#হৃদয়_মাঝে_হঠাৎ_তুমি
#সানা_শেখ
#পর্ব_6
[কার্টেসি ব্যতীত কপি করা নিষিদ্ধ]
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে লম্বা শ্বাস টেনে নেয় আলভী। শিস বাজাতে বাজাতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শিস বাজালে টেনশন কমে আলভীর, রিল্যাক্স ফিল করে তখন।
গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বির বির করে বলে,
_ আলভী তোর ইগো খুব শীগ্রই তোকে বউ ছাড়া করবে। বউয়ের আদর পেতে চাইলে দ্রুত ইগো কে নিজের জীবন থেকে আউট কর। নয়তো তোর বউ গেল।
দেশে আসার আগে যা যা বলেছিল আর শর্ত দিয়েছিল সেসবের পর কোন মুখে এখন বলবে “আমি তালাক দেবো না। মায়ার সাথেই সংসার করবো আমি”। জোর করে আলভী বলতে চাইলেও ওর ইগো বার বার বাধা দিচ্ছে। এক কথা একবার বলে এখন আরেক টা বলতে পারছে না।
বাড়ির কেউ তো একটা বার বলতে পারে “আর একবার ভেবে দেখো আলভী। কোনো ভাবে মায়ার সাথে জীবন টা পাড় করা যায় না?”
কেউ তো একটা বার বলতে পারে এই কথা গুলো। এত দিন তো খুব বলতে পেরেছে এখন কেন বলছে না?
খাবার খাওয়ার সময় ভেবেছিল সকলের মুখের উপর বলে দেবে মায়া কে তালাক দেবে না। কিন্তু যখন বলার সময় হলো তখন আর বলতে পারল না। তাই রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে নিজেকে বোঝালো এমন করলে চলবে না। বলতে হবে কিন্তু ওই যে ইগো। এই ইগো ওকে বলতে দিচ্ছে না। কি করবে বলবে বুঝতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন এই কাঠফাটা রোদে হাঁটছে।
,
,
ছেলের উপর রেগে আলতাফ মাহমুদ ছেলে কে গালাগালি করেন। সামনে পেলে এখন জুতো পেটা করতেন বোধহয়। বাড়িতে আসার আগে হম্বিতম্বি করলো, শর্ত দিলো। আর এখন? রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে জান। এখন তৈরি হয়ে অফিসে যাবেন। বাড়িতে থাকলে রাগ হুহু করে বাড়তেই থাকবে।
ভেবেছিলেন ছেলে টা বোধহয় ভালো হয়ে গেছে। শুধু ওনাদের উপর রেগে আছে। কিন্তু এই ছেলে তো ছোট বেলার চেয়েও বেশি বজ্জাত হয়ে গেছে। সবাই কে নিজের পেছনে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে বোধহয়। তালাক দেবে না, সংসার ও করবে না। ঝুলিয়ে রেখেছে যেন কোথাও বিয়ে দিতে না পারে। প্রতিশোধ নিচ্ছো বোধহয় সকলের কাছ থেকে। তিনিও প্রতিজ্ঞা করেন , আজকে অফিস থেকে ফিরে রাতে আলভীর ঘাড় ধরে তালাক বলিয়েই ছাড়বেন।
আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই মায়া কে অন্য জায়গায় বিয়ে দেবেন।
নিজেদের ভুলের কারণে ছেলের কাছে নত হয়ে ছিলেন। নরম পেয়ে তো ছেলে এখন পিন্ডি চটকাচ্ছে ওনার।
আলতাফ মাহমুদ এর পেছন পেছন ঐশী রহমান ও রুমে চলে জান।
নাহার বেগম নিজেও রুমে চলে জান।
সানজিদা মেয়ে কে নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে যায়। মাহির ভীষণ রেগে আছে।
একে একে সবাই ড্রইং রুম থেকে চলে যায়। শুধু বসে রইলেন মেহবুবা মেহের। তিনি উঠছেন না সোফা থেকে। ওঠার শক্তিই বোধহয় পাচ্ছেন না। গত কাল থেকে কথা বলতে পারছেন না ঠিক ভাবে। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। মেয়ের মলিন মুখ তাকে ভীষণ পিড়া দিচ্ছে ।
তেরো বছর আগে ছোট জা যখন কেঁদে কেঁদে ইমোশনাল হয়ে তাকে বলেছিল মায়া কে সে ছেলের বউ করতে চায়। মেহবুবা মেহের প্রথমে রাজি হননি। তিনি জানেন আলভী মায়া কে পছন্দ করে না। ঐশী রহমান এর কথা ছিল “এখন পছন্দ করে না তো কি হয়েছে বড় হয়ে করবে। ওরা তো এখনো ছোট তাই এখন এমন । বড় হলে দুজনেই তো পরিবর্তন হবে। মায়ার স্বভাব পরিবর্তন হবে। এখন বিয়ে পরিয়ে রাখবে , বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মায়া আলভীর বউ হলে আলভীর মন আস্তে আস্তে পরিবর্তন হবে। মায়া কে ভালোবাসতে শুরু করবে।
সবাই বোঝানোর পর তিনি রাজি হয়ে জান আর সেদিনই বিয়ে টা হয়ে যায়।
নিজেদের একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আলভী এত গুলো বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল প্রায়। মায়া ছোট থেকেই বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন কটু কথা শুনেছে। অনেক আত্মীয় স্বজন আর আশে পাশের অনেকেই জানতো আলভী আর মায়ার বিয়ের কথা। এক কান দুকান করে হাজার হাজার মানুষ জেনে গিয়েছে ওদের দুজনের বিয়ের কথা। তারাই সুযোগ পেলে দুই চার টা কথা শুনিয়ে দিতো মায়া কে। যদিও পরিবারের কারো সামনে বলতে পারতো না। মায়া কে একা পেলে বলতো। স্কুল কলেজ আর এখন ভার্সিটি তেও ক্লাসমেট দের কাছে শুনতে হয় “বিয়ে করে বর ফেলে রেখে চলে গেছে। দ্বিতীয় বার দেখতে আসেনি কথাও বলেনি। আর কোন দিন আসবেও না। কোন সুন্দরী বিদেশিনী কে বিয়ে করে নিয়েছে নিশ্চই”।
আগে কেউ কিছু বললে একা একা কাদত। আস্তে আস্তে বাইরের মানুষদের সাথে মেশা বন্ধ করে দেয়। বাড়ি থেকেও বের হতে চাইতো না। কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যেতে চাইতো না। স্কুল কলেজে যেতে চাইতো। সারা বছর টিউশন টিচার বাড়িতে এসে পড়াতো। শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিতো।
ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার পর থেকে কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করে।
ছোট বেলায় মায়া চুপ চাপ সব শুনলেও বড় হওয়ার পর থেকে কেউ কিছু বললে মুখের উপর জবাব দিয়ে দেয়। মানুষের বিভিন্ন কথার কারণে নরম মনের মায়া শক্ত আর খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে। কেউ কিছু বললেই খ্যাক খ্যাক করে, ছ্যাত করে ওঠে এখন। রাগ যেন থাকে নাকের ডগায়। বাড়ির কারো সাথে সেভাবে কথা বলে না এখন আর। তবে চঞ্চল আর ছটফটে স্বভাব টা এখনো আছে। এই স্বভাব টা পরিবর্তন করতে পারেনি।
রাগ উঠলে সেই রাগ প্রয়োগ করে ছোট ভাই মাহিদ এর উপর। মাহিদ ও ওকে খ্যাপায়, মায়াও খেপে যায়। ধরতে পারলেই হলো, বড় ভাই তো কি হয়েছে? রাগ মিটিয়ে ইচ্ছে মত ক্যালানি দেয়।
গত কাল মায়া ফ্রিজ থেকে পানি খেতে গিয়েছিল। মাহিদ ওর হাত থেকে পানির বোতল কেড়ে নিয়ে আগে খেয়েছে। ব্যাস হয়ে গেল, মায়া রেগে ওকে মা র তে গেলে দৌড় শুরু করে মাহিদ। মায়া হাতের কাছে ডিম পেয়ে সেটা নিয়েই দৌড় শুরু করেছিল। আর ছুঁড়ে
মে রে ছিল আলভীর মাথায়। বেচারার এত গুলো বছরের ভুলের শাস্তি মায়া মাথায় ডিম ফাটিয়ে উদ্ভবন করেছে। আরো কি কি আছে কপালে কে জানে?
,
,
মায়া নিজের রুমে চুপ চাপ বসে আছে খাটে। দুই চোখ বেয়ে টুপ টাপ গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ নোনা জল। কেন যে এত কষ্ট হচ্ছে? কষ্ট গুলো ঘুরে ফিরে বার বার কেন ওর কাছেই আসে শুধু?
চোখের পানি মুছে নেয়। কাঁদবে না আর, কেন কাদবে?কার জন্য কাঁদবে? কেউ ছিল না, নেই। সব দুঃস্বপ্ন আর ছোট্ট একটা ভুল।
আলতাফ মাহমুদ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে নিয়েও হলেন না। ড্রেস রেখে খাটে বসে পড়েন। খাটের অন্য পাশে মলিন মুখে বসে আছেন ঐশী রহমান। চোখ দুটো এখনো পানিতে টুইটুম্বর। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,
_ গত কাল থেকে মুখের এই হাল করে রেখেছো কেন?
_ আলভী কে আর একটা বার বোঝানো যায় না? ও এরকম করছে হয়তো মায়া কে তালাক দিতে চাইছে না। মুখ ফুটে বলতে পারছে না তাই এমন করছে।
_ তুমি ওকে জন্ম দিলেও এখনো চেনোনি ঐশী। ওর মস্তিষ্কে নিশ্চই কোন বদ বুদ্ধি এটে রেখেছে। প্রতি শোধ নেবে আমাদের সকলের কাছ থেকে।
_ তুমি ভুল বুঝছো ওকে।
_ একদম না। ঠিক বুঝেছি আমি।
_ আর একটা বার বলে তো দেখি!
_ আমি কিছু বলতে পারবো না।
_ আমি বলবো।
একটু চুপ করে রইলেন। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বসা থেকে উঠে বলেন,
_ ঠিক আছে যা বলতে ইচ্ছে বলবে।
_ কোথায় যাচ্ছো?
_ আসছি।
রুম থেকে বেরিয়ে জান আলতাফ মাহমুদ। প্রবেশ করেন মায়ার রুমে। রুমে মায়া কে দেখতে না পেয়ে বেলকনিতে উঁকি দেন।
নিচে গেল নাকি?
পেছন ফিরতেই দেখেন মায়া ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে।
_ কিছু বলবে আব্বু?
_ হুম কিছু কথা ছিল তোর সাথে।
_ বলো।
_ খাটে বোস আগে।
মায়া হাত মুখ মুছে খাটে বসে। ওর পাশে বসেন আলতাফ মাহমুদ।
ঐশী রহমান ঝিম ধরে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। আবেগের বশবর্তী হয়ে পনেরো বছর আগে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন কাউকে বলেননি মনের কথা।
নিজের মনের কথা মনের ভেতরেই রেখে দিয়েছিলেন।
তেরো বছর আগে ওনার কানে খবর আসে আলভী পাশের বাসার ছোট মেয়ে মারিয়ার সাথে প্রেম করে।
খবর টা শোনার পর মনের মধ্যে ভয় ঢুকে যায়।
তিনি আগেই ভেবে রেখেছেন মায়া কে ছেলের বউ করবেন। নিজের মেয়ে কে হারিয়ে মায়া কে মেয়ের মত করেই লালন পালন করছেন। মনে মনে মায়া কে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। আলভী অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করে, আর দুই এক বছর পর বিয়েও করে ফেলতে পারে। তিনি আর দেরি করেন না। আলতাফ মাহমুদ কে বলেন নিজের মনের কথা। এবং জেদ ধরে বলেন আজকেই মায়া আর আলভীর বিয়ে দিয়ে দিতে।
বাড়ির সবাই মোটামুটি রাজি হলেও মাহির আর মেহবুবা মেহের রাজি হোন না। বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুজন কেও রাজি করানো হয়।
পারিবারিক ভাবে হুজুর ডেকে বিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। আলভীর ফুপু আনজারা আর ওনার স্বামী সন্তান দের কল করে বাড়িতে ডাকা হয়।
আলভী বাড়িতে ফেরার সাথে সাথেই ধরে জোর করে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয় দুজনের।
_________________
সারা দিন বাড়ির বাইরে ঘুরে ফিরে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আসে আলভী। ড্রইং রুমে বসে সানজিদা মানতাসা কে খাবার খাওয়াচ্ছে। পাশেই ফোনের স্ক্রিনে ডুবে আছে মাহিদ। মনোযোগ দিয়ে টাইপিং করছে। আর কাউকে দেখতে পেলো না ড্রইং রুমে। কিচেনের দিকে উঁকি দিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ঘেমে নেয়ে শরীর চিটচিটে হয়ে গেছে। শাওয়ার নিতে হবে। বাইরে এত গরম , সহ্য করা যায় না।
দীর্ঘ সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে শরীর শীতল করে।
থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে এক হাতে ভেজা ড্রেস অন্য হাতে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমে আসে।
সোজা চলে যায় বেলকনিতে। ভেজা ড্রেস মেলে দিয়ে রুমে ফিরে আসে। গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে চুল ব্রাশ করে নেয়। মিষ্টি ঘ্রাণের পারফিউম টা হাতে তুলে নিতেই রুমে প্রবেশ ঘটে ঐশী রহমান এর।
ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার আয়নায় নিজের দিকে তাকায়।
ঐশী রহমান আলভীর পাশে এসে দাঁড়ান। দশ মিনিট আগেও এসেছিলেন আলভী ওয়াশরুমে ছিল তাই চলে গিয়েছিলেন।
হাতের পারফিউম টা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে মায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
_ কিছু বলবে আম্মু?
মলিন মুখে বলেন ,
_ তুমি কত দিন আছো বাংলাদেশে?
_ এক মাস।
_ এত গুলো বছর পর এসে মাত্র এক মাস?
মায়ের মলিন মুখ টা দুই হাতে আগলে ধরে। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি টুকু আঙ্গুলের সাহায্যে মুছে দেয়।
_ ব্যবসা ফেলে রেখে তো এখানে বেশি দিন থাকতে পারবো না। আবার আসবো।
ঐশী রহমান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কেন যেন ছেলের মুখের দিকেই শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। ছেলে কে দেখার তৃষ্ণা মিটছে না তার। একটু একটু দেখে মন ভরছে না।
ঐশী রহমান এর চোখ বেয়ে গলগল করে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বাধ ভাঙ্গা পানি গড়িয়ে পড়ছে। ছেলের দুই গালে হাত রাখেন। সাড়া মুখে হাত বুলান।
আলভী যখন ছোট ছিল তখন যেভাবে ডাকতেন এখনও সেভাবেই ডেকে ওঠেন।
_ আব্বা আমার আব্বা। তুমি এত গুলো বছর কেন আমার কাছ থেকে দূরে ছিলে? তুমি আমার আব্বা কে কেন আমার কাছ থেকে এত গুলো বছরের জন্য কেড়ে নিয়েছিলে? আমার বুক টা যে হাহাকার করতো আমার আব্বা কে বুকে নেওয়ার জন্য। আব্বা গো তুমি এত বড় শাস্তি কেন দিলে আমাকে? আমি ভুল করেছিলাম। তোমার সাথে অন্যায় করেছি। তাই বলে তুমি আমাকে এত বড় শাস্তি দেবে আব্বা? আব্বা তুমি এত পাষাণ কেন? আমার কথা তোমার একটুও মনে পড়ে নাই আব্বা? এগারো টা বছর তুমি আমার সাথে কথা বলোনি আব্বা।
_ আম্মু শান্ত হও কাদঁছো কেন এভাবে ? অসুস্থ হয়ে যাবে তো , শান্ত হও। আমি এসেছি তো। এখন থেকে ঘন ঘন আসবো। শান্ত হও এখন।
ঐশী রহমান শান্ত হতে পারেন না। ছেলে কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ছেলে কে দেখার পর থেকে একটা বার জড়িয়ে ধরার জন্য অস্থির হয়ে ছিলেন। ছেলের শর্ত গুলো শোনার পর রাগে অভিমানে ছেলের সাথে কথা বলেননি গত কাল। তখন সেভাবে কথা না বললেও ছেলে ঘুমোতে চলে যাওয়ার পর থেকে সে নিজের কান্না আটকে রাখতে পারছিলেন না। সারা রাত কেঁদেছেন। আজ সারা দিন একটু পর পর কেঁদেছেন। ছেলে বাড়িতে ফিরেছে কিনা একটু পর পর দেখেছেন। কয়েক বার বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তার ছেলে বাড়ি ফেরেনি। সন্ধ্যার পর যখন শুনলো বাড়িতে ফিরেছে তখনই এই রুমে এসেছিলেন। কিছু সময় বসেও ছিলেন। ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছিল না বলে নিজের রুমে গিয়ে স্বামী কে আবার কতক্ষন বোঝালেন আলভী কে যেন একটা বার তিনি বলেন মায়ার সাথে সংসার করার কথা।
কিন্তু আলতাফ মাহমুদ সাফ সাফ না করেছেন। এই বিষয়ে তিনি একটা কথাও বলবেন না আলভীর সাথে।
কাদতে কাদতে শ্বাস নিতে পারেন না ঐশী রহমান। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। আলভী মাকে ধরে নিয়ে খাটে বসায়। বেড সাইট টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল থেকে মাকে পানি খাওয়ায়।
পানির বোতল রেখে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
_ শান্ত হও আম্মু। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তো তোমার। সরি, হাজার বার লাখো কোটি বার সরি। আর কোন কষ্ট দেবো না তোমাদের কাউকে।
,
,
ডাইনিং টেবিলে খাবার খাওয়ার জন্য বসেছে সবাই।
শুধু নেই মায়া। ও এখনো রুম থেকে বের হয় নি। মাহিদ গিয়ে ডেকে এসেছে দুবার।
মায়া রুম থেকে বের হয়। ও কেন লুকিয়ে থাকবে? চোরের মতো খু নীর আসামির মতো কেন লুকিয়ে বসে থাকবে? ওতো চুরি করেনি আর না খু ন করেছে।
তাহলে কেন আলভীর জন্য রুম বন্দী হয়ে থাকবে? অনেক থেকেছে বাড়ি বন্দী, রুম বন্দী হয়ে। আর না।
শিনা টান টান করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। কাউকে ভয় পায় না আর না কাউকে পরোয়া করে এখন। ওই আলভী কে তো মোটেও ভয় পায় না। শুধু সামনে থেকে দেখলে শরীর কাপে, বুক কাপে। নাম শুনলে বুকের ভেতর দিরিম করে ওঠে। তাছাড়া আর কিছুই হয় না।
নিচে নেমে স্বাভাবিক ভাবে ডাইনিং রুমে এগিয়ে যায়। বসে আলভীর সামনা সামনি হয়ে। আলভী চোখ তুলে একবার তাকায় মায়ার মুখের দিকে। তারপর আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
অন্য দিনের তুলনায় আজকে ডাইনিং রুম একদম নিশ্চুপ। মাথার উপরের ফ্যান টা শুধু ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে ঘুরছে।
নয়টার মধ্যে সকলের খাওয়া শেষ হয়।
আলতাফ মাহমুদ আলভীর হাত শক্ত করে চেপে ধরেন। এই ছেলে কে এখন কিছুতেই পালাতে দেবেন না। একটা না একটা বিহিত করতেই হবে এখন। হয় তালাক দে নয়তো সংসার কর।
_ এভাবে বাচ্চাদের মতো হাত চেপে ধরছো কেন আব্বু? আমি কোন বাচ্চা ছেলে না আর না কোন মেলায় রয়েছি যে হারিয়ে যাবো। হাত ছাড়ো।
সবাই তাঁকিয়ে আছে বাপ ছেলের দিকে।
_ কোন চালাকি নয়।
_ কি চালাকি করলাম?
_ সবাই সোফায় বসো।
আলভী কে টেনে নিয়ে সোফায় বসেন নিজেও।
_ তুমি কি চাইছো?
_ আপাতত ঘুমোতে চাইছি।
চরম বিরক্ত আলতাফ মাহমুদ।
_ মায়া কে তালাক দাও এখন।
_ আমি তালাক দেওয়ার পর কি করবে?
_ মায়া কে ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেবো।
_ ছেলে দেখেছো?
_ হ্যাঁ।
_ ছেলে মায়া কে দেখেছে?
_ হ্যাঁ।
_ ছেলের বাড়ি কোথায়? থাকে কোথায়? কি করে? নাম কি? দেখতে কেমন?
এত গুলো প্রশ্ন শুনে বাড়ির সবাই তাঁকিয়ে আছে আলভীর দিকে।
_ তা দিয়ে তোমার কি কাজ? তোমার কাজ তুমি করো। দ্রুত বলে ফেলো বাক্য তিনটা।
_ ছেলের পিক দেখাও আমাকে।
_ কেন?
_ আমি দেখবো তাই।
আলতাফ মাহমুদ ছেলে কে নিজের ফোনে থাকা একটা ছেলের পিক বের করে দেখান।
আলভী মনোযোগ দিয়ে দেখে ছেলে টা কে।
_ পছন্দ হয়নি।
_ কি?
_ ছেলে টা কে। দেখতে যেন কেমন।
_ তোমার চেয়ে বেশি সুদর্শন। আর তোমার তো পছন্দ হওয়ার দরকার নেই। যার সাথে বিয়ে হবে সে পছন্দ করলেই হলো।
আলভী মনে মনে বলে,
_ আমার বউ কে বিয়ে করবে আর আমার পছন্দ হতে হবে না? আর এই ছেলে কোন এঙ্গেল থেকে আমার চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম? দুদিন পরেই তো টাক হয়ে যাবে।
ফোন টা বাবার হাতে ধরিয়ে দেয়। বাবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
_ আমি মায়া কে তালাক দেবো না। ও আমার বউ আর আমার বউ হয়েই থাকবে সারা জীবন।
কথা শেষ করে শিস বাজাতে বাজাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।
চলবে……..