#আমার_মা (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
বাবা গরিব বলে যে ফুপুরা সোফা নোংরা হয়ে যাবে বলে মেঝেতে বসতে বলতো আজ আমার বাবার টাকা হওয়ার পর তারাই সবচেয়ে আপন হলো। তাই তো আমার বাবা এখন তাদের কথায় আমার মায়ের সঙ্গে দূর্ব্যবহার করতেও দু’বার ভাবে না। অথচ তার খারাপ সময়ে আমার মায়ই ছিলো তার সঙ্গী। ইদানীং এসব বিষয় নিয়ে বাবা, মায়ের খুব তর্ক হয়। একদিন যে মাকে ছাড়া আমার বাবা অচল ছিলো আজ সেই মায়ই তার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এসব আমার একদমই সহ্য হচ্ছিলো না। বাবা, মায়ের এই দূরত্ব আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। সেজন্য বাবাকে আলাদাভাবে বোঝানোর কথা ভাবছিলাম। সেই সময়ে জানতে পারলাম আমার বাবার এই দূর্ব্যবহারের কারণ। আমার ফুপুরা আমার বাবার কানে মায়ের বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে শুরু করেছে। যেটা বাবার উপর ভয়ংকরভাবে প্রভাব ফেলে। তাই তো মাকে এখন বাবার বিরক্ত লাগছিলো।
যেদিন আমি প্রথম ফুপুদের বিষয়ে জানতে পারলাম সেদিন আমার যা রাগ উঠছিলো। ইচ্ছে করছিলো ফুপুদের গিয়ে মে রে ফেলি। আজ আমার বাবার কাছে ভালো সাজতে এসেছে। অথচ এরাই আমাদের খারাপ সময়ে আমাদের সঙ্গে যা নয় তাই ব্যবহার করেছে। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আমি যখন শুনলাম বড় ফুপু বাবাকে বলছে,“ভাইয়া তোমার বয়স আর কত হলো? এই বয়সে এসে নিজের অসুস্থ স্ত্রীর বোঝা টানবে? এভাবে জীবনটা শেষ করে দিবে? তোমার জীবনের কি কোন চাওয়া পাওয়া নেই?”
বড় ফুপুর কথায় তাল মিলিয়ে ছোট ফুপু বলে,“ঠিক তাই। তোমার উচিত অসুস্থ বউকে ছেড়ে দিয়ে নিজের জীবন নিয়ে নতুনভাবে ভাবা। তোমার আর একটা বিয়ে করা উচিত।”
এটা শুনে আমি আমার রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করে রাগান্বিত গলায় বললাম,“এভাবে আমার বাবার কান ভাঙানো হচ্ছে? এভাবে? আপনারাই তবে আমাদের ঘরের শনি।”
”ভাই তোমার মেয়ে এসব কী বলছে? এটা কোন ধরনের ভাষা ঋতু?”
বড় ফুপু উচ্চবাক্যে কথাটি বলে উঠলেন। আমি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বললাম,“আপনারা যা আমাদের সাথে করেছেন, এখনো করছেন তাতে আপনাদের সঙ্গে ভালো ভাষায় কথা বলাই উচিত নয়। তাও তো আমি ভালোভাবে কথা বলছি।
নিজেদের সংসারে কাজ নাই যে অন্যের সংসারে এসে সেটা ভাঙার চেষ্টা করছেন। আগে তো আমাদের বাড়িতে বছরেও আসতেন না। এখন আসছেন কেন? আমার বাবার টাকা দেখে? টাকা হাতানোর নেশায় এসেছেন? তাই?”
“কি!”
ছোট ফুপু অবাক হওয়ার ভান ধরে বললেন। অতঃপর ন্যাকামি করে বলে,“ভাই এভাবে মেয়েকে দিয়ে না বলালেও পারতে। যা বলার সেটা আমাদের সরাসরি বলতে। আমরা আমাদের ভাইয়ের বাসায় আসতে পারবো না? এটা যদি তোমাদের পছন্দই না হয় তবে বলতে। আমরা আর আসতাম না। এভাবে হাঁটুর বয়সী মেয়েকে দিয়ে অপমান করাচ্ছো।”
এই কথা শুনে আমি কিছু বলতে যাবো তখনই আমার বাবা আমার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা কঠিন গলায় বললেন,“এসব শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে আমি? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না?
তাছাড়া যেখানে বড়রা আলোচনা করছে তুমি সেখানে কোন সাহসে আসো? তোমাকে আমরা ভালো শিক্ষা দেইনি?”
আমি আমার বাবার মুখের কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারলাম না। যেই বাবা আমাকে এত ভালোবাসতো সেই বাবা এখন আমার গায়ে হাত তুলছে। এই ঘটনা আমাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলো, আমার বাবা শুধু আমার মাকে নয় সঙ্গে আমাকেও নিজের বোঝা ভাবতে শুরু করেছে। সে নিজের বোনদের কথায় প্রভাবিত হয়ে বোধহয় রঙীন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আমি আরও অবাক হলাম যখন আমার বাবা আমাকে ধমক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলেন। আমি বাবাকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম কিন্তু বাবা আমার কথা শোনেনি। সে আমাকে বের করে দেয়।
বাবার এই পরিবর্তন আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করলো। সে অন্যকারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মায়ের সঙ্গে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে না তো? এটা যদি হয়েই থাকে। তবে শুধু কি ফুপুরা দ্বায়ী? তাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে এটা করলো? এটা কি আদৌ সম্ভব? যদি মানুষ নিজে না চায় তবে কী কেউ তাকে দিয়ে জোর করে কিছু করাতে পারে।
__
আমি মায়ের পাশে বসে নিরবে কান্না করছিলাম। আমার মায়ও বিছানায় শুয়ে নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছিলো। পাশের ঘরে থাকার সুবাদে মায়ও সবটা শুনলো। আমার মা আমার হাতটা কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে বলে,“পুরুষ মানুষ পরিবর্তন হতে সময় নে না রে মা। জীবন আমাকে এই কথাটি ভালোভাবে বুঝিয়েছে। তাছাড়া এখানে তোর বাবার কোন দোষ নেই। তোর বাবার জায়গায় যেকেউ থাকলে বোধহয় এই কাজটাই করতো।”
“তাই? আজ বাবা বিছানায় পড়লে, তার একই রোগ হলে তুমি পারতে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে? পারতে মা?”
আমার এই কথার জবাব মা দেয় না। সে নিরবে কান্না করে। আমি মায়ের কান্না না মুছিয়ে অতীতের স্মৃতিগুলো নিয়ে ভাবি। অতীতে আমরা কষ্টে ছিলাম। কিন্তু তবুও আমরা সুখী ছিলাম। আমাদের পরিবারে সুখ ছিলো। আজ আমাদের সেইসব কষ্ট দূর হয়েছে। কিন্তু সুখটা হারিয়ে গেছে। আজ যে ফুপুদের কথায় আমার বাবা নাচছে সেই ফুপুদের অতীতে করা আচরণগুলোর কথা ভাবলে আজও আমার হৃদয়টা কষ্টে ফেটে যায়। অথচ বাবা দিব্যি সেসব ভুলে তাদের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাচ্ছে।
অতীত,
সেই সময়ে বাবার চাকরি চলে যায়। সংসারের বেহাল অবস্থা। বাবা নিজের এই দূরাবস্থার মানসিকভাবে বেশ ভেঙে যায়। সেই সময়ে মা তাকে সাহস দিয়ে তার হাতটি শক্ত করে ধরে বলে,“সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভেবো না তো।”
সেই সময়ে মা অনেকভাবে বাবাকে মোটিভেট করতো। তার মানসিক অবস্থা ভালো করার জন্য। এইসবে বাবা ধীরে ধীরে নতুনভাবে কিছু করার অনুপ্রেরণা পেতো। একটা সময় বাবা সিদ্ধান্ত নিলো শহরে গিয়ে ব্যবসা করবে। কিন্তু ব্যবসার কথা বললেই তো হয় না। তার জন্য টাকার দরকার। সেই টাকার আশায় বাবা ছোট ফুপার কাছে হাত পাতে। ধার হিসাবেই টাকা চায়। সেই সময়ে ফুপার অবস্থা বেশ ভালো। সেদিন আমি আমার বাবাকে মলিন মুখে বাসায় ফিরতে দেখালম। পরবর্তীতে বাবা এবং মায়ের কথোপকথনের মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, ফুপা টাকা দিতে চাইলেও ফুপু দিতে চাইনি। তার এক কথা, বাবার অবস্থা ভালো না। সে কখনো এই টাকা শোধ দিতে পারবে না। তাই তাকে টাকা দিয়ে নিজেদের টাকা নষ্ট করতে চায় না।
বাবা সেদিন মলিন মুখে মাকে বলে,“আমার নিজের বোন এভাবে আমাকে না করতে পারলো? আজ ওরা বিপদে পড়লে আমি কী সাহায্য করতাম না?”
মা বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। অবশেষে নিজের অবশিষ্ট গহনা এবং ভাইয়ের বাসা থেকে কিছু টাকা ধার করে এনে বাবার হাতে দেয়। বাবা সেইসব হাতে পেয়ে মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,“তোমায় ভয় হচ্ছে না? ব্যবসা লস হলে তো তোমার এই গহনা, তোমার ভাইয়ের টাকা সব শেষ? এই টাকা তো কখনো শোধ করতে পারবো না। এই ভয় হচ্ছে না?”
“না। একদম ভয় হচ্ছে না।কারণ আমি জানি তুমি সফল হবে। আমার বিশ্বাস তুমি কিছুতেই হার মানবে না।”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বাবা খুব খুশি হয়। ভরসা পায়। মনেমনে ধীর প্রতিজ্ঞা করে, সে পারবে। সে যেকোন মূল্যে ব্যবসাটা ধার করাবে। ব্যবসা করার উদ্দেশ্য বাবা শহরে চলে যায়। যাবার আগে আমাদের বড় ফুপুদের বাসায় রেখে যায়। যাতে বাবা না থাকা অবস্থায় কয়েকদিন আমাদের কষ্ট করে ঘরে থাকতে না হয়। মা মেয়ে একা ঘরে থাকবো, বিপদের ভয়ে বাবা তার বোনের বাসায় রেখে যায়। আর সেই সময়ে আমরা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলাম, টাকা ছাড়া এই দুনিয়ায় সব সম্পর্কই মিথ্যা। তাই তো বড় ফুপু আমাদের থাকার জন্য তাদের ঘরের আসবাপত্র রাখা রুমটি দেয়। যেখানে ময়লা, পোকা-মাকড়ের বাসা জমেছিলো। তবে আমার মা এটা দেখে সেদিন কিছুই বলেনি। বরং হাসিমুখে সেই ঘরটি পরিস্কার করে থাকার উপযোগী করে ফেলে। আমরা মা মেয়ে প্রথম রাত সেখানেই কাটাই। সেই রাতে আমাদের যে খাবারটি খেতে দেওয়া হয়েছিলো সেটা দেখে আমি প্রায়ই কান্নাই করে দিয়েছিলাম। শুধু ভাত এবং একটু তরকারির ঝোল। আমরা অভাবে ছিলাম কিন্তু তাও আমার বাবা, মা কখনো আমাকে এসব খাবার দেইনি। বরং তারা না খেয়ে থেকেও আমার খাবার জন্য কিছু না কিছু ব্যবস্থা করেছিলো। সেদিনের মতো সবটা মেনে নিলাম। কিন্তু পরবর্তী দিন যা হলো তা মা একদমই মেনে নিতে পারেনি। সেদিন আমি সোফায় বসে টিভি দেখতে ছিলাম। সেটা দেখে ফুপু এগিয়ে এসে বলে,“এই সোফায় বসেছিস কেন? সোফা নোংরা হয়ে যাবে। নিচে বস।”
আমাকে কিছুটা টেনেই সোফা থেকে নামালো। তারপর মেঝেতে বসতে বললো। এই ঘটনায় আমি প্রায় কান্না করে দিলাম। কান্নারত অবস্থায় বললাম,“আমার গায়ে তো কোন ময়লা নেই ফুপু।”
“চুপ ভিখারির বাচ্চা।
তোর গায়ে ময়লা নাই বললেই হলো। তুই জানিস এটা কত দামী সোফা? এটা তুই বসছিস বলেই নোংরা হয়ে গেছে।”
ফুপুর বলা ভিখারির বাচ্চা কথাটি মায়ের ভালো লাগেনি। যতই হোক একজন মা। আর একজন মা কখনো নিজের সন্তানের অপমান সহ্য করে না। তাই তো সেদিনই মা আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
’
’
চলবে,