#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১১ [দ্বিতীয় খণ্ড]
আজ ইথানের স্কুলে প্রথমদিন। এত ঝামেলার কারণে বছরের শুরুতে স্কুলে ভর্তি করানো হয়ে ওঠেনি মোহের। তাই কিছুদিন দেরি হয়েছে ইথানের বিদ্যালয় জীবন শুরু করতে। ইথান খুশিতে গদগদ একেবারে। চোখেমুখে খুশি ধরছে না। তার সবচেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে কারণ সে নতুন বন্ধু পাবে। মোহ ভয়ে বাহিরে খেলতে দেয়না ইথানকে। তবে ছোট্ট ইথানের অজানা মোহের ভীতির কারণ। ইথানের পরিচয় সকলের অজানা। তাকে নিয়ে বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলে। যেটার সম্মুখীন মোহ হতে পারলেও ইথানের ছোট্ট মন হতে পারবে না। স্কুল ড্রেসের টাই গলায় বেঁধে লাফিয়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় ইথান। স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে না মাম্মা?”
মোহ হেসে ওঠে। ইথানের চিবুক ধরে বলে,
“ইয়েস, ইয়েস! মাই ইথান ইজ দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম বয় ইন মাই হার্ট।”
মোহের প্রশংসায় আরো উচ্ছ্বসিত হয় ইথান। বড়ো বড়ো তাকিয়ে মোহকে জড়িয়ে ধরে। তারপর আহ্লাদী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ঈশানী আন্টি তো আমার স্কুলের ফার্স্ট দিনে আসবে বলেছিল। সে আজকে সত্যি আসবে?”
“মনে হয় না, বাবু। তার অনেক জ্বর। তোমায় নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার সময় তাকে দেখতে যাব। ঠিক আছে?”
ইথান বাধ্য ছেলের মতো সম্মতি জানায়। মোহ বেগুনি ওড়নাটা নিজের মাথায় জড়িয়ে একহাতে ইথানের ব্যাগ এবং অন্যহাতে ইথানের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বের হয়।
বসার ঘরে আসতেই নিজের মামা এবং মামীর মুখোমুখি হলো মোহ। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও একটা হাসি দিয়ে সালাম দিলো সে। এই সকালে সাইফুল সাহেব এবং মিসেস আফিয়াকে মোটেও আশা করেনি সে। সাইফুল সাহেব নিজের ভাগ্নীকে ইশারাতে ডেকে উনার পাশে বসতে বললেন। মোহ গিয়ে চুপটি করে বসল মামার কাছে। তার মাথায় সাইফুল সাহেব হাত রাখতেই সে মিহি সুরে বলে ওঠে,
“মামা আপনারা এত সকালে….”
“কেন? অখুশি হয়েছ আমাদের দেখে?”
মোহ তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“মোটেও নয়। আমি ভাবলাম কোনো বিশেষ ব্যাপার আছে তাই… ”
সাইফুল সাহেব মোহকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ফের বললেন,
“বিশেষ ব্যাপার তো আছে। বিশেষ ব্যাপারটা তুমি তৈরি করেছ?”
মোহের কপালে ভাঁজ। ঠোঁটে মৃদু হাসি বজায় রয়েছে। সে নিজেকে দেখিয়ে বলল,
“আমি?”
“তোমার জন্য শুধু তোমার মামা নয় অনেক মানুষ নিজের অধিকারটুকু বুঝে নিতে পেরেছে।”
মোহ ডাগরডাগর চোখে চাইল তার বাবার দিকে। বিষয়টা মেলাতে পারল না সে। সাইফুল সাহেব আচানক বলে উঠলেন,
“আমরা আমাদের ফ্যাক্টরির জন্য যত টাকার ভাগীদার ছিলাম সবটা ফিরে পেয়েছি। নিজের হাতে সব ফিরিয়ে দিয়েছেন ম/ন্ত্রী সাহেব।”
মাথাটা যেন তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে গেল মোহের। পরক্ষণেই বুঝল নিজেকে শুদ্ধ প্রমাণ করার জন্য এবং কামালকে ফাঁসাতে নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করছেন সরোয়ার সাহেব। তবে এই সুযোগে সবার হকের টাকা পাওয়া গেছে বলে ভালো লাগল মোহের। সাইফুল সাহেব আজহার সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ও হচ্ছে তোমার ঘরের লক্ষ্মী।”
“সেটা তো আমি জানি, সাইফুল ভাই।”
সাইফুল ভাই একটু সময় নিয়ে বললেন,
“কিন্তু সারাজীবন এই লক্ষ্মীকে নিজের ঘরেই রাখবেন নাকি আজহার ভাই?”
মোহ বিভ্রান্তিকর মুখ নিয়ে বাবাকে আর মামাকে একবার দেখল। আজহার সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
“ওর চাহিদা তো আপনি জানেনই। যে ইথানকে মানবে না তাকে সেও মানতে চায়না।”
মোহের মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে ওঠে। দ্রুত সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইতস্ততবোধ করে বলে,
“ইথানের স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসি।”
মোহ গিয়ে ইথানের হাত ধরতেই সাইফুল সাহেব ডেকে বললেন,
“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাই তো শুনে গেলে না, মোহ!”
মোহ ফের বিনয়ী হয়ে জানতে চাইল,
“জি, বলুন। আসলে ইথানের স্কুলে আজকে প্রথম দিন।”
“আর কয়দিন পর আমার ছেলে অভিক আসছে দেশে।”
কথাটা শুনে মোহের খুশি হওয়া উচিত বলে সে নিজের ঠোঁটে হাসি আনলো।
“সে তো ভালো কথা মামা! এত বছর পর অভিক ভাই দেশে আসছে।”
সাইফুল সাহেব মাথা নাড়িয়ে জানালেন,
“ওর চাকরিও হয়ে গেছে ওখানে। তাই ভাবছি ওর বিয়ে দেওয়ার কথা।”
মিসেস আফিয়া এবার মুখ খুললেন। মুখে কিছুটা অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে বললেন,
“কিন্তু আজকাল সব মেয়ের মধ্যেই খুঁত দেখতে পাচ্ছি। আমার ছেলের সাথে একটা ভালো মেয়ের বিয়ে দেব সেটার কোনো উপায় পাচ্ছি না। কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করতেও ভয় লাগে।”
সাইফুল সাহেব এবার সকলকে চমকে দিয়ে বলে বসলেন,
“সেকারণেই তো আমি আমার বোনের কাছে তার মেয়েকে চাইতে এসেছি।”
পিলে চমকে উঠল মোহের। চোখের পলক পড়া বন্ধ হলো। একহাত মুঠো করে শক্ত করে নিজের জামাটা চেপে ধরল। আজহার সাহেব চমকে উঠেও স্বাভাবিক হলেন। কেননা, এর আগেও এই বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল উনার সাথে সাইফুল সাহেবের। কিন্তু মোহের সম্মতি ব্যতীত কথা এগোতে সাহস পান নি। উনি কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারেন মোহ এবং স্বচ্ছের বিষয়টি। তিনি মোহের চুপসে যাওয়া মুখশ্রীর দিকে তাকান। মিসেস আফিয়া নিজেও হতবাক স্বামীর এমন প্রস্তাবে। কেননা সাইফুল সাহেব কখনোই তার সঙ্গে এমন বিষয়ে আলোচনা করেননি। মিসেস আফিয়া উনার বাহুতে হাত রেখে চাপা সুরে বলেন,
“এসব কী বলছ?”
সাইফুল সাহেবের চোখেমুখে ভরাট আত্মবিশ্বাস। তিনি বলতে থাকলেন,
“অভিকের জন্য সত্যিই একজন বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী প্রয়োজন। যে কিনা ওর প্রতি সৎ থাকবে। আর আমার চোখে দেখা মোহই একমাত্র মেয়ে যাকে আমি সৎ থাকতে দেখি সব কাজে। আমার মনে হয় না মোহকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ আছে।”
মিসেস আফিয়ার মাথায় রক্ত চড়ে উঠল যেন। মোহকে তিনি কোনোকালেই তেমন পছন্দ করে উঠতে পারেন নি। বিশেষ করে, ইথান জন্ম নেওয়ার পর। উনি এবার রাগ চেপে বললেন,
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? মোহের কারণে নিজের সব পরিশ্রমের টাকা ফিরে পেয়েছ তার কারণে মোহের প্রতি তোমার কৃতজ্ঞতা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ওকে সরাসরি অভিকের সাথে জুড়ে দিতে হবে? তুমি তো আসার সময় এব্যাপারে একবারও কিছু আমাকে জানাও নি। তুমি কী করে পারো আমার ছেলের ব্যাপারে আলোচনা না করে ধুমধাম করে এসব বলে দিতে?”
সাইফুল সাহেব ক্লান্তিত শ্বাস নিলেন। স্ত্রীকে শান্ত গলায় বললেন,
“আফিয়া, শান্ত হও। আমার বোন আর জামাই সামনেই আছে। আর আমি যা বলেছি অনেক ভাবনাচিন্তা করে বলেছি। মোহের মতো একটা মেয়েকেও পাবে তুমি?”
“মোহের মতো মেয়ে আমি চাইও না। ওকে সৎ বলছ কী করে? যেই মেয়েটা বিয়ের আগে বাচ্চা জন্ম দেয় তাকে তোমার শুদ্ধ মনে হলো আমার ছেলের জন্য? আমি ম/রে গেলেও এই সম্বন্ধ মানব না বলে রাখলাম।”
সাইফুল সাহেব পারলেন না আফিয়ার মুখ বন্ধ করতে। শেষ কথাগুলো সরাসরি সারা অঙ্গে আগুন ধরালো মোহের। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠল অপমানে। মোহের মা মিসেস সুফিয়া কিছু বলতে উদ্যত হলেন তার আগেই মোহ বলা শুরু করল,
“আপনি মানলেও এই সম্বন্ধ আমি মানতাম না, মামী। আপনি যে শুরু থেকে আমায় অপছন্দ করেন আমার ইথানের কারণে আমি সেটা জানি। কিন্তু তাই বলে আপনি ইথানকে নিয়ে যা ইচ্ছে বলবেন আর আমি মানব সেটা ভাববেন না। ইথানের জন্য আমি সবকিছুর ঊর্ধ্বে যেতে পারি। অভিক ভাইকে আমি ভাই ছাড়া অন্য চোখে দেখতেও পারব না। তাই এই সম্বন্ধে রাজি হবার প্রশ্নও আসে না। মামা, আপনি খারাপভাবে নেবেন না আমার কথাগুলোকে। আমাকে যদি কখনো বিয়ে করতেই হয় তবে আমি সেই বাড়িতে করব যেখানে আমাকে আর ইথানকে অপমান করার কথা কখনো ভাববেও না।”
কথাগুলো শেষ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল মোহ। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা, আমি আসছি।”
টেবিলে মাথা রেখে দুহাত ছড়িয়ে বসে আছে ফারাহ। চোখেমুখে বিশাল ক্লান্তি। সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এই বর্ষাকালেও এত বিয়েশাদি করে কে? তাদের মনে কি আমার মতো ছোট্ট ডিজাইনারের মতো একটুও মায়া হয়না?”
নিজের আনমনা কথাবার্তায় ব্যাঘাত ঘটল ফারাহর। একটি মেয়েলি চিকন কণ্ঠ কানে এলো তার।
“ম্যাম, মে আই কাম ইন?”
ফারাহ মাথা উঠিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করল না। তার হাত তুলে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে তাকে ভেতরে আসতে বলল। মেয়েটি ফারাহর সামনে এসে মিনমিন করে বলল,
“দুপুর তিনটায় একটা মিটিং আছে। ক্লায়েন্টের প্রজেক্ট হচ্ছে বিয়ের।”
ঝড়ের গতিতে ফারাহ মাথা উঠে মেয়েটির দিকে এমনভাবে তাকাল যেন মেয়েটি অনেক বড়ো অপরাধ করে ফেলেছে। ফারাহ উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন সুরে বলল,
“আগামী এক ঘণ্টাতে আমি কোনোরকম কাজের কথা শুনতে চাইনা। যে আমাকে কাজের কথা বলতে আসবে আমি তাকে ফায়ার করে দেব।”
মেয়েটি ঘাবড়ে বেরিয়ে গেল। তবে এটা তাদের কাছে নতুন নয়। মাঝে মাঝেই ফারাহ এমন করে থাকে। ফারাহ আবারও চেয়ারে গা এলিয়ে বসল। হঠাৎ তার অবসাদে ভরা মস্তিষ্কে স্মরণে এলো শৌভিকের ব্যাপারটা। দ্রুত হাতে ফোন নিলো সে। শৌভিকের নম্বরটা সে নিয়েছিল। ফারাহ দ্রুত হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল। শৌভিককে এক্টিভ দেখে চোখ ছোটো করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। লোকটির প্রোফাইলে সচরাচরের মতো পাঞ্জাবি পরিহিত ছবি। ছবি দেখে এসে হুট করে একটা মেয়ের ছবি পাঠিয়ে দিলো শৌভিকের নম্বরে। মেয়েটির চেহারা, গড়ন মিলিয়ে বেশ স্মার্ট, সুন্দর। তৎক্ষনাৎ ওপরপাশ থেকে শৌভিকের উত্তর এলো, ‘এটা কে?’
ফারাহ রিপ্লাই করল, ‘আপনার জন্য বেস্ট প্রেমিকা খুঁজে দেব বলেছিলাম। পছন্দ হচ্ছে আপনার? আপনি বললেই লাইন ক্লিয়ার।’
ওপরপাশ থেকে উত্তর আসা বন্ধ রইল পাঁচ মিনিটের জন্য। অথচ উত্তরের অপেক্ষায় অধৈর্য হলো ফারাহ। এরপর উত্তর আসতেই তড়িঘড়ি করে দেখল সে। শৌভিকের জবাব ছিল, ‘প্রেমিকা হিসেবে এই মেয়ে বেস্ট বুঝলেন কী করে? প্রেম টেম নিয়ে পিএইচডি করেছেন ইনি?’
ফারাহ মুখ বাঁকিয়ে উত্তর লিখল, ‘উঁহু, আমার চেনা তো। আমি জানি মেয়েটি কেমন। আপনি শুধু বলবেন আপনার পছন্দ কিনা।’
পরক্ষণেই শৌভিক রিপ্লাই দিলো, ‘উঁহু, মেয়েটা অতিরিক্ত লম্বা।’
ফারাহ ধৈর্য নিয়ে আরো একটি মেয়ের ছবি পাঠালো। আবারও শৌভিক বলে, ‘উঁহু, মেয়েটি অতিরিক্ত খাটো মনে হচ্ছে। আমার সাথে দাঁড়ালে মনে হবে বাবা মেয়ের জুটি।’
দাঁত কিড়মিড় করে আরো দুটো মেয়ের ছবি দিলো ফারাহ। আবারও শৌভিকের প্রত্যুত্তর, ‘মেয়েটি অতিরিক্ত ফর্সা। আমার এত ফর্সা মেয়ে পছন্দ নয়। আর অন্য মেয়েটা দেখে মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে অনাহারে ভুগছে।’
ফারাহ ধৈর্য হারিয়ে কয়েকটা রাগের ইমোজি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘ইটস কলড জিরো ফিগার। আমার কোম্পানির বেস্ট মডেল সে।’
‘আমি তো আমার প্রেমিকার প্রেমিক পুরুষ হবো। তাকে দিয়ে তো আর মডেলিং করাব না যে জিরো ফিগার লাগবে।’
এভাবেই প্রায় আরো দশ জনের ছবি পাঠিয়ে হাঁপিয়ে উঠল ফারাহ। সে বুঝল শৌভিক ইচ্ছে করে তাকে জ্বালাতন করছে। তবুও হাল মানল না সে। অলস ভঙ্গিতে টেবিলে ভর দিয়ে আরেকটি মেয়ের ছবি পাঠাতে গিয়ে হুট করে হাত লেগে ভুলবশত তার ছবি চলে গেল। বিষয়টি বুঝতে পেরে দ্রুত ছবি ডিলেট করতে গেলেই ঝড়ের বেগে ওপাশ থেকে রিপ্লাই এলো যে ‘আই থিংক সি ইজ পারফেক্ট। লুক, সি ইজ নট অনলি মাই গার্লফ্রেন্ড ম্যাটারিয়্যাল, সি ইজ অলসো মাই ওয়াইফ ম্যাটারিয়াল। ইজ নট সি?’
ফোন হাতে নিয়ে থম মে/রে বসে রইল ফারাহ। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার৷ চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে। মনে মনে সে নিজেকে বারবার বোঝাচ্ছে সে ভুলভাল ম্যাসেজ পড়ছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। লোকটা কি খেয়াল করেনি এটা কার ছবি? নাকি ইচ্ছে করে এমন করছে? শূন্য মস্তিস্কে কাঁপা হাতে সে লিখল, ‘কিন্তু এটা তো আমার ছবি।’
ম্যাসেজটা আর সেন্ড করার সাহস হয়ে উঠল না ফারাহর। ফোনটা উল্টো করে শব্দ করে টেবিলে রেখে দিলো সে। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে টেবিলে থাকা পানি ঢকঢক করে পান করল সে। তবুও যেন শিহরণ কাটে না।
আর কিছু সময় পরই বিকেল হবে। সূর্য ঢলে পড়বে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আলো দেখাতে সে ছুটবে। ঢাকা শহরে ট্র্যাফিক জ্যাম থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যানবাহনের জোটের মাঝেই কাটিয়ে দিতে হয় অনেকসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মোহেরও আজকে দেরি হয়ে গিয়েছে ইথানকে নিতে স্কুলে পৌঁছাতে। তাও প্রায় আধঘণ্টা দেরি। অটো থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে ভাড়া মিটিয়ে স্কুলে ঢুকল সে। বেশির ভাগ বাচ্চারা বাড়ি চলে গিয়েছে। মাঠটা পুরো ফাঁকা। মোহ আশেপাশে দেখল। ইথানকে পেল না কোথাও। অথচ সে বলে রেখেছিল ইথানকে মাঠের বেঞ্চে বসে থাকতে। আস্তে করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে ক্লাসরুম অবধি গেল মোহ। ক্লাসরুমে তখন তালা দেওয়া হচ্ছে অর্থাৎ সেখান থেকে সব বাচ্চা বেরিয়ে গেছে। মনটা আনচান করা আরম্ভ করল মোহের। পরক্ষণেই নিজেকে শান্তনা দিলো এই ভেবে যে, এত বড়ো স্কুল, তার মাঝে নিশ্চয়ই কোথাও ইথান রয়েছে। তাছাড়া এই স্কুল অনেকটা সিকিউরিটি মেনে চলে।
মিনেট বিশেক পুরো স্কুল ঘুরেও ইথানকে যখন পাওয়া গেল না প্রাণটা তখন যেন বেরিয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো তার। হাত-পা অনবরত কাঁপছে মোহের। এই প্রথম ইথান তার চোখের আড়ালে। করিডোর ঘেঁষে বসে পড়ল সে। বিড়বিড়িয়ে শুধু নিতে থাকল ইথানের নাম। তবে একজন শিক্ষক তাকে দেখে অফিস রুমে নিয়ে যান এবং সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে দিলেন।
দুরুদুরু মনে সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিল মোহ৷ ইথান মাঠেই বড়ো কিছু ছেলেপেলের সঙ্গে ভাব জমিয়ে দোলনায় বসেছিল। দরজার অনেকটা বাম পাশে থাকা দোলনায় বসে তখন ইথান দোল খাচ্ছিল তখন ইথান বাহিরের দিকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাহিরের দিকে চলে যায়।মোহ তাড়াহুড়ো করে বলে,
“মনে হচ্ছে ওকে কেউ ডাকছিল৷ ও মনে হলো কারোর ডাকে যেন চলে গেল! আপনাদের কাছে দরজার ওদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই?”
টিচার সরাসরি বলে দিলেন,
“সরি ম্যাম। ওদিকটায় ক্যামেরা কিছুদিন ধরে কাজ করছে না।”
কপালে হাত ঠেকিয়ে কিছু মুহূর্ত বসে থাকার পর রাগ উঠল মোহের। চিল্লিয়ে সে বলে উঠল,
“এমন ইরেসপন্সিবল এর মতো কাজ কেন করেন আপনারা? এখানে এতগুলো বাচ্চা কে কখন কার সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরার গুরুত্ব কতটা জানেন? ওদিকে ওয়াচম্যানও কিছু বলতে পারছেন না। অথচ উনি নাকি বাচ্চাকে কে নিতে এলো, কে রেখে গেল সব মানুষের পরিচয় লিখে রাখেন! তাহলে আমার বাচ্চাকে কে নিয়ে গেল?”
অফিসরুমে থাকা দুজন টিচার মোহকে শান্ত করতে চাইল। কিন্তু মোহ যেন রণচণ্ডী রূপ ধারণ করেছে। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় সাবধান করে দিলো তাদের।
“আমি বলে দিচ্ছি! আমার বাচ্চার যদি একটা আ/ঘাতও লাগে তাহলে এই স্কুলের সিকিউরিটি নিয়ে আমি কোর্টে প্রশ্ন তুলব।”
কারোর কোনো কথা শুনতেই রাজি নয় মোহ। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল স্কুল থেকে। বাহিরে এসেই তার কঠিন মুখ বিলীন হলো। ভেতরে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তার। লাল চোখে টলমল অশ্রু। হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠে রাস্তায় বসে পড়ল সে মুখ ঢেকে। অস্ফুটস্বরে বলতে থাকল,
“ইথান! কোথায় গেলে বাবু তুমি?”
মোহের আচানক এমন কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখে আশেপাশের কিছু লোক জড়ো হলো। সমাগম তৈরি হলো। ঢল গিলে মাথা তুলে তাকাল মোহ। চোখে পানি নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সবার সামনে গিয়ে ইথানের ছবি বের করে মিনতি করে বলে,
“সবাই একটু দেখবেন এই ছবিটা? ওকে কোথাও দেখেছেন আপনারা আধঘণ্টা বা একঘণ্টা আগে এই স্কুল থেকে বের হতে?”
সবাই না বোধক মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাল। মোহ আবারও অনুরোধ করল,
“একটু ভালো করে দেখুন। ওকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ না কেউ দেখবেন! প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।”
সবাইকে একে একে ছবি দেখিয়েও যখন লাভ হচ্ছিল না। রাস্তা ফাঁকা হচ্ছিল। তখন হঠাৎ আশার আলো দেখল মোহ। একজন লোক মোহের ফোনটা ধরে ভালো করে দেখে বলে উঠলেন,
“এই বাচ্চাকে তো মনে হয় প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে একটা লোকের সঙ্গে দেখেছিলাম।”
মোহের চিন্তা আরো বাড়ল। ভয়ে ভেতরটাতে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে তার। কাঁপা সুরে সে বলল,
“লোক? কোন লোক?”
“আমি তো চিনি না। তবে ওইযে তিন মাথার রাস্তা দেখছেন ওদিক দিয়ে আমি আসছিলাম। ওই ডান দিকের রাস্তার প্রথম গলিটাতে ঢুকতে দেখেছিলাম। ওদিকে একটা বন্ধ বাড়ি পড়ে আছে।”
মোহ এক মুহূর্ত থামলো না যেন। সেই গলির দিকে হাঁটা ধরল। মিনিটেই বিধ্বস্ত হয়েছে তার অবস্থা। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না আর। মিনিট পাঁচের মাঝে গলি পেরিয়ে এলো দুটো পোড়া বাড়ি। আগে হয়ত এখানে আগুন লেগেছিল। মোহ ছন্নছাড়া হয়ে আশেপাশে দেখল। উদ্ভ্রান্তের মতো শুধু ইথানের নাম জপতে লাগল। তার দুটো চোখ তখন ঘোলা হয়ে এসেছে। পোড়া বাড়ির এক দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে সে। আকস্মিকভাবে তার অজান্তে কোত্থেকে যেন একটা দড়ি এসে গলায় ঝুলে পড়ে। হঠাৎ এরূপ ঘটনায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই দড়িতে টান অনুভব করে সে। গলায় ফাঁ/স অনুভব করে মোহ। দুহাত দিয়ে দড়ি সরিয়ে দিতে চাইতেই চুলেও টান পড়ে তার। মেয়েটি পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। চোখ খিঁচে ধরে চুলে হাত রাখতেই অন্য একটি হাতের উপর হাত পড়ে তার৷ বুঝতে সময় লাগে না খুবই খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। সে ছটফটিয়ে ওঠে। চিৎকার করার আগে তার মুখে রুমাল জোরে চেপে ধরা হয়। সে কাতরাতে থাকা ছাড়া পাবার আশায়। তবে শ্বাস নেয় না সহজে। সে জানে, শ্বাস নিলে সে জ্ঞান হারাতে পারে। কৌশলে তার এক হাতের ব্যাগ উল্টো করে দিয়ে পেছনে ধরে রাখা লোকটির মাথায় অবিরাম আ/ঘাত করতে থাকে। লোকটির মৃদু আর্তনাদ শুনছে সে। মোহ এবার লোকটির পায়ে পা তুলে দিলো সজোরে। চিৎকার করে উঠে মোহকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো লোকটি। পিছু ফিরে এক অচেনা, শ্যামলা করে মানুষ দেখে চোখ ছোটো করে রইল সে। আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
“দূরে থাক। আমার দিকে এগোবি না।”
দুই পা পিছিয়ে যেতেই এবার তার ওড়না ধরে টান দেয় কেউ। হকচকিয়ে উঠল মোহ। পিছু ফেরার আগে তার ওড়না জড়িয়ে তার গলায় ফাঁ/স দেওয়া হলো। মোহ এবারও নিজের পুরোনো কাজটি করল। কিন্তু তার পায়ের আ/ঘাতে প্রতিহত হলো না এবার লোকটি। একহাতে মোহের দুটো হাত কবজা করেছে সে। মোহ বারে বারে পা দিয়েই প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। লোকটি আস্তে আস্তে দুর্বল হচ্ছে। হঠাৎ সে মোহের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এত তিড়িংবিড়িং করলে তোমার ইথান তো গায়েব হয়ে যাবে, মোহ রানি!”
মোহ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে গেল। কণ্ঠটা চেনা। ইথানের ক্ষতির হু/মকি। শরীর অসার হয়ে এলো মোহের। মোহকে ধরে রাখা লোকটি সামনের লোকটিকে ইশারা করল রুমাল তার মুখের সামনে ধরতে। মোহের মুখে চেপে ধরা হলো রুমাল। তাকে আদেশ করল,
“শ্বাস নাও। রিল্যাক্স ফিল করবে। রাত অবধি কিচ্ছু হবে না, আই প্রমিস।”
মোহ শ্বাস নেওয়ার মতো বোকামি করল না। শুধু চোখ বুঁজে ফেলার ভান ধরল। এতে হেসে উঠল তাকে প্রতিহত করার চেষ্টায় থাকা লোকটি। তার মুখে আরো জোরে চেপে ধরে সে বলল,
“তোমাকে আমি চিনি, মোহ। তুমি অতি চালাক। তুমি এখনও শ্বাসই নাওনি।”
মোহের গলায় ওড়না দিয়ে জোরে ফাঁ/স দেওয়া হলো। মোহ এবার শ্বাস না নিয়ে থাকতে পারল না। একবার শ্বাস নিয়েই নেতিয়ে পড়ল সে। বুঝতে পারল, হয়ত আজই তার শেষ।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মোহ এখনো ইথানকে নিয়ে বাড়ি ফেরেনি। চিন্তা এবং রাগে নিজে নিজে বিড়বিড় করছেন মিসেস সুফিয়া। ফোনও ধরছে না মোহ। ক্রোধ আরো বাড়ছে মিসেস সুফিয়ার। এই মেয়েটাকে কোনোদিনই বশে আনতে পারলেন না তিনি। আজহার সাহেবও স্কুলের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছেন। তাই স্বামীর জন্য চা বানাতে রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন মিসেস সুফিয়া। চুলায় পানি বসিয়ে দিতেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। চোখমুখ শক্ত করে দরজার দিকে গেলেন তিনি। উনার উদ্দেশ্য মোহকে এবার খুব করে ঝাড়বেন৷
দরজা খুলেই যখন মোহকে দুটো কথা শোনাতে নিবেন তখনি শুধু ইথানকে দেখতে পেলেন মিসেস সুফিয়া। হতভম্ব হয়ে ইথানকে ঘরে নিয়ে আসতে আসতে শুধালেন,
“ইথান, তোমার মাম্মা কোথায়?”
ইথান সহজ ভাষা উত্তর করল,
“জানি না তো।”
মিসেস সুফিয়া আরো অবাক হলেন। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমায় নিতে যায়নি?”
“না। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি মাঠে বড়োদের সাথে দোল খাচ্ছিলাম। তারপর একটা আঙ্কেল ডাকল। আমি প্রথমে সাড়া দিইনি। মাম্মা বলেছিল অচেনা কারোর ডাকে সাড়া না দিতে। কিন্তু পরে আঙ্কেল বলল, তাকে নাকি মাম্মা পাঠিয়েছে। তাও আমি যাইনি। কিন্তু শেষে মাম্মার ফটো লোকটার ফোনে দেখে আমি বিশ্বাস করে নিই আর বাড়ি আসার জন্য আঙ্কেলের গাড়িতে উঠি। কিন্তু আঙ্কেল অনেকক্ষণ ধরে ঘুরাচ্ছিল আমায়। চকলেট, চিপস কিনে দিলো, রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। আমি বারবার বলেছিলাম আমি বাড়ি যাব। কিন্তু শুনছিলই না। পরে আমি কাঁদতে শুরু করি। তখন আমাকে এনে এখানে ছেড়ে চলে গেল।”
সবটা শুনে অদ্ভুত লাগল মিসেস সুফিয়ার। মোহের চিন্তায় চুপসে গেল মুখ। ঢক গিলে বিড়বিড়িয়ে বললেন,
“আমার মোহ কোথায় তাহলে?”
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১২ [দ্বিতীয় খণ্ড]
গোলাপের বিশাল এক তোড়া নিয়ে বিয়ের রিসেপশনে হাজির হলো তানিয়া। পরনে ভারি কাজের গোলাপি শাড়ি। মাথায় আর কানে বড়ো বড়ো কানের দুল এবং টিকলি ঝুলিয়ে রাখা। নতুন বর এবং বউয়ের স্টেজ থেকে কিছু দূরত্বে এসে দাঁড়ায় সে। সামনে আরো এগিয়ে যাবে তার আগেই আচানক কেউ এসে তার ঘাড়ে থা/বা দিয়ে বলে ওঠে,
“আরে তুইও এসেছিস নিজের প্রাক্তনের বিয়ের রিসেপশনে? আমি তো ভেবেছিলাম ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করবি।”
কথা শেষ করে তানিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায় রিয়ানা। তানিয়া ভাবেও নি সেদিন রেস্টুরেন্টে এমন বিদঘুটে কাণ্ডের পরও রিয়ানা তার সাথে কথা বলবে। তানিয়া মুখে হাসি বজায় রেখে বলল,
“কেন? দুনিয়াতে কি ছেলের অভাব পড়েছে নাকি যে এই একটা ছেলের জন্য আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদব?”
“বাবাহ্! এত তাড়াতাড়ি সব ইমোশন ভ্যানিশ হয়ে গেল?”
“না হওয়ার কী আছে! যার প্রতি অনুভূতি কাজ করত তার মধ্যেই যদি আমার প্রতি অনুভূতি না থাকে তাহলে আমার মনে নিজের ইমোশন দিয়ে কি ঘুড়ি ওড়াব?”
তানিয়ার প্রতিটা কথায় ঝাঁজ। সে রিয়ানার উত্তরের অপেক্ষা করল না। সামনে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল। দুটো সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই তার প্রাক্তন রাফাতের। সে কখনোই আশা করেনি তানিয়া এখানে হাজির হতে পারে। তার হাসি মুখটা রাফাতকে আরো বিস্মিত করে তুলছে। অপরদিকে এত বছরের সম্পর্কে সে কখনোই তানিয়াকে এত সুন্দর করে সাজতে দেখেনি। সে মূলত তানিয়াকে ইনভাইট করেছিল তাকে জ্বালানোর জন্য। তানিয়াকে দেখে এখন তারই গা জ্বলছে। তানিয়া এসেই রাফাতের দিকে চেয়ে বলল,
“কংগ্রাচুলেশনস, রাফাত! তুমি তো জিতে গেছো। বেশ সুন্দরী বউ হয়েছে তোমার। তবে বিয়েতে ইনভাইট করলে না। তাতে কিন্তু রাগ করেছি।”
রাফাত হকচকিয়ে উঠল। তানিয়া প্রচণ্ড নরম মনের ভীতু স্বভাবের মেয়ে। প্রাক্তনের বিয়ের অনুষ্ঠানে এত সাহস দেখিয়ে আসার ব্যাপারটা মানতে পারল না রাফাত। তানিয়া রাফাতের নতুন বউয়ের হাতে ফুলটা ধরিয়ে দিলো। আর রাফাতকে আবার বলল,
“তুমি কি বোবা হয়ে গেলে? পরিচয় করাবে না নাকি তোমার বউয়ের সাথে?”
রাফাতের কণ্ঠস্বর কাঁপছে। কেমন যেন এখন লজ্জা লাগছে তানিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তার ইতস্ততবোধ করার ব্যাপারটি তানিয়ার চোখ এড়ালো না। এই লজ্জাটাই সে দেখতে চেয়েছিল। রাফাত ঢক গিলে তার নতুন বউকে দেখিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,
“সি ইজ মাই ওয়াইফ রিফা।”
অল্পবয়সী রিফা মুখে লাজুক হাসি নিয়ে তানিয়াকে বলল,
“হ্যালো, আপু।”
তানিয়াও তাল মিলিয়ে বলল,
“হ্যালো, আমি তানিয়া।”
তানিয়া আরো কিছু আলাপ করল রিফার সঙ্গে। রাফাত তখন ঘামছিল অনবরত। যদি তানিয়া বেফাঁস কিছু বলে ফেলে? কিন্তু তানিয়া সেটা করল না। রিফার সঙ্গে একটি ছবি তুলে স্টেজ থেকে নামতে আরম্ভ করল সে। রাফাত হাফ ছাড়ল যেন।
একটা সিঁড়িতে তানিয়া পা রাখতেই বিশাল হলরুমের এক কোণে মেয়েদের হইহট্টগোলের মাঝে একটি ছেলের দিকে নজর পড়ল তানিয়ার৷ ধূসর রঙা এক শেরওয়ানি পরনে ছেলেটির মুখে মেয়েরা রসগোল্লা পুরে দিচ্ছে। ভালো করে দেখে বুঝল তানিয়া ভুল দেখছে না। ছেলেটি সৌমিত্র। এই দৃশ্যটা বিরক্তিকর লাগল তানিয়ার কাছে। তানিয়া বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে গিয়ে বসল। হাতে ফোন নিলো মোহকে কল করার জন্য। মোহকে আশেপাশে দেখছে না সে। অথচ আজ তারও থাকার কথা ছিল। সে কি আসে নি? তানিয়া দু’বার কল করেও মোহের ফোন সুইচ অফ পেল। বিরক্তিটা আরো বেড়ে গেল তার।
খাবার টেবিলে একা বসে আছে তানিয়া। রিয়ানা একবার ডেকে গেছে তাকে যেন তাদের সঙ্গে গিয়ে বসে। কিন্তু তানিয়া জানে রিয়ানার সঙ্গে আবারও কথা কাটাকাটি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কাজেই একা একা বসেছে তানিয়া। বলা নেই, কওয়া নেই, কোত্থেকে যেন তার পাশে এসে সৌমিত্র বসে পড়ল। সৌমিত্রের সঙ্গে তার আরেক বন্ধু। তার বন্ধু সৌমিত্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই টেবিল ছাড়া আর কোনোটা ফাঁকা নেই রে।”
সৌমিত্র ক্লান্তি ভঙ্গিতে বলল,
“হ্যাঁ, আর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।”
তানিয়াকে এখনো খেয়াল করেনি সৌমিত্র। তানিয়া ঠিকই খেয়াল করে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। বিড়বিড়িয়ে সে বলে উঠল,
“এক হাঁড়ি মিষ্টি মেয়েদের হাতে সাবাড় করার পরেও নাকি উনার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে!”
সৌমিত্রে কানে বিড়বিড় আওয়াজ অস্পষ্ট হয়ে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে গোলাপি শাড়িতে আবিষ্ট নারীকে দেখে মুহূর্তেই ডেকে উঠল,
“মিস গোলাপি!”
তানিয়া হকচকিয়ে উঠে তাকায় আঁখি দুটো গোল গোল করে। সৌমিত্র আবারও তানিয়ার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“গোলাপি রঙটা কি আপনার জন্যই বানানো নাকি? আজকেও আপনি গোলাপি শাড়িতে। নাকি আপনার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পেছনে গোলাপি রঙের কোনো কারসাজি আছে?”
তানিয়া প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এখানে? বর নাকি কনেপক্ষ?”
“আমি সেইভাবে দেখতে গেলে কনেপক্ষ। মেয়েটা আমার বন্ধুর ছোটো বোন। ওদের বিয়েতে আসতে পারিনি। তাই বন্ধুর জোরাজুরিতে এখানে এসেছি। আর আপনি এখানে?”
তানিয়া আমতা আমতা করছে। পাশেই সৌমিত্রের আরেক বন্ধু। সে বলতে চায়না রাফাত তার প্রাক্তন। তানিয়ার অস্বস্তি দেখে সৌমিত্র ফট করে বুঝে নিলো বিষয়টি।
“ওহ, হো! ওয়েট! এই ছেলেই…”
কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই তানিয়া সৌমিত্রের মুখ বন্ধ করতে তার মুখের উপর হাত রাখল। বিয়ে বাড়ি ভর্তি আত্মীয়। সে চায়নি, বিষয়টা ফাঁস হয়ে কথাগুলো নতুন বউয়ের কানে পৌঁছাক। সৌমিত্রের ঠোঁটে হাত রাখার পর তানিয়ার মনে হলো সে ভীষণ লজ্জাজনক কাজ করে ফেলেছে। দ্রুত হাতটা সরিয়ে নিলো সে। সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“নাইস ফ্র্যাগরেন্স! রোজ ফ্লেবারের ইউজ করেন?”
কান গরম হয়ে আসে তানিয়ার। পাশেই সৌমিত্রের বন্ধু মুখ টিপে হাসছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“দয়া করে চুপ করে থাকুন এখন। তাতে আমি শান্তি পেতাম একটু।”
সৌমিত্র বাধ্যমতো উত্তর করল,
“যথা আজ্ঞা!”
রাতের মহল! সরোয়ার সাহেবের বাড়ির বড়ো ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হয়েছে মেহমান। সরোয়ার সাহেব আজ বেশ খোশমেজাজে রয়েছেন। টুকটাক গল্প চলছে উনার সঙ্গে নাহিয়ান রায়হানের। যিনি এই মুহূর্তে শহরের এক অন্যতম বড়ো ব্যবসায়ী। উনার একপাশে উনার স্ত্রী এবং অন্যপাশে দেখা যায় হাস্যোজ্জ্বল মুখের একজন আধুনিকাকে। যে কিনা নাহিয়ানের একমাত্র ছোটো বোন অন্বেষা। স্বাস্থ্যের প্রতি অতি যত্নশীল মেয়েটি চিকন গড়নের এবং পরনে শুভ্র রঙের সুন্দর ও দামী আধুনিক পোশাক। সোজা চুলের ফাঁকে ব্রাউন কালার করা যেসব দেখলেই বোঝা যায় নিজের সৌন্দর্যের পরিচর্যায় কমতি রাখেনা মেয়েটি। সরোয়ার সাহেব উনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীকে আদেশ করলেন,
“স্বচ্ছের ঘুম ভাঙেনি? যাও ডেকে নিয়ে এসো ওকে। উনারা অনেকক্ষণ এসেছেন।”
মিসেস জেবা এবার মিহি সুরে বললেন,
“গতরাতে ছেলের অনেক জ্বর ছিল। শরীর ভালো নেই ওর। তাই হয়ত ঘুম থেকে উঠতে পারছে না।”
নাহিয়ানের কানে এলো কথাটি। তিনি আগ বাড়িয়ে বললেন,
“সমস্যা নেই। শরীর খারাপ থাকলে ঘুম পাবে স্বাভাবিক। ওকে ডাকাডাকির দরকার নেই। আজ তো মূলত আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছি।”
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু এক ঢিলে দুই পাখি মা/রার অভ্যেস আমার। বোঝেনই তো আমি ম/ন্ত্রী মানুষ। এমনিতে আপনার বোনও উপস্থিত আছে এখানে। কথা এগিয়ে রাখলে ক্ষতি তো নেই।”
নিজের ঘর থেকে সবে তৈরি হয়ে বেরিয়েছে স্বচ্ছ। গায়ে হালকা জ্বর তবুও বিদ্যমান। বৃষ্টির মৌসুমে চারিদিকে কিছুটা ঠাণ্ডার ছাপ পড়েছে। নিজের পাতলা জ্যাকেটের চেইন লাগাতে লাগাতে করিডোর পেরোতেই নিচে ভিন্ন কিছু কণ্ঠস্বর শুনে কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে স্বচ্ছের। ঘুরে রেলিং ঘেঁষে তার ধূসর দুটি নয়নের নজর নিক্ষেপ করে নিচের দিকে। সোফায় আলাপচারিতা মন দিয়ে শোনে। আস্তে আস্তে সরু হয় দৃষ্টি, জোরে চাপ দিয়ে ধরে থাকে রেলিং। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। তার নামা দেখেই সকলের মনোযোগ তার দিকে যায়। মিসেস জেবা আদুরে স্বরে বলে ওঠেন,
“ঘুম ভেঙেছে তোমার? দুপুরে কিছু খাওনি। এখন কিছু বানিয়ে দেব?”
স্বচ্ছ মায়ের কথার জবাব দেওয়ার সুযোগ পেল না। সরোয়ার সাহেব শুধালেন,
“কোথাও বের হচ্ছো তুমি?”
“হুমম। একটু বন্ধুরা ডেকেছে।”
স্বচ্ছের সোজা উত্তর। সরোয়ার সাহেব তেজি সুরে আদেশ করেন,
“বন্ধুদের সঙ্গে তো প্রতিদিন বের হও। আজকে মেহমান এসেছে বাড়িতে। বসো আমার পাশে। কথাবার্তা বলো।”
স্বচ্ছ কোনো বাহানা ব্যতীত গিয়ে সোজা বসে পড়ল বাবার পাশে। সরোয়ার সাহেব নাহিয়ানকে দেখিয়ে বললেন,
“উনি হচ্ছে নাহিয়ান রায়হান। আর এইচ কোম্পানির সিইও।”
নাহিয়ান স্বচ্ছের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে স্বচ্ছও ভদ্রতার খাতিরে হাত মেলায় উনার সঙ্গে। সরোয়ার সাহেব কিছুটা হেসেই ছেলেকে দেখিয়ে বলেন,
“এটাই আমার বড়ো ছেলে, স্বচ্ছ।”
“আপনার তো আরো একটা ছেলে আর মেয়ে থাকার কথা তাই না?”
নাহিয়ানের সরল প্রশ্নে সরোয়ার সাহেব মাথা দুলিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ। ছোটো ছেলেটা একদম বাউণ্ডুলে। কথা শোনেনা। সারাদিন বাহিরেই কাটায়। আর মেয়েটা নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। ডিজাইনার তো! বিজি ওমেন।”
নাহিয়ান প্রশস্ত করে হেসে নিজের বোনের দিকে একবার তাকায়। অন্বেষা হুট করে দৃষ্টি সরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। নাহিয়ান বুঝতেই পেরেছিল সে এতক্ষণ স্বচ্ছকে দেখছিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে অন্বেষা৷ নাহিয়ান বলতে শুরু করে,
“আমি আসল ব্যাপারে বলে রাখতে চাই, আমার বোন হচ্ছে আমার অন্য দুনিয়া। সবকিছু একদিকে আর আমার বোন একদিকে। ওর বয়স অনেকটাই কম তখন মা মা/রা গেলেন। বাবাও বেশি বাঁচেন নি। চেষ্টা করতাম ওকে মা-বাবার অভাব বুঝতে না দিতে। বাট এখন রিয়েলাইজ করছি ও বড়ো হয়েছে। তাই বিয়ের ব্যাপারটা ভাবছি৷ আপনারা কি স্বচ্ছকে বলেছিলেন আগে এসব ব্যাপারে? ও কি কিছু ভেবেছে?”
সরোয়ার সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,
“ও আলাদা কী বলবে! ওর নিজের পছন্দ নেই। ও জানে, আমিই ওর জন্য সবসময় বেস্ট এনে দিয়েছি।”
স্বচ্ছ হঠাৎ মৃদু হাসল। তার হাসিটা কারো নজরে না এলেও অন্বেষা দেখল। ভ্রু কুঁচকে এক নজরে চেয়ে রইল সে। অন্বেষা বিচক্ষণী মেয়ে। তার মনে হলো স্বচ্ছ নামক সুদর্শন পুরুষটি একটি রহস্যে ঘেরা পুস্তক। তার মনে ভীষণ কৌতূহল জাগল এই লোকটিকে আরো জানার জন্য। নাহিয়ানের স্ত্রী কথার মাঝে বলে ওঠেন,
“আজকাল ছেলেমেয়েদেরও তো পছন্দ থাকে তাই না? ওরা একে অপরকে পছন্দ করল কিনা জানা প্রয়োজন।”
সরোয়ার সাহেব স্বচ্ছের পানে চাইলেন। তার মুখে বিন্দুমাত্র আগ্রহের ছাপ নেই। রয়েছে গাম্ভীর্যের আধিক্য। বসে বসে নিজের চেইনের ঘড়িটা আপনমনে ঘোরাতে ব্যস্ত সে। তখন বেজে ওঠে স্বচ্ছের ফোন। ফোনটা বের করে রিসিভ করার আগে নামটা দেখে জড়িয়ে যায় মুখ। কল রিসিভ করে কানে ধরে চুপ করে বসে থাকে। সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগেই ভার চোখমুখ মুহূর্তে চুপসে গেছে। নয়ন দুটি বড়ো করে ফেলেছে। সে শুধু দুটো শব্দ উচ্চারণ করল,
“আমি আসছি।”
কাউকে কোনো কৈফিয়ত না দিয়েই ঝড়ের বেগে হাঁটা ধরে স্বচ্ছ। সবাইকে না পেরিয়ে যেতেই সরোয়ার সাহেব পিছু ডেকে বলেন,
“স্বচ্ছ! কোথায় যাচ্ছো? এটা কেমন অভদ্রতা?”
স্বচ্ছের হাঁটা বন্ধ হয়। মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। তার তাকানোর মাঝে অনল প্রবাহ ছিল। তার দৃষ্টি কাউকে হু;মকি দিচ্ছে যেন৷ সরোয়ার সাহেব বুঝলেন এই দৃষ্টি উনার জন্যই।
খাওয়াদাওয়া শেষে পুরো আড্ডামহল তৈরি হয়েছে রিসেশপনের একটি কর্ণার। বন্ধুবান্ধব সকলে বসেছে নতুন বউ এবং বরের সঙ্গে গল্পগুজব করতে। তানিয়াও রয়েছে সেখানে। তবে সে থাকতে চায়নি মোটেও। চলে যেতে চেয়েছিল। রিয়ানা তাকে এনেছে একপ্রকার জোর করেই। তানিয়া উপলব্ধি করতে পারে যখন তখন রিয়ানা বেফাঁস কিছু বলে দিতে পারে। তাই সে ভীষণ চিন্তিত। তার বিপরীত পাশেই বসে সৌমিত্র। তানিয়াকেই পর্যবেক্ষণ করছে। সবার বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। কারোর বিয়ে হয়েছে, কারোর এঙ্গেজমেন্ট সেরে ফেলা হয়েছে আবার কেউ রিলেশনশিপে। সবার কথা শোনার পর রিয়ানা দুম করে বলল,
“তানিয়া তোর কী খবর? পুরোনো রিলেশনশিপ ভুলে নতুন কিছু করতে পারলি?”
তানিয়া থতমত খেলো। সে জানত এমন কিছু হবে। রিয়ানার আরেক বান্ধবী বলল,
“এবার রিলেশনে না গিয়ে সরাসরি বিয়ে করে নিস। তাহলে আর বর পালাতে পারবে না। বেচারি! তোকে দেখে কষ্টই লাগে। শেষমেশ টিকিয়ে রাখতে পারলি না।”
এসব কথাতে রাফাতও ঘামছে। মনে মনে দোষারোপ করছে তানিয়াকে। কী দরকার ছিল এখানে আসার? তানিয়া ঢক গিলে বলল,
“কোনো সম্পর্ক মৃত্যুর আগ অবধি টিকিয়ে রাখতে গেলে দুজনেরই ইচ্ছে, সম্মতি, ভালোবাসা, মায়া থাকতে হয়। হয়ত অপরপাশ থেকে তা ছিল তা তাই সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে গেছে৷ এসব নিয়ে আর কখনো ভাবি না।”
“নতুন কাউকে সুযোগ দিলেও তো পারেন মিস গোলাপি। কিন্তু আপনি তো চোখে দেখতেই পান না।”
তানিয়া ঘাবড়ে তাকায় সৌমিত্রের পানে। লোকটা কী বলছে? তার জিজ্ঞাসু চোখ দুটি সৌমিত্রের দিকে স্থির। লোচন দুটি জানতে চাইছে, ‘কেন এমন বললেন?’
সৌমিত্র রিয়ানার দিকে চেয়ে বলে,
“মিস রিয়ানা! আপনি তো একটু আপনার বান্ধবীকে বলুন চোখ মেলে চারিদিকে দেখতে। যেন আমাকে দেখতে পায়। আমি এক হতভাগা উনার সামান্য ইশারা পেতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।”
সকলে আনন্দে হেসে উঠল, তানিয়া ও রিয়ানা ব্যতীত। তানিয়া এখনো সৌমিত্রের এসব কথা বলার পেছনে কারণ খুঁজে বের করতে পারছে না। এসব বলে কি লোকটা তাকে এই রিয়ানার বলা কথাগুলো থেকে রক্ষা করতে চাইছে! কে জানে? সকলের মাঝে তানিয়া এবং সৌমিত্র নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়। সকলে জানতে চায়, সৌমিত্র কি আসলেই তানিয়াকে পছন্দ করে? সকলের উত্তর দিতে উঠে দাঁড়ায় সৌমিত্র। সকলকে থামানোর প্রচেষ্টা করে বলে,
“ইয়েস, আই লাইক মিস গোলাপি। কিন্তু সে চোখে দেখেও দেখে না, কানে শুনেও শোনে না।”
সৌমিত্রের বন্ধুমহল হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। তানিয়া কী প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে না পেরে থম মেরে বসে রইল। সৌমিত্র তাকে আরো বিস্মিত করে গেয়ে উঠল,
“হতে পারে কোনো রাস্তায় কোনো হুড তোলা এক রিকশায়,
আমি নীল ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, তুমি দেখলে না! রোদে পোড়া এ রোমিও চেহারা তুমি বুঝলে না, আমার ইশারা।
মন বলে যদি থামতে, তুমি থামলে না।”
সকলে হাত তালি দিয়ে পরিবেশ আরো রোমাঞ্চিত করে তুলল। তানিয়া এক বিরাট অস্বস্তি থেকে বাঁচলেও নতুন অস্বস্তিতে পড়ল যেন। লজ্জা লাগছে তার। সৌমিত্র তার দিকেই চেয়ে আছে এখনো। নাটক করলেও এতটা নাটক করার দরকার আছে কি? এত শোরগোলে সৌমিত্র অনুভব করল, তার ফোন বাজছে। সে সেখান থেকে খানিকটা দূরে এলো, কেননা কলটা স্বচ্ছ করেছে। সে কল রিসিভ করে হ্যালো বলারও সুযোগ পেল না। স্বচ্ছ ওপাশ থেকে প্রচণ্ড তাড়া নিয়ে বলল,
“তোর একটা ফ্রেন্ড আছে না? ফোন ট্র্যাক করতে পারে? ওকে এখন একটা ফোন ট্র্যাক করতে দিলে পারবে?”
স্বচ্ছের এত তাড়া দেখে নিজে কিছুটা ভড়কায় সৌমিত্র। এক সেকেন্ডও হয়নি তাতেই সৌমিত্রের গলার আওয়াজ না পেয়ে স্বচ্ছ চেঁচিয়ে উঠল।
“কী হলো বল!”
” হ্যাঁ নম্বর দিলে পারার তো কথা কিন্তু কী হয়েছে? কাকে ট্রেস করতে চাও?”
স্বচ্ছ নিজের শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে শ্বাস নেওয়া চেষ্টা করল। দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাতাসে শান্তি নেই। সে বলল,
“মোহকে। ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
সৌমিত্র আকাশ থেকে পড়ল যেন!
“কী! খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী?”
“মানে বোঝানোর সময় আমার কাছে নেই। ওকে বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ও বাড়ি ফিরেনি। ওর নম্বর ট্রেস করার চেষ্টা কর, ভাই। জলদি।”
সৌমিত্রও বিচলিত হলো তৎক্ষনাৎ। সায় দিয়ে বলল,
“আমি দেখছি।”
ফোন কেটে সৌমিত্র ছুটল তানিয়ার দিকে। তাকেও বিষয়টা জানানো দরকার। বন্ধুমহলের হাসাহাসির মাঝে সৌমিত্র তানিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“মিস তানিয়া! আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।”
তানিয়া পেছন ফিরে সৌমিত্রের গম্ভীর মুখ পরখ করল। জানতে চাইল,
“কোথায়? কেন যাব?”
“প্রশ্ন করবেন না। আমি যেতে যেতে বলছি।”
সৌমিত্রের কিছুক্ষণ আগের হাসি মুখ মিলিয়ে গেছে। কিছু কী ঘটেছে? আন্দাজ করে উঠে দাঁড়াল তানিয়া। বাকি সব বন্ধু বলে উঠল,
“আলাদা করে প্রপোজ করার মন্য ডাকছিস?”
সেসব কথাতে কান দেওয়ার সময় হলো না সৌমিত্রের। তানিয়ার সঙ্গে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।
মাথা ভর্তি উত্তাপ। দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়। এক মুহূর্তের জন্য নিজ চিত্তের স্থিরতা অনুভব করতে পারছে না স্বচ্ছ। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে জাগছে মাথা ফা/টিয়ে ফেলতে। আগেরবার এটা করে সে শান্তি পেয়েছিল। কিন্তু এবার সে শুধু মোহকে একপলক দেখতে চায় তাও সুস্থভাবে। গাড়ির স্পিড বাড়ায় স্বচ্ছ। তার মনের আতঙ্ক সে কাউকে মেলে দেখাতে পারছে না। সৌমিত্রের কল আসে। সময় নষ্ট না করেই কলটা ধরতেই সৌমিত্র জবাব করে,
“ফোনটা বন্ধই ভাইয়া। হয়ত সিমও খুলে ফেলা হয়েছে। লাস্ট লোকেশন ওই ব্রিজের আশেপাশেও কোথাও ছিল।”
স্বচ্ছের ভীতি বাড়ল। হাত অনবরত কাঁপতে থাকল। গাড়ির স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যেতে থাকল। তখনি হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরল স্টিয়ারিং। সামনেই সিগন্যাল পড়ে গেল। সব গাড়ি থেমে গেল। কিন্তু থামাল না স্বচ্ছ। আগের মতোই স্পিডে সব গাড়ি অতিক্রম করে বেরিয়ে গেল। তার সময় নেই। একেকটা মুহূর্ত যাচ্ছে এবং রূহ্ এর আর্তনাদ বাড়ছে। সিগন্যাল না মানার ব্যাপারটি নজরে এলো ট্র্যাফিক পুলিশের। গাড়ির নম্বর নোট করা হলো তার। কল করা হলো ইমারজেন্সি পুলিশ ফোর্সকে। স্বচ্ছ অ/পরাধ করে ফেলেছে।
নিজের নেত্রপল্লব মেলতেই মনে হলো মাথা যেন ব্য/থায় ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ টেনে এনে ফেলে দিলো শক্ত কোনো জমিনের উপর। হাত-পা কোথাও ছি/লে গেল। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো মোহ। হাত নাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বুঝল তার হাত বাঁধা। মস্তিষ্কে নাড়া দিলো জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্ত। মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কারোর কান্নার আওয়াজ আসতে থাকল। কান্নার আওয়াজ তার চেনা। মুখ থেকে হালকা আর্তনাদ বের করার চেষ্টা করল মোহ। তবুও সফল হলো না। এরপর কর্ণকুহরে এলো লঞ্চের কিছু শব্দ। বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। সে কোথায়? ভালো করে চোখ মেলে চারিদিকে অন্ধকারই দেখে। রাতের পরিবেশ। শনশন করছে চারিদিকে বাতাস। আচমকা তার মুখে টর্চ লাইট মারল কেউ। চোখটা আবারও বন্ধ করতে হলো তার। মুখটা কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও আওয়াজ বের করার চেষ্টা করতেই আরিদ্র এসে তার সামনে বসল। তার হাতে টর্চ। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মোহ। অবস্থা বেশ রুগ্ন। আবছা আলোতে আরিদ্রকে দেখেই রাগে গজগজ করে উঠল সে। উঠে বসতে চাইল। আরিদ্র হেঁসে বলল,
“যতই চেষ্টা করে নাও। সফল কিন্তু আমিই হবো।”
মোহ নিজের বাঁধা পা দিয়ে লা/থি মারা চেষ্টা করে আরিদ্রকে। এত তেজ মোটেই পছন্দ নয় আরিদ্রের। সে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল মোহকে। চোখে পানি টলমল করে উঠল মোহের। তাকে আরিদ্র ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোমার জন্য চমক আছে। ভেতরে দেখো।”
লঞ্চের ভেতরে দেখতে বলল আরিদ্র তাকে। মোহ না চাইতেও দেখল সেদিকে। ঈশানীকেও বাঁধা অবস্থায় দেখে থমকাল সে। ছটফটিয়ে যেতে চাইল ওর কাছে। ও কেন এখানে? মনে বিভিন্ন প্রশ্ন। ঈশানীর মুখ খোলা। সে কাঁদছে। মোহকে বলছে,
“আমায় ক্ষমা কর মোহ! আমার বোকামির জন্য তুই এমন অবস্থায়।”
মোহ কিছু বলতে চাইল। গোঙাতে থাকল অনবরত। চোখ রাঙাল আরিদ্রকে। ছেলেটা আবার হাসল।
“অবাক হলে? ভাবছ ঈশানীকে কী করে পেলাম? তোমার ফোন থেকে নম্বর বের করে কল করেছি। আমি জানতে পেরেছিলাম ওর সাথে তোমার যোগাযোগ আছে। ওকে শুধু বলেছি, তুমি আমার নাগালে আছো। ও যদি না আসে তোমার অবস্থা ওর মতো করব। নিষিদ্ধ নারী বানাব তোমায়।”
গা গুলিয়ে আসে মোহের। শরীরের লোম শিউরে ওঠে। মুখে কাপড় না থাকলে থুথু নিক্ষেপ করত আরিদ্রকে। ঈশানী ভেতরে থেকে নিজের বাঁধা হাতটা জোড় করে বলল,
“আরিদ্র! ওর কী দোষ! ওকে ছাড়ো। তুমি বলেছিলে ওকে ছাড়বে। তুমি কথার খেলাপ করতে পারো না। তুমি আমাকে আবার সেখানে রেখে এসো নয়ত মে/রে ফেলো। কিন্তু ওকে ছাড়ো। আমি তোমার পায়ে পড়ি!”
আরিদ্র টেনেহিঁচড়ে মোহকেও নিয়ে লঞ্চের ভেতরের দিকটাই গেল। অতঃপর ঈশানীর কাছে যেয়ে তার গালে হাত বুলিয়ে বলল,
“তোমার আর্তনাদ আমার খুব প্রিয়। তাই তোমার মুখ খোলা রেখেছি। তুমি তো জানো, কথা দিয়ে কথা না রাখা আমার স্বভাব। কেন আমায় বিশ্বাস করলে বলো তো?”
ঈশানী অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে মিনতি করল।
“আরিদ্র,প্লিজ!”
আরিদ্র তবুও হাসল। ঈশানী হঠাৎ ক্ষেপে উঠল। সমস্ত মিনতি রাগে পরিণত হলো আকস্মিকভাবে। এটা ঈশানীর স্বভাব ছিল আগে থেকেই সে চিৎকার করে উঠল,
“জা/নোয়ারের বাচ্চা! ছেড়ে দে আমাকে। তারপর তোর লা/শ ফেলব শা/লা। ভয় পাস আমাদের? বেঁধে রেখেছিস কেন? খুলে দেখ কী করি। জঘন্য কাপুরুষ! তোকে আমি…”
এই বলেই কিছু না ভেবেই আরিদ্রের মুখে থুথু দিয়ে বসল ঈশানী। মোহ কাঁপছে তখন। শরীরে শক্তি অবশিষ্ট নেই। চেষ্টা করছে ছাড়া পাওয়ার। থুথুতে ভরে গেল আরিদ্রের মুখ। আরিদ্রের বাকি লোকগুলো ঈশানীকে সরে নিয়ে গেল। ঈশানীর মুখ বন্ধ হলো না। সে বলতেই থাকল,
“আমাকে মে/রেই ফেল কু/ত্তার বাচ্চা। আমি বেঁচে থাকলে তোদের মতো কাপুরুষকে চুড়ি পরিয়ে ঘোরাব আর শেষে সকলের সামনে মা//রতে দ্বিধাবোধ করব না।”
ক্রোধে কাঁপুনি উঠল আরিদ্রের শরীরে। পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা দড়ি হাতে তুলে ঈশানীর কাছে এগিয়ে গেল সে। ঈশানী ফুঁসছে। মুহূর্তের মধ্যে দড়ি দিয়ে ঈশানীর গলা পেঁচিয়ে ধরল আরিদ্র। পিলে চমকে উঠল মোহের। ঈশানীকে জোরে ফাঁ/স দিতে দিতে বলল,
“তোর ইচ্ছে আমি পূরণ করছি আজকে। জীবনের শেষ মুহূর্ত এসে গেছে তোর। এতদিন বাঁচিয়ে রেখে ভুলই করেছিলাম।”
ঈশানীর চোখ উল্টে যাচ্ছে। মোহ তার কাছে যেতে পারছে না। তবুও হাঁটু দিয়ে আরিদ্রের পায়ের কাছে যেয়ে পড়ল সে। আরিদ্র তার হাতের উপর পা তুলে দিলো। আর্তনাদ করতে চেয়েও পারল না সে। দেখল ঈশানী ছটফট করছে। তার চোখে বাঁচার আর্তনাদ রয়েছে। হয়ত নিশ্চয় সে শেষ মুহূর্তে নিজের ছেলেকে ইথানকে নিয়ে সুন্দর সময় কল্পনা করছে! মোহের চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরতে থাকে। সে ব্যর্থ, সে অযোগ্য। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। ঈশানীকে বাঁচাতে পারছে না সে। কী নির্মম দৃশ্য। মোহ সব অস্পষ্ট দেখছে। একটা সময় সে খেয়াল করল ঈশানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। সে মাটিতে তার পাশেই পড়ে গেছে নিস্তেজ হয়ে। আরিদ্র মোহের হাত থেকে পা উঠিয়ে নিলো। দ্রুত ঈশানীর দিকে ফিরে অস্পষ্ট কণ্ঠে ডাকতে থাকল মোহ। লাভ হলো না। আরিদ্র যেন এতক্ষণ ঘোরের মাঝে ছিল। একজনকে সে মে/রে ফেলেছে এটা অবিশ্বাস্য লাগছে। হাতে থাকা দড়ি ছুঁড়ে দূরে ফেলে দিলো। কী করবে ভেবে পেল না। তখন যেন মাথায় শয়/তান চেপে বসেছিল। এখন কী হবে? অনেক ভেবে আরিদ্র তার সঙ্গে থাকা ছেলেদের বলল,
“এই মেয়ের লা/শ বাহিরে নদীতে ফেলে দে। তাড়াতাড়ি কর।”
মোহ চিৎকার করার চেষ্টা করল। ওকে নিয়ে যেতে মানা করল। তবুও কেউ শুনল না। দুইজন মিলে ওকে ধরে বাহিরে নিয়ে গেল। মোহ শেষ অবধি শেষ করল। হাঁটুর মাধ্যমে কষ্ট করে বাহিরে যেতেই পানির তীব্র শব্দ হলো। সে বুঝল ঈশানীকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই থম মে/রে বসে রইল সে। তার জীবনকে শূন্য লাগছে। সবটা ঘোলাটে লাগছে। তারা ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হচ্ছে। মোহ ওপরের দিকে চুপ করে চেয়ে আছে। তার খেয়াল যেন সব ম/রে গিয়েছে। একজন ছেলে আরিদ্রকে জিজ্ঞেস করল,
“এই মাইয়ার কী করমু, বস? এরেও কি ওই মাইয়াডার মতো…”
ছেলেটির কথা শেষ না হতেই আরিদ্র তাকে ধমকে বলল,
“না, না। ওকে আর মা/রব না। তোরা যা ইচ্ছা কর। আমি এমনিতে অনেক চিন্তায় পড়ে গেছি। আজকে রাতে তোরা ওকে নিয়ে যা মন চায় কর। ভোরের দিকে সেই নিষিদ্ধপল্লী হবে ওর স্থান।”
গায়ে কাটা দিয়ে উঠল মোহের। আবছা আলোয় খেয়াল করল সে ছেলে দুটির লোলুপ দৃষ্টি৷ হৃদয় কাঁপছে তার। এবার কী তার সম্মানও খোয়া যাবে? আত্মা কেঁ/পে উঠল তার। সে পিছিয়ে গিয়ে থামল একদম কিনারায়৷ ওরা এগিয়ে আসছে। নিচে পানি। এখান থেকে ঝাঁপ দিলে এই বাঁধা হাত-পা নিয়ে বাঁচার সম্ভবনা নেই। ছেলে দুটির দিকে একবার তাকায় মোহ। হঠাৎ কেউ টর্চ ধরে তার দিকে ব্রিজের উপর থেকে। তা খেয়াল করে আরিদ্র চিল্লিয়ে বলে,
“এই শালা! কে/স খাওয়াবি নাকি? ভেতরে নিয়ে আয়। তারপর যা করার কর।”
ছেলেটি মোহের হাত স্পর্শ করতে যায়। আগপাছ না ভেবে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ল মোহ। ছেলে দুটো চিৎকার করে উঠল। আরিদ্র তড়িঘড়ি করে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। মোহ স্বইচ্ছায় মৃ/ত্যু বেছেছে।
চলবে….
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৩ [দ্বিতীয় খণ্ড]
স্বচ্ছের হাত একজন ট্রাফিক পুলিশ অফিসার ধরে রেখেছেন। বারংবার গাড়ির লাইসেন্স এবং কাগজপত্র দেখানোর জন্য জেরা করে চলেছেন। স্বচ্ছ তাকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। উপরন্তু চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার উপর তা ক্রোধে রূপান্তরিত হচ্ছে। সৌমিত্র ব্রিজের উপর থেকে টর্চ জ্বালিয়ে চারিদিকে দেখছিল। তানিয়ার হাত-পা ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে মোহের চিন্তায়। অনেকটা দূরত্বে রয়েছে শৌভিকের সঙ্গে তার দলের ছেলেপেলেরা। স্বচ্ছ বিচলিত কণ্ঠে পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করল,
“আমি কোথাও পালাচ্ছি না। লাইসেন্স এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। আমি আমার বাবার গাড়ি নিয়ে এসেছি। উনার লাইসেন্স উনার কাছে আছে। আমি একজনকে খুঁজছি। তাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ। আমাকে খুঁজতে দিন। আপনারাও সাহায্য করুন প্লিজ!”
“একদম বাহানা বানাবি না। এগুলো গল্প থা/নায় শোনাবি। রুলস যখন ব্রেক করেছিস তখন জরিমানা দিয়ে দিস। দেখি কোন বাপের বেটা তুই! তোর বাপের নম্বর দে।”
সৌমিত্রের চোখে পড়েছিল একটি মেয়ের অবয়ব। চুল দিয়ে ছিল মুখটা ঢাকা। এত উপর থেকে কিছুই বুঝে উঠতে না পারায় সে তানিয়াকে শুধায়,
“আপনি কি ওই লঞ্চে কোনো মেয়ে দেখলেন?”
তানিয়ার চোখে তখন কিছুই না পড়ায় অসম্মতি জানাতেই সৌমিত্র সেই অস্পষ্ট মেয়েটিকে পড়তে দেখে আঁতকে উঠে বলল,
“এই! মনে হচ্ছে মেয়েটা ঝাঁপ দিয়েছে।”
কথাটা স্বচ্ছের কানে এসে লাগল। গলা শুঁকিয়ে এলো। সৌমিত্রের ফোনে কল এলো। কল রিসিভ করতেই লাউড স্পিকারে ধরলে নদীর পারে মোহকে খুঁজতে থাকা শৌভিক বলতে থাকল,
“আমি মোহের ফোন খুঁজে পেয়েছি। ও এর আশেপাশেই ছিল।”
সৌমিত্র চমকে জবাব দিলো,
“আমার তো মনে হলো একটু আগে একটা মেয়ে লঞ্চ থেকে পড়ে গেল।”
সৌমিত্রের কথা শেষ হওয়া মাত্র স্বচ্ছ কিছু না ভেবে পু/লিশকে ধা/ক্কা দিয়ে ব্রিজের কিনারায় এসে আগপাছ না ভেবে ঝাপ দিলো। নিজের ভাইয়ের কাণ্ড দেখে কিছু বলার সুযোগও পেল না সৌমিত্র। আতঙ্ক ঢুকেছে তার মনেও। সেও জ্যাকেট খুলে তানিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ধরে থাকুন।”
তানিয়া কিছু বলার আগেই রেলিং-এ উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল সৌমিত্রও। তানিয়ার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। গায়ে কাটা দিচ্ছে। মোহ কি সত্যিই পানিতে পড়েছে? তবে সে তো সাঁতার জানে। নিজেকে তো রক্ষা করতে পারার কথা। তানিয়া মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে।
অন্ধকারে পানির নিচে সব ঘোলাটে। স্বচ্ছ পাগল প্রায় হয়ে কাজটা করে ফেলল ঠিকই তবে কাজটা ভুল হলো কিনা ঠিক হলো সে বুঝতে পারছে না। একাধারে পানির নিচে অনেকক্ষণ থেকে দম বন্ধ হয়ে এলো তার। পানি থেকে মাথা উঠিয়ে বড়ো শ্বাস নিয়ে আবারও ডুব দিলো সে। সে একদম নদীর মাঝে। নদী এখন শান্ত। স্রোত কম। যদি কোথাও মোহ থাকেও তাহলে আশেপাশেই রয়েছে। এমতাবস্থায় স্বচ্ছ খেয়াল করল কেউ ব্রিজ থেকে তীব্র আলো ছুঁড়ছে নিচে। অস্পষ্ট কিছু হলেও দেখতে সক্ষম হলো সে। তার থেকে পাঁচ মিটার দূরত্বে থাকা একটা মানুষ আকৃতি অবয়বে তার চোখ থমকালো। তার দম ফের বন্ধ হয়ে আসছে। সে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল সেদিকে। অবশেষে একটি হাতকে স্পর্শ করতে সক্ষম হলো স্বচ্ছ। কোনোকিছু না ভেবেই তাকে টেনে নিলো নিজের দিকে। একহাতে ধরতে খেয়াল করল পেছনে তার হাত বাঁধা। আঁতকে উঠল স্বচ্ছ। খুলে দেওয়ার চেষ্টা করল না। বুঝল মেয়েটি ইতিমধ্যে জ্ঞান হারিয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে স্বচ্ছের। দ্রুত উপরে উঠতে না পারলে দুজনকেই ডুবে ম/রতে হবে এবার।
মোহকে অবশেষে তুলতে সক্ষম হলো স্বচ্ছ। তার মুখে, হাতে ও পায়ে নিষ্ঠুরভাবে বাঁধা দড়ি ও কাপড়। স্বচ্ছ হাঁপাতে হাঁপাতে মুখে বাঁধন খুলে দিতে দিতে শরীর ভারি হয়ে এলো। আচানক মোহের উপর আধশোয়া হয়ে গেল সে। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে বসল। অন্ধকারে আবছা মোহের মুখ ভিজে থাকলেও কিছু সময়ের ব্যবধানে চুপসে গেছে চেহারা। তার গায়ে ওড়না নেই খেয়াল হলো স্বচ্ছের। দ্রুত নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে মোহের উপর দিয়ে তার ভিজে শরীর নিজের চোখ এবং বাকিদের নজর থেকে আড়ালের চেষ্টা করল। বহুক্ষণ পর বাতাসে শ্বাস নিতে পেরে কেশে উঠল মোহ। বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে থাকল সে। তবে জ্ঞান সম্পূর্ণ ফিরেনি এখনো। স্বচ্ছের পক্ষে অসম্ভব হলো নিজের পৃথিবী সমান অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখা। মোহকে দুহাতে জাপ্টে ধরল নিজের বুকে। মোহের কাঁধে নিজের মুখ গুঁজে বলল,
“আমার বুক চিঁড়ে তোমায় যদি সেখানে লুকিয়ে রাখতে পারতাম, তাহলে বোধহয় তুমি নিরাপদে থাকতে। আফসোস আমি তা করতে পারিনা।”
মেয়েলি কণ্ঠ স্বচ্ছের কানে বাজল। মোহকে শুইয়ে দিয়ে দেখল বাকি সবাই তাদের দিকে ছুটে আসছে। সৌমিত্রও পানি থেকে উঠে চিত হয়ে শুয়ে শ্বাস নিতে থাকল অনবরত। এখনি যেন ম/রতে বসেছিল। বেশি গভীরে খুঁজতে গিয়ে দম ফুরিয়ে এসেছিল। বুকে হাত দিয়ে বুলাতে বুলাতে কাশতে থাকল সে। স্বচ্ছের উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি তাকে পেয়ে গেছো বলবে না? আমি তো তোমার মতো সুইমিং আর শ্বাস বন্ধ রাখতে এক্সপার্ট নই।”
স্বচ্ছ তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। সে মোহকে দেখছে। তানিয়া এসে মোহের হাত-পা ডলে গরম করার চেষ্টা করছে। পুলিশ দুজন ছুটে এসেছে এদিকেই। ওরাই লাইট ধরেছিল নদীর দিকে। শৌভিকের দলের ছেলেপেলে তাদের মানিয়েছিল বিষয়টি নিয়ে। আচানক পানি থেকে উঠে এলো শৌভিক নিজেও। সে উঠিয়ে এসেছে আরো একজন নারী। যাকে তারা চিনতে পারল না। তাকে এনে শুইয়ে হাতের পার্লস চেক করল শৌভিক। পার্লস চলছে না। শৌভিক শুধাল,
“এনাকে কেউ চেনো?”
তানিয়া মনোযোগ দিয়ে দেখল তাকে। অতঃপর তড়িঘড়ি করে বলল,
“একে আমি মোহের ফোনে ছবিতে দেখেছিলাম। মোহ বলেছিল এটা তার অনেক কাছের বান্ধবী। যার সঙ্গে মোহের যোগাযোগ নেই।”
“আগে এদের দুজনকে হসপিটালে নিতে হবে। তারপর বাকিসব হবে।”
স্বচ্ছের গম্ভীর কথায় সবাই সম্মতি দিলো। শৌভিক কিছু বলার আগেই মোহকে আগলে কোলে তুলে নিয়ে আগে হনহনিয়ে চলে গেল স্বচ্ছ। শৌভিক তুলে নিলো মেয়েটিকে। সকলের সঙ্গে তানিয়া যখন পিছু ধরবে তৎক্ষনাৎ তার খেয়াল হলো সৌমিত্রের কথা। দ্রুত পিছু ফিরে তাকাল সে। ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে দেখল সৌমিত্র এখনো চিত হয়ে চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। তানিয়া ডেকে উঠল তাকে।
“আপনি কি এখানেই সারারাত কাটাবেন? ওরা সবাই চলে গেল।”
সৌমিত্রের কোনো সাড়া না পেয়ে ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠল তানিয়ার। এই লোকের আবার কী হলো? সে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল সৌমিত্রের কাছে। বুকে হাত দিয়ে নাড়িয়ে বলল,
“শুনছেন আপনি?”
সৌমিত্রও জ্ঞান হারিয়েছে। সেটা বোঝার পর তানিয়াও আতঙ্কে চিল্লিয়ে উঠল। সৌমিত্রকে ধরে তুলতে সাহায্য করল দুই পুলিশ। তাকেও হসপিটালের উদ্দেশ্যে নিয়ে রওনা দেওয়া হলো দ্রুত।
কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ। কেবিনের দরজার গ্লাসের অংশটুকু দিয়ে দেখছে ভেতরে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকা মোহকে। স্যালাইন দিয়েছে তাকে। প্রেশার খুব বেশি ফল করেছে তার। তার উপর বেশ কিছু সময় পানিতে ডুবে থাকার ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছিল তার। তাই কিছুটা সময় অক্সিজেন মাস্কও পরিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন অনেকটাই স্টেবল মোহ। অনেকক্ষণ ধরে ভেজা গায়ে বাহিরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ। তার চোখমুখের বর্ণও আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে। শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। জ্বরের প্রকোপ ফের বাড়তে শুরু করেছে তার। মাথা টলমল করছে শুধু। তাও দুচোখ সেই মোহতেই স্থির। তার দৃষ্টি যেন বলছে, ‘আমি মোহতে শুরু মোহতেই শেষ।’
নিজের হাতটা সেই দরজার গ্লাসের উপর রাখে স্বচ্ছ। হাতের চামড়া কুঁচকে গেছে পানিতে ভেজার কারণে। আলতো করে গ্লাসটা এমনভাবে ছোঁয়াল যেন মোহের গাল ছুঁয়েছে সে। হাতটা কেউ দেখার আগেই দ্রুত নামিয়ে ফেলল।
“আপনি চাইলে ভেতরে গিয়ে দেখতে পারেন মোহকে।”
হঠাৎ শৌভিক তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলে উঠল। দৃষ্টি সরে গেল মোহের উপর থেকে৷ ঘাড় ঘুরিয়ে শৌভিককে দেখল সে। অতঃপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো,
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এখনি চলে যাব।”
“কেন? মোহের জ্ঞান না ফেরা অবধি অপেক্ষা করবেন না?”
স্বচ্ছ জবাবে কিছু বলল না। অদ্ভুত অনুভূত হলো শৌভিকের। আবারও সে বলল,
“আপনি ভেজা গায়ে রয়েছেন তো। আপনার ঠাণ্ডা লেগেছে দেখে বোঝা যাচ্ছে। আমার গাড়িতে আরেক সেট পোশাক রয়েছে। এনে দেব?”
“দরকার নেই তার। মোহের পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে?”
শৌভিক শান্ত কণ্ঠে জবাব করল,
“হ্যাঁ। উনারা রাস্তায়।”
তাদের কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ ডাক্তার উপস্থিত হলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে ভার মুখে প্রশ্ন করলেন,
“এই কেবিনের পেশেন্ট সুস্থ থাকলেও আরেক যেই মেয়েটিকে আনা হয়েছিল তিনি কে হয় আপনাদের?”
শৌভিক কোনোরকম ভণিতা ছাড়া উত্তর করল,
“আমরা কেউই চিনি না তাকে। যেই পেশেন্ট ভালো থাকার কথা বললেন তারই বান্ধবী নাকি উনি। এমনটাই আমরা জানতে পেরেছি।”
“একচুয়ালি সি ইজ অলরেডি ডেড।”
খবরটা শুনে স্বচ্ছ এবং শৌভিক দুজনই হতবাক হলো বেশ। তারা এটা বুঝতে পারছে না মোহের সাথে এসব ষ;ড়যন্ত্রের সঙ্গে সেই মেয়েটির কী যোগাযোগ। কেননা তারা মেয়েটিকে কখনো দেখেও নি। ডাক্তার আরো জানালেন,
“উনার মৃ/ত্যু কিন্তু পানিতে ডুবে হয়নি। উনার গলায় আমরা একটা গভীর দাগ দেখেছি। দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা একটা মা/র্ডার কেস। আপনারা প্লিজ দ্রুত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।”
স্বচ্ছ ভাবনায় পড়ে গেল। মেয়েটির সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজতে ব্যস্ত হলো এই মন। এত ঘটনার পেছনে সে নিজের বাবাকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারছে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস এই কাজটি সরোয়ার সাহের ব্যতীত অন্য কারোর হতেই পারে না। শৌভিক ডাক্তারকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“পুলিশ বাহিরেই এসেছে। এই ঘটনার শুরু থেকে উনারা রয়েছেন। শুরুতে ট্রাফিক পুলিশ ছিল এখন এসব ঘটনার পর পুলিশ তদন্ত করতে এসেছেন। এসব নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।”
ডাক্তার সম্মতি জানিয়ে নিজের কাজের জন্য চলে গেলেন। স্বচ্ছের লাল দুটি চোখ পর্যবেক্ষণ করল শৌভিক। স্বচ্ছ হঠাৎ তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমি এবং আপনি দুজনেই পরস্পরের শত্রু। তবুও মোহকে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সেটার খবর দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”
শৌভিক ক্ষীণ হাসল।
“মোহ লাস্ট কল আমাকে করেছিল সেটা বিকেলের শেষ দিকে। সে কল দিয়ে আমায় জানায় যে ইথানকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তারপর সব কাজ ফেলে রেখে ইথানের স্কুলে আসি। মোহকে খুঁজেছি আশেপাশে সবখানে। ওকে পায়নি। যখন ওর ফোনও বন্ধ বলছিল তখন আমি বুঝতে পারি কোনো জটিল সমস্যা হয়েছে। আমিই চেষ্টা করছিলাম ওকে খুঁজতে। পরে আপনাকে কল করি।”
স্বচ্ছ আবারও নীরব থাকল। তার মস্তিষ্কে কী চলছে সেটা হয়ত আন্দাজ করতে পারছে শৌভিক। সে আবারও স্বচ্ছকে জিজ্ঞেস করে,
“মোহের প্রতি অনেক টান আপনার৷ অনেক অনুভূতি জমানো রয়েছে। তবুও ওর সাথে এমন ব্যবহার করেন কেন?”
স্বচ্ছের হাতের মুঠো শক্ত হয়। কঠিন হয় মুখখানা। ঘোলাটে চোখে তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সে বলে ওঠে,
“সবকিছু খোলাসা করে দিলে যেকোনো একজনকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে। খোলস দিয়ে কিছু জিনিস আবৃত থাকা ভালো।”
কথাটি শেষ করে একটু থেমে স্বচ্ছ শৌভিককে বিনয়ের সঙ্গে বলল,
“আপনি, আমি পরষ্পরকে খুব অপছন্দ করি। বিশেষ করে আমি আপনাকে দুইচোখে দেখতে পারি না। তবুও আপনার কাছে আমার একটি বিশেষ অনুরোধ, মোহকে আপনি জানতে দেবেন না যে আমি এসেছিলাম ওর কাছে।”
শৌভিক কিছু বলার আগেই তড়িৎ গতিতে তার পাশ কাটিয়ে প্রস্থান করল স্বচ্ছ। শৌভিক থম মে/রে রইল অনেকটা সময়। স্বচ্ছকে বোঝা আসলেই দায় হয়ে গেল। রহস্যে ভরপুর ছেলেটা!
নেত্রপল্লব দুটো মেলতে গিয়ে অচেনা জায়গা আবিষ্কার করল সৌমিত্র। প্রথমে চারিপাশ ঘোলাটে দেখল সে। আস্তে করে বলল,
“আমি কোথায়? আমি কি ম/রে গেছি?”
“ম;রিস নি এখনো। দুনিয়ার মাঝেই অবস্থান করছিস এখনো অবধি।”
স্বচ্ছের কণ্ঠ চিনতে ভুল হলো না সৌমিত্রের। আশ্বস্ত হলো। তখন দম নিতেই পারছিল না যেন। শক্তি ফুরিয়ে এসেছিল যার ফলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ভালো করে তাকিয়ে নিজের ভাইকে দেখে একটা হাসি দিলো সে। স্বচ্ছ ধমকে বলল,
“থাপড়িয়ে গাল ফা/টিয়ে দেব। আমাকে দেখাদেখি করে পানিতে নেমেছিলি কেন? শ্বাস আঁটকে রাখতে পারিস তুই?”
সৌমিত্র আশ্চর্য হয়ে বলল,
“আরে, অদ্ভুত! তোমার সাহায্যই তো করতে চেয়েছিলাম। আমার মতো অসহায় মানুষের জন্যই হয়ত এই প্রবাদ বানানো হয়েছে যে, যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর। যাই হোক, মোহ ভাবি কেমন আছে?”
স্বচ্ছ সৌমিত্রের উল্টাপাল্টা কথায় কান না দিয়ে বলে,
“সে ঠিক আছে এখন। তুইওএকদম স্টেবল আছিস এখন। আমি বাড়ি যাব এই মুহূর্তেই। তুই কি এখন থাকতে চাস নাকি যাবি? গেলে এখনি বেড থেকে নেমে পড়।”
সৌমিত্র মুখ মলিন করে অসহায় ভান ধরে বলে,
“অসুস্থ ভাইয়ের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে ভাইয়া?”
স্বচ্ছ আর একটুও অপেক্ষা করল না। চলে গেল বাহিরে। বলে গেল,
“আমি যাচ্ছি।”
সৌমিত্র বারংবার পেছন থেকে ডাকল। তবে কে শোনে কার কথা! এতটা সময় কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সৌমিত্রের উল্টাপাল্টা কথায় হাসছিল তানিয়া। সৌমিত্র তার দিকে তাকাতেই হাসি মিলিয়ে গেল তার। সৌমিত্র অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আমার ভাইয়ের মতো সুইমিং চ্যাম্পিয়ন নই। তার তো রেকর্ড ছিল পানির মধ্যে শ্বাস অনেকক্ষণ আঁটকে রাখার। আমি তো কোনোমতে সাঁতার শিখেছিলাম। আমাকে আর হাসির খোঁড়াক না বানিয়ে একটু এপ্রিসিয়েট তো করতে পারেন। আমি কিছু পারি আর না পারি মানুষের বিপদে কিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ি।”
তানিয়ার ফের হাসি পেল। তবে জোরে হাসল না। ঠোঁট চেপে বলল,
“জি বুঝেছি।”
কিছুটা সময় তাদের মাঝে বিরাজ করল স্তব্ধতা। তানিয়ার অস্বস্তি লাগল বিষয়টি। হঠাৎ মনে পড়ল বিয়ের রিসেপশনের সৌমিত্রের করা উটকো পাগলামি। সে নিজের অস্বস্তি লুকাতে হালকা কেশে বলল,
“আপনার কি আর কিছু লাগবে? আপনি থাকুন আমি মোহকে দেখে আসি।”
তানিয়া সৌমিত্রের উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজার দিকে পা বাড়ায়৷ সৌমিত্র পিছু ডেকে আচমকাই জিজ্ঞেস করে,
“রিসেপশনে আপনাকে আমি যা যা বলেছি একটা কথাও মিথ্যে ছিল না কিন্তু মিস গোলাপি!”
থেমে গেল তানিয়ার চলা। ঘুরে উঠল যেন তানিয়ার পুরো পৃথিবী। এটা যেন সত্যি নয়। সে ঘুরে সৌমিত্রের পানে তাকানোর সাহস পেল না। তবে সৌমিত্র ততক্ষণে উঠে পড়েছে। আস্তে পায়ে সে তানিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল তানিয়া। আমতা আমতা করে পিছু সরে গেল। ঢক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করল। সৌমিত্র সরল স্বীকারোক্তি জানালো,
“আমি একটু অন্যরকম। কখনো কথা লুকাতে জানি না। যা মুখে আসে তাই বলি। তাই মনেও যা এসেছে আমি তাই বলেছি।”
তানিয়ার মুখে কোনো শব্দ নেই৷ মাথা তুলে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে তার। সৌমিত্র ফের বলে,
“আমার হিংসে হয় যখন দেখি আপনি নিজের প্রাক্তনের কথা ভুলতে পারেন না। এতটা হিংসে হয় যে মনে হয় পারলে আপনার মনে ঢুকে আপনার প্রাক্তনের নামটা মিছে দিতাম। এতটা ঈর্ষা আমার মনে কখনো ছিল না। আপনি আমার মনে এই ঈর্ষা ঢুকিয়েছেন। অ্যান্ড ইট ইজ অ্যা সাইন অফ লাভ, ইজ নট ইট?”
তানিয়ার বোবা মুখে কোনোরকমে কথা ফুটালো। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“আপনি এখানে…”
“আমি জানি আমি এখানে সিরিয়াস সিচুয়েশনে এসব বলার জন্য আমাকে পাগল মনে হচ্ছে। আসলে আমি যে এমনই। ওইযে বললাম যখন যেটা মনে আসে তাই বলে দেই। তবে আমি আর এর থেকে বেশি কিছু বলব না। আপনি এখন যেতে পারেন।”
তানিয়া সত্যিই হনহনিয়ে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সৌমিত্রের দিকে মুখ তুলে তাকাতে অবধি পেরে উঠল না সে। আবারও নতুন স্বপ্ন দেখানো হচ্ছিল তাকে। যেটাকে সে এড়িয়ে যেতে চায়৷ কারণ স্বপ্ন ভাঙলে মনে হয় যেন জীবন সেখানেই শেষ!
বাড়ি ফিরল স্বচ্ছ। সদর দরজা পেরিয়ে সোজা তাকাল তার বাবার ঘরের দিকে। ফারাহ ছিল উপরের করিডোরে। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত শরীরে করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে ফোন ঘাঁটছিল সে। নিচে তাকিয়ে স্বচ্ছকে দেখে এগিয়ে আসে রেলিংয়ের দিকে। সম্পূর্ণ ভেজা গায়ে স্বচ্ছকে দেখে দৃষ্টি সরু হয়ে আসে তার। নিজে নিজে বলে,
“ভাইয়া গোসল করে এলো কোত্থেকে! তার গায়ে না জ্বর ছিল?”
ফারাহ আর না দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে এগোয়। একধাপ নামতেই লক্ষ্য করে স্বচ্ছ সোজা কোনোদিকে না তাকিয়ে সরোয়ার সাহেবের ঘরের দিকে চলে গেল। কপাল কুঁচকে সেখানেই থেমে গেল ফারাহ।
সরোয়ার সাহেবের ঘরের দরজা খোলা ছিল। তিনিও ঘরেই ছিলেন। নিজের চেয়ারে বসে চশমা খুলে চোখ বুঁজে স্বচ্ছের কথা ভাবছিলেন। তখনি স্বচ্ছ কোনোরকম অনুমতি ছাড়াই ঘরে প্রবেশ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজার শব্দে চোখ খুলে ছেলেকে দেখেন সরোয়ার সাহেব। স্বচ্ছের দৃষ্টি ভর্তি ক্রোধে যেন স্বচ্ছ উনাকেই জ্বালাতে চাচ্ছে।
চলবে…