যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-৩+৪

0
18

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩ [দ্বিতীয় খণ্ড]

সকাল সকাল হসপিটালের বাহিরে থেকে লোকজনের কঠোর স্লোগানে অবচেতন সরোয়ার সাহেব পিটপিট করে তাকালেন। উনার মুখে এখনো অক্সিজেন মাস্ক। হাতে ক্যানোলা দেওয়া সেখান দিয়ে দেহে স্যালাইন প্রবেশ করছে। পাশে চোখ যেতেই লক্ষ্য করেন উনার স্ত্রী ক্লান্তি নিয়ে পাশে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজে রয়েছেন। সেই মুহূর্তে নিজের ছেলের গলা শুনে খানিকটা চমকালেন দুর্বল সরোয়ার সাহেব।
“বাবা! এখন কেমন লাগছে?”

উনি দেখতে পেলে স্বচ্ছ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে। এতদিন পর নিজের ছেলেকে দেখে আবেগপ্রবণ হলেন সরোয়ার সাহেব। অবশ্য এর আগে থেকেই উনি লোক দিয়ে ছেলের খোঁজ খবর রেখেছিলেন। তিনি মাথা নাড়িয়ে বোঝালেন উনি ঠিক আছেন। স্বচ্ছ বলল,
“আমি ডক্টর ডেকে আনছি। তোমার চেকআপের প্রয়োজন।”

স্বচ্ছ বেরিয়ে গেল। নিজের অন্য হাত দিয়ে কোনোরকমে অক্সিজেন মাস্ক খুলে বড়ো একটি শ্বাস নিলেন তিনি। উনার কানে আসছে বাহিরের হট্টগোল। সবার এক কথা, ‘মন্ত্রী সাহেবের শাস্তি চাই। এমন মানুষকে আর কেউ ভোট দেব না। মন্ত্রীর আসনে তাকে বসিয়ে রাখতে চাই না।’

বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে যাবার পর কেবিনে এলেন কামাল সাহেব। তখন মিসেস জেবা ফ্রেশ হতে গেছেন। এই সুযোগে কামাল মুখ গোমড়া করে এসে সরোয়ার সাহেবকে শুধালেন,
“সব কথা জানাজানি হয়ে গেছে মাত্র এক রাতের ব্যবধানে। আপনার বিরুদ্ধে মিছিল বেরিয়েছে। আপনি কি এসবের ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন স্যার?”

সরোয়ার সাহেব বড়ো একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে দুর্বল মুখে সামান্য হাসি নিয়ে বললেন,
“সব ভাবা শেষ আমার। আমি জানি আমাকে কী করতে হবে।”

কামালের চোখ কৌতূহলে জ্বলজ্বল করে উঠল। তখনি দরজা খোলার শব্দ এলো। গতকালের দুজন অফিসার ফের হাজির হয়েছে। উনারা সঠিক জবানবন্দি নিতে চান সরোয়ার সাহেবের কাছ থেকে। সরোয়ার সাহেব প্রস্তুত হলেন। উঠে বসানো হলো সাবধানে উনাকে। অফিসারদের মাঝে একজন প্রশ্ন শুরু করলেন,
“এখন কেমন আছেন? কেমন লাগছে আপনার শরীর? কথা বলতে পারবেন?”

সরোয়ার সাহেব আস্তে করে মাথা ঝাঁকালেন। অফিসার আবার শুধালেন,
“তাহলে বলুন আপনার নিজের পক্ষে কিছু বলার আছে? নাকি আপনি স্বীকার করছেন সবকিছু?”

সরোয়ার সাহেব হতাশা নিয়ে বলেন,
“ভুলটা তো আমারই। আমিই ভুল করেছি। আমি ভুল করেছি কামালকে বিশ্বাস করে। ওকে নিজের সব যাবতীয় কাজের দায়িত্বের ভাগিদার করে।”

কামাল চমকাল। বিস্ময়ে চোখ দুটো যেন খুলে আসার উপক্রম। সরোয়ার সাহেবের পরিকল্পনা কিঞ্চিৎ বুঝতে পেরে গায়ের লোম শিউরে উঠল উনার। কামাল কিছু বলে ওঠার আগেই অফিসার পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন,
“মানে? কামাল বলতে ইনিই তো? আপনাকে সব কাজে সাহায্য করেন?”

কামালকে দেখিয়ে বললেন অফিসার। সরোয়ার সাহেব ঢক গিলে বললেন,
“হ্যাঁ। ওকে বিশ্বাস করতে গিয়ে আমার উপর আজ আঙ্গুল উঠেছে। আমি আমার সব ছোটোখাটো কাজগুলো ওকে দিয়েই করাই। তবে তার বদলে ও আমার পেছনে এভাবে ছু/রি মা/রবে ভাবতে পারিনি৷ সেই ফ্যাক্টরির জন্য বরাদ্দ টাকা যেন ফ্যাক্টরির মালিকের কাছে পৌঁছে যায় সেটার দায়িত্ব আমি ওকে দিয়েছিলাম। কিন্তু ও অনেকগুলো টাকা সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে আমার অগোচরে৷ আর মিথ্যে এগ্রিমেন্ট পেপারও সে-ই তৈরি করেছে। আর এখন সম্পূর্ণ দোষ আমার।”

কামাল থরথর করে কেঁপে উঠে গর্জে উঠল এবার। উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে উঠল সে।
“এটা মিথ্যে। স্যার আপনি নিজেকে বাঁচাতে এখন আমাকে ফাঁসাচ্ছেন। এটা আপনি ঠিক করছেন না।”

রেগেমেগে হুঁশ হারিয়ে সরোয়ার সাহেবের দিকে এগোতে নিলেই কনস্টেবল ধরে রাখে তাকে। তিনি রাগে ফুঁসে একটাই কথা বলে চলেছে যে সরোয়ার সাহেব যা বলছে সব মিথ্যে। অফিসার সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“আপনি যা বলেছেন। তার কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

সরোয়ার সাহেবের আত্মবিশ্বাসের সহিত উত্তর,
“জি অবশ্যই। আপনি তার ব্যাংক একাউন্ট চেক করলেই তো বুঝতে পারবেন অফিসার। আর কিড/ন্যাপিং এর কথা যদি তুলতে চান তাহলে বলব এটাও ওরই কাজ।”

“আপনি এতটা নিশ্চিত হয়ে কী করে বলছেন?”

“বলছি কারণ অনেকদিন ধরেই ওর লোভ আমার এই জায়গার প্রতি। সেটা আমি ওর কর্মকাণ্ড বুঝতে পারতাম। তবে কিছু বলিনি। আমার ফোনটা কাজের জন্য বেশির ভাগ সময় ওর কাছে থাকে। তাই আমার ফোন থেকে এসব কিড;ন্যাপের আদেশ দেওয়া ওর জন্য কঠিন কিছু নয়।”

কামাল উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলেন।
“এতদিন আপনার সকল অন্যায় কাজকর্মে আমি আপনাকে সাহায্য করে এসেছি। আর নিজে বাঁচতে আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন? এটা আমি মানি না। আমি একাই কিচ্ছু করিনি। সব মন্ত্রী সাহেবের আদেশে করেছি।”

কামাল ছটফট করছেন কনস্টেবলের হাত থেকে ছাড়া পেতে। উনার কড়া দৃষ্টি সরোয়ার সাহেবের দিকে পড়লেও সরোয়ার সাহেবের আদেও কিছুই যায় আসেনা। এসময় মিসেস জেবা এলেন। এরপর এলেন ডক্টর সাথে স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেব পুলিশদের অনুরোধ করে বলেব,
” আমার অনুরোধ একটাই! বিনা দোষে আমার উপর আঙ্গুল তুলবেন না আপনারা। আমি কতগুলো বছর ধরে আমার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে এসেছি। একবারও কি আমার উপর আঙ্গুল উঠেছে কখনো? কেউ বলতে পারবে না আমি অন্যায় করেছি।”

অফিসার দুজনই ভাবনায় পড়লেন। সিনিয়র অফিসার আদেশের সুরে বললেন,
“ঠিক আছে। আমরা বিষয়টাকে আরো ঘেঁটে দেখব। তবে আপনারা দুজনই আমার নজরে থাকবেন। মন্ত্রী সাহেব! আপনার কথাতে আমরা বিনা প্রমাণে কামাল সাহেবকে গ্রেফতার করতে পারব না। আপনারা দুজনই পুলিশের নজরে থাকবেন।”

“কামালকে যদি ছেড়ে রাখা হয় তবে আমার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তবে? তার সম্পর্কে আমি এত কথা বললাম সে তো আমার ক্ষতি করতে দুবার ভাববেও না।”

বেশ সন্দিহান হয়ে বলেন সরোয়ার সাহেব। অফিসার ফের জবাবে বলেন,
“সেটাও আমাদের নজরে থাকবে। কামাল সাহেব আপনার আশেপাশেও আসতে পারবে না।”

কামাল শাসিয়ে উঠলেন এবার। সরোয়ার সাহেবের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলেন,
“আপনি এটা ঠিক করলেন না মন্ত্রী সাহেব। সঠিক সময়ে যেই রঙটা আপনি পাল্টালেন। এর জন্য আপনাকে ভুগতে হবে।”

এই শাসানোর কারণে কনস্টেবল আর এক মুহূর্ত কামালকে কেবিনে থাকতে দিলো না। নিয়ে চলে গেল তাকে। সঙ্গে বিদায় নিলেন দুই অফিসার। স্বচ্ছ এতক্ষণ নীরবে সব শুনলেন সন্দেহের তীরটা নিজের বাবার দিকেই গেল তার। ডক্টর এগিয়ে গেলেন সরোয়ার সাহেবের চেকআপ করতে। স্বচ্ছও নিকটে এলো। চোখ ছোটো করে বলল,
“বাবা? কামাল আঙ্কেলের সাথে কী হলো বলো তো? উনার বিরুদ্ধে এমন কী বললে তুমি?”

সরোয়ার সাহেব কিছু বলবার আগেই ডক্টর বিনয়ের সাথে স্বচ্ছকে থামতে বললেন।
“প্লিজ, বেশি কথা বলাবেন না পেশেন্টকে দিয়ে। এমনি অফিসারদের সাথে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। মাত্র নিজের সেন্স-এ ফিরলেন তিনি।”

স্বচ্ছ নিজের হাতের মুঠো শক্ত করল। কিছু বলতে চেয়েও বাঁধা পড়ল। ভেতরে জমা রইল অনেক কৌতূহল!

নিজ অফিসে মন টিকছিল না ফারাহর। বাবার জ্ঞান ফিরেছে শুনেই হাতের সব কাজ ফেলে রেখে এসেছে হসপিটালে। সরোয়ার সাহেবের পাশে বসে থেকে একধ্যানে উনাকে দেখছে ফারাহ। রয়েছে গভীর চিন্তাতে। ফারাহ উপলব্ধি করতে পারে তার বাবার অপ;রাধের কথা। কিন্তু লোকটা যে তার বাবা যার কারণে এই বাবার ঘৃণা করার মনোভাব আসে না। স্বচ্ছ আগেই চলে গেছে। আবার আসবে শেষ দেখা করতে। সরোয়ার সাহেব ইতিমধ্যে স্বচ্ছকে বাড়ি ফিরতে অনুরোধ করে ফেলেছে। তবে স্বচ্ছ এখনো নারাজ।

“বাবা! কেমন লাগছে এখন?”

নরম সুরে বাবার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে শুধালো ফারাহ। সরোয়ার সাহেব শুধু মাথা নাড়ালেন। ফারাহ আরো কিছু বলতে উদ্যত হলো। তবে ফোনের রিংটোনটা আচমকাই বেজে উঠল তার। অফিস থেকে কল এসেছে। রাগ হলো ফারাহর। সে কল করতে মানা করেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে একটু দূরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করার পরেই গর্জে উঠল সে।
“মাথার ব্রেইন কি হাঁটুতে নিয়ে ঘোরো নাকি তোমরা, হ্যাঁ? বলেছি না কল দেবে না?”

ওপাশ থেকে যা উত্তর এলো তাতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না ফারাহ। মুখটা যেন নিমিষে চুপসে গেল ওর। অস্থিরতার সহিত বলল,
“না, না, না। আমি আসছি। এখনি আসছি।”

সে জানালা থেকে তড়িঘড়ি করে মিসেস জেবা আর সৌমিত্রের পাশ কাটিয়ে বলল,
“মা, সৌমিত্র ভাই আমি আসছি। অফিস থেকে ইমারজেন্সি কল এসেছে।”

মেয়ের হঠাৎ এত বিচলতা দেখে অবাক হলেন মিসেস জেবা। তবে পাল্টা প্রশ্ন করার সময় পেলেন না। ফারাহ হম্বিতম্বি করেই বেরিয়ে গেল।

নিজের লাল গাড়িটা এনে দাঁড় করালো ফারাহ। অফিসের বিল্ডিংয়ের সামনে বিরাট শোরগোল। সকলের মুখে তার বাবার বিরুদ্ধে শ্লোগান। বিরোধী দলের লোকজন উঠেপড়ে লেগেছে এখন ফারাহর অফিসটাকেও উঠিয়ে দিতে। ফারাহ নিজেকে সংযত করতে পারল না। পাবলিকের সামনে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো শুরু করল তাদের থামাতে। সকলে থেমে সর্বপ্রথম গাড়ির জানালা দিয়ে ফারাহকে দেখল। একটা ছেলে চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“এইতো ওই ভণ্ড মন্ত্রীর মেয়ে! এইযে আপা! নিচে নামেন। এভাবে গাড়িতে লুকিয়ে বসে থাকলে হবে?”

ফারাহ নিজের ক্রোধ না সামলে কিছু না ভেবেই নিচে নেমে পড়ল। চিল্লিয়ে প্রশ্ন তুলল,
“কী চান আপনারা? কেন অফিসের পেছনে উঠেপড়ে লেগেছেন? আমার অফিসকে ভাঙচুর করছেন। আমার অফিসের এমপ্লয়দের গায়ে হা/ত তু;লতে চাইছেন? কেন? এত সাহস কোথায় পেলেন আপনারা?”

“সাহসের কী দেখছেন? আমরা আপনার এই অফিস খোলা থাকতে দেব না। বন্ধ করেন আপনাদের পুরা পরিবারের ভণ্ডামি। যার বাপের এত কুকর্ম তার মেয়ের কাছ থেকে আমরা ভালো কিছু আশা করি না। বন্ধ করেন আপনার কোম্পানি নাহলে…”

ফারাহর রাগ তুঙ্গে উঠল যেন। চোখমুখ শক্ত করে ছেলেটির দিকে এগিয়ে এসে আঙ্গুল উঁচিয়ে ধমকে উঠল সে।
“এই মুখ সামলে কথা বল। নাহলে আমি একটাকেও ছাড়ব না।”

ছেলেপেলেরা বলতে লাগল,
“যেমন বাবা তেমনি মেয়ে! আমাদের হু;মকি দিচ্ছে। মেয়ে বলে ছাড় দিচ্ছিলাম। এই তোরা, ডিম, পাথর হাতের কাছে যা আছে সব ছুঁড়ে মা/র।”

ফারাহ একটু হলেও ভয় পেল। দূরে পিছিয়ে এলো কিছুটা। তৎক্ষনাৎ সে অনুভব করল তার কপালে এসে ডিম ফেটে গেল। মুখ মেখে গেল। অপমানে, লজ্জায় চোখমুখ খিঁচে রইল সে। হুট করে একটি কালো রঙের গাড়ির আগমন হলো। ফারাহকে আগলে দাঁড়াল সেই গাড়িটি। ছোটো পাথর, ডিম সব এসে লাগল গাড়ির কাঁচে। গাড়ির কাঁচ ভেঙে গেল। সেসব হেয় প্রতিপন্ন করে গাড়ি থেকে বের হলো শৌভিক। তাকে দেখে এক মুহূর্তে থেমে যায় সকলে। থমথমে হয়ে যায় পরিবেশ। শৌভিক নিজের সূক্ষ্ম দৃষ্টি দ্বারা পরখ করে চারিদিকে। কিছু ছেলেপেলের দিকে চোখ আটকায় তার। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“তুই আরিফ না?”

আরিফ আমতা আমতা করে বলল,
“জ..জি ভাই।”

“এখানে কী করিস? একটা মেয়ের উ/পর হা/মলা করছি কাপুরুষের মতো? কে তোকে করতে বলেছে এসব?”

“না, ভাই কেউ না। মানে আমি ভেবেছিলাম এদের উৎখাত করলে আপনাদের ভোটের সময় সুবিধা হবে। তাই…”

শৌভিক গগনবিদারী চিৎকারে গর্জে উঠল যেন।
“একটা যে কিনা কিছু করেনি তাকে আ/ঘাত করে আমাদের সুবিধা করে দিতে চাস তোরা? হ্যাঁ? শা/লা ব/লদের দল!”

শৌভিক বলেই থামল না। এগিয়ে গিয়ে আরিফের শার্টের কলার ধরে একটানা গালে চ/ড় মা/রল তিন-চারটা। মাথা নত হলো আরিফের। পাশ থেকে অন্য এক ছেলে বলে উঠল,
“শৌভিক ভাই আপনি কিন্তু ওকে মে/রে ঠিক করছেন না। আমরা কিন্তু আপনাদেরকে সাপোর্ট করেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলাম।”

“লা/থি মা/রি তোদের এই পদক্ষেপকে। তোরা সব কয়টা এখান থেকে চলে যাবি আমার চোখের সামনে থেকে। আমাদের দল সাপোর্ট করার কোনো দরকার নেই।”

“এটা কিন্তু ঠিক করলেন না ভাই। সামনে ভোট! আপনার ভোট কমে যাবে।”

শৌভিক একরোখা মনোভাব নিয়ে উত্তর করল,
“তাতে আমার কিছু যায়ও না। আসেও না। তোরা আসতে পারিস।”

সকলে মুখ কালো করে বিদায় নিতে নিলে ফারাহ মুখ খুলল এবার।
“দাঁড়ান আপনারা। আমার কিছু বলার আছে।”

শৌভিক উৎসুক হয়ে তাকায় কিছুক্ষণ আগেই অপমানিত হয়ে কুঁকড়ে যাওয়া নারীটির দিকে। মুহূর্তেই মেয়েটির মুখে অদম্য জেদ দেখা যাচ্ছে। অন্য মেয়ে হলে নিশ্চিত এতটা সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না তাও অশ্রুবিহীন! শৌভিকের মনোযোগই সরতে চাইল না সহজে তার দিক থেকে। ফারাহ কঠিন গলায় জানতে চাইল,
“আপনারা এইযে আমার অফিসের সামনে এসে আমার অফিস ভাঙচুর করলেন, আমায় অপমান করলেন সেটা কি শুধুই আমার বাবা খারাপ মানুষ তাই?”

কারোর মুখে কোনো কথা নেই। কারোর কথা বলার মুখ নেই। ফারাহ ফের বলে,
“একজনের অপরাধের জন্য পুরো পরিবার অপরাধী হয়ে যায় না। এই সামান্যতম জ্ঞান আপনাদের মাঝে থাকলে আমার মতো একা একটা মেয়ের সাথে লড়াই করতে আসতেন না আপনারা। কেউ বলতে পারবে না আমার কোম্পানি কাউকে ঠকিয়েছে বা ফারাহ সাহের কারোর সাথে অ/ন্যায় করেছে। যদি বলতে পারে প্রমাণ সমেত তবে আমি নিজে নিজের কোম্পানি ধ্বংস করব। আর তার আগে আমার সাথে আর একবার লাগতে আসলে আমার নিজের ক্ষমতার দৌড় কতদূর সেটা মিনিটে বুঝিয়ে দেব। আপনারা আসতে পারেন।”

সকলের মনে রাগ সৃষ্টি হলেও প্রকাশ করার মতো কোনো জায়গা রইল না। সুতরাং বিদায় নিতে হলো তাদের। হাফ ছাড়ল ফারাহ। জীবনের এত ভয়ানক পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হয়নি তাকে। গোল গোল চোখে সে ভালো করে দেখে শৌভিককে। মানুষটা যেন তার জীবনে লাকি চার্ম। যতবার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হয়েছে ততবারই লোকটি স্বস্তি হয়ে এসেছে। তাকে স্বস্তি বোধ করিয়েছে। ফারাহ ধন্যবাদ দিতে যায় তাকে। তবে তার আগেই শৌভিক সোজাসাপটা বলল,
“আমি দুঃখিত!”

“আপনি কেন দুঃখিত বলছেন? আপনার ভুল কোথায়?”

“ভুলটা আমারই আগাগোড়ায়। আপনি হয়ত জানেন না আপনার বাবার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেসবের পেছনে আমি আছি!”

ফারাহ হতবাক হয়ে চাইল শৌভিকের পানে। মুখটা তার ফ্যাকাসে। শৌভিক ফারাহর কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে নিজের পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে ফারাহর দিকে এগিয়ে দিলো।
“মুখে ডিমের অংশ লেগে আছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে। মুছে নিন। নাকি ফ্রীতে ডিম পেয়ে রূপচর্চা করার সাধ জেগেছে? এমনিতে আজকাল যা ডিমের দাম!”

ফারাহর চোখ ছোটো হলো। শৌভিকের হাত ঠেলে দিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে নিজের মুখ মুছে নেয়। ভার স্বরে বলে,
“আপনার এসব অভিযোগের জন্য বাবার কী অবস্থা হয়েছে জানেন? আর একটু হলে হয়ত বাবাকে হারিয়ে ফেলতাম। বড়ো ক্ষতি হয়ে যেত। তখন হয়ত আপনাকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না।”

শৌভিক নিঃশব্দে ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসে। বলে,
“আপনার বাবা এতদিন মানুষজনের সাথে যেসব অপ/রাধ গুলো করেছে। তা আদেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আপনার মনে হতেই পারে আমি আপনার বাবার বিরোধী দল তাই তাকে নিচে নামানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সত্যি এটাই আপনার বাবা যা যা করেছে তা সামনে এলে কেউ উনাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।”

“যে অন্যায় করেছে সে শা/স্তি পাবে। বাবা সেই মানুষ হলে বাবা পাবে। আমিও চাই। কিন্তু আপনার সাথে আমার অন্য কথা আছে!”

শৌভিক কিছুটা আগ্রহী দৃষ্টিতে একমনে তাকাল ফারাহর দিকে।
“বলে ফেলুন।”

ফারাহ কিছুটা ইতস্ততবোধ করে শুধাল,
“মোহ নামের কাউকে চেনেন?”

চমশার ফ্রেমের উপরে কপালের চামড়া ভাঁজ হলো শৌভিকের। একটু ভেবে বলল,
“চিনি হয়ত!”

ফারাহ সামান্য রাগলো। তেজ নিয়ে বলল,
“আপনি এত হেয়ালি করে কথা বলেন কেন বলুন তো? চিনি আবার হয়ত বলছেন! এটা কেমন কথা?”

শৌভিকের হাসি পেল। তবে তা চেপে রেখে বলল,
“আমি চিনলেও বা কী! না চিনলেও বা কী?”

“আপনার সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে?”

ফারাহর স্ট্রেটকাট কথা শুনে বিষম খেয়ে গেল শৌভিক। ফারাহ নিজেও আচানক কথাটি বলে লজ্জায় পড়ে গেল যেন। আমতা আমতা করে বলল,
“জানি কারোর পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করা উচিত না। কিন্তু এটা জানা খুব দরকার আমার ভাইয়ার জন্য।”

“আপনার ভাইয়ার জন্য কেন?”

“সে মোহকে ভালোবাসে। কিন্তু আপনাকে তো দুচোখে দেখতে পারে না সেটা আপনিও ভালো করে জানেন। সেই আপনাকে সে মোহের সাথে দেখেছে। তাই আপনি যতক্ষণ বিষয়টা ক্লিয়ার না করেছেন তার সাথে আমি ভাবীর লাইনটা ক্লিয়ার করতে পারছি না। বুঝতে পেরেছেন?”

শৌভিক এবার ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল। ফারাহর মুখ তখন ফুলে উঠেছে রাগে। শৌভিক বিদ্রুপ করে বলে,
“সেটা তো আপনার ভাইয়ের সমস্যা! আমি কেন আমাকে যে দুচোখে দেখতে পারে না তার ডাউট ক্লিয়ার করতে যাব?”

ফারাহ নাক ফুলিয়ে জেদ ধরে জানতে চাইল,
“এমন কেন আপনি? বলুন না, আপনার তাকে পছন্দ কিনা!”

শৌভিক কিছু সময় চুপ থাকল। ফারাহর কথাতে পাত্তা না দিয়ে নিজের গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল,
“আমি এই জীবনে শুধু একটা মেয়ের দিকেই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকার আগ্রহ পেয়েছি।”

“কে সে?”

ততক্ষণে শৌভিক নিজের গাড়িতে বসে গিয়েছে৷ গাড়ি তৎক্ষনাৎ স্টার্ট দিয়ে বলল,
“বললে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতে পারে!”

ফারাহকে এক পাহাড় সমান দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে ফেলে চলেই গেল শৌভিক। তার উপর বড্ড রাগ হলো ফারাহর। গটগট করে নিজের অফিসের সিঁড়ির দিকে ছুটল সে।

সামনে নীলয়কে দেখে গাড়ি থামাল শৌভিক। নীলয় তাড়াতাড়ি করে উঠে বসে ভাঙা গাড়ির কাঁচ দেখে আতঙ্ক নিয়ে বলল,
“শৌভিক ভাই! আপনি ঠিক আছেন? শুনলাম ওদিকে ঝামেলার মধ্যে গেছিলেন?”

শৌভিক ফের গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
“হুমম। আমি ঠিক আছি।”

“আগে বললে তো আপনার সাথে আমরাও যেতাম ভাই।”

শৌভিক কথা ঘুরিয়ে বলল,
“সিগারেট আছে তোর কাছে?”

নীলয় তাড়াতাড়ি করে নিজের পকেট থেকে সিগারেট বের করে শৌভিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এইযে ভাই!”

“লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দে।”

নীলয় লাইটারও বের করল। সিগারেট ধরিয়ে শৌভিককে এগিয়ে দিল। একহাতে সিগারেট ধরল সে। নীলয়ের কৌতূহল দৃষ্টি শৌভিককে দেখছে। অতিরিক্ত চিন্তাই থাকলে তবেই শৌভিক সিগারেট খায়। এত কীসের চিন্তা বুঝতে পারছে না নীলয়। শৌভিক ফট করেই বলে বসল,
“আচ্ছা, শত্রুর মেয়ের প্রেমে পড়লে তাকে বিয়ে করার উপায় কী?”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪ [দ্বিতীয় খণ্ড]

আর কিছুক্ষণের মাঝে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হবে সরোয়ার সাহেবকে। স্বচ্ছ নিজে দায়িত্ব নিয়ে সকল ফর্মালিটিস পূরণ করছে। সৌমিত্র তার পাশেই দাঁড়িয়ে। সবকিছু করা শেষে যখন রিসেপশন থেকে অপেক্ষা করতে বলল তখন দুই ভাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকল। স্বচ্ছ হুট করে বলল,
“সৌমিত্র! বাড়ি থেকে আমার সার্টিফিকেট, বায়োডাটা সব এনে দিস তো।”

সৌমিত্র কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেন ভাই?”

“চাকরি খুঁজব। আবার কেন? বেকার তো বসে থাকা যায় না। ক্লাবে কতগুলো দিন ধরে পড়ে আছি। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।”

“কিন্তু ভাই, বাবা তো চাইতো বাবার দিকটা তুমি সামলাও। এখন তুমি…”

স্বচ্ছ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসল হালকা। বলল,
“রা/জনী/তিতে ইন্টারেস্ট আমার কোনো কালেই ছিল না। তবুও বাবার জন্য এটা আমি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন বাবার জন্যই ওইদিকে আমি মুখ তুলেও তাকাতে চাইনা। তার দিকটা বরং তুই সামলে নে।”

সৌমিত্রও হেঁসে দিয়ে বলে,
“বাবা খুব ভালো করে জানে এসব আমার দ্বারা হবে না। তাই তিনি আমার উপর এতটা ভরসাও রাখেন না।”

নিজ কেবিনে বালিশে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে রয়েছেন সরোয়ার সাহেব। তার সামনেই গম্ভীর মুখে রয়েছে আরিদ্র। মাথা ভর্তি তার চিন্তা। একসময় সে হতাশা নিয়ে বলল,
“তার মানে মাত্র একটা সাধারণ মেয়েকে ঘিরে এতকিছু হয়ে গেল? স্বচ্ছ বাড়ি ছেড়ে দিল তার জন্য? আপনার ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি হচ্ছে ওর জন্য? এটা কোনো কথা?”

“কী আর বলব আমি! আমার নিজের ছেলেই যখন আমার বিরুদ্ধে তখন বাকিদের তো সাহস হবেই। কামাল এখন পুলিশের নজরে থাকবে। ওকে দিয়েও কিছু করানো সম্ভব নয়। নিজে বাঁচতে ওকে ফাঁসাতে হয়েছে আমায়। এখন আমি একমাত্র যাকে ভরসা করতে পারি সেটা তুমি।”

আরিদ্র মাথা নাড়ায়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে,
“আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। আপনি শুধু মেয়েটাকে চিনিয়ে দেবেন। বাকি কাজ আমি সামলে নেব। আর সবচেয়ে বড়ো কথা। এই পরিস্থিতিতে আপনাকে প্রথমে স্বচ্ছকে বাড়ি ফেরাতে হবে। আপনার কথা অনুযায়ী স্বচ্ছের সাথে মেয়েটার বন্ডিং অনেক ভালো। আবার বলছেন স্বচ্ছ মেয়েটাকে ভালোবাসে। আগে আপনার ছেলেকে ঠিক করতে হবে আঙ্কেল যেকোনো উপায়ে।”

সরোয়ার সাহেব কিছুই বললেন না। শুধু মনে মনে পরিকল্পনা এঁটে গেলেন। আরিদ্র বিদায় নিলো সেখান থেকে খানিকক্ষণ পরে।

সৌমিত্র দ্রুত এলো সরোয়ার সাহেবের নিকট। বেশ উচ্ছ্বাস দেখা গেল তার চোখমুখে। তার পেছনে ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেবের লক্ষ্য তখন স্বচ্ছের পানেই। সৌমিত্র বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল,
“তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছে বাবা। এখন তুমি আমাদের সাথে।”

“হুমম যাব। তার আগে আমি স্বচ্ছের সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”

ফ্লোরে এক নজরে তাকিয়ে থাকা স্বচ্ছের ঘোলাটে চোখ দুটো তখন গিয়ে থামল নিজের বাবার দিকে। বোঝার চেষ্টা করল বাবার মনে থাকা হরেক প্যাঁচের বিষয়। বুঝে উঠতে পারল না। তৎক্ষনাৎ সরোয়ার সাহেব সৌমিত্রকে আদেশ করলেন,
“বাহিরে যাও। আমি স্বচ্ছের সঙ্গে একাই কথা বলব।”

সৌমিত্র আঁড়চোখে স্বচ্ছকে দেখল। গলা খাঁকারি দিয়ে পেছন ঘুরে বাহিরে যেতে যেতে ভাইকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমাকেও পরে বলবে! যদিও আমি বাহিরে দরজায় কান লাগিয়ে দিয়ে শোনার চেষ্টা করব। বেস্ট অফ লাক বাবার সঙ্গে তর্কাতর্কি করার জন্য।”

সৌমিত্র বাহিরে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। স্বচ্ছ সরোয়ার সাহেবের দিকে না তাকিয়েই ভার গলায় শুধাল,
“বলো কী বলবে!”

“বাড়ি ফিরে চলো আমার সাথে স্বচ্ছ।”

এতক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা স্বচ্ছ বাবার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট হালকা বাঁকিয়ে শব্দহীন হাসে। তার এই হাসিতে জড়িয়ে বিশাল তাচ্ছিল্য।
“মা বলে আমি তোমারই মতো। যেন পুরোটাই কপি। তবে আমাদের দুজনের মাঝে একটা বিশাল ফারাক আছে। সেটা হয়ত তুমিও জানো। কিন্তু বাবা, আমি তোমারই মতো কোনো জিনিসকে উপেক্ষা করলে তার দিকে ফিরে তাকাই না।”

সরোয়ার সাহেবের ঠাণ্ডা মেজাজ তখন বিগড়ে যেতে থাকল। রূঢ় সুরে বললেন,
“তোমার কী মনে হয়? তোমার এই খামখেয়ালীপনার জন্য আমি আমার অবস্থান হারাতে দেব?”

স্বচ্ছ সামান্য থম মে/রে থেকে বলল,
“ওহ! তাহলে আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাওয়ার পেছনেও তোমার স্বার্থ আছে?”

সরোয়ার সাহেব ছেলের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন,
“ধরে নাও তাই। আর ছেলে হিসেবে দায়িত্ব তোমার যে আমার স্বার্থটাকে হাসিল করা৷ তুমি একটা মেয়ের জন্য আমার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছ। যে মেয়ে কিনা তোমার বাবাকে জে/ল খাটানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।”

“তো ভুলটা কী করছে সে? ভাগ্যিস সে এগুলো করছে নয়ত আজীবন একটা ইডিয়টের মতো তোমায় অন্ধবিশ্বাস করতাম আমি। বাবা, তোমায় একটা কথা বলে রাখি। তুমি অসুস্থ হয়েছিলে তাই ছেলে হিসেবে তুমি সুস্থ হওয়া অবধি দায়িত্ব পালন করেছি। যাতে অন্য কেউ আমার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারে। তাই বলে এতটা এক্সপেকটেশন রেখো না আমার থেকে। ভেবো না আমি সব ভুলে বাড়ি যাব।”

স্বচ্ছের আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না সেখানে। পেছন ফিরে দরজার দিকে হাঁটা দিতেই সরোয়ার সাহেব পেছন থেকে বলে উঠলেন,
“মোহ আমার কম ক্ষতি করেনি। আর ও বর্তমানে যা করছে এবং করে চলেছে সেটা আমার সহ্যের বাহিরে চলে যাচ্ছে। তবুও আমি তাকে কিছু বলছি না। কিন্তু ওর জন্য যদি আমার ছেলে আমার থেকে দূরে সরে যায় তাহলে ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমি বাধ্য হবো।”

চোয়ার শক্ত হয়ে এলো স্বচ্ছের। দাঁতে দাঁত চেপে, হাত মুঠো করে প্রতিটা প্রশ্বাসে যেন দগ্ধ হচ্ছে বায়ু। ঘাড় বাঁকিয়ে বাবার দিকে নিজের সবথেকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলল,
“প্লিজ বাবা, এই সাহস তুমি দেখিয়ো না।”

সরোয়ার সাহেব নিজেকে শান্ত রেখে পাশ থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে বললেন,
“সবার চোখে ইতিমধ্যে আমি খারাপ হয়ে গিয়েছি। তাই আরো একটু খারাপ হতে আমার বাঁধবে না একটুও। ডিসিশন তোমার উপরে। তুমি ফিরে আসবে বাড়িতে। আগের মতো হয়ে যাবে। আমার আর কিছু চাইনা তোমার থেকে।”

স্বচ্ছ পলকহীন ক্রুদ্ধ নয়নে দৃষ্টিপাত করে রইল সরোয়ার সাহেবের দিকে। অতঃপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। পিছু ডাকলেন সরোয়ার সাহেব। ছেলে তার কথা শুনল না। আচানক স্বচ্ছের এমন চলে যাওয়ার ফলে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল সৌমিত্র। সেও ডাকল ভাইকে। কিন্তু স্বচ্ছ আর থামলোই না।

বাহিরে বেরিয়ে আবারও হট্টগোলের সম্মুখীন হলো স্বচ্ছ। তার বাবাকে নিয়ে এখনো আমজনতা অশান্তি সৃষ্টি করছে। নিয়ে এসেছে মিছিল। সেটি কোনোরকমে পার হয়ে বারংবার মোহকে কল করে যাচ্ছে স্বচ্ছ। মোহ কল তুলছে না। স্বচ্ছের অসহ্য রকমের রাগ হলো। ভাবল সে মোহের বাড়ির দিকে যাবে কিনা! পরক্ষণেই ভাবল, মোহের পরিবারের কেউ দেখলে কী ভাববে। দুশ্চিন্তায় ভার হয়ে এলো স্বচ্ছের মাথা৷ এরপর অটোকে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ল সে।

সরোয়ার সাহেবকে হসপিটাল থেকে বের করা হলো। উনাকে ঘিরে সব মানুষ ঝামেলা সৃষ্টি করতে লাগলে পুলিশ তা আটকানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হুইলচেয়ারে বসে থাকা সরোয়ার সাহেবের মুখ তখন অপমানে, লজ্জায় নত হয়ে রয়েছে। সবাই উনাকে হেয় করছে। উনি সহ্য করতে পারলেন না। কোনোভাবে ভিড় ঠেলে গাড়ির কাছাকাছি নিয়ে যেতেই উনার নজর পড়ল সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। তাকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি ম/ন্ত্রী সাহেবের। মেয়েটি মোহ। তার মুখে একটা শোধ নেওয়ার পর তৃপ্তিময় রকম হাসিটা লেগে রয়েছে। মৃদু হাসি দিয়ে একনজরে সরোয়ার সাহেবকেই দেখছে সে। সরোয়ার সাহেবকে গাড়িতে তোলা হলো। সরোয়ার সাহেব সৌমিত্র এবং মিসেস জেবাকে বলে দিলেন অন্য গাড়িতে আসতে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে উনার গাড়িটি সরাসরি মোহের সামনে এসে দাঁড়ায়। মোহের মুখে হাসি প্রসারিত হয়। জানালার কাঁচ খুলে যায়। মোহ এবং সরোয়ার সাহেব মুখোমুখি হয়। মোহ বিদ্রুপ করে শুধায়,
“নিজের সম্মান ভিক্ষা করতে এসেছেন নাকি মন্ত্রী সাহেব?”

ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়লেও তা প্রকাশ করতে পারেন না সরোয়ার সাহেব। শান্ত সুরে বলেন,
“ভিক্ষা তাও তোমার থেকে?”

“তাহলে গাড়ি দাঁড় করালেন কেন?”

“তোমাকে সাবধান করতে।”

মোহ এবার খানিকটা শব্দ করেই হেসে দিলো। বলল,
“আপনি একই ভুল করছেন। চেষ্টা কম করেন নি আমাকে দাবিয়ে রাখতে। এই চেষ্টার ফলাফল আপনার চোখের সামনে। দেখুন, চোখ মেলে। প্রতিটা জনগন আপনার বিরুদ্ধে। একদিন আপনি আমার বাবাকে অসম্মানিত করেছিলেন। আজ আপনার সেই এসেছে। সময় বদলায়, এভরিথিং ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড ক্যামস্ ব্যাক এগেইন বাট ইন রিভার্স।”

“সময়টা তোমার। আমারও সময় আসবে।”

সরোয়ার সাহেবের গাড়ি স্টার্ট হলো। মোহকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল গাড়িটি। মোহের প্রচণ্ড পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সে বাকিদের মতো ক্ষমা করতে পারে না। তাও যদি বিষয়টা তার পরিবারের সম্মান ঘিরে হয় তবে আরোও না।

মোহের বাড়ির সামনের রাস্তাটিতে দাঁড়িয়ে অবিরামভাবে কল করে যাচ্ছে স্বচ্ছ। এবার মোহের ফোন বন্ধ বলছে। আতঙ্কে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে তার। এই শেষবার কল করার সিদ্ধান্ত নিলো সে মোহকে। কল না ধরলে সরাসরি তার বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেসা করবে সে। কল করা আর হলো না তার। সৌমিত্রের কল এলো। বিরক্তি নিয়ে তা রিসিভ করার পর ওপরপাশে সৌমিত্রের কণ্ঠ শুনে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। অনেকটা চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“কী! মোহের এ/ক্সিডেন্ট?”

ওপরপাশে সৌমিত্র বলল,
“হ্যাঁ। আমি ওই রোডেই ছিলাম। তাই তাকে নিয়ে আসতে পেরেছি হসপিটালে।”

“আমি আসছি।”

কল কেটে দিলো স্বচ্ছ। ফোনটা পকেটে রাখতে গিয়ে দেখল তার হাত কাঁপছে। তার বাবার বলা কথাগুলো স্মরণে আসছে বারবার। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে দ্রুত সামনের দিকে হাঁটা দিলো সে।

বেডে বসে আছে মোহ। মাথার ব্যান্ডেজ লাগানো। হাতের কনুইয়ের কাছে সবেই ড্রেসিং করে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার। সৌমিত্র পাশেই চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। মোহ মাথা তুলতে পারছে না কিছুতে। মাথাটা একহাতে ধরে সৌমিত্রের উদ্দেশ্যে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে।”

সৌমিত্র সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি ঠিক আছেন তো ভাবিজি?”

মোহ কিছু বলতে চাইলে হুড়মুড়িয়ে স্বচ্ছের আগমন হয়। উপস্থিত থাকা সবাইকে চমকে দিয়ে মোহকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বসে সে। অতঃপর স্বস্তির দম ফেলতে শুরু করে। এতক্ষণ যেন শ্বাস নেওয়া ভুলে গিয়েছিল সে। মোহ শুনতে পায় স্বচ্ছের জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ। স্বচ্ছের আচানক কাণ্ডে সে নির্বাক। লজ্জায় যেন নাক কাটা গেল তার! লোকটা কী করছে? স্বচ্ছ তখন বলে বসে,
“আমাকে মে/রে ফেলতে চাও? তো মে/রে ফেলো। তবুও এমন জঘ/ন্য যন্ত্রণা দিও না আমায়।”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]