ঘিয়ে ভাজা পরোটা পর্ব-০২

0
21

#ঘিয়ে_ভাজা_পরোটা
#দ্বিতীয়_পর্ব
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা

Feminine Wisdom

পেটটা আজ খুব ভার লাগছে! নাড়াচাড়া বড্ড কম! মনে পড়ল অনেকক্ষণ কিছু খায়নি রুহি! কাল রাতে সেই যে সব উগলে দিল, তারপর থেকে না খাওয়া।

“কই রে তুতান, হলো!” দরজার সামনে থেকে হাঁক দিচ্ছে প্রতিভা! প্রতিভার এই একটা ভালো দিক — যে কাজের দায়িত্ব নেবে, খুব সুন্দর করে সামলাবে! এত তাড়া দিচ্ছে যে আজ তুতান বাস আসার আগেই রেডি হয়ে গেল! জুতো-মোজা একাই পরে তুতান! না, কিছু শেখায়নি রুহি! বলেওনি — “নিজের কাজ নিজে করো!”
এখন এই শিক্ষাটাই যেন বড় অপরাধ হয়ে যাবে!

তাই অপেক্ষা করছে রুহি! আর মাস খানেক পর যখন নার্সিংহোমে ভর্তি হবে রুহি আর তুতান দেখবে কেউ নেই ওর কাজ করার জন্য, আপনিই শিখে যাবে! প্রতিভাই শিখিয়ে দেবে নাতিকে! কারণ রুহি জানে, এই পরিবারে রুহি একাই যা কাজ করে, প্রতিভার পক্ষে তা করা সম্ভব না! আর সেই সব কারণেই এত আপত্তি ওঁনার — রুহির দ্বিতীয় সন্তান আসার ক্ষেত্রে!
শুধু প্রতিভা না, কেউই বিষয়টা ভালো চোখে দেখেনি!
অমর তো বলেই বসলো —
“এই যুগে দুটো বাচ্চা মানুষ করা কিন্তু সহজ নয়! একজনকে যেটুকু কম দেবে, তাতেই অভিযোগ!”

ইচ্ছে হচ্ছিল রুহির — বলবে, “তুমি আর তোমার বোন তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছো, আর তোমার দাদা গ্র্যাজুয়েশন করে কত বছর বসে ছিল! তারপর কীসব কোর্স করে তবে একটা চাকরি! আজকে বেশ ভালো জায়গাতেই আছে সমর, কিন্তু লড়াইটাও বেশ কঠিন!”

“মা, জুতো পরে নিয়েছি, দেখো!” — তুতানের কথায় রুহি দেখল, বেশ গুছিয়েই পরেছে।
না, শেখায়নি রুহি! শুধু সহবত জ্ঞানটা শিখিয়েছে! দরদ শিখিয়েছে! শিখিয়েছে অন্যের কষ্টে কষ্ট পেতে! যেটা না শেখালে, বোধহয় তুতান শিখতো না! এই পরিবারেরই তো গাছ! কত ভালো আর ফল দেবে!
তুতান রুহির শিক্ষাটা নিয়েছে! ও জানে, ওর বনু আছে মায়ের পেটে! ঠিক ক্যাঙারুর মতো? জিজ্ঞেস করেছিল তুতান!
রুহি হেসে হ্যাঁ বলেছিল, সাথে এটাও বলেছিল — “বনু আছে বলেই নিচু হতে কষ্ট হয় মায়ের!”

ব্যাস, তারপর আর বলতে হয়নি! মোজা, জুতো — সব সুন্দর করে সামলায় ছেলে! এই এক মাসে জামা পরা, ব্রাশ করাও শিখিয়ে দেবে রুহি!
এক মাস পর যে কতদিনের ছুটিতে যাবে, ও নিজেও জানে না!
সমর অবশ্য থাকবে ওইসময়! এটুকুই ভরসা!

“মা, আসলাম!” — বলেই হাত নাড়িয়ে টাটা করলো তুতান!
জড়িয়ে আদর করে দিল রুহি!
ওর মনে যেন কখনো না হয়, মা বনুকে ভালোবাসে! যদিও এই ধারণা তৈরির জন্য কম মাথা নেই বাড়িতে! আর বিষয়টা যখন সবার অপছন্দের!
বাসের হর্ন শুনতে পাচ্ছে রুহি! ছেলেকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়েই সোজা রান্নাঘরে!
এক কৌটো চালের ভাত হয়ে গেছে এতক্ষণে! হয়তো নরমও হয়ে যেতে পারে!
একটু দ্বিধা নিয়েই রান্নাঘরে গেল রুহি!

ভাতটা হয়ে গেছে, কিন্তু নরম হয়নি! তাড়াতাড়ি ফ্যান ঝাড়তে দিয়ে দিল!
কিন্তু পেটে তো আজ কোনো সাড়া নেই! আট মাস চলছে!
প্রতিদিন তো ছটফট করে! কী হলো আজ?
ভেবেই ঢকঢক করে দু’গ্লাস জল খেল রুহি!
“কী গো, হলো ভাত? অমর কিন্তু ঘুম থেকে উঠে গেছে!”
রুহি দেখল দরজায় প্রতিভা!

“মা, জানো বাচ্চাটা নড়ছে না কাল রাত থেকে!” — একটু ভয় পেয়েই বলে দিল রুহি!
ইচ্ছে ছিল না বলার! কিন্তু বড্ড ভয় লাগছে!
প্রতিভা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল রুহির দিকে! তারপর বলল —
“সারারাত ঘুমানোর পর বাচ্চারা একটু অমন নেতিয়ে যায়! পরোটা টা করে, একটু দুধ-বিস্কুট খাও! দেখবে ঠিক লাগবে! তারপর একটু জিরিয়ে নাও! রিনি উঠলে আবার দেখা যাবে!”

প্রতিভার মুখ মিষ্টির জন্য ওর ওপর রাগ থাকে না রুহির!
এ তো শাশুড়ি! এঁরা এরকমই হয়!
কিন্তু মা! ফোনে খবরটা দিতেই বলল —
“কী দরকার ছিল মান্তু এসবের! ভগবান তো প্রথমেই ছেলে দিয়ে দিয়েছিল! এগুলোকে আদিখ্যেতা বলে! মেয়ে মেয়ে করে মরে যাচ্ছিস যেন! মেয়ে হলে বুঝবি কী জ্বালা!”

কেঁদে ফেলেছিল রুহি!
জেদও চেপে গেছিল!
মেয়ের শখ ছিল রুহি আর সমরের! পরিকল্পনা করেই নিয়েছিল!
আসলে ভাবনাটা অনেক দিনের! শুধু আনতে পারছিল না সমরের প্রমোশনের জন্য!
খুব শিক্ষিত নয় রুহি, কিন্তু এটুকু শিক্ষা ওর আছে যে একটা বাচ্চাকে আনলেই হলো না — তার যত্নটুকু যথাযথ হতে হবে!
সমরকে একটু বেশিই বাইরে থাকতে হয় ঠিকই, কিন্তু রুহি ভেবেছিল, মাকে নিয়ে আসবে আর তাহলে অনেকটা সমস্যা মিটবে!

কিন্তু মাকে ফোন করা মানেই এক কথা —
“বাজে সিদ্ধান্ত! একদম ঠিক হয়নি!”
তাই আজকাল আর জ্বালায় না মাকে!
থাকুন উনি ওঁনার সেবা সমিতি নিয়ে!
যদিও এই ‘সেবা’র মানে বোঝে না রুহি — যেটাতে ঘরের লোকই সেবা পায় না, সেই সেবার মানে কী!

পরোটা গুলো করে আলু চচ্চড়ির সাথে সাজিয়ে দিল অমরের টিফিন বক্স!

গ্যাসে ততক্ষণে আলু, ডিম সব সেদ্ধ হয়ে গেছে!
চারটে ডিম বের করে দিয়েছে প্রতিভা! রিনি, রুহি, অমর আর তুতান!
স্কুল থেকে সাড়ে এগারোটায় চলে আসে ও! এসেই খিদেতে ছটফট করে!
ফিরিয়ে আনা টিফিন টুকু কিছুতেই খাবে না! তাই ওই সময় ফল, ডিম সেদ্ধ — এইসবের ব্যবস্থা করে প্রতিভা!
হ্যাঁ, খাবারের ব্যবস্থা প্রতিভাই করে! ওই যে হিসেবটা নিজের হাতে রাখে!
ওঁ যদিও নিরামিষ খায়, কিন্তু প্রাণীজ পুষ্টির কোনো অভাব রাখতে দেয় না বাড়ির সদস্যদের!

পাশে রাখা ফোনটা বাজছে!
সমর!
ঠিক সাতটা নাগাদ ফোন করে সমর! এই সময় অফিস যাবে বলে তৈরি হয়!
দূর থেকে যেটুকু সম্ভব খেয়াল রাখা যায় আর কী!

“জানো, আজ একদম নড়ছে না!” — ফোন ধরতেই বলল রুহি!
সমর হেসে বলল — “শেষের দিকে তো এমনই হয়! ডাক্তার বলেছিল!”
“না গো, বাচ্চাটা সত্যি নিস্তেজ হয়ে গেছে!” — ভয় নিয়ে বলল রুহি!
“খাওনি কিছু? কাল রাতে ওতো বমি করলে যে!” — সমর বলতেই রুহি বলল —
“এই তো, ছেলে স্কুলে গেল, ভাই সাইটে যাবে, ওরটা গুছিয়ে একটু ওই হেলথ ড্রিংকটা খাবো!”

রুহির কথায় রেগে গেল সমর!
“ভাই সাইটে যাবে, ছেলে স্কুলে যাবে, সেইসব দেখতে গিয়ে খালি পেটে থাকলে তো হবেই! বাচ্চা নিস্তেজ! এই সময় খাবার চাই ওর! উফফ, দ্বিতীয় বাচ্চার মা তুমি! কে বলবে! একটু বুদ্ধি রেখে কথা বলো!”
সমরের কথায় কান্না পাচ্ছে রুহির!

বোকা, মূর্খ — এগুলো বলতেই থাকে সমর!
গায়ে মাখে না রুহি! কিন্তু আজ!
সত্যি, ও মূর্খ!
এই বাড়িতে সবাই শিক্ষিত! অমর, রিনি, সমর — শুধু যেন রুহিই কিছু করে উঠতে পারেনি!
শুধু সংসার আর সংসার! সং হয়ে আছে!

বারবার কান্না পাচ্ছে রুহির! বুঝতে পারলো বোধহয় সমর!
শান্ত স্বরে বলল —
“শোনো, আগে কিছু খাও! পেট ভরে খাও! যেটা ইচ্ছে করছে খাও! মনে রাখবে বমি করা যাবে না! দরকার পড়লে আগে একটা বমির ওষুধ খেয়ে নাও! তারপর খাবার খেয়ে ভাই বেরিয়ে গেলে টানা ঘুমাও! ততক্ষণে নিশ্চয়ই মায়ের পুজো হয়ে যাবে! আর তারপর যদি ভালো না লাগে, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করো, একটা ক্যাব বুক করে চলে যাও!”

সমরের কথায় সাহস পাচ্ছে না রুহি!
আরও ভয় লাগছে! ক্যাব, ডাক্তার — এইসব সমরই করে!
সময় সময়ে এসে ঠিক এইটুকু করে দেয়!
ও পারবে এতকিছু?
যদিও রিনি আছে বাড়িতে! ও খুব ভালো পারে এইসব! কী সুন্দর গাড়ি বুক করে, একা একাই চলে আসে!

“শুনছো? আগে খাও! আমি ন’টা নাগাদ ফোন করছি!” — বলেই ফোন রেখে দিল সমর!

কী খাবে বুঝতে পারছে না রুহি! যেটা খাবে বলে ভাবছে, সেটাই অরুচি লাগছে!
সামনে রাখা ময়দা মাখা! বড়ো ঘিয়ের কৌটো!
খুব ইচ্ছে করছে দুটো ঘিয়ের পরোটা খেতে!
ভাবার সাথেসাথেই লেচি কেটে বেলতে শুরু করল!

ওর ইচ্ছে করছে মানে, পেটের ভেতরে থাকা প্রাণটার ইচ্ছে করছে!
কিন্তু প্রাণটা সাড়া দিচ্ছে না কেন? এরকম তো করে না!
জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে রুহি!
না, পারছে না ও!
আটকে যাচ্ছে! কষ্ট হচ্ছে খুব!

“বৌদি কী দারুণ গন্ধ বেরিয়েছে পরোটার! খিদে পেয়ে গেল! দেবে দুটো?” — রিনি ঘুম থেকে উঠে এসে রুহির গলা জড়িয়ে বলল!
রুহি কথা বলতে পারছে না!
ও নিজের জন্য বানানো পরোটা দুটো ইশারায় দেখিয়ে ঘরে চলে এল!

মাথা ঘুরছে, চোখ অন্ধকার!
পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলেই যাচ্ছে —
“সোনা, একটু হাত-পা নাড়িয়ে বল, তুই ভালো আছিস! আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে! ভয় করছে!”

খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল রুহি!
কিছু খেতে ভালো লাগছে না!
তীব্র ভয় আর অরুচি!
খাক, রিনি পরোটা দুটো!
ওর পেটেও তো প্রাণ আছে!
ওর যত্ন হোক!

শরীরটা ঠিক হলে, দুটো পরোটা ঠিক ভেজে নেবে নিজের জন্য রুহি!

“তুই শুধু সাড়া দে!” — বিড়বিড় করছে রুহি!

না, নড়ছে না!
শক্ত হয়ে গেছে পেটটা…

চলবে।