তবুও তুমি পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
211

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩৭]
~আফিয়া আফরিন

(অন্তরালের আলো)
আদিয়াতের কথা শোনার পর জহিরুল ইসলাম একদম চুপ রইলেন। তারমধ্যে কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। চোখের কোণাটা টনটন করতে লাগল, যদিও সেটা প্রকাশ করলেন না। টেবিলের ওপর রাখা চশমাটা নাড়াচাড়া করছিলেন তিনি। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। সোফায় বসে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— “ঠিক বলেছ কিন্তু বিশ্বাস করো, কিছু কিছু জিনিস আমাদের হাতের বাইরে চলে যায়। অন্যায় পথ অবলম্বন করা ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকেনা।”

উনি শান্ত থাকলেও আদিয়াত থাকতে পারল না। ওর সমস্ত প্রতিরোধে বিস্ফোরণ ঘটেছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে এক লহমায়।
— “দোষ করেছেন আপনি। শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল আপনার। অথচ আপনি আরেকজনের মাথার উপর থেকে ছায়া তুলে নিলেন। পরিবারের ভরসা, সম্মান সবকিছু পিষে দিলেন নিজের অহংকারে?
আংকেল যেহেতু আপনার শত্রু ছিলেন, তবে শত্রুর মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে কেন করালেন? এটা কি আপনার প্রতিশোধের একটা চাল ছিল?”

জহিরুল ইসলাম রাগ দেখালেন না বরং থমথমে কণ্ঠে বললেন,
— “আদিয়াত, থাক। এইমুহূর্তে এসব বলা ঠিক না। আরশীন কোথায় তা জানা দরকার। ওর খোঁজ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

আদিয়াত আরও এক পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। চোখে ক্ষোভের ঝড়,
— “আমি উত্তর চাই। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমি সত্যিটা জানতে চাই। বিয়ের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী ছিল? আপনি ওকেও মিথ্যা বলেছেন।”

তিনি দৃষ্টি নামিয়ে বললেন,
— “কি বলব এখন? সবটাই তো জেনে গেছো তুমি। কিন্তু যা হয়েছে, তা তো কেউই চাইনি…”
— “আমি যেটুকু জানি না সেটুকু বলুন। বিয়েটা কিসের হাতিয়ার ছিল? প্রতিশোধের, ক্ষমতা জাহিরের, নাকি নিজের পাপ ধুয়ে ফেলার প্রয়াস?”

জহিরুল ইসলাম চোখ বন্ধ করে বললেন,
— “শুরুতে ভেবেছিলাম নিজের স্বার্থ হাসিলের সুযোগ পাব। কিন্তু পরে তোমাদের দুজনকে একসাথে একই বন্ধনে বেঁধে দেওয়ায় আর নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করতে ইচ্ছে করল না। বুঝলাম দেরি হয়ে গিয়েছিল, অনেক বেশি দেরি…”
আর মিথ্যা লুকিয়ে রাখার কোনো মানে নেই। সত্য ধরা পড়েই গেছে। আদিয়াত সবটা জেনে গেছে। কিন্তু কীভাবে? কে বলল? রেজা? নাকি নিজেই খুঁজে বের করল?
একটা শীতল শ্বাস ফেলে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক চেষ্টা করেছিলেন, সবকিছু লুকাতে। যতদূর সম্ভব কভার আপ করেছিলেন। অনেক লোক লাগিয়েছিলেন সব মুছে ফেলতে, পাল্টে দিতে। একটা সময় তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রেজা হাল ছাড়েনি। সে খুঁজে গেছে একের পর এক, নিজের মতো করে। হয়তো সেই লাইন ধরেই আদিয়াত পৌঁছে গেছে শেষপ্রান্তে। চোখ বন্ধ করে চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। যে তীর আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়েছিলেন সেটা এখন তার বুকে এসে বিঁধছে।
ভাবনা-চিন্তা ছুঁড়ে ফেলে তিনি বলতে শুরু করলেন,
— “আসলে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। এহসান ছিল আমার খুব ভালো বন্ধু। শুধু বন্ধু না, মানুষ হিসেবেও খুব ভালো, নীতিবান, সোজাসাপ্টা লোক। ওর মতো মানুষ কমই দেখা যায়। অথচ সেই মানুষটার চোখে একসময় আমি শত্রু হয়ে উঠলাম। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। একটা সময়, এক সভায় রেজার সঙ্গে পরিচয় হয়। রেজা আগে থেকেই আসামি টাইপের, নামের পাশে মামলা নেই এমন দিন কমই গেছে, কিন্তু কোনো জোরালো প্রমাণ না থাকায় বেঁচে যেত বারবার। তাই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলত।
রেজা অবৈধ ড্রাগস ব্যবসায় জড়িত ছিল। সেই জগতে টান পড়ে গেলাম আমিও। প্রথমে ভাবিনি এতটা গভীরে যাব। কিন্তু একবার ঢুকে গেলে আর বের হওয়া যায় না। ক্ষমতা, অর্থ, প্রভাব সবকিছু আকর্ষণ করে। সেই খবর একসময় এহসানের কানে পৌঁছায়। সে কিছু আঁচ করে ফেলেছিল। রেজার বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজতে গিয়েই আমাকে ধরে ফেলে সে। বন্ধুর চোখে তখন আমি একজন অপরাধী, বিশ্বাসভঙ্গকারী।
আমি জানি, তখন আর বন্ধু ছিলাম না। ওর নীরব প্রতিরোধ আমার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আমার শেষটা তখনই লেখা হয়ে গিয়েছিল। এহসান অনেকগুলো প্রমাণ জোগাড় করে রেখেছিল, একটা মেমোরি কার্ডে। বহুবার চেয়েছি, বুঝিয়েছি কিন্তু সে কিছুতেই শুনছিল না। শেষমেশ, নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমাকে এই পন্থা অবলম্বন করতেই হলো। বিশ্বাস করো, এটাই ছিল একমাত্র উপায়।”
তিনি থেমে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলেন। আদিয়াতের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসটা পেলেন না। তাকালে হয়তো দেখতে পারতেন, তার বড় ছেলের চোখে তার জন্য ঘৃণা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তিনি পুনরায় বলতে শুরু করলেন,
— “আরশীনকে আমি আগেই চিনতাম। শান্তশিষ্ট, সংযত কিন্তু স্বভাবটা ওর বাবার মতোই জেদি, একরোখা। সহজে কিছু ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে না। আমার ধারণা, এহসান হয়তো কিছু একটা বলে ফেলেছিল ওকে। ব্যস, আরশীন বুঝে গেল তার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তখন থেকেই শুরু করল নিজের মতো করে অনুসন্ধান। ছোট ছোট সূত্র জড়ো করতে থাকল, অনেকটা পোকা ধরার জালের মতো। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, ওকে কাছে রাখতে হবে। চোখের সামনে। ওর গতিবিধি, চিন্তা, সংশয় সব জানতে হবে। তাই, ওর সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছিলাম। যাতে আমি ওর মাথার ভেতরটা বুঝতে পারি। নিজের প্রতি ওর বিশ্বাস জন্মাতে চেয়েছিলাম, সফলও হয়েছিলাম।”

উনার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঘর কাঁপিয়ে আদিয়াত হো হো করে হেসে ওঠে। হাসিটা কোনো আনন্দের ছিল না, ছিল তীব্র ব্যঙ্গের, ক্লান্তির, অপমানের উপহাসে মোড়ানো।
— “বাহ, মিস্টার জহিরুল ইসলাম। কী অসাধারণ বুদ্ধি আপনার মাথায়! সত্যি বলতে, প্রশংসা না করে পারছি না।”

জহিরুল মাথা নিচু করে বললেন,
— “আমি জানি আমি ভুল করেছি। অনুশোচনায় পুড়ছিলাম। তোমাদের অনাগত সন্তান, এই নিষ্পাপ জীবনটা, পিষ্ট হয়েছে আমার কারণে। আমি প্রতিটা সেকেন্ড কাটিয়েছি একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে। আমিও তো বাবা, এই কষ্টটা বোঝার মত ক্ষমতা আছে আমার। কিন্তু কিছু করতে পারছিলাম না। বাবা হিসেবে বড্ড অপরাগ…” তিনি আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আদিয়াত হাত উঠিয়ে চোখের ইশারা করে তাকে থামিয়ে দিল। বলল,
— “বাবা? শব্দটা আপনার মুখে মানায় না। এই সম্পর্কে আপনি একটাও কথা বলবেন না। আমি শুনতে চাই না। আপনি তো আমাকে সারা জীবনের জন্য ছোট করে দিলেন আরশীনের কাছে। বুঝতে পারছেন না? আপনার কাজের পর আমি কীভাবে ওর চোখের সামনে দাঁড়াব? আমার জন্মদাতা পিতা কিনা, আমার স্ত্রীর বাবার খুনি! কী পরিচয়ে ওর সামনে দাঁড়াব আমি? ও যদি জানতে পারে খুব কাছের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তখন কি অবস্থা হবে, এসব কখনো ভেবে দেখেছেন? কিসের অভাব ছিল আপনার? সারাজীবন পরিশ্রম করে এই বয়সে এসে এসব কি করলেন? ছেলে হিসেবে আমি লজ্জিত। আপনি আজ থেকে আমার কেউ নন।”
শেষ কথাটা একটা ফাঁকা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলো নিঃশব্দে। জহিরুল ইসলাম কিছু বলতে পারলেন না। ঘরে ঝিম ধরা নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল।
কণ্ঠে দগ্ধ অনুতাপের ছায়া রেখে বললেন,
— “তোমার চোখে আজ আমার জন্য যে ঘৃণা দেখছি, তার ওজনটা আমি জানি বাবা। এই বয়সে এসে এমন এক বোঝা বয়ে বেড়ানো সহজ নয়। কিন্তু সত্যকে আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। তুমি যাও, আরশীনের কাছে যাও। আমি জানি ও কোথায় আছে। সম্ভবত রেজার হাতের নাগালে। এই নাও, ঠিকানা দিচ্ছি। দোষ যেহেতু আমার, তাই লজ্জা আর দায়ও আমার। তোমাদের কিছুই নিতে হবে না। অন্যায়টা আমি করেছি, তার শাস্তিও আমার একার। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। ধরা দেব। কিন্তু তুমি আগে ওকে ফিরিয়ে আনো।”

আদিয়াত কিছু বলল না। শুধু একরাশ বিষন্নতা নিয়ে হাসল। বুকের ভিতর কোথাও একটা ব্যথা চাপ দিয়ে উঠল। ঠিকানাটা পকেটে রেখে বেরিয়ে পড়ল। দরজার কাছাকাছি পৌঁছতেই পেছন থেকে আবার ডাকলেন জহিরুল,
— “এই ষড়যন্ত্রে আরেকজনও লুকিয়ে আছে। তুমি গেলে হয়তো বুঝতে পারবে।”
আদিয়াত আর পেছনে তাকাল না। ওর মনে হলো, ও বুঝে গেছে সেই ব্যক্তিটা কে। গাড়ি স্টার্ট দিল। রাস্তাটা শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে…

পেছনে, জহিরুল ইসলাম ধীরে ধীরে গিয়ে বসে পড়লেন সোফায়। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। বুকের মাঝে একমুঠো আগুন চেপে ধরেছে। ডান হাতে বুক চেপে অসহ্য ব্যথাটা নিরসনের চেষ্টা করলেন। পারলেন না, ওই ব্যাথা আরো চেপে ধরল। মনে হচ্ছে, কেউ গলা টিপে ধরেছে ভিতর থেকে। হাত কাঁপে, মাথা নিচু হয়, হৃদয় হিম হয়ে আসে। তার ছেলেদের জন্য কম কিছু তো করলেন না। জীবন দিয়ে ভালোবাসলেন, ছোটোবেলা থেকে রাতের পর রাত কাটালেন ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে; সেই ছেলের চোখে আজ তার জন্য তীব্র ঘৃণা। আযহান জানলেও কি এমনই করবে? নিজের রক্ত যে তাকে এভাবে এড়িয়ে যাবে, চোখের দিকে তাকিয়ে থু থু ছুঁড়ে দিবে; তা কোনোদিন সহ্য করতে পারবেন? পরক্ষণেই ভেতরের গলার স্বর বলে ওঠে, আদিয়াত তো ভুল কিছু বলেনি। অন্যায় তো সেই করেছে।
এই স্বীকারোক্তিটুকু হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারছেন তিনি। নিজের আত্মসম্মান, পিতৃত্ব, জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, সবকিছুর সামনে আজ একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন! অপরের ক্ষতি করে সে কী জিততে চেয়েছিল? কোন রাগে, কোন স্বার্থে, কোন প্রতিশোধে সে এমন পথ বেছে নিয়েছিল; তা নিজেও ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। এত বছর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন অথচ নিজের ছেলের সামনে আজ একজন অপরাধী ছাড়া আর কিছু না তিনি।
জহিরুল ইসলাম পুলিশে ফোন করলেন। আরশীনের অবস্থার কথা সংক্ষেপে জানিয়ে নিজেও দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন।
.
আদিয়াত ঘোরের মধ্যে রয়েছে। বাস্তব আর দুঃস্বপ্ন গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর হিংস্র একদল শব্দ একসাথে চিৎকার করছে। কেউ বলছে বিশ্বাসঘাতকতা, কেউ বলছে ব্যর্থতা, কেউ বলছে সর্বনাশ।
“না না না… এটা মিথ্যা… সবটা ভুল… এটা একটা দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই সব আবার দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।” নিজেকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল আদিয়াত। কিন্তু চারপাশের নিস্তব্ধতা, স্টিয়ারিংয়ে হাতের কাঁপুনি, বুকের ভেতর দম আটকে আসা, সবকিছু এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার জানান দিচ্ছে।
গাড়ির গতি কখনো ৮০, কখনো ১০০ পার হয়ে যাচ্ছে। ওভারটেক করতে করতে রাস্তাও মনের মতো পথ দিতে চাচ্ছে না। আদিয়াতের দুই চোখের দৃষ্টি কুয়াশায় আচ্ছন্ন, অথচ চালিয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া। ভাগ্যিস এখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নাই, হয়তো সৃষ্টিকর্তাও এইমুহূর্তে তার শূন্যতা বুঝতে পেরে একটু ধৈর্য ধরেছেন।

এতটা অসহায়, এতটা দিশেহারা আদিয়াত নিজেকে আগে কখনো দেখেনি। চোখের সামনে মুহূর্তে ভেসে উঠছে সবকিছু। এইতো সে যাচ্ছে… আরশীনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কোন মুখে? সে জানে না তবে আরশীনকে তো আগলাতে হবে। আদিয়াতের ভেতরে এক প্রবল ভাঙচুর চলছিল তাও সে এগিয়ে গেল…

রেজা অনেকক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছে আরশীনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে। কিন্তু আরশীন? সে দেয়ালের মতো নির্বাক, অনড়। এই মেয়েটা কথা শোনার পাত্রী না, বোঝারও না।
— “শুনেন ম্যাডাম। আপনাকে তো অর্ধেক সত্য বলে দিলাম। বাকিটা শুনবেন না? আপনার বাবার খুনের মাস্টারপ্ল্যান কার ছিল, জানতে চাইবেন না?” রেজা ঠোঁটের কোণে কুৎসিত হাসি ঝুলিয়ে বলল।

আরশীন নিঃশব্দে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বুকের ভেতর জমে থাকা রক্তের ঢেউ পাঁজর কাঁপিয়ে উঠল। আগুন দৃষ্টিতে তাকাল রেজার দিকে। তার বাবার খুনি, তার সামনে বসে আছে। কথা বলছে ঠান্ডা মাথায়।
— “কে?” দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল।

রেজা হেসে উঠল, বিষাক্ত হাসি।
— “আপনার শশুর মশাই। দেখলেন তো কীভাবে সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে গেল?”
আরশীন আশা একে অপরের দিকে তাকাল। রেজার কথা বিশ্বাস করার প্রয়োজন’ই মনে করছে না। আর রেজা তখন শান্ত পাখির মতো গুনগুন করে বলল,
— “আপনার বিশ্বাসের বুননে যে ছিদ্র নেই, সেটা তো বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম। সবাইকে বিশ্বাস করতে নেই।”

ঘরটা থমথমে হয়ে আছে। জানালার ফাঁক দিয়ে পড়া ম্লান আলোয় রেজার মুখটা আরও ছায়াঘেরা, ছলনাময় মনে হচ্ছে। আরশীন চেয়ারে বাঁধা, মুখে তীব্র বিরক্তি আর রাগ। রেজা একের পর এক বক্রোক্তি ছুঁড়ে দিচ্ছিল, আর আরশীনের স্নায়ু দিয়ে আগুন ছুটে যাচ্ছে। নেহাত হাত বেঁধে রেখেছে, নয়তো এতক্ষণে চড়ে-থাপ্পড়ে মুখ ভেঙে দিতো সে। তার চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে, আর মাত্র একটু সময় বাকী সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার। আরশীন এক ঝটকায় দড়ি বাঁধা হাত ছাড়াতে চাইল, মুখে বেদনা আর কষাঘাত মিলেমিশে একাকার হয়েছে। রেজা হেসে এগিয়ে এলো,
— “আরে আরে, এত তেজ কোথা থেকে এলো?”

সে দাঁতে দাঁত চেপে শ্বাস টানল,
— “একবার শুধু হাত খুলে দাও… তারপর দেখাচ্ছি কোথা থেকে এলো এই তেজ!”
রেজা বিকৃত ভঙ্গিতে হাসলো। এদের ধরাশায়ী করা সহজ না। সে উঠল। আপাতত থাকুক, দুটোদিন যাক। এরমধ্যে সহজে আপোষ না করলে আবার অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

আদিয়াত এসে পৌঁছাল। এটা রেজার গোপন ডেরা। সব কাজকর্মের হিসেব এখানে গচ্ছিত রাখে। গাড়িটা কিছুটা দূরে রেখেই এসেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, একটা প্রলয়ংকারী ঝড় এদিকে এগিয়ে আসছে।
ধম্‌ম্‌ম্ করে দরজার একটা পাল্লা ভেঙে ঢুকে এলো আদিয়াত। চোখের দৃষ্টি বিদ্যুতের মতো তীক্ষ্ণ। মুঠো শক্ত। রেজা তাকাতে না তাকাতেই, এগিয়ে গিয়ে ওর কলার চেপে ধরল। একটুও সময় নিলো না আদিয়াত। প্রথম ঘুষিটাই রেজার গাল কেটে দিয়ে গেল। দ্বিতীয়টা পেটের মাঝ বরাবর। তৃতীয়টা কানের কাছে, ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়ল রেজা।
ওদিকে আরশীন আর আশা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো কিন্তু ঠোঁটে হাসি। আশার দিকে তাকিয়ে তিনি বলল,
— “বলেছিলাম না, তোর ভাইয়া আসবে।” আশা একপ্রকার খুশিতেই কান্না করে ফেলল।

এদিকে রেজা কিছু বলার চেষ্টা করলেও আদিয়াত তাকে দাঁড়াতে দিল না। চুল ধরে টেনে তুলল, আবার মারল, পাশের টেবিল ভেঙে পড়ে গেল। ঘরের জিনিসপত্র তছনছ হয়ে গেল চোখের পলকে। আরশীনের মনে ভয় ধরে গেল। আদিয়াত এমন করছে কেনো? এমন পাগলাটে আচরণ ওর সাথে মানাচ্ছে না। আরশীন চেঁচাল,
— “আরে এইভাবে মারলে মরে যাবে। আপনি ছাড়ুন ওকে। এমন করছেন কেনো?”
আদিয়াত ওকে ছাড়ল। এমনভাবে ছেড়ে দিল যে রেজা ধপাস করে পড়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে প্রতিরোধের সময় পায় নাই। আর এখন শরীরে একফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই। নিচে পড়ে জীবন বাঁচানোর জন্য কাতরাচ্ছে, আহাজারি করছে।
আদিয়াত এসে আরশীন আশার হাতের বাঁধন খুলে দিল। আরশীন এগিয়ে এসে আদিয়াতকে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে আপনার? আপনি এরকম করছেন কেনো?”
— “আমি…”

আদিয়াত আরশীনের কথোপকথনের ঠিক মাঝখানে হঠাৎ সরাসরি ঢুকে পড়লেন বিলাল হক। উনাকে দেখামাত্রই আশা দৌড়ে গেল। শুধু আদিয়াত নয়, চাচাও এসেছে তাদের নিয়ে যেতে। তিনি প্রথমে কিছুটা হতচকিত হয়ে তাকালেন চারপাশে। তার চোখ আটকে গেল রেজার দিকে, মেঝেতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। এককোণে দাঁড়িয়ে আছে আরশীন আদিয়াত।
উনি কিছুটা ভাণ করে গলার গভীর থেকে মিনমিন স্বরে বললেন,
— “জামাই, এসেছো? আমিও এসেছিলাম ওদের খোঁজ পেয়ে… চলো চলো, এবার এখান থেকে চলি।”

তিনি পিছু ফিরতেই না ফিরতেই আদিয়াত গর্জে উঠল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে কলার চেপে ধরল সে। মুখটা একদম কাছে এনে দৃঢ়স্বরে বলল,
— “এত তাড়া কীসের, চাচা সাহেব? দাঁড়ান। আগে হিসাবনিকাশটা চুকিয়ে নেই। তারপর যাওয়া যাবে।”

চাচা নিজেকে সামলে নিয়ে একটু শক্ত গলায় বললেন,
— “এসব কী বেয়াদবি হচ্ছে? কীসের আবার হিসেব? আমি তো শুধু আমার মেয়েদের নিতে এসেছি। ওদের পেয়েছি, এরচেয়ে বেশি কিছু চাই না। আরশীন মা, আশা মা, চলো তো।” তার কণ্ঠের অধিকারবোধে মনে হচ্ছে, দুনিয়ার সবকিছু ফেলে শুধু এখনকার উপস্থিতিই যথেষ্ট। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন মেয়েদের দিকে।

কিন্তু ঠিক তখনই আদিয়াত আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে তার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল। চোখে আগুনের মতো জ্বলছিল রাগ। কঠিন কণ্ঠে বলল,
— “আপনাকে আমি এখন ঠিক কী করি বলুন তো, চাচা? রেজার মতো নিচে ফেলে মারতে পারি না। কারণ, এখনো কিছু সম্মান রেখে চলছি। তাই বলছি, যতটুকু সম্মান করছি ততটুকু বজায় রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। মেয়েদের কী হবে, সেটা আপনাকে ঠিক করতে হবে না।”

আরশীন এগিয়ে এসে রীতিমতো ধমক দিয়ে বলল,
— “আদিয়াত! আপনি কী করছেন? কী বলছেন? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেনো?” ওর গলায় বিস্ময়ের সাথে রাগের মিশ্রণ। এর আগে কখনো আদিয়াতের এমন বেপরোয়া রূপ দেখে নাই।

পাশ থেকে আশাও যোগ করল,
— “ভাইয়া, আপনি চাচার সাথে এমন করছেন কেনো? উনি তো আমাদের উদ্ধার করতে এসেছেন।”

আদিয়াত বাঁকা হেসে ওদের দিকে তাকাল। দৃষ্টিতে ঠান্ডা বিদ্রুপ আর জমে থাকা রাগ। ঠোঁটের কোণ টেনে বলল,
— “উদ্ধার?” একটু থেমে আরও জোরে হেসে বলল, “উনি তোমাদের উদ্ধার করবেন? বেস্ট জোকস অব দ্যা ইয়ার।”
আরশীন আশার মুখের অভিব্যক্তি আচমকা বদলে গেল। আদিয়াত আবার বলল,
— “এই রেজাউল করিম, বিলাল হক আর জহিরুল ইসলাম এরা কিন্তু সরাসরি তোমাদের বাবার খুনের সাথে জড়িত। জানো তোমরা?” ওর গলায় কোনো ঠাট্টা ছিল না, ছিল সত্যের ধারালো শান।
আরশীন কিছু বলতে চাইল কিন্তু শব্দ বের হলো না। বুকের ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি হলো। ঠোঁট কেঁপে উঠল। চোখে অস্থিরতা। এটা… এটা সে ঠিক কী শুনল? মাথার ভেতর ঝড় বয়ে গেল। সে ঘুরে তাকাল চাচার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই সে দেখতে পেল, চাচার দৃষ্টিতে লুকোচুরি। অপরাধবোধ? ভয়? না কি ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক? চাচার মুখটা এবার আর আগের মতো দৃঢ় নয়। চোখজোড়া এড়িয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি। কিছু লুকাতে চাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না।
আরশীন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
— “আপনি… আপনি কী বলছেন?”
— “সত্যিই বলছি।”

আরশীন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সে হোঁচট খেতে খেতে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। ঠিক বসা নয় মনে হলো, ভেঙে পড়ল। আশা দৌড়ে চাচার দিকে এগিয়ে এলো,
— “চাচা, এটা কী বলছে ভাইয়া? আপনি কিছু বলেন।”
কিন্তু সে বুঝতে পারেনি, তার সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে, সে আর আগের চাচা নেই। মুহূর্তের মধ্যেই মুখোশ ঝরে পড়ল। বিদ্যুতের মতো ক্ষীপ্র গতিতে আশার হাত চেপে ধরল। বিষভরা কণ্ঠে বলল,
— “যখন সব জেনেই গেছো, তখন আর লুকোচুরি করে কী হবে? হ্যাঁ আমরা; আমি, রেজা আর জহির মিলে খুন করেছিলাম তোমাদের বাবাকে।”
একটা থমকে দেওয়া নিঃশ্বাস নিল সে। তারপর নিঃসংকোচে বলল, “একটা সত্য জানার জন্য তোমাদের বাবার জীবন নিতে পেরেছি আর এখন, নিজেকে বাঁচাতে হলে তোমাদের জীবন নিতেও হাত কাঁপবে না আমার।”
আরশীন আর আশার চোখে পানির বদলে অবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩৮]
~আফিয়া আফরিন

(স্বীকারোক্তির অবসান)
খেলার মোড় ঘুরে গেল এক পলকে। রেজার গলা চিরে এক চিৎকার বেরোল,
— “কোথায় আছিস তোরা সব?”

চারপাশে থেকে হুট করেই দৌড়ে এলো রেজার সাঙ্গপাঙ্গরা। ওরা এতক্ষণ আশেপাশে ছিল না। ঝামেলার গন্ধ পেয়ে সবকটা ছুটে এসেছে। সবার হাতেই আক্রমণের জন্য কিছু না কিছু রয়েছে। বোঝা গেল, বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।
বিলাল হকের হাতে তখনও আশা। তিনি রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “আহাম্মকের দল। কাজের সময় কোথায় থাকিস? ধর সবকয়টাকে। আমার পথে যারা বাঁধা হয়ে আসে তাদের আমি সহজে ছেড়ে দিব না।”

আদেশ আসার সাথে সাথেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু ঠিক সামনে গিয়েই সব থেমে গেল। কেউ ঠিকমতো ব্যালান্সই রাখতে পারল না। আর তার আগেই শুরু হয়ে গেল এলোপাথাড়ি মার। চোখের পলকে লাঠিগুলো ঘুরে এলো, কোনো কোনো লাঠি ভেঙে গেল পিঠে, আর মুখে থাপ্পড় এমনভাবে বসলো যাতে চেহারাছবি-ই বদলে যায়। আদিয়াত ছাড়ল না কাউকে। একটার পর একটা থাপ্পর, ঘুসি, লাথি কারা খাচ্ছে, বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ আরশীনের চোখ পড়ল পরিচিত মুখে।
ওই লোকটা… যে তাকে সেইদিন ধাক্কা দিয়েছিল। সেই এক ধাক্কা থেকেই পুরো জীবনটাই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। চোখের পলকে বুকের ভেতর থেকে ছুটে এলো এক অদম্য জ্বালা। আরশীন দম নিল গাঢ়ভাবে। পাশেই পড়ে থাকা লোহার রডের মতো মোটা একটা লাঠি হাতে তুলে নিল। তার হাত কাঁপল না। কিন্তু নিজের মধ্যকার একরাশ জেদ, ক্ষোভ, আর অন্যায়ের হিসাব মেটানোর অদম্য ইচ্ছা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে ছুটে গেল লোকটার দিকে। লোকটা সরে যেতে চাইল, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।
প্রথম ঘায়ে চিত। দ্বিতীয় ঘায়ে একটা আর্তনাদ, এরপর আরশীনের মনে আর কোনো দয়ামায়া কাজ করল না। এই লোকটা কেবল বাবা কিংবা নীরার খুনি নয়, তার অনাগত সন্তানেরও খুনি। হ্যাঁ খুনি-ই তো।

রেজা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে এতক্ষণ কাতরাচ্ছিল। হঠাৎই সে উঠে দাঁড়াল। জানোয়ারের মতো ধূর্ত আর অন্ধ ক্রোধে ভরা। তার হাত কোমরের দিকে গেল। পিস্তল… কালো ধাতব অস্ত্রটা রেজা তাক করল সরাসরি আদিয়াতের দিকে। আরশীন মুহূর্তেই থেমে গেল। সে চিৎকার করে উঠল,
— “আদিয়াত!” সেই চিৎকারে বাতাস কেঁপে উঠল।

আদিয়াত ঘুরে তাকাল। তার চোখে তখনও আগুন কিন্তু রেজার পিস্তল তাকে একমুহূর্তের জন্য স্থির করে দিল। রেজার ঠোঁটে ফাঁসির দড়ির মতো এক ঠান্ডা হাসি। সে বলল,
— “ভাবছিলাম, কাকে আগে উপরে পাঠাব। জামাইবাবু এসে গেছেন।
বোন দুটোও তো কাছে আছে। কেমন হবে বলো? আগে বরং জামাইবাবুকেই আপ্যায়ন করি। তারপর বাকি দুই বোনের চিন্তা করব।”

রেজার কথা শুনে বিলাল হক এগিয়ে এলেন। আরশীন দাঁড়িয়ে গেছে পাথরের মতো। আশা এগিয়ে পাশে দাঁড়াল। আদিয়াত এক পা সামনে এগোল। রেজার হাতে পিস্তল থাকলেও আদিয়াতে চোখে যে আগুন ছিল তা ওই ইস্পাতকেও নড়বড়ে করে দিতে সক্ষম। রেজা পিস্তলটা সরাসরি আদিয়াতের বুকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটে সেই জঘন্য, ঠাণ্ডা হাসি। আঙুলটা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে ট্রিগারের দিকে।
চারপাশে নিস্তব্ধতা। আর আদিয়াত? সে দাঁড়িয়ে আছে নির্লিপ্ত। এক পা-ও নড়ল না। চোখ সরাল না। রেজা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
— “একটুও ভয় নেই?”
— “ভয় পেলে কি সব থেমে যাবে?” আদিয়াত মুচকি হাসল। রেজা থমকে গেল। তার আঙুল তখনও ট্রিগারে। চাপ দিতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে “ধাঁইই” একটা তীব্র গুলির শব্দ ছিঁড়ে দিল চারপাশের নিস্তব্ধতা। আর সঙ্গে সঙ্গে রেজার মুখ বিকৃত হয়ে গেল। সে গর্জে উঠল,
— “আহহহ।”

পিস্তলটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। রেজার ডান হাতে গুলি লেগেছে, রক্ত চুইয়ে পড়ছে। সবাই ঘুরে তাকাল। ধুলোমাখা গেটের পাশ থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন জহিরুল ইসলাম। হাতে ধরা পিস্তলটা থেকে এখনও ধোঁয়া ছাড়ছে। চোখে ঝলসে ওঠা দৃষ্টি। তিনি বললেন,
— “অনেক সহ্য করেছি কিন্তু আজ আর না। আমার ছেলে-মেয়েরা কেউ শিকারে পরিণত হবে না, রেজা। অনেকটা দেরি করে ফেলেছি, জানি। ভুল করেছি। ওদের মত সাহস যদি আমার থাকত তবে এত অনর্থ হতো না। পরিস্থিতি আমাকে অন্যায় করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আজ আর না। এই ক্ষত, এই গুলি, এসব রক্ত শুধু রেজার নয়। আমারও রক্ত লেগে আছে এই অন্যায়ে। তোমরা আমায় ক্ষমা করো, আমি বাবা হয়ে উঠতে পারি নাই।”
রেজা মাটিতে বসে গোঁ গোঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, এক হাতে ক্ষত চেপে ধরেছে। আরশীনের চোখের কোণ ভিজে গেছে, ঠোঁট কেঁপে উঠছে কান্নায়। আদিয়াত তখনও নড়েনি।

জহিরুল ইসলাম পুলিশ নিয়ে এসেছিলেন। তারা রেজাকে তুলে নিল, বাকি দোসরদের হাতকড়া পরাল। এক পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে জহিরুল ইসলামের দিকে ঘাড় নেড়ে বললেন,
— “আপনাকেও আমাদের এক্ষুনি এরেস্ট করতে হচ্ছে স্যার। অন্যায়ের দায় এড়াতে পারবেন না।”
জহিরুল একটুও প্রতিবাদ করলেন না। শুধু চোখ বন্ধ করে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। আরশীন তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
তার চোখে প্রশ্ন, অভিমান, হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে খুব চুপিসারে একটু আশাও। এমনও তো হতে পারে, সব ভুল। তিনি মুখ ফেরালেন না। কোনো কথা বললেন না। চেষ্টা করলেন না একবার “বাবা” হয়ে দাঁড়াতে। হয়তো পারেননি… হয়তো সাহস হয়নি।

রেজা কি এত সহজে হার মানার মানুষ? নিজেকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা তো করাই যায়। এই ধান্দায় হাতের ব্যথাটা ভুলে গেল সে।
বিদ্যুতের গতিতে ঘুরে দাঁড়াল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের কোমর থেকে ছিনিয়ে নিল পিস্তলটা। আর একমুহূর্তের মধ্যেই,
“ধাঁই! ধাঁই! ধাঁই!”
চারদিক কেঁপে উঠল এলোপাথাড়ি গুলির শব্দে। দুজন কনস্টেবল গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। চারপাশে চিৎকার, বিশৃঙ্খলা।
একটা গুলি ছোঁড়া হলো জহিরুল ইসলামের দিকে। ঠিক তখনই
“বাবা” বলে চিৎকার করে তাকে সরিয়ে দিল আদিয়াত। কিন্তু মিস হলো না। গুলিটা হাতে বিঁধে গেল। সে ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। সকলে ছুটে আসে আদিয়াতের দিকে। আরশীন ছুটে আসে। জহিরুল থমকে দাঁড়িয়ে আছেন অচল, হতভম্ব চাহনিতে। কিন্তু রেজা থামল না। সে পিস্তলের শেষ গুলিটা ছুঁড়ে দিল জহিরুল ইসলামের দিকেই।
“ধাঁই।” এইবার গুলিটা সরাসরি গিয়ে বিঁধল জহিরুলের বুকে। তার শরীরটা ধীরে ধীরে নুয়ে এলো, আর মুহূর্তের মধ্যে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। অবস্থা শোচনীয়, বাবা-ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
আরশীন কেমন নির্বিকার। তার মনের ভেতরটা নিস্তব্ধ। সত্য-মিথ্যা, চিৎকার, গুলি, রক্ত, সবমিলে সুনামির মতো ধ্বংস করে দিয়েছে ওর ভেতরটা। কোনো কষ্টই ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না। চোখে পানি নেই। কেবল বুকের ভেতর একটা শূন্যতা। বোধহয় সমস্ত দুঃখ একসাথে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

হাসপাতালের করিডোরটা ভারী হয়ে আছে চাপা নিঃশ্বাসে। শাহানা ছুটে এসেছেন। মেয়েদের দেখে কিছু বলার শক্তি ছিল না তার। জড়িয়ে ধরলেন আর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল জমে থাকা কান্না। নাজনীন দাঁড়িয়ে, চুপচাপ। তার চোখে হাহাকার। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আযহান আর আলিয়ার চোখেও একই অন্ধ বিস্ময়। আলিয়া এসে বসে পড়ে আরশীনের পাশে।
আরশীন তখনও পাথরের ন্যায়। আলিয়া একটু ছুঁতেই, ভেঙে পড়ল। আরশীন জড়িয়ে ধরল ওকে, বুক চেপে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
— “আপু, এটা কী হয়ে গেল? আমি তো এমন চাইনি। সত্যিটা জানার চেয়ে না জনাই ভালো ছিল। আমি তো শুধু চেয়েছিলাম সবাই থাকুক। আমি তো কাউকে হারাতে চাইনি।”

আলিয়া ওকে শক্ত করে ধরে রাখে। তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ে আরশীনের মাথায়।
— “আমার বাবাকে তুমি মাফ করে দাও, প্লিজ। উনি এমন মানুষ ছিলেন না, আরশীন। জানি না কীভাবে হারিয়ে গেলেন অন্ধকারে। যা করেছেন তা মন থেকে করেননি, আমি জানি…”

আযহানও সামনে এসে দাঁড়ায়। মাকে সামলাতে গিয়ে বেশ হিমশিম খাচ্ছিল বেচারা। বলল,
— “আমি তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, বাবা এতকিছুর সাথে জড়িত। তিনি তো আমাদের সুপারহিরো ছিল। কোনোদিন ভাবিওনি, এমন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে হবে। মনে হচ্ছে, কারো অন্য জীবনের গল্পে ঢুকে পড়েছি। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে।”

ঠিক তখনই একজন ডাক্তার দ্রুত পায়ে হেঁটে এলো। সবাই দাঁড়িয়ে গেল। ডাক্তার বললেন,
— “ভয়ের কিছু নেই, আদিয়াত এখন আশঙ্কামুক্ত। গুলিটা হাত ভেদ করলেও মারাত্মক কিছু হয়নি। এখন রক্তচাপও স্থিতিশীল।” আরশীন চোখ বন্ধ করে হাঁফ ছাড়ল। এরপরই ডাক্তার গলার স্বর খানিক নিচু করে বললেন,
— “তবে জহিরুল সাহেব… উনার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। গুলিটা লেগেছে হার্টের নিচে। আর উনি আগে থেকেই হার্টের রোগী।
বয়সের কারণে শরীরও দুর্বল। আমরা উনাকে লাইফ সাপোর্টে রেখেছি। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

ডাক্তার চলে যেতেই নাজনীন এগিয়ে এলেন। ধীরে ধীরে, স্থির পায়ে।
সরাসরি এসে আরশীনের সামনে দাঁড়ালেন। দুটো চোখে দাহের মতো আগুন, যন্ত্রণায় দগ্ধ এক মায়ের চোখ। আরশীন প্রথমে কিছু বুঝল না।
চোখ তুলে তাকাতেই, একটা থাপ্পড় সপাটে এসে পড়ল ডান গালে।
আলিয়ার সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠল,
— “মা, কী করছো তুমি?”

শাহানা এগিয়ে আসতে গেলেন কিছু বলতে কিন্তু আশা এক চোখের ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দিল।
— “এখন কিছু বলার সময় না, মা। এটা আপুর শশুরবাড়ীর ব্যাপার, ও ঠিক সামলে নিবে। আমরা এ ব্যাপারটার মধ্যে ঢুকলে ভালো দেখাবে না।”
আরশীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চোখে পানি, মুখে বিস্ময় কিন্তু প্রতিবাদ নেই। সে তাকাল শাশুড়ির দিকে। নাজনীন কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,
— “ভুল কী করেছি আমি? ওই মানুষটা আর কয়দিন বাঁচত? তবু তাকে এইভাবে মারতে হলো? তুমি এ বাড়িতে আসার পর থেকেই অশান্তি আর অশান্তি। কী করেছো তুমি? সংসারটা নষ্ট করে দিলে।
আমার সব হারিয়ে যাচ্ছে এক এক করে।”

আলিয়া এগিয়ে এলো,
— “মা, ও কিছু করেনি। ও শুধু সত্যিটা জেনেছে… সত্যিটা বলেছে।”

আরশীন তখনও চুপ। বুঝে গেছে, আজ কথা বলে লাভ নেই। চোখে ছলছল জল। গাল বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে না, ভেতর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে কোথাও, যেখানে কেউ দেখতে পায় না। তার ভেতরে একটা কথা কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিল,
— “আমার বাবাকে যারা শেষ করল, সন্তানটাকেও কেড়ে নিল। সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও যদি অশান্তি হয়… তবে শান্তি কী?”

শাহানা আরশীনকে আর একমুহূর্তও এখানে রাখতে চাইলেন না। কিন্তু আরশীন যেতে চাচ্ছিল না আর তিনিও জোর করছিলেন।
— “আমি যাবো না, মা। আদিয়াতের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকব।”

শাহানা কণ্ঠ কঠিন করলেন,
— “না। এখনই যেতে হবে। আমি বলছি।”
এই চাপা উত্তেজনার মাঝে আলিয়া এগিয়ে এলো। বলল,
— “তুমি বাড়ি যাও। আদিয়াতের জ্ঞান ফিরলে আমি তোমাকে ফোন করব।”

আরশীন তাকাল আলিয়ার দিকে। চোখ ভরা প্রশ্ন, ভেতরে অজস্র না বলা ব্যথা।
— “আপু… মা কি আমাকে ভুল বুঝল? আমি কি সত্যিই ভুল করেছি? দোষ না করেও আমি দোষের ভাগীদার হয়ে গেলাম।”

আলিয়া একটুখানি থেমে গলা নিচু করল,
— “দেখো, একজন স্ত্রী হিসেবে যদি দেখি, তাহলে ঘটনাটা মায়ের কাছে সহজ ছিল না। আমি এবং আমরা সবাই জানি, তুমি দোষ করোনি। কিন্তু মায়ের এখন মন ঠিক নেই। সময় লাগবে। তুমি তো জানো, উনি তোমাকে কতটা ভালোবাসেন। তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও। নিজেরও তো একটু নিঃশ্বাস দরকার, তাই না?”
আরশীন চোখ নামিয়ে নিল। আলিয়ার কথা মেনে নিয়ে মায়ের সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
.
আরশীনের মনের ভিতর এখনও ঘূর্ণিঝড় বহমান। সে আর কাঁদতে পারছে না। কান্নার জায়গায় শূন্যতা এসে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির সবারই একই অবস্থা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিজের মত করে কোথায় যেনো আছে। আশা কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে মন হালকা করল। কেউ ওকে শান্তনা দিতে গেল না, কোনো কথাও বলল না। একটা সময় পর নিজেই চুপ হয়ে ঘরে ফিরে গেল।
আরশীনের মাথাটা ভার হয়ে আছে। অনেকটা ধকল গেল না গতকাল থেকে। ওর মস্তিষ্ক এখন ফাঁকা, বোধবুদ্ধি কিছুই নেই। বালিশে মাথা রাখল তবুও ঘুম এলো না। কিন্তু এইমুহুর্তে ঘুমটাই সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল।
রাত তখন অনেক গভীর। চারদিক নিস্তব্ধ, ফ্যানের বাতাসটা খুব কানে লাগছে। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। আরশীন উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতেই শাহানা ভেতরে এলেন। উনার মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, চোখও লাল, ভেতরে জমে থাকা একসাগর কথা। কান্নাকাটি যে বেশ ভালোই করেছেন তা বোঝা গেল। আরশীন কিছু বলল না। নিজে সরে গিয়ে মাকে ভেতরে আসতে দিল। তিনি ঘরে এসে বিছানায় বসলেন। আরশীনকেও ইশারায় পাশের জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। তারপর একটানা তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। বললেন,
— “নিজের মানুষের এমন করে বিশ্বাসঘাতক হবে, আগে কখনও ভাবিনি। মানুষ দূরের হলেও বোঝানো যায়, নিজেকে কিছু বলে শান্তনা দেওয়া যায়। কিন্তু কাছের মানুষ যখন আঘাত করে, তখন সেটা শুধু ব্যথা না; ওটা পুরো বুকের ভেতরটা ফাঁকা করে দেয়। তোর চাচা, তোর বাবার নিজের ভাই, কি করে করতে পারল এমন? একবারও হাত কাঁপল না? একবারও পরিবারের কারো কথা ভাবল না? তোদের কথা একবারও চিন্তা করল না? তোর বাবা নিজের ভাইকে বিশ্বাস করেছিলেন চোখ বুজে, জীবনভর। আমিও করেছিলাম, করতাম। আজ চোখ খুলে দেখি, আমি অন্ধ ছিলাম।”

আরশীন মাথা নিচু করে বসেছিল। ভেতরে জমে থাকা কান্না মাত্র ফুঁসে উঠছে। মা আবার বললেন,
— “তোর বাবার বন্ধু ভাই সবাই শত্রু ছিল। এই শত্রুদের ছায়াতলে তিনি আমাদের রেখে গেছেন। জহির ভাই এটা করতে পারলেন? তিনি যখন তোর বিয়ের কথা বলেছিলেন আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি এই ভেবে যে, বাবা না হলেও বাবার মত কাউকে পাচ্ছিস। উনি এমন করতে পারল? বিশ্বাস ভরসা সবকিছু ধুলিসাৎ করে দিল। আমি তোকে কীভাবে ওই বাড়িতে রাখব বল? কাদের ভরসায়? তোর শাশুড়ি সবকিছুর জন্য তোকে দায়ী করল। অথচ এটা ভাবল না, তুইও বিশ্বাস করেছিলি।”

আরশীনের গলা কেঁপে উঠল। খুব আস্তে বলল,
— “মা আমি এসব চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম সবাই ঠিক থাকুক। অথচ আমি নাকি ওই সংসারটা নষ্ট করে দিয়েছি, সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছি।”
— “তুই কিচ্ছু ভাঙ্গিসনি। তুই শুধু ভাঙ্গা জিনিসগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিস, এটাই তোর দোষ। হওয়ার কথা ছিল, স্বাভাবিক। এগুলো তো পৃথিবীর অনেক পুরোনো নিয়ম।”

আরশীন মুখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “মা, তোমার কষ্ট হচ্ছে না?”

মা একমুহূর্ত চুপ থাকলেন। তারপর নিস্তেজ গলায় বললেন,
— “কষ্ট? সে তো তোর বাবা যেদিন মারা গেল, সেদিনই পেয়েছিলাম।
সেইদিনের পর থেকেই ভেতরটা কেমন একটা ফাঁকা হয়ে গেল। আমি তো বেঁচেও আছি তোদের জন্য। তোরা আছিস আমার সাথে, তারপর আর কীসের কষ্ট বল তো?”
— “সবকিছু জানার পরেও কষ্ট হচ্ছে না এখন?

শাহানা মৃদু হাসলেন,
— “এখন? এখন তো আগের ব্যাধিতে নতুন করে সংক্রমণ হওয়ার মত ব্যথা। কষ্টটা তো নতুন না মা, পুরোনো। খুব পুরোনো।”

আরশীন ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল,
— “কিন্তু মা, আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অথচ আমি কাঁদতে পারছি না। জানো, কষ্টটা আমার বুকের ভেতর থেমে আছে, একদম মাঝখানে। মনে হয় কেউ ওখানে ভারি পাথর রেখে গেছে। আমি ঠিক বুঝতেও পারছি না, এটা দুঃখ, কষ্ট না অন্যকিছু? শুধু দমবন্ধ লাগছে, মা… আমি কী করব?”

শাহানা তৎক্ষণাৎ কথা বললেন না। এগিয়ে এসে আরশীনের মাথাটা বুকে টেনে নিলেন। ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন আস্তে আস্তে। তারপর ফিসফিস করে বললেন,
— “তুই কিছু করবি না, তোকে কিছু করতে হবে না। তুই শুধু একটুখানি সময় থাক আমার কাছে। কান্না না এলেও, চোখ বন্ধ রাখ। মন খুলে না হোক, অন্তত নিঃশ্বাস ফেল। তোর কষ্টটা আমি ভাগ করে নেব মা। তুই শুধু আমার কাছে থাক। আমার যে বড্ড ভয় করছে তোকে নিয়ে।”
আরশীন উত্তরে কিছু বলল না। তবে সে মায়ের বুকে মাথা রেখে কাঁপছিল, এরপর আরও খুব শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরল।
.
আদিয়াতের জ্ঞান ফিরল ভোরবেলায়। ও আরশীনের খোঁজ করল। তখন আলিয়া সংক্ষেপে বাড়ি যাওয়ার কথা বলল। নাজনীন আদিয়াতের কাছে এসে খানিকক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। গতকাল থেকেই তিনি একনাগারে কান্না করে যাচ্ছেন, থামাথামির নাম নেই। আলিয়া, আযহান চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
জহিরুল ইসলামের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তার জ্ঞান ফিরে এলো বিকাল নাগাদ। উনার সময় ফুরিয়ে আসছে এই ভেবে ডাক্তার সবাইকে কথা বলার অনুমতি দিলেন। নাজনীন নিঃশব্দে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলেন। পিছনে আলিয়া, আযহান দুজনেই দাঁড়িয়েছিল অসহায়তা মেশানো দৃষ্টিতে।
জহিরুল ইসলাম চোখ খোলা রেখেছেন, চোখের ক্লান্তি বলে দিচ্ছে, একজন পাঠক জীবনের শেষ পাতা চুপচাপ পড়ে যাচ্ছেন। নাজনীন এগিয়ে যেতেই তার কণ্ঠে ভাঙ্গা আওয়াজ এলো,
— “আ… আদিয়াত কোথায়?”

ঘরের বাতাস জমাট বাঁধল। নাজনীন ফিরে তাকালেন। দুই ছেলে-মেয়ে আছে অথচ আদিয়াত নেই। আলিয়া গিয়ে আদিয়াতকে ডেকে নিয়ে এলো। আদিয়াত শিয়রে এসে দাঁড়াল। জহিরুল ছেলেকে দেখে হালকা হাসার চেষ্টা করলেন। সেই হাসি একসাথে অনুশোচনা, ক্লান্তি, মায়া আর ভাঙা একখণ্ড ক্ষমার মিশ্রণ ছিল। তার কিছু শেষ কথা ছিল তাই তিনি বলতে শুরু করলেন,
— “নাজনীন, ধৈর্য ধরে তুমি আমার পাশে অনেকগুলো বছর ছিলে। আমি না পারলাম তোমার ধৈর্যের দাম দিতে না পারলাম তোমার ভালো মানুষীর দাম দিতে। সবশেষে আমি তোমার কাছেও একজন অপরাধী।”
তারপর ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,
— “আদিয়াত, তুমি শুধু আমার ছেলে ছিলে না, আমার আয়না ছিলে। আমি তোমার দিকে তাকাতে ভয় পাই এখন। আমি জানি, সব হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ওই সময়টায় যখন প্রথম গুলিটা আমার দিকে লাগছিল আর তুমি আমাকে বাবা বলে ডাকলে দৌড়ে এসে আমায় বাঁচালে, তখন মনে হচ্ছিল আবার সবকিছু ফিরে পেয়েছি। চলে যাওয়ার আগে আমার জন্য যা তুমি দেখিয়েছ এরপর আর কোনো অতৃপ্তি নেই। একজীবনে যে পাপ করেছি তার ক্ষমা নেই, জানি। ক্ষমা চাইবও না। আমি মনে হয় খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম… আমি তোমাদের চেয়ে নিজের সম্মান, নিজের স্বার্থ বড় করে দেখেছি। আমার মেয়ের বিয়ে দিলাম ক্ষমতার হিসাবে। তোমাদের ভালোবাসার ভাষা আমি পড়তে পারি নাই, আমি শুধু আদেশ দিতে পেরেছি। আযহান… আমি নিজে ভালো মানুষ না হয়েও চেষ্টা করেছি তোমাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়তে। এই চেষ্টা তুমি ধরে রেখো বাবা। তোমরা তিনজন,
আমার বুকের পাঁজরের তিনটি হাড়। অথচ আমি সেই বুকেই ছুরি চালিয়েছি… শুধু নিজের ক্ষমতা, নিজের অহংকার টিকিয়ে রাখতে গিয়ে। যদি তোমরা তোমাদের বাবা হিসেবে আমাকে ক্ষমা করে দাও তবে আমি শান্তিতে চোখ বন্ধ করতে পারি।”
ঘর জুড়ে তখন নিঃশব্দ কান্নার গুমগুম শব্দ। আলিয়া মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদছিল। আযহান চোখ মুছছিল বারবার। আর আদিয়াত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। জহিরুল ইসলাম আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। উনার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। ডাক্তার এলো। উনি মারা গেলেন রাত নয়টা আটচল্লিশ নাগাদ।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩৯]
~আফিয়া আফরিন

(মোহন্বিত)
একদিনের মাথায় পুলিশ রেজাকে গ্রেপ্তার করে ফেলল। তিন জেলার সীমান্ত ঘেঁষা পুরনো পরিত্যক্ত গুদামে লুকিয়ে ছিল। গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতা কারণে শেষরক্ষা হলো না। পুলিশ রেজার বিরুদ্ধে সব অভিযোগের প্রমাণ হাতে পেয়েছে। এইবার আর পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। বিলাল হকের বিরুদ্ধেও প্রমাণ জড়ো হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কোন অনুশোচনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তিনি এখনও ভাবছেন, যা করেছে ঠিক করেছে। আগেই যদি সবকটাকে শেষ করে দিত তবে আজকের দিনটা তার জীবনে আসতো না।
আমাদের জীবনে কিছু কিছু মানুষ থাকে না বড্ড স্বার্থপর, লোভী, আত্ম-অহংকারী, নিজেরটা ছাড়া সারাজীবন কারোটা বোঝে না, অন্যের জন্য কিছু করে সুখ পায় না উল্টো অন্যের ভালো দেখলে যন্ত্রনায় ছটফট করে, বিলাল হক হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ। এরা কোনোদিন শুধরায় না, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও না।

জহিরুল ইসলামের মৃত্যুর খবর ফরিদপুরে পৌঁছাল। আরশীন খবরটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ওর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। আরশীন জানালার ধারে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
কিছুক্ষণের জন্য চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এসেছিল। ভিতরে একটা থমকে থাকা দ্বিধা কাজ করছিল। একাধারে তিনি আরশীনের শ্বশুর, ওর বাবার খুনী, সমাজের চোখে একজন অপরাধী, তবুও মন মানতে চাইছে না কেন? মনে একটা ভার বসে গেছে, যেটা হওয়া উচিত হয় নাই। একজন মেয়ে হিসেবে আরশীন কখনোই তার জন্য মায়া করতে পারে না। কিন্তু মানুষ হিসেবে মানবিকতার খাতিরে তো করতেই পারে, তাইনা? তাই করল, চোখের পানি ছেড়ে দিল নির্দ্বিধায়। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আদিয়াত কেমন আছে? কী করছে? সে কেমন করে সামলাচ্ছে নিজেকে? সবথেকে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, দুজন দুজনকে এখনো একবারের জন্যও ফোন করেনি। কেন? আরশীন তো পরিস্থিতির কারণে এড়িয়ে গেছে। আদিয়াতও কি তাই? এই প্রশ্নটা আরশীনের বুকের মধ্যে ঘূর্ণি তোলে। নাকি নিজের বাবার কৃতকর্মের জন্য ও নিজে লজ্জিত? কী জানি, হবে হয়ত কিছু একটা। সবদিক ভেবে আরশীন আর ওকে ফোন দেয় নাই। ঘটনাটা জানার পর থেকে আদিয়াত নিজের মধ্যে ছিল না, কেমন পাগলাটে হয়ে গেছিল। আগে ধাতস্থ হোক, তারপর কথা বলবে। তবে আদিয়াত তো এটা জানে না যে, আরশীন এই দূরত্বে থেকেও প্রতিটি দিন, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ওকে অনুভব করছে।

স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই নাজনীন জ্ঞান হারাচ্ছে বারবার। প্রথমে পড়ে গিয়েছিলেন, তারপর থেকে প্রতি ঘণ্টায় একবার করে জ্ঞান হারাচ্ছে আবার ফিরছে। ডাক্তারেরা বলেছে, “এটা শক। একটা মানসিক ধাক্কা, যা ওনার স্নায়ুতন্ত্র সামাল দিতে পারছে না।”

উনাকে কেউ সামলে রাখতে পারছে না, বোঝাতে পারছে না। চিৎকার করে কাঁদছেন, আহাজারি করছেন, যে সামনে আসছে তাকেই ভর্ৎসনা করছেন। একাও ছেড়ে দেওয়া যাবে না, কী থেকে কী করে বসে ঠিক নেই‌। তার মুখে একটাই কথা বারবার ফিরে আসছিল,
— “সব ওই মেয়েটার দোষ, সব ওই মেয়েটার দোষ। ওই বিষ এনেছিল আমার সংসারে। আমি ওকে কোনোদিন ক্ষমা করব না, আমার কত্ত বড় সর্বনাশ করল।”
আলিয়া মা’কে থামানোর চেষ্টা করে। এমন করলে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়বে‌। আত্নীয়-স্বজন জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চায়। কিন্তু তার হৃদয়ে এইমুহূর্তে যুক্তির কোনো ঠাঁই নেই।
জহিরুল ইসলামের জানাজার সব ব্যবস্থা করছিল আদিয়াত আর আযহান। বাড়িতে লোকজন আসছে, যাচ্ছে। দুই ভাই সব সামলাচ্ছে। একটা মুহূর্তে চোখাচোখি হলেও মুখে কিছু বলা হয়ে উঠে না। তবে আদিয়াত ঠিকই টের পায়, আযহানের ভেতরকার চাপা যন্ত্রণা। ভালো বা খারাপ, নিষ্ঠুর বা স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতকও হোক; কিন্তু সবশেষে এই মানুষটাই ওদের জন্মদাতা। তার কণ্ঠে একদিন বাবা ডাক শুনেছিল ওরা, তার হাত ধরেই প্রথম হাঁটতে শেখা, তার মুখেই একদিন প্রশংসার ছায়া, তার চোখেই একদিন গর্বের দীপ্তি; এসব তো কখনো অস্বীকার করা যায় না।
আজ সেই মানুষটিকে শেষ বিদায় দিতে গিয়ে, সব দুঃখ, ক্ষোভ, প্রশ্ন চাপা পড়ে গেল অসমাপ্ত ভালোবাসার নিচে।

আরশীনের মন টানছিল আদিয়াতের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শাহানা ওই পথ ওকে মাড়াতে দিলেন না। তিনি ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
— “বাড়াবাড়ি করবি না আরশীন। তোকে স্পষ্ট করে বলছি, এই বাড়ি থেকে এক পা-ও বাইরে দিবি না। এত অপমান, এত কষ্ট, এত অবহেলার পরেও তোর ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে হয় কেমন করে? মান-সম্মান বোধ কি ধুয়ে খেয়েছিস?”

আরশীন অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে কাঁপা গলায় বলল,
— “মা, ওখানে আদিয়াত আছে। তুমি কীভাবে বলছো এমন কথা?”
— “থাকুক। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মেয়েদের ব্যাপারে আমি আর কারো সাথে আপোষ করব না। আদিয়াতও হয়তো মায়ের সুর ধরেছে, তোকে ভুল ভাবছে। ফোন করেছিল একবার? আমি যখন তোকে যেতে মানা করেছি তখন তুই যাবি না। তোর মা এখনো মরে যায় নাই আরশীন। যতক্ষণ না তোর শাশুড়ির মাথা ঠিক হচ্ছে ততক্ষণ আমি তোকে যেতে দিব না। ওই বাড়িতে এখন তোর কেউ নেই, এটা বুঝতে শিখ।”

আরশীন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— “মা আমি যাব না তাও তুমি আদিয়াতকে ভুল বুঝো না প্লিজ। ও এমন না। ও কেমন তা তোমাদের কখনো বোঝাতে পারব না। আদিয়াত আমাকে কখনো ভুল বুঝবে, এটা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা।”

শাহানা তাকালেন না আরশীনের দিকে। পেছন ফিরে বললেন,
— “তুই আমার মেয়ে। তোকে আমি সহজে ভাঙতে দেবো না। নিজের চেহারাটা একবার দেখেছিস? কি হাল হয়েছে তোর? তুই ওই বাড়িতে যাবি তারপর পাথর হয়ে ফিরবি, সেটা সহ্য করতে পারব না। এখন ভেতরে যা। চুপচাপ থাক, সময়ের পক্ষে সম্ভব হলে সব ঠিক করে দেবে।”
আরশীন থমকে দাঁড়াল। সামনে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে গেল মাতৃকণ্ঠের কঠিন সুরে।
আরশীন বোঝে দুজনের অবস্থাই। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার ভিতর থেকেই ক্ষত আর ভয় সৃষ্টি হয়েছে। দুজনেই একা, দুঃখী, অস্থির। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাদের ভুল বোঝাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাদের এই ভুল বোঝাবুঝির ছায়ায় আরশীন পিষ্ট হচ্ছে। ও মাঝের এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে যেখানে কারো দুঃখে পাশে দাঁড়াতে গেলেও অপরাধী আর চুপচাপ থেকে গেলেও দোষী।
.
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সারা বাড়ি জুড়ে ভারী স্তব্ধতা এখনও বিদ্যমান। সবাই শোকাহত কিন্তু নিস্তব্ধ, কেউ কান্নাকাটি করছে না। একমাত্র নাজনীনের-ই কান্না থেমে নেই। দিনরাত তার আহাজারিতে ঘর কেঁপে উঠছে। কখনো বিছানায় পড়ে কাঁদছেন, কখনো চিৎকার করছেন। আচমকা এই শোক তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তার মন কোনো সত্যি-মিথ্যা মানতে চাচ্ছে না। তিনি যা চোখের সামনে দেখছেন তাই বলছেন। চোখের সামনে দেখেছেন জহিরুল ইসলাম আরশীনকে আদর ভালোবাসায় এই বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলেন… তারপর থেকেই একেরপর এক অঘটন। তাই এতটা নির্মমভাবে ওকেই সমানে দোষ দিয়ে যাচ্ছেন।
আদিয়াত অনেকক্ষণ দূর থেকে তাকিয়ে ছিল মায়ের দিকে। অবশেষে এগিয়ে এলো, পাশে বসল। মৃদু কণ্ঠে বলল,
— “মা, এইবার একটু শান্ত হও। এইভাবে চেঁচামেচি করলে তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। বারবার আরশীনের দোষ দিচ্ছো কেনো? সত্যিই কি সব দোষ ওর?”
— “তোরা আমার সাথে কথা বলিস না। তোরা সব স্বার্থপর। এখন বউয়ের হয়ে কথা বলছিস? তোরা নিজের চোখে কিছু দেখিস নাই।”

আদিয়াত শোনে তারপর মায়ের হাতটা ধরে বলল,
— “নিজের চোখে দেখেছি বলেই সব সত্যিটা জানি মা। আমি জানি, তুমি যা বলছো মন থেকে না। শান্ত হও মা। চোখ খুলে সত্যিটা দেখো। আরশীনের অবস্থা একটাবার বোঝার চেষ্টা করো। আমি এখন পর্যন্ত ওর মুখোমুখি হতে পারি নাই। আমার লজ্জা লাগছে। তুমি বুঝতে পারছো? ওর দিকে না তাকিয়েও আমি ঠিক বুঝতে পারছি, ও ভেঙে গেছে মা। আমার মতো, তোমার মতোই।”

নাজনীন চোখ নামিয়ে নিলেন। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের বিন্দু লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। আদিয়াত মায়ের কাঁধে মাথা রাখল,
— “তুমি এই দোষ দিও না, মা। বরং ওকে কাছে ডাকো। আমরা সবাই অনেককিছুই হারিয়েছি, কিন্তু এই হারানোর ভেতরেই যদি একজন আরেকজনকে ধরে না রাখি… তাহলে আমরা একলা হয়ে যাব একেবারে। আরশীন কি হারিয়েছে, ওর মধ্যে কি হচ্ছে, ও কি সত্যি জানতে পেরেছে, তা তুমি বোঝো তো তাইনা? তুমি জানো না, আরশীন কেমন? ও সবকিছু চুপচাপ নিজের ভেতরে পুষে রাখছে। ও নিজেও বুকের ভেতরে একরাশ দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছে। সত্যি কখনো মিথ্যা হয়ে যায় না মা। একটা কথা আমি উচ্চারণ করছি না। আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু তাতে কি সত্যি বদলে যাবে? বাবা কি আরশীনের বাবাকে খু….”

নাজনীন উঠে দাঁড়ালেন।
— “চুপ থাক বাবা, আর বলিস না।” উনি কথাটা বললেন কিন্তু তার কথায় জোর ছিল না। জোর করে এই সত্য তো চাপা দেওয়া যায় না।
আদিয়াত মৃদু হাসলো। দুনিয়ার নিয়ম বড্ড অগোছালো। মাকে আর কিছু বলল না। যতটুকু বোঝাতে চেয়েছে ততটুকু বোঝানো হয়ে গেছে।

আদিয়াতের মুখে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত সত্যে নাজনীনের সব পাজল একসাথে মিলে গেল। আসলে তিনি এটা আগেও টের পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মনকে বোঝাতে পারেননি। আজ ছেলের মুখে না বোঝা সত্যের দৃঢ় উচ্চারণে তিনি দীর্ঘ এক বোঝা নামিয়ে রাখলেন। এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলেন।
সত্যিই তো, আরশীনকে দোষ দেওয়ার কি মানে হয়? নাজনীন মনে মনে এই প্রশ্নটা করে ফেললেন নিজের কাছেই। চারপাশের ঘটনার ঘূর্ণিতে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। আরশীন সবকিছু সহ্য করে গেছে। ওকে ভুল বোঝা হয়েছে, ওকে আঘাত করা হয়েছে, অথচ ও নিজেই ভুক্তভোগী। তবুও সে কখনো পাল্টা আঙুল তোলেনি, শুধু সহ্য করে গেছে।
নাজনীন গহীন উপলব্ধিতে পৌঁছালেন। আবেগ আর অপূর্ণ বোঝাপড়ায় ওকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। ওদের উচিত, আরশীনের কাছে ক্ষমা চাওয়া। ভুলটা তাদের পরিবারেরই। নাজনীন উপরে উঠে এলেন। ওদের ঘরে গিয়ে আদিয়াতের সামনে দাঁড়ালেন। নিজের মধ্যকার ক্লান্তির ছাপ মুছে ফেলেছেন। সামান্য গলা তুলে বললেন,
— “তুই এখনও এখানে কেনো? আরশীনকে ফিরিয়ে আনছিস না কেনো?”

আদিয়াত নিজের ঘরেই ছিল মানে অপেক্ষা করছিল। মা যে আসবে, এই কথাগুলো বলবে, ও বোধহয় আগে থেকেই জানত। জানবেই তো, মাকে তো ভালো করেই চিনে। বলল,
— “নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছি মা। বুঝতে পারছি না, কীভাবে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াব… কী বলব ওকে।”

নাজনীন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন,
— “তুই যা বাবা। তুই গেলে কি আরশীন তোকে ফিরিয়ে দেবে? যা হয়ে গেছে, তা ভুলে যাওয়াই ভালো। ওসব মনে রেখে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই। যা, দেরি করিস না।”

আদিয়াত চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল।
— “যাবো মা, যাবো।”

নাজনীন বিছানার এককোণে বসলেন। নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
— “দেরি করছিস কেনো তাহলে? এখনই যা, ওকে ফিরিয়ে আন। আমি ওকে অনেক আজেবাজে কথা বলেছি। আমারই হয়তো ওকে আনতে যাওয়া উচিত, ওর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু শরীরটা ভালো লাগছে না রে…” তার শেষ কথাগুলো ক্লান্তির আবরণে ঢাকা ছিল, “তুই যা বাবা, যা। ওকে ফিরিয়ে আন।”

আদিয়াত আর দেরি করল না। মায়ের কথাগুলো তাকে একটা ধাক্কা দিল। মায়ের মুখে অপ্রত্যাশিত স্বীকৃতি, ক্ষমা চাওয়ার আন্তরিকতা দেখে ভেতরে জমে থাকা সব দ্বিধা মুহূর্তেই উবে গেল। সে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। আরশীন কি করছে? নিশ্চয়ই অপেক্ষায় রয়েছে।

জানালা দিয়ে পড়া বিকেলের শেষ আলোটা মেঝেতে লম্বা ছায়া ফেলছিল। আরশীন আর আশা বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে টুকটাক কথাবার্তাও হচ্ছিল। কথার ফাঁকে মূল ফটকে ঠক ঠক আওয়াজ হলো। আরশীন কপাল কুঁচকে বলল,
— “মা বোধহয় ঘুমাচ্ছে… তুই গিয়ে দেখ তো, কে এলো এই অসময়ে?”

আশা গা এলিয়ে বসেছিল। ঝিম ধরা ভঙ্গিতে বলল,
— “উঠতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও আপু।”

আরশীন চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।
— “আমারও ইচ্ছে করছে না। তুই যা তো। এখন যদি কলিংবেল চাপে, মা’র ঘুম ভেঙে যাবে।”
— “তুমি যাও না একটু…”

আরশীন বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করল,
— “আমি তোকে যেতে বলেছি আশা।”

আশা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
— “আচ্ছা যাচ্ছি, এত রাগ করো না।” তারপর আলস্যে পা টানতে টানতে উঠল, গায়ের ওড়না ঠিক করে এগিয়ে গেল। দরজাটা খুলতেই হালকা বাতাসের সাথে আদিয়াতের মুখটা দেখা গেল। চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে, কপালে ব্যান্ডেজ, ডান কব্জিতেও ব্যান্ডেজ। আশাকে দেখে মৃদু হাসলো। আশাও চোখ বড় বড় করে হেসে উঠল,
— “আরে ভাইয়া যে। আসুন, ভিতরে আসুন।”
— “কেমন আছো?”
— “ভালো। আপনার তো খোঁজখবর নাই। ভাবলাম, ভুলেই গেলেন কিনা?”

আদিয়াত মৃদু হাসলো।
— “না ভুলি নাই। সবকিছু সামলে তারপর এলাম। আরশীন আছে তো?”

আশা উত্তর দিল,
— “হ্যাঁ, আর কোথায় যাবে? ঘরেই আছে।”
আদিয়াত মাথা নাড়ল। চোখ দুটো একটু ভেতরে তাকাল। শাশুড়িকে কোথাও দেখতে পেল না। আশা নিজে থেকেই বলল,
— “মা ঘুমাচ্ছে মনে হয়। আপনি ঘরে যান ভাইয়া, আপু ওখানেই আছে। আপনার কথাই বলছিল। আপু যেতেও চেয়েছিল, কিন্তু… যাইহোক আপনি গিয়ে কথা বলুন ভাইয়া।”
— “আচ্ছা।”
আদিয়াত ধীরে পা ফেলে ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা আধখোলা। বাতাসে পর্দা একটু নড়ছে, ভেতরে আলোছায়ার নিঃশব্দ খেলা।

আশাকে বিদায় করার পর ঘরের ভেতরে আরশীন শুয়েছিল। ঘুমানোর চেষ্টা করছে। ইদানীং ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। যার কারণে মাথাব্যথা করে, আর মাথাব্যাথা নিয়ে কোনকিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। মেজাজটাও চড়ে থাকে। আর চিন্তা তো আছেই। হঠাৎ দরজার আশেপাশে পায়ের শব্দ শুনে ওপাশ ফিরেই বলল,
— “আশা, দরজাটা লাগিয়ে দিস তো। আর পর্দাটাও দিয়ে দে। বাতাসে ঠান্ডা লাগছে। তারপর এই ঘর থেকে চলে যাবি। আমি একটু ঘুমাব। তোর বকবক এখন শুনতে ইচ্ছে করছে না।”

আদিয়াত এসে পর্দাটা টেনে দিল। বাতাস আর আলো দুটোই কমে এলো ঘরে। মনে হচ্ছে, বাইরের দুনিয়াটাকে খানিকটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। এরপর সে আরশীনের বিছানার পাশেই খালি জায়গাটায় বসে পড়ল। আরশীন বলল,
— “তোকে এখান থেকে যেতে বলেছি না? আমার ভালো লাগছে না।”
— “আমারও ভালো লাগছে না। তাইতো পাশে এসে বসেছি।”
আদিয়াতের কণ্ঠটা ধীরস্রোতা কোনো নদীর মতো এসে আছড়ে পড়ল আরশীনের কানে। সে প্রথমে চমকে উঠল। বুকের ভেতর কেমন ধক করে উঠল। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি একটা আবছা দোলাচলে দুলছিল ও। মনে হলো, নিশ্চয়ই স্বপ্ন। ঘুম না এলেও মনের ভেতর তো কতকিছু চলে আসে হুটহাট।
ক্লান্তি-ধোয়া দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকাল। দেখল, আদিয়াত। চুপচাপ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মাথা চোখে দীর্ঘ দিনের অনিদ্রার ছায়া, কপালে সাদা ব্যান্ডেজ, গালের এককোণে একটুখানি দাগ। আরশীনের চোখ স্থির হয়ে গেল ওর চোখে। একমুহূর্তের জন্য বিশ্বাস হলো না। এত বাস্তব? তবে কি এখনো স্বপ্নেই আছে?
নিজেকে বোঝানোর জন্য প্রায় অবচেতনভাবে একটুখানি ঠোঁট কামড়ে দেখল। ব্যথা পেল। তারপর বুঝল, না স্বপ্ন নয়। সত্যিই আদিয়াত।
— “আপনি?”

আদিয়াত হালকা হেসে বলল,
— “ঘুরতে এলাম।”

আরশীন অবাক চোখে তাকিয়েই রইল। একটা থমকে যাওয়া স্বর বেরোল ওর ভেতর থেকে,
— “ঘুরতে? কখন এসেছেন?”

আদিয়াত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “এইমাত্র।”
আরশীন বিছানা থেকে নামল। দেয়ালঘেঁষা সুইচে চাপ দিয়ে আলো জ্বালাল। আদিয়াত একপলক তাকিয়ে বলল,
— “অন্ধকারে আমাকে দেখা যাচ্ছিল না?”

আরশীন এসে ওর পাশেই বসল। ওর চোখেমুখে একগাদা প্রশ্ন জমে ছিল অনেকদিনের।
— “ফোন করেন নাই কেনো এতদিন? আসেনও নাই। মনে পড়ে নাই?”

আদিয়াত গলা নামিয়ে বলল,
— “পড়েছে। তবে আসা হয়ে উঠেনি।”

আরশীন চোখে চোখ রেখে বলল,
— “কেনো?”

আদিয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কণ্ঠে অনুশোচনার ভার,
— “বুঝতে পারছেন না?”
— “না।”

আদিয়াত বিষণ্ন হেসে বলল,
— “অপরাধবোধ।”

আরশীন গম্ভীরভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি অপরাধ করেছেন?”
— “আমি করি নাই কিন্তু আমার সাথে সংযুক্ত তো কেউ করেছে। তার একটা দায় আছে না?”

আরশীন জোরালো কণ্ঠে বলল,
— “এত দায় দায় করছেন কেনো? আপনার কীসের দায় পড়েছে? পৃথিবীর সমস্ত অপরাধের দায় নিজে নিতে চাচ্ছেন?”
আদিয়াত কিছু বলল না। চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আরশীন ধীরে উঠে দাঁড়াল। গিয়ে দাঁড়াল আদিয়াতের সোজাসুজি, মুখোমুখি। কোমল দু’হাত বাড়িয়ে আদিয়াতের মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিল।
— “কি হয়েছে, হুঁ?” গলাটা নরম, স্বাভাবিক।

আদিয়াত ওর প্রশ্নের উত্তর দিল না। কেবল ধীরে কণ্ঠে বলল,
— “খুব শক্ত করে, একটু জড়িয়ে ধরো না। ভালো লাগছে না…”
.
.
.
চলবে….