তবুও তুমি পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
30

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২৫]
~আফিয়া আফরিন

(একাত্মতা)
কলাবাগানের পুরোনো বাসার গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ওরা। চারদিকে ধুলোর স্তর, ভাঙাচোরা আসবাব, উল্টানো সোফা, বইয়ের আলমারি তছনছ, সবকিছু এলোমেলো। এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যেন কাউকে খুঁজে পেতে গিয়েই সব ওলট-পালট করে ফেলা হয়েছে।
আরশীন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাল বসার ঘরের কোণার ছোট শোকেসটার সামনে। কাচের ভাঙা খোপের মধ্যে একটা জংধরা ছোট্ট মেটাল বক্স দেখতে পেল। কৌতূহলে সেটা তুলে আনল। খুলে দেখল ভেতরে রাখা আছে ছোট্ট একটা হারমোনিকা, রঙচটা কয়েকটা পোস্টকার্ড, আর কয়েকটা পুরোনো ছোটোবেলার চুল বাঁধার ক্লিপ। আরশীনের চোখ হঠাৎই ছলছল করে উঠল। হারমোনিকা ধরতেই ক্লিপগুলো পড়ে গেল।
— “এই হারমোনিকাটা বাবা আমাকে কিনে দিয়েছিল, আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি… রাতে শুয়ে শুয়ে বাজাতাম।” সে চাপ দিল হারমোনিকাটা, একটা ভাঙা-মরা সুর বেরিয়ে এলো। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল অতীতের মিষ্টি স্মৃতিতে।

— “সব শেষ হয়ে গেছে ভেবেছিলাম। অথচ কত কিছু থেকে যায়… ঠিক এইরকম।”
আরশীন তখন মেঝেতে বসে পড়ল, নিজের হাতের তালুতে ছোট্ট ক্লিপগুলো নিয়ে অপলক চেয়ে রইল। আদিয়াত পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়াল, কিছু বলল না। আরশীন হারমোনিকার বাক্সটা হাতে নিয়ে বসে ছিল। অতীতের ধুলোমাখা সেই স্মৃতি থেকে কিছুতেই নিজেকে সরিয়ে আনতে পারছিল না। এমন সময় আদিয়াত পাশের ভাঙা শোকেসের নিচে একটা পুরোনো কাঠের ড্রয়ার দেখতে পেল, যা বেশ জংধরা তালাবদ্ধ ছিল। অনেক কষ্টে দু’জন মিলে সেটা খুলে ফেলার পর ভিতরে দেখা গেল কিছু কাগজপত্র, পুরনো ছবির অ্যালবাম আর একটা রঙচটা ছোট্ট ব্যাগ। আরশীন তাকিয়ে রইল। ব্যাগটা হাতে নিয়েই তার কপালে ভাঁজ পড়ল।
— “এটা তো… এটা তো আমার হারিয়ে যাওয়া চেইনটা। আমি তো ভেবেছিলাম বহু আগেই হারিয়ে গেছে!”
চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ। সে ধীরে ধীরে ব্যাগ খুলে ভিতরে হাত দিল। একটুকরো লাল মখমলের ভাঁজে রাখা একটা সোনালী রঙের পাতলা চেইন আর ছোট্ট লকেট; ভেতরে একটা অতি ক্ষুদ্র ছবি, আরশীন আর তার বাবার, যেটা সে বহুদিন আগে এক ঈদের দিন তুলেছিল। সেই ছবি হারিয়ে যাওয়ার কষ্টে কত রাত কেঁদেছিল, কেউ জানে না। আরশীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেইনটা হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “আমার ছোটবেলার প্রিয় জিনিস ছিল এটা… খুঁজে খুঁজে একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কীভাবে এটা এখানে এলো?”

সাথে পাওয়া ছবির অ্যালবামে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেল কিছু চিঠি। কিন্তু লেখা দেখে স্পষ্ট, মায়ের হাতের লেখা। হয়তো ওর জন্মদিনে কিংবা পরীক্ষার সময় দেওয়া শুভেচ্ছা বার্তা। আরশীনের চোখে জল এসে গেল। এসব তো সে হারিয়ে ফেলেছিল অনেক আগেই… অথচ হারায় না কিছুই, সময় শুধু দূরে সরিয়ে রাখে। এবার সময় নিজেই ফিরে এসে তার হাতে তুলে দিল সবটুকু। সন্ধ্যার নরম আলোয় সে একে একে সব জিনিসপত্র আদরের সাথে গুছিয়ে ব্যাগে ভরল। আদিয়াতকে বলল,
— “এগুলো আমার স্মৃতি না, আমার অস্তিত্ব।” আদিয়াত নীরবে আরশীনের চোখের কোণে জমে থাকা জলের ঝিলিকটা দেখছিল। মুহূর্তটা খুব সংবেদনশীল। সে হালকা হেসে বলল,
— “যেহেতু আপনি একে নিজের অস্তিত্ব বলে দাবি করেছেন, তবে এদের ঠাঁই হবে আমাদের সংসারে। আমাদের মাঝেই থাকবে।”
আরশীন ফিরে তাকাল মুগ্ধতা নিয়ে। আদিয়াত আবার বলল,
— “যা আপনার, তা আমারও। আপনার স্মৃতি, আপনার হারানো পাওয়া, আপনার আবেগ… সবই আমার। এসব ফেলে রাখার জিনিস না। এগুলো আমাদের ঘরের এক কোণায় থাকবে, যেন আপনি সবসময় নিজেকে খুঁজে পান। আর আমিও অবগত থাকি আপনার অস্তিত্ব সম্পর্কে।”
আরশীন কিছু বলতে পারছিল না। শুধু তার ভেতরের প্রতিটি অনুভূতি যেন শব্দ ছাড়াই জড়িয়ে ধরেছিল আদিয়াতকে। এই মানুষটা বুঝতে জানে। গ্রহণ করতে জানে। ভালোবাসতে জানে সম্পূর্ণরূপে। ও ধীরে মাথা নাড়ল। কিছুটা কম্পিত কণ্ঠে বলল,
— “তবে সব নিয়ে যাচ্ছি আমাদের ঘরে।”
‘আমাদের ঘর’ আদিয়াতের বলা এই দুটি শব্দ আরশীনের হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় ঢেউ তুলে দিল। এত সহজ, এত সাধারণ একটা কথা; তবু তার জন্য এর মানে কত গভীর, কত অনন্য! ওর ভেতরে যেন কিছু গলে পড়ল নরম হয়ে। তার জীবনে ‘আমার’ শব্দটা বরাবরই একলা ছিল; আমার দুঃখ, আমার বোঝা, আমার শূন্যতা। আর এখন, হঠাৎই সেই ‘আমার’-এর পাশে দাঁড়িয়েছে কেউ। বলেছে, ‘আমাদের।’ এত সহজভাবে সে বলে ফেলল, ‘আমাদের ঘর’ কোনো জোর নেই, দাবি নেই, আছে এক অলিখিত প্রতিজ্ঞা। এই একটা বাক্যই সমস্ত জগতের নিরাপত্তা দিয়ে দেয়।
আদিয়াত ভেবেচিন্তে শেষমেশ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালো। বারবার হামলা, অনধিকার প্রবেশ, উল্টাপাল্টা খোঁজখবর, এসব আর চলতে দেওয়া যায় না। নিরাপত্তা না থাকলে যেকোনো সময় আবার কিছু একটা ঘটতে পারে। চোখ মেলে চারপাশটা একবার দেখে নিল। কোনো একসময় এই বাড়িতে হয়তো ছিল হাসি, দাপট, সাহস… এখন কেবল অস্থিরতা আর স্মৃতির ভার। এই বাড়িটায় পাহারা বসাতে হবে। নিয়মিত পাহারা। যেন কেউ সহজে ঢুকতে না পারে, সাহস না পায়।

আদিয়াতের স্বভাবই এমন। যা বলে, তা করেই ফেলে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সে আর দেরি করে না। পাহারার ব্যবস্থা করতে একদিন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বসাতে আরেকদিন; মোটে দুদিনের মধ্যে বাড়িটা নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলল। সেখানে এখন গেটের পাশে সার্বক্ষণিক একজন পাহারাদার, সিসিটিভি, মেরামতসহ আগের সেই উল্টোপাল্টা অবস্থা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সব ঠিকঠাক করে বিকেলে সে নিঃশ্বাস ফেলল, ভেতর থেকে একদম ঝাড়া নিঃশ্বাস।
অসুস্থতার পর গুনে গুনে সময় কেটেছে ঠিক ২০ দিন। শরীরটা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছে। কপালের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে তবে দাগটা স্পষ্ট। ক্লান্তি ভাবটা নেই। পরদিন সকালে অফিসে এলো। সাদা হালকা প্রেশার দেওয়া শার্টটা প্যান্টের ভিতরে নিখুঁতভাবে ইন করা, হাতে চকচকে ধাতব ঘড়ি। চুলগুলো পরিপাটি, গায়ে এক পরিচিত পারফিউমের সুগন্ধ। হালকা, কিন্তু ছুঁয়ে যাওয়া মতো। কপালের ডানদিকে ছোট একটা কাটা দাগ, সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার চিহ্ন। ওর চলাফেরায় এক ধরনের নিশ্চয়তা। কোথা থেকে ফিরে এসেছে আর কোথায় যেতে চলেছে, সবটা বোধহয় তার আয়ত্তে। একটা সাদামাটা অথচ গভীর দৃঢ়তায় ভরা উপস্থিতি… সবাই একে একে এসে কুশল জিজ্ঞেস করল, “স্যার, এখন কেমন আছেন?” “অনেক দিন পর এলেন, দেখে ভালো লাগছে।” আদিয়াত সবার দিকে হালকা হাসি ছুঁড়ে দিল।

আদিয়াত অফিসে নিজের কেবিনে না গিয়ে সোজা গেল আমিনুলের কেবিনের দিকে। দরজায় হালকা টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। আমিনুল চোখ তুলে তাকালেন। মুখে কিছু বললেন না, ড্রয়ার থেকে বের করে একটা চেক টেবিলের উপর রাখলেন। সংক্ষিপ্তভাবে বললেন,
— “পঞ্চাশ লক্ষ টাকা, বাকিটা আগামী সপ্তাহের মধ্যে পৌঁছে যাবে।”

আদিয়াত চেকটা হাতে তুলল। একবার চোখ বুলিয়ে নিল পরিমাণ আর সইয়ের দিকে।
— “ধন্যবাদ।” উঁহু, তার কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা নয় বরং হিসেব মিটে যাওয়ার পরের এক নিঃশব্দ ঘোষণা, কোনো বাড়তি সৌজন্যতা নেই।
.
সেদিন অনেকদিন পর বাড়ির ভেতর ফিরে এলো পুরনো রঙ। একরকম নিঃশব্দ উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই। দিনের ক্লান্তি মুছে ফেলে সবাই বসেছে ড্রইংরুমে। হালকা গল্প, হেসে ওঠা, নরম আলোয় শান্ত একটা পরিবেশ। আরশীন তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত। চা বসিয়ে রেখেছে সাথে কিছু ভাজাপোড়া, যেন গল্পের টেবিলে টান পড়ে না। ঠিক তখনই আলিয়া এলো রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। সে খুব চেষ্টা করছে তাহমীদকে আগাগোড়া ভুলতে। প্রমাণ পেয়েছে যে ওই ছেলের আপাদমস্তক অন্যায়ে লিপ্ত। মা ভীষণ আফসোস করেন… কিন্তু কী লাভ? খুব শ্রীঘ্রই তাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। আহ! ভালোবাসা। সম্পর্কের কী টান, কী গতি। আলিয়া অবশ্য শক্ত রয়েছে। প্রথমদিকে যেরকম ভেঙ্গে পড়েছিল এখন নিজেকে বোঝায়। সুন্দর একটা ঘ্রাণে বাস্তবতায় ফিরে এলো। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
— “মা কোথায়? তুমি একা কী কাজ করছো?”

আরশীন পাশে থেকে ফিরে তাকাল, চোখে হালকা ক্লান্তি আর মুখে শান্ত হাসি।
— “মাকে একটু আগে পাঠিয়ে দিলাম। সবাই গল্প করছে, আমি চা বানাচ্ছি… সাথে কিছু ভাজাপোড়া।”

আলিয়া আরেকটু এগিয়ে হাঁ করে শ্বাস নিলো।
— “দারুণ ঘ্রাণ পাচ্ছি! কতদূর করেছো? খেতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।”

আরশীন হেসে বলল,
— “এইতো হয়ে গেছে। তুমি গিয়ে বসো আপু, আমি সব নিয়ে আসছি। আজ ঘরকন্নার কাজ করেছি সব। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।”
— “আমাকে দাও, আমিও সাহায্য করি। অনেকক্ষণ যাবত একলা আছো নিশ্চয়ই? আমাকে একটু ডাকলেও পারো। আমি সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে আছি। কাল থেকে বরং মাকে বেড রেস্টে দিয়ে তুমি আমি মিলে রান্না করব।”

আরশীন মুখ কালো করে বলল,
— “রান্না? ইয়ে মানে… আমি না রান্নাবান্নায় ওতো পারদর্শী না। মানে রান্না করতে পারি কিন্তু খেতে খুব একটা সুবিধার হয় না। আমি রান্না করলে, সবার ও’বেলা উপোষ থাকতে হবে।”
— “আরে কী বলো? আমি আছি না। যখনকার ব্যাপার তখন দেখব, এখন চলো। পেটের মধ্যে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।”
আরশীনের সাথে সাথে আলিয়াও সবকিছু নিয়ে এসে টেবিলে গুছিয়ে রাখছিল। দু’জনে টুকটাক গল্প, হাসি, কাজকর্ম সবটাই একসাথে চালিয়ে যাচ্ছে।

আদিয়াত বসেছিল বাবার সাথে, কথাবার্তা বলছিল। জহিরুল ইসলাম নরম কণ্ঠে বললেন,
— “হিসেবের বিষয়টা যে তুমি ক্লিয়ার করবে, সেটা আমি জানতাম। তাই আর নিজে থেকে নাক গলাইনি।”
সত্যিই তো, আদিয়াত যেদিন থেকে দায়িত্ব নিয়েছে, তিনি দীর্ঘদিনের ভার নামিয়ে রেখেছেন। একসময় সবকিছু তিনিই সামলাতেন, কিন্তু এখন ছেলের উপর ভরসা রেখেই একটু একটু করে নিজের পা সরিয়ে নিয়েছেন। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আমিনুল একটা উল্টোপাল্টা মন্তব্য করেছিল। জহিরুল তাতে কোনো গুরুত্ব দেননি। জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না, কারণ সময়ই উত্তর দিয়েছে।
কথা বলতে বলতে আদিয়াতের চোখ হঠাৎই আটকে গেল রান্নাঘরের দরজায়। আরশীনকে দেখে একমুহূর্ত থমকাল। আলোয় তার মুখটা ঝলমল করছে। থুতনি আর গালের রেখায় ঘামের ফোঁটা মুক্তোর কণা জ্বলজ্বল করছে। এত ব্যস্ত হয়ে রান্না করছে, একবার রান্নাঘরে একবার ডাইনিংয়ে; মনে হচ্ছে দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে সে। তার চোখে-মুখে ক্লান্তি নেই, আছে একধরনের নিবেদন। চুলগুলো হাত খোঁপা করে তাড়াহুড়োয় বেঁধেছে, তবুও ছোট ছোট চুলগুলো কপালে এসে পড়ে জেদ করে রয়ে গেছে। বারবার ও হাত দিয়ে সামলাতে গিয়ে অস্থির হয়ে উঠছে। সেই অস্থিরতা দেখে আদিয়াতের মনে হচ্ছিল; এই মেয়েটাকে সে এখনো পুরোপুরি চেনে নাই। প্রতিদিন একটু একটু করে চিনতে হচ্ছে। এইমুহূর্তে ওর মাঝে একটা ঘরোয়া শুদ্ধতা রয়েছে, একরকম শাশ্বত মমতা। ওর এই রূপের মাঝে কোনও সাজ নেই, কোনও কৃত্রিমতা নেই, তাও সে নিজের মতো করে দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। আদিয়াত নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। আরশীন এসে বলল,
— “চলে আসুন সবাই।”
— “একা একা সব করলে?” নাজনীনের প্রশ্ন।
— “আপু ছিল আমার সাথে।”
সকালে উঠে গেলেও আদিয়াত উঠল না। আরশীন এগিয়ে এসেছিল সে বসে আছে দেখে বাকিদের চোখ এড়িয়ে পিছিয়ে গেল। চোখে প্রশ্ন— “কি হলো? আপনি আসছেন না?”

আদিয়াত খুব ধীরে মাথা নাড়ল, মানে— “ইচ্ছা করছে না।”

আরশীন আবার চোখ কুঁচকে গালে একটু বাঁকা হাসি এনে চোখে বলল, — “আমি নিজে রান্না করেছি, আর আপনি খাবেন না?”

আদিয়াত একটু হাসল। চোখে মজা লুকানো,
— “হাত ধরুন, একসাথে যাব।”

আরশীন ভ্রু উঁচিয়ে চোখ গোল করে তাকাল,
— “হুহ ছেলেমানুষি আবদার। উঠে আসুন।”
— “আপনি রেগে গেলে দেখতে ভালো লাগে।”
আরশীন ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। কোমরে হাত রেখে একটু রাগি ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু তার চোখে হাসির ঝিলিক। এরপর আবার ইশারায় বলল,
— “যদি না ওঠেন, তাহলে খবর আছে।”
আদিয়াত এবার দু’হাত তুলে সেজে-সেজে মাথা নাড়ল,
— “আচ্ছা, আসছি। হুম… খুবই ভয় পেয়ে গেলাম।” আদিয়াত আস্তে করে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল, আরশীনের হাত ধরার উদ্দেশ্য।
আরশীন হাত সরিয়ে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফিসফিস করে বলল,
— “এইসব কী করছেন? সবাই তো সামনে বসে আছে।”

আদিয়াত একটু অবাক আর নাটুকে ভঙ্গিতে বলল,
— “আরে কী করলাম আমি? হাত ধরতে বলেছি শুধু।” তারপর চোখ ছোট করে কপট দুঃখে বলল, “আপনি কিনা এমন ভাবলেন… হায়রে আমার চরিত্র!”

আরশীন গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আদিয়াত এবার একদম মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “আচ্ছা, আপনি কী ভেবেছিলেন সত্যি করে বলুন তো?”

আরশীন ঠোঁট কামড়ে হাসল। মুখ ঘুরিয়ে ধীরকণ্ঠে বলল,
— “যা ভেবেছি, সেটা আবার বলাও যায়?”

আদিয়াত এবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “এই জন্যই বলি, আপনাদের মেয়েদের মন সবচেয়ে ভয়ানক জিনিস। আমি হাত ধরতে চাইলাম, আপনি…”

আরশীন এবার চুপচাপ আদিয়াতের হাত ছুঁয়ে দিল একমুহূর্তের জন্য, তারপর নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
— “এই এক সেকেন্ড-ই বেশি।”

আদিয়াত চোখ বন্ধ করে বলল,
— “ঠিক আছে, এইটুকুই সারাজীবনের সমান।”
চারপাশে হাসাহাসির শব্দ, কেউ কিছু টের পেল না। চোখে চোখে চলল কথাবার্তা, নতুন অনুভব। আরশীন মুখ ফিরিয়ে হাসল। এরপর হেঁটে চলে গেল। তার চোখে-মুখে জয়ের ছাপ স্পষ্ট। আদিয়াতও হাসিমুখে ধীরে ধীরে উঠে এলো টেবিলের দিকে।
.
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে একটানা। বারান্দার রেলিং ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশীন। মাথার সামনের চুলগুলো হালকা ভিজে গিয়েছে, গালে পড়ছে ঠান্ডা ফোঁটা। মুখটা বৃষ্টির দিকে তুলে রাখা, চোখ বুঁজে সেই ছাঁট অনুভব করছে।
— “শুনুন…” আরশীন নিচু গলায় ডাকল। আদিয়াত ঘরে ছিল। ডাকে সাড়া দিয়ে নিঃশব্দে এসে পাশে দাঁড়াল।
— “এই ভেজা ভেজা আবহাওয়াটা কেমন যেন… তাই না?”

— “আপনার মতো।” আদিয়াত মৃদু হেসে বলল, “নরম, গভীর, কিন্তু টের না পেলেই হঠাৎ ভিজিয়ে দেয়।”
— “আপনি আজকাল বড় বেশি কথা বলেন।”

— “অথচ সেদিনই বললেন, আমি কথা কম বলি।” আদিয়াত ওর দিকে তাকাল। এক হাতে ওর চুলের গোঁড়ায় ছুঁয়ে দিল হালকা করে।
— “এই ভেজা চুল… ঠিক ভিজে গল্পের পাতার মতো।”

আরশীন চোখ সরিয়ে নিলো, ঠোঁটে লাজুক হাসি।
— “কবিতা লেখা শুরু করলেন নাকি?”
— “সাহস করলাম।”
বাতাসে তখন বৃষ্টির কাঁচা ঘ্রাণ। আরশীন নিচু গলায় বলল,
— “ভেতরে চলুন। আপনি ভিজবেন, ঠান্ডা লাগবে।”
— “ঠান্ডা না উল্টো উষ্ণ মনে হচ্ছে।”
আরশীন হেসে পেছনে হাঁটল, আদিয়াত তার ঠিক এক কদম এগোতেই সে দৌড়ে ঘরে এলো।
ঘরের আলো বন্ধ। শুধু জানালার ফাঁক গলে আসা ঝাপসা বৃষ্টির আলো অন্ধকারের মধ্যে নরম ছায়া এঁকে রেখেছে। বারান্দায় আলো ঠিকরে ঘরে আসছে। আরশীন হালকা ভেজা ওড়না কাঁধ থেকে নামিয়ে বিছানার একপাশে রাখল। চুলে এখনও বৃষ্টির গন্ধ। ঘরের আলো ম্লান, জানালার কাঁচে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ পড়ছে। আদিয়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল। আরশীন হালকা হাসল। চোখ তুলে বলল,
— “এইভাবে দেখছেন কেন?”
— “বুঝতে চেষ্টা করছি।”
— “তা বুঝেছেন কিছু?”
— “হ্যাঁ… একেক সময় একেকভাবে বুঝি।”

ও চুপ করে ওর কাছে এলো। এক হাত বাড়িয়ে চুলের ভেজা গোছা সরিয়ে দিল আরশীনের কপাল থেকে।
— “এই ভেজা গন্ধটা আমার ভালো লাগে।”
আরশীন চোখ বন্ধ করল। আদিয়াত আরও একটু কাছে এলো, খুব আস্তে। ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল,
— “আপনি এমনই এক শান্তি, যার কাছে আমার সমস্ত অস্থিরতা শুরু হয়।”

আরশীনের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো, ওর গলায় কাঁপন। চোখ তুলে ওর চোখে চোখ রাখল। কিছু না বলেও অনেক কিছু বলা হলো। হাত বাড়িয়ে আদিয়াতের হাত ধরল। আদিয়াত হাতটা ওর গাল ছুঁয়ে বলল,
— “ছুঁতে চাইলেই যদি কিছুটা আপনার মন পড়ে নিতে পারতাম… তাহলে প্রতিদিনই ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ে যেতাম।”

আরশীন হেসে ফেলল। চোখ নামিয়ে বলল,
— “পড়ে নিতে চান?”
— “অনুমতি পেলে…”
চুপ করে গেল ওরা দুজনেই। তারপর ধীরে ধীরে বৃষ্টি যেমন মাটি ছুঁয়ে মিশে যায়, তেমনি দুজনের ঠোঁটের দূরত্বও মুছে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আদিয়াত উঠে বারান্দায় আলো নিভিয়ে দিল। চাঁদের আলো আর তার ঘরের আলো ব্যতীত কোনোকিছুর অস্তিত্ব রাখল না।
আলো নিভে যাওয়ার পর ঘরটা একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ নেমে এসেছে একঘেয়ে সুরে, কিন্তু ভেতরের শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দে যেন এক অনুচ্চারিত গান বাজছে। আরশীন বলল,
— “জানেন, এই মুহূর্তটা আমি কতবার কল্পনা করেছি?”
— “ঠিক কেমন কল্পনা করতেন?”
— “আপনি থাকবেন আমার পাশে, আর আমি… আমি শুধু দেখব। ছুঁয়ে দেখব, সব সত্যি তো?”

আরশীন একটু ঘুরে আদিয়াতের দিকে মুখ করল। ওর চুল ভিজে গাল ছুঁয়ে আছ।
— “আমি সত্যিই আছি এবং সম্পূর্নভাবে।”
— “আপনার এই একটা বাক্য… আমাকে ভেতর থেকে কেমন করে গলে ফেলে।”
— “সমস্যা নাই, বেঁধে রাখব। সকলে বলবে রাতের এই নীরবতা ঘুমের জন্য। অথচ আমার কাছে এটা সবচেয়ে বেশি বোধ করার সময়।”
— “কাকে?”
— “শুধুমাত্র আপনাকে।”
আরশীন আস্তে ওর বুকে মাথা রাখে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেন শরীর-মন গলে মিশে যাচ্ছে একটিমাত্র পরিচয়ে—“আমরা”।
ফিসফিস করে বলে,
— “ভালোবাসি, প্রতিটা নিঃশ্বাসে… প্রতিটা চোখ বোজার মুহূর্তে, প্রতিটা না বলা কথায়। আপনি থাকুন, শুধু থেকে যান আমার পাশে।”
— “থাকব… আপনি যতদিন চাইবেন এবং না চাওয়ার মুহূর্তেও।”
দেহ ছুঁয়ে যায় নিঃশব্দে, নিঃশ্বাসে। আলো নিভে আছে, বৃষ্টি থেমে গেছে… কিন্তু ঘরের ভেতর ভালোবাসার রেশ এখনো ঝিরঝির করে বাজছে।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২৬]
~আফিয়া আফরিন

(একমুঠো মৌসুম)
সময় কেমন যেনো পাখির ডানায় ভর করে উড়ে যায়। বিশেষ করে যখন জীবনটা স্রোতের মতো শান্ত, যখন মন খুশির ভেতরে ভেসে থাকে, তখন তো মুহূর্তও পালিয়ে যায় হেসে হেসে। আদিয়াত আর আরশীনের জীবনেও সেই রকমই এক গোপন ছন্দ লুকিয়ে ছিল।
একদিনে একমুঠো সকাল, এক সন্ধ্যায় ভরপুর গল্প, রাতের শেষ প্রহরে নিঃশব্দ ভালোবাসা, সব মিলিয়ে সময়টা পলকে বয়ে যায়। আরশীন মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে, এইতো সেদিন বিয়ে হলো, এই তো সেদিন যেন বৃষ্টি ভেজা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল… এখন তো বছর হতে চলল। ঘরবসতির ভেতরে সুখ নীরবে সময়কে গিলে খায়। সুখের সময়ে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যায় বিনা নোটিশে। কিন্তু দুঃখ? সে তো বড় কড়া প্রকৃতির। একেকটা মুহূর্তকে ঘষে ঘষে আটকে রাখে মনে। সেখানে ঘড়ির কাঁটা যেন ক্লান্ত, সময় জমে থাকে কুয়াশায় ঢাকা শোকের জানালায়। তাদের জীবনে এখন সেই জমাট বেঁধে থাকা দুঃখ নেই, শুধু ছুটে চলা সময় আর তার ফাঁকে ফাঁকে জমানো ছোট ছোট সুখ। বুঝতে না পারার আগেই একেকটা মৌসুম বদলে যায়। দু’জন মানুষ নিজেদের মতো করে জীবনের মানে খুঁজে নিয়েছে… আর তাতে সময়ও কিছুটা ঋণী হয়ে উঠেছে।
.
একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট এসেছে কোম্পানির জন্য। আগেরবার এই কাজটা সামলেছিল আমিনুল। এবার সেই দায়িত্ব এসে ঠেকল আদিয়াতের কাঁধে। দেশের বাইরে যেতে হবে পুরো এক সপ্তাহের জন্য।
খবরটা শুনে আদিয়াত একদম মন থেকে চাইল না যেতে। এক নিঃশ্বাসে বাবার কাছে গিয়ে আবদারের সুরে বলল,
— “বাবা, আমি আপাতত কোথাও যেতে চাচ্ছি না। প্রতিবার চাচা গেছেন, এবারও তাকেই পাঠাও।”

জহিরুল ইসলাম কাগজপত্রে চোখ রেখে হালকা হেসে বললেন,
— “আরে বাবা, সব কাজের দায়িত্ব কি সবাই নিতে পারে? তুমি সামনে থেকেছো, প্রজেক্টটা বুঝেছো, কাজের সাথে তোমার সম্পর্কও গভীর। এক সপ্তাহের তো ব্যাপার!”
আদিয়াত কিছু বলল না। চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। মনে মনে বলল,
— “তোমাদের কাছে এক সপ্তাহ হয়তো কিছু না, কিন্তু আমার কাছে এটা একটা জীবন-মরণ প্রশ্ন। বিয়ের সময় কিছু হয়নি, আবার যদি বিবাহবার্ষিকীতেও কিছু না হয়… তাহলে ম্যাডাম আমাকে ছেড়ে দেবে ভেবেছ? হ্যাঁ, রাগ করেই ছেড়ে দেবে।”
আদিয়াত সিদ্ধান্ত নিল, এবার সে নিজে থেকে কিছুই বলবে না। পরিস্থিতি যাই হোক, আগে জানতে হবে আরশীন কী চায়। কারণ সে এখন একা না, জীবন জুড়ে আরশীন নামের আরেকটা সত্তা ছড়িয়ে আছে।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আদিয়াত একরকম দ্বিধা নিয়ে আরশীনের পাশে বসল। জানালার ওপাশে আলো কমে এসেছে, ঘরে হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আরশীন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “কী হয়েছে? কিছু বলবেন? মন খারাপ?”
আদিয়াত নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তারপর ধীরে ধীরে সব খুলে বলল। সব শুনে আরশীন হেসে ফেলল। হাসিটা ছিল একটু আদরে ভরা। আরশীন তার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল,
— “আচ্ছা বলেন তো, আপনি কি পাগল? এই জন্য আপনি এত চিন্তায় ছিলেন? এক বছরে এই চিনলেন আপনি আমাকে? এই এক বছরে এমন অনেক মুহূর্ত গেছে, যা আমার সারা জীবন রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে ছাড়া আর কিছু চাই না। সাময়িক দূরত্ব বা সময় আমাদের কিছু নিতে পারবে না, যদি আমরা চাই ধরে রাখতে।” ওর কণ্ঠে ছিল অটুট বিশ্বাস। আদিয়াতের চোখে স্বস্তির ছায়া নেমে এলো। শব্দহীন একটা ধন্যবাদ ঝরে পড়ল ওর দৃষ্টিতে।

আদিয়াতের যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আরশীন এই কয়েকটা দিন বাড়ি গিয়ে থাকতে চাইল। একা একা এখানে থেকে আর ভালো লাগবে না। তাছাড়া মা’ও অনেকদিন ধরে ডাকছেন। আদিয়াত এলে বরং ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। বাড়ির সবাই সে কথাই বলল। আদিয়াত ভেবেছিল, আরশীনকে আজকেই ফরিদপুর পোঁছে দিয়ে আসবে কারণ তার আগামীকাল সকাল ১০ টা নাগাদ ফ্লাইট। আরশীন অবশ্য মানল না বলল,
— “আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ড্রাইভার আছে তাছাড়া আযহানও বাড়িতে আছে, প্রয়োজন হলে ওকে বলব। কিন্তু আপনাকে বিদায় না দিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না… যাব না।”
আদিয়াত নিজে পৌঁছে দিলে ভরসা পেত। আরশীন কোনো কথা শুনল না, নিজের কথাতে অটুট রইল। আদিয়াত আযহানকে কয়েকবার ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল, আরশীনকে যেন ঠিকভাবে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। আযহান ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “ভাইয়া, আমার দশ হাজার টাকা লাগবে। টাকা ছাড়া আমি কিছুই করব না।”
— “ছিঃ কী শিখছিস তুই? পড়াশোনা করে ঘুষখোর হচ্ছিস? এমনিতে চাইলে দিতাম কিন্তু ঘুষ হিসেবে চেয়েছিস তাই এক পয়সাও পাবি না।”
— “ভাইয়া! নিজের বউয়ের জন্য তুমি এটুকু করতে পারবেনা?”
— “আমার বউ কি হেলাফেলার জিনিস যে কেউ তার জন্য ঘুষ চাইবে? সেই সাহস-ই দিব না কাউকে।”
— “কিন্তু আমি তো চাইলাম।”
— “তুই যে মীরজাফর…”
— “ভাই তোমার নামে আমি ভাবির কাছেই কমপ্লেন করব। ভাবি হিসেবে তো তাকে আমি অবশ্যই পৌঁছে দিব বাট তোমাকেও ছাড়ছি না।”
— “যা ভাগ।” আযহান ভুরু কুঁচকাল। যে সত্যিই বিচার দিবে। তাকে অবমাননা, অবহেলা করা হচ্ছে… কিছুতেই সহ্য করা যাবে না এসব। সে স্বাধীন দেশের সদস্য, কেনো মানবে? বড়ভাই হয়েছে দেখে কি যা ইচ্ছে বলবে? উঁহু… ভাবি আছে না!
.
সকালের সূর্য তখন ধীরে ধীরে শহরের গায়ে রোদ মেখে দিচ্ছে। জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছে আরশীনের চোখে। আজ তার চোখে কোনো ঝিলিক নেই। নীরব, স্থির আর একটু কুয়াশায় ঢাকা। আদিয়াত জিজ্ঞেস করল,
— “মনটা কি একটু বেশি খারাপ?”
আরশীন মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। বলল না কিছুই। কথা বললে কান্না এসে যাবে, সেটাই চেপে রাখছে। আদিয়াত ওর হাত ধরে বলল,
— “এইরকম মন খারাপ করে থাকলে আমি যেতে পারব?”
আরশীন নিঃশব্দে চোখ নামিয়ে রাখল। আদিয়াত ফের বলল,
— “এই ক’টা দিন চোখ বন্ধ করে পার করে দিন।”
আরশীন তবুও কিছু বলছিল না… আদিয়াত ওকে একটু নিজের দিকে টেনে নিল, বুকের কাছাকাছি এনে দাঁড় করাল। এক হাত কোমরে, আরেক হাতে চিবুকটা তুলে ধরল আলতো করে। আরশীনের চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ; ভেতরে যেন হাজার কথা, কিন্তু ঠোঁট নিঃশব্দ। আস্তে করে ওর কপালে একটা চুমু দিল, তারপর থুতনির কাছে ঠোঁট নামিয়ে হালকা ছুঁয়ে থাকল একমুহূর্ত। ওর গায়ের গন্ধ, নরম ত্বক, নিঃশ্বাসের তপ্ত ছোঁয়া, সব মিলে সময়টা থমকে দাঁড়াল।
আরশীন চোখ বন্ধ করল। আদিয়াতের বুকের সঙ্গে ঠাসা শরীরটা একটু কেঁদে উঠলো নীরবে। ও ধীরে আদিয়াতের গলার কাছে মুখ রাখল, নিঃশ্বাস ছুঁয়ে গেল ওর ত্বকে। ফিসফিস করে বলল,
— “আর একটুখানি বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকি। আপনাকে ছেড়ে থাকা সহজ হবে না… ফিরেই এসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই এইভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আপনার গায়ে।”
— “আচ্ছা।”
— “তাড়াতাড়ি ফিরবেন তো?”
— “খুব তাড়াতাড়ি… মনে রাখব কেউ আমার অপেক্ষায় রয়েছে।”
— “যে সে কেউ না, আপনার বউ।”
— “তাও একমাত্র!”
আরশীনের চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠল। সে হাসিমুখেই এয়ারপোর্টে এলো। কিন্তু আদিয়াত ঠিকই টের পেল, এই হাসির আড়ালে চাপা একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। যত যাই হোক না কেন, বিদায়ের মুহূর্তটা ঠিকই ভারী হয়ে ওঠে। যাওয়ার আগে আদিয়াত বেশি কথা বলল না। আরেকটু কিছু বললেই একটা কাহিনী হয়ে যাবে। এমনিতেই তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আযহানকে বলল, ওকে যেন ঠিকঠাকভাবে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। আযহান আবার মনে করিয়ে দিল,
— “ভাইয়া আমার টাকাটা…”
এইবার আদিয়াত হেসে উঠল। বলল,
— “যা, পাঠিয়ে দিব।”
— “জিও! তোমার বউকে ঠিকমত পৌঁছে দিব, নো টেনশন।”

আদিয়াত যাওয়ার পর, একরকম দমচাপা অনুভূতি নিয়ে আরশীন এয়ারপোর্ট থেকেই সোজা ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা দিল। আগেই শ্বশুর-শাশুড়িকে জানিয়ে রেখেছিল। গাড়িতে তার পাশে বসে আযহান। রাস্তার মোড় ঘুরতেই আরশীন বলল,
— “তোমার পুরোপুরি যেতে হবে না। অযথা কষ্ট করে আসছো।”

আযহান একটু হেসে উত্তর দিল,
— “মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়েছি ভাবি, ভাই জানতে পারলে খবর আছে।”

আরশীন হালকা হাসল,
— “জানবে না। আমি বলে দিচ্ছি নাকি? ফিরে যাও। থাকার উদ্দেশ্যে গেলে মেনে নিতাম।”
— “না না, তোমাকে বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে তারপর আমি যাব।” ও নিজের মতামত স্পষ্ট করল।
আরশীন আর কিছু বলল না। চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। বাইরের সবুজ ঝাপসা লাগছিল, চোখের পাতাগুলো ভারী। কপালে হাত দিয়ে টিপে ধরল, মাথাব্যথাটা জেঁকে বসেছে। শরীরটাও খারাপ লাগছিল ভেতর থেকে, মন খারাপের প্রভাব শরীর ছুঁয়ে গেছে। সকালে যেভাবে কান্না চাপতে হয়েছিল, সেই চাপা কান্নারই প্রতিক্রিয়া।

আরশীন বাড়ি ফিরতেই চারদিকে একরকম প্রাণ ফিরে এলো। সবাই খুশি, বাড়ির বাতাসেও একটা স্নিগ্ধতা। সাথে সাথে চাচাও চলে এলেন, অলক্ষ্যেই বাবার মতো ছায়া হয়ে পাশে থাকা মানুষটা। আর আযহান? উল্টো দিক ফিরে চলেই যেতে নিচ্ছিল। সবাই মিলে এমন জোর করল, যাওয়াটাই আর হলো না।
আরশীন যতক্ষণ না আদিয়াতের ঠিকঠাক পৌঁছানোর খবর পাচ্ছে, ততক্ষণ তার বুকের ভিতরটা ঠিক শান্ত হচ্ছিল না। ফোনটা বেজে উঠবে, ও পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসবে, এই আশায় সারারাত কেটে গেল। ঠিকঠাক খবরটা না আসা পর্যন্ত একবিন্দু ঘুম নেই চোখে। বারবার ফোনের স্ক্রিনটা দেখে, হালকা নিঃশ্বাস ফেলে। অবশেষে অপেক্ষার সেই প্রহর ফুরালো পরদিন সকালে। আদিয়াত ফোন করল।
— “পৌঁছে গেছি ঠিকঠাক। আমার খুব ভুল না হলে, রাতে আপনার ঘুম হয় নাই। তাই না?”
আরশীনের মুখে তখন স্রেফ একটা স্বস্তির শ্বাস। বলল,
— “জানেন যখন তখন বাদ দিন। আপনি কেমন আছেন?”
— “ভালো, তবে একটু সাবধানে থাকবেন। আপনাকে একা ছেড়ে দিয়ে ভরসা পাইনা। এত দূরে এসে এখন ওই চিরকুটগুলোর কথা মনে পড়ছে।”
— “আরে ধুর ওগুলো মানুষের ফাজলামি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। দ্রুত কাজ শেষ করে ফিরে আসুন। আপনাকে ছাড়া আমার বেশিদিন ভাল্লাগবে না।”
— “আপনি যে নিজের দায়িত্বটা নিজে নিতে পারেন এটা আমি ভালো করে জানি। সবটা যে ফাজলামি এটা আমি মেনে নিতে পারছিনা। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছুদিন নিজ দায়িত্বে নিজের খেয়াল রাখুন আর সাথে নিজের ভালো থাকার দিকটাও লক্ষ্য রাখবেন। আমি ফিরে এলে ওই নিয়ে আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না। ঠিক আছে?”

আরশীন একগাল হেসে বলল,
— “ঠিক আছে।”
বিকাল নাগাদ আরশীন আশাকে সঙ্গে করে আযহানকে এগিয়ে দিতে এলো। মনে হচ্ছিল, আযহানের মনটা কেমন যেন ভারী হয়েছিল, হয়তো সবার সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়ে কিছুটা মায়া পড়ে গেছে। তবুও ইমারজেন্সি, যেতেই হবে। ফেরার পথে দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল নদীর ধারে। মেঘলা আকাশের নিচে ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগতেই ভেতরের ক্লান্তি হালকা হয়ে গেল। নৌকার কিনারে গিয়ে বসে দু’জন। পা ছেড়ে দিল পানির ভেতর। ঢেউ এসে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে।
চারপাশে মানুষের আসা-যাওয়া, চড়ের বাতাস, নদীর সেই শান্ত গর্জন; একটুখানি নিরিবিলি আর নিঃশ্বাস নেওয়ার মত মুহূর্ত। ওরা দু’জন নদীর চড়ে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিল। চড় থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে মাঝরাস্তায় এসে হঠাৎ আরশীনের মনে হলো, মা-কে জানানো হয় নাই। এত দেরি হয়ে গেল, চিন্তা করবে নিশ্চয়ই। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই চোখ কপালে।
আদিয়াতের নাম ভেসে উঠছে স্ক্রিনে; একবার নয়, বারবার। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ফোন, সব মাধ্যমে চেষ্টা করেছে। এমনকি ওই বাড়ি থেকেও একাধিকবার কল এসেছে। মায়ের মিসড কলের সংখ্যা দেখে বুক কেঁপে উঠল। আরশীন মাথায় হাত দিয়ে থমকে দাঁড়াল। হোয়াটসঅ্যাপে চোখ বুলিয়ে দেখল, দেড় ঘণ্টা আগেই আদিয়াত একের পর এক মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে, উদ্বিগ্ন ও অস্থির চিত্তে।
সাথে সাথেই এক লাইন রিপ্লাই দিয়ে মা ও শাশুড়িকে ফোন করল। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে চিন্তায় ভেজা কণ্ঠ। সবাই আতঙ্কে ছিল। এতটা উৎকণ্ঠা হতো না, যদি আদিয়াত প্যানিকড হয়ে একাই পুরো বাড়ির সবাইকে ফোনে না তুলে দিত। কোন কুক্ষণে যে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল? আশার অবস্থাও একই, ফোন সাইলেন্ট। ওকেও একাধিকবার ফোন করা হয়েছিল। আদিয়াতের ফোন এলো। আরশীন ভয়ে ভয়ে রিসিভ করল। ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
— “আরশীন! বারবার কল করছি, একটা রিপ্লাই পর্যন্ত না। জানেন তো, আমি দেশে নেই। জানেন তো, কী ধরনের পরিস্থিতি চলতেছে। তবুও একটু বোঝার চেষ্টা করেন না। দায়িত্বশীল মানুষ আপনি, না? ফোন কেন সাইলেন্ট ছিল, এই জবাবদিহিতা আমি আপনার কাছে চাইবো না। একটা খবর না দিলে কেমন লাগে জানেন? জানবেন কী করে? আমি এখন রিপিট করব এই মুহূর্তটা? আমার অবস্থা কী হয়েছিল ভাবতে পারছেন?”

আরশীনের চোখ ছলছল করে উঠল। সে ধীরে বলল,
— “আমি সত্যিই দুঃখিত…”

আদিয়াত এবার শান্ত গলায় বলল,
— “থাক। পরে কথা বলব। বাসায় পৌঁছে সবাইকে জানান, আমি কথা বলেছি। এখন থেকে প্লিজ ফোনটা সাইলেন্ট রাখবেন না।” আদিয়াত ঠাস করে ফোন কেটে দিল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আরশীন মাথা নিচু করে।
.
বাড়ি ফিরে আসতেই দুই বোনকে দেখে শাহানা মুখ গোমড়া করে দাঁড়ালেন, চোখ দুটো ঠিক রোদে পোড়া আগুন। আরশীন আদিয়াতকে অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছে কিন্তু কথা বলতে পারছে না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে, আদিয়াতের ফোন আর আসে না। মেসেজগুলো পড়ে থাকে, রিপ্লাই আসে না। এতবার কল করেছে, একটাও ধরেনি।
আরশীন ঠোঁট কামড়ে বসে থাকে। মুখ কালো করে চুপচাপ। বুকের ভেতরটা যেন ভার হয়ে আছে। ভয় পাচ্ছে না বরং জানে, ও রেগে গেছে। ভয়ানকভাবে রেগে গেছে। আদিয়াত খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের। রেগে গেলে কখনো চেঁচামেচি করে না উল্টো বিরক্তবোধ করে। কখনো কখনো কেবল চুপ হয়ে যায়। আর আজ যে ভয়ানক রকমের চুপ। তবে তার চেয়েও বেশি কাঁপিয়ে দিয়েছে ওর সেই গম্ভীর কণ্ঠ। আদিয়াত কখনো নাম ধরে ডাকে না, দু’জনে সম্বোধনেই কথাবার্তা বলে। তবে আজ ওর “আরশীন” উচ্চারণেই বুক কেঁপে উঠেছে।

সে রাতে আরশীনের ঘুম আর আসেনি। চোখ দুটো বারবার বন্ধ করার চেষ্টা করলেও ভেতরটা কেমন অস্থির লাগছিল। আদিয়াতের সাথে কথা হয়নি, সেটাই মাথার ভেতর হালকা শূন্যতা তৈরি করে রেখেছে।
চোখ বুজলেই বারবার ভেসে উঠছে সেই গম্ভীর কণ্ঠ, অভিমানী মুখটা।
আরশীন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও ক্লান্ত হয়ে গেল। ওর ভেতরটা যেন হাঁসফাঁস করছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় খেলে গেল আচমকা। অকারণ ভাবনাটাই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যাওয়ার মতো নেমে এলো। চমকে উঠে বসল সে। চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
— “হুম… এটা তো সত্যি হতে পারে। খুব সম্ভব।” এইজন্যই কি অস্থির লাগছে? এমনভাবে অনুভব করছে নিজেকে? এতদিন টের পেল না কেনো? নিজেকেই অপরিচিত লাগছে। শরীরের প্রতিটি কণায় এখন সেই এক ভাবনার প্রতিধ্বনি বাজছে। বাকি সময়টুকু ঘুমাতে পারল না আর। পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়াল ঘরজুড়ে; কখনও জানালায় দাঁড়াল, কখনও বিছানায় এসে বসল। অস্থির, উত্তেজনা আর অজানা আশার এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সে রাত কেটে গেল নিঃশব্দে, নিঃঘুমে। সকাল হতে না হতেই আরশীন আর স্থির থাকতে পারল না। সারারাতের জেগে থাকা, এক বুক উত্তেজনা আর সংশয়ের ওজন আর বইতে পারছিল না সে। আশাকে গিয়ে ডেকে তুলল। তারপর আস্তে করে বলল,
— “আশা, একটা কথা বলি, আমি কিছু একটা অনুভব করছি… হয়তো… আমি…”
আশা থমকে গেল, কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকল। আরশীন আর বলল না, শুধু চোখ তুলে তাকাল। সেই চোখেই সব লেখা ছিল।
আশা প্রথমে অবাক হলো, তারপর মুখে ফুটে উঠল প্রশস্ত এক হাসি।
— “ভাবনায় মাখামাখি হবার আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার আপু।”
আরশীন মাথা নাড়ল। আশা তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেন দেরি করলে পুরো পৃথিবীটাই মিস হয়ে যাবে। আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এলো হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে।
জিনিসটা আরশীনের হাতে ধরিয়ে বলল,
— “টেস্ট করে শিওর হয়ে নাও। তারপর আমরা উড়বো আনন্দে, নাকি চিন্তায় পড়ে যাব, সেটা দেখা যাবে।”

আরশীন ব্যাগটা হাতে নিয়ে চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হৃদপিণ্ড তখন একটু বেশিই ধুকপুক করছে। সবকিছু এখন নির্ভর করছে সেই ছোট্ট কিটটার ওপর। একটা দমবন্ধ করা মুহূর্ত। কিটের ফলাফল স্পষ্ট, পজেটিভ। হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বসে পড়ল বিছানায়। বুকের ভেতর যে ধুকধুক শব্দ হচ্ছিল, তা যেন আচমকাই থেমে গিয়ে আনন্দের ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনটা টুনটুন করে উঠল। আদিয়াতের মেসেজ,
— “এতবার মেসেজ দিচ্ছেন কেনো? কী হয়েছে?”
আরশীন ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনের ভিতরে জমে থাকা হাসি আর শিহরণ একসাথে হুড়মুড়িয়ে উঠতে চাইছে অথচ… আদিয়াত কিছুই জানে না। ওর ঠোঁটে চাপা একটা দুষ্টু হাসি খেলে গেল। কী হয়েছে সেটা এখন বলা যাবে না, একদম না। এই মুহূর্তটা শুধু নিজের কাছে রাখতেই বেশি ইচ্ছে করছে। তাই আদিয়াতের মেসেজের উত্তরে লিখল,
— “কিছু না। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।” মেসেজ পাঠিয়ে সে ফোনটা বিছানার এক কোণে ছুঁড়ে রাখল। হৃদয়ে এখন নতুন এক সুর বাজছে।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২৭]
~আফিয়া আফরিন

(ঝড়ের পূর্বাভাস)
আরশীনের মনে হলো, আদিয়াতের রাগ ভঙ্গানো উচিত। সে ফোন হাতে নিল। টাইপ করল,
— “এই যে… এতটুকু ভুলে এতো রাগ? আপনি কি একটু বড় হয়ে গেছেন, নাকি আমি ছোট হয়ে গেছি?” মেসেজ সীন হয় কিন্তু রিপ্লাই আসে না। আরশীন লিখতেই থাকে,
— “আপনি কথা না বললে আমার যে দিন কাটে না, তা জানেন না?”
— “আচ্ছা, আপনি রাগ করে থাকুন। কিন্তু জেনে রাখুন, আজকে আমি আপনাকে খুব খুব বেশি মিস করছি।”

খানিক পর রিপ্লাই আসে,
— “আপনার মিস করাটা কি প্রমাণ করে?”
আদিয়াতের রিপ্লাই আসতেই, আরশীন ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রেখে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে অভিমানী হাসি। তারপর অপেক্ষা করিয়ে জবাব দিল,
— “আমার শরীরটা খারাপ।”

ওপাশ থেকে আদিয়াত লিখল,
— “ভালো তো। আমি কি করতে পারি?”
— “শুধু শুনবেন… আর কি করবেন?”
সেই মুহূর্তেই ফোন বেজে উঠল। সাহেব ফোন করেছেন… আরশীন রিসিভ করে কানে ফোনটা ধরল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর এক কণ্ঠ,
— “কি হয়েছে, কি সমস্যা আপনার?”

হুট করেই মনটা নরম হয়ে এলো আরশীনের। সে একটু অগোছালো ভঙ্গিতে বলল,
— “অনেক সমস্যা। মন খারাপ, শরীর খারাপ… মনে হয় কপালটাও খারাপ।”

আদিয়াত বিরক্ত স্বরে বলল,
— “ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন না কেন?”

— “ডাক্তার নাই তো।”
— “কোথায় গেছে?”
— “বিদ্দ্যাশ্যে…”
— “ফাজলামি করছেন?”

আরশীন হেসে ফেলল,
— “করছি। আগে বলেন, কাল রাতে আমাকে ফোন দেন নাই কেন?”

আদিয়াত গম্ভীর সুরে জবাব দিল,
— “ওটা আপনার শাস্তি, প্রাপ্য ছিল।”
আরশীন ঠোঁট কামড়ে চুপ করে গেল। ফোনের ওপাশে শাস্তি দেওয়ার মানুষটার গলায় যতটা কড়াভাব, ভেতরে তার চেয়েও বেশি যত্ন লুকিয়ে ছিল। আরশীন একটু চুপ থেকে বলল,
— “শাস্তি দিলে তো অন্তত জিজ্ঞেস করবেন, কেমন আছি। আমার কোনো খবর না নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন?”

আদিয়াতের কণ্ঠে একটু নরম সুর,
— “খবর নেবো বলেই তো এখন ফোন করেছি।”
— “তখন দরকার ছিল। রাতে ঘুম আসছিল না। জানেন, আপনার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।”
— “জানি… কিন্তু আমি যদি একটু না রাগ করি, আপনি গুরুত্ব বুঝবেন?”

আরশীন কণ্ঠ নিচু করে বলল,
— “আমি সব বুঝি। শুধু আপনাকেই বুঝাতে পারি না ক্ষেত্রবিশেষে।”

আদিয়াত হালকা নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “বুঝি আর আপনাকেও জানি। আপনি যত বলুন শরীর খারাপ, আসলে মনটাই বেশি খারাপ।”
— “দু’টাই খারাপ। তবে আপনি যদি থাকতেন পাশে, সব ঠিক হয়ে যেতো।”
— “আমি কাছে আসলে তো আপনি আর অভিমান করতেন না। তাহলে তো ভালোবাসার সুযোগও পেতাম না।”

আরশীন চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে বলল,
— “আপনি থাকলে আমার অভিমানও নরম হয়ে যায়… খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।”

ওপাশে নীরবতা… তারপর আদিয়াত হালকা কণ্ঠে বলল,
— “আসতে দিন, তখন শুধু কথা নয়, সব শোনাবো… ছুঁয়ে, বুঝিয়ে, জড়িয়ে…”
আরশীন চোখ বুজে ফেলল, হৃদস্পন্দন যেন একটু বেড়ে গেল।
আরশীনের কণ্ঠ ভার হয়ে উঠল,
— “তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন তো?”
— “প্রতিটা মূহূর্ত গুনছি শুধু আপনার কাছে ফেরার জন্য…”

হঠাৎই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল আরশীনের।
— “আসুন… সারপ্রাইজ আছে।”
— “তাই? সেটা কী?”

আরশীন হালকা হেসে, একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
— “সরাসরি বলব… আপনার বুকে মাথা রেখে। খুব করে মিস করছি আপনাকে।”

এক মুহূর্তের জন্য আদিয়াত নিঃশব্দ হয়ে গেল। বুকের ভেতর টান পড়ল। তারপর নরম গলায় বলল,
— “আমিও… প্রতিটা নিশ্বাসে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, ঝগড়া করার পর ঠোঁট ফোলানো মুখটা। ঘুমের লাজে জড়ানো সেই চোখজোড়া, এলোমেলো চুলে ঝুঁকে পড়া মুখটা, কানের পাশে ফিসফিস করে বলা স্বপ্নগুলো; ভীষণ মিস করছি।”
ওদের মাঝে আর কোনো শব্দ নেই, শুধু নিঃশ্বাসের সুর… আরশীনের চোখ বুজে আসে, মনে হয় এমন সময় যদি আদিয়াত এসে পাশে বসতো, তবে কিছু না বলেই সব বলা হয়ে যেত।
.
আরশীনের মুখে খবরটা শুনেই শাহানার চোখ চকচক করে উঠল। তার ভেতর আনন্দের বিস্ফোরণ ঘটে গেল। মুখে হাজারটা প্রশ্ন, চোখে অশ্রুর রেখা, আর ঠোঁটে থামতে না চাওয়া হাসি।
— “সত্যি? মাশআল্লাহ!” বলেই কাছে টেনে নিলেন মেয়েকে। কপালে চুমু খেলেন একবার, বুকে জড়িয়ে ধরলেন মনে হয় কোনো অলৌকিক কিছু পেয়েছেন।
সেই শুরু। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, শাহানা রান্নাঘর থেকে বের হলেনই না। যা যা আরশীনের পছন্দ—ভুনা খিচুড়ি, গরুর মাংস, মুগডালের হালুয়া, ইলিশ মাছ ভাজা, সব রান্না করে ফেললেন একে একে। আরশীন চুপচাপ বসে দেখছিল, মা কী করে তার জন্য ছোট ছোট বিষয়ে এত ভাবেন, এত যত্ন করেন। চোখটা একটু জলে ভিজেই গেল। আর লজ্জা? সেটা তখন দুই গালে লাল হয়ে ফুটে উঠেছিল স্পষ্ট। মুখ নিচু, ঠোঁটের কোণে টুকরো হাসি।
সবকিছু মিলিয়ে যেন চারপাশে উৎসব লেগে গেছে। আরশীনের মুখে লজ্জার একটা আলো ঝলমল করছে। কথায় কথায় সবাই বলছে,
— “কী সুন্দর লাগছে তোকে আজ।”
— “মা হবি রে, কী দারুণ ব্যাপার!”
— “জামাই জানে তো? শুনে কি দিল হুম?”
আরশীন আসলে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না এত আয়োজনের জন্য। আশাকে আগেই বলে রেখেছিল,
— “দেখ, এখনই যেন ওই বাড়ির কেউ কিছু না জানে। আর আদিয়াত তো একদম না, ওকে আমি নিজে বলতে চাই।” ওর কথাই রাখল। কাউকে জানাবে না। সন্ধ্যা হতেই শাহানা আরশীনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। চেক-আপের দরকার আছে, কত মাস চলছে কিংবা কী বৃত্তান্ত; তারা এখনো কিছুই জানেনা।
ডাক্তারের কাছে আসার পর সত্যিই নিশ্চিত হওয়া গেল যে, আসলেই ওর মধ্যে একটা ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে এবং প্রায় দুই মাস চলছে। তাছাড়া, সব ঠিকঠাক। কোনো অসুবিধে নেই। ডাক্তার আরশীনকে সাবধানে থাকতে বলল, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে বলল এবং মেন্টালি কোনো প্রেসার নিতে মানা করল।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পর শাহানা হাসি মুখে বললেন,
— “দুই মাস প্রায় পার করে ফেললি মা! এরমধ্যে কিছু বুঝতে পারলি না? পাগলি!”

আরশীন একটু অপ্রস্তুত হয়ে হেসে ফেলল,
— “আমি কী আর জানতাম? শুধু মাথাটা কেমন যেন হচ্ছিল… ভাবছিলাম, টেনশন।”
— “এই টেনশনই তো এখন তোর জীবন বদলে দেবে। আর এখন থেকে তুই একা না, ছোট্ট একটা প্রাণ তোর সঙ্গে আছে।”
আরশীন শুধু মুচকি হেসে মাথা নেড়ে দিল। আদিয়াতের সঙ্গে আর কথা হয়নি। আসলে ও বোধহয় সত্যিই কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফোন দেয়নি, মেসেজও না; ব্যস্ততার কথা স্মরণ রেখে আরশীনও আর বিরক্ত করে নাই। তবুও মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, একবার বলে…
— “শুনুন, একটা ছোট্ট গোপন কথা আছে…”

ঘরে ফিরে আরশীন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। জানালার পর্দা নরম বাতাসে একটু দুলে উঠল। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল সে। ধীর চোখে নিজের প্রতিবিম্বে তাকাল। চেহারায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন নেই; সেই চিরচেনা মুখ, কিছুটা ক্লান্তি হয়তো আছে কিন্তু তবুও ঠিক এ মুহূর্তে নিজেকে আর আগের মতো মনে হচ্ছে না। সে আলতো করে নিজের পেটে হাত রাখল। কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। না কোনো নড়াচড়া, না কোনো ভার। তাও ঠিক এই হাতের নিচেই, নিঃশব্দে বেড়ে উঠছে একটা জীবন। তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরেকটা হৃদস্পন্দন, একটা ছোট্ট, নিষ্পাপ প্রাণ।
আরশীন মৃদু একটা হাসি দিল। চোখে জল টলটল করছে অথচ মনটা প্রশান্তির এক অচেনা নদীতে ভাসছে। আয়নায় ওর প্রতিফলন যেন একটু আলাদা হয়ে উঠল। সেই চেহারার আড়ালে এখন এক নতুন পরিচয়ের আলো-ছায়া খেলা করছে, একজন মা হয়ে ওঠার সূচনার ছায়া।
হঠাৎ মনে হলো, আদিয়াত জানলে কী হবে? এই প্রশ্নটা মনে আসতেই যেন আরশীনের ঠোঁটে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল। ও কি খুশি হবে? আদিয়াতের সাথে এই বিষয়ে বিশেষভাবে কখনো কথা বলা হয়নি। আরশীন নিজের মনে গুনগুন করল,
— “আপনার সামনে দাঁড়িয়ে যদি বলি, ‘আমি একা নই এখন…’ আপনি কী করবেন আদিয়াত?”

একটু ভেবে আবার নিজেই উত্তর দিল,
— “আপনি নিশ্চয়ই প্রথমে চুপ করে যাবেন। তারপর অবাক হয়ে বলবেন, ‘সিরিয়াস?’ তারপর হাঁসফাঁস করতে করতে বলবেন, ‘আরশীন, আমি তো ঠিকভাবে হাসতেও পারছি না! আমি বাবা হচ্ছি?’ তাইনা?”
আরশীনের মুখে হাসি ফুটল। তারপর একটু ভেবেই গভীর হয়ে গেল মুখটা। আবার হেসে নিজেকে কল্পনা করল, আদিয়াতকে প্রথমবার খবরটা জানাচ্ছে। ওর চোখ দুটো কী রকম উজ্জ্বল হয়ে উঠবে! ওর ঠোঁট কাঁপবে, হাতদুটো হয়তো অন্যমনস্কভাবে মাথায় রাখবে, চোখ নামিয়ে বলবে,
— “আপনি এই খবরটা এতদিন লুকিয়ে রাখলেন?”

তখন সে বলবে,
— “আপনার এই চেহারাটা দেখার জন্যই তো এত অপেক্ষা করলাম…”
আরশীন জানে, তখন আদিয়াত আর নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। ও ছুটে আসবে। জড়িয়ে ধরবে। আদুরে গলায় বলবে,
— “এইটুকু জীবন… এতটুকু মানুষ… কিন্তু এটাই তো আমাদের পুরো পৃথিবী হতে চলেছে!”

আরশীন তখন নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে বলবে,
— “হ্যাঁ… আমাদের পৃথিবী।”
এমন সময় শাহানা ঘরে ঢুকতেই আরশীন চমকে উঠল। কল্পনার রঙিন রাজ্য থেকে বাস্তবের আলো-ছায়ায় ফিরে এলো সে। চোখেমুখে তখনও আবেশের ছায়া। মা কিছু বুঝলেন না ঠিক, তবে মেয়ের মনের মধ্যে যে আলোড়ন চলছে, তা তিনি ঠিকই টের পেলেন। আরশীন ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। মায়ের পাশে বসে পড়ল। তারপর আস্তে করে মাথাটা তুলে মায়ের কোলে রেখে দিল। ছোটবেলার সেই চিরচেনা নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে এলো সে। শাহানা হাত বুলিয়ে দিলেন ওর চুলে,
— “তোর বাবা যদি আজকে থাকত… এই কথা শুনতো… তাহলে যে কী পরিমাণ খুশি হতো রে, আন্দাজ করতে পারবি না।”

আরশীন শান্ত কণ্ঠে বলল,
— “জানি তো মা।”

শাহানা একটু চুপ করে থেকে স্মৃতিমেদুর কণ্ঠে বললেন,
— “যেদিন আমরা জানতে পারলাম, তুই আসতে চলেছিস… তোর বাবা তো ওভাবেই পাগল হয়ে গেল রে। যেন সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে চায়, ‘আমার মেয়ে আসছে!’ আজ সারাটা দিন সেটাই ভাবলাম, মানুষটা যদি আজও থাকত, তোকে আবার এভাবে নতুন করে জীবনের পথে হাঁটতে দেখে কী বলত কে জানে…”
আরশীনের চোখে ঝাপসা জমে উঠল। বুকটা ভার লাগছে। মায়ের কণ্ঠে এমন মমতা; সে কোনো কথা বলল না, শুধু মুখ গুঁজে রইল মায়ের কোলেই। মা আবার বললেন,
— “আদিয়াতকে এখনো বলিসনি বুঝি?”

আরশীন মাথা নাড়ল,
— “উঁহু।”
— “ঠিক আছে। ফিরুক তারপর বলিস। জীবনের এই পরিবর্তনটা সাধারণ না বুঝলি মা? এটা এমন একটা সময়, যখন মেয়েরা আর শুধু মেয়ে থাকে না। একেকটা নতুন পরিচয়, নতুন ব্যথা, আনন্দ, দায়িত্ব… সব এসে পড়ে।”
আরশীন মায়ের গলা শুনে মনোযোগ দিল। শাহানা বললেন,
— “প্রথমে বুঝবি না কিছুই। শরীর ধীরে ধীরে বদলাবে, মনটা আবেগে ভরে উঠবে। তখন তুই বুঝবি, তোর ভেতরে শুধু জীবন নয়, একটা ছোট্ট আলাদা গল্প জন্ম নিচ্ছে। ওই গল্পটা প্রথম হাঁটবে তোর পেটের ভেতর… তারপর তোর হাত ধরে হাঁটবে এই দুনিয়ায়।”
আরশীন মুখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে। মায়ের মুখে একধরনের প্রশান্তি, মায়া আর গর্ব। নিজের মেয়েকে নতুন করে বড় হতে দেখছেন।

— “সবাই তো থাকবেই কিন্তু নিজের শরীরের যত্ন নিজেকেই করতে হবে।” মা বললেন, “ভুলে যাবি না, এখন আর তুই একা না। আর যখন আদিয়াতকে বলবি দেখবি, ওর চোখেও নতুন এক আলো জ্বলবে। কারণ মা হওয়া যেমন সৌভাগ্য, তেমনই কারও বাবা হওয়া যে কতটা গর্বের; তা একজন ভালোবাসার মানুষই ঠিক বুঝবে।”
আরশীন চুপচাপ মায়ের কথাগুলো শুনল। প্রতিটি শব্দ ওর ভিতরে আলতো করে ছুঁয়ে গেল। এই জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা দেওয়ার আগে এটাই দরকার ছিল; একটু স্নেহ, একটু আশ্বাস আর মায়ের ভালোবাসায় ভেজা কিছু মোলায়েম কথা। এমনই এক শান্ত, আবেগঘন মুহূর্তে হঠাৎ করেই বাইরের ঘর থেকে ভেসে এলো আশার কণ্ঠ,
— “মা! মা!”
ডাকে একটা ব্যাকুলতা ছিল, যেন খুব তাড়াতাড়ি দরকার কিছু। মুহূর্তেই আরশীন আর শাহানার মাঝের সেই কোমল মুহূর্তটা ছিঁড়ে গেল।

— “দেখি, আশা ডাকে কেন?” আরশীনের কপালে আলতো করে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। “তুই বস এখানেই, বেশি নড়াচড়া করবি না।” আরশীন শুধু মাথা নাড়ল। মায়ের কোমল উপস্থিতি সরে গেলেও কানের ভেতর এখনো গুঞ্জন তুলছিল তার কথাগুলো।
.
চাচা এসেছেন, একটা মারাত্মক খবর দিলেন। ঘরের আবহ এক মুহূর্তেই ভারী হয়ে উঠল। শাহানা দ্রুত চোখ তুললেন, মুখে উদ্বেগ স্পষ্ট।
বিলাল হক বললেন,
— “আজ বাজারের পাশে দু-তিনজন লোককে দেখেছি, এহসানুল হকের বাড়ি কোথায় খোঁজ করছিল।”

শাহানার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চোখেমুখে আতঙ্কের ছায়া। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন, গলার স্বর কাঁপছিল,
— “এখানেও…?”
এই ‘এখানেও’-র মধ্যে সমস্ত ভয়, আশঙ্কা আর অস্থিরতার মিশেল। তিনি তো এই ভয় থেকেই ঢাকা ছেড়ে এসেছিলেন, ভেবেছিলেন ফরিদপুরে অন্তত শান্তিতে থাকা যাবে। এহসানুল হকের কর্মজীবনের জগৎ একেবারেই আলাদা ছিল। নিরাপত্তা, সতর্কতা, সবকিছুর ভেতরে থেকেও এমন কিছু শত্রু ছিল, যাদের মনোভাব হিংস্র আর প্রতিশোধপরায়ণ। তার আসল বাড়ি ফরিদপুর, এই তথ্য একেবারে নিকটজন ছাড়া কেউ জানত না। এই কারণেই তো শাহানা হুট করে দুই মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিলেন এখানে। কিন্তু এখন যখন এই জায়গাতেও শত্রুপক্ষ তার স্বামীর বাড়ি খুঁজছে, তখন বুকের মধ্যে আবার সেই পুরনো ভয় জেগে উঠল। হঠাৎই মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কেন খুঁজছে ওরা আমাদের? কী চায়?”

বিলাল একটু ইতস্তত করে বললেন,
— “জানি না ভাবি, ওদের আসল উদ্দেশ্য কী। তবে বাজারে যে এভাবে খোঁজখবর নিচ্ছে, সেটা ভালো লক্ষণ না। মানুষ তো আমাদের চেনে, কেউ না কেউ বলে দিয়েছে হয়তো। আমি আপনাদের সাবধান করতে এসেছি। আমার মনে হয়, এখানে থাকাটা এখন আর নিরাপদ না।”

আরশীন তখন কিছুটা দূরে, চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। চাচার কথা শেষ হতেই এগিয়ে এলো, চোখে দৃঢ়তা, কণ্ঠ শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ সুরে বলে,
— “তবে কোথায় যাব আমরা, চাচা? ওরা যদি আসেই, আসুক। আমি কথা বলব ওদের সাথে। জানতে চাইব, তারা আসলে কী চায়।”

শাহানা সঙ্গে সঙ্গে রাগ আর উদ্বেগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “তুই এসেছিস কেন এখানে? তোদের বারবার বলেছি, এসবের মধ্যে না আসতে। তোরা দুই বোন এসব থেকে দূরে থাকবি। যাই হোক, আমি সামলাব।”

আশা তখন পাশে দাঁড়িয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,
— “আমরা থাকতে তুমি কেন মা? এই পরিবারের যা কিছু, সেটা আমাদেরও। তুমি একা হয়ে গেলে, আমাদেরও কিছু থাকবে না। এবার তো আর পিছিয়ে থাকা যাবে না।”
শাহানার মুখের রঙ ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে এলো। চিন্তায় ডুবে গিয়ে উপলব্ধি করলেন, তার দুই মেয়েই বাবার রক্ত। মাথা গরম, কিন্তু ন্যায়বোধে অটল। অন্যায় দেখলে রক্ত ফুটে ওঠে তাদের। এই গুণটা যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি ভয়ংকরও। কারণ এ বাড়িতে আর কোনো পুরুষ নেই, যে সময়মতো সামনে এসে একটা ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। যদি কিছু ঘটে যায়, তবে সামাল দেবে কে?
চোখ মেলে তাকালেন, দুটো মেয়েই পাশে দাঁড়ানো। আরশীন তখন মায়ের কাছে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখল। চোখের নিশ্চিন্ত ভরসা বলে দিচ্ছে,
—“আমরা আছি, মা। ভয় পেও না।”

শাহানা ওই চোখে অদ্ভুত কিছু দেখলেন; একরকম জেদ, সাহস, আর নির্ভরতার অদৃশ্য শক্তি। আরশীনের ভয় বলে কিছু নেই। বরং সে তীব্র আত্মবিশ্বাসী, অন্যায়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে জানে। চুপ করে থাকা তার ধাত নয়। সত্যের পাশে দাঁড়ানোর শক্তি তার আছে।
শাহানার মনে যতটা শঙ্কা, ততটাই গর্ব। তবু ভিতরে একটা মা হৃদয়ের দুর্বলতা, মেয়েগুলোর যদি কিছু হয়ে যায়? সেই প্রশ্নটাই মাথায় বাজতে থাকে। বুকের ভেতর জমে থাকা অস্থিরতা আরশীনের স্পর্শে সামান্য নরম হয়ে এলো। কিন্তু মেঘ কাটেনি কারণ ঝড় এখনও থামেনি।
.
.
.
চলবে….