অন্তঃশূন্য পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
25

#অন্তঃশূন্য
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৬(অন্তিম পর্ব)

আজ তায়িবাদের বাসায় আফসানা বেগম আর ইহসান সায়েফ এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তায়িবাকে আফসানা বেগম নিজের কাছে নিয়ে যেতে চান। সায়েফ মায়ের কথা ফেলতে পারেনি। কারণ তায়িবাকে প্রথম দেখায় কেমন কৌতূহল হয়েছিলো তার। সেদিনের পরে প্রায় দুইমাস গোপনে তায়িবার দিকে নজর রেখেছে সে। যা কেউ জানেনা। তামিমের ব্যাপারটাও জানা শেষ সায়েফের। তবুও তার তায়িবাকেই চাই। কারণ তায়িবা তো আর তামিমকে চায়না। তাছাড়া তামিমও একটা ভালো ছেলে খুঁজছে। তার কারণও সে জানে। সবটা জেনেই সে এসেছে এখানে। তায়িবাকে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিয়ে আনা হলো। এই প্রথম তায়িবাকে সামনাসামনি দেখলো সায়েফ। এর আগে তার মায়াবী মুখখানা সামনাসামনি দেখা হয়নি।

তামিম সেই তখন থেকে মাথা নিচু করে বসে আছে। বুকের ভিতরে চিনচিন করছে তার। এই একতরফা ভালোবাসা তাকে হয়তো পুড়িয়ে মারবে। সায়েফ একপলক তামিমের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“আমি তায়িবার সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাই।”

তামিম কিছু বলল না। চুপ করেই আছে তার। চুপ করে থাকবে নাই বা কেন তার কানে তো কোনো কথা যাচ্ছেই না। মনের ঝড়ের আওয়াজে কানে কিছু শুনতে পারছেনা সে। রানু বেগম বললেন,
“তায়িবা তোর রুমে নিয়ে যাহ ওকে।”

সায়েফ উঠে দাঁড়ালো। তায়িবা ওকে নিয়ে নিজের রুমে আসলো। সায়েফ ছোট্ট রুমটাতে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো। টেবিলে থাকা বিভিন্ন বইগুলোর মধ্যে চোখ পরতেই হাসলো সে। এগিয়ে গিয়ে একটা বই তুলে নিয়ে বলল,
“বাহ আমার লেখা বই পড়া হয় দেখছি?”

তায়িবা চোখ তুলে তাকালো। অবাক হয়ে বলল,
“মানে!”

সায়েফ হেসে চেয়ার টেনে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে বলল,
“আমিই এই বইয়ের লেখক ইহসান সায়েফ।”

তায়িবা চোখ বড় বড় করে বলল,
“নিজের বাবাকে হত্যার অপরাধে জেলে গিয়েছিলো সেই ইহসান সায়েফ।”

সায়েফ হাসলো। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বলল,
“হুম আমিই সেই। নিজ হাতে আফসানা ইহসানের হাসবেন্ডকে খুন করেছি। যে আফসানা বেগমকে বোকা বানিয়ে একাধিক মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে ছিলো এবং হাসপাতালে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করতো।”

তায়িবা সায়েফের সামনাসামনি বিছানায় বসলো। গালে হাত দিয়ে বলল,
“আপনার লেখাগুলো অনেক সুন্দর।”

সায়েফ ভ্রুকুচকে তায়িবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তো মনে করেছিলাম তুমি রিয়েক্ট করবে।”

তায়িবা হাসলো।
“আমার বাবার কারণে আমার মা মারা গেছে জানেন।”

সায়েফ হাতের বইটা রেখে মনোযোগ সহকারে তায়িবার দিকে তাকালো।

তায়িবা মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
“আমার বাবার সম্পদের অভাব ছিলো না। আমার মা ছিলো তার কাছে নাম মাত্র বউ। ওই লোকের সম্পর্ক ছিলো একটা তার সহকারীর সাথে। আমার মা যখন বুঝতে পারে তখন থেকেই তাদের মাঝে ঝামেলা হতে থাকে। তখন আমি অনেকটাই ছোট ছিলাম। ওই লোক আমার দিকেও ভালো করে তাকাইনি। আমার দাদা এসব জানতে পেরে ওই লোকের ভাগের সম্পদ আমার আর আম্মুর নামে করে দেয়। সেই রাগে ওই লোক আমার মাকে লোক দিয়ে এক্সিডেন্ট করায়। আমার আম্মু আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। তারপর থেকে আমি মামুনির কাছে। তাই কোনো রিয়েক্ট করিনি। আসলে আমাদের অতীত একই। তবে আপনি যা করতে পেরেছেন আমি তা করতে পারিনি। এই আর কি?”

সায়েফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তাহলে বিয়েতে তো তোমার কোনো আপত্তি নেই?”

তায়িবা সোজাসুজি উত্তর দিলো,
“না কারণ আপনার মা সহ পুরো পরিবার চায় আমাদের বিয়েটা চায়। এখানে আপত্তির কিছু নেই।”

সায়েফ বাঁকা হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ডান হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে বলল,
“তাহলে রেডি হয়ে নেও মিসেস সায়েফ। আজকেই আমাদের বিয়ে হবে।”

বলেই সে চলে গেলো রুম ছেড়ে। তায়িবা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো।
তায়িবা গোলাপি বেনারসি পরে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। ঠোঁট কাঁপছে তার, কিন্তু চোখে জল নেই।

ইহসান সায়েফের গলার আওয়াজ এখনো কানে বাজছে,
“রেডি হয়ে নাও মিসেস সায়েফ।”

একটু পরেই তামিম এলো তার রুমে।তার পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ আছে । আজ অনেকটা চুপসে গেছে সে। এই সম্পর্কের বাইরে দাঁড়িয়ে কেবল দেখছে তায়িবার নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে।
তার চোখে জল নেই, কিন্তু ভিতরে অনেক কিছু ভেঙে যাচ্ছে।

তায়িবা মুখ ফিরিয়ে বলল,
“তুমি খুশি তো?”

তামিম হেসে বলল,
“তোকে কেউ বুঝবে এমন একজনকে পেয়ে গেলে আমি কেন খুশি হব না?”

তায়িবার চোখ চিকচিক করে উঠলো।
সে আর কিছু বললো না। দুজনের মাঝখানে থাকা নীরবতা আজ চিরতরে থেকে যাবে।

সাদামাটা হলেও খুব গম্ভীরভাবে বিয়েটা হলো।
সায়েফ কাবিননামায় সই করলো এক নিঃশ্বাসে। তায়িবাও এক মুহূর্ত থেমে সই করে দিলো।
তাদের পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ছিল তামিম।

———-

তায়িবা আর ইহসানে বিয়ের একবছরের মাথায় বিয়ে হয় তামিম আর আয়েশার। আয়েশার বাবা মা দুইজনই এক্সিডেন্টে মারা যায়। এরপরে আয়েশা তায়িবার কাছে আসলে তায়িবা বিয়ের ব্যবস্থা করে।

তামিম তায়িবার কথায় রাজি হয়ে যায়। তাছাড়া তায়িবাও এখন বেশ ভালো আছে সায়েফের সাথে। সায়েফ তায়িবাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তায়িবার চোখেও সায়েফের জন্য ভালোবাসা দেখেছে তামিম। এরপরে আর কিছু বলার থাকে না। তাই কোনো কথা ছাড়াই রাজি হয়ে গেছে সে। তাসফিয়া বেগমও ভালো হয়ে গেছে।

তামিম তায়িবাকে ভুলতে চেষ্টা করছে আয়েশার হাত ধরে।

তায়িবা নিজ দায়িত্বে আয়েশা আর তামিমের বিয়ে দিয়েছে।

পরবর্তীতে তাসফিয়া বেগম সবকিছু জানতে পারে রানু বেগমের মাধ্যমে। কারণ রানু বেগম মুখে কিছু না বললেও সবটা জানতেন।

————-

তাসফিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাইরা আর ইলহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে বুঝলে। এখন দেখছো তো তামিম-আয়েশা আর তায়িবা-সায়েফ কতো ভালো আছে।”

ইলহান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“মনি আমি তোমার কথার অর্থ বুঝে গেছি। আমি ওই বুচিকে বিয়ে করবো।”

তাইরা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“এই পেটপাতলা আমাকে বুচি বলবি না।”

ইলহান মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বুচিই বলবো।”

“বল বল তোরই বউ হবো।”

“তো কি তখনো তোকে বুচি বউ বলেই ডাকবো।”

তাসফিয়া বেগম হাসলেন ওদের ঝগড়া দেখে।
“আচ্ছা বাবা ডেকো। এখন যাও ঘুমাও গিয়ে। অনেক রাত হয়েছে।”

মনির থেকে বিদায় নিয়ে ওরা দুইজন চলে গেলো। ওরা রুম থেকে বের হতেই রুমে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো তামিম, আয়েশা, তায়িবা আর সায়েফ। ওদের দেখে তাসফিয়া বেগম বললেন,
“ওরা রাজি হয়ে গেছে। ওরা ভালোবাসে একজন আরেকজনকে কিন্তু বুঝতে পারেনা। একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেও পারেনা। আবার ঝগড়াও করে। দিনে দিনে বুঝবে। তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা করো।”

তাসফিয়া বেগমের কথায় চারজন মিলে ধপ করে বসে পরলো বিছানার উপর। খানিকবাদে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল।

সায়েফ তায়িবার হাত ধরে তামিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বেয়ান সাহেব নিজের বউকে তুলুন আর নিজের রুমে চলুন অনেক রাত হয়েছে।”

বলেই তায়িবাকে নিয়ে চলে গেলো সায়েফ। তামিম হাসলো। আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলো বউ রুমে যাই।”

ওরা দুইজনও চলে গেলো। তাসফিয়া বেগম মনে মনে দোয়া করলেন,
“আল্লাহ তুমি সবাইকে ভালো রেখো।”

তায়িবা রুমে এসে চেঁচিয়ে বলল,
“এটা কি করলেন আপনি? বয়স তো আর কম হলো না।”

“কেন বউ কি হয়েছে?”

তায়িবা রাগী গলায় বলল,
“ওখানে মামুনি ছিলো আর আপনি ওমন করে আমাকে নিয়ে এলেন।”

সায়েফ তায়িবাকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলো। তায়িবা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তায়িবার ঠোঁটের উপরে তর্জনী ঠেকিয়ে বলল,
“আর কোনো কথা নয় বউ। তোমার স্বামীটার ঘুম পেয়েছে।”

তায়িবা মুখ বাঁকালো। সায়েফ মুচকি হেসে তায়িবার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায় বউ।”

তায়িবা মুচকি হেসে সায়েফের নাক টেনে বলল,
“আমিও ভালোবাসি আপনাকে বর মশাই।”

——–

তামিম আয়েশাকে নিয়ে ঘরে এসে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো। চোখ বুজতে নিবে তার আগেই আয়েশা বলল,
“তায়িবা আপুকে এখনো ভালোবাসেন?”

তামিম চোখ ছোট ছোট করে আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো তো বাসি তবে তোমার থেকে বেশি নয়। কারণ তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। তুমি আমার শেষ জীবনের সঙ্গী। তুমি আমার শূন্য মনের প্রশান্তির হাওয়া।”

আয়েশা মুচকি হেসে তামিমের বুকে মুখ গুজলো। তামিম মুচকি হেসে আয়েশা কপালে চুমু বসিয়ে বলল,
“ঘুমিয়ে যাও বউ। কাল সকালে তোমার মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বহুত খাটনি আছে।”

#সমাপ্ত
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।গল্পটা কেমন হলো কমেন্টে বলে যাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।)