তবুও তুমি পর্ব-৭+৮+৯

0
2

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-০৭]
~আফিয়া আফরিন

(দহন প্রারম্ভ)
স্টেশনটা তখন কেমন যেন হালকা হালকা নির্জন হয়ে উঠেছে। এতক্ষণ যে কোলাহল আর ব্যস্ততা, সেটা থেমে গেছে। ট্রেনটা বেরিয়ে যাওয়ার পর মানুষজনও ছড়িয়ে পড়েছে যে যার গন্তব্যে। আরশীন লজ্জায় একটু গুটিয়ে গেল। কী বাজে পরিস্থিতি! সকলে দেখল আবার আদিয়াতও ছিল সাথে। ছিঃ… এমনটা হলো কেনো? এখন ব্যাপারটা সে ভুলে গেলেই হয়। আদিয়াত দু’কদম এগিয়ে এলো,
– “ঠিক আছেন আপনি? কোথাও ব্যথা পেয়েছেন?”
আরশীন চুল সরিয়ে হালকা হাসল, যদিও চোখেমুখে তখনো লজ্জার ছায়া। বলল,
– “না ঠিক আছি। কী অবস্থা হলো বলুন তো।” একরকম হেসেই চাপা দিতে চাইল তার পড়ে যাওয়ার অপ্রস্তুত মুহূর্তটা।

আদিয়াত একটু হাসল, ঠোঁটের কোণে মৃদু দুষ্টুমি আর দৃষ্টিতে খেয়াল। তারপর বলল,
– “আচ্ছা, এখন চলুন। হাঁটতে পারবেন তো?”
আরশীন একটু ইতস্তত করল, তারপর সামান্য এগিয়ে গেল। কিন্তু ও একবার একটু কেঁপে উঠতেই আদিয়াত অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে এসে এক হাত দিয়ে ওর হাতে হালকা স্পর্শ রেখে বলল,
– “হাত ধরুন তারপর চলুন।”

আরশীন চোখ তুলে একটু থেমে তাকাল আদিয়াতের দিকে। সে মনে মনে রীতিমতো অস্বস্তিতে—এমনিতেই সামনে পড়ে গিয়ে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে, তার ওপর আদিয়াতের এই হাত ধরে সহানুভূতি… যেন তার দুর্বলতাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। কয়েক পা এগোতেই সে আচমকা ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
– “সমস্যা নাই। আমি পারব।”

আদিয়াত এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। মুখে তেমন কিছু প্রকাশ করল না। এরপর হালকা মাথা নেড়ে বলল,
– “ঠিক আছে। আপনার যা ইচ্ছে।”
– “আমি একাই একশ।” আরশীন ঠোঁট উঁচু করে বলল।
– “হুম, সেটা তো দেখলাম।” আদিয়াত ঠাট্টার সুরে বলল।

– “খুব হাসছেন? আপনি হলে তো ওইখানেই নাটক করে পড়ে থাকতেন।” আরশীন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল।
– “আমি পড়ি না তো কখনো, কাজেই নাটক করার সুযোগই পাই না।”
আরশীন চোখ রাঙাল,
– “আপনাকে না সিরিয়াসলি কিছু বলা যায় না, সবকিছুতেই ঠাট্টা।”
আদিয়াত কিছু বলল না শুধুমাত্র কাঁধ ঝাঁকাল।
আরশীন জেদি গলায় বলল,
– “তর্কে কেউ আমাকে হারাতে পারবে না, জানেন?”
– “আচ্ছা, তাহলে এখানে বসেই ডিবেট শুরু করি?”
– “আপনি এক্কেবারে অসহ্য!” আরশীন মুখ ফিরিয়ে হাঁটা দিল।
– “ধন্যবাদ, আপনার মুখে এটা শুনে নিজেকে সফল মনে হচ্ছে।” আদিয়াত পেছন থেকে বলল।

ঠিক এমন সময়, স্টেশনের সিঁড়ি ভেঙে হঠাৎ এক চেনা কণ্ঠস্বর ছুটে এলো বাতাস কাঁপিয়ে,
— “আপুউউউউ!”
আরশীন এক মুহূর্ত চমকে তাকাল। সামনেই ছুটে আসছে একটা মেয়ে, মুখটা তার রোদে ঝলমল করছে, চোখে একরাশ উচ্ছ্বাস। খোলা চুল, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ, হাতে চিপসের প্যাকেট ধরে রাখা, দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে যেন হাওয়াও তাকে ছুঁতে পারছে না। আরশীন থমকে গেল। চোখে বিস্ময়ের মিশ্রতা।
– “আশা!” তার মুখ থেকেও বেরিয়ে এলো এক আনন্দভরা হাঁসফাঁস। আশা দৌড়ে এসে একদমে জড়িয়ে ধরল বোনকে।
– “আপু, তোমাকে এত্তো মিস করছি আমি!”
– “তোর না বিকালে আসার কথা ছিল?”
– “সারপ্রাইজ দিতে আগেভাগেই চলে এসেছি। চমকে গেছ, তাইনা? আমি জানতাম। হেহে।”
আরশীন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, চোখের কোণে তখনও হালকা লজ্জা, খানিক অভিমান, আর পুরোনো অভ্যস্ত মায়া। বোনকে কিছু বলল না, শুধু ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

আদিয়াত সবটা দূর থেকে চুপচাপ দেখছিল। আশা ছুটে এসে আরশীনকে জড়িয়ে ধরার মুহূর্তটা, আরশীনের চোখের ভেতর হঠাৎ নরম হয়ে যাওয়া, সবটাই ওর চোখ এড়াল না। “আশা” নামটা শুনেই আদিয়াত বুঝে ফেলেছিল, এটা আরশীনের ছোটো বোন। তার চোখে একটা হালকা কৌতূহল, ওর দৃষ্টিতে ছিল একরকম নরম মনোযোগ। একদিকে ছোট্ট মেয়েটার সরল উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে আরশীনের ভেতরে ছায়ার মত জেগে ওঠা গভীর একটা ভালোবাসা; এই দুইয়ের মাঝে আদিয়াত একটু স্থির হয়ে গেল।
হঠাৎই আশার চোখ পড়ল আদিয়াতের দিকে।
একটু থেমে, ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর আরশীনের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে রেখে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো তার দিকে। মুখে একরকম সন্দেহ, আর চোখে রহস্য ভেদ করার স্পষ্ট চেষ্টা। ছোট্ট গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি ভাইয়া, তাইনা?”

আদিয়াত একটু থমকে হেসে বলল,
— “হুম, বলা যায়।”
আশা একদম কাছে গিয়ে আদিয়াতের মুখের দিকে ভালো করে তাকাল, তারপর খুব গম্ভীরভাবে বলল,
— “দুলাভাই বলব না ভাইয়া?”

আরশীন পিছন থেকে বলল,
— “বাড়ি গিয়ে কথা বলিস। অনেকক্ষণ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।”

আশা একটুও না দমে, ঘাড় কাত করে আরশীনের দিকে ফিরল। চোখ দুটো বড় করে বলল,
— “তুমি চুপ করো তো আপু।” তারপর এক পা এগিয়ে গিয়ে আদিয়াতের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, গলাটা একটু নাটকীয়ভাবে বদলে গেল।
— “আমার সাথে আজ ভাইয়ার প্রথম পরিচয়, তাই কথা বলছি। তোমার তো পরিচয় পর্ব শেষ, তাই তোমার মনে হচ্ছে বাসায় গিয়ে কথা বললেই হবে। কিন্তু বিষয়টা তা না।”
— “আশা, বাসায় ফিরে তোকে আমি দেখাচ্ছি। খুব বেশি কথা…”

আশা ওর কথা কেটে দিয়ে বলল,
— “তুমি এখন দর্শক। আমি প্রশ্ন করব, ভাইয়া উত্তর দেবে। পরে বিশ্লেষণ করে জানাব, পাস করছে কিনা।”

আরশীন হতাশ গলায় বলল,
— “তোর সাথে এই মাঝপথে দেখা হওয়াটাই ভুল।”

আশা আবার চিপস খেতে খেতে বলল,
— “এখন ভুল হোক বা ঠিক, আমি ঠিকই ইন্টারভিউ নিব। কাজেই চুপচাপ আমাকে কাজটা করতে দাও।”
আদিয়াত হেসে ফেলল এবার খোলাখুলিভাবে। আশা বলল,
— “হেসে লাভ হবে না ভাইয়া। চলেন প্রশ্ন শুরু করি… এটা হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের ইন্টারভিউ। ওকে? প্রথম প্রশ্ন, বলেন প্রেম মানে কী?”
আরশীন চোখ রাঙিয়ে তাকাল। আশা তার গুরুত্ব দিল না। আশার প্রশ্নে আদিয়াত একটু থমকে গেল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবার ভান করে বলল,
— “উমমম প্রেম মানে… কিছু একটা আছে হয়তো। পুরো বোঝা যায় না, কিন্তু শুধু টের পাওয়া যায়…”

আশা কপাল কুঁচকে বলল,
— “মানে?”

আদিয়াত হালকা হেসে বলল,
— “মানে, কেউ একজন থাকে… যাকে দেখে মন শান্ত হয়ে যায়। তার রাগ, তার হাসি—সবকিছুই অসহ্য রকমের দরকারি হয়ে পড়ে হয়ত।”

আশা চট করে বলে উঠে,
— “আর হ্যাঁ, সেই মানুষটার নাম যদি আরশীন হয়, তাহলে তো কথাই নেই।”
কথাটা শুনে আদিয়াতের মুখে খুব বেশি পরিবর্তন এলো না। একরকম নির্লিপ্ত চোখ ফিরিয়ে আশেপাশের দিকেই তাকিয়ে থাকল, যেন কথাটা তার কানেই যায়নি। কিন্তু আরশীনের অবস্থা ছিল ঠিক উল্টো। তার গাল দুটো এক লাফে লাল হয়ে উঠল, চোখের পাতায় যেন অস্থির একটা কাঁপন। তার মনে হচ্ছিল, আশেপাশে সবাই যেন তাকিয়েই আছে ওর দিকে। আশা তখনও হেসে চলেছে। আরশীনের পাশে দাঁড়াল, মুখে দুষ্টু হাসি।
— “আপু লজ্জা পাচ্ছে মানে ব্যাপার সিরিয়াস! ওহো, দারুণ তো।”
.
ওরা বাড়ি ফিরে এলো। আরশীন বহুকষ্টে ধমকে আশাকে থামিয়েছে। কথা যে শুরু করেছে… থামার কোনো নামগন্ধ নেই। বাড়ি ফিরে এসে জহির আংকেলের থেকে শুনল,
তাদের খুব তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরতে হবে, বিশেষ করে আদিয়াতকে। অফিস থেকে ফোন এসেছিল। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হাতে নিতে হবে, সময় নেই বেশি।
ঘরের মধ্যে হঠাৎ এক ধরনের নীরবতা নেমে এলো। আরও কয়েকদিন থাকার ইচ্ছে ছিল আরশীনের। কিছু কাজ রয়েছে আবার ইচ্ছেও রয়েছে। সে কিছু বলল না, যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে রাতেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিল শুকনো মুখে। আদিয়াত বুঝল, আরশীনের কিঞ্চিত মন খারাপ। স্বাভাবিক, সে অবশ্য ওকে থেকে যেতে বলেছিল কিন্তু সেখানেও আরশীন মানা করে দিয়েছে। ওই আর কী বলবে? যতটুকু বলার ছিল ততটুকু বলেছে। জোর তো করতে পারবে না… জোর করা সাজে না। বিয়ে করেছে বলেই যে জোর করার সুযোগ পেয়েছে কিংবা অধিকার দেখাবে; এমন স্বেচ্ছাচারিতা তার মধ্যে নেই। ওর হিসেব আলাদা, ব্যবসায়ী মানুষ কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যর সাথে জড়িত বলে হয়ত হিসাবটা খুব ভালো বোঝে। চিন্তাধারাই বড্ড অদ্ভূত—অভ্যন্তরীণ মানুষ, নীরব পর্যবেক্ষক; পরিস্থিতি বোঝে, মানুষ দেখে, অনুভব করে—কিন্তু সেগুলো প্রকাশ করে না সরাসরি।নিজেকে কারো কাছে খোলাখুলি ভাবে বর্ণনা করা পছন্দ করে না। অনুভূতিগুলো নিজের ভেতর রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ব্যক্তিত্বে ভারসাম্য; বাইরে থেকে শান্ত, সংযত, ঠান্ডা। অল্প হাসে, কিন্তু সেই হাসির গভীরতা থাকে; হাসির শেষে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকে যায়! সম্পর্কের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন। সে জানে ভালোবাসা মানে দায়িত্ব, শুধু আবেগ নয়; তাই হুট করে কিছুতে জড়ায় না। রহস্যময় অনভিব্যক্ত অনুভূতির মানুষ—তার ভালোবাসা প্রকাশ পায় চুপিসারে, চোখের দিকে তাকিয়ে বা দরজার বাইরে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে।
.
সকাল সকাল ঘরের ভেতরে সবার ব্যস্ততা—মোবাইলের চার্জার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা পাচ্ছে না, সেটা পাচ্ছে না। কিন্তু এসবের ভিড়ে একমাত্র আশাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দার এক কোণে। ওর মুখে কোনো কথা নেই, হাসিটাও যেন ব্যাগের ভেতরে কোথাও গুটিয়ে ফেলেছে। আরশীন এসে বলল,
— “এইরকম মুখ করে আছিস কেন? আবার দেখা হবে, কী এমন হয়েছে? আমাকে ছাড়া যেনো এর আগে কখনো থাকিস নাই।”

আশা নিচু গলায় বলল,
— “একটা দিনও তোমার সাথে থাকতে পারলাম না অথচ আমার কত কথা জমে ছিল…”

আরশীন ওর মাথায় হাত রেখে একটু নরম গলায় বলল,
— “তোর সাথে কথা না বলেই চলে যাচ্ছি ভাবিস না। কথা তো আমাদের রোজ চলতেই থাকবে। তুই তো জানিস আমাকে? আমি সবসময় তোদের সাথে কথা বলতে পারি না, দেখা করতে পারি না। সবটাই জানিস তো আশা… সবকিছু ঠিক হওয়ার অপেক্ষাই আছি আমি।”
— “আচ্ছা।”
আশা শুধু দাঁড়িয়ে রইল দরজার চৌকাঠে। চোখের পানি আটকে রাখলেও চোখে সেই ঝিলিকটা ছিল একটা অপূর্ণ দিনের ক্ষোভ আর না বলা গল্পের দীর্ঘশ্বাস। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। আশা আবার এলো। আদিয়াত একবার ফিরে তাকাল। আশা চোখ ছোট করে বলল,
— “ভাইয়া, আপনি আসবেন কিন্তু আবার। আপু না এলেও।”

আদিয়াত বেশ হাসিমুখে বলল,
— “আচ্ছা, আসব। তবে তোমাদেরও আসার অপেক্ষায় রইলাম।”
গাড়িতে ওঠার আগে হঠাৎই আরেকবার আশা এগিয়ে এল। আরশীনের কানে খুব আস্তে বলল,
— “সাবধানে থেকো আপু।”
তার চোখে কোনও ভয় ছিল না, ছিল এক ধরণের চাপা সতর্কতা। একটা হাসি ছিল ঠোঁটের কোণে, কিন্তু চোখের কোণটুকু একটু ভিজে। আরশীন আদুরে দৃষ্টিতে তাকাল।
— “আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। মায়ের খেয়াল রাখিস আর সাথে নিজেরও‌। কোনো সমস্যা মনে হলে, আমাকে ফোন দিস।”

আশার চোখ পড়ল আদিয়াতের দিকে। সে বোধহয় কিছু শুনেছে। চোখেমুখে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গি! সে একটু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কথাটা,
— “ঠিক আছে। ঢাকা মানেই তো… ব্যস্ততা, নতুন নতুন মানুষ, অফিস-টফিস… তো তাই বললাম সাবধানে থেকো। আর ভাইয়া তো আছেই, কোনো সমস্যা নেই।”

আদিয়াত দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। ওর কানেই কথা ঢুকেছিল—“সাবধানে থেকো আপু।” ওর কপাল সামান্য কুঁচকে উঠল। কেন বলল ওটা? স্রেফ আদরের বোন বলেই? নাকি… অন্যকোনো কারণ আছে তার পেছনে? আদিয়াত চুপ করে থাকল। তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। আবার আগেভাগে সন্দেহ করাও ঠিক নয়। আরশীন তাকে তাড়া দিচ্ছিল কিন্তু মাথার ভিতরে আশার কথাটা যেন ঠক ঠক করে বাজতে লাগল। সেই কিশোরী হাসিমাখা মুখটা, চুপিচুপি উচ্চারণ করা একটা বাক্য। কিছু শব্দ গল্পে ঢেউ তোলে। এই বাক্যটাও হয়তো সেইরকম এক ঢেউ। আদিয়াত চেষ্টা করেও মাথা থেকে বিষয়টা সরাতে পারল না। কীসের জন্য এই সাবধানবাণী? আরশীন কি কোনো বিপদে রয়েছে?
.
বাসায় ফিরে সন্ধ্যার হালকা ধোঁয়াটে আলোয় ঘরটা যেন একটু অপরিচিত লাগল। যেখানে প্রতিদিনের চেনা দেয়াল, চেয়ার আর চুপচাপ ফ্যান ঘুরে—তাও যেন এক অদৃশ্য ভার চাপিয়ে রাখছিল আশপাশে।
আদিয়াতের মনে আবারও কেমন একটা দ্বিধা দানা বাঁধছিল। ঘরটা যেমন গুছানো, আশপাশের শব্দগুলোও তেমনি হিসেব করা, মেপে নেওয়া। তবু কোথাও যেন একটা অদেখা খালি জায়গা রয়ে গেল; একটা না বলা প্রশ্ন, একটা অতৃপ্ত দৃষ্টি।
আরশীন তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে মগ কিন্তু চুমুক দিতে ভুলে গেছে। চোখ তার রাস্তার গলির ধারে, যেখানে কিছুই নেই—তবুও সে দেখছিল… অদৃশ্য কিছু।
আদিয়াত এক কোণে বসে ওর সেই চাহনিকে লক্ষ করল। হাসি তো ছিল মুখে কিন্তু চোখে ছিল না।
আচরণে ছিল স্বাভাবিকতা, কিন্তু মনের কোথাও যেন ভীষণ গোলমাল। তার মুখে ছিল এমন একটা ভাব যেনো বোঝাচ্ছিল,
— “আরে, এত ভাবছো কেন? সব ঠিক আছে!”
কিন্তু তার দৃষ্টিতে ছিল,
— “আমি ঠিক নেই, কেউ বুঝছ না কেনো?”

আদিয়াত কিছু বলে না। তবে তার মনের ভিতরে জেগে রইল একটাই অনুভব; এই মেয়েটা যেমনটা দেখায়, আসলে ঠিক তেমনটা নয়। আর সেটা বোঝার জন্য কিছু সময় নয়, বিশ্বাস লাগে। সন্ধ্যার আলো একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছিল। আর সেই সঙ্গে বাড়ছিল নীরবতার গভীরতা। দুজন মানুষ একই ঘরে, তবুও দুই দিকের মেঘে ঢাকা আকাশে খুঁজে ফিরছিল—একটুকু সত্য, একটুকু স্বস্তি।

ঢাকায় ফিরে কয়েকদিন কেটে গেছে। আদিয়াত দ্বিধায় থাকলেও প্রকাশ করে না। তবে আরশীনের ছোট ছোট বিষয়গুলো খুব খেয়াল করে। আজ বিকালে একটা কাজে পুরান ঢাকায় দিকে গেল, আরশীনও হঠাৎ বের হওয়ার বায়না করল। তাই আদিয়াত ওকে নিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
আদিয়াতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষে ওর সাথেই আরশীন একদম হালকা মন নিয়ে হাঁটছিল—খোলা রাস্তায়, পুরনো গলিতে যেন শ্বাস নিচ্ছিল একটু প্রশান্তি। তবে সেই প্রশান্তির গায়ে খুব ধীরে একটা অস্থির ছায়া পড়ে যেতে লাগল… একটা অচেনা লোক হঠাৎ সামনে দিয়ে হেঁটে গেল—চোখ আটকে গেল আরশীনের চোখে। লোকটা বেশিক্ষণ থামল না, শুধু তাকাল আর একটা চাপা হাসি দিয়ে আরশীনের হাতের মুঠোয় একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে ভিড়ে হারিয়ে গেল।
পুরো বিষয়টা আদিয়াতের চোখের সামনে ঘটল। সে কিন্তু মোটেও অবাক হলো না। এমনটা যে ঘটবে বা ঘটতে পারে, আগে থেকেই যেনো জানত। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরশীনের হাতের মুঠোয়। মেয়েটাও কেমন যেন হঠাৎ থমকে গেল। সেও অবাক চোখে নিজের হাতের মুঠোয় রাখা চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে আছে। আদিয়াত জিজ্ঞেস করল,
— “আপনার সেই প্রেমিক নাকি?”

আরশীন একটু না বোধক মাথা নাড়ল। বলল,
— “বুঝতে পারলাম না… এটা আমাকে কেনো দিল?”
আদিয়াত খেয়াল করল; ওর চোখে একটা অস্থিরতা, একটা ঘাম জমেছে কপালে, যা ওই ঠান্ডা বিকেলে অস্বাভাবিক। আদিয়াত এবার জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি ভয় পাচ্ছেন? ও লোকটা কে ছিল?”

আরশীনের দৃষ্টি থেমে যায়। অস্থির গলায় বলে,
— “আমি জানি না, সত্যিই জানিনা। কিছুই বুঝতে পারছি না।”
— “আপনার যদি কোনো সমস্যা না থাকে কিংবা গোপনীয় বিষয়বস্তুর বালাই না থাকে তবে ওটা আমাকে দিন।” আদিয়াতের গলায় একধরনের কতৃত্ববোধ।
আরশীন একবাক্যে ওটা দিয়ে দিল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল আদিয়াত। ভেতরে খুব সাদামাটা, ছেঁড়া ধরনের চিরকুট। কোনো প্রিন্ট নয়—হাতে লেখা অদ্ভুত অক্ষর। চোখ বুলিয়ে আদিয়াত থমকে গেল। একটাই লাইন লেখা,
— “আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করো। এই খেলায় কেউই জিতবে না। তুমি যা শুরু করেছ তার শেষ আমিই করব এবং খুব তা শীঘ্রই।”
আদিয়াত স্তব্ধ।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-০৮]
~আফিয়া আফরিন

(নীরব প্রতিশ্রুতি)
সেদিন আশার সাবধান বাণী তাহলে সাধারণ কিছু ছিল না। আদিয়াত চুপচাপ তাকিয়ে আছে আরশীনের দিকে, হাতে মুঠো করা চিরকুট। চোখে যেন একধরনের অস্থির নিরবতা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আরশীন—অপরাধী নয়, কিন্তু অস্বস্তিতে মোড়া। আদিয়াত ধীরে করে কাগজটা সামনে তুলে ধরল।
– “এটা কি?” স্বরে কোনো রাগ নেই কিন্তু শীতল কিছু জমে আছে।
আরশীন তাকিয়ে রইল কাগজটার দিকে। তার চোখে সত্যিই বিস্ময়, কিংবা খুব নিখুঁত অভিনয়।
তারপর বলে উঠল,
– “আমি জানি না।”

আদিয়াত চোখ সরাল না।
– “তাহলে আপনাকে সাবধান করার প্রয়োজন পড়ল কেন কারোর?”

আরশীন গলার স্বর শক্ত করল, যেন আড়াল করতে চায় অস্বস্তি।
– “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কেউ হয়ত ভুল করে দিয়েছে। আপনি প্লিজ ভুল বুঝবেন না অন্তত।”
– “আশার কথাটা তবে মিথ্যা ছিল না… কারণ, এখন তো মনে হচ্ছে ওর ‘সাবধানে থেকো আপু’ কথাটা শুধু একটা আদরের উপদেশ ছিল না।”

আরশীনের মুখ থেকে কিছুক্ষণ শব্দ বেরোল না। সে চোখ নামিয়ে ফেলল। তবু মুখ শক্ত রেখেই বলল,
– “সবকিছুকে রহস্য ভাবার দরকার নেই। আপনি চাইলে কাগজটা পুড়িয়ে ফেলতে পারেন কিংবা রেখে দিন। আমি কিছু জানিনা।”
– “না জানলে মুখ এমন থমথমে হয় না। না জানলে কেউ এভাবে চোখ সরায় না। আপনি কিছু একটা জানেন, শুধু বলতে চান না।” আরশীন চুপ। আদিয়াত ফের বলল,
– “বাড়ি চলুন।”
বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকেই আরশীন যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলেছে আদিয়াতকে। ও এক তলার ড্রয়িংরুমেই ঘোরাঘুরি করছে সারাক্ষণ।
সেখানে কখনো আযহানের সাথে বসে টিভিতে শো দেখছে আবার কখনো আলিয়ার সাথে চায়ের কাপ হাতে গল্পে মেতে আছে বা রান্নাঘরের দিকে গিয়ে নাজনীনের হাতের কাজে সাহায্য করছে—এক কথায় সে ঘরের সবজায়গায় আছে, শুধু আদিয়াতের সামনে নেই। তার চোখে মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত ভ্রু-কুঁচকে থাকা দেখা যায়, যেন কোনো অদৃশ্য প্রশ্ন তার মাথায় গেঁথে আছে। আরশীন জানে, সে নিজে কোনো ভুল করেনি। সে নিজেও বুঝতে পারছে না ওই চিরকুটের উদ্দেশ্য কিংবা ওই লোকটার! কিন্তু এই সতর্কতা… এমন হুঁশিয়ার শব্দ?— “আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করো।” এ তো ঠাট্টা নয়, এটা হুমকি।
রান্নাঘরের জানালাটা একটু খোলা। সন্ধ্যার আলো ঢুকে পড়েছে নিঃশব্দে। আরশীনের চোখ দূরে, খুব দূরে… ঠিক তখনই নাজনীন হঠাৎ বলে উঠলেন,
– “কিছু ভাবছো নাকি মা? মন খারাপ লাগছে বুঝি? বাড়ি থেকে চলে এলে এমন হয়।”

আরশীন একটু চমকে উঠল। তার মন যে এতটা স্পষ্ট মুখে ফুটে উঠেছিল, সেটা সে বুঝতেই পারেনি। সে মুখ ফেরাল, হালকা হাসল,
– “না না, কিছু না। শুধু একটু… ক্লান্ত লাগছে।”

নাজনীন তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তার চোখে একরকম সতর্ক কোমলতা, যেমনটা একজন অভিজ্ঞ নারী অন্য নারীর চোখে লুকানো অস্থিরতা দেখে বুঝে ফেলেন। আরশীন টের পায়, তার নিজের শাশুড়ির সামনে কথা বলা এখনও খুব সহজ নয়। এই সম্পর্কটা যেন একরকম “ভদ্র দূরত্ব”-এর ভিতর দাঁড়িয়ে আছে। কখনো ঠান্ডা না, কখনো একেবারে গরমও না বরং বুঝেশুনে মেপে চলা।
সম্পর্কটা আচমকা হয়ে গেছে বলেই হয়তো ও ভেতরে একটা আড়ষ্টতা বয়ে বেড়াচ্ছে। নিজের না বোঝা অনুভূতি সব মিলে আরশীন যেন আরও বেশি গুটিয়ে যাচ্ছে। নাজনীন হালকা হেসে বললেন,
– “শোনো মা, আমার একটু মাথা ধরেছে। তুমি কি এক কাপ চা বানিয়ে দেবে আমাকে?”

আরশীন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
– “জী, মানে… হ্যাঁ, অবশ্যই। এখনই করে দিচ্ছি।”

নাজনীন মিষ্টি গলায় বললেন,
– “তুমি তো মিষ্টি মেয়ে, তোমার হাতের চা-ও নিশ্চয়ই মিষ্টি হবে। আরেকদিন তো বানিয়ে খাওয়ালে‌।”

আরশীন লজ্জা মেশানো গলা বলল,
– “আমি তো সেদিন শুধু বুঝে না বুঝে করছিলাম। ঠিকমতো হলো কিনা তাও বুঝিনি।”
– “ভালোবাসা দিয়ে বানালে সব কিছু ভালো হয়। আমি আজ তোমার বানানো চা খাব। শুধু মাথা ব্যথা নয়, মনটাও একটু হালকা হবে।”

আরশীন চুপ করে তাকায় একবার, তারপর হালকা মাথা নেড়ে বলে,
– “আমি বানাচ্ছি, একটু অপেক্ষা করুন। চিনি কম না বেশি দেব?”
– “তুমি যেমন পছন্দ করো, আমি সেভাবেই খাব। আজ তুমি ঠিক করবে।” আরশীন চোখ নামিয়ে নিল। তিনি ফের বললেন,
– “সম্পর্কগুলো না, মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেই গুছিয়ে নিতে হয়। সবসময় তো আপনিই এগিয়ে যাবে না, তাই না?”
– “হ্যাঁ।”

নাজনীন তখন হেসে বললেন,
– “আসলে জানো… আমি ভাবছিলাম, আমাদের মাঝে কথাবার্তা হয়েই উঠছে না ঠিকঠাক। অথচ একই ছাদের নিচে আছি। তাই ভাবলাম, এক কাপ চায়ের অজুহাতে যদি একটু আলাপ হয়, মন্দ কী?”
আরশীন এবার হালকা হেসে ফেলল। এমন সরল স্বীকারোক্তি শুনে তার মনটা একটু নরম হলো। চা ফুটছে, তার গন্ধ পুরো রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়ছে।
দুই নারীর মাঝে দূরত্বটা যেন একটু গলছে। না, একেবারে আত্মীয় হয়ে যাওয়া নয়; তবে হ্যাঁ, এক কাপ চা বানানোর অজুহাতে সম্পর্কটা ঠিকই এক চুমুক এগিয়ে গেল।
.
এই ঘরের মধ্যে আলোয় ঝলমল, কিন্তু দু’জনের চোখাচোখিতে যেন ছায়া খেলা করছে। আরশীন বুঝছিল, এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না আর। আদিয়াতের মুখে কিছু নেই কিন্তু চোখে অজস্র প্রশ্ন। সুযোগ পেলে হয়ত সেই প্রশ্নে চেপে ধরবে।
হাসির আড়ালে ঢেকে রাখা অনুভূতির ভার দু’জনেই টের পাচ্ছিল। চিরকুটের অন্ধকার এখন ঘরের বাতাসে মিশে আছে আর সময়টা শুধু অপেক্ষা করছে—একটা নির্ভেজাল মুখোমুখির জন্য।
রাতটা যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় গাঁথা ছিল। নামমাত্র নিজের ঘরে ঢোকার সময় আরশীন প্রস্তুত ছিল, হয়তো আদিয়াত কিছু বলবে বা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে। কিন্তু না, আদিয়াত কিছুই বলল না। সে নিজের মতো বেডে বসে ফোন স্ক্রল করছিল, যেন কিছু ঘটেইনি। এই নিঃশব্দতা যেন আরও বেশি অস্বস্তিকর, আরও বেশি ভারী। আরশীন বুঝতে পারছিল না—ওর চুপ করে থাকাটা কি রাগ? উপেক্ষা? নাকি কিছু বোঝার চেষ্টা? তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, এই নীরবতা কোনো স্বস্তির নয়।
এটা যেন ঝড়ের আগে গভীর শ্বাস নেওয়ার মুহূর্ত।
আরশীন কিছুক্ষণ নিজের ভেতরের দ্বিধা সামলে, ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বসল বিছানার ধারে।
আদিয়াত তখনো ফোনের পর্দায় চোখ রাখলেও ওর উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাল। আরশীন নিঃশ্বাস টেনে বলল,
– “আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। এটা আপনাদের কারো কাছেই বলিনি। ইচ্ছে করে গোপন করেছিলাম।”
আদিয়াতের চোখ একটু চওড়া হলো কিন্তু সে কিছু বলল না। চোখে মনোযোগ, ঠোঁটে নীরবতা।
আরশীন আবার বলল,
– “তিনি খুব সৎ, দায়িত্বশীল আর একরোখা মানুষ ছিলেন। হঠাৎ একদিন—মারা গেলেন। বলা হলো অ্যাক্সিডেন্ট। সবাই মেনে নিল সহজভাবে।” তার গলা কেঁপে উঠল সামান্য, কিন্তু সে থামল না।
– “কিন্তু আমরা জানতাম, ওটা কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। সেটা ছিল একটা ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনা। একটা ভয়ঙ্কর ফাঁদে ফেলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
আদিয়াত এবার ধীরে ধীরে ফোনটা পাশে রেখে পুরোটা মনোযোগ দিল ওর দিকে। চোখে গভীর চিন্তার ছাপ। আরশীন বুঝতে পারল, ওর বলা প্রতিটা শব্দ আদিয়াতের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে নিঃশব্দে। এই প্রথম সে নিজের একটা বড়ো সত্যি তুলে ধরল ওর সামনে। কিন্তু সে জানে, এটা শুধু শুরু। এখনো অনেক কিছু বলা বাকি।
আদিয়াত ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করল,
– “তারপর?”

ঘরজুড়ে তখনো সেই নিরবতা কিন্তু তার ভেতর যেন এক এক করে জমে উঠছিল অতীতের চাপা শব্দ, যন্ত্রণার চাপা কান্না। আরশীন একটু ঝুঁকে বসল। গলার স্বর মৃদু, চোখে ক্লান্ত আলো।
– “বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারে নেমে এলো এক ভয়াবহ ছায়া। তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন, যেগুলো সম্ভবত লুকিয়ে রেখেছিলেন আমাদের কলাবাগানের বাসায়। আমরা জানি না ঠিক কোথায়।”

আদিয়াত চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। প্রতিটা শব্দ যেন খুঁটিয়ে শুনছিল ও। আরশীন একটু থেমে আবার বলল,
– “একদিন হঠাৎ সেই অপরাধী গোত্রের কেউ এসে পুরো বাসাটা উল্টে ফেলল। দেয়াল, তাক, বিছানা কিছুই বাদ যায়নি। মা খুব ভয় পেয়ে গেলেন। তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের নিয়ে ঢাকা ছাড়বেন।” তার চোখে একটা বেদনার দাগ ফুটে উঠল। একটু থেমে আবার শুরু করল,
– “মা আমাকে নিয়ে গেলেন ফরিদপুরে। আর আশাকে পাঠিয়ে দিলেন মামাবাড়ি, সেখানে একটু নিরাপদে থাকত অন্তত।”
আরশীন এবার হালকা একটা হাসি দিল। তবে সেই হাসিতে ক্লান্তি আর বিদ্রুপের ছায়া মেশানো ছিল।
– “আর আমি?” একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
– “আপনার বাবা তখন আপনার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। মা ভেবেছিল, নিরাপত্তা পাবে মেয়েটা। আমি ভেবেছিলাম কী জানেন? এখানে এসে রহস্যটা উদ্ধার করব। ওখান থেকে তো সম্ভব হচ্ছিল না। মা আমাদের একলা ছাড়ার ভরসা পাননি। বারবার বলতেন, যা গেছে তা হয়ত যাওয়ার ছিল কিন্তু তোদের আমি কিছুতেই ছাড়ব না। আংকেল অবশ্য খুব চেষ্টা করেছিলেন, আমাকে এই বাড়িতে আনার। আর সেই চেষ্টার ফল, আমি এখন আপনার কপালে জুটেছি।”

এই প্রথম আদিয়াত বুঝতে পারল, আরশীনের মুখে খেলা করা ঠাণ্ডা হাসির নিচে লুকিয়ে আছে এক বিশাল আঁধার। এতদিন যাকে সে শুধু রহস্যময় ভাবত, আজ তার ভেতরের গল্পটা যেন একটু একটু করে স্পষ্ট হতে লাগল এবং সেই গল্পে সে নিজেও এখন জড়িয়ে গেছে… গভীরভাবে।
– “তাহলে এ জন্যই আপনি সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করতেন?”
– “হয়তো।”
– “সব বোঝা গেল না ঠিকই, কিন্তু অন্তত এটুকু বুঝলাম, আপনি অনেক কিছু একা সহ্য করেছেন। একা লড়েছেন এবং এখনও সেই চেষ্টাই করছেন।”
আরশীন তাকাল না কিন্তু চোখে একটুখানি পানির আভাস। আদিয়াত ফের বলল,
– “আপনাকে কোনোভাবেই দোষ দিই না। শুধু বলতে চাচ্ছি, আমাকে আগে বলে দিলেই ভালো হতো। আজকে যা ঘটল… এরপর তো আপনাকে একা কোথাও ছাড়া যাবে না।”

আদিয়াতের কথায় যেন ঘরে হালকা ঠান্ডা বাতাস বইল। আরশীনের মুখটা হঠাৎ থমকে গেল।
– “আমি সত্যিই জানি না কে ওই চিরকুট দিল। আমি শুধু চমকে গিয়েছিলাম… ভয়ও পেয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন, আমি জানিনা সত্যিই…”

আদিয়াত একটু মাথা ঝাঁকাল।
– “বিশ্বাস করলাম। তবে একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, শত্রু পক্ষের সবার চেহারা আগে থেকে কেউ চেনে না। অনেক সময় তারা খুব আপন বলেই কাছে আসে।”

আরশীন চুপ। মুখে কোনো উত্তর নেই, কিন্তু চোখের গভীরে ছায়া নেমে এলো। আরশীন ধীরে বলল,
– “ধন্যবাদ।”
– “প্রয়োজন নেই, যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু বলুন এখন।”
– “কী?” আরশীনের চোখেমুখে প্রশ্ন।
– “আপনি আঙ্কেলের সমস্ত ইনফরমেশন আমাকে দিন। মানে তিনি কোন কেসে কাজ করছিলেন কিংবা কাদের বিরুদ্ধে? তারপর আমি দেখছি।”
– “আপনি দেখবেন?” আরশিনের চোখে মুখে বিস্ময়।

– “তো কি এখন সব জেনে আপনাকে একা বিপদের মধ্যে ছেড়ে দেব? যেটা বলেছি সেটা করেন। সবসময় জেদ দেখাবেন না, আমার সাথে তো একেবারেই না।”
– “আচ্ছা।”
আরশীনের যা জানে, সব বলল। কিছু জিনিসপত্র ছিল তার কাছে, সেসবও হস্তান্তর করল। আদিয়াতকে বিশ্বাস করা যায়। সে মানুষ হিসেবে ভালো… সব দেখেশুনে আদিয়াতের কপালে পরপর কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। আরশীনের সাথে রাত জেগে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করল। ভাবছিল, ঘরটা নীরব হয়ে গেল। আর সেই নীরবতার মাঝেই জেগে রইল এক নতুন শঙ্কা আর একটুখানি আস্থা।

আরশীন জানে, জহিরুল ইসলাম একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। শুধু আদিয়াতের বাবা নন, সেই মানুষ যিনি পরিবারে নিঃশব্দে সবকিছু দেখেন, বোঝেন এবং সিদ্ধান্ত নেন নিজের মতো করে। তবুও, আরশীন তাকে কিছু বলল না। কেন? সেটা সে নিজেও জানে না ঠিক করে। হয়তো আদিয়াতের উপর পুরোপুরি ভরসা আছে বলেই। তাও একটুখানি দ্বিধাও থেকে যায়; তিনি কী মনে করেন কে জানে?
জহিরুল ইসলাম যদি জানতে চান, হয়তো তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করবেন। আর যদি না করেন, তবে হয়তো তিনিও বুঝে যাবেন আদিয়াত দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করেছে। আবার আরশীনের মনে একবার সন্দেহ জাগে,
– “আংকেল যদি সব জেনে ফেলেন, কী ভাববেন আমার সম্পর্কে? আমি যদি ওনার বিশ্বাস হারাই? কিন্তু তিনিই বলেছিলেন, আদিয়াতের সব জানার অধিকার রয়েছে।”
.
হ্যাঁ, আদিয়াত ঠিকই বলেছিল। সেদিন বিশ্বাসের সাথে বলেছিল,
— “আমি চোখ খোলা রাখব।” আর সে ঠিক সেই কাজটাই করেছে। শুধু চোখে নয়, মনেও রেখেছে আরশীনের বলা প্রতিটা কথা। শত্রুপক্ষ কারা, কেন তারা এখনও তৎপর, সবকিছু বোঝার চেষ্টা করেছে সে নিজের মতো করে। আরশীনের অস্বস্তি, হাসির আড়ালে লুকানো গুমরে থাকা কিছু; এসবও সে লক্ষ্য করেছে নিঃশব্দে। নিজস্ব ছায়া-তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল। একটা একটা করে খুঁজে বের করেছে আরশীনের বাবার কিছু নথিপত্র, পুরনো কাগজ, কলাবাগানের বাসার দেয়ালে লুকানো কিছু ইঙ্গিত।
আর অবশেষে একদিন সব তথ্যের খুঁটিনাটি জোড়া লাগিয়ে, একটা নাম সামনে নিয়ে এলো—রেজা ভাই।
স্থানীয়ভাবে পরিচিত একজন প্রভাবশালী নেতা।
শাসক দলের উচ্চপদস্থ, প্রভাবশালী মুখ। কাজে-কর্মে ভয় ধরানো কিন্তু কথাবার্তায় বড় মার্জিত, ঠাণ্ডা। আর আশ্চর্য ব্যাপার, আদিয়াত তাকে চেনে। চোখে চোখ পড়েছে বহুবার, এমনকি একই অনুষ্ঠানে থেকেছে তারা। এখন এই মিলটা যেভাবে বসছে সেই খুনের ছকে; সেটা শুধু ভয়াবহ না, অত্যন্ত বিপজ্জনকও।
আদিয়াত বলল,
— “এই রেজা যদি সত্যিই আরশীনের বাবার মৃত্যুর পেছনে থেকে থাকেন, তাহলে তার সামনে দিনগুলো সত্যিই খুবই কঠিন এবং ভয়াবহ হবে।”
আদিয়াত আরশীনকে প্রতিটি পদক্ষেপ জানিয়েছে। তবে একটা বিষয় ছাড়া… আরশীন এসে একটু দূরে দাঁড়াল।
— “এতকিছু জেনেছেন আপনি এরমধ্যে?”

আদিয়াত একবার শুধু তাকাল। চোখে ছিল না কোনো বিস্ময়, যেন সে জানতই আরশীন আসবে, এই প্রশ্নও করবে। হালকা মাথা নেড়ে বলল,
— “হুমমম…”

আরশীন এক পা এগিয়ে এল।
— “সব বলবেন না?”

আদিয়াত ধীরে বলে,
— “আপনি যা জানেন, তার চেয়েও কিছু বেশি ঘটেছে। কিন্তু এখন বললে আপনি আরও অস্থির হবেন। আরও কিছু ক্লু পেয়ে নিই…”

আরশীন একটু কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “আরও বেশি কিছু জানতে পারব আমি? এখনো কিছু বাকি? কবে জানব?”
— “আজ না, আরশীন। আমি বলব আপনাকে।”
আরশীন আর কিছু বলল না। শুধু জানালার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। অজানা কোনো ভয়, আর পরিচিত একজন মানুষ; এই দুইয়ের মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে।
বিশ্বাস—একটা অদৃশ্য সেতু, যা গড়ে ওঠে না দিনে দিনে বরং জন্ম নেয় বহু নীরব মুহূর্তের ভিতর দিয়ে। আরশীন আর আদিয়াত, দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের মানুষ। একজনের জীবন কাঁটায় ভরা রহস্যে ঢাকা, অন্যজনের স্বভাব গম্ভীর, মেপে চলা। তবু দু’জন দু’জনের দিকে যে ভরসার চোখে তাকাতে শুরু করেছে, সেটা যেন এক অলিখিত অঙ্গীকার।
আরশীন তার জীবনের সবচেয়ে গোপন, সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়টা আদিয়াতকে বলেছে। এটা সে তখনই করেছে, যখন সে ভেবেছে—এই মানুষটি বুঝবে, পাশে থাকবে, বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না।
আদিয়াত; যে তার অনুভূতি লুকিয়ে রাখে, সহজে কিছু প্রকাশ করে না—সে মুখে না বললেও নিজের কার্যকলাপেই প্রমাণ করে দিয়েছে, সে আরশীনকে রক্ষা করতে চায়। তাদের সম্পর্কটা এখনো প্রেমে মোড়ানো কোনো গল্প নয় বরং সতর্ক ভরসার পথচলা। সেখানে অবিশ্বাসের জায়গা নেই, কিন্তু প্রশ্নের জায়গা আছে। আর সেই প্রশ্নগুলো যখনই উঠে আসে, তখন দু’জনের চোখেই একটা অসাধারণ উত্তর লেখা থাকে—“আপনি থাকেন, আমি আছি।”
এই বিশ্বাসই তাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; ধীরে ধীরে, কিন্তু স্থিরভাবে।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-০৯]
~আফিয়া আফরিন

(ছু মন্তর ছু)
আরশীনের একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করল। এই যে আদিয়াত সবকিছুতে তাকে সাহায্য করছে। কিন্তু সে তো স্বার্থপরের মত এসেছিল, নিজের স্বার্থ হাসিল করতে। আদিয়াত ইচ্ছে করলেই তাকে কড়া কিছু বলতে পারত অথবা ছেড়েও দিতে পারত। কিন্তু তার বদলে এসে উপকার করছে। কেন? জিজ্ঞেস করবে একবার?
আরশীনের দ্বন্দ্ব—মনে মনে বারবার প্রশ্ন করছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ, আদিয়াত ভবতে পারে, তার নিঃস্বার্থ সাহায্যের মূল্যটা আরশীন বুঝতে পারছে না? তবুও মন তো চুপ করে থাকে না। এক সন্ধ্যায়, হালকা আলোয় ছায়া পড়া বারান্দায় বসে, একটু ইতস্তত করে আরশীন অবশেষে বলেই ফেলল,
— “শুনুন… একটা কথা বেশ ভাবছি। এখন বলব? মাত্র ফিরলেন অফিস থেকে।”
— “বলুন।”

আরশীন খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
— “এখন তো আপনি সবকিছুই জানেন। মানে, আমি আপনাকে কেন বিয়ে করেছি এটাও জানেন। আপনার আমাকে স্বার্থপর মনে হয় নাই? আমিতো কাজটাই করেছি স্বার্থপর এর মত। সবকিছু জেনেও আপনি উল্টো আমাকে সাহায্য করছেন। কেন করছেন এসব? আমি তো আপনাকে বাধ্য করিনি। আপনি চাইলে ছেড়েও দিতে পারতেন। কড়া কিছু বলতেই পারতেন… তাও না। বরং পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেন?” তার কণ্ঠে ছিল একরাশ কৌতূহল, একটু ধোঁয়াটে দ্বিধা, আর লুকোনো কৃতজ্ঞতা।
আদিয়াত তখন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বাতাসে শুধু ছিল পাখির ডাকে ভেজা এক শান্ত সন্ধ্যা। তারপর চোখ সরিয়ে বলল,
— “কারণ সবাই যদি নিজস্ব স্বার্থ নিয়েই বাঁচে, মানুষ বলে আর কিছু থাকবে না। আপনি না চাইতেও আমাকে অনেক কিছু বলে ফেলেছেন। আমি শুনেছি, মনে হয়েছে আপনর পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিল; তাই দাঁড়িয়েছি।”

আরশীনের মনে হলো, উত্তরটা তার প্রত্যাশার চেয়েও গভীর। আর মনে মনে সে বলল— “এ মানুষটা ঠিক তেমন নয়, যেমনটা প্রথমে ভেবেছিলাম।”
ফের জিজ্ঞেস করল,
— “তবুও অপ্রত্যাশিতভাবে আপনার কপালে জুটে গেলাম, আফসোস হয় না আপনার? এরচেয়ে ভালো জীবন আপনি পেতে পারতেন!”
— “হয়তো ভালো জীবন পেতে পারতাম… কিন্তু যেহেতু পাই নাই তাই আফসোসের জায়গাও নেই। কেন করব আফসোস? লাভ আছে? নেই তো‌। তাহলে?”
আদিয়াত থামল কিছুক্ষণ। আরশীনের নীরবতা বোঝার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
— “আর একটা কথা, আপনি কপালে জুটে যাননি। আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন, হয়তো আমার জীবনে আসার কথা ছিল বলেই এসেছেন।”

আদিয়াতের কথাটা এত সহজ, অথচ এত গম্ভীর ছিল যে আরশীন প্রথমে একটু চুপ করেই গেল। কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তার নিঃশ্বাস আটকে গেল যেন। বুকের ভেতরটা কেমন গুমগুম করে উঠল। মনে হলো কেউ যেন ভিতরে নরম করে একটা আলো জ্বেলে দিল।
আরশীন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল আদিয়াতের দিকে। এই মানুষটা এতটা গভীরভাবে ভাবতে পারে, এতটা নির্লিপ্তভাবে হৃদয়ের কথা বলে দিতে পারে; সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। ওর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল। নরম, নিরীহ এক হাসি। চোখে একরাশ প্রশংসা। এই মানুষটা… দিনে দিনে কেমন যেন আপন হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে। অকারণেই। সেই মুহূর্তে আরশীন বুঝল, সে আবার এক দফা হেরে গেল। তবে দুঃখের কাছে নয়; এটা বড্ড সুখের হার, মুগ্ধতা মেশানো হার। সে হেরে গেল একটুখানি নিঃশব্দে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে।

এই পুরো জটিলতা, গোপন রহস্য, ভয় আর সাবধানতার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে আদিয়াত আর আরশীনের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক ধরণের আশ্রয়। শুরুতে ছিল দূরত্ব, ছিল অস্বস্তি, ছিল মুখে না বলা অনেক কিছু। কিন্তু এখন? এই সম্পর্কটাকে আর কোন নাম দিতে হয় না। এটা বন্ধুত্ব, আস্থার, নির্ভরতার একটা সহজ অথচ গভীর সংজ্ঞা। এখন কথা বলার আগে আর ভাবতে হয় না আরশীনকে, কী বললে আদিয়াত কিছু মনে করবে? আদিয়াতও ওর দিকে তাকিয়ে সহজ হাসি হেসে বলতে পারে,
— “আপনি চাইলে সব বলতে পারেন। আমি শুনছি।”
এই সম্পর্কের মধ্যে এখন রোজকার দিনের মতোই স্বাভাবিকতা এসেছে। একটা হাসি, একটা দৃষ্টি কিংবা এক গাল মৃদু অভিমান; সবকিছুতেই ওরা বোঝে একে অপরকে। কোন জট নেই, কোন প্রমাণের দরকার নেই, শুধু বিশ্বাস আছে, আর নিঃশব্দে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। এ সম্পর্ক এখন আর কেবল দু’জন মানুষের মধ্যে নয়; এটা যেন একটা সুর—শান্ত, অবিরাম, এবং সৎ।
.
আকাশে তখন বিকেলের নরম আলো। সূর্য একটু একটু করে হেলে পড়ছে পশ্চিমে। কলাবাগানের রাস্তাগুলো যেনো চেনা অথচ অচেনা লাগে আরশীনের কাছে। অনেকদিন পর ফিরেছে এই বাড়িতে—যেখানে তার শৈশব, যেখানে তার বাবার ছায়া এখনও দেয়ালে দেয়ালে লেগে আছে। হুট করেই ওর মনে হলো, একবার ফিরে দেখা দরকার, কিছু স্মৃতি, কিছু উত্তর, হয়তো কিছু অসমাপ্ত কথা।
আদিয়াতকে এখানে আসার কথা বলতেই সে চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওর পাশে বসে রওনা হয়। রাস্তা জুড়ে দু’জনের মধ্যে খুব একটা কথা হয় না।

কলাবাগানে পৌঁছে, পুরনো বাড়িটার গেট ছুঁয়ে আরশীন একবার চোখ বন্ধ করল। যেনো সে বাড়ির নিঃশ্বাস শুনতে চাইছে। বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে পা রাখতেই এক ধরনের ঘনতা নেমে এল। ধুলোমাখা সিঁড়ি, দেয়ালের ফ্রেমে বাবার ছবি, সব যেনো নীরবে অপেক্ষা করছিল তার ফেরার। আরশীন ধীরে ধীরে ঘরগুলোতে হাঁটতে লাগল, আদিয়াত কিছু দূরে দাঁড়িয়ে, ওর চোখে একটা অদ্ভুত মমত্ববোধ। সে বুঝতে পারছে, এই বাড়ি আরশীনের শুধু একখণ্ড ইট-কাঠ না, এটা একখণ্ড অতীত; একটা অসমাপ্ত অধ্যায়। আরশীনের চোখে তখন ভিজে আলো। সে শুধু ফিসফিসিয়ে বলল,
— “সবকিছু যেনো একসাথে ফিরে আসছে…”
— “কারা ফিরে আসছে?”
— “স্মৃতিরা সব একত্রে। এখানে একসময় আমার বাবার সাথে সবাই ছিলাম… বাবাও ছিল।”
অরশীনের মত বাড়িটাও তখন নিঃশব্দে শ্বাস নিল।

দখিনা জানালায় হালকা বাতাস ঢুকছে। পর্দা একটু-একটু করে দুলছে। জানালার ফাঁক গলে সোনালি আলো পড়ছে আরশীন আর আদিয়াতের মুখে। দুজন পাশাপাশি বসে। আরশীন প্রথমে কথা বলল। নরম গলায়, যেন নিজের মনেই বলে ফেলে,
— “এই বাতাসটা ছোটবেলায় খুব ভালো লাগত। মনে হতো, জানালার এপারে আমি, ওপারে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
— “অপেক্ষা করত কি?”

আরশীন হেসে ফেলল।
— “জানি না। হয়তো করত না। আমি নিজেই কল্পনা করতাম। গল্প বানিয়ে রাখতাম মনে মনে।”

আদিয়াত তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল,
— “আপনার কল্পনা ভালো। আমি তো এতটা ভাবতেই পারতাম না। জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবতাম, আকাশে উড়ে যাওয়া পাখিটা যদি আমার কাছে এসে বসত… ব্যস।”
— “তাহলে তো আপনি একদম বাস্তববাদী।” আরশীন একটু কৌতুক মেশানো চোখে তাকায়।
— “হ্যাঁ, কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে অবাস্তব জিনিসও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। যেমন…” আদিয়াত কথাটা মাঝপথে থামাল।
— “যেমন?”
— “কিছু না বাদ দিই। সব কথাও বলতে ইচ্ছে করে না।”
— “তবে কি না বলা কথাগুলো বুঝে নিতে হয়?”
— “অনেককিছুর উপর নির্ভর করে সেটা। সবক্ষেত্রে না বলা কথা বোঝা সম্ভব হয় না। আমরা তো সকলের মনের ভেতর বসে থাকতে পারিনা তাই না?”
— “হুমম।” আরশীন একটু গম্ভীর স্বরে বলল।
দুজন এখনো পাশাপাশি জানালার ধারে বসে আছে। আলো একটু কমে এসেছে। বাইরের গাছের পাতা ধীরে দুলছে, বাতাসে। ওদের কথাবার্তা হালকা কিন্তু গভীর। আরশীন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
— “আপনার প্রিয় রঙ কী?”

আদিয়াত একটু ভেবে বলল,
— “প্রিয়? উমমম… প্রিয় কিনা জানিনা তবে সবচেয়ে বেশি শান্তি লাগে সবুজে। গাছের পাতার মতো। আপনার?”
— “আমার নীল। আকাশের নীল, পানির নীল, কেমন যেন গভীরতা আছে এই রঙে।”

আদিয়াত হেসে বলল,
— “তাই তো… আপনি একটু গভীর ভাবের মানুষ।”

আরশীন তাকিয়ে বলল,
— “আর আপনি একটু চাপা স্বভাবের। নিজের কিছু বোঝাতে চান না, তাই না?”
— “সবাই কি সব কথা বলে দিতে পারে?”

আরশীন ধরা পড়ার হাসি দিয়ে বলল,
— “আমি পারি। মাঝে মাঝে ভাবি, বেশি বলে ফেলি। আপনি হয়ত ভাবছেন, আমি খুব বেশি কল্পনাবিলাসী।”

— “ভাবছি না।” আদিয়াত বলল, “আপনার কথা শোনার মধ্যে একটা নির্ঝঞ্ঝাট ব্যপার আছে।”

আরশীনের চোখ একটু বড় হলো। সে বলল,
— “নির্ঝঞ্ঝাট? আমি তো সাধারণ কথাই বলি।”
— “তাই তো… সাধারণ জিনিসগুলোই তো অনেক সময় সবচেয়ে বেশি নির্ঝঞ্ঝাট মনে হয়।”

আরশীন এবার চুপ করে গেল। তারপর বলল,
— “আপনার অপছন্দ কী?”

আদিয়াত চোখ ঘুরিয়ে তাকাল বাইরের দিকে,
— “ভান করা মানুষদের একদম পছন্দ না। যারা কিছু হয়ে ওঠার ভান করে, অথচ ভেতরে ফাঁপা।”

আদিয়াত পাল্টা প্রশ্ন করল না তবে আরশীন নিজ থেকেই বলল,
— “আমি একা থাকতে পছন্দ করি কিন্তু অবহেলা পছন্দ করি না।”
দুজন একসাথে চুপ করে গেল। বাতাস বইতেই থাকল। হালকা দখিনা বাতাসে আরশীনের চুল এলোমেলো হয়ে উড়ে এসে আদিয়াতের মুখ ছুঁয়ে যায়। এক গুচ্ছ চুল ওর চোখের কোণে লাগতেই সে ধীরে হাত তুলে সরিয়ে দেয়, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। মুখে কিছু বলে না, যেন কথার ছন্দ না ভেঙে যায়। আরশীন তখনও জানালার দিকে তাকিয়ে, কথার ভেতরে ডুবে।
.
সকালের আলো পুরোপুরি ছড়িয়ে গেছে শহরের গায়ে। আদিয়াত প্রতিদিনের মতো ঠিক সময়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। আরশীন এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আজকে। সে দ্রুত কাগজপত্র গুলো গুছিয়ে নিল। খুনের মামলার ফাইল, তাওহীদ খানের নাম সেখানে আসামী হিসেবে আছে—আরশীন কিছু তথ্যপ্রমাণ এক বিশেষ সূত্রে জোগাড় করেছে। সে শুধু একটাই কথা মনে মনে বলল,
— “আমাকে একাই সবটা সামলাতে হবে। এই ব্যাপারে আদিয়াত বা আংকেল কাউকে কিচ্ছু বলব না। যতযাই হোক, তাহমীদ তাদের নিজের মানুষ।”
ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল সাড়ে ন’টা ছুঁইছুঁই। আদিয়াত বেরিয়ে গেছে আধঘণ্টা আগে। চোখেমুখে শান্তভাব কিন্তু অন্তর্গত স্নায়ু টানটান। রান্নাঘর থেকে নাজনীন ভরাট গলায় ডাক দিলেন,
— “বাহিরে যাচ্ছো নাকি মা?”

আরশীন একপ্রকার বাধ্য হয়ে মিথ্যে কথা বলল,
— “হ্যাঁ আসলে, আদিয়াত একটা ফাইল ভুল করে রেখে গেছে। ওটা দিয়ে আসি অফিসে।”

নাজনীন এগিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়ালেন।
— “ঠিক আছে, সাবধানে যেও।”
আরশীন হালকা হাসল। দরজার হাতল ধরা হাতটা একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। আজ ওর চলার পথে সত্য আর বিপদের এক অদৃশ্য সমীকরণ লেখা আছে।

কিছুক্ষণ পর….
নিচতলায় দরজা খোলার শব্দ হতেই নাজনীন ভেবেছিলেন, আরশীন ফিরে এলো বোধহয়। কিন্তু অবাক হলেন কারণ দরজার ফাঁকে দেখা দিল আদিয়াত।
— “তুই এখন এখানে?” নাজনীন অবাক হয়ে বললেন।
— “হ্যাঁ মা, একটা ফাইল বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম। সেটাই নিতে এলাম।”

নাজনীন তখন কিছুটা কৌতুহলী হয়ে বললেন,
— “ফাইলের কথা তো আরশীন বলল। ও এক ঘণ্টা হলো বেরিয়ে গেছে… বলল, তুই অফিসে রেখে গেছিস,

আদিয়াতের মুখের হাসি এক মুহূর্তে জমে গেল। মনে মনে বলল,
— “কোন ফাইল? আমি তো ওকে কিছু বলিইনি।”
কিন্তু মুখে বলল, — “ওহ আচ্ছা, আমি দেখছি।”
— “আরশীনকে কোথায় রেখে এলি? ও তোর সাথে ফিরল না কেন?”
আদিয়াত কিছু না বলে তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর ঢুকল। নিজের টেবিলের উপর খোলা অবস্থায় ফাইলটা তখনো পড়ে আছে। সে ফাইলটা হাতে তুলল, ভেতরের কাগজগুলোর অবস্থানও একদম আগের মতোই। সে থমকে দাঁড়াল। চোখের ভেতর চিন্তার গাঢ় ছায়া। আরশীন কোথায়? সে গেল কোথায়, কোন অজুহাতে, কেন? আবার কোন বিপদ-আপদ হলো না তো? কিন্তু ও মিথ্যে বলে যাবে কেন? তার মাথায় তখনই ফের আরেকটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো—আরশীন কিছু একটা লুকোচুরি খেলা খেলছে। আদিয়াত ফাইলটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। সে বারবার ফোন হাতে তুলে আবার নামিয়ে রাখে। ইচ্ছে করেই ওকে একটা ফোন করল না। ফিরলে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করবে। অফিস যাওয়ার কথাও মাথা থেকে মুছে গেল। ফাইল টেবিলের একপাশে রেখে সোফায় বসে রইল আদিয়াত, নিঃশব্দে। সময় কেটে যায় ধীরে ধীরে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঘড়ির টিকটিকি যেন বিরক্তিকর শোনায়।
ডোরবেল বাজল। নাজনীন এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। আরশীন ঢুকল, মুখে একগাল ক্লান্তি আর হালকা একটা তৈরি হাসি। আরশীন ঘরের দরজায় পা রাখতেই চমকে উঠল। আদিয়াত… একদম চুপচাপ। চোখে স্থির দৃষ্টি। আরশীনের মুখ শুকিয়ে গেল। পায়ের শব্দ হঠাৎ থেমে যায়।
— “আ… আপনি?”
আদিয়াত কোনো ভঙ্গি পাল্টাল না। শান্ত, নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দিল,
— “হ্যাঁ, অন্য কাউকে আশা করেছিলেন নাকি?”
আরশীন এখন পুরোপুরি থেমে গেছে।
— “না না, আমি তো ভেবেছিলাম…”

আদিয়াত চোখ সরাল না তার থেকে।
— “আপনি ভেবেছিলেন, আমি ফাইল ফেলে গেছি। তাই না?”
আরশীন একমুহূর্তে বোঝে, সে ধরা পড়ে গেছে। মুখে কিছু একটা বলতে চাইলেও শব্দ আটকে যায় গলায়। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— “আপনি কখন ফিরলেন?”
— “কিছুক্ষণ আগেই। তবে মজার ব্যাপার কী জানেষ? ফাইলটা ঠিক এখানেই ছিল। যেটা আপনি আমাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। আমি সত্যিই ফাইলটা ছেড়ে গিয়েছি।”

আরশীন এবার আর চোখ তুলে তাকাতে পারল না।
তার কণ্ঠ ফেঁসে গেল। পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল,
— “আসলে আমার একটা পুরনো বন্ধু এসেছে হঠাৎ। অনেকদিন পর। তাই একটু দেখা করতে গিয়েছিলাম।” একটা হাসি আনতে চাইল ঠোঁটের কোণে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ হলো না। আদিয়াত এবার ধীরে উঠে দাঁড়াল। ধারালো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
— “আমার চেহারা দেখে কি আপনার বোকা মনে হয়? বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলেন, অথচ বাড়িতে বললেন, আমি একটা ফাইল ফেলে গেছি। সেটা আপনি নিয়ে যাচ্ছেন আমার অফিসে। তাই তো?”
আরশীন এবার চুপ করে রইল। গলা শুকিয়ে গেছে।
— “আসলে মা কী না কী মনে করেন তাই… আমি ভাবলাম বন্ধু আর দেখা, এসব শুনলে হয়তো প্রশ্ন করবে। তাই ফাইলটাকে অজুহাত বানালাম। ওটাই সহজ মনে হলো।” স্পষ্ট বোঝা যায়, সে সত্যি-মিথ্যার এক অদ্ভুত জায়গায় দাঁড়িয়ে। আদিয়াত কিছুক্ষণ ওর দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল। নির্বিকার কণ্ঠে বলল,

— “আচ্ছা ঠিক আছে।”
— “কী ঠিক আছে? আরে শুনুন তো আমার কথা…”
আদিয়াত ধীরে ঘুরে গেল, যেন আর শুনতে চায় না কিছু। সে সোফায় গিয়ে বসল চুপচাপ। সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে, যেন আরশীনের দিকে চোখ না পড়ে আর ওর ওপর রাগ বজায় থাকে।
আরশীন একটু থেমে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আদিয়াতের পেছনে। মুখটা একটু কুটিল করে বলল,
— “তাহলে আপনি এখন অফিশিয়ালি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না?”
আদিয়াত কোনো উত্তর দিল না। চোখ সরিয়ে রাখল। আরশীন একটু এগিয়ে এসে আবার বলল,
— “তাহলে কি ধরে নেব, আপনি এখন ‘বিদ্বেষবানের চেয়ারম্যান’ হয়েছেন?”
আদিয়াত চোখ বন্ধ করে হাতটা কপালে রাখল।
আরশীন এবার পেছন থেকে এসে হালকা কাশল। নাটুকে গলায় বলল,
— “আপনার এই রাগ দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ, যে ভেবেছি আপনার নামে একটা চরিত্র লিখব। নাম হবে রাগী স্যার, যিনি কথা না বলেই যুদ্ধ জিতেন।”

এইবার আদিয়াত মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল।
— “সবকিছু নিয়ে মজা করা আমার পছন্দ না।”
— “আমি ভুল করেছি, ঠিক আছে। তবে আপনার এই রাগটাও একটু বেশি সিনেমাটিক না?”
— “সিনেমাটিক?” আদিয়াত ভুরু কুঁচকে তাকাল।

আরশীন সুযোগ বুঝে পাশে বসে বলল,
— “অবশ্যই। রাগ করলে আপনাকে দেখতে সুন্দর লাগে, তাই ইচ্ছে করেই রেগে আছেন। ভেবেছেন কি, বুঝিনা আমি?”

আদিয়াত গম্ভীর গলায় বলল,
— “তা হলে তো আপনি আমার রাগের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। সেক্ষেত্রে আমি আর রাগ ভাঙাব কেন?”

আরশীন চোখ বড় করে বলল,
— “মানে আপনি এবার রাগকে পুঁজি করে বসে থাকবেন?”

আদিয়াত একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “আপনি যদি আমার রাগে সৌন্দর্য খুঁজে পান, তবে আপনাকে সৌন্দর্য দান করাই তো আমার দায়িত্ব।”
— “আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি থাকেন আপনার সৌন্দর্য নিয়ে, আমি গেলাম।”
— “অবশ্যই নিজের সৌন্দর্য নিয়ে থাকব। আছে তাই থাকছি। মানুষের থেকে তো আর তাদের সৌন্দর্য ধার নিতে যাই নাই।” আদিয়াত কথাটা বলল নির্বিকার ভঙ্গিতে। আরশীন ওর ঠান্ডা কথা শুনে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

দুদিন কেটে গেছে।
আরশীন হাল ছেড়ে দেয়নি, আদিয়াতের রাগ ভাঙানোর চেষ্টায় ছিল একেবারে সিরিয়াস মুডে। কিন্তু আদিয়াত, ঠিক যেন একটা বরফের পাহাড়। না গলছে, না টলছে।
আজ সকালে আদিয়াত খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে অফিসে, একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। মাথায় কাজের চাপ। মিটিং রুমে ঢুকে ফাইল খুলে যেমনই পাতাগুলো উল্টাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ভাঁজ করা কাগজ বেরিয়ে এল মাঝখান থেকে। ফাইলের মাঝে এমন কিছুর থাকার কথা না। আদিয়াত কপাল কুঁচকে কাগজটা খুলল। চোখে পড়ল পরিচিত হাতের লেখা:
“হ্যালো মিস্টার রাগী স্যার… ছু মন্তর ছু! স্যারের রাগ এখনই ভালো হয়ে যা। একটা হালকা হাসি দিলে তো আর আকাশ ভেঙে পড়বে না, তাই না?”
নিচে ছোট্ট একটা মুখ আঁকা—জিভ বের করা একটা কার্টুন টাইপ স্মাইলি। আর কোণায় লেখা:
“বি.দ্র. আপনার এই রাগী মুখের ছবি যদি আমি কালকে তুলতাম, তাহলে ফটো ফ্রেমে রেখে দিতাম, ‘জুন মাসের মেঘলা মুখ’ নামে!”

আদিয়াতের ঠোঁটের কোণে এক মুহূর্তের জন্য হাসি খেলে গেল। হাতের কাগজটা একটু ভাঁজ করে নিল পকেটে। পাশে বসা সহকর্মী জিজ্ঞেস করল,
— “স্যার কোনো সমস্যা? এটা কীসের কাগজ?”

আদিয়াত মাথা নাড়ল।
— “না, কিছু না… একটু ব্যক্তিগত জাদুবিদ্যার চিঠি পেয়েছি মনে হয়।” সবাই মৃদু কৌতূহলী চাহনিতে তাকিয়ে রইল আদিয়াতের দিকে।
.
.
.
চলবে….