তবুও তুমি পর্ব-১০+১১+১২

0
11

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১০]
~আফিয়া আফরিন

(সহচর)
আদিয়াত মিটিং শেষ করে কেবিনে ঢুকল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সে থমকে যায়। চেয়ারে বসে আছে আরশীন। হাসি থেমে আছে ঠোঁটের কোণে, কিন্তু চোখে খেলে যাচ্ছে দুষ্টু একটা ছায়া। ও চেয়ার ঘুরিয়ে সামনের দিকে এসে বলে,
— “চলে এলাম। আপনি তো আমাকে ট্রিট দিবেন, তাই আগেভাগেই চলে এসেছি।”

আদিয়াত দরজা বন্ধ করে হেঁটে আসে। কপালে ভাঁজ রেখেই জিজ্ঞেস করে,
— “ট্রিট? কীসের ট্রিট?”

আরশীন গম্ভীর মুখে বলে,
— “এই যে আপনার রাগ ভাঙা গেল, এইজন্য।”
— “কে বলল আমার রাগ ভেঙেছে? আর আমি তো রাগ করি নাই, সেখানে ভাঙ্গানোর প্রসঙ্গ কী করে আসে?”
— “ওহ আচ্ছা, তারমানে চিরকুটটা আপনি পড়েছেন। ভালোই হয়েছে…”

আদিয়াত চেয়ার টেনে বসে। একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলে,
— “এসব উল্টোপাল্টা কাজ করা কি আপনার অভ্যাস না শখ?”
— “সবার বেলায় সব খাটে না। কারো বেলায় অভ্যাস, কারো বেলায় ইচ্ছে, কারো বেলায় শখ।”
— “আচ্ছা? আমার বেলায় কি?”
— “আপতত শখ!” আরশীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
— “আমি তো শুধু মনে করিয়ে দিলাম… আপনি হাসলে আকাশ ভেঙে পড়ে না।”

আদিয়াত চাপা স্বরে বলে,
— “এখানে হঠাৎ? আজকে তো কোনো ফাইল রেখে আসি নাই।”

আরশীন বেশ আয়েস করে হেলান দিয়ে বসে বলল,
— “উফফ, সবসময় খোঁচাবেন না তো। বললাম না, ট্রিট নিতে এসেছি।”
— “সত্যি কথা বললাম।”
— “রাখুন আপনার সত্য কথা… সত্যবাদী যুধিষ্ঠির।”
আরশীন এবার ব্যাগ থেকে দুইটা আইসক্রিমের কাপ বের করল। একটা আদিয়াতের দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,
— “নিন, মাথা ঠান্ডা করুন। আপনার রাগের অবসান উপলক্ষ্যে ট্রিট আজ আমিই দিচ্ছি।”

আদিয়াত চোখ ঘুরিয়ে বলে,
— “মানে আপনি ঠিক ধরে নিয়েছেন আমি মেনে নিয়েছি?”
— “আশ্চর্য! ধরে নিতে হবে কেনো? আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। এখন চুপচাপ খান তো। গরমে আইসক্রিম গলে যাচ্ছে তবুও আপনার মন গলে না। কী ইস্পাত দিয়ে গড়া মন রে বাবা!”
আদিয়াত হালকা হেসে আইসক্রিমের কাপটা হাতে নিল। চামচে আইসক্রিম তুলে আরশীন বলল,
— “আপনার রাগ ভাঙানোর পারিশ্রমিক হিসেবে পরেরবার একটা কফিশপে বসা চাই। অফিসের সবাই কাজে ব্যস্ত আর চেহারাও কেমন গম্ভীর। এরা বোধহয় হাসতে জানেনা, তাইনা? এখানকার বাতাস একটু বেশিই ভারি।”
— “আপনিই আগে অফিসে চলে এসেছেন আবার বাতাস নিয়ে অভিযোগ করেন?”

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে দুজনেই সেদিকে তাকায়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে নীরা। চোখে সূর্যচশমা ঠেলে তোলার আগেই থেমে যায় কয়েক পা দূরে। তার চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে পড়ে চেয়ারে বসা মেয়েটির দিকে—আরশীন। এক মুহূর্তে তার চোখে কৌতূহল, তারপর বিস্ময়, আর শেষে একরকম চাপা-সচেতন দৃষ্টি খেলে যায়।
আরশীন তখনও বসে, ওর দিকে তাকিয়ে। চিনতে পারল, আলিয়া একদিন ফ্যামিলি ফটোতে ওর ছবি দেখিয়েছিল। আরশীন ভদ্র একটা হাসি দিয়ে বলল,
— “হ্যালো। আপনি নিশ্চয় নীরা?”

নীরার চোখে তখন একধরনের বিশ্লেষণ চলছে।
এই মেয়েটি তো সে, যার জন্য তাকে আদিয়াতকে হারাতে হয়েছিল। সে আবার সুন্দর করে হেসে হেসে কথা বলছে? বাহ্! এত আনন্দ তার? নীরা ওর আপাদমস্তক পরখ করল। মেয়েটার গায়ের রং পুরোপুরি ফর্সা নয়, তবে খুব সুন্দর যেন খুব যত্ন করে আঁকা হয়েছে। চুলগুলো পেছনে বেঁধে রেখেছে, খুব সাধারণভাবে অথচ চোখ আটকে যায়। সাজগোজের বালাই নেই, তবুও ঠোঁটে হালকা একটা গোলাপি ছায়া, আর চোখের নিচে এক বিন্দু কালি; যেটা লুকোনোর কোনো চেষ্টা করেনি।
চেহারায় ক্লাসিক সৌন্দর্য নেই কিন্তু এমন একটা ভারসাম্য আছে, যেটা দেখলে মনে হয়, কেউ তাকে গড়ে তুলেছে যত্নে—একটু একটু করে। চোখদুটো শান্ত, গভীর আর কেমন যেন দেখেই ফেলা যায় ভেতরের আত্মবিশ্বাসটা। আর হাসি, তা ছিল শব্দহীন একটা কবিতার মত। ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁক আর ঠোঁট না নাড়লেও চোখ মৃদু হাসতো। এই ভঙ্গিতেই আরশীন তাকিয়ে আছে নীরার দিকে। নীরার চোখের দৃষ্টি স্থির। সে কিছুটা এগিয়ে এসে একটু কাঁধ বাঁকিয়ে আরশীনের দিকে তাকাল। স্বভাবজাত ভদ্রতা রেখে, কিন্তু গলায় চাপা জিজ্ঞাসার সুরে বলল,
— “তুমি এখানে এই সময়ে? কাজের সময় বাহিরের মানুষ এলাও করা হচ্ছে বুঝি আজকাল?”

আরশীন সামান্য অবাক চোখে তাকাল নীরার দিকে। জবাবটা এল স্বাভাবিক স্বরে,
— “অসময়ে এসে পড়েছি বলে তো মনে হয় না।” একটু বিরতি নিয়ে নরম ভঙ্গিতে যুক্ত করল,
— “এই একই প্রশ্নটা আমারও আপনাকে করার ছিল, আপনি এখানে আজ এই সময়ে?”

নীরার চোখে এক মুহূর্তের কৌতুক, যেন প্রশ্নটা নিজের দিকেই ঘুরে এসেছে বুঝে গেছে। সে ঠোঁট একটু আঁকাবাঁকা করে বলল,
— “তার কৈফিয়ত আমি তোমাকে কেনো দিব? তুমি এখন এসো। আদিয়াতের সাথে আমার জরুরী কিছু কাজ রয়েছে।”
— “আমিও জরুরী কাজে এসেছি। আমার কাজ শেষ হোক তারপর এন্ট্রি নিন প্লিজ। এমনিতেই নক না করে সরাসরি কেবিনে চলে এসেছেন। কারো পার্সোনাল সময় তাকে ডিস্টার্ব করা কি অফিস কালচারের মধ্যে পড়ে?”
— “ওয়েট… তুমি আমাকে কালচার শেখাচ্ছো? তাও এই অফিসের? ওয়াও! আদিয়াত কিছু বলবে না? কয়দিন হলো এসেছে ও? সবজান্তা শমসের হয়ে গেছে এরইমধ্যে?” আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নীরা।

আদিয়াত বলে,
— “এটা অফিস, তর্ক কিংবা কথা কাটাকাটির জায়গা নয়। দু’জনেই…”
আরশীন মাঝ পথে ওর কথা কেটে নিজে বলে,
— “তুমি তো কথা আমার সাথে বলছিলে নীরা। মাঝখানে আদিয়াতকে টানাটানি করছ কেনো? আমার সাথে কথা বলো।”
আরশীন ধীরে নীরার দিকে এগিয়ে এলো। একেবারে কাছে এসে মাথা একটু ঝুঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “আমার স্বামীর প্রতি এত আগ্রহ কেনো গো? জানোনা সব জায়গায় প্রবেশের আগে দরজায় কড়া নাড়তে হয়… বিশেষ করে যেখানে ভালোবাসা বসবাস করে।”
আরশীনের ঠাণ্ডা কথাটা যেন গায়ে ছুরি চালানোর মতো করে এসে বিঁধল নীরার ভেতরে। একটা মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর,
— “ধ্যাঁত!” এক গুচ্ছ কাগজ আর ফাইল নীরার হাত থেকে ছিটকে পড়ল টেবিলের উপর। নীরার চোখ আগুনের মতো জ্বলছে। গলার স্বর চাপা কিন্তু তীক্ষ্ণ,
— “আদিয়াত বাবা তোমাকে এই ফাইলগুলো দিতে বলেছিল। এটা দিতেই এসেছি।” তারপর এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে আরশীনের দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বলে উঠল,
— “তোমার বউ একটা জংলী। সোজা কথা সোজাভাবে নিতেই পারে না।” ঘরে একটা থমথমে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। আদিয়াত কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আরশীন ফাইলগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে স্থিরতায় উত্তর দিল,
— “আদিয়াত এখন এসব দেখতে পারবে না। আমরা বাইরে যাব।” ও এমন এক সুরে কথাটা বলল যেন ঘরের মালিক সে-ই। আরশীন এবার একধাপ এগিয়ে এসে, নীরার চোখে চোখ রেখে বলল,
— “বিবাহিত মানুষদের ব্যক্তিগত সময় বলে একটা জিনিস থাকে, এত বিরক্ত করলে চলে বলো?” তার ঠোঁটে হালকা হাসি। নীরার চোখ কাঁপে এক মুহূর্ত। রাগে, অপমানে, আর হয়তো একটু হেরে যাওয়ার আতঙ্কে।
আদিয়াত তখনো কিছু বলেনি। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, দুই চোখে একরকম একরকম আশ্চর্যতা।
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি কিন্তু সেটা যেন গোপন রাখা কষ্টকর।
নীরা এক পা পেছনে হটে, চোখ ঘুরিয়ে বলে,
— “গো টু হেল। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও।” সে আর কারও জবাবের অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। দরজাটা একটু বেশি জোরে বন্ধ হয়। ঘরে তখন শুধু টেবিলের ওপর এলোমেলো ফাইল আর দুটো মানুষের চোখে একরকম নিঃশব্দ হাসি। আদিয়াত উঠে দাঁড়ায়; তখনই আরশীন ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। চোখে একধরনের মিশ্রিত তাহলে। তার গলার স্বর নিচু, ধীর, কিন্তু ধারালো। হুমকি নয়; ঘোষণার মতো শোনায়,
— “ওর সাথে যদি আপনাকে আর কোনোদিন দেখেছি আমি, তখন কিন্তু….”
আরশীন থেমে যায়। আদিয়াত বাকি কথাটুকু টানে,
— “তখন?”
আরশীন একটু থমকায়। চোখ নামিয়ে শান্তভাবে বলে,
— “তখন দেখা যাবে। তবে বলবেন না কথা। আজকে তো হালকার উপর ছেড়ে দিলাম।”
তার গলার স্বর এবার খানিক বদলে যায়; শীতল ও স্পষ্টভাবে হুমকিসুলভ তবে ঠোঁটে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসি জ্বলজ্বলে,
— “এরপর হলে চুলের মুঠি ধরব, তারপরেও কাজ না হলে চটকানা মেরে ক-পাটি দাঁত ফেলে দিব।”

আদিয়াত এবার চোখ বড় করে তাকায়, ভুরু একটু কুঁচকে মজা করে বলে,
— “আর তাতেও কাজ না হলে?”

আরশীন এবার মুখটা কাছে এনে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
— “তাহলে আপনাকে দেখে নেব, বুঝছেন?” এত অধিকার সে কেনো ফলাচ্ছে কে জানে? অধিকার রয়েছে তবে চর্চা তো নেই। আদিয়াত বা আরশীন কেউ বুঝল কিনা কে জানে; আরশীনের এই হুমকি-ধামকির মধ্যে লুকিয়ে আছে একগাল অনাবৃত প্রেম!
আদিয়াত হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,
— “ভালোই ঝগড়া জানেন আপনি। আচ্ছা চলুন, এসব কাগজপত্র পড়ে দেখে নিব।” আরশীন উত্তর না দিয়ে পাশ ঘুরে হাঁটা শুরু করে, মুখে চাপা হাসি। ওর পাশাপাশি আদিয়াতও এগিয়ে এলো।
.
সন্ধ্যা নেমেছে কিন্তু আজ ঘরটা অন্ধকার। আলো জ্বলছে, বাতাস চলছে, তবুও চারদিকে ভারী কোনো চাপা কুয়াশা জমে আছে।
ড্রয়িংরুমের মাঝখানে সোফায় বসে আছেন সৈয়দ জহিরুল ইসলাম। তার মুখে কোনো শব্দ নেই। এক হাতে চিবুক চেপে ধরা, চোখে দূরদৃষ্টি। পাশেই বসে আছে আদিয়াত। সোজা হয়ে বসেছে কিন্তু তার কপালের ভাঁজগুলো অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। চোখে চিন্তা আর দ্বিধা একত্রিত হয়ে বলছে, “কী করব এখন?”
ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আযহান। ওর চোখের দৃষ্টি দুটো মুখে ঘুরে ফিরে যায়। কৌতূহল আর অস্থিরতা মিশে গেছে। একটা প্রশ্নই ঘুরে ফিরে মাথায়, “তাহমীদ ভাই কি সত্যিই…? কী হবে এখন?”
বিছানার ধারে বসে কাঁদছে আলিয়া। একটানা, নিঃশব্দ না—হালকা সোঁ সোঁ করে কান্নার শব্দে ভরছে ঘরের বাতাস। বারবার বলছে,
— “তাহমীদ তো এমন না… কেউ ওকে ফাঁসাচ্ছে… আমি জানি…”
নাজনীন বারবার ওর কাঁধে হাত রাখছে, পানি এনে দিচ্ছে, কখনো হাত চেপে ধরছে কিন্তু আলিয়ার কান্না থামে না। আরশীন নতজানু হয়ে বসে আছে আলিয়ার পাশে। এক হাতে আলিয়ার হাত ধরে, অন্য হাতে চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে। তার চোখেও লুকনো কষ্ট কিন্তু সে শক্ত থাকার চেষ্টা করছে।
ঘরের মধ্যে একধরনের স্তব্ধতা, চাপা ক্রন্দন, আর বিষণ্ন দৃষ্টির কারণে অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সৈয়দ জহিরুল ইসলাম হঠাৎ ফিসফিস করে বলেন,
— “অফিসার কাদেরকে ফোন করেছিলাম… কোনো সদুত্তর দিল না। কেউ কিছু বলছে না ঠিকভাবে। এত বছর আগের একটা কেস এখন সামনে এলো কেন এই জবাবদিহি আমার চাই।”

আদিয়াত এবার চোখ তুলে তাকায়।
— “কেস সামনে আসা তো বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, যেই অভিযোগ করা হয়েছে সেটা সত্য কিনা।চিন্তা করো না বাবা, আমি কাল সকালে নিজে যাব। এইটুকু এখনও বুঝলাম না, ভাইয়ার তো বাংলাদেশের সীমানায়’ও থাকার কথা ছিল না, তবে ঘটনা ঘটল কীভাবে? ভাইয়া দেশে আছে অথচ আমরা কেউ জানিনা। বিষয়টা আশ্চর্যের না?”

আদিয়াতের কথা শুনে আরশীন ঘুরে তাকায়। সে তখনও আলিয়ার পাশে বসে, চোখে গভীর সহানুভূতি। মুখ শান্ত, কণ্ঠ কোমল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কিছু কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে মনে বলে উঠল,
— “হুম… যাও, যাও কাল থানায় যাও। খুব দরকার তো, না গেলে পাপ হবে। তবে যাওয়ার আগে একটা কাজ করো, একখানা খাতা-কলম নিয়ে নিও। ওর বিরুদ্ধে আর কী কী অভিযোগ আছে, কী কী শুনতে পাবে—তা সব লিখে রাখো। মনে তো রাখতে পারবে না, পরে কেউ জিজ্ঞেস করলে গুলিয়ে ফেলবে। তার চেয়ে লিস্ট করে নিয়ে এসো। সময়েও বাঁচবে, মুখেও বাঁচবে।” কেউ টের না পায় কিন্তু ওর চোখে একটুকরো বিদ্রুপের ঝিলিক স্পষ্ট। আলিয়ার জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু তা বলে অন্যায়কারীকে তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।

পরদিন সকাল। এই বাড়ির মানুষগুলোর সারারাত ঘুম হয় নাই। সকাল হতে না হতেই আলিয়া জোর গলায় অনুরোধ করল,
— “ভাই তুই অফিসারের সাথে গিয়ে কথা বল।”
সকলেই এটা যথার্থ মনে করল। আদিয়াত দেরি করল না, গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল; গা-ঢাকা ধূসর শার্টে একরকম চুপচাপ দৃঢ়তা। আরশীন ঠিক তার পেছনে, হালকা বেগুনি কুর্তিতে, মুখে চাপা গাম্ভীর্য; বাইরে খুব স্বাভাবিক। আদিয়াত পরিচিত একজন অফিসারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে রেখেছিল। অফিসার ফাইলে চোখ রেখে বললেন,
— “তোমার আত্মীয় তাহমীদ খান… উনি এখন আমাদের হেফাজতে আছেন। কিছু গুরুতর অভিযোগের তদন্ত চলছে। অর্থপাচার, বেআইনি প্রপার্টি অর্জন, খুনের মামলায় জড়িত এবং এক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। প্রাথমিক তদন্তে একটা সন্দেহজনক একাউন্টে লেনদেন পাওয়া গেছে।”
— “আমি একটু উনার সাথে দেখা করতে চাই।”
— “আদিয়াত শোনো, ওকে এখন দেখা যাবে না। কেস প্রসিডিং চলছে। তুমি ধারণাও করতে পারবে না, আমাদের অবস্থা। ওর সাথে দেখা হয়ত নির্দিষ্ট একটা সময়ে করতে পারবে কিন্তু মনে হয় না সহজে ছাড়াতে পারবে। কাগজপত্র চাইলে কপি দেওয়া যাবে।”

আদিয়াতের গলা শক্ত হয়ে উঠল,
— “আপনারা কি জানেন কারা এই তথ্য পাঠিয়েছে?”

অফিসার একঝলক তাকিয়ে বললেন,
— “ঠিক বলা যাচ্ছে না। কিন্তু যে-ই করেছে, ভিতরের কেউ না হলে এত কিছু জানা সম্ভব ছিল না। সব তথ্যগুলো পাঠিয়েছে ডিআইজি শওকত ওসমানের কাছে।”
— “তাহমীদ ভাই কি আসলেই এসবের সাথে জড়িত নাকি কেউ ফাঁসাচ্ছে?”

অফিসার একটু চুপ থেকে বললেন,
— “সেটাই আমরা জানার চেষ্টা করছি।”
তাদের সেখান থেকে একজন পরিচিত আইনজীবী বা ভেতরের একজন জানায়,
— “তাহমীদের বিরুদ্ধে অদ্ভুতভাবে দ্রুত প্রমাণ জমা পড়েছে। এমনকি কেউ গোপনে কিছু ইমেইল, কল রেকর্ডও পাঠিয়েছে পুলিশকে।”
আদিয়াত কিছু বলল না। সে ধীর পায়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে পড়ল। আরশীনও পাশের দরজা খুলে আস্তে করে গাড়িতে উঠল। নিঃশব্দে সিট বেল্ট বাঁধল। দুজনের মাঝখানে কোনো কথা নয়, শুধু নিঃশ্বাসের মৃদু সুর।

এই মুহূর্তে আদিয়াতের কাছে আরশীন শুধু একজন স্ত্রী নয়, একজন সহচরও। অথচ সে জানে না, আজকের পুরো নাটকের পর্দার পেছনে দাঁড়ানো সেই মানুষটা আরশীন নিজেই। তথ্য পাঠানো, সন্দেহের সূচনা, সবটুকু ছিল ওরই পরিকল্পনা। আরশীন জানেনা, সত্যি উন্মোচিত হলে আদিয়াত কী করবে?
সে কি রেগে যাবে? চোখ সরিয়ে নেবে? নাকি বলবে,
— “অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তুমি ভুল কিছু করোনি।” এইসব ভাবনা আরশীনের ভিতরে একেকটা ঢেউ হয়ে উঠে আসে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। রাস্তা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। আরশীন হঠাৎ চুপচাপ ভঙ্গিতে বলল,
— “আপনার কি মনে হয়, তাহমীদ ভাইয়ার বিষয়টা… সত্যি, না মিথ্যা?”

আদিয়াত চোখ না সরিয়ে ধীর গলায় জবাব দিল,
— “বলার মতো কিছু নেই এখনো।”
— “যদি সত্যি হয়?”
— “তবে শাস্তি পাক। নিজের ভুলের মাশুল তো দিতেই হবে।”
— “তাহলে যদি প্রমাণ হয়, কোনো আপন মানুষ তথ্য প্রমান জোগাড় করেছে তবে কি বলবেন?”

আদিয়াত একটু ওর দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। চোখে ক্লান্তি,
— “আপন মানুষ হিসেবে যেহেতু চাইতেছি অন্যায় করলে তাহমীদ ভাই শাস্তি পাক তবে অবশ্যই আমার আপন মানুষ যদি এই অন্যায়কে প্রতিহত করার চেষ্টা করে তাকে তো বাহবা দেওয়া উচিত। আপন হোক, পর হোক… অন্যায়ের সামনে আত্মীয়তা বড় নয়।”

আরশীন হালকা হেসে বলল,
— “তাহলে আপনি অনেক শক্ত মানুষ।”
— “না, আমি আসলে ঠিক শক্ত নই। শুধু চাই কেউ সত্যটা আড়াল না করুক। আমি ঠকে যেতে রাজি কিন্তু মিথ্যার সঙ্গে থাকতে রাজি না।”
— “আচ্ছা ধরুন, আপনার এক আপন মানুষ যদি আরেক আপন মানুষের বিপক্ষে যায়; সেটাকে কি হিসেবে দেখবেন? কি বলতেন তখন?”

আদিয়াত এবার একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উত্তর দিল,
— “তাকে সাহসী বলতাম। কিন্তু শর্ত একটাই—প্রমাণ সত্য হতে হবে। প্রতিহিংসা নয়, ন্যায়বোধ থেকে আসা সিদ্ধান্ত হলে, সে মানুষটা সম্মানের যোগ্য।”
আরশীন ঠোঁট চেপে বসে থাকল। কিছু বলল না, শুধু চোখ নামিয়ে জানালার বাইরের শহর দেখতে থাকল। যতটুকু তার জানার দরকার ছিল, সে জেনে গেছে।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১১]
~আফিয়া আফরিন

(অনুভূতির সূচনালগ্ন)
গলির ভিতরের এক নির্জন কফিশপে সজীব আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। আরশীন দরজা ঠেলে ঢোকে। সে চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে ধীরে সজীবের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে।
— “তুমি যথাসময়ে এসেছো। আমাকে কিছুক্ষণ বাদেই উঠতে হতো।” সজীব হাসল।
— “আচ্ছা, বেশি সময় নিব না। বলো, বাকি রেকর্ডিং আর রিপোর্ট ত এনেছো?”
— “হুঁ।” সজীব ব্যাগ থেকে একটা পেনড্রাইভ এগিয়ে দেয়।
— “অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার কাজ আপাতত শেষ।”
— “তাহমীদ এখনো জানে না আমি কী করেছি। বিশ্বাস করে আমাকে। সেদিন রাতে নেশা চড়ে গেছিল আর আমি চুপচাপ রেকর্ড চালু করে দিয়েছিলাম।”
— “মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে ভেবেছিল সবকিছু করে ঠিক বেঁচে যাবে। অন্যদিকে নিজের মুখেই নিজের কবর খুঁড়েছে।”

— “ও যা করেছে, তা অপরাধ। সন্তানহারা মা-বাবা এখনও কাঁদছে, এর বিচার হওয়া উচিত।”
— “আমি ওকে চিনতাম। ওর পরিবারের কিছু করার ছিল না কারণ জানত তাহমীদ বড়ো লোকের ছেলে, আর সমাজ… সমাজ সত্যর চেয়ে নাম দেখে বিচার করে।”
— “তোমার হাজব্যান্ড কিছু জানেনা?” সজীব জিজ্ঞেস করে।
— “না, আমি চাই ও নিজে চোখে দেখুক তারপর বুঝুক; আমি যা করছি, সেটা অন্যায় নয়। ও আমাকে ভরসা করে। আমার মনে হয় না, ও আমাকে ভুল বুঝবে। যদিও বোঝে, আমি মাথা নত করব না। কারণ সত্যি জানে না মিথ্যে কোন মুখে দাঁড়াবে।”

সজীব একটু থেমে ফের জিজ্ঞেস করে,
— “আংকেলের বিষয়ে আর কোনো খোঁজ পেলে?”
— “না, ওই দায়িত্ব আদিয়াত নিয়েছে। আমি আপাতত বাবার অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পূর্ণ করি। মৃত মানুষের থেকে জীবিত মানুষের ন্যায়ের আর্তনাদ বেশি সজীব ভাই।” আরশীন হালকা হাসল।

বৃষ্টির পর ভেজা শহরের রাস্তায় গাড়ি থেমে যায় বিশাল এক বাড়ির সামনে। এটা ডিআইজি শওকত ওসমানের বাসা। আরশীন যে আজকে আসবে তা আগেই জানিয়ে রেখেছিল। ও সরাসরি গিয়ে দেখা করল। ফোল্ডারটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
— “এইটা আমার শেষ প্রমাণ, স্যার।” শওকত ওসমান ফোল্ডারটা নেন। এক এক করে কাগজ ও ফ্ল্যাশ ড্রাইভ বের করেন।
— “এই রেকর্ডিং কবে নেওয়া?”
— “গত এক সপ্তাহের মধ্যে। সাথে থাকা ফাইলগুলো সব কনফার্মড সোর্স থেকে; ক্যাশ ট্রেইল, ব্ল্যাকমেইলিং প্যাটার্ন, ভুক্তভোগীদের গোপন স্বীকারোক্তি। ওর মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য এগুলো যথেষ্ট হওয়া উচিত।”
— “তুমি জানো, তুমি কার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছো?”
— “জানি স্যার। কিন্তু অন্যায়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক না চুক্তি নেই।”

ডিআইজি চোখ সরু করে ওর দিকে তাকায়। তারপর হেসে বলে,
— “তুমি খুব সাহস দেখিয়েছো, আরশীন। এতোটা সাহস… সবাই দেখাতে পারে না। তুমি প্রমাণ করে দিয়েছ, তুমি সত্যিই এহসানের মেয়ে। আজ বেঁচে থাকলে গর্বে বুকটা ভরে উঠত। আমি এটা তদন্ত ইউনিটে পাঠাচ্ছি। তাহমীদকে আর বেশি দিন রক্ষা করা যাবে না।” একটা ছোট্ট ধন্যবাদ জানায়, পরক্ষনেই দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আরশীন। বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে ভেজা কাপড় পাল্টাতেই আদিয়াত ঘরে আসে। আরশীন জিজ্ঞেস করল,
— “আজ আপনার ফিরতে দেরি হলো যে? গিয়েছিলেন কোথাও?”
— “হুম… অন্য কাজে। আদিয়াত টাইয়ের নট খুলতে খুলতে উত্তর দিল।”
সাধারণত এই সময়টাতে আরশীন ওর আশপাশে থাকে না—নিচে থাকে, কখনও রান্নাঘরে। কিন্তু আজ কিছুটা ভুলবশতই সে এখনো রুমে। আদিয়াত নিজের শার্টের বোতাম খুলতে ব্যস্ত, আরশীন ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। জানালার পর্দা সরে গেলে সবটাই দেখা যায়। সে ভেতর থেকে পেছনে ফিরে তাকায় একবার। আরশীন জানে এইভাবে কারও দিকে চোখ রাখা অনুচিত। নিজেই মনে মনে নিজেকে ধমক দিল,
— “এইভাবে চেঞ্জ করার সময় ওর দিকে তাকানো একদমই অভদ্রতামি…” কিন্তু কে যেন ওর চোখের লাগাম খুলে রেখেছে আজ।
সে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইল, কিন্তু চোখ? সে তো এত সহজে কথা শোনে না। বেহায়া চোখ ঠিকই পর্দার ফাঁক গলে সরে যাওয়া কাপড়ের ভেতর দিয়ে আদিয়াতকে খুঁজে বের করল। আলো-ছায়ায় ওর শরীরটা টুকরো টুকরো করে ধরা পড়ছে—বুকের উপর তবকানো হালকা ক্লান্তি, পেটের মসৃণ রেখাগুলোর মাঝখানে ভাঁজ হয়ে থাকা নিঃশ্বাস, আর পিঠের গড়ন… যেন কোনো ভাস্করের মসৃণ ছাঁচে তৈরি।
আদিয়াত কিছু বুঝতে না পেরে চুলে হাত বোলাচ্ছে। বাতাসে ওর শরীরের গন্ধ হালকা করে ছড়িয়ে পড়ছে রুমজুড়ে; আরশীনের নাকে এসে ঠেকছে, অস্বস্তি আর উত্তাপের এক অদ্ভুত মিশেল নিয়ে।
আরশীন চোখ নামিয়ে নিতে চায়। কিন্তু মনের ভেতর কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠছে,
— “কিন্তু এই দৃশ্য তো শুধু আমারই দেখা উচিত…” একটা নরম ধাক্কা লাগে ভেতরে। ঠিক তখনই আদিয়াত এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। সাদা রঙা একটা হালকা টি-শার্ট গায়ে। আরশীন ওর দিকেই চট করে তাকিয়ে পরে আবার সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তবুও কিছু একটা কাঁপে মনে, হয়তো ওর উপস্থিতির প্রভাবেই। তাকে একটু জায়গা দিতে গিয়ে সরে যেতে নেয় আরশীন। কিন্তু কোণের কার্পেটটায় পা আটকে যায়। একটুখানি হাঁকডাকের সময়টাও মেলে না। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেয় ঠিক সেই মুহূর্তে দুটো শক্ত হাত এগিয়ে আসে, কোমড় জড়িয়ে ধরে ফেলে তাকে। আশ্চর্য নিঃশব্দে, নিঃশ্বাস ফেলার মতো সাবধানে… সে আরশীনকে আঁকড়ে ধরে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সময়টা যেন থেমে যায়। আরশীন টের পায় ওর বুকের ধ্বনি, ওর নিঃশ্বাসের গতি আর সবচেয়ে বেশি—ওর হাতে থাকা সেই ছায়ার মতো ভরসা। আরশীনের ঠোঁট কাঁপে, কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। লজ্জায় চোখমুখ কুঁচকে আছে। ধীরকন্ঠে বলল,
— “ছাড়ুন…?”
— “আবার পড়ে যাবেন না তো? জায়গাটা পিচ্ছিল, বৃষ্টির পানি এসেছে।”
— “আমি ঠিক ছিলাম, কার্পেটটা ভুল ছিল। সব দোষ এটারই।”
— “আপনার সমস্যা কি, বলুন তো? অফিসে এসে বাতাসের নামে অভিযোগ করেন। এখন আবার ঘরের কার্পেট? কখনো নিজের ভুল স্বীকার করতে হয়।”

আরশীন ভ্রু তুলে তাকাল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
— “তাহলে কি আপনি বলছেন, আমার পা পিছলে যাওয়াটা একদম আমার দোষ?”
আদিয়াত মাথা ঝাঁকাল,
— “একদম তাই। নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পারলে দোষটা পরিবেশের না, নিজের।”
— “আমি তো স্বীকারই করেছিলাম…”
— “বাদ দিন।” আদিয়াত ওকে থামিয়ে দেয়। ততক্ষণে আরশীন আদিয়াতের বন্ধন থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর ডোন্ট কেয়ার টাইপের কথা শুনে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “আপনি একটা বাজে লোক।” তারপর কিছুটা ধুপধাপ শব্দে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো। আদিয়াত রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগল,
— “হাত, পা, কোমড় ভাঙ্গার মত মারাত্মক একটা সমস্যার মধ্যে থেকে উদ্ধার করলাম আমি আর আমাকেই কিনা বলে বাজে লোক! ধন্যবাদের বদলে কপালে এমন উপাধি জুটল? এরা আসলে চায় কী? না ধরে পড়ে যাওয়ার সুযোগ দিলেই কি ভালো হতো? ঠিক আছে, এর পরেরবার ট্রাই করতে হবে।”

ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করেই আরশীন এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। পিঠ ঠেকিয়ে দেয়ালে হালকা ভর নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। অদ্ভুত এক উত্তাপ এখনো শরীরে খেলে যাচ্ছে। আদিয়াতের গায়ের গন্ধ এখনও যেন তার শ্বাসে মিশে আছে। সেই হালকা পারফিউমের গন্ধ, সঙ্গে পুরুষালি কিছু একটার মিশ্র অনুভূতি; যেটা দূরে এসেও পুরোপুরি ফেলে দেওয়া যায় না।
সে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বিছানার ধারে এসে বসে পড়ে। মন তো পড়ে আছে ঠিক সেদিকেই; বারান্দায়, আদিয়াতের দুই হাতে ঘেরা মুহূর্তে।
—“ইশশ.. কতটা কাছাকাছি ছিলাম আমরা।” ওর নিঃশ্বাসে মিলেছিল আদিয়াতের নিঃশ্বাস। চোখে চোখ আটকে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য, যেন সময় থেমে গিয়েছিল। আদিয়াতের সেই ঠান্ডা অথচ গভীর দৃষ্টি এখনো স্পষ্ট চোখে ভাসছে। আরশীন চুলের ভেতর হাত চালিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।
— “আহ্, কী ভাবছিলাম এসব? ছিঃ! এভাবে… এভাবে কেউ তাকায়? কেউ ধরে? তারচেয়ে পড়ে যেতাম, সেটাই ভালো হতো। ওর চাহনিটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না।” ওর বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। আরশীন চুপচাপ কাঁধ গুটিয়ে ফেলে। নিজেকেই ধমক দেয় মৃদু স্বরে,
— “যা হয়েছে ভুলে যা, ওই অংশটুকু মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেল। এত লজ্জা, অস্বস্তি… সব বৃথা। ভুলে যা, চেষ্টা কর ভুলে যাওয়ার।”
তারপর নিজেকেই জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বিছানায় পড়ে যায়।
চোখ বন্ধ করে কিন্তু অন্ধকারের বদলে সেখানেও আদিয়াতের মুখ ভেসে ওঠে। আদিয়াতের সেই উপস্থিতি, সেই স্পর্শ, সেই গন্ধ যেন পুরো ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
.
সকালের আলো তখনও পুরোপুরি ঘরে ঢোকেনি। রাতে বৃষ্টির কারণে জানালায় পর্দা দেওয়া হয়েছিল যার কারণে এই সকালেও ঘর অন্ধকার। আরশীন ঘুম থেকে উঠে দেখল নয়টা পার হয়েছে। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসল। আদিয়াত পাশেই ঘুমাচ্ছে। ছুটির দিন, তাই তাড়া নেই। আরশীন দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামল। রান্নাঘর থেকে মৃদু শব্দ আসছে, নাজনীন হয়তো চা বসিয়েছে। মূল দরজায় গাড়ির হর্ন বাজছে।
আরশীন দেখল অপরিচিত এক মহিলাকে। পাশে নীরা, মুখ গম্ভীর, ঠোঁট শক্ত। ও আন্দাজ করে নিল ভদ্রমহিলা নীরার মা। আর সামনের দরজা পেরিয়ে ঢুকছেন আমিনুল ইসলাম এবং জহিরুল ইসলাম। তাদের চেহারায় রাগ, বিরক্তি, এবং একটা অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। পাঞ্জাবি পরনে, চোখে কালো চশমা, হাতে ফাইল ধরা। তাদের বিরক্তের আসল কারণ হচ্ছে, তাহমীদের গ্রেফতার হওয়া।

রান্নাঘরে তখন কেবল চায়ের গরম পানি ফুটছে। নাজনীন কাজের ফাঁকে ফাঁকে একবার বাইরে তাকাচ্ছেন আর একবার আরশীনের দিকে। আরশীন ধীরে পা ফেলে ভিতরে ঢুকল। কিছুক্ষণ আগে উপস্থিত হওয়া মেহমানদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক পরিচয়পর্ব সেরে এসেছে সে।
নাজনীন চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
— “মেহমানদের সাথে পরিচিত হয়েছ?”

আরশীন মাথা নাড়ে,
— “হ্যাঁ।”
— “উনি তোমার চাচি শাশুড়ি, রাবেয়া বেগম। আর ও হচ্ছে নীরা, আদিয়াতের চাচাতো বোন।”
— “বুঝেছি। নীরার সাথে আমার অফিসেই পরিচয় হয়েছিল।”
— “তাই?”
— “হ্যাঁ আপনি গিয়ে বসুন। বাকিটুকু আমি সামলে নিচ্ছি।”

নাজনীন ভ্রু তুলে তাকালেন।
— “পারবে তো?”
আরশীন ছু’রি হাতে নিয়ে হালকা মাথা নাড়ল,
— “চেষ্টা করি। না হলে আপনি তো আছেনই।”
— “ঠিক আছে আমি দশ মিনিটের জন্য যাচ্ছি। আমি এলে তুমি একটু আলিয়ার কাছে গিয়ে বসো। মেয়েটাকে এত বোঝাচ্ছি কাজ হচ্ছে না। আসলে, ভালোবাসা বুচ্ছো? মন মানতে চায় না। কিন্তু তুমিই বলো, একটা মানুষের নামে এত অভিযোগ কেনো উঠবে? যা রটে তার তো কিছুটা বটে।”
আরশীন মাথা নাড়ল, মুখে একটুকরো চুপচাপ সম্মতি। আরশীনের মনের ভিতর একটা খচখচানি শুরু হলো। তাহমীদের নাম শুনলে কেউ একটুও ব্যথিত হয় না। সেদিন সে খেয়াল করেছিল, যখন প্রথম গ্রেফতার হওয়ার খবর এলো, আদিয়াতের চোখে কেমন একটা উদাসীনতা ছিল। আজ শাশুড়ির চেহারাও একইরকম, কোনো দুঃখ নেই। আরশীন নিজেকে প্রশ্ন করল,
— “তাহমীদ কি এই বাড়ির মানুষদের জন্য অস্বস্তির কারণ ছিল?”
আরশীন কড়াইতে তেল গরম করছিল। মাঝে তাহমীদকে নিয়ে ভাবছে। ভাবনার ভারে যখন পেঁয়াজ ভাজছিল, তখন হঠাৎ অসাবধানতাবশত ডান হাতটা কড়াইয়ের গরম প্যানে লেগে গেল।

— “আহ!” একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। ও তড়িঘড়ি করে কল খুলে দেয়, সোজা ঠান্ডা পানির নিচে হাত রাখে। পানির স্পর্শে ব্যথা আরও চাগার দিল। সে মুহূর্তে নাজনীন রান্নাঘরে পা রাখতেই চমকে উঠলেন।
— “আরে, তোমার হাতটা। এটা কী করে হলো?” চোখে আতঙ্ক, কণ্ঠে তাগিদ।
আরশীন তাড়াতাড়ি হাতটা পেছনে নিতে চাইল, যেন লুকাতে চায়।
— “না কিছু না। ফ্রাই প্যানে একটু ছ্যাঁকা লেগেছে।”
নাজনীন এগিয়ে এসে ওর হাতটা টেনে নিয়ে দেখলেন। লাল হয়ে উঠেছে হাতের চামড়া, একটা দিক তো ফোলাও ধরছে।
— “এইটাকে কিছু না বলছো তুমি? এত অসাবধান হলে হয়? ফোসকা পড়ে যাবে! এক্ষুনি ঘরে যাও, মলম লাগাও। আমি বলছি।”

আরশীন ধীরে মাথা নেড়ে বলল,
— “একটুও লাগেনি, এই তো ঠিক আছি।”

নাজনীন কঠিন গলায় বললেন,
— “তুমি যাও তো। এইরকম জেদ নিয়ে কী হবে? সব ঠিক আছে কিন্তু ইনফেকশন হয়ে গেলে তখন কি করবে?” নাজনীন মায়া করে আরশীনের পিঠে হাত রাখলেন,
— “মেয়েরা সব পারে। তাই বলে সব কষ্ট চেপে রাখতেই হবে, তা না।”
আরশীনের চোখ কিছুক্ষণ নিচু রইল। সে আর তর্ক করল না, চুপচাপ ঘরের দিকে হাঁটা দিল।

আরশীন চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছিল, ডান হাতটা বাম হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। ঠিক তখনই সিঁড়িতে আদিয়াতের সাথে চোখ মিলল, এক পলক। আদিয়াত বোধহয় খেয়াল করল না ওর হাতের দিকে সেও লুকিয়ে রাখল।
ঘরে ঢুকেই সে দ্রুত ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগোল। একের পর এক ড্রয়ার খুলছে, খুঁজছে মলম কিন্তু কোথায় রাখা আছে, তা তো জানে না। হাতে টান লাগছে, ব্যথা বাড়ছে তবুও বিরক্তি চাপা দিয়ে খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পিছন থেকে হালকা পায়ের শব্দ। আদিয়াত এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে সে শান্ত গলায় বলল,
— “ওখানে খুঁজে লাভ নেই। আপনি বসুন এখানে।”
আরশীন চমকে তাকায়। আদিয়াত হাত বাড়িয়ে আলমারির ড্রয়ার থেকে মলম বের করছে।
— “বসুন। আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।” সে কিছু না বলে ধীরে ধীরে বিছানার পাশে বসে। হাতটা এমন ভাবে বাড়িয়ে দেয় যেন ওর নিজের হাতটাই পর হয়ে গেছে এবং তা আদিয়াতের নিকট সমর্পণ করছে।

আদিয়াত খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মলম বের করে ওর হাতটা তুলে নেয়। হাতের ঐ অংশটুকু হালকা লাল আগুনের মত হয়ে আছে। ওর স্পর্শে কিংবা ব্যথায় হালকা কেঁপে ওঠে আরশীন। আদিয়াত নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— “ব্যথা করছে?”
— “না।”
নীরবতার ভিতর দিয়ে মলম লাগানোর প্রতিটি স্পর্শ যেন ঠান্ডা জলে ডুবে যাওয়ার মতো। শেষে ওর দিকে না তাকিয়েই বলে,
— “সাবধানে কাজ করতে পারেন না? কথাবার্তা বলার সময় তো তিরিং-বিরিং করেন, কাজের সময়েও তাই?”
— “আমি তিরিং-বিরিং করি? আর করলেও বা কি? আমি তো মানুষ, রোবটের মত স্ট্যাচু হয়ে থাকব নাকি?”
— “রোবট তো আপনি। কথা বললেই বিট-বাইট আর মেজাজ আপডেট হয়। ঢং যত্তসব।” আদিয়াত পেছনে হেলান দেয়।
— “ঢং? আমি ঢং করি?” আরশীন হালকা ঝাঁকুনির সাথে চোখ কুঁচকে তাকাল।
— “আপনি তো কথায় কথায় এমন ভাব করেন, মনে হয় নাটকের রিহার্সেলে আছেন।” আদিয়াত হেসে ফেলল।

— “আর আপনি সেই দর্শক যিনি শুধু সমালোচনা করেন, হাততালি দেন না।”
— “বাস্তব জীবনের স্ক্রিপ্ট ফলো করা যায় না?”

— “বাস্তব জীবন বলছেন? আপনি তো একটু ঝাঁকুনি খেলেই ডায়লগ দেন; সাবধান হোন, পড়ে যাবেন। এগুলো নাটকীয়তা না?”
— “ওটা নাটক না, সতর্কতা। আপনি যে হারে চলাফেরা করেন, গতকাল তো দেখলাম।”
— “আপনি আসলেই একটা…”

ওর পুরো কথা শেষ করতে দিল না আদিয়াত। মাঝখানে বলে উঠল,
— “দেখলেন? আপনি কথা বললেই যুদ্ধাবস্থা। এমনকি হাত পোড়ার মধ্যেও ঝগড়া করছেন।”
— “হাত পুড়ে গেছে বলে চুপ করে বসে থাকব? আপনার এই অসহ্য কথাবার্তা সহ্য করব?”
— “আপনি তো আগুন। সহ্য করবেন কেনো? জ্বালিয়ে দিন সব।”
— “আপনি হচ্ছেন কেরোসিন… আগুন নেভানোর বদলে আরো জ্বালাচ্ছেন।”

আদিয়াত উত্তরে মজা করে বলল,
— “অবশ্য আগুন জ্বালাতে মজা আছে।”
— “আপনি আমার মতো নির্বিষ আগুনে কেরোসিন ঢেলে দুনিয়া পোড়াতে চাইছেন।” আরশীন ভ্রু কুঁচকে বলে।
ঠিক তখনই দরজার হালকা কড়া না দেওয়া আওয়াজের সাথে সাথে ভেতরে ঢোকে নীরা। ওর মুখে একরকম তাচ্ছিল্য মেশানো হাসি। ঠোঁটের কোণে বাঁকা চাহনি। চোখে শ্যেন দৃষ্টি। আচমকা নীরাকে দেখে দুজনেই চুপ হয়ে যায়। আরশীনের চোখের কোণ থেকে হাসি গায়েব, ঠোঁট সোজা হয়ে আসে। আদিয়াত চোখ ফিরিয়ে নেয়। নীরার চোখ ঘোরে আরশীনের হাতের দিকে, সেখানে এখনও আদিয়াতের হাত।
— “আমি বোধহয় ডিস্টার্ব করে ফেললাম।”
আরশীন ফিসফিস করে বলল,
— “ডিস্টার্ব করা তো তোমার স্বভাব।”
— “ভুল সময়ে এসে পড়েছি, সরি।” নীরা ফের বলে।

আরশীন উঠে দাঁড়ায়। ঠাণ্ডা হেসে বলে,
— “না এলেই পারতে, এখানে আগুন কেরোসিন নিয়ে কথা হচ্ছিল এতক্ষণ। এত তাড়াতাড়ি আগুনে ঘি পড়ার দরকার ছিল না।” আবহাওয়াটা এক মুহূর্তে থমথমে হয়ে ওঠে। তখনই আদিয়াত খুব শান্ত গলায় বলে,
— “নীরা, কারো ঘরে ঢোকার আগে দরজায় নক করতে হয়। এটা তো ছোটবেলাতেই শেখানো হয়েছে, মনে নেই?”
নীরার মুখের হাসি ফিকে হয়ে গিয়েছিল আরোও আগেই। এখন অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে উঠল। আদিয়াত পুনরায় বলে,
— “তোমার যদি কিছু দরকার থাকে, বলতে পারো।”

নীরার চোখে স্পষ্ট অপমানের আভাস। সে ঠাস করে উত্তর দিল,
— “বড় আব্বু নিচে যেতে বলেছে।” এইটুকু বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আরশীন তখন একটু গা ছুঁইয়ে পাশ ফিরে বলল,
— “এবার আমাদের আগুন আর কেরোসিন এর বিশেষ প্যাকেজে বিরতি দেওয়া যায়, তাই না? চলুন, নিচে যাই।”
আদিয়াত আগে নামছিল। পেছন পেছন আরশীন… এখান থেকে নীরার মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল। কী ভাবছে কে জানে? আরশীন মনে মনে বলল,
— “নিয়তি দেখো, কামড়াতে এসেছিল উল্টো নিজেই বিষ খেয়ে গেল। যাকে চাও তাকে আমিই দখল করে নিয়েছি। তোমার কপালে কচু আছে, কচু।”
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১২]
~আফিয়া আফরিন

(নীরবে নিভৃতে)
নীরার চোখ যেন মুহূর্তেই লাল হয়ে উঠল; ভেতরে কী যেন জ্বলছে। কেউ তার বুকের ভেতর আগুন ছুঁড়ে দিয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই সে আদিয়াতের দিকে তাকায় তারপর এক ঝলক আরশীনের দিকে।
আদিয়াত… সেই মানুষটা, যার হাত ধরে জীবনটা সাজানোর হাজারটা কল্পনা করেছিল নীরা। সেই চেয়ারে বসে থাকা, সেই ঘরের প্রতিটি জিনিস, এই বাড়ির প্রতিটি কোনাকুনি; সব ছিল একসময় তার কল্পনায় তার নিজের। আর এখন? সব কিছু ঐ মেয়েটার। নীরার বুকের ভেতর থেকে এক তীব্র দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, মুখে প্রকাশ পায় না। তবে চোখে ভেসে ওঠে জ্বলন্ত অভিমান।
— “এই মেয়েটা না থাকলে আদিয়াত আজ আমার হতো। এই ঘর, এই সংসার, সব আমার হতো।” কোনো শব্দে বলা হয় না এসব, কিন্তু নীরার ভিতরের ভাষা যেন আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে। সে জানে, তার হাত ফসকে গেছে সময়। তবে হৃদয়ের জেদ এখনো পরাজয় মানে না।

বাড়ির পরিবেশে তেমন কোনো উচ্চস্বরে উত্তেজনা নেই। কিছু হয়নি, শুধু কিছু পারিবারিক আলাপ আর খোশগল্প। কিন্তু কথার ফাঁকে একাধিকবার উঠে এসেছে তাহমীদ, গ্রেফতার আর কেস—এই শব্দগুলো। তাহমীদের পক্ষে শহরের একজন বিশিষ্ট নামকরা উকিল নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি বিকেলের দিকে এসে কিছুক্ষণ ছিলেন। পোড় খাওয়া মুখ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর পরিমিত কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিলেন, এই মামলা সহজে ছাড়বে না। উনার কথায় বোঝা যায়, আইনি লড়াই কেবল শুরু হয়েছে। আরশীন ভাবে,
— “শুরু যেহেতু হয়েছে তবে শেষও হবে।”
.
সন্ধ্যার আলো তখন একটু ম্লান হয়ে এসেছে। চাচা-চাচীর বিদায়ের সময় হয়েছে। তারা গাড়ির দিকে এগোলেন। নীরা একটু পেছনে, একটা ব্যাগ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। যাওয়ার আগে হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য তার চোখ আরশীনের চোখে আটকে যায়। নীরা তাকিয়ে থাকল নিঃশব্দে, চোখে হারানোর গ্লানি। আরশীন ভেতরটা পড়ে ফেলেছিল, ঠোঁটে হালকা এক হাসি টেনে বলল না কিছুই। শুধু একটা মিষ্টি কিন্তু দৃঢ় হাসি… সৌজন্যতার সহিত মেহমান বিদায় দিয়ে আলিয়ার ঘরে এলো। আরশীন জানালার পর্দাটা টেনে নামাল, একবার চোখ বুলিয়ে নিল ঘরটার ভিতর। বিছানার কোণায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে আলিয়া। ওর মুখ শুকিয়ে গেছে, চেহারাটা এমন যেন আরেকটু কাঁদলেই গলে যাবে। কাঁধের চুলগুলো এলোমেলো, চোখদুটো লাল হয়ে আছে কান্নায়। ঠোঁটে রঙ নেই, মুখে কোনো প্রাণ নেই। আশ্চর্য ব্যাপার; এই নরম সুরে কথা বলা, সহজ-সরল মেয়েটা সেই দস্যুর জন্যই বুক ভাসিয়ে কাঁদছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। চোখের জল’ই ওর একমাত্র ভাষা। আরশীন ধীরে ধীরে পাশে গিয়ে বসে আলিয়ার মাথায় হাত রাখে।
— “এইভাবে ভেঙে পড়লে চলবে আপু? ভাইয়া যদি সত্যিই দোষ করে থাকে, তবে তার ফলও তাকে পেতে হবে।”
আলিয়া বলে,
— “তোমরা বিশ্বাস করছো না। কিন্তু আমি জানি, ও এমন না…।”
আরশীন চুপচাপ ওর কথাগুলো শুনে যায়। ঠিক বা ভুলের জবাব দিতে পারে না। শুধু মনে মনে ভাবে,
— “আপুর মনটা কতটা নরম, চোখে ভালোবাসার এমন চশমা পরে আছে যে তাহমীদের গায়ে লাগা কাঁদুড়েও দেখতে পাচ্ছে না।”
পরদিন সকালেই আরশীন বাসায় বলে আলিয়াকে নিয়ে রওনা দেয় তাহমীদের কাছে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তা পেছনে পড়ে যায় আর আলিয়া ভেবে যায়। ডিটেনশন সেলে পৌঁছেই চোখে পড়ে পুলিশ আর গম্ভীর চেহারার কয়েকজন অফিসার। আলিয়া একটু পিছিয়ে দাঁড়ায়। আরশীন এগিয়ে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে।
— “তিন মিনিট সময়।” একজন কর্মকর্তা বলে। তিন মিনিট, তাও যেন একটা জীবন।
তাহমীদের সামনে এসে দাঁড়ায় আলিয়া। চোখে মুখে অপার আকুতি। আরশীন একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে সেই দৃশ্য। তাহমীদ একবার তাকায়, চোখ মেলে দেখে কিন্তু মুখে কিছু বলে না। আলিয়া ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
— “তুমি ঠিক থাকো, আমি আছি। আমি অপেক্ষা করব।” এই ভালোবাসা… এইটুকু জোর থাকলে, মানুষ পাহাড়ও সরাতে পারে। অথচ তাহমীদ, সেই জোরটুকু হারিয়ে ফেলেছে তাই বোধহয় কিছু বলতে পারল না।
— “তুমি কিছু বলছো না কেন? আমি জানি, তুমি আমাকে ঠকাওনি… জানি না কেন? কিন্তু বিশ্বাস করি।”
তাহমীদ চুপ। মাথা নিচু করে আছে, শব্দের ওজন বহন করার মতো শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। একবারও চোখ তুলে তাকাল না আলিয়ার দিকে। তিন মিনিট—শুধু তিনটা মিনিট, অথচ আলিয়া যেন সেই অল্প সময়েই তার ভেঙে পড়া ভালোবাসাটাকে শব্দে রূপ দিল। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলল,
— “তুমি জানো, আমি তোমার জন্য সব ছাড়তে পারি। শুধু তুমি বলো, সত্যিটা কী? আমি দাঁড়িয়ে থাকব তোমার জন্য। সবাই ছেড়ে দিলেও, আমি না।”
আরশীন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল। তিন মিনিট পেরিয়ে গেলে একজন অফিসার এসে বলল,
— “সময় শেষ।”

আলিয়া উঠে দাঁড়াল, চোখ দুটো জলেভেজা। যাকে ভালোবাসে, তার সামনে নিজের ভালোবাসাটুকু করে তুলে ধরেছে; তাহমীদ দেখুক আর না দেখুক, বুঝুক বা না বুঝুক। আরশীন তার কাঁধে হাত রাখল। আলিয়া তাকিয়ে বলল,
— “ও না তাকালেও আমি তো তাকিয়েছি, কথা বলেছি। ওকে আমি কখনো ছেড়ে যেতে পারব না। ভালোবেসেছি, মর্যাদা রাখব। ও দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ অপরাধী হলেও আমি ওর জন্য অপেক্ষা করব।”

আরশীন একটুকরো নরম হাসি দিল।
— “ভালোবাসা যদি একপাক্ষিক হয়, তাও সেটা ভালোবাসা; এই ভালোবাসার জন্য আত্মমর্যাদাহীন না হলেই হলো।”
ফিরতি পথে গাড়িতে বসে আরশীন জানালার পাশে ঠাঁই নিয়েছিল। গাড়ির চলার একঘেয়ে শব্দে আলিয়া কিছুটা স্থির, কোলের ওপরে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
আরশীনের চোখ বারবার পেছনের আয়নায় আটকে যাচ্ছিল। একটা ধূসর রঙের গাড়ি, যেন একদৃষ্টে পিছু নিয়েছে ওদের। প্রথমে সে ভেবেছিল কাকতালীয় কিন্তু পরপর তিনটা মোড় ঘোরার পরেও যখন একই গাড়ি ঠিক পেছনেই, বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে লাগল। সে হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে ড্রাইভারকে বলে,
— “ভাই, একটু ডান দিকের গলিটা ধরে যান তো।”

ড্রাইভার কিছু না বলে মাথা নেড়ে গলি ধরে মোড় নেয়। আলিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— “এই রাস্তা দিয়ে কেন? সোজা গেলে তো কম সময় লাগত।”
— “আবহাওয়াটা ভালো লাগছে… হালকা ঘোরাঘুরি করে যাই না হয়।”
গাড়িটা সত্যি ওদের অনুসরণ করছে। কিন্তু কী কারণে জানা নেই। তাহমীদের কোনো ব্যাপার? বুকের ভেতরটা হঠাৎ খচখচ করে উঠল। সে তৎক্ষণাৎ ড্রাইভারকে বলল,
— “গাড়িটা সাইডে নিন। এখনই।” ড্রাইভার হকচকিয়ে গেলেও গাড়ি দাঁড় করাল রাস্তার একপাশে। আলিয়া জিজ্ঞেস করল,
— “আরশীন, কী হয়েছে?” সে কোন জবাব না দিয়ে দরজা খুলে নেমে পড়ল। চট করে একবার চারপাশটা দেখতে না দেখতেই ঠিক তখনই ঘূমঘূম করে গতি তুলে সেই অনুসরণকারী গাড়িটা সামনে এল। আরশীন কিছু বোঝার আগেই গাড়িটা ওকে সজোরে ধাক্কা মারল।

— “আরশীন!” আলিয়ার গলা কেঁপে উঠল ভেতর থেকে। আরশীন ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেল, কনুইয়ে ঘষা লাগল, নিঃশ্বাস একটু আটকে এল। গাড়িটা মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়, যাওয়ার সময় জানালার ফাঁক দিয়ে কেউ একটা ছোট চিরকুট ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার পাশে। ড্রাইভার দৌড়ে এসে আরশীনকে তুলতে গেলে সে নিজেই উঠে দাঁড়াল।
আলিয়া দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসেই চিৎকার করে উঠল। চোখের সামনে এভাবে ওকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখে যেন বুকটা হিম হয়ে গেল। সে ছুটে এল প্রায় হাপাতে হাপাতে,
— “আল্লাহ! এটা কী হলো তোমার? কোথাও ব্যথা পেয়েছো?” আলিয়ার কণ্ঠ কেঁপে উঠল।
আরশীন ধুলো মুছল ধীরে ধীরে। কনুইয়ে ছেঁড়া দাগ, হালকা রক্তপাত।
— “আমি ঠিক আছি আপু।”

আলিয়া ওর হাত ধরে বলল,
— “কোথায় তুমি ঠিক আছো? রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে গেছে। চলো, গাড়িতে উঠো। হাসপাতালে নিয়ে যাই, তোমার হাতটা দেখে নিতে হবে। কে বা কারা এটা করল বলো? আমি পুলিশে বলব।”

আরশীন নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বলল,
— “এখন না।”
সে আড়চোখে দেখে নিয়েছে পথের ধারে পড়ে থাকা সেই চিরকুটটা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চুপিচুপি সেটা হাতে তুলে নিল,
চোখের পলকে ওড়নার খুঁটিতে বেঁধে ফেলল। এদিকে আলিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বারবার তাড়া দিচ্ছে।
হাসপাতালের করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিল আরশীন। পা টেনে টেনে চলছে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। ডান পায়ের পাতায় চোট লেগেছে, ব্যথা তীব্র না হলেও হাঁটার প্রতিটি মুহূর্তে কেঁপে উঠছে ওর মুখ। পথিমধ্যে আলিয়া আদিয়াতকে ফোন করে জানিয়েছে ঘটনার ইতিবৃত্ত। সে চলে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
— “ব্যথা কোথায়? ওর কণ্ঠ রুক্ষ, কিন্তু চোখে চিন্তার ছায়া।”
আরশীন চোখ তুলে তাকাল, চোখে মুখে কেমন যেন অভিমান। বলল,
— “কিছু না, সামান্য ধাক্কা।”
— “আপনাকে আমি এত কথা বলতে বলেছি? যেটুকু জিজ্ঞেস করেছি তার জবাব দিন।”
আরশীন মাথা নিচু করে পায়ের দিকে ইশারা করল। আদিয়াত ঝুঁকে পায়ের দিকে তাকাল, ওর বাঁ পায়ের গিঁটটায় হালকা ফোলা দেখা যাচ্ছে।
হাসপাতালের সাদা আলো, ওষুধের গন্ধ আর ক্লান্ত মুখগুলোর ভিড় থেকে অবশেষে তারা বেরিয়ে আসে। আরশীন গুছিয়ে বসেছিল চুপচাপ, হালকা মাথা ঝিমঝিম করছিল, ব্যথার ঘন কুয়াশার ভেতরেও নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছিল। হাসপাতাল থেকে এই পর্যন্ত নিজেকে সামলে এসেছে। কিন্তু বাসায় এসে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠা সম্ভব নয়। আদিয়াত পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “হাঁটতে পারবেন?”
— “হ্যাঁ, পারব।” কিন্তু বাস্তবে পা ফেলতেই যেভাবে কেঁপে উঠল, সেটা আরশীনের ‘হ্যাঁ’-কে মিথ্যে প্রমাণ করে দিল। আদিয়াত কিছু না বলে এগিয়ে এলো। মুহূর্তে নিজের দুই বাহু দিয়ে আরশীনকে কোলের মধ্যে তুলে নিল। আরশীনের মুখ হঠাৎই লাল হয়ে উঠল।
— “অ্যাই এইটা কী করছেন? নামিয়ে দিন। আশেপাশে সবাই দেখলে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”

আদিয়াত ভুরু কুঁচকে হালকা সুরে বলল,
— “আমি তো মনে করছি না এখানে কোনো রোমান্সের দৃশ্য চলছে… একটা আহত মানুষকে সাহায্য করছি মাত্র। লোকে দেখে খারাপ ভাববে কেন?” আরশীন কুঁকড়ে যেতে যেতে চোখ নামিয়ে ফেলল, কিন্তু সত্যি বলতে এই নিরাপদ ভারবহন তার সব ব্যথা ভুলিয়ে দিচ্ছে।

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আদিয়াত ওকে নিয়ে এলো। প্রতিটা ধাপে যেন শব্দহীন ভাষাগুলো বলছিল
— “তুমি আমার দায়িত্ব… আজ, কাল, যতদিন তুমি আঘাতে কাতর থাকবে, আমি পাশে থাকব।” আরশীন কিছু বলল না, শুধু চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকল ওর বুকে; বোধকরি এই নিরাপত্তার মুহূর্তটুকু সে চিরকাল ধরে রাখতে চায়। আদিয়াত আরশীনকে সর্তকভাবে বিছানায় শুইয়ে দিল। মাথার পাশে বালিশটা দিয়ে বলল,
— “আর নড়াচড়া করবেন না।”

আরশীন হালকা হেসে বলল,
— “আপনি ডাক্তার হলেন কবে?”
— “সবকিছুর জন্য ডাক্তার হওয়া লাগে না।” এরপর সে নিজের হাতে মলম লাগিয়ে দিল আরশীনের ব্যথা পাওয়া জায়গাটায়, খুব সতর্ক হাতে। যেন একটু টানেও ব্যথা না লাগে।
রাত যত বাড়ে, আরশীনের গায়ে হালকা জ্বর দেখা দেয়। সারা শরীর গরম হয়ে আছে, মাথাও ভার লাগছে। বিছানায় শুয়ে থাকলেও আরাম পাচ্ছে না সে। চোখ আধা বন্ধ কিন্তু ঘুম আসছে না। আরশীনকে ঔষুধ খাইয়ে সবকিছু শেষ করে আদিয়াত শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাঝরাতে ওর নড়াচড়ায় ঘুমটা ভেঙে গেছে।
— “মাথা গরম লাগছে?” আদিয়াত নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল। আরশীন শুধু হালকা মাথা নেড়ে সাড়া দিল। আদিয়াত ঠোঁটের কোণে একটুখানি চিন্তার রেখা রেখে বলে,
— “একটু তাপ দেখি।” আদিয়াত ওর কপালে হাত রাখে। বেশ গরম… তারপর থার্মোমিটারে পরিমাপ করে। একটুখানি সময় পেরোতেই বোঝা যায় জ্বরটা হালকা না, ১০১-এর কাছাকাছি।
— “জ্বর আছে ভালোই।”

আরশীন চোখ বুজে বলল,
— “আমি ঠিক আছি, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
— “শাট আপ। আমাকে আদেশ করবেন না। এটা করা থেকে বিরত থাকুন।” আদিয়াতের গলা কঠিন শোনাল। সে বিছানা থেকে নামল। কোথায় গেল কে জানে? আরশীন কিছুতেই আরাম করতে পারছে না। বেশ সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে, এমন ব্যথা! চিরকুটটাও আছে এখনও। ওটা দেখলে আদিয়াত কীভাবে রিয়্যাক্ট করে কে জানে? কথাই তো বলা যাচ্ছে না তার সাথে। ধামকিধুমকি মেরে কোথায় গেল বোঝা যাচ্ছে না।
আদিয়াত ফিরে এলো হাতে এক বাটি ধোঁয়া ওঠা স্যুপ নিয়ে। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আরশীন অবাক হয়ে তাকাল।
— “আপনি রান্নাও করতে পারেন?” ওর কণ্ঠে বিস্ময় আর এক চিলতে হাসির ছায়া।
আদিয়াত সপ্রতিভভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “ইউটিউব আছে। না পারার কি হলো?”
— “কিন্তু আপনি কষ্ট করতে গেলেন কেনো? দরকার ছিল না।”

সে ট্রে-টা বিছানার পাশে নামিয়ে বসে বলল,
— “খেয়ে নিন। তারপর ওষুধ খান, ভালো লাগবে।”

আরশীন বাটির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
— “দেখতেই তো ভালো লাগছে। খেতে খারাপ হলে কি ব্যাড রিভিউ দিতে পারব?”
— “হ্যাঁ, পারবেন।”
আরশীন ছোট্ট হাসি চাপতে না পেরে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল কিন্তু গাল বেয়ে যে গরম একটা অনুভূতি নেমে এলো, তা সে চাইলেও লুকাতে পারল না।
আরশীন প্রথম চামচটা মুখে দিয়েই এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে ফেলল। জ্বর-জর্জর ক্লান্ত শরীরে যেন একধরনের আরাম নেমে এলো। স্যুপটা অতুলনীয়; না কোনও তারকা রেঁধেছে, না দামি রেস্তোরাঁর স্পেশাল তবুও এই মুহূর্তে ওর কাছে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে মজার খাবার। ও একঝলক আদিয়াতের দিকে তাকাল। কী আশ্চর্য! এই পুরুষটা কি সত্যিই কেবল কড়া মুখ, নাকি ভেতরে গোপনে গোপনে কেউ একজন প্রতিদিন একটু একটু করে ওর হয়ে উঠছে? এত আশ্চর্য লাগে কেন? এত আপন আপন অনুভূতি হয় কেন? আদিয়াত পাশেই বসে লক্ষ করছিল। একটু পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “এত চুপচাপ খাচ্ছেন কেন? খাবার খারাপ?”
— “না… একটু বেশি ভালো। তাই শব্দে নষ্ট করতে ইচ্ছে করল না।”

আরশীন কিছুক্ষণ চুপ করে স্যুপ খেয়ে বলল,
— “আপনি না, আমার ধারণা বদলে দিচ্ছেন।”
আদিয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
— “ভালো না খারাপ দিকে?”
— “এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।” ও চামচটা হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, “তবে আপনি স্যুপের মতোই… বাইরে থেকে সাধারণ, ভিতরে গিয়ে বোঝা যায় কতটা উষ্ণ!”

আদিয়াত আলতো করে ওর কপালে হাত রাখল,
— “জ্বর এখনও আছে। ওষুধ খেয়ে একটু বিশ্রাম নিন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আরশীন নিঃশ্বাস ফেলল,
— “আপনার মুখে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ শুনলে সত্যি মনে হয়…”
— “কারণ আমি মিথ্যে বলি না।”
.
রাত অনেক গড়িয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁই ছুঁই করছে। ঘরের বাতি নিভে গেলেও জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে ধীর, শান্ত ভঙ্গিতে। নিস্তব্ধতা যেনো ভারী হয়ে উঠেছে। চারপাশ থমথমে, অথচ আরশীনের ভিতরটা অস্থির।
সে বিছানায় শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ করেও ঘুমাতে পারছে না। বারবার পাশ ফিরে তাকাচ্ছে। একবার ছাদের দিকে, একবার জানালার পর্দা দুলছে কি না দেখে। আরশীন হঠাৎ পাশ ফিরে আস্তে করে বলল,
— “আপনার কি মন ভালো না খারাপ?”
— “কেনো?”
— “বলেন না।” আরশীনের অনুরোধ।

আদিয়াত হালকা গম্ভীর স্বরে বলল,
— “ভালোই।”
— “ই-প্রত্যয়যোগে ভালো? পুরোপুরি না?”

আদিয়াত আরশীনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন,
— “কী বলতে চাচ্ছেন, সেটা বলেন তো। এত কথা প্যাঁচাচ্ছেন কেনো?”

আরশীন ধীরে চোখ বন্ধ করে বলল,
— “মনটা ভালো থাকলে খারাপ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম আর কী!”
— “আচ্ছা, করুন।”
আরশীন ধীরে ধীরে উঠে বসল। চারদিকে ঘুমঘুম পরিবেশ, কেবল বিছানার পাশের ল্যাম্পে হালকা আলো জ্বলছে। পাশে রাখা ড্রয়ারের উপর রাখা চিরকুটটা রাখা। চুপচাপ হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা তুলে নিল। মুহূর্তের দ্বিধা কাটিয়ে আদিয়াতের দিকে এগিয়ে দিল। আদিয়াত একটু অবাক হয়ে তাকাল। ভুরু কুঁচকে নিয়ে ধীরে হাতে চিরকুটটা নিল।
আদিয়াত বলল,
— “এটা কী?”

আরশীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “ওরা শুধু ধাক্কা দেয়নি… বার্তাও দিয়েছে।”
আদিয়াত ধীরে চিরকুটটা খুলে পড়তে লাগল। তার চোখের গভীরতায় চিন্তা আরও ঘন হয়ে উঠছে। ছোট্ট এক ভাঁজ করা কাগজ তবুও যেন তার ওজন অনেক। কালো কালিতে বাঁকা হাতে লেখা, শুধু একটা লাইন,
— “তুমি একা কেন আগুন নিয়ে খেলবে? চলো আমিও যোগ দিই।”
.
.
.
চলবে….