালে পৌঁছালো। মহিলাটাকে ইসতিয়াক কথাবার্তা বলে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো। মহিলাটার ব্যাগ তায়িবার কাছেই রয়েছে। মহিলাটা কিছুতেই তায়িবার হাতটা ছাড়তে চাইছিলো না। হঠাৎ করেই তায়িবার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মুহূর্তেই সে কেমন যেন অস্থির হয়ে পরলো। যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ওই তো সামনে ছোট্ট একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে অঝোরে কান্না করছে তার মায়ের হাত ধরে। মায়ের নাকমুখ দিয়ে রক্ত পরছে। মেয়েটার মাকে কিছুতেই ছাড়বেনা। যদি তার মা হারিয়ে যায়। তবুও নার্সরা তাকে তার মার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সে তার মাকে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারেনি। না সে একদমই আটকে রাখতে পারেনি তার মাকে। তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে এই বেইমান দুনিয়ার কাছে।
তায়িবা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। সে আর সহ্য করতে পারছেনা। ভিতরের হাহাকার যেন ক্রমেই বের হয়ে আসছে।
তখনি ইসতিয়াক ক্লান্ত ভঙ্গিতে তায়িবার থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে পরলো। তায়িবা চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ইসতিয়াক একপলক তায়িবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর ইউ ওকে মিস তায়িবা?”
তায়িবা ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“হুম”
হাতের ব্যাগটা ভাইব্রেট হচ্ছে দেখে তায়িবা সেদিকে তাকালো। খানিকটা সংশয় নিয়েই ব্যাগের চেইন খুলে একটা ফোন বের করলো। একটা ছেলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভেসে উঠলো। চাপ দাঁড়ি, শ্যাম বর্ণের গভীর চোখের একজন সুদর্শন পুরুষ। তায়িবা কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই অপাশ থেকে গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
“মা কোথায় তুমি? তোমাকে না বাসায় থাকতে বলেছি!”
তায়িবা ধীর গলায় বলল,
“আপনার মা এক্সিডেন্ট করেছে।”
অপরপাশ থেকে বেশকিছুক্ষণ কিছু শোনা গেল না। ভারী নিশ্বাস ফেলে ধীর গলায় লোকটা বলে উঠলো,
“কোথায় আছে এখন?”
তায়িবা বলতেই লোকটা কল কেটে দিলো। তায়িবা কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখতেই ইসতিয়াক বলল,
“ক্লাস না ছিলো তোমার?”
তায়িবা তাকালো ইসতিয়াকের দিকে আকাশী রঙের শার্টের উপরে সাদা এপ্রোন, ঠোঁটে সামান্য হাসি, চোখে চশমা।
“তো আপনি কি এই অবস্থায় কাউকে রেখে ক্লাসে যেতেন!”
ইসতিয়াক জবাব দিলো না। উঠে দাঁড়িয়ে কোথায় যেন চলে গেলো। পনেরো মিনিটের মাথায় একটা লোক দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এলো। লম্বাচড়া বলিষ্ঠ দেহের একজন পুরুষ। বয়স বোঝা যাচ্ছে না তবে পরনে সাদা পাঞ্জাবী। বেশ বড়ো চুল দাঁড়ি লাগছে। চুল গুলো ঘাড় অব্দি ছুঁই ছুঁই।
তায়িবা এগিয়ে গেলো। তায়িবার হাতে মায়ের ব্যাগ দেখে লোকটা তায়িবার দিকে তাকালো। তায়িবা আঙুল তুলে সামনে দেখিয়ে বলল,
“ওখানে আপনার…!”
“মা”
তায়িবা তাকালো এবার লোকটার দিকে। একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আপনার মাকে ইমার্জেন্সি নেওয়া হয়েছে। পায়ে ক্ষতটা অনেক গভীর। রক্তও বের হয়েছে অনেকটা।”
লোকটা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। ইসতিয়াকে দেখে লোকটা এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইসতিয়াক বলল,
“আপনার মার অপারেশন করতে হবে। পায়ের হাড্ডিতে ফ্যাকচার ধরেছে। তবে ভেঙে যায়নি।”
লোকটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে থিয়েটারের দরজার দিকে তাকালো।
“আমাকে কি করতে হবে?”
ইসতিয়াক একটা ছেলেকে ডাক দিলো। লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু ফর্ম ফিলাপ সহ যা কাজ আছে তা ওর সাথে যান ও বুঝিয়ে দিবে। হয়তো পুলিশ ও আসতে পারে। পুলিশের ঝামেলাটা আমি সাময়িক সময়ের জন্য সামলে দিয়েছি।”
লোকটা গম্ভীর গলায় বলল,
“ধন্যবাদ”
ইসতিয়াক মুচকি হেসে বলল,
“আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে ওই মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিন। ও উদ্যোগ না নিলে আপনার মা হয়তো রাস্তায় পড়ে থাকতো পুলিশের অপেক্ষায়।”
লোকটা তায়িবার দিকে তাকালো। তায়িবা চুপ করে বসে আছে। লোকটা সব কাজ শেষ করে তায়িবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ধন্যবাদ”
তায়িবা চোখ তুলে তাকালো।
“ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই।এখানে যে কেউ থাকলে আমি তাকে সাহায্য করতাম।”
লোকটা কপালে ভাঁজ ফেলে মেয়েটার দিকে তাকালো। অস্থির চাহনির মেয়েটাকে বড্ড অদ্ভুত ঠেকলো। লোকটা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ইহসান সায়েফ, আপনি?”
তায়িবা কপালে ভাঁজ ফেলে হাত না মিলিয়েই বলল,
“তায়িবা ইসলাম। তবে আপনার নামটা বেশ চেনা চেনা লাগছে।”
সায়েফ বাঁকা হাসলো।
#চলবে