#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩৪]
~আফিয়া আফরিন
(বিপরীত ধারা)
ঘরটা নিঃস্তব্ধ। শুধু দেয়ালের ঘড়ির টিকটিক শব্দটা কানে আসছিল। আরশীন ওভাবেই বসে ছিল। নড়ল না, উঠল না, চোখের জলও গড়াল না। মাথার ভেতর তখন চলছিল হাজারটা ভাবনা, অথচ কোনোটাই পরিষ্কার না। আজকের এই কথোপকথন, আদিয়াতের ঠান্ডা কণ্ঠের কঠিন কথা সব তাকে চুরমার করে দিয়েছে। ওর মনে হচ্ছিল, আজ যদি সময়টা একটুখানি পেছনে নিতে পারত! যদি একটু সাহস করে বলেই দিত, তাহলে কি আদিয়াত ওর চোখে এভাবে অবিশ্বাস মিশিয়ে তাকাত? যদি আগেভাগেই জানাত তাকে, তাহলে হয়ত এই চরম দুরত্বটা তৈরি হতো না। আরশীন মনে মনে স্বীকার করল, ও একটা মস্ত বড় ভুল করেছে। গভীর ভুল। আদিয়াতকে জানালে ওর পাশে থাকত, সুরক্ষার মতো আগলে রাখত, যতটা পারত বুঝে নিত, কষ্টটা ভাগ করে নিত। আর এখন? ভুল বুঝে চলে গেল। আরশীন তো সত্যিটা বলতে পারে নাই নিজের অপারগতার কারণে। একটা ভয় ছিল, একটা দ্বিধা ছিল; যেখানে নিজে মেনে নিতে পারছিল না, নিজের কাছে নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল সেখানে আদিয়াতকে কি বলতো? কীভাবে বলতো? সাহস ছিল না আরশীনের। সে নিজে কীভাবে এই সত্যের মুখোমুখি হয়েছে, তা আদিয়াত জানে? জানে না, বোঝে না। কিংবা ও নিজেই বোঝাতে পারেনি ঠিকভাবে। আর তাই তো, ভুল সময়ে চুপ করে থাকার খেসারত দিতে হচ্ছে।
বাইরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল হঠাৎ। আরশীনের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। সে চমকে তাকাল ঘড়ির দিকে। অনেক রাত। ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাল। কোনো মেসেজ? কোনো কল? না, কিছুই না। নিচ থেকে দরজা খুলে যাওয়ার মৃদু আওয়াজ ভেসে আসতেই আরশীনের বুক ধক করে উঠল। আদিয়াত এসেছে? এই ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে হবে। দরকার হলে আরশীন সব দোষের দায়ভার নিজের উপর নিয়ে নিবে। সে প্রায় ছুটেই চলে গেল সিঁড়ির ধারে। কিন্তু নিচে চোখ পড়তেই আশাভঙ্গের হালকা একটা ঢেউ বুকের ভেতর ধাক্কা দিল। আদিয়াত নয়, মা আর আলিয়া ঘরে ঢুকছে। আলিয়া ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
— “ভাই কোথায় গো? একা একা বোর হচ্ছিলে?” তারপর কাঁধের ব্যাগ নামাতে নামাতে আবার বলল, “দাঁড়াও, ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আরশীন কিছুই বলল না। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি এনে মাথা নাড়ল শুধু। অথচ এই মানুষগুলো তার সমস্ত সত্যি জানে। একবারের জন্য বুঝতে দেয় নাই। ক্ষতটা জাগিয়ে দিতে কোনো কড়া কথা অব্দি বলে নাই। এখনো এমন ভাব করে রয়েছে যে, তারা কিছুই জানে না। এই মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও তো কম হবে।
আলিয়া ঘরে ঢুকতেই আরশীন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যথা ছাপিয়ে গেল প্রতিরোধের সব সীমা। সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে কান্নাটাও উঠতে লাগল হেঁচকি তুলে, বুকের ভেতর থেকে কেমন একটা ঝড় বেরিয়ে আসছে। আলিয়া ওর পাশে গিয়ে বসল। কথা বলল না, কান্না থামানোর চেষ্টা করল না একবারও। হয়তো সে বুঝতে পারছে ঘটনার মূল উৎস। এই কান্না এখন প্রয়োজন, এই কান্নাটুকু ওর মুক্তির পথ। তাই কাঁদতে দিল মন ভরে। আরশীনের কান্নার গতি একটু কমলে আলিয়া ধীরে, খুব মোলায়েম গলায় বলল,
— “আমার ভাইটাকে কি এখনও চিনতে পারো নাই তুমি, আরশীন? ও যাকে নিজের মানুষ ভাবে, তাকে সারা জীবনের জন্য ভাবে। সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, বিশ্বাস করে। মিথ্যা কথা, বিশ্বাসঘাতকতা এইসব শব্দ ওর অভিধানেই নেই। ও এইগুলো বলেও না কারো বলা পছন্দ করেনা। আদিয়াত কাউকে নিজের ভাবলে, সে তার সবটা ভাগ করে নিতে চায়। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান, সব। তুমি যদি কিছু চেপে যাও, না বলো তাহলে ওর কাছে সেটা বিশ্বাস ভাঙার মতোই শোনাবে। ভাই হয়তো ভাবতে পারে, এতদিনের সম্পর্কে সে নিজের প্রতি বিশ্বাসটা তোমার মনে স্থাপন করতে পারল না। এটা কত বড় ব্যর্থতা জানো? ও তোমায় ভালোবাসে আরশীন, ভীষণভাবে ভালোবাসে। তবে কেনো এমন করলে, বলো?”
আলিয়ার কণ্ঠে ছিল না কোনো অভিযোগ, ছিল না কোনো দোষারোপ, শুধু একটা মমতাভরা প্রশ্ন। আরশীনের চোখ দিয়ে আবারো একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মনে হতে লাগল, হ্যাঁ… সে ভুল করেছে, ভীষণ ভুল। ওর কণ্ঠে কেমন একটা ফাটল ধরে এলো,
— “আমি কি করতাম বলো? ওই মুহূর্তটা আমার জন্য সহজ ছিল না। আমি হিমশিম খাচ্ছিলাম নিজের সাথেই। একটা কথা মুখে আনার আগেই বুকটা কেমন ভার হয়ে যাচ্ছিল। আমি জানতাম, আদিয়াতকে বলতে হবে… বলতেই হবে। কিন্তু কীভাবে বলব, কোন ভাষায় বলব, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি ভেবেছিলাম, আজ না। কাল বলব। আরেকটু সাহস জমাই। ভাবছিলাম, আদিয়াত যখন পাশে বসবে, তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলব সব। আমি নিজের ভেতর ঠিক করে রেখেছিলাম কথাগুলো। যখন ও ছিল না আর আমি ওই খবরটা জানতে পেরেছিলাম তখন অজান্তে কত কিছু ভেবে ফেলেছিলাম। আমার জীবনেও তো প্রথম ওমন একটা মুহূর্ত এলো, যা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। ‘আমি মা হতে চলেছি’, এই চারটা শব্দ সরাসরি বলতে চেয়েছিলাম আপু। কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে গেল চোখের সামনে। আর আজ আদিয়াত কী করল? ও তো আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারত। তাহলে এবার কী হলো? ও কি সব দোষ আমার দিল?
কথাটা গোপন করার কারণে ও এমনভাবে চলে যাবে?” আরশীনের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
আলিয়া চোখ মুছিয়ে আরশীনকে বুকে জড়িয়ে নিলো। চুপচাপ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— “আরে পাগলি, ভাই কোথায় যাবে তোমাকে ছেড়ে? আমরা যখন মাঝরাস্তায় ছিলাম, তখনই ফোন দিলো। বলল, তোমার সাথে একটু রাগারাগি হয়ে গেছে। যেন তাড়াতাড়ি গিয়ে তোমাকে সামলে দিই। এইসব কি বলে কেউ, যদি মনের ভেতর ভালোবাসা না থাকে? ভালো না বাসলে কেউ কি এত খোঁজ রাখে? এভাবে দূর থেকেও পাশে থাকার চেষ্টা করে? ও তো নিজের অভিমান লুকিয়ে রেখেছিল, যাতে তোমার ওপর না যায় কিছু। আর তুমি ভাবছো, ও তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? না রে, ওর তো সবটাই তুমি। আমার ভাইয়ের সাধ্য নেই তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারার। এটা বুঝো না বোকা মেয়ে?”
আলিয়ার কথাগুলো শুনে শান্ত হয়ে আসে আরশীন। বুক ভরা কান্না একটু একটু করে জমাট বাঁধা বরফের মতো গলে গেল। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু মোছার আগেই ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল।
আলিয়া জানাল, আদিয়াত রাতে ওর এক বন্ধুর বাড়িতে থাকবে বলেছে। একটু রাগারাগি হলে ও নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ওরও তো মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল। তাই একটু দূরে গিয়ে মাথা ঠান্ডা করছে। সকালে ফিরে আসবে, বলে দিয়েছে।
আরশীন তখন কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ মাথা নাড়ল। ভিতরে ভিতরে একরাশ স্বস্তি এসে ভর করল। হঠাৎ করে সমস্ত অন্ধকারের মাঝে একটা আলো জ্বলে ওঠার মত। আদিয়াত তাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেয় নাই, এটুকুই তার জন্য সবচেয়ে বড় আশ্বাস।
আলিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো ফিরে তাকাল। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি টেনে আলিয়া দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল,
— “এই যে শুনো ম্যাডাম, এবার কিন্তু দেরি করো না। দ্রুত একটা জুনিয়র আনো। এই বাড়িটা অনেক বড়, খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মা তো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু আমাকে বলে, যা অরশীনকে একটু বল না! আমি কীভাবে বলি বলো তো? আজকে সাহস করে দিলাম বলে। এত রাগ অভিমান না করে, কাজের কাজ করো প্লিজ।”
আরশীন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। কিন্তু মুখের হাসিটা চেপে রাখতে পারল না, খিলখিল করে হেসে উঠল।
.
আদিয়াত সকাল সকাল ফিরে এলো। ঘর ছাড়া তার মন টিকছিল না। বাতাসে ভোরের ঠান্ডা রেশ, চারপাশ নিস্তব্ধ। দরজা খুলে আস্তে ঘরে ঢুকে পড়তেই চোখে পড়ল, আরশীন এখনো ঘুমে। বিছানার চাদরের মাঝে ওর নিস্তব্ধ মুখটা নিখুঁত কোনো ছবির মতো স্থির। আদিয়াত নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসল। চোখে তার অনুশোচনার ছায়া। তবুও ফুরফুরে মন নিয়ে ধ্যানে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। একসময় নিজেই হালকা করে একটা নিশ্বাস ফেলল। ইশশশ… কাল অদ্ভুত একটা দিন গেল। রাগটাও বোধহয় একটু বেশি হয়ে গেছিল। চুলগুলো ওর চোখে এসে পড়েছিল, আদিয়াত আঙুলের ফাঁকে ওগুলো সরিয়ে দিল সযত্নে। তারপর ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল। হাতটা ওর গালের ওপর রাখল। আরশীনের ঘুম এতটুকুও আলগা হলো না। আদিয়াত ওর দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। ঘুম জড়ানো মুখটায় এমন এক কোমলতা, য দেখে আরেকবার প্রেমে পড়ে গেল। আগেরবার যে প্রেমে পড়েছিল সেটা থেকেই এখনো উঠতে পারল না, তারউপর আরেকবার। ব্যস, অধঃপতন নিশ্চিত। আদিয়াত ওর চোখের পাতা ছুঁয়ে একটা হালকা চুমু খেল। তারপর ঠোঁট নামিয়ে আনল ওর ঠোঁটে। চুমুটা ছিল স্নিগ্ধ, গভীর। আরশীন একটু নড়ল। হয়তো ঘুমে, হয়তো চুমুতে…
আদিয়াত হাসল। চুলগুলো সরিয়ে এবার মুখ ঘষল ওর ঘাড়ে। ওর কানে ফিসফিস করে বলল,
— “আমি এসেছি এইবার উঠুন ম্যাডাম।”
এমন আকস্মিক স্পর্শে আরশীনের ঘুমটা ধীরে ধীরে ভাঙছিল। তবে সে চোখ খোলেনি, খুলতে চায়নি। বুঝতে পারছিল, স্পর্শটা আদিয়াতের। ওর ঠোঁটের স্পর্শ কখনো কপালে, কখনো চোখের পাশে। গালের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া নিঃশ্বাসে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল ওর শরীরে। আরশীন চোখ বন্ধ রেখেই হালকা স্বরে বলল,
— “সকাল সকাল কি শুরু করলেন? কখন এসেছেন?”
আদিয়াত মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমটা ভাঙিয়ে একটু জ্বালানো দরকার।”
আরশীন ঠোঁট কামড়ে হাসল,
— “আপনার জন্য আমি একদিন হার্ট অ্যাটাকে যাবো। এই রাগ করেন, এই আদর করেন, এই ভালোবাসেন। একের ভিতর সব তাইনা?”
আদিয়াত তখন গলার কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
— “আপনার দোষ। রাগ করে থাকতে দিচ্ছেন কোথায়?”
আরশীন উঠে বসল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সবে ছয়টা বাজে। এমনিতেই রাতে অনেকটা দেরি করে ঘুমিয়েছে, আরেকটু ঘুমানো উচিত ছিল। কিন্তু উঠে বসলো। চুলগুলো কোনরকম আলুথালু করে মাথার উপর বেঁধে নিচু গলায় বলল,
— “আমার ওপর কি আপনার এখনো রাগ আছে?”
আদিয়াত নেতিবাচক মাথা নাড়ল,
— “কখনোই ছিল না আরশীন। কিন্তু কিছু বিষয় আছে… যেগুলো আমার পছন্দের আওতাভুক্ত নয়। সবকিছু আমি হাসিমুখে মেনে নিতে পারি না। এত বড় একটা কথা নিজের মধ্যে চেপে রাখলেন। আমার কি কোনো অধিকারই ছিল না জানার?”
— “হুমম, ছিল তো।”
আদিয়াত নিঃশ্বাস ফেলল।
— “তবে? দায় কি শুধু আপনার? আমাকে জানিয়ে অন্তত আমার পাশে থাকার সুযোগ তো দিতে পারতেন। আপনি যখন বললেন না, তখন আপনার কষ্ট, আপনার সিদ্ধান্ত সব আপনার একার হয়ে গেল। আর আমি? শুধু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। জানতাম না ভিতরে কী চলছে। এটা খুব ছোট করে দিল আমাকে, আরশীন।”
আরশীন চোখ তুলে তাকাল,
— “আমি ভয় পেয়েছিলাম।”
— “ভয় যদি থেকেই থাকে, তাহলে আমি তো আরো বেশি জানার অধিকার রাখি।”
আরশীন একটুখানি এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল,
— “সরি, আর কখনো এমন হবে না।”
আদিয়াত নিজের দৃষ্টি ওর চোখে গেঁথে দিয়ে বলল,
— “চেষ্টাও করবেন না। আমি সহজে রাগ করি না। কিন্তু একবার রেগে গেলে তখন সামলানো মুশকিল হয়ে যায়।”
— “কান ধরব? আমিও তো কষ্ট পেয়েছিলাম।”
আদিয়াত ওর হাতটা ধরল। নরম কণ্ঠে বলল,
— “না, কান ধরতে হবে না আর কষ্টও পেতে হবে না। কিন্তু এখন এসব নিয়ে আর কথা না বলি। যা গেছে, তা ভুলে যাওয়াই বোধহয় শ্রেয়… মনে রেখে কেবল নিজেকেই কষ্ট দেওয়া হবে।”
আরশীন অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
— “ভালোবাসা কি কখনো কখনো বোঝা হয়ে যায় আদিয়াত?”
— “ভালোবাসা কখনোই বোঝা হয়ে যায় না, বোঝাপড়া হয়ে যায়। তার সাথে জড়িয়ে থাকে প্রত্যাশা, ত্যাগ, অভিমান আর ভালো থাকা।”
আরশীন একটু কণ্ঠ নরম করে বলল,
— “আমি যদি আবার এমন ভুল করি?”
আদিয়াত হেসে বলল,
— “তাহলে আবারও রাগ করব। তারপর এভাবেই ফিরে আসব। কারণ, রাগ হলেও আপনার সুন্দর কথা থেকে তো বের হতে পারব না।”
আরশীন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল,
— “সবাই কি রাগ করে এমন সুন্দর কথা বলে?”
আদিয়াত হালকা গম্ভীর গলায় বলল,
— “সবাই তো আপনি না।”
আদিয়াতের ভেতরের দুষ্টুমিটা আবার জেগে উঠল। সে ধীরে ধীরে আরশীনের দিকে এগিয়ে এলো। ঠোঁটে একরকম বাঁকা হাসি, দৃষ্টিতে চঞ্চলতা। আরশীন একটু পিছিয়ে গেল,
— “আবার কী মাথায় এলো আপনার?”
— “আপনার কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে, একটা বড়সড় শাস্তি।”
— “মানে?”
আদিয়াত চোখের ইশারায় ওকে চুপ করিয়ে দিল। মুখটা আরশীনের খুব কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,
— “শাস্তিটা দুষ্টুমি দিয়ে শুরু, কিন্তু শেষ হবে আদর দিয়ে। রাজি তো?”
আরশীন হালকা ঠেলে দিল আদিয়াতকে। আদিয়াত বলল,
— “এসব কি হচ্ছে?”
— “প্রতিরোধ করছি।”
আরশীন চাদর টেনে মুখ ঢাকল। আদিয়াত চাদর সরিয়ে বলল,
— “এইটা প্রতিরোধ না বরং আমন্ত্রণ মনে হচ্ছে।”
ঠিক এমন সময় টুকটুক শব্দে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। আরশীন চমকে উঠে সরে গেল। তাড়াতাড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে মিটিমিটি হেসে তাকাল আদিয়াতের দিকে। আদিয়াতও হালকা অস্বস্তিতে পড়ে গেছে, চোখ নামিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
— “কাজের সময় ডিস্টার্ব।” আরশীন উঠে দরজা খুলতে গেল।
.
রেজা এখনো আত্মগোপনে। কী থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। পুলিশ তাকে খুঁজছে, চারদিকে তল্লাশি চলছে। স্থানীয় দোকানের সিসি ক্যামেরায় ওর মুখ ধরা পড়েছে পরিষ্কার, নির্দ্বিধায় চেনা যায়। থানার নোটিশ বোর্ডে, রাস্তার মোড়ে, পোস্টার হয়ে ছাপা পড়ছে ওর মুখ। পালিয়ে থাকা যে কতখানি যন্ত্রণার, এখন রেজা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মনস্থির করেছিল আমিনুল ইসলামের কাছে যাবে, কোনো উপায় বের করা যায় কিনা। কিন্তু তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই।
রেজা সবগুলো ঘটনাকে পরপর একত্রে সাজালো। আরশীনের বাবার খুন, আমিনুল ইসলামের কথায় আরশীনকে হুমকি-ধামকিমূলক চিরকুট দেওয়া, আদিয়াতের এক্সিডেন্ট, আরশীনদের বাড়ির প্রতিটা কোণাকুণি তল্লাশি সবশেষে আদিয়াতকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কেউ জানে না অথচ সে জানে, প্রতিটা ঘটনার সাথে রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো কীভাবে জড়িয়ে আছে। রেজার চাহনিতে একটা কুটিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল। দেশ ছাড়তে হবে অতি দ্রুত। কিন্তু তার আগে হিসাব-নিকাশগুলো চুকাতে হবে। আদিয়াতের ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। আরশীনকে নজরে রাখতে হবে। আরশীন সহজ মানুষ না। মাথায় খোপে খোপে বুদ্ধি, কথায় কথায় ধরা যায় না। ভাঙবে তবুও মচকাবে না। খুব শক্ত মেয়ে। পরিস্থিতির ভেতর ঢুকে পড়ে বুঝেছে, আরশীন অনেক কিছু জানে। হয়তো সবই জানে। এই মেয়েকে কাবু করা সহজ হবে না। তবে অসম্ভবও না। দরকার শুধু ধৈর্য। একবার যদি ওর কোন একটা টান ধরে টানা যায়, সব বেরিয়ে আসবে। “কান টানলে মাথা আসে” এই বিশ্বাসে রেজা এখনো দৃঢ়।
এইবার কোনো ভুল চলবে না। ছায়ার মতো চলতে হবে। একেকটা চাল হিসাব করে ফেলতে হবে। এটা শেষ খেলা, সামান্য ভুল মানেই শেষ।
—
ফরিদপুরের শান্ত বিকাল। শাহানা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে পিঁয়াজ কুচো করছিলেন। মাঝেমাঝেই চুলায় ফুটতে থাকা দুধের দিকে চোখ দিচ্ছেন। ড্রইংরুমে বিলাল হক আর আশা বসে গল্প করছিল। বড় সোফাটার একপাশে হেলান দিয়ে চাচা হালকা হাসিমুখে বলছিলেন,
— “আরশীনটা হয়েছে ভাইজানের মতো। যেমন চেহারায় তেমনি কাজেকর্মে। কতবড় একটা ঝড় বয়ে গেল ওর উপর দিয়ে, তাও শক্ত আছে।”
— “আপু অনেক ভেঙ্গে পড়েছিল চাচা।”
— “ওইটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু উপর উপর যে নিজেকে শক্ত রেখেছে, এটা কয়জন পারে? ধৈর্য আছে মেয়েটার।”
শাহানা এসে বললেন,
— “পুরাতন কথা বাদ দেন ভাই। এসব শুনতেও ভালো লাগে না। এখন বোধহয় মরে গেলেই শান্তি পাই। মেয়েগুলোর জন্য শুধু বেঁচে আছি। তাও দেখেন, দুরাবস্থা। আমিই পারলাম না আগলে রাখতে।” আশা মায়ের কাছে এগিয়ে এলো। বিলাল হক বললেন,
— “এত সহজে ভেঙে পড়লে হবে? জীবনে এখনো অনেক বাকি। আশায় বাঁচে চাষা। তাইনা রে আশা মা?” আশা হেসে চাচার কথায় সায় দিল।
সাধারণভাবে দেখলে মনে হতে পারে, একটা নিখুঁত পারিবারিক বিকাল। কিন্তু না… বাস্তব চিত্রটা এতটা সরল নয়। আকাশের হালকা রঙের মতো নিস্তরঙ্গ এই বিকেল আসলে ছিল এক ঝড়ের পূর্বাভাষ। বাতাসে ছিল বারুদের হালকা গন্ধ। ঝড় এখনও শুরু হয়নি, কিন্তু তার আগমনী আওয়াজ ছায়ার মতো লুকিয়ে পড়েছে ফরিদপুরের শান্ত সময়ে।
.
.
.
চলবে….
#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩৫]
~আফিয়া আফরিন
(পত্রস্থলে অনুনয়)
পুলিশের হাতে এসে পৌঁছেছে কয়েকটা ফুটেজ, কিছু প্রমাণ। লোকগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আদিয়াতকে থানায় ডাকা হয়েছিল। ওর সাথে আরশীন ছিল। আদিয়াত তাদের চিনতে না পারলেও আরশীনের টনক নড়ে উঠল। কারণ ছবিতে দেখা প্রতিটি লোক তার চেনা। এরাই কিছুদিন আগে তাদের ফরিদপুরের বাসায় হামলা চালাল। এইতো সেই ষন্ডা মার্কা চেহারার লোকটা, যে আরশীনকে ধাক্কা মেরেছিল। আরশীন পুলিশকে জানালো, আদিয়াতকে বলল। তারমানে আরশীনের বাবার হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা ছিল তারা আদিয়াতকেও টার্গেট করেছে। কিন্তু কেন? এর কোনো সুস্পষ্ট কারণ কেউ খুঁজে পেল না।
পুলিশ তদন্তে একাধিক সূত্র ধরে এগোতে গিয়ে একটি নামে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছিল আমিনুল ইসলাম, ভিকটিমের বাবা। প্রথমে নিজেদের ভুল মনে করে বিষয়টা এড়িয়ে গেলেও পরবর্তীতে আর পারল না। পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, আমিনুল ইসলামের সঙ্গে রেজার যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। নীরার মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাদের মধ্যে ফোনে এবং অফ-রেকর্ড মিটিং হয়েছে। এছাড়াও প্রথমদিকে তিনি তদন্তে খুবই আগ্রহী থাকলেও ধীরে ধীরে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন পুলিশকে। প্রমাণগুলো একত্রিত করে এসেছিল আদিয়াতের কাছে। পুলিশের অফিসার রয়ে সয়ে বললেন,
— “আমরা আমিনুল ইসলামের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। বেশ কিছু প্রমাণ রয়েছে আমাদের কাছে, আপনাকে জানাতে চাচ্ছি। আপনার সাহায্য প্রয়োজন।”
আদিয়াত মাথা নাড়ল। একটুও চমকাল না, ভ্রু-ও কুঁচকাল না। কেবল সংক্ষিপ্তভাবে বলল,
— “আচ্ছা। কি সাহায্য করতে পারি বলুন?”
পুলিশ অফিসের সিসি ক্যামেরা দেখতে চাইল। আদিয়াত ব্যবস্থা করে দিল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রেজা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে সরাসরি অফিসে এসে দেখা করেছে বেশ কয়েকবার। ওর মধ্যে কোন রাখঢাক নেই, লুকোচুরির ব্যাপার নেই, দ্বিধা নেই, দেখে সবটাই পূর্বপরিকল্পিত মনে হয়। ফুটেজে নীরাকেও দেখা গেছে কয়েকবার।। মেয়েটার মুখে এক ধরনের কুণ্ঠা, দ্বিধা, চাপা ভয়। ও তাহলে সবটা জেনে বুঝেই বিপদে পা বাড়িয়েছিল। আদিয়াত টেবিলে রাখা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর বলে,
— “নীরার মৃত্যুর পর রেজাকে আর অফিসে আসতে দেখা যায় নাই।”
— “হ্যাঁ, পালিয়েছে। তবে আপনার সাথে আপনার চাচার কি শত্রুতা? তিনি হঠাৎ এরকম বেপরোয়া হয়ে উঠলেন কেন? আপনার জন্য ফাঁদ পাততে গিয়ে নিজের মেয়েকে হারিয়েছেন।”
আদিয়াত এই পরিপেক্ষিতে কিচ্ছু বলে না তবে আরশীনের বলা একটা কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যায়।
— “নীরা মারা যাওয়ার আগে কিছু বলতে চেয়েছিল। ঠোঁট নড়ছিল… কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে পারে নাই।”
তবে কি সে নিজের বাবার কথাই বলতে চেয়েছিল? নিজের বাবার গোপন কুকীর্তি? গত কয়েকদিনে ওদের উপর দিয়ে এত প্রেসার গেল যে এ কথাটা বেমালম ভুলে গিয়েছিল। যদিও পুলিশকে জানানো হয়েছে, কিন্তু তাদেরও মনে রাখা উচিত ছিল।
কিছুক্ষণ আগেই পুলিশের বিশেষ ইউনিট এসে পৌঁছেছে, হাতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। অফিসার ইনচার্জ গম্ভীর মুখে বললেন,
— “আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তাকে এখনই আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।”
আদিয়াত এগিয়ে এলো। শান্ত কণ্ঠে বলল,
— “আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই ওনার সঙ্গে, একান্তে।”
অফিসার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। হয়ত বোঝার চেষ্টা করলেন কিছু। তারপর বললেন,
— “ঠিক আছে, তবে দ্রুত করুন। আমরা বেশি সময় দিতে পারছি না।”
পাশের ডেস্কগুলোতে টানা চোখ। কীবোর্ডে কেউ টাইপ করছে না,
একমুহূর্তে সবাই থেমে গেছে। ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছে। এতবছর যারা আমিনুল ইসলামকে একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে চিনত, তারা এক লহমায় ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করল। চুপিচুপি ফিসফাস চলছে,
“উনিই কি তবে, সত্যিই?”
“নিজের দোষে নিষ্পাপ মেয়েটাকে হারালো।”
“অবিশ্বাস্য! চাচা হয়ে নিজের ভাতিজার সাথে কেউ এমন করতে পারে?”
“আমিনুল স্যার যে খুব একটা ভালো লোক নন তা জানতাম কিন্তু তলে তলে এতো শয়তানি?”
সবাই জেনে গেছে অথচ নাটের গুরু ভদ্রলোক এখনও কিছু জানেন না। আদিয়াত এগিয়ে গেল তার কেবিনের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেমে, নিঃশ্বাস নিল। তারপর দরজায় এসে কড়া নাড়ল। আমিনুল আদিয়াতকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “কোনো দরকার?”
আদিয়াত ভিতরে ঢুকল। উনার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। চোখে ভ্রুকুটি।
আদিয়াত গিয়ে দাঁড়াল সামনে। হাত দুটো বুকের উপর আড়াআড়ি বেঁধে বলল,
— “প্রয়োজন মেটাতেই এসেছি, চাচা সাহেব।”
আমিনুল গলা শক্ত করে বললেন,
— “তোমার সাথে আমার আর কোনো হিসেব নেই আদিয়াত। যাও, আমি কথা বলতে চাই না।”
আদিয়াত ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে হাসল,
— “আচ্ছা? তবে এত কিসের রাগ আর অপমানবোধ জমিয়ে রেখেছিলেন যে আমাকে মারার পরিকল্পনা করতে হলো আপনাকে?”
আদিয়াতের ঠান্ডা, স্থির স্বরে উচ্চারিত অভিযোগটি শূন্যঘরে বজ্রধ্বনির মতো প্রতিধ্বনিত হলো। আমিনুল ইসলাম মুহূর্তেই চমকে উঠলেন।
— “প-পাগল নাকি তুমি? কার উপর, কিসের অভিযোগ চাপাচ্ছো?” কথাগুলো বেরোল আমতা আমতা করে, বিশ্বাস না করতে পারার ভঙ্গিতে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে। কণ্ঠে একরাশ ক্ষোভ মেশানো আশঙ্কা।
— “আদিয়াত, ধরাকে সরা জ্ঞান করতে যেও না। তুমি বুঝতেও পারছো না, কী ভয়ানক অভিযোগ করছো তুমি।”
— “গলা নামিয়ে কথা বলুন। আমি ধরাকে সরা জ্ঞান করছি না বরং অনেকদিন ধরে অন্ধ হয়ে থেকেছি। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য চুপ থেকেছি। ঘটনাটা যদি শুধুমাত্র আমার সাথে জড়িয়ে থাকত তাহলে আজও হয়তো কিছু বলতাম না। কিন্তু আপনার জন্য আপনার নিষ্পাপ মেয়েটা চলে গেছে। আমি দোষ দিচ্ছি না, দোষগুলো নিজেই একেক করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগও করছি না। আমি শুধু বলছি আপনার ভয়ানক ছায়াতে আজ সব অন্ধকার। আমি চুপ থেকে আপনাকে সুযোগ দিয়েছিলাম। জানতাম বলেই চুপ ছিলাম। এখন আর কিছু গোপন রাখার নেই, সবাই সবটা জেনে গেছে।” কথাগুলো আদিয়াত শান্ত স্বরে বললেও, সেগুলোর ওজন এবং রেশ আমিনুল ইসলামের মুখে জবাব রাখল না। তার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কোনো কথা বের হলো না। এমন একটা পরিস্থিতি যে ভুল স্বীকার করার সাহস নেই, অস্বীকার করার সুযোগও নেই।
আদিয়াতের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ কোনো প্রশ্নচিহ্নের মতো বিঁধে যাচ্ছিল আমিনুল ইসলামের ভিতরটায়। চোখ নামাতে পারছিলেন না, মুখ তুলে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছিল। পরক্ষণেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পড়লেন। আদিয়াত ধীরে বলল,
— “আমি আপনাকে ঘৃণা করতাম না। শ্রদ্ধা করতাম একসময়। কিন্তু আজ, এইমুহূর্ত থেকে আমি আপনাকে চিনি না। আপনার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক এখানেই শেষ। আপনি যা করেছেন, সেটার পরিণতি আপনি নিজেই বহন করবেন চিরকাল।”
তারপর আর কেউ কিছু বলার অবকাশ পেল না। পুলিশ দ্বিধাহীন হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাকে নিয়ে চলল একগাদা লোকের সামনে দিয়ে। আদিয়াত থম মেরেই ছিল। ওর ভাবভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না। আমিনুলকে নিয়ে যাওয়ার পর আদিয়াতের চেহারার দিকে তাকিয়ে কারো আর সাহস হলো না দাঁড়িয়ে থাকার কিংবা মাত্র ঘটা ঘটনা নিয়ে করা বলার। যে যার কাজে ফিরে গেল।
জহিরুল ইসলাম তখন অফিসে ছিলেন না। ঢাকার বাইরে একটি সরকারি বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। ফোনের ওপাশে যখন খবরটা শুনলেন, তখন তার কণ্ঠ নিস্তেজ হয়ে গেল। তারপর তিনি নিজে থানায় কথা বললে ওসি নিজে ঘটনার খুঁটিনাটি জানায়। মুহূর্তের জন্য কী যেন হারিয়ে ফেললেন জহিরুল। পায়ের নিচের মাটি সরে গিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
নাজনীন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের দেয়ালে। অজান্তেই বললেন,
— “এ কী হচ্ছে আমাদের সাথে? কার কু-দৃষ্টি পড়লো আমাদের ঘরে? কার ছায়া লাগলো? আমার ছেলের কী দোষ ছিল? এমন কেনো করল?”
আলিয়া আরশীন পাশে বসে মা’কে জড়িয়ে ধরল। আরশীন বলল,
— “মা, আপনি শক্ত হন। আল্লাহ ভরসা, ওর কিচ্ছু হবে না। আদিয়াত আপনাকে দেখে নিজেকে সামলায়। আপনি ভেঙে পড়লে ওর কেমন লাগবে বলুন?”
নাজনীন চোখ মুছে বললেন,
— “মা হয়ে কিভাবে এসব সহ্য করি বলো? আমাদের নিজেদের মানুষ… কী করে নাই আদিয়াতের বাবা ওদের জন্য? এই প্রতিদান দিল? আমার ছেলের যদি কিছু একটা হয়ে যেতো?”
চারপাশ নিঃশব্দ হয়ে এলো। তবে দীর্ঘশ্বাস যেন ঘর জুড়ে বয়ে চলল। আরশীন আদিয়াতকে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলল না, কিছু জিজ্ঞাসাও করল না।
—
আমিনুল নিজের দোষ স্বীকার করলেন। কেনো এই কাজ করেছেন তাও জানালেন। কিন্তু রেজার কথা জিজ্ঞেস করায়, কোনো উত্তর মিলল না। তার স্বীকারোক্তি:
আদিয়াতকে প্রথম থেকেই সহজভাবে নিতে পারেননি তিনি। অফিসের ভেতরের প্রতিটি বিষয়ে আদিয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি, সত্যবাদিতা এবং প্রশ্ন তোলা তার কাছে ছিল ভিত্তিহীন। নিজের বছরের পর বছর গড়ে তোলা অবস্থান, সম্মান সব কাঁপিয়ে দিচ্ছিল আদিয়াত। তার অভ্যস্ত নিয়ম ছিল, চোখে না দেখালেও সবাই মাথা নিচু করে থাকবে। কিন্তু আদিয়াত ছিল উল্টো। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করত, সত্য চাইত, ভুল ধরিয়ে দিত। রাগ জমতে জমতে একসময় হিংসায় পরিণত হয়। সেই থেকেই প্রতিশোধ শুরু। প্রথমে এক্সিডেন্ট সফল না হওয়ায় দ্বিতীয় পরিকল্পনা। আর তাতেই সব শেষ হয়ে গেল। নিজের বুদ্ধিতে, নিজের মেয়ের জীবন…
আদিয়াত এসব জানতে চায়নি। একটুও না। নিজেকে বুঝিয়েছিল যা গেছে, তা শেষ। আপন মানুষের রূপ যত দেখছে, তত অবাক হচ্ছে। চোখের সামনে ভাঙতে দেখল মানুষের মুখোশ। বিশ্বাস করে রাখা সম্পর্কগুলো ভেঙে পড়ছিল চাপা যন্ত্রণার মতো। ক্ষত তো হয়ে গেছে আগেই, এখন কেবল পোড়া ঘ্রাণটুকু বাকি রয়ে গেছে।
.
ঘটনার বেশ ক’টা দিন পার হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে একটা অদৃশ্য ভার ঘিরে রেখেছে পুরো পরিবারকে। হাসিমুখ, হালকা আড্ডা, চায়ের কাপের ঠোকাঠুকি এসব অতীতের ছবি হয়ে গেছে। বাড়ির প্রতিটা ঘর চিন্তা, শোক আর ক্লান্তির নিঃশ্বাসে ভারী। আরশীনের আজ খুব মন খারাপ। একঘেয়ে লাগছে। কিছু করেই শান্তি পাচ্ছে না। আদিয়াতকে ফোন করল,
— “হ্যালো শুনুন, আমি একটু কলাবাগান যেতে চাইছিলাম। যাবো?”
ওপাশে আদিয়াত ভেবে উত্তর দিল,
— “আচ্ছা যান। আমি তো একটু ব্যস্ত আছি, তাই যেতে পারছি না। বাড়ির গাড়ি নিয়ে বের হবেন। সাবধানে যাবেন।”
— “আপনিও সাবধানে থাকবেন প্লিজ। বিপদ তো এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি।”
— “আমি আছি। চিন্তা করতে হবে না। পৌঁছে ফোন দিবেন।”
— “হুমম।”
আরশীন বাড়ির গাড়ি নিয়েই বের হলো। এই বাড়িটায় এলে ও একটু স্বস্তি পায়। আদিয়াত যেদিন থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে, তারপর থেকে আর কোনো সমস্যা হয় নাই।
আরশীন ভেতরে ঢুকল। একে একে প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখছিল, কিন্তু বাবা-মায়ের পাশের এই ঘরটাতে এসে হঠাৎ থমকে গেল। এই ঘরটা ছিল বাবার প্রিয়, নিতান্ত ব্যক্তিগত এককোণ। চোখটা হঠাৎ আটকে গেল দেয়ালের একদিকে, একেবারে কোণার দিকে। একটু অস্বাভাবিক দেখাল জায়গাটা। দেয়ালের গায়ে একটা বাক্সের মতো কিছু যেন আটকানো ছিল, এখন সেটার অর্ধেক বেরিয়ে আছে। আগে তো এমন কিছু চোখে পড়েনি।
ভাবতেই মনে পড়ল, এই ঘরে তো একটা আলমারি ছিল যেটা দেওয়ালটাকে অনেকটাই ঢেকে রাখত। হামলার পর সমস্ত ঘরই উলটপালট হয়ে গিয়েছিল, আসবাবও সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তাই হয়তো এতদিন চোখে পড়েনি জায়গাট। মৃদু হাতের স্পর্শে দেয়ালের অংশটুকু ছুঁয়ে দেখল। কাঠ বা ধাতুর তৈরি বাক্সের মতো, সতর্কভাবে লুকিয়ে রাখা। তার বুকের ভেতর একটা অজানা শিহরণ দৌড়ে গেল। এটাই কি তবে অপ্রকাশ্য সত্যের ঠিকানা? আরশীনের চোখে প্রশ্ন, মনে সন্দেহ, পায়ে নিঃশব্দ উত্তেজনা… সবকিছুর পরে কি সম্ভাব্য উত্তরটা সে খুঁজে পেতে চলেছে? দ্রুত ফোন বের করে আদিয়াতকে কল করল। কণ্ঠে ছিল কাঁপা কাঁপা উত্তেজনা।
— “আদিয়াত, আমরা বোধহয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি। কিছু একটা আছে এখানে। আমি নিশ্চিত না, তবে এটা ফাঁকা কিছু নয়। মনে হচ্ছে, এইবার আমরা ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছি। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।”
— “আরশীন চুপ, এত উত্তেজিত হবেন না। কাউকে কিছু না বলে আপনি চুপচাপ বেরিয়ে আসুন। সোজা অফিসে চলে আসুন, আমি সন্ধ্যায় দেখছি বিষয়টা।”
— “ওই অংশটা কি কোন কিছু দিয়ে ঢেকে রাখব?”
— “যদি ঠিক মনে হয় তাই করুন।” আদিয়তের কন্ঠে চাপা সতর্কতা।
আশেপাশে তাকিয়ে আরশীন ফোনটা নামিয়ে রাখল। পাশের কাবার্ডটা ঠেলে দিল। তার অন্তর্দৃষ্টি বলছে, এখানে কিছু না কিছু আছে নিশ্চয়ই।
আরশীন বাহিরে বেরিয়ে এলো। ড্রাইভারকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না। একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোলো। মাঝদুপুরে রাস্তাটা বেশ ফাঁকা ছিল, মানুষজনও হাতে গোনা। গলির একপাশে ছায়া পড়ে আছে গাছের, সে পথেই এগিয়ে গেল আরশীন। মাথার মধ্যে ভাবনাচিন্তারা সব এলোমেলো। হঠাৎ খেয়াল হলো, সে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে। ওহো, এতদূর কোন খেয়ালে চলে এলো? ফেরার জন্য উল্টোদিক ফিরল। ঠিক সেইমুহূর্তে একটা গাড়ি পেছন থেকে এসে গতি কমিয়ে পাশে থামল। কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়ির দু’পাশের দরজা একসাথে খুলে গেল। দু’জন লোক দ্রুতগতিতে বেরিয়ে এসে আরশীনের মুখে রুমাল চেপে ধরল। কিছু বলতে গিয়েও পারল না, কিছু করতেও পারল না। চোখের পলকে হাতের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলল। ধস্তাধস্তির সুযোগ না দিয়ে, দ্রুত ওকে গাড়িতে তুলল। দরজা বন্ধ করল ঠাস করে, গাড়ি ছুটে চলল…..
.
ড্রাইভার গাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল। দুপুরের রোদটা ম্লান হয়ে আসছিল। হঠাৎ সামনে থেকে একটা মাঝবয়সী ছেলে এগিয়ে এসে বলল,
— “আরশীন ম্যাম এটা আদিয়াত স্যারকে দিতে বলছেন।” সে ছেলেটির হাতে একটা ভাঁজ করা চিরকুট। ফের বলল,
— “উনি এখন ফিরবেন না। আপনি গিয়ে দিয়ে দিবেন।”
ড্রাইভার এক ঝলক ছেলেটার দিকে তাকাল। কণ্ঠে কেমন রোবটিক ভাব। চিরকুট হাতে নিয়ে ড্রাইভার বলল,
— “ঠিক আছে।”
ড্রাইভার চিরকুটটা পকেটে রেখে গাড়িতে উঠে পড়ল। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ছুটল আদিয়াতের অফিসের দিকে।
চিরকুটটা হাতে পেয়ে আদিয়াত একটু অবাকই হলো। আরশীন হঠাৎ চিরকুট কেন পাঠাতে গেল? এমন কিসের গোপনীয় বিষয়?
— “কখন থেকে ফোন দিচ্ছি, রিসিভ করার খবর নাই। আর প্রেমপত্র পাঠাচ্ছে কীসের সুখে?” বিড়বিড় করে বলল সে।
চারকোণা ভাঁজটা খুলল। প্রথম লাইনটা পড়ার পর চোখমুখ কুঁচকে গেল। আচমকা কোথা থেকে ঠান্ডা হাওয়া মুখের উপর এসে পড়ল কপালে ভাঁজ পড়ল; একটা নয়, দুটো নয়, পরপর কয়েকটা। আদিয়াত পুরোটা পড়তে লাগল,
“আদিয়াত…
আজ তোমাকে ‘প্রিয়’ বলে ডাকতে ইচ্ছে করল না। তোমার কিছুই না হয়ে উঠতে চাইছি এবার। চেষ্টা করেছি, জানো? নিজের যতখানি পারি সবটা দিয়ে তোমার হয়ে থাকতে। কিন্তু… একটা সময়ের পর চেষ্টাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তোমার সাথে আমার এই বিয়েটা ছিল হঠাৎ করে নেওয়া এক সিদ্ধান্ত। সেই সময়ের আবেগ, পরিবার-সমাজের চাপ, না বলা কথার ভেতরে গুমরে ওঠা কিছু আবছা ভালোবাসা, সব মিলে হয়ত আমাদের একসাথে ফেলে দিয়েছিল একটা সম্পর্কে। আমরা ভেবেছিলাম ভালোবাসা পরে গড়ে উঠবে। কিন্তু আদিয়াত, ভালোবাসা জোর করে হয় না। আমাদের প্রতিদিনের ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি, তুমুল নীরবতা, ভালোবাসা এসব আর সইতে পারছি না। রাতগুলো দীর্ঘ হয়, আর দিনগুলো বোবা। তুমি হয়তো ভালোবাসো তোমার মতো করে, কিন্তু আমি তো মানুষ… অনুভব করি, ভেঙে পড়ি। একটা সময়ে এসে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি সত্যিই সুখী?
আমি জানি, আমার চলে যাওয়াটা হঠাৎ লাগবে। কিন্তু আমার ভেতরে এই সিদ্ধান্তটা ধীরে ধীরে জমে উঠেছে। আমি ক্লান্ত আদিয়াত। মনের ভেতরে এত না পাওয়া, এত ভুল, এত বোঝা নিয়ে আর হাঁটতে পারছি না। তোমার দেয়া একেকটা কথা, একেকটা রাতের চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যাওয়া, আমার শূন্য হাত সবকিছু এখন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এবং সেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করছি, আমরা আদৌ একে অপরের জন্য ছিলাম না। এই চলে যাওয়া কোনো ঘৃণার নয়, প্রতিশোধের নয়। এটা আমার শেষ চেষ্টা নিজেকে বাঁচানোর।
একদিন যদি তুমি চুপচাপ সন্ধ্যায় বসে থাকো, আর এই চিঠির কথা মনে পড়ে তবে জেনো, আমি হাল ছেড়ে দিইনি হুট করে। আমি শুধু এক জীবনে একটু শান্তি চেয়েছিলাম। ভালো থেকো। নিজেকে ভালোবাসো। আমার ভাগেরটুকুও…” নাম নেই, শুধু একফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়া দাগ…
.
.
.
চলবে….
#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩৬]
~আফিয়া আফরিন
(আলোকপাত)
পুরো চিঠিটা পড়ার পর আদিয়াত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। লাইন বাই লাইন চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল, কোথাও অচেনা কিছু একটা আছে। ধরতে পারছে না সে। আরশীনের প্রতিনিয়ত বলা কথাবার্তার সাথে এই লেখার কোনো মিল নেই।
— তুমি? হঠাৎ মাথায় খেলল। আরশীন কখনোই তাকে “তুমি” সম্বোধন করে না। সে বরাবরই বলেছে “আপনি”, এমনকি রাগ, অভিমান, ভালোবাসার মুহূর্তেও। সেই মেয়ের হঠাৎ চিরকুট লেখায় এমন বদল কেনো? আর সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে গেলে কেউ কখনো ঢাকঢোল পিটিয়ে যায়? নাহ, এটা কিছুতেই আরশীন লিখতে পারে না। সে তৎক্ষণাৎ ফোন হাতে তুলল। আরশীনের নাম্বারে আবার ট্রাই করল, রিং হতে লাগল। একবার… দুবার… তিনবার… কিন্তু রিসিভ হলো না। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল আদিয়াত। কোনোদিকে না তাকিয়ে সরাসরি কলাবাগানের দিকে ছুটল। সিকিউরিটির কাছে গিয়ে তাড়াহুড়ো গলায় বলল, “আরশীন এসেছিল তো? ও যাওয়ার পর আর কেউ ঢুকেছে?”
সিকিউরিটি বলল, “না স্যার, ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর আর কেউ আসে নাই।”
একটা মুহূর্তের জন্যও দেরি করল না সে। ল্যাপটপ খুলে বসল। সিসিটিভি ফুটেজগুলো চেক করল। যদিও আরশীন তাকে ফোনে বলেছিল সবকিছু কিন্তু কোন রুমে কোথায় কি রাখা আছে, তা আলাদা করে খুঁজে সময় নষ্ট করার মত সময়ই হাতে নেই। ফোল্ডার ঘেঁটে খুঁজে বেশ কিছু ফুটেজ স্কিপ করে কাঙ্খিত জায়গাটা খুঁজে পেল সে। ওই রুমে গিয়ে সবকিছু উদ্ধার করল। একটা কাঠের ড্রয়ারের মত করা ছিল দেওয়ালের মধ্যে। অবাক হওয়ার কথা, কিন্তু তারও সময় নেই। বেশ কিছু ফাইলপত্র, ক্যামেরা, কাগজপত্র, নোট খুঁজে পেল। সবকটা নিয়ে হম্বিতম্বি করে ফিরে আসতেই দরজার সাথে ধাক্কা খেল। দরজাটা পিছন দিকে আছাড় খেল এবং দেওয়ালে টাঙানো বড় ফ্রেমের ছবিটা ভেঙ্গে পড়ল।
— “উফফফ, কাজের সময়…।” ছবিটার দিকে ঝুঁকতেই দেখল ওটা আরশীন আশার ছোটোবেলার ছবি বাবা-মায়ের সাথে। কাঁচের এক সাইডে হঠাৎ চোখ পড়তেই খেয়ালে এলো একটা মেমোরি কার্ড। আদিয়াত হাতে তুলল। মাই গড! এটাই কি তবে সেই কার্ড যার জন্য এত কাহিনী? যদি হয় তবে তো সব প্রমাণ তার হাতের মুঠোয়। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। পুলিশ অফিসারের ফোন।
— “হ্যালো?”
— “মিস্টার আদিয়াত, কলাবাগান এরিয়ার ভেতরেই আপনার ওয়াইফের ফোন ট্রেস করা গেছে। তবে মোবাইলটা কিছুক্ষণ ধরে এক জায়গায় একদম স্ট্যাটিক…”
আদিয়াত কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে ছুটল লোকেশন অনুযায়ী। গলির এককোণে পৌঁছাতেই তার চোখ পড়ল ব্যাগ, আরশীনের ব্যাগ। পড়ে আছে, অস্থির হাতে ব্যাগটা খুলল। ভেতরে ফোনটা বাজছে। আদিয়াত মাথায় হাত দিয়ে দমকা হাওয়ার মতো পেছনে তাকিয়ে হন্যে দৃষ্টিতে চারপাশ খুঁজে দেখল। গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। চোখে অন্ধকার দেখছে। আরশীন যে কিডন্যাপড হয়েছে এটা বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু কারা করল এসব? এই সবকিছু লুকিয়ে আছে ওই ছোট্ট মেমোরি কার্ডে আর ফাইলগুলোর মধ্যে।
.
পুলিশকে সবকিছু বলে, বুঝিয়ে দিয়ে আদিয়াত বাড়ি ফিরছিল। তবে ওই মেমোরি কার্ড আর ফাইলপত্রের বিষয়টা গোপন রেখেছিল। এগুলা এখন পর্যন্ত ব্যাক্তিগত।
সন্ধ্যার আঁধারে শহরের ব্যস্ততা একটু একটু করে স্তিমিত হয়ে আসছিল। রাস্তার আলোয় তার ছায়া যেন ধীরে ধীরে লম্বা হচ্ছিল। হঠাৎ পকেটের ফোনটা আবার বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল “আম্মু”… অর্থাৎ আরশীনের মা। আদিয়াত কিছুটা থমকে গেল। উনি তো সচরাচর ফোন করেন না, উনার সাথে ফোনে কখনো কথা বলা হয়েও ওঠে নাই। নিশ্চয়ই আরশীনকে ফোনে না পেয়ে তাকে ফোন করেছে। আদিয়াত ফোন রিসিভ করল। ভদ্রতা আর শ্রদ্ধা মিশিয়ে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। একটুখানি নীরবতার পর শাহানা বললেন,
— “বাবা, তুমি কি বাসায়? মানে, আরশীন তোমার আশেপাশে আছে?”
আদিয়াত মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। একধরনের শঙ্কা বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। থেমে ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “আরশীন…?”
— “হ্যাঁ। অনেকক্ষণ ধরেই ফোনে ট্রাই করছি। কিন্তু রিসিভ করছে না। তুমি বোধহয় বাইরে আছো, তাই না? হর্নের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। তুমি বাড়ি গিয়ে ওকে একটু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলো।” শাহানার কণ্ঠে উদ্বেগের রেখাটা স্পষ্ট।
ফোনটা ওপাশ থেকে ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে আদিয়াত প্রায় গলার জোরে বলে উঠল,
— “মা… মা, এক মিনিট। আরশীনকে খুঁজে পাচ্ছি না।” কণ্ঠে তীব্র উৎকণ্ঠার সুর। শ্বাস আটকে আসা অবস্থা।
নিঃশব্দ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল ফোনের ওপাশ থেকে। শাহানা কাঁপা কণ্ঠে হঠাৎই হু হু করে কেঁদে উঠলেন। গলার স্বর বাচ্চার মতো অসহায়,
— “আমি তো এখানে সকাল থেকে আশাকেও খুঁজে পাচ্ছি না বাবা। ওর চাচা আর আমি হন্যে হয়ে সব জায়গায় খুঁজেছি। কোথাও পাই নাই। এখন আবার কী খবর শুনলাম? আল্লাহ! কোথায় আছে আমার মেয়েরা? কী হচ্ছে এসব আমাদের সাথে?”
আদিয়াত মুহূর্তেই নিজেকে শক্ত করল। এখন ভেঙে পড়ার সময় নয়।
— “মা, আপনি নিজেকে একটু সামলান। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, কিছু হবে না। আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন।”
শাহানা থেমে থেমে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললেন,
— “দেখো বাবা, আমরা এখানে পুলিশেও জানিয়েছি।”
আদিয়াত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “চিন্তা করবেন না মা। আপনি আর চাচা একটু সাবধানে থাকুন। আমিও এখানে পুলিশে জানিয়েছি। কোনো আপডেট পেলে অবশ্যই আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দিব।”
ফোনটা কেটে গেল। চারপাশের বাতাসটা আরও ভারী লাগল আদিয়াতের কাছে। ও বোধহয় একটা গভীর অন্ধকারে গুহায় এসে পড়েছে। আরশীন… আশা… কোথায় ওরা?
আদিয়াত নিজের বাড়ি ফিরে এলো। মা আর আলিয়া আরশীনের খোঁজ করছিল। সে কেবল একটাই উত্তর দিল,
— “জানি না।” ইচ্ছে হলো না কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সবার প্রশ্ন, চিন্তা, আনাগোনা আর উত্তরের দাবি থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনল। এতক্ষণ চিন্তা, গ্লানি, দায় সবকিছুর ভারে সে এমনভাবে নিজেই ধুঁকছিল যে তার মাঝে আরশীনের কথা আলাদা ভাবে মাথায় ঢুকার জায়গা পায়নি। এইবার একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেতেই আরশীনের চিন্তা তাকে গ্রাস করে নিল। সে কোথায়? কার সাথে? আশা নিশ্চয়ই আছে ওর সাথে? ঠিক আছে তো? নিমিষেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল চেহারায়।
আদিয়াত ফ্রেশ হলো না। চুপচাপ চেয়ারে বসল। ছোট মেমোরি কার্ডটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এখানেই নিশ্চয়ই সত্য-অসত্যর সমস্ত হিসেব রয়েছে। আদিয়াত ল্যাপটপের কার্ড-রিডারে সেট করল কার্ডটা। মনিটরের স্ক্রিনে ছোট্ট একটা ‘ডিটেকটেড’ শব্দ ভেসে উঠতেই আদিয়াতের চোখ স্থির হয়ে গেল। আসছে মুহূর্তগুলো…. তারপর মাউসের কার্সরটা এগিয়ে দিল, ‘ওপেন ফোল্ডার’ অপশনের দিকে।
একে একে ভেসে উঠল অনেক ছবি, ভিডিও… এইতো সে সমস্ত প্রমাণ যেসব আরশীন পাগলের মত খুঁজছিল। সব আজ হাতে এসে ধরা দিল। সে প্লে বাটনে চাপ দিল। ভিডিওটি শুরু হতেই প্রথমে অন্ধকার। তারপর ঝাপসা আলোয় দেখা গেল একটা চেনা রাস্তা। পরিচিত মুখ কতকগুলো… আদিয়াত যা বোঝার এক লহমায় বুঝে গেল। পুরোটা দেখতে হলো না ওকে। ধরাম করে উঠে দাঁড়াল। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, পায়ের নিচের মাটি সত্যিই কেঁপে উঠেছে। তার চোখে একধরনের অবিশ্বাস, হতবাক বিস্ময়। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। এই মুহূর্তে প্রতিটি শ্বাস বোঝার মতো ভারী। চোখে-মুখে একটাই প্রশ্ন, — “এমনটা কিভাবে সম্ভব?”
আদিয়াত ভিডিওটা আবার দেখল। ওই কণ্ঠটা… ওই চোখ… ওই হাঁটার ভঙ্গি, একটুও ভুল নেই। উনি’ই! উনিই করেছেন! আদিয়াত এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ক্ষোভ, কষ্ট, রাগ, অবিশ্বাস সব মিলে অনুরণন তুলল মনে, নিজের সবচেয়ে আপন মানুষটাই সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে সামনে।
.
অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারপাশ, ঘন কুয়াশার মতো স্তব্ধতা। আরশীনের চোখ ধীরে ধীরে খুলে আসছে, কিন্তু স্পষ্ট কিছু দেখতে পারছে না। মাথাটা ভারী লাগছে, অনেকটা সময় অচেতন অবস্থায় ছিল কিনা। হালকা একটা আলো ড্রিম লাইটের মতো, অন্ধকারের বুক চিরে এক কোণায় জ্বলছে। ওই আলোতেই আশেপাশের অস্পষ্ট অবয়ব বোঝা যাচ্ছে; দেয়ালের ছায়া, একটা চেয়ারের সিলুয়েট, জানালার গ্রিল।
আরশীন চোখ মিটমিট করে তাকায়। নিজের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। হাত-পা গুলিয়ে আছে। মাথার পেছনে টান লাগছে, হয়তো জোরে কোনোকিছুর সাথে ঠেকেছিল।
— “আমি কোথায়?”
মনে মনে প্রশ্নটা করে সে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, কিছু অস্বাভাবিক হয়েছিল। কেউ ধাক্কা দিয়েছিল। তারপর জোর করে কোথাও নিয়ে আসা হয়েছিল। বলেছিল, আশাও তাদের দখলে। তারপর আদিয়াতের জন্য একটা চিরকুট লেখানো হয়েছিল একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করে।
বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আলোটায় চোখ আটকে থাকে কিছুক্ষণ। আরশীন এবার চোখ সম্পূর্ণ খুলল। এটা কোনো পরিচিত জায়গা নয়। আলোটা হয়তো ইচ্ছা করে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। একটা চাপা ভয় বুকের ভেতর খেলা করে।
কোথায় সে? কারা নিয়ে এনেছে? আশা কোথায়? আদিয়াত কি জানে? আদিয়াত কি বুঝবে ওই লেখার উদ্দেশ্য? কেউ কি খুঁজছে তাকে?
ভোরের আলো একটু একটু করে ঘরে প্রবেশ করছিল। এমন সময় ঘরের বাইর থেকে কারো পায়ের শব্দ ভেসে এলো। আরশীন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল ওইদিকে। তারপর হঠাৎ করেই দরজাটা খুলে গেল। একটা লোক দরজায় দাঁড়িয়ে, তার পেছনে আরেকজন। লোকটা একহাতে আশাকে ধরে রেখেছে। আশার মুখ চেপে বাঁধা, চোখে আতঙ্ক। ওর হাতগুলোও দড়িতে বাঁধা, শরীরটাও ভেঙ্গে গেছে। আরশীনকে দেখে দৌড়ে আসতে চাইল। কিন্তু লোকটাই ওকে ঠেলে দিল আরশীনের দিকে। হিম হয়ে যাওয়া বাতাসে আরশীনের শ্বাস আটকে এলো।
— “নাও, দুই বোন খানিক গল্প করে নাও। পরে হয়তো আর সময় পাবে না। অ্যাই সিদ্দিক, এই দুটোর উপর ভালো করে নজর রাখিস। ভাইয়ের অর্ডার।” লোকটা বলল ঠাণ্ডা গলায়, ঠোঁটের কোণে হালকা একটা বিদ্রুপের হাসি।
আরশীন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দরজাটা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। ও এগিয়ে এলো আশার কাছে। আরশীনের হাত-পা, মুখ কিছুই বাঁধা ছিল না। ও আশার বাঁধন খুলে দিতেই বোনকে জড়িয়ে ধরে আশা কান্না করে ফেলল।
— “কাঁদিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।” আশার চোখ মুছে দিয়ে বলল আরশীন।
— “আপু, ওরা আমাদের শহর থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি কিছুই ঠিক হবে না। আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ওদের একজন মাস্টারমাইন্ড আছে। আমি আবছা আবছা শুনেছি কিছু নাম… উফফ, মনে পড়ছে না এখন।” গলাটা কেঁপে উঠল আশার।
— “শান্ত হ, এইভাবে কান্নাকাটি করে কিচ্ছু হবে না।”
— “কে জানে এখন আমাদের খোঁজও কেউ জানে কিনা, এখন কি হবে বলো?”
— “ভালো-মন্দ কিছুতো একটা হবে। ওরা আমাকে দিয়ে একটা চিঠি লিখিয়েছিল। এমনভাবে লিখিয়েছে যেন মনে হয় আমি নিজের ইচ্ছায় সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি। ওটা আদিয়াতকে বোঝানোর উদ্দেশ্য লেখা হয়েছিল। এতক্ষণে হয়তো ওর হাতে সেটা পৌঁছেও গেছে। আমি যদি খুব ভুল না করে থাকি, আদিয়াত নিশ্চয়ই বুঝে গেছে ঘটনার রহস্য।”
— “বুঝলেও কি? ভাইয়া তো জানে না আমরা কোথায়? সে কীভাবে আসবে?” আশার গলায় হতাশা।
— “চিন্তা করিস না আশা। তোর ভাইয়া এতটাও বোকা না। ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করছে… করবেই। শুধু একটু ধৈর্য্য ধর।”
আরশীন আশার হাত শক্ত করে ধরে রাখল। আশা ওকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদেই চলছে। নিজের জন্য না। মায়ের কথা ভেবে। মা একা একা কীভাবে সব সামলাচ্ছে? চাচা তাকে খুঁজবে না মাকে সামলাবে? আরশীন কাঁদল না। সে জানে, এটা ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্ত নয়। তাকে দিয়ে চিরকুটটা লেখানো হয়েছিল গাড়িতেই, ওদের চোখের সামনে। ওরা শর্ত দিয়েছিল, ছোটবোনকে বাঁচাতে চাইলে এটা করতেই হবে। আরশীন ফের হতবাক! আশাও? আশাও ওদের কবলে? তারপর আর কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই এক সমুদ্র চোখের পানি ফেলে লিখে গেল অনবরত। সেও এমনভাবে লিখল যাতে আদিয়াত কিছু বুঝতে পারে। প্রথমত সম্বোধন করল তুমি করে, যা কখনোই করে নাই। তারপর একটু নাটকীয়তা আনার চেষ্টা করল। এতে আরশীনের উদ্দেশ্যও সফল হলো আর ওই লোকগুলোও কিছু বুঝল না। সাপ মরা আর লাঠি না ভাঙ্গা বোধহয় এটাকেই বলে।
—
আদিয়াতের সারারাত ঘুম এলো না। বিছানায় যেতে পারে নাই। সারারাতটা কাটিয়ে দিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। চোখ বন্ধ করলেই ভেতরটা আঁধারে ভরে যায়, প্রতিটা নিঃশ্বাসে ঘুরে ফিরে আসে বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া। সেই ভয়াবহ মুহূর্তগুলো তাকে ভয়াবহভাবেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আরশীনের মুখটা ভেসে ওঠে… সেই চোখের দৃষ্টি, যা সবসময় নির্ভরতা দেয়, যা ভালোবাসার আশ্রয়; সব সত্য জানার পর সেখানে কি আর ভালোবাসা থাকবে? যদি সেখানে ঘৃণা আর অবিশ্বাস জন্ম নেয়, তখন আদিয়াত কি করবে?
বসার ঘরে আলোচনা চলছিল। নাজনীন সোফার কোণে বসে ছিলেন গভীর চিন্তায়। তার কপালে ভাঁজ, চোখে ক্লান্তির ছায়া আরশীনকে ঘিরে। বারবার বলছিলেন,
— “আদিয়াতের হঠাৎ কী হলো? আরশীন কোথায়?”
জহিরুল ইসলাম পাশে বসে ছিলেন গম্ভীর নীরবতায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— “কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না, নাজনীন। সব যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আগের দিনগুলো কী শান্ত ছিল, কত ভালো ছিল আমাদের মেয়েগুলো, এখন কী হলো? সব শেষ হয়ে গেল। আমার মেয়েটার সংসারটা ধুলিসাৎ হয়ে গেল। এখনো নীরার মুখটা মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী নিরীহ, শান্ত মুখ।”
ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে নামছিল আদিয়াত। বাবার কথাগুলো তার কানে এসে লাগল কাটা ঘায়ে লবণের মতো। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। চোখে তীব্র তীক্ষ্ণতা। ঘরে ঢুকেই বলল,
— “পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিজেরা করতে না জানলে প্রকৃতি করিয়ে নেয় জোর করেই। গা ঢাকা দিয়ে কয়দিন থাকা যায়? একদিন না একদিন তো সব উন্মোচন হবেই, তাই না?”
জহিরুল ঘুরে তাকালেন। কী বুঝলেন কে জানে? বললেন,
— “বাবা! আরশীনের কী খবর? কোথায় ও?”
আদিয়াত মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “মা, তুমি একটু অন্য ঘরে যাও। আমার কথা আছে।”
— “কার সাথে?” নাজনীনের কণ্ঠে কৌতূহল।
আদিয়াত চোখের ইশারায় জহিরুল ইসলামের দিকে তাকাল। তাতে অনুচ্চারিত একটা শব্দ ছিল। নাজনীন খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন। আদিয়াতের চোখে এমন কিছু ছিল, এমন দহন, যা তাকে আর প্রশ্ন না করে উঠে যেতে বাধ্য করল।
জহিরুল ইসলাম হঠাৎ অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কপালের ভাঁজে উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করলেন,
— “কি হয়েছে, আদিয়াত?”
আদিয়াত সামনের সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে জিজ্ঞেস করল,
— “আরশীন কোথায়?”
জহিরুল চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
— “মানে? এই কথা তুমি আমায় জিজ্ঞেস করছো আদিয়াত? আমি কীভাবে বলব? এটা তো তোমার জানার কথা!”
আদিয়াত ঠান্ডা গলায় বলল,
— “বসুন। বসে কথা বলুন। এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো? ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেছি কেবল। বাদবাকি সব তো এখনও বললাম-ই না। বলুন, আরশীন কোথায়?”
নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না জহিরুল। আচমকা কণ্ঠ উঁচু করে ধমকের সুরে বললেন,
— “আদিয়াত! তুমি আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলছো? নিজের বউয়ের খবর নিজেই খুঁজে বের করতে পারছো না?”
আদিয়াত সামান্য হাসল। সেই হাসির ভেতরে শীতল বিদ্রুপের ছায়া খেলে গেল,
— “কে বলেছে পারছি না? ওকে তো আমি খুঁজেই বের করব। আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিষয়টা সহজ করে নেওয়ার জন্য।”
— “মানে?”
আদিয়াত মুখ ফিরিয়ে বলল,
— “মানে কি বলব আপনাকে?”
জহিরুল কিছুটা ধাক্কা খেলেন, সেই সঙ্গে অবাকও হলেন। আদিয়াত তাকে ‘আপনি’ করে বলছে। ‘বাবা’ বলেও ডাকছে না। তিনি বললেন,
— “কী হয়েছে তোমার? এমন করে কথা বলছো কেন? পাগল হয়ে গেছো নাকি?” তার কণ্ঠে বিস্ময়।
আদিয়াত ঠান্ডা গলায় বলল,
— “পাগল হয়ে যেতে পারলে তো বেঁচে যেতাম। কিন্তু আপনি যা করেছেন তা শুনে বা জেনে পাগল হওয়া কঠিন।”
— “আমি কি করেছি? তুমি ঠিক করে বলো তো।” জহিরুল অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করে ওঠেন।
আদিয়াত গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
— “আপনাকে তো আমি মাথার ওপর জায়গা দিয়েছিলাম। আপনি নিজেই সেই জায়গাটা পায়ের নিচে মাড়িয়ে ফেললেন। আরশীনের বাবাকে কেনো খুন করলেন? উনি আপনার কি ক্ষতি করেছিল? এই মুহুর্তে আপনি শুধু একজন খুনি না, আপনি বিশ্বাসঘাতক। পরিবার ধ্বংসকারী।”
.
.
.
চলবে….