তবুও তুমি পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
36

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২৮]
~আফিয়া আফরিন

(প্রেম ও প্রহর)
ঝড় কেমন হবে, তারা জানতো না। কিন্তু আকাশে একটা অজানা ভারী ভাব, বাতাসে থমথমে নিস্তব্ধতা, আর মাটিতে অদৃশ্য কাঁপুনি যেন জানিয়ে দিচ্ছিল ঝড় আসছে। ঠিক যেমন ঝড়ের আগে হঠাৎ করেই প্রকৃতি নিঃশব্দ হয়ে যায়, তেমনি ওদের চারপাশেও ছড়িয়ে পড়েছিল এক গম্ভীর সুনসান। চাচা বারবার অনুরোধ করেছিলেন,
— “তোমরা তোমাদের মামার বাসায় চলে যাও, এই মুহূর্তে এখানে থাকা নিরাপদ না।”
কিন্তু আরশীন আর আশা কেউই রাজি হয়নি। আরশীন তখন দৃঢ় গলায় বলেছিল,
— “আর কতদিন পালাবো চাচা? ওদের এত সাহস হয় কেন? কারণ আমরা পালাই। এবার দাঁড়াব, সামনাসামনি। যা হবে দেখা যাবে।”

চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করেছিলেন। আর শাহানা, মায়ের মন তো! সে কেবল আতঙ্কে ভুগছিলেন। প্রতিটা শব্দে চমকে উঠছিলেন। মনে মনে বলছিলেন, আর কয়েকটা দিন শুধু নির্বিঘ্নে কাটুক। তারপর মেয়েরা চলে যাক ওদের গন্তব্যে। এরপর যা খুশি হোক, কেউ দেখতে আসবে না। অন্তত ওরা নিরাপদ থাকুক।
দুটো দিন কেটে গেল নিঃশব্দে, নিঃঝামেলায়। কিছুই হলো না। তবে নিস্তব্ধতা কি কখনও ভালো কিছু নির্দেশ করে? ঝড় কি তবে আরও একটু গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে, আঘাত হানার আগে?
.
আলিয়ার সাথে তাহমীদের ডিভোর্স ফাইনাল হওয়ার আগে, শেষ দাগ টানার আগে দৃষ্টি মেলানো জরুরি ছিল। ও চুপচাপ ফোন করেছিল বাবাকে।
— “বাবা, একটাবার দেখা করতে চাই তাহমীদের সঙ্গে। একবার মাত্র। তারপর সই করব।”

জহিরুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন,
— “মা, তুমি কি চাও ফেরাতে? মনে রেখো, যে অপরাধ ও করেছে তারপর সে না আইন থেকে সহজে ছাড়া পাবে আর না সহজে আমাদের বাড়ির জামাই হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।”
— “না… শুধু একটা কথা বলার আছে।”

তাহমীদ তখন মুক্ত আকাশের নিচে নয় বরং চার দেয়ালের ভেতর। কয়েদিদের পরিচিত ইউনিফর্ম, চোখে গভীর ক্লান্তি, চুলগুলো কিছুটা বড় হয়ে গেছে। এই চেহারাটা আলিয়া শেষবারের মতো দেখতে চায় নাই, তবুও এলো।
জহিরুল ইসলাম উদ্যোগ নিয়ে ব্যবস্থা করেছিলেন। একটু আলাদা দেখা করার অনুমতি মেলানোটা সহজ ছিল না, কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার স্বার্থে বলে একটু সময় আদায় করে ফেলেছিলেন। নির্দিষ্ট দিনে আলিয়া এসেছে, গাড়ির জানালা দিয়ে জেলের বাইরে তাকিয়ে থেকে নিজের শ্বাসগুলো গুছিয়ে নিয়েছিল কিছুক্ষণ। মনের ভেতর অনেক দ্বিধা; যাকে একসময় “নিজের” ভেবেছিল, আজ সে অপরাধী, বন্দি। অথচ আজকেই সে হয়ত “স্বামী” পরিচয় থেকেও মুক্তি পাবে।

ভিজিটর রুমে বসেছিল কিছুক্ষণ। চারদিকে বিরক্তিকর নিস্তব্ধতা। নিরাপত্তার চাপে আটকে থাকা নিঃশ্বাস। তখনই ওকে আনা হলো। চোখাচোখি হলো। মুহূর্তটুকু দীর্ঘ, জটিল, অস্বস্তিকর।
— “কেমন আছো?” আলিয়ার গলা ভেঙে যাচ্ছিল, তবুও গাম্ভীর্য ধরে রাখল।

তাহমীদ হেসে বলল,
— “এইখানে ভালো থাকার মতো কিছু থাকে না। তবুও, ঠিক আছি।”
— “আজকে সই করব আমি। এটুকু জানিয়ে যেতে এলাম।”

তাহমীদের চোখেমুখে নির্বিকার ভঙ্গি। বলল,
— “জানি। ভিত্তিহীন সম্পর্ক তো সারা জীবন বয়ে বেড়ানো যায় না। শুধু একটা অনুরোধ…”
— “কী?”
— “নিজেকে দোষ দিও না কখনো।”

আলিয়া স্থির চোখে তাকাল,
— “আমি দোষ দিই না। প্রথম প্রথম খুব বিশ্বাস রেখেছিলাম, তারপর সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন আর কিছু অনুভবও করি না। ভুল মানুষের জন্য নিজের জীবন থামিয়ে রাখা ঠিক না, এই সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছি অবশেষে।”

তাহমীদ একটু মাথা নোয়াল,
— “তোমার মতো কাউকে হারানোই আমার শাস্তি।”

আলিয়া উঠে দাঁড়াল। টেবিলে কাগজগুলো রেখে বলল,
— “এটা স্বাক্ষরের ফর্মালিটিতে শেষ হলেও, আমাদের গল্পটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আজ শুধু দরজা বন্ধ করছি।”
তাহমীদ কিছু বলল না। শুধু চোখ নামিয়ে ফেলল। আলিয়া তখন পেছন ফিরে হাঁটা দিল। তাহমীদের শেষ প্রশ্নটা ছিল নীরব ভঙ্গিতে ছোঁড়া একটা তীরের মতো,
— “বিয়ে কবে করছো?”

আলিয়া থেমে গেল এক মুহূর্ত। পেছনে ফিরেও তাকাল না। একটা ক্ষীণ বিরতি, চোখের দৃষ্টি স্থির সামনে, কিন্তু কণ্ঠ ছিল শান্ত, স্বচ্ছ, প্রায় অনুভূতিহীন,
— “যদি কোনদিন মনে হয় ভালোবাসা শুধু কাগজে সই নয়, বোঝাপড়ার একটা ঘর… সেদিন করব। আর যদি না হয়, তাহলেও ভালো আছি। এখন নিজের সাথেই সবচেয়ে ভালো লাগে।”
বাইরে বেরিয়ে এসে আলিয়া আকাশের দিকে তাকাল। রোদের আলো পড়ছিল চোখে, তবু সেই রোদে একটা শান্তি ছিল; মুক্তির শান্তি। আজ সে সত্যি মুক্ত; আইনত, মানসিকভাবে, আবেগগতভাবে। গাড়িতে জহিরুল অপেক্ষা করছিলেন। আলিয়া এসে বসতেই ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললেন, এছাড়া আর কোনো কথা বললেন না। মাঝপথে ফোনটা বাজল। কল কেটে জহিরুল ইসলাম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, গাড়ি থামাতে বললেন।
— “তুমি সাবধানে যাও মা। আমার একটু কাজ আছে।”
— “বাড়ি ফিরবে কখন বাবা?”

জহিরুল হালকা হাসলেন,
— “এইতো… খানিক বাদে।” আর কিছু বলার আগেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। তারপর ওখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বাদে একটা বাইক এলো। হেলমেট পরিহিত কণ্ঠস্বরটা বলল,
— “উঠে আসুন।” তিনি উঠে বসলেন। বিকেলের আলো নিভে গিয়ে চারপাশে নেমে এসেছে ধূসর একটা ছায়া। বাইকটা গিয়ার বদলাতে বদলাতে শহরের কোল ছেড়ে ঢুকে পড়েছে একটা নির্জন ফাঁকা রাস্তায়। বাইক থামল। জহিরুল ইসলাম নেমে দাঁড়ালেন। চোখে চশমা ঠিক করে নিলেন,
— “বলো রেজা, কী এমন কথা বলবে যে শহর ছেড়ে এতদূর আসতে হলো?”
রেজা হেলমেট খুলল না, কেবল ঠান্ডা স্বরে বলল,
— “কিছু কথা তো এমন হয়, যা চার দেয়ালের মাঝে বলা যায় না। চিন্তা করবেন না স্যার, আপনাকে ঠিকমতো পৌঁছে দেবো।”

জহিরুল নীরব। রেজা পকেট থেকে একটা চিপ বের করল। বাতাসে ওটা ঝুলিয়ে বলল,
— “এটা একটা কপি স্যার, যেখানে কিছু কণ্ঠস্বর, কিছু ডকুমেন্টস আছে। পুরনো কথা, পুরনো সম্পর্ক, যার খুঁটিনাটি কাহিনি একেবারে পারিবারিক শিরায় মিশে আছে।”
— “এটা কিসের? তুমি কী চাও?”

রেজা একটু হাসল,
— “আমি ভেবেছি একটা কাজ করব। যার আগাগোড়া সবখানে বিপদ লেখা থাকবে। আর সেই বিপদ যদি আপনার পরিবারকে কেন্দ্র করে হয়, কেমন হবে বলেন তো? মজাই তো হবে, রোমাঞ্চকর একটা খেলা।”

জহিরুল ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এলেন। থেমে গিয়ে কড়া গলায় বললেন,
— “আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করো রেজা। এর ফল জানো না?”

রেজা মাথা নিচু করে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল,
— “জানি তো। সেটাই তো আসল মজা, স্যার…”
রেজার গলায় হালকা খেলাচ্ছল ভাব থাকলেও, জহিরুল ইসলামের মতো অভিজ্ঞ মানুষ ততক্ষণে টের পেয়েছেন, এই ছেলে কিছু একটা বড় ঝামেলার ছক কষছে। যেভাবে কথা বলেছে তাতে স্পষ্ট, রেজা শুধু ঝুঁকির খেলায় নামছে না; সে চায় কাউকে ঝাঁকুনি দিতে, কাবু করতে, হয়তো ধ্বংস করতে।
.
আদিয়াত এখন সিঙ্গাপুরে। বিশেষ একটা গ্লোবাল টেন্ডার প্রজেক্টের দায়িত্বে আছে, যেটা নিয়ে তাদের কোম্পানির ভেতরে বহুদিন ধরেই পরিকল্পনা চলছিল। বিভিন্ন দেশের অংশীদারদের নিয়ে কনফারেন্স, প্রেজেন্টেশন, নেগোশিয়েশন; এসব নিয়েই প্রতিদিন তার ঘুম, খাওয়া, ফোনালাপ, এমনকি শ্বাস নেওয়াটাও টাইম টেবিল অনুযায়ী। একেকটা মিটিং শেষে, ফোন খুলে স্ক্রিনে তাকায়, আরশীনের কোন মেসেজ এল কিনা। কাজের ভিড়ে নিজের পক্ষ থেকেও ঠিকঠাক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে না। কে জানে, ম্যাডাম গাল ফুলিয়ে বসে আছেন কিনা? চাপা দুশ্চিন্তা অবশ্য আছে, ওর শরীর কেমন আছে? খেয়াল রাখছে তো নিজে? বলেছিল, অসুস্থ… তারপর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে গেছে। হাজার প্রশ্ন করলেও উত্তর মেলে নাই। এইমুহূর্তে যেটুকু সময় আদিয়াতের হাতে আছে, সেটা শুধু আরশীনের জন্য চিন্তা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আজ আদিয়াতের বহু প্রতীক্ষিত ছুটি। টানা কাজের ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে ছিল ঘুম, আর মন জুড়ে… একটাই মুখ। সকালে কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, তাই অনেকদিন পর লম্বা একটা ঘুম দিলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে একবার বড় করে হাঁফ ছেড়ে ফোনটা হাতে নিল। নোটিফিকেশন চেক করেই মনটা একটু ভার হয়ে গেল, আরশীনের কোনো মেসেজ নেই। না আছে কোনো কল। সে নিজেই টাইপ করল,
— “ভুলে গেছেন?”

মেসেজ সেন্ড হতেই, সীন হয়ে গেল। আর মুহূর্ত পেরোতেই রিপ্লাই,
— “যেভাবে সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করেন, এই জীবনে ভুলে যাওয়া সম্ভব?”

আদিয়াতের মুখে না চাইতেই হাসি চলে এলো।
— “তো শুনি কিভাবে ঘোরাফেরা করি? এতদূর থেকেও যে কারো মাথার ভিতর ঘোরাফেরা করার ক্ষমতা রাখি, তা তো জানা ছিল না।”
— “মাথার একটা কোণ দখল করে বসে থাকেন। কখনো চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন, আবার কখনো হুট করে কথা বলেন। মন খারাপ হলে আপনাকে নিয়ে ঝগড়া করি, খুশি হলে মনে মনে আপনাকে বলি, ‘দেখলেন?’ ঘুমোতে গেলেও আপনি সাথে থাকেন। আপনার গলাটা শুনতে না পেলে ঘুম আসে না এখন।”

আদিয়াত লিখল,
— “আরেকটু ঘুমাতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনার এই কথাগুলা আমার ঘুম ভেঙে দিল।”
— “তাই?”
— “হুমম, চোখ ভর্তি ঘুম আর মাথা ভর্তি আপনি!”
— “এতো ডায়লগবাজি কইরেন না তো।”

আদিয়াত মুচকি হাসল,
— “কেনো? একটু করলে কি হয়?”
আরশীন এবার চুপ। একটু লজ্জা, একটু ভেতরের আলোড়ন।
আদিয়াত জানে এই চুপ মানে রাজি, এই চুপ মানে হাসিমুখ। সে আবার লিখল,
— “পটে যাবার সম্ভাবনা আছে?”

ওপাশ থেকে আসলো ছোট্ট উত্তর,
— “সে তো কবেই…”
— “নতুন করে আরেকবার না হয় পটলেন! যাবেন নাকি আবার সেই কুয়াকাটা, সিলেট, জাফলং, আমাদের প্রেমের রাজত্বে?”

আরশীন এবার বালিশে মুখ চেপে বলল,
— “ইশশশ, আপনি একলাই যান।”

আদিয়াতের উত্তর এল ঠিক সাথে সাথে,
— “আপনি সাথে না থাকলে সেই ফিল পাব কীভাবে? নাকি ফরিদপুর চলে আসি, কি বলেন?”

আরশীন ভুরু কুঁচকে জবাব দিল,
— “আপনি কি বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় জেলায় আপনার প্রেমের রাজত্ব চালাতে চাচ্ছেন?”

আদিয়াতের দুষ্টু হেসে রিপ্লাই,
— “ক্ষতি কি? আপনি তো আছেন রাণী হয়ে রাজত্ব চালানোর জন্য!”

আরশীন এবার নিজের স্নিগ্ধ মেজাজে ফিরল,
— “রাজত্ব চালাতে গেলে সৈনিক লাগে, আপনি তো একাই আছেন।”
— “সৈনিক? লাগবে নাকি?”
— “রাজত্ব চালাতে গেলে তো অবশ্যই লাগবে।” আরশীন শান্ত গলায় জবাব দিল, মনে একটুখানি খুঁনসুটি ছড়িয়ে।

ওপাশ থেকে আদিয়াত দেরি না করে বলল,
— “ওকে ঠিক আছে, আমি আসি। ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দিয়ে হুট করেই হাজির হব, বাট সেটা তো হচ্ছে না। এখন তো মনে হচ্ছে, আমি আসার আগে আপনাকে প্রিপারেশন নিতে হবে। যত যাই হোক, সৈনিকের ব্যাপার বলে কথা!”
আরশীন প্রথমে কিছু বুঝতেই পারল না। চোখ বড় বড় করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মাথায় যেন একটু দেরিতে ক্লিক করল কথার আসল মানে। তারপর…?
তারপরই গাল বেয়ে গরম এক ঢেউ উঠে গেল কানে, চোখের কোণ থেকে কপাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল লজ্জার একফালি রঙ। মনে হচ্ছিল যেন কানের পাশ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে! আরশীন তাড়াতাড়ি বালিশ মুখে চেপে লিখল,
— “ইশশশশ, আপনি না… অ্যাই আমার সাথে এখন কথা বইলেন না তো।”
অন্যপ্রান্তে আদিয়াত নিশ্চয়ই হাসছে, আর এপাশে একটা মিষ্টি শিহরণ নিয়ে আরশীন বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রেম শুধু কথা নয়, কথার ভেতরে লুকানো ইঙ্গিতেই যে এতটা আলোড়ন; তা ওরা দুজন ভালোই জানে।
আদিয়াতের সেই “সৈনিক”-এর কথা হঠাৎ এমনভাবে কানে বেজে উঠল, যেন শব্দটার গভীরে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো ইঙ্গিত। ধীরে হাতটা নিজের পেটের ওপর রাখল। অদ্ভুত এক টান অনুভব করল ও;
একটা নরম, অদেখা, অনুভবযোগ্য টান… যেটা রক্তের ভেতর দিয়ে বইছে, মন ছুঁয়ে যাচ্ছে।
এটা কি করে হয়? আদিয়াত কি সত্যিই অনুভব করতে পারছে? এই ছোট্ট অস্তিত্বের উপস্থিতি, ওর না বলা অনুভূতি? তবে কি রক্তের টান এমনই হয়? আরশীন উঠে আবার ফোনটা হাতে নিল। মৃদু হাসি ঠোঁটে এসে বসেছে। আঙুল নরম ছোঁয়ায় কি-বোর্ডে টোকা দিল,
— “একটা সৈনিক হলে আপনি খুশি হবেন?” এই কথাটা লেখার পর মুহূর্তে ওর বুক ধক করে উঠল। মনে হলো, নিজের ভেতরের সবচেয়ে গোপন অনুভূতিটা হঠাৎ করে খুব নিঃশব্দে জানিয়ে ফেলেছে।

আদিয়াত মেসেজ টাইপ করল,
— “সৈনিক না, সেনাবাহিনী হলেও খুশি হয়ে যেতাম।”
আরশীন একটু আহ্লাদী হলো,
— “কীরকম খুশি?”

— “বুঝেছেন, মানুষ জীবনে অনেক কিছু চায়; চাকরি, সাফল্য, ভালোবাসা… কিন্তু কিছু কিছু অনুভব থাকে যেগুলোর জন্য তো চাওয়া যায় না, তা শুধু সৃষ্টিকর্তা যদি চায় তবে হয়। একটা প্রাণ যে আমার রক্ত, আমার স্পন্দন, পৃথিবীতে আসবে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসবে, আমি তার জন্য নাম বাঁচব; এগুলো ভাবলেই বুকের ভেতর কেমন খালি হয়ে যায় আবার পরিপূর্ণও লাগে। এই অনুভবটা খুশির চেয়ে গভীর। আপনি বললেন খুশি হবো কিনা? না… আমি ধন্য হবো। আপনাকে পাশে পেয়ে, আমার সন্তানকে এই পৃথিবীতে আনতে পারার আশীর্বাদ পেয়ে, আমি সত্যিই ধন্য হবো। ব্যস্ততা, দায়িত্ব, কর্পোরেট দুনিয়ার গোলমাল; সবকিছু একদিকে সরিয়ে দিব।”

আরশীনের যে কী হয়েছে, তা সে নিজেও ঠিক বোঝে না। চোখের পানির এক অদ্ভুত অভিমান আছে আজকাল, ছোট্ট একটু ভালোবাসার কথা শুনলেই টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে। কিছুতেই আটকে রাখতে পারে না, ইচ্ছেমতো বেরিয়ে আসছে বুকের ভেতর জমে থাকা আবেগ। ঝাপসা চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে লিখল,
— “বাবা হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই শুধু ভালো না, শ্রেষ্ঠটাই হবেন… কারণ আপনার ভালোবাসায় কখনো কমতি দেখি না।”
— “আর স্বামী হিসেবে?”
— “স্বামী হিসেবে আপনি শুধু আমার সঙ্গী নন, আপনি আমার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি। আপনার ভালোবাসায় এমন এক আশ্রয় পাই, যা জীবনের যেকোনো ঝড় ঠেলে দিতে পারে। আপনার ভালোবাসায় ভরসা আছে, সেই ভরসাতেই তো আমি হাঁটছি চোখ বুজে…”

আদিয়াত যাওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজ সকালটা অন্যরকম হলো। ফোনে একটা ছোট্ট মেসেজ, “আরো এক সপ্তাহ লাগবে। ডেট পেছানো হয়েছে কিছু কারণে।”
আরশীন মেসেজটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সে কিছু লিখল না ফিরতি মেসেজে। নালিশ করতেও ইচ্ছে হলো না। রাগও হলো না ঠিক। শুধু একটা হালকা মনখারাপ ঢেউয়ের মতো বুকের ভেতর ঘুরপাক খেলো।
দুদিন বাদেই ওদের বিয়ের একবছর পূর্ণ হবে। একবছর শুনতে যতটা ছোট লাগে, ততটাই গভীর ছিল এই পথচলা। যদি আদিয়াত এই সময়টায় পাশে থাকত! দুজনে একসাথে দিনের শুরুটা করতে পারত। একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলত, —“আমরা একবছর পেরিয়ে এসেছি।”
আরশীন মন খারাপ ঝেড়ে ফেলে বিকেলেই বেরিয়ে পড়ল। আলো-হাওয়া গায়ে লাগতেই মনে হল, সব ক্লান্তি হাওয়ায় উড়ে গেল।

ঘটনাটা ঘটল পরদিন সন্ধ্যায়… একেবারেই হঠাৎ। যেন শান্ত পরিবেশের মধ্যে হঠাৎ বজ্রপাত। ডাক্তার দেখিয়ে মা-মেয়েতে বাড়ি ফিরেছে। শাহানা ফ্রেশ হচ্ছেন, আশা নিজের ঘরে নিশ্চয়ই ঘুমে। আরশীন ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। মাথাটা ভার ভার লাগছিল, চোখে ঘুমের পর্দা নেমে আসছিল। ঠিক সেই সময়, বাড়ির দরজায় একটানা টং টং টং করে বেজে উঠল কলিংবেল। চোখ কুঁচকে আশেপাশে তাকাল, কেউ নেই। কয়েকবার দরজার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
— “কে?”
কোনো জবাব এলো না। বরং দরজায় চাপ পড়ার আওয়াজ আরও জোরে হলো। দরজার ছিটকিনি খুলতেই, এক মুহূর্তে সব ওলটপালট হয়ে গেল। হুড়মুড় করে চার-পাঁচজন লোক ভেতরে ঢুকে পড়ল। একজন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “এটাই পুলিশের বাড়ি। এখানেই আছে সব প্রমাণ।”

আরশীনের চোখ বিস্ফারিত। কিছু বলার আগেই একজন ওকে ধাক্কা দিয়ে পাশে সরিয়ে দিল। আরশীন নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল। শরীরটা হালকা হয়ে গেছে আগেই, তার উপর এমন একটা অপ্রত্যাশিত আক্রমণ। গলায় জোর এনে বলল,
— “আপনারা কে? কী চান?”

সামনে দাঁড়ানো লম্বা, গম্ভীর গলার এক ষণ্ডামার্কা লোক চোখ কুঁচকে বলল,
— “পুলিশের কাছে অনেক কিছু আছে। হার্ডড্রাইভ, ডকুমেন্ট, সবই এখানেই আছে, তাই না?”

আরশীন ধরা গলায় উত্তর দিল,
— “এখানে কিচ্ছু পাবেন না। আপনারা ভুল করছেন।”

লোকটা তার দিকে এগিয়ে এলো আর হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল,
— “তুমি কে হে?”
এই বলে এমন জোরে ধাক্কা মারল আরশীনকে যে সে সোজা ছিটকে গিয়ে দরজার চৌকাঠে আছড়ে পড়ল। কপালের পাশে ঘষা খেয়ে এক চিলতে রক্ত বেড়ে উঠল। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল সবকিছু। কোনটা বাস্তব, কোনটা দুঃস্বপ্ন আর বোঝা গেল না।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২৯]
~আফিয়া আফরিন

(সত্তালয়ন)
আদিয়াতের হাতটা বারবার ফোনের স্ক্রিনে গিয়ে থেমে থাকছে। সব শেষ করে এখন একটু মন হালকা করতে আরশীনকে ফোন দিচ্ছিল।
একবার, দুইবার, তারপর ছয়-সাতবার ফোন করল। রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ ধরছে না। হয়ত ঘুমাচ্ছে, ভাবল প্রথমে। তারপর ভাবল, হয়ত ব্যস্ত আছে বা ফোন সাইলেন্টে; উনার তো আবার ফোন সাইলেন্ট রাখার একটা বাজে অভ্যাস আছে।
অফটাইমে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য বিষয়েও ভিডিও কল করে। অথচ আজ, একেবারে নিরুত্তর। আদিয়াত ফোনটা একবার নামিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করল। সে আবার ফোন হাতে নিল এবং আবারও কল দিল। রিং হচ্ছে, অথচ সাড়া নেই। একপ্রকার ছন্নছাড়া বিরক্তি নিয়ে আদিয়াত মেসেজ করল,
— “ফ্রি হলে একটু ফোন দিয়েন, প্লিজ। দরকারের মুহূর্তে বারবার খুঁজেও যখন আপনাকে পাই না, তখন ঠিক কী বলা উচিত বুঝে উঠতে পারি না।”

আদিয়াতের ভালোবাসা প্রদর্শনের নয়, অনুভবের। সে শব্দে জয় করতে চায় না বরং নীরবতার গভীরে একটানা পাশে থাকাকে ভালোবাসা বলে মনে করে। তার ভালোবাসায় নেই নাটক, নেই ঘোষণা, আছে স্থিরতা, আশ্রয়ের মতো এক নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি। আরশীন ঠিক সে মানুষ, যে শব্দের বাইরেও আদিয়াতকে পড়ে ফেলতে পারে। চোখের ভাষা, বিরক্তির ছায়া কিংবা নিঃশ্বাসের ভার সব বুঝে নিতে পারে সে। সে ভালোবাসে না বলে, ভালোবেসে ফেলে। আরশীন তার ভালোবাসার নীরব, অথচ সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ। আদিয়াত যদি জানতো, এই মুহূর্তে তার আরশীন, তার ভালোবাসার মানুষ, প্রিয়তমা স্ত্রী; একা, আতঙ্কিত, দুর্বল শরীর নিয়ে মাটিতে পড়ে আছে… চোখে অজস্র ভয়, বুকে চাপা কান্না তাহলে সে দুনিয়ার যেকোনো কাঁটাতার, যেকোনো সীমান্ত ভেঙে ছুটে আসতো। তারপর হয়ত চোখে-মুখে ছায়া পড়ত তীব্র অপরাধবোধের। নিজেকে দোষ দিত, এই সময়ে পাশে না থাকতে পারার জন্য। ফোনে একটাও উত্তর না পেয়ে, বারবার কল করেও ব্যর্থ হয়ে, সে এক মুহূর্ত দেরি না করে উড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিত। পাসপোর্ট, ফ্লাইট, কাজ সবকিছু হারিয়ে যেত প্রিয় মানুষের নিরাপত্তার কাছে। বাড়ি ফিরে এসে দরজা ঠেলে ঢুকে খুঁজে নিত ওকে, একবার ওকে চোখে চোখে দেখেই নিঃশ্বাস ফেলত। আর যেই ছায়া এই অস্থিরতা তৈরি করেছিল, যেই হাত ওর গায়ে তুলেছিল, যেই ভয় ওর গর্ভে থাকা প্রাণটাকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে তাদের জন্য আদিয়াত আর প্রেমিক স্বামী থাকত না, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত এক অসীম প্রতিজ্ঞার মানুষ। শুধু আসতো না, সে থাকতো। আরশীনের শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিটি তাল রাখত।
.
ধাক্কা লেগে আরশীন যেই পড়ল, তখনই মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু থেমে গেল। তার দৃষ্টির সামনে ছায়াময়, ঝাপসা এক পৃথিবী তৈরি হলো। মাথাটা ঘুরছে, বুকটা ধুকপুক করছে। মেঝের ঠাণ্ডা স্পর্শে হাড়ে কাঁপন ধরছে। অথচ তার চোখ খোলা, সে দেখতে পাচ্ছে… দেখতে পাচ্ছে, কীভাবে কিছু অচেনা, হিংস্র মানুষ তাদের সংসারের ভেতর ঢুকে পড়েছে। একজন আলমারির দরজা খুলে সব জিনিস ছুড়ে ফেলছে, আরেকজন তাক ভেঙে বইপত্র ছিঁড়ে দিচ্ছে, ঘরটা যেন যুদ্ধক্ষেত্র।
মা কোথায়? আশা কোথায়? চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে… ঠিক এমন সময় ওর গায়ে কিছু একটা আছড়ে পড়ল। লোহার কোনো বস্তু, বা কাঠের টুকরো, ব্যথায় চোখ ছলছল করে উঠল। পেটের নিচে যেন কিছু একটা কেঁপে উঠল, ভেতরটা হিম হয়ে গেল। ওর মধ্যে আরেকটা প্রাণ আছে। আর এই আঘাত সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। ভয়ে, যন্ত্রণায়, আশঙ্কায় আরশীনের মুখে শুধু একটাই শব্দ বেরিয়ে এলো,
— “মা… মা…” কঁকিয়ে উঠল, বুক ফেটে কান্না এলো। তবু চিৎকার করে উঠতে পারল না।

ঠিক তখনই ভেসে এলো এক বিকট আতর্চিৎকার,
— “আরে কারা তোমরা? থামো। ওমা…।” শাহানার গলা। আতঙ্কে ছেয়ে যাওয়া, বুক ভেঙে বের হওয়া এক চিৎকার।
আরশীন শোনে, ওর মা এসেছে… এই মুহূর্তে আরশীন শুয়ে আছে নিঃসহায়, একা, চারপাশে আগ্রাসন, বুকের ভেতর চেপে বসেছে অজানা আশঙ্কা, আর মনটাই কেবল চিৎকার করে উঠছে,
— “আমার সন্তানের কিছু যেন না হয়… প্লিজ আল্লাহ, কিছু যেন না হয়।”
ওরা ঠিক কতক্ষণ তাণ্ডব চালাল, কে জানে? মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল কেটে গেছে। প্রতিটা মুহূর্ত একেকটা যুগের মতো ভারি, থেমে থাকা নিঃশ্বাসের মতো দীর্ঘ। শাহানা অথবা আশা কাউকে এক হতে দিল না। আর আরশীন? সে ওইভাবেই পড়ে রইল। উঠে দাঁড়ানোর সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে।
ঘন্টাখানেক কেটে গেছে। ওরা কিছু পেল কিনা, জানা নেই। চারপাশ ধ্বংসস্তূপের মতো, ঘরের প্রতিটি কোণে হিংস্র চিহ্ন রেখে গেছে। কিন্তু এসবের চেয়ে আরশীনের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই ছিল সবচেয়ে নির্মম। শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে টান পড়ছিল, কেউ ভেতর থেকে একে ছিঁড়ে ফেলছে নিঃশব্দে। পেটের নিচে টান, ভার, চাপা ব্যথা প্রথমে সহনীয়, তারপর অসহ্য। আরশীন চুপ করে পড়েছিল, হাত একভাবে পেটের উপর রেখে। চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু কোনো কান্না ছিল না, ছিল নিঃশব্দ আর্তি। কেবল হৃদয়ের ভিতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল, বারবার। শাহানা তখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি কী ঘটছে। তিনি বারবার জিজ্ঞেস করছেন,
— “মা কেমন লাগছে? কোথায় ব্যথা?”
কিন্তু আরশীন কোনো কথা বলছে না। ঠোঁট ফাঁটা, নিঃশব্দ, ফ্যাকাশে মুখ। হঠাৎ এক মুহূর্তে ওর পেটের নিচে তীব্র ব্যথা চিৎকার ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলো,
— “মা!” ওর শরীর জমে গেল, চোখে অন্ধকার নেমে এলো, হাত পেটের উপর রেখে চেপে ধরল,
— “মা… আমার বাচ্চা… মা… আমার ভেতরে কি কিছু হচ্ছে?” আরশীনের কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছে। অল্প না, অনেকটা। মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ছে। শাহানা তখনই বুঝে গেলেন। আশাকে কিছু বলতে হলো না। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে উঠে দাঁড়াতেও দু’বার হোঁচট খেলো। ডাক্তারকে ফোন করলো। ঘরজুড়ে আরশীনের কাঁপা গলা, রক্ত, হাহাকার। আরশীনের দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। শরীরটা এতটাই ভার হয়ে গিয়েছিল যে একটুখানি নড়ার শক্তিও ছিল না। ধরা গলায় ফিসফিস করে বলল,
— “আশা… আদিয়াত… ও বোধহয় ফোন করেছিল, প্লিজ ওকে কিছু জানতে দিস না… আদিয়াত…” চোখের কোনায় জমে থাকা কান্নার ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। তারপর আর কিছু বলার অবকাশ রইল না, নিঃশব্দে জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয়ে গেল সে।

ডাক্তারের ঠান্ডা কণ্ঠে বলা কয়েকটা শব্দ সারা ঘরে ছায়া ফেলে দিল। শাহানা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, চোখেমুখে শোকের ছাপ। তিনি তো বুঝতেই পেরেছিলেন। আরশীন হারিয়েছে তার গর্ভের সেই ছোট্ট প্রাণ, যাকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল, ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। বুকে পাথরের মতো ভার চেপে বসে আছে, তবুও কাঁদার সুযোগ নেই এখন। মেয়েকে বাঁচাতে হবে। শাহানা ব্যথা চেপে ধরে তৎক্ষণাৎ ছুটলেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মেয়ের নিথর হাত ধরে বারবার ফিসফিস করে বলছিলেন,
— “ধৈর্য ধর মা। কিছু হবে না তোর, আমি আছি।”
আরশীনের কোনো সাড়া নেই, আশার চোখে নীরব কান্না ঝরছে।

স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা আরশীনকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। শাহানা আর আশা দ্রুত পেছনে ছুটে এলো। ডাক্তাররা দ্রুত পরীক্ষা শুরু করলেন। নার্সরা ভেতরে-ভেতরে ছুটছে। একজন চিকিৎসক এসে জিজ্ঞেস করলেন,
— “প্রেগন্যান্সি কনফার্ম ছিল? কতো সপ্তাহ চলছিল?”

শাহানা গলা পরিষ্কার করে বললেন,
— “প্রায় আট সপ্তাহের মতো।”

ডাক্তারের মুখ থমথমে,
— “শারীরিক আঘাতের কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু গর্ভপাত হয়েছে, আমরা রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে এনেছি। তবে রোগী এখনও শক-এ আছে। বেশ দুর্বল।”
শাহানা চুপ করে বসে পড়লেন ওয়ার্ডের এক পাশে। আশার চোখ ছলছল করছে। এরইমধ্যে ওর হাতে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো। আরশীনের ফোন, আসার সময় নিয়ে এসেছিল। স্ক্রিনে নামটা জ্বলজ্বল করছিল—“Adiyat Calling” বুকটা ধক করে উঠেছিল আশার। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, আরশীন হাসপাতালের বেডে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে, আর ফোনটা এখন বাজছে ওর স্বামীর। কী বলবে এখন ও? আস্তে করে আশপাশে তাকাল। শাহানা তখন চোখে পানি নিয়ে ডাক্তারের সাথেই কথা বলছেন। আশা একটু দূরে এলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফোন রিসিভ করল,
— “ভাইয়া।”

— “আশা?” আদিয়াত একমুহূর্তে চিনে ফেলল।
— “হ্যাঁ ভাইয়া, আমি।” গলা শুকনো শোনাল আশার।
— “ওহ আচ্ছা, কী খবর? কেমন আছো?”
— “জি, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
— “আমি ঠিক আছি। আরশীন কোথায়?”
এই প্রশ্নেই আশার বুক কেঁপে উঠল। মুহূর্তের জন্য গলা আটকে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিল,
— “ভাইয়া… আসলে আপু তো নাই… মানে বাইরে গেছে।”

— “এই রাতের বেলা? কোথায় গেছে?” প্রশ্নটা ছিল নরম স্বরে, কিন্তু তাতে এক অদ্ভুত শীতল স্পর্শ ছিল।
এইমুহূর্তে সত্যিটা বলা যাবে না। আপু তাকে বলেছিল, আদিয়াত যেন কিছু না জানে। সে শুধু বলল,
— “একটা জরুরি কাজ ছিল ভাইয়া, ফিরলেই কথা বলবে। আপনি চিন্তা কইরেন না…”
ফোনের ওদিকটা চুপচাপ। আদিয়াত কিছু বলবে ভেবেও আবার নিজেকে সামলে নিচ্ছে। আশার গলা কেঁপে উঠছে কিন্তু সে দৃঢ় থাকার চেষ্টা করছে।
আদিয়াতের কণ্ঠে এবার একটু গম্ভীর ভাব। ও জিজ্ঞেস করল,
— “আরশীন একা গেছে?”

আশা চট করে উত্তর দিল,
— “না তো! মায়ের সঙ্গে গেছে মামাবাড়ি। ভাইয়া, আপনি তো জানেন আপুর কী ভুলো মন, ফোনটা ফেলে গেছে। আজকে তো রাত হয়ে গেছে, মনে হয় না আসতে দেবে। কাল সকাল সকাল চলে আসবে। তখন কথা বলবেন। চিন্তা করার কিছু নেই, মায়ের সঙ্গে যেহেতু গেছে।”

একটু থেমে আদিয়াত বলল,
— “ঠিক আছে।”
কথাটা বললেও আদিয়াতের ভেতর একটা হালকা অস্বস্তি বয়ে গেল। ঠিক কোথাও কিছু একটা মিলছে না। আশার গলায় তাড়াহুড়োর ছাপ, কথা বলার ধরনটা অস্বাভাবিক। আদিয়াত বুঝতে পারছিল, কিছু একটা লুকানো হচ্ছে। কিন্তু সন্দেহ করবেই বা কীভাবে? দ্বিধা বা বিশ্বাস-অবিশ্বাস্যের কোনো বিষয় নেই। তবু মনে একধরনের অজানা টানাপোড়েন শুরু হলো। চিন্তা জমে মাথা ভার হয়ে উঠল।
— “কোনো বিপদ হলো না তো?” এই ভাবনাটা একবার মাথায় ঢুকতেই আর বেরোতে চাইল না। “উফফ… এতদূর থেকে ভাবলেও বা কী হবে?”
আদিয়াত বিছানায় গা এলিয়ে দিল, মনটা এলোমেলো রয়ে গেল। আশার কথাগুলো বারবার কানে বাজছিল। মনে হচ্ছিল, অনেক যত্নে সাজানো একরকম নাটকীয় স্বাভাবিকতা।
.
রেজা ফরিদপুরেই অবস্থান করছিল। শহরের প্রান্তে এক পরিত্যক্ত গ্যারেজে বসে ছিল সে, চোখে ঠাণ্ডা এক হিসেবি ঝলক। বাইরে ধুলো উড়ছিল, তার লোকেদের জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশেষে ওরা ফিরে এলো। লন্ডভন্ড অবস্থা, কারো কপালে ঘাম। ওরা জানাল, ভিতরে যা ছিল, সব ওলট-পালট করে ফেলেছে। কিন্তু কিছুই পায় পাই। উল্টো কার যেনো মাথা ফাটিয়ে দিয়ে এসেছে। রেজা ধৈর্য ধরে শুনছিল। মাথা ফাটানোর কথা শুনে দাঁত চেপে বিরক্তিতে ফুঁসল। এই বাড়ি থেকে কিছু পাওয়া যাবে ভেবেছিল। অন্তত প্রমাণ, ছবি, ফাইল, যে কিছু একটা…
কিন্তু না, সব ফাঁকা।
— “কার মাথা?” ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল রেজা।

একজন মুখ চুলকে বলল,
— “বড় মেয়েটার, আরশীন বোধহয় নাম।”

রেজার চোখের কোণে আগুনের মতো কিছু একটা দপ করে উঠল।
— “আরশীন?” কণ্ঠস্বর বিষে টইটম্বুর।
সে এক পা এগিয়ে এলো, যেন নিঃশ্বাসের সাথে সাথে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
— “তোরা আমার সামনে থেকে দূর হ… তোরা কার অনুমতিতে হাত তুললি? আমি কি তোদের বলেছিলাম গিয়ে জানোয়ারের মতো আচরণ করতে?”

কেউ কিছু বলার সাহস করল না। সবাই মাথা নিচু করে চুপ।
শেষে একজন ধীরে বলল,
— “ভাই… রেজা ভাই, আপনি তো বলছিলেন জিনিসপত্র খুঁজে বের করতে। একটু ধাক্কাধাক্কি তো হতেই পারে।”

রেজা দাঁতের ফাঁক দিয়ে চাপা গর্জনের মতো বলল,
— “ধাক্কাধাক্কি? আরে তোরা খুনির মতো হ্যাভিওয়েট খেলতে গেছিস? আমি কী বলেছিলাম?”
কেউই বুঝতে পারেনি রেজার রাগটা এতটা তীব্র কেন? তাদের কাছে তো এটা ছিল একটা “টাস্ক”, একটু গিয়ে চেঁচামেচি, তল্লাশি, ছিটকে ধাক্কা; ব্যস।
লোকগুলো চুপচাপ সরে গেল। আর রেজা পেছন ফিরে দূরে তাকিয়ে রইল… আরশীনের মাথা ফাটানো ঘটনা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে নিজেই ছুটল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আরশীনের একটা খোঁজ নেওয়া উচিত। চেনা এক নার্সের মারফত জানতে পারল, আরশীনের পেটে বাচ্চা ছিল এবং সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। খবরটা শুনে প্রথমে একটা শীতল শ্বাস ফেলল সে। তারপর চোখ বন্ধ করে হাসল। না, আনন্দের হাসি নয় বরং এক ধরণের স্বস্তির। একটা দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেল। কেন খুশি লাগল? আরশীন যদি মা হতো, আদিয়াতের সাথে সেই সম্পর্কটা হয়ে যেত আরও দৃঢ় আরও রক্তমাখা পবিত্র কিছু। আর রেজা? সে চেয়েছিল ভাঙন, অস্থিরতা, একরাশ তিক্ততা। একটা সন্তানের উপস্থিতি সেখানে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। সন্তান মানে আশ্রয়, সন্তান মানে দায়িত্ব, সন্তান মানে শক্ত বাঁধন। আর এই বাঁধনেই রেজার বিপদ।
আর এখন? এইমুহূর্তে সেই বাঁধনটা ছিঁড়ে গেছে। আরশীন বেঁচে আছে, ভালো আছে, এ খবরটা শুনে খানিকটা শান্তি পেয়েছে। কিন্তু সেই অনাগত সন্তানের হারিয়ে যাওয়ায়, এক নির্মম আত্মতৃপ্তি ওর চোখে মুখে ছায়া ফেলল। এখন আরশীন আর আদিয়াতকে আলাদা করা একটু সহজ হবে। একটু কম জটিল হবে খেলাটা।

আরশীনের জ্ঞান ফিরল গভীর রাতে। হালকা আলোয় ভেসে থাকা হাসপাতালের সাদা ছায়াগুলোকে প্রথমে চিনে উঠতে পারল না। চোখ খুলে ধীরে ধীরে যখন চারপাশ বুঝতে পারল, তখন শরীরের সাথে সাথে মনের ভেতরেও একধরনের ভার নেমে এলো। একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে।
তারপর হঠাৎ… তীব্র কিছু মনে পড়ল। পেটের ব্যথাটা, কান্নার শব্দ, বাড়ির ভেতর সেই ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব। এক হাত অজান্তেই গিয়ে পেটে রাখল। হাত রাখতেই শূন্যতা ছুঁয়ে ফেলল। চুপচাপ… নিস্তব্ধ। কোনো নড়াচড়া নেই, কোনো শব্দ নেই। আরশীনের বুক হিম হয়ে গেল। চোখের পাতা ফেলে আবার খুলল।
শুধু ভাবল, — “ও আছে তো? আমার ভেতরে…” মনে পড়ে গেল ডাক্তারদের কণ্ঠস্বরে ভেসে আসা শব্দগুলো, “বাচ্চাটা বাঁচেনি”, “তীব্র ট্রমা”, “অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ”, “আট সপ্তাহ”… একমুহূর্তে দুনিয়াটা থেমে গেল।
আরশীন ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসার চেষ্টা করল, পারল না। বুকের ভেতর কান্না দলা পাকাতে লাগল, কিন্তু গলা দিয়ে কিছুই বেরোচ্ছিল না। ঠোঁট কাঁপে, চোখ ছলছল করে ওঠে তারপর হঠাৎ ঝড়ের মতো ফেটে পড়ল কান্নায়। সে কান্নায় বাচ্চা হারানোর হাহাকার ছিল, নিজের প্রতি রাগ ছিল, অসহায়তা ছিল, এক দহনভরা শোক যা বুকের গভীর থেকে উঠে এসে ভেঙে দিল সমস্ত প্রতিরোধ। নিজের শরীরটাই ওর বিরুদ্ধে চলে গেছে। আদিয়াতকে কীভাবে বলবে? ভিজে ধরা গলায় ও আদিয়াতকে কল্পনা করল।
— “আপনি জানেন না, আমি কীভাবে বাঁচছিলাম ওকে নিয়ে। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে আপনার অনুপস্থিতিকে আমি মেনে নিয়েছিলাম শুধু এই ভেবে যে আপনি ফিরবেন। আর তখন জানবেন আপনি বাবা হতে চলেছেন তখন আপনার চোখে যে আলো জ্বলবে, সেটা আমি দেখতে চাইতাম। আমি অপেক্ষা করছিলাম সেই আলোর জন্য। কিন্তু এখন? আমি খালি। আমার শরীর খালি, আমার বুক খালি, আমার স্বপ্ন খালি। আমি জানি না, কীভাবে এই খবরটা আপনাকে বলব। কীভাবে বলব, আমাদের সন্তানের আর পৃথিবীতে আসা হলো না।
আপনি বলেছিলেন, আমি যদি বলি চলে আসবেন। এইবার যদি বলি, আমি আর পারছি না, আপনি কি ফিরবেন? যদি বলি, আমার বুক ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, আপনি কি জড়িয়ে ধরবেন? আপনি ফিরে আসুন আদিয়াত, আমি একা হয়ে গেছি।”
বুকচিরে বেরিয়ে আসছিল প্রতিটি আহাজারি, নিরবধি, বর্ণনাতীত করুণ প্রতিধ্বনি। শাহানা এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের মতো নয়, একজন মেয়ে হয়ে আরেক মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করলেন। আরশীনের হাত দুটো মায়ের কাপড় আঁকড়ে ধরল। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলছিল,
— “আমার বাচ্চা… মা, আমি ধরে রাখতে পারলাম না। সবাই এইভাবে আমায় ছেড়ে চলে যায়।”

শাহানা নিজের কান্না গিলে বললেন,
— “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন মা, সবই তাঁর ইচ্ছা। তুই ভেঙে পড়িস না। আদিয়াত আসবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আদিয়াতের কথাটা ওষুধের মতো কাজ করল বোধহয়, আরশীনের বুকফাটা আহাজারির মাঝে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস শোনা গেল। সে একটু থেমে কষ্টটাকে গিলে ফেলতে চাইল…

সকালটা পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। হালকা রোদের আভা ছড়িয়ে পড়ছে হাসপাতালের করিডোরে। ঠিক তখনই আযহান এসে হাজির হলো। প্রথমে সে গিয়েছিল বাড়িতে। লোকমুখে গতরাতের ঘটনা শুনে সরাসরি হাসপাতাল চলে এসেছে। এখানে এসে জানতে পারল, আরশীনের মাথায় লেগেছে, হাসপাতালে আনতে হয়েছে। এখন ও এখানেই আছে।
আযহানের উপস্থিতটা আকস্মিক ছিল। সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি পরখ করে নিজেই বলে দিল,
— “ভাইয়া পাঠিয়েছে। খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল। ফোনে ভাবির খোঁজ পাচ্ছিল না। আমাকে বলল একবার গিয়ে দেখে আসিস, কেমন আছে সবাই। মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।”
আযহানকে ঘটনার একাংশ জানানো হয়েছে মাত্র। আরশীন ওকে দেখে অবাক হলো। আরও বেশি অবাক হলো তখন যখন শুনল, আদিয়াত পাঠিয়েছে। ও ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। যাকে কিছুই জানানো হয়নি, যে কিছুই জানে না, সে ঠিকই বুঝে গেছে কিছু একটা হয়েছে। আর তাও এতটা দূর থেকে? মনে হলো আদিয়াত হাসপাতালের দরজার ওপারে, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ওর বুকের সব কষ্ট অনুভব করছে।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩০]
~আফিয়া আফরিন

(আত্মঘাতী আকাঙ্ক্ষা)
আযহানের মাধ্যমে আদিয়াত আরশীনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবরটা জানতে পারল। একটা ধাক্কা বুকের ভেতরটা চাপা দিয়ে ফেলল। এত কিছু হয়ে গেল অথচ তাকে জানানো হয়নি। কেউ প্রয়োজন মনে করেনি। উল্টো মিথ্যে কথা বলেছে, সেটাও নাকি আরশীনের বলে দেওয়া। তবে কি আরশীন তাকে অবিশ্বাস করে? এমন না যে ও আরশীনকে দোষ দিচ্ছে বরং মাথার ভেতর বারবার ঘুরে ফিরে আসছে একটা প্রশ্ন, আপন হতে গেলে আসলে কতটুকু কী লাগে? ঠিক কী করলে মানুষের আপন হওয়া যায়। দূর দেশে চলে এসেছে বলে কি দূরের মানুষ হয়ে গেছে? ভালোবাসার গভীরতার একটা শিকড় থাকে, সেখানে অন্ধ আস্থা জন্মায়। এইমুহূর্তে সেই শিকড়ে সামান্য একটা প্রশ্ন এসে দাঁড়াল। আর সেই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নিল অভিমান।
আরশীনের হয়তো এই মুহূর্তে আদিয়াতকে দরকার। হয়তো একটা ফোন, একটুখানি ভরসা… কিন্তু আদিয়াত ফোন করল না। হাতের কাছে ফোনটা থাকলেও, বারবার নামটা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। রাগে না, অভিমানে না, একধরনের ক্লান্তিতে। ভালবাসা দিতে গিয়ে, বোঝাতে বোঝাতে হঠাৎ করে নিজের ভেতরটা ফাঁকা লাগছিল। এ বেলায় বরং একটু স্বার্থপর হওয়া যাক! তবে আদিয়াত একদম উদাসীন নয়। উপর উপর এই স্বার্থপরতা দেখালেও ভিতর থেকে তা পারে নাই। আযহানকে বলে রেখেছিল, আরশীনের খেয়াল রাখতে। যেহেতু বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই তাই ওই যেকোনো প্রয়োজনে যেনো আযহান উপস্থিত থাকে।

আরশীন কিছুতেই চাচ্ছিল না আদিয়াতের মুখোমুখি হতে। কণ্ঠস্বরের ওপর নিজের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিছু বললেই কান্না ভেঙে পড়বে। আর আদিয়াত সেই কান্নার কোনো ব্যাখ্যা চাইলে, কোনো প্রশ্ন করলে, তা আরশীন সহ্য করতে পারবে না। তাই নিজে ফোন করল না।আসলে ও চাচ্ছিল না যে আদিয়াত তাকে দুর্বল, ভাঙা দেখে ফেলুক।
চাচ্ছিল না, ভালোবাসার মানুষটার সামনে এই ভঙ্গুর চেহারাটা মেলে ধরতে।
অথচ আজ, তাদের দু’জনের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। স্মরণীয় হওয়ার কথা ছিল। এক বছর আগে এইদিনেই তো তারা একে অপরের সঙ্গী হয়েছিল। কিন্তু আজ? একজন অভিমান চেপে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, আরেকজন নিজের কষ্ট লুকাতে মুখ লুকিয়ে রেখেছে।
ভালোবাসা আছে, কিন্তু পাশে নেই। ভালোবাসার জন্মদিনে ভালোবাসার মানুষটাই অনুপস্থিত, এই শূন্যতা কখনো কোনো শব্দে বোঝানো যায় না।

আরশীন ফিরে এলো ঘরে। ঘরের কোনোকিছুই ঠিক করা হয় নাই। দেয়ালে দাগ, মেঝেতে ভাঙা গ্লাসের চিহ্ন, পর্দার ভাঁজে ভয়, চোখ বুলিয়ে নিতে না নিতেই ব্যথাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। পেটের দিকটা ধরফর করল, হাতটা আপনাতেই গিয়ে পড়ল ওখানে। আযহান পাশে ছিল, অবাক দৃষ্টিতে তান্ডব দেখছিল। আশা আরশীনকে নিজের ঘরে রেখে এসে কাজে হাত লাগাল। ভাঙচুর যতটুকু সামলানো যায়, সেটা গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল। আযহানকে একপাশে পেয়ে আশা বলল,
— “দেখো এমন সময় তুমি এলে, আমাদের কী অবস্থা! ঠিকঠাক মতো তোমার যত্নআত্তি করতেও পারছি না।”

আযহান মাথা নেড়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
— “সমস্যা নেই আপু। আপনারা এই দিকটা দেখেন। যদি আমাকে সত্যিই নিজের মানুষ ভাবেন, তাহলে চিন্তা করতে হবে না। আমি আছি। তবে একটা কথা, হঠাৎ এভাবে আক্রমণ করল কেন? আপনাদের সাথে কি কারো পুরনো কোনো বিরোধ ছিল?”

আশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জমে থাকা গোপন ক্লান্তি বেরিয়ে এলো শব্দহীনভাবে। মৃদু কণ্ঠে বলল,
— “সমস্যাটা আসলে বাবার সাথে ছিল। বাবা তো চলে গেলেন, এখন আমরা তার জায়গা নিয়েছি।”

আযহান গলার স্বর একটু নিচু করে জিজ্ঞেস করল,
— “কি শত্রুতা ছিল আঙ্কেলের সাথে? কী এমন হলো যে এতদূর গড়াল?”
— “তা তো আমরা সঠিক জানি না। বাবা এসব বিষয়ে আমাদের খুব বেশি কিছু জানাতেন না। তবে ওরা কিছু একটা খুঁজছে। এমন কিছু, যা হয়তো বাবার কাছে প্রমাণ হিসেবে ছিল যেটা ওদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই খোঁজে ওরা পাগলের মতো আচরণ করছে। আমাদের ঘর, আমাদের জীবন সবকিছু তছনছ করে ফেলছে। বাবা তো নেই, এখন আমাদের রক্ষা করার কেউও নেই।”
— “তাহলে তো আপনাদের এখানে থাকাটা একদমই নিরাপদ নয়।”

আশা মাথা নিচু করে বলল,
— “মেনে নিতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চয়তা। কিছু বুঝে উঠার আগেই যেন সব ভেঙে পড়ছে। আচ্ছা, ভাইয়া কবে আসবে?”

আযহান জবাব দিল,
— “কাজ শেষ। আগামীকাল ফ্লাইট।”
— “ভালো। আমি আপুর সাথে কথা বলি। ওকে নিয়ে যাও তুমি। ওর এখন ভাইয়ার কাছেই থাকা দরকার। আমি আর মা দু’জনেই মামাবাড়ি যাব কয়েকদিনের জন্য। মাথা আর কাজ করছে না। মাকে নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে, একেবারে ভেঙে পড়েছে। চোখের পানি তো থামে না আর কথা বললে কেবল বাবার কথা উঠে। আর আপু, ওকে তো তুমি দেখতেই পাচ্ছো।”
আযহান হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
— “ভাবি হঠাৎ এতটা শকড হল কিভাবে?”

আশা অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল,
— “কী জানি…”
ঢাকা ফিরে যাওয়ার কথা শুনে আরশীনের মন অস্থির হয়ে উঠল। মা আর আশাকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়া কি ঠিক হবে? তবে সবাই একসুরে আশ্বস্ত করল, তারা নিজেদের খেয়াল রাখবে। এই বাড়ি থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে থাকবে, বিপদ কেটে গেলে তবেই ফিরবে।
চাচাও বললেন,
— “আমি ওদের নিজে পোঁছে দিয়ে আসব, চিন্তার কিছু নেই।”
এই আশ্বাসে আরশীন একটু স্বস্তি পেল। সে মনের লাগাম টেনে শক্ত হতে চাইল। এইমুহূর্তে ওরও পুনর্গঠনের দরকার, এত ভেঙ্গে পড়া আরশীনকে দেখলে আদিয়াত কী বলবে?
বিকেলের দিকেই ব্যাগ গোছালো। চাচাকে মা-বোনকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে, মনকে শক্ত করে আযহানের সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। চোখের পেছনে অশ্রুভেজা দু’টি মুখ রেখে, সে পাড়ি জমাল তার নিজের ঘরে, নিজের সংসারে।

আরশীনের শরীর ছিল ক্লান্ত। কিছুদিন আগে যখন সে বাবার বাড়ি এসেছিল, তখনো শরীরে একটা প্রাণের নীরব অস্তিত্ব ছিল, যার কথা সে জানত না। আজ সে ফিরছে স্বামীর বাড়ি, সেই একই পথ ধরে। কিন্তু এবার বুকের ভেতরের জায়গাটা একেবারে খালি। শরীরে আর কোনো নীরব স্পন্দন নেই। সবার কাছে সবকিছু আগের মতো হয়তো, কিন্তু আরশীনের কাছে কিছুই আর আগের মতো নয়।

বাড়িতে পা রাখতেই চারদিক থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। নাজনীন, আলিয়া ছুটে এলো আরশীনের কাছে। ওর মাথা ফাটার খবর আগেই শুনেছে। কপালে ব্যান্ডেজ দেখে কত চিন্তা তাদের। তবে যদি ওরা জানতো, এই ব্যান্ডেজের নিচে মাথার ক্ষতটার থেকেও বড় ক্ষত সে বুকে নিয়ে ফিরেছে। যদি বুঝতো, এই নির্বাক মুখের আড়ালে লুকানো আছে জীবনের সবচেয়ে বড় হারানোর যন্ত্রণা। তখন কি ওরা কেবল মাথা ছুঁয়ে দেখত? নাকি বুক ছুঁয়ে কান্না করত?

আরশীনের ভেতর একটা হাহাকারের মতো ভাব চলে এসেছে। চারপাশে মানুষ আছে, পরিচিত মুখ, পরিচিত কণ্ঠ, তবুও কোথাও এক ফোঁটা আশ্বাস নেই। ২৪ ঘন্টায় ২৪ বারেরও বেশি নিজেকে সামলাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু একটুখানি স্বস্তি পেয়েছিল তখন, যখন শুনেছিল মা আর আশা ঠিকঠাক মামাবাড়ি পৌঁছে গেছে। নিজের মনে আবোল-তাবোল ভাবনার মাঝেই আলিয়া এসে হাজির হলো। হাতে দু’কাপ কফি, মুখে হাসি।
— “গতকাল তো গেল তোমাদের এক বছরের বিবাহবার্ষিকী! বলো দেখি, ভাইয়ের সাথে কী কী প্ল্যান ছিল? ভাই কি কিছু উপহার দিল? নাকি উপহার তোলা থাকলো আজকের জন্য? আজ তো আসছে।”

আরশীন ম্লান হেসে বলল,
— “মনেই ছিল না আমার…”

আলিয়ার চোখ বড় হয়ে গেল। অবিশ্বাস মাখা স্বরে বলল,
— “মেয়ে বলে কী? আমাকে বলবে না, সেটা আলাদা কথা কিন্তু মনে ছিল না বলছো? এটা একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না?”
— “না আপু। কথাই হয়নি ওর সাথে। একটা ফোনও করল না আমাকে।”

আলিয়া একটু গম্ভীর হলো,
— “রাগারাগি হয়েছে বুঝি?”
— “উঁহু… মনে হয় আমার উপর অভিমান করেছে। ফ্লাইটে উঠার আগেও একটা ফোন দিল না। অথচ তোমাদের সবার সাথে কথা হয়েছে, আমাকেই এড়িয়ে গেল। হয়তো আমি ওর জন্য এখন অপ্রয়োজনীয়, হয়তো আমার জন্য সময় নেই।”

আলিয়া ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখল। মুখটা নরম করে বলল,
— “আরশীন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমনই। ভালোবাসার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মান-অভিমান। একটু দূরত্ব হলে তাতে সম্পর্ক ভাঙে না বরং বোঝার সুযোগ তৈরি হয়।”

আলিয়ার আশ্বস্ত করা কথাগুলো শুনে আরশীন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
— “মাঝে মাঝে মনে হয় ওর চুপ করে থাকা মানেই রাগ, আবার কখনো মনে হয় অভিমান। আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারি না, ঠিক কোথায় কী ভুল হয়ে গেল। ও যদি একবার জিজ্ঞেস করত, কেমন আছি… তাহলে হয়তো আমি কেঁদে ফেলতাম। আমার মনে হচ্ছে, আমি আর শক্ত থাকতে পারছি না। কিন্তু ওর সামনে দুর্বলও হতে চাই না।”

আলিয়া ওর হাত চেপে ধরে বলল,
— “নিজের মানুষের কাছে দুর্বল হওয়া কিন্তু লজ্জার বিষয় নয়। সম্পর্ক মানে কি সবসময় শক্ত থাকা? কখনো কখনো কাঁদাও দরকার হয়, কাঁধে মাথা রেখে হালকা হবারও দরকার হয়।”
আলিয়ার কথার সত্যতা আরশীন নিজেও জানে। আদিয়াত এলেই বোধহয় তার দুঃখ ঘুঁচবে। এই ভার একা বইতে পারছে না। অর্ধেক ভার তার কাঁধে রেখে নিজে একটু হালকা হবে। এভাবে থাকলে পাগল হতে বেশি সময় লাগবে না। আরশীন ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সময় থেমে আছে, একটুও এগোচ্ছে না। আদিয়াতের আসতে এখনও কত দেরি। সে জানে, দরজায় কড়া নাড়া অবধারিত। তবুও এই মাঝখানের সময়টুকু পার করাটা সবচেয়ে কষ্টের।
.
আদিয়াত ঠিক রাত এগারোটার দিকে ল্যান্ড করল। আশেপাশে তাকাল। তার পড়নে ছিল ধবধবে সাদা শার্ট ইস্ত্রি করা, একটুও ভাঁজ নেই। শার্টের হাতাগুলো কনুইয়ে গুটিয়ে তোলা, ক্লাসিক ঘড়ি ঠেকছিল কব্জিতে। গলার উপরের খোলা বোতাম আর ছাঁটা চুলে একরকম পরিণত সৌন্দর্য ছড়াচ্ছিল। কোটটা গায়ে না দিয়ে হাতে ঝুলিয়ে রেখেছিল। চোখেমুখে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি থাকলেও সেই চিরচেনা গাম্ভীর্য ও সংযম ঠিকই ছিল। এয়ারপোর্টে আদিয়াতের জন্য ছিল আযহান আর তাদের পুরোনো ড্রাইভার কাশেম চাচা। আযহান যথারীতি আগে থেকেই পৌঁছে গিয়েছিল। রাতের এয়ারপোর্ট অপেক্ষাকৃত শান্ত, আলো-আঁধারির মাঝখানে ঝিম ধরা নীরবতা। কেউ প্রিয়জনকে খুঁজছে, কেউ নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে আপন গন্তব্যে। আদিয়াত এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিল,
— “আমি এখনই বাড়ি ফিরব না।”

আযহান একটু অবাক হয়ে বলল,
— “মানে কি? ভাইয়া, আমরা তো তোমাকে নিতে এসেছি। বাবাও আসতে চেয়েছিল, তবে রাত হওয়ায় তাকে বুঝিয়ে রেখে এসেছি।”
— “ফিরে যা। আমার জরুরি কিছু কাজ আছে।”

আযহান একটু হাসি মিশিয়ে বলল,
— “আবার কাজের কথা? ভাবি যদি শোনে, নিশ্চয়ই তোমার মাথা ফাটাবে।”

হঠাৎ মনে পড়লো এমন ভঙ্গিতে আদিয়াত বলল,
— “ভালো কথা, ম্যাডাম এলেন না?”
— “তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।” আযহান জানালো।

আদিয়াত নিরব চোখে উত্তর দিল,
— “অপেক্ষা করুক… আমি আজ বাড়ি ফিরব না। কবে ফিরব সেটাও ঠিক বলতে পারছি না। বাড়ি গিয়ে বলে দিস যারা অপেক্ষায় আছে, তাদের অপেক্ষা করতে হবে না।”

আযহান একটা তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,
— “এই রাতের বেলা কি ছেলেমানুষি শুরু করলে, ভাইয়া? মা শুনলে তো রাগারাগি করবে। যা কাজ আছে সব বাসায় গিয়ে করো। আমার উপর প্রত্যেকবার সব গুরুচন্ডালী মার্কা দায়িত্ব পড়ে।”

আদিয়াত হাসি দিয়ে আযহানের কাঁধে হাত রেখে বলল,
— “সরি ব্রাদার, আরেকবার তোমাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
আযহান ভেবেছিল, ভাইকে জোরাজুরি করলে হয়তো সে যেতে রাজি হবে। কিন্তু আদিয়াত নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। ওদের বিদায় করে দিয়ে নিজের রাস্তা দেখল। পরিকল্পনা করেই এসেছিল, সহজে সে বাড়ি ফিরবে না। যদিও মন উথাল-পাথাল করছিল কিন্তু যতক্ষণ না আরশীনের বিশ্বাস পুরোপুরি স্থাপন হবে ততক্ষণ সে ফিরবে না। এখন দেখার বিষয়, সে বিশ্বাস কবে স্থাপন হয়। আদিয়াত একটা হোটেলে উঠল। আরশীনকে ফোন করতে চেয়েও করল না বরং ওর ফোনকলের অপেক্ষায় রইল।

বাড়ি ফিরে আযহানের মুখে বিস্তারিত শুনে জহিরুল ইসলাম কপাল চাপড়ালেন। নাজনীন ভয়ংকর রেগে গেল। আরশীন নির্বিকার, ঘরে ফিরে এলো। কষ্টের মুহূর্তে সবাই কষ্ট দেয়, কেউ বোঝে না। ফোন হাতে নিয়ে আদিয়াতের নাম্বারে ডায়াল করল। কিন্তু আদিয়াত ফোন কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠালো,
— “কথা বলতে পারবোনা, ব্যস্ত আছি। বলুন?”
এসব ব্যস্ততার ধার আরশীন ধারে না, ভিডিও কল করলো। আদিয়াত আবার ফোন কেটে মেসেজ করল,
— “বললাম তো, ব্যস্ত।”

আরশীন একগাল গম্ভীর হয়ে লিখল,
— “আপনি কাকে ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন? আমাকে? আমি জানতে চাই, দেখতে চাই এই মুহূর্তে কার সঙ্গে রয়েছেন আপনি। বাড়ি ফিরলেন না কেন?”
— “সন্দেহ হচ্ছে?”

সন্দেহ চোখে ফুটে উঠলো,
— “পুরুষ মানুষ আপনি, ধোঁয়া তুলসী পাতা নন যে আপনাকে সন্দেহের বাহিরে রাখব। ফোন রিসিভ করুন।”
— “না।”
— “কেন?”
— “বললাম তো, ব্যস্ত আছি।”
— “অজুহাত দিচ্ছেন? কে আছে আপনার সঙ্গে? সিঙ্গাপুর গিয়ে নতুন কাউকে জুটিয়েছেন? কোথায় আছেন বলুন আমাকে।”

আদিয়াত মনে মনে হাসি আটকাল। ইচ্ছে করেই মেসেজ করল,
— “নারীসঙ্গের প্রয়োজনে এসেছি।”

আরশীন রাগে ফুঁসে উঠল,
— “নারীসঙ্গের প্রয়োজন? তাহলে আমি কি পুতুল?”
— “হুম, পুতুল’ই। আমার আসলে মানুষ দরকার ছিল।”

আরশীন আর্টফুল ভাবে জবাব দিল,
— “তাহলে কি আমি এইবার এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব?”
— “আপনাকে যেতে হবে কেন? আপনার শ্বশুরবাড়ি, আপনি থাকুন। আমি তো আর ফিরছি না।”
— “নতুন সংসার পেতেছেন?” আরশীনের প্রশ্ন।
— “কষ্ট হচ্ছে?”

আরশীন দীর্ঘশ্বাস চেপে লিখল,
— “হুহ। এক জীবনে যা কষ্ট পেলাম, তার কাছে এসব কিছুই না।”
— “তাই?”

আরশীন ছোটো করে লিখল,
— “হুম। আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা।”

আদিয়াত একটু ঠাট্টা মিশিয়ে জবাব দিল,
— “বাহ, কত ভালো বউ। এমন বউ কোথায় পাওয়া যায়?”
— “আপনার তো আছেই।”

আদিয়াত আবার চালিয়ে গেল,
— “সন্ধানে আরো আছে নাকি? থাকলে বন্ধুদের বিলাতাম আর কী।” আদিয়াতের মেসেজ পড়ে আরশীনের রাগের সীমা ছাড়িয়ে গেল। মনে হলো, এই হাসি-ঠাট্টার আড়ালে আদিয়াত বোধহয় ওর যন্ত্রণাকে ছোট করে দেখছে। একটু থেমে আরশীন বাধ্য হয়ে নিজের ভেতরের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল কিন্তু চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। সে ফোনটা আছাড় মেরে ফেলে দিল মেঝেতে। ফোনটা ভেঙ্গে গেল। আদিয়াত সামনে থাকলে বোধহয় এলোপাথাড়ি মাইর খেত আজকে!

আদিয়াত নিজেকে গোপন রেখেছিল। শেষ মেসেজের পর থেকে আর কোনো কল করেনি। আরশীন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দুইদিন পার করে দিয়েছে তার অপেক্ষায়। অবশেষে সেদিন আদিয়াত অফিসে এসে পৌঁছলো, আরশীনের কানে খবর পৌঁছতেই সে আর অপেক্ষা করতে পারল না। দ্বিধাহীনভাবে সোজা অফিসে এসে কেবিনের দিকে চলে এলো। দরজা খুলেই ভিতরে প্রবেশ করে। কে আছে, কে নেই তার পরোয়া করল না। একদম সামনে গিয়েই আদিয়াতকে জড়িয়ে ধরল, আদিয়াত কিছু বুঝে উঠার আগেই।
দু’জন কেবিনে উপস্থিত ছিলেন, তাদের জন্য এই আচরণ একদম অপ্রস্তুত ছিল। তারা চুপচাপ সরে দাঁড়ালেন, কোনো শব্দ না করেই সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আরশীন ও আদিয়াত একা হয়ে গিয়েছিল। আদিয়াত কিছুটা অবাক, এক ধরনের ঘোরে। এতদিন পর ওর স্পর্শ পেয়ে, মন একটু নরম হল। আরশীন ধীরে ধীরে ওর বুকে মুখ ঘষে বলল,
— “আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন না, প্লিজ।” সেই অসীম আবদারে আদিয়াতের রাগ আর অভিমান কোথায় গিয়েছিল, কে জানে? সব মুছে গিয়েছিল একমুহূর্তেই। আদিয়াত আরশীনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আরশীন নিরব কান্নায় ওর শার্ট ভিজিয়ে দিল। কপালের ব্যান্ডেজের ওপর আদিয়াত আলতো করে চুমু দিল। আরশীন হঠাৎ ওর বুকে ধাক্কা মেরে বলল,
— “এত দরদ দেখাতে হবে না। স্বার্থপর কোথাকার?”

আদিয়াত মৃদু স্বরে ফিরল,
— “আপনিই তো আমাকে বাধ্য করেছেন।”
— “আমার দোষ তাই না? উফফ বারবার ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? জড়িয়ে ধরতে ভালো লাগছে না?”
কথায় কথায় কখন যেন ওর হাত আলগা হয়ে গিয়েছিল। সে এক হাত আরশীনের কোমরে রাখল, আরেকহাতে ওর গাল ছুঁয়ে দিল আলতো করে।
অথচ আরশীনের দু্ঃখ প্রকাশ করার কথা ছিল। যেই মুহূর্তে আদিয়াতের বুকের উপর মাথা রাখল, সবকিছু কেমন ফিকে হয়ে গেল। ওর বুকের ধ্বংসস্তূপের মতো ভারী যন্ত্রণাগুলো একনিমিষে হালকা হয়ে গেল। কীসের দুঃখ? কীসের অভিমান? যার বুক এমন শান্ত, যার স্পর্শে এত স্বস্তি; তার কাছে দুঃখ সাজে না কোনোভাবেই। ওর জীবনে এখন শুধু আদিয়াত আছে। আর আদিয়াত মানেই সুখ, তৃষ্ণার অতল স্রোত, চাহনির অতল দাবি, বিষণ্ণ প্রয়াসের নীড়!
.
.
.
চলবে….