যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-২৩+বোনাস+২৪

0
13

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৩ [দ্বিতীয় খণ্ড]

মেইন রোডের পাশে পেট্রোল স্টেশনের কাছে খালি জায়গায় গাড়ির মধ্যে বসে আছে স্বচ্ছ। বাহিরে রাস্তায় পায়চারি করছে তার বন্ধুরা। স্বচ্ছের চোখমুখ দেখেই ভয় করছে তার বন্ধুদের। তার চোখেমুখেই যেন মারাত্মক গ্রহণ লেগেছে। তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ঘন হচ্ছে। ভেতর থেকে ফুঁসছে সে। স্বচ্ছের পাশের সিটে বসে থাকা এক বন্ধু সাদিক ফট করে বলে উঠল,
“মাইয়া মানুষের বিশ্বাস নাই রে স্বচ্ছ। যতই পাহারা দে লাভ নাই। হুদাই সেদিন আমাদের হসপিটালে বসে রেখে পাহারা দিয়ে নিয়েছিলি। পোলারা তো কন্টিনিউয়াস গ্রিন সিগনাল দিবেই। মাইয়াও যখন দিয়ে দেয় তাইলে খেল খতম।”

গাড়ির জানালায় বাহু লাগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল স্বচ্ছের অন্য বন্ধু বিভোর। সাদিকের মুখে অবিরাম এসব কথা শুনে সে স্বচ্ছের মুখের দিকে দেখল এবার। স্বচ্ছের চোয়াল ওঠানামা করছে তীব্র ক্রোধে। ক্রুদ্ধ স্বচ্ছ যখন তখন বোমের মতো ফেটে যাবে বোধ হচ্ছে। সে সাদিকের হাতে চিমটি মে/রে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আজকে মনে হয় দুইটা লা/শ পড়বে। একটা ওই শৌভিকের আরেকটা হচ্ছে তোর। এখনো বাঁচা আর বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে কথা কম করে বল।”

স্বচ্ছের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো সাদিক। ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না যেন আগুনের তাপ লাগছে। আচানক রাস্তার পাশে থাকা স্বচ্ছের দুজন বন্ধু ইশারা দিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
“স্বচ্ছ! তোর সতীন আইসা পড়ছে।”

বিভোরের কপাল চাপড়াতে মন চায়। স্বচ্ছকে ঠাণ্ডা রাখতে গেলেও বাকিরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। স্বচ্ছ দরজা খুলছে বের হওয়ার জন্য। বিভোর ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“স্বচ্ছ আগেই ঝামেলা করিস না। আগে কথাবার্তা বলে দেখ। মাথা গরম না করে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা সলভ করলে মনে হয় ভালো হবে।”

স্বচ্ছ শুধু বলল,
“আমি ভেতর থেকে কতদিন ধরে জ্বলছি সেটা শুধু আমি বুঝি।”

স্বচ্ছ সামনে যেতে যেতে দেখল তার দুই বন্ধুরা গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। শৌভিকের বাড়ি থেকে কাজী অফিস যাওয়ার রাস্তা এই একটাই ছিল। তাই স্বচ্ছ এখানেই অপেক্ষা করছিল। স্বচ্ছ হাঁটার গতি বাড়ায়।

আচানক দুটো ছেলের হাতের ইশারাতে গাড়ি দাঁড় করাতে হয় শৌভিককে। পরনে তার সুন্দর সাদা রঙের শেরওয়ানি। চোখে বরাবরের মতো তার চশমা। সাজসজ্জা দেখে যে কেউ বুঝবে তার বিয়ে। শৌভিক ভাবে, ছেলে দুটোর কোনো সাহায্য দরকার। সেই কারণেই জানালার কাঁচ খুলে ছেলে দুটোকে কিছু জিজ্ঞেসা করার আগে তার দৃষ্টি পরে অদূরের সেই স্বচ্ছকে। স্বচ্ছের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে শৌভিকের ভালো ঠেকল না। তবে, স্বচ্ছ কি তার আর ফারাহর বিয়ের কথা জেনে গিয়েছে? স্বচ্ছ কি বিয়ে মানতে রাজি নয়? মিসেস জেবা জানিয়েছিলেন, বিয়ের দিনেই স্বচ্ছকে জানাবে তার বোনের বিয়ের কথা। হয়তবা ছেলে বিষয়টা জানার পর মেনে নিতে পারে নি। বিষয়টা অস্বাভাবিক নয়।

এত কথা যখন শৌভিকের মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল তখনই স্বচ্ছ তার কাছাকাছি চলে আসে। আচানক শৌভিকের শেরওয়ানির কলার টেনে ধরে স্বচ্ছ। হকচকিয়ে যায় কিছুটা শৌভিক। শৌভিকের সঙ্গে নীলয় উপস্থিত ছিল। সে তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে,
“আরে কী করছেন?”

শৌভিক তাকে ইশারায় থেমে যেতে বলে। ভাই হয়ে এমন প্রতিক্রিয়া করাটা সে অস্বাভাবিক চোখে দেখে না। যদি ভাইকে বোনের বিয়ের কথা একেবারে না-ই জানানো হয় তবে এমন আপত্তি করা সাধারণ বিষয়। তবে শৌভিকের বিশ্বাস, স্বচ্ছকে পুরোটা বললে স্বচ্ছ বুঝবে।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র তার গালে সজোরে ঘু;ষি মা/রা হলো। ছিটকে পড়ল শৌভিকের চোখ থেকে চশমা। গাল ব্যথায় টনটন করে উঠল। স্বচ্ছের চোখ থেকে যেন রক্ত ঝরছে আর মুখ দিয়ে ঝরছে বিষ। শৌভিক নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে চাইল,
“আমি বিয়েটা করতে চাইনি। আবার মানাও করতে পারিনি। আমার মনে হয় বসে আলোচনা করলে বিষয়টা ঠিক হয়ে যাবে।”

স্বচ্ছকে উসকে দিলো মাঝখান থেকে তারই এক বন্ধু। বলল,
“শালা, আমরা গাড়ি না ধরলে বিয়ে করেই ফেলতো। এখন আবার আলোচনা করতে চাইছে। আমাদের ভাবির দিকে নজর দেস কেমনে?”

শৌভিক স্বচ্ছের বন্ধুদের কথার কোনো আগামাথা খুঁজে পেল না। ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করল বিষয়টা। তখনি আবারও তার শেরওয়ানির কলার ধরে ফেলল স্বচ্ছ। ধাক্কাতে ধাক্কাতে গাড়ির সঙ্গে ঠেকিয়ে ধরল তাকে। নীলয় হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে এসে থামাতে গেলে তাকে স্বচ্ছের বন্ধুরা কাবু করে ফেলে নিমিষে। স্বচ্ছ হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
“শত্রু শত্রুই থাকে। কিন্তু এখন তুই আমার জীবনের মহা শত্রু হয়ে উঠেছিস। তোকে তো আমি বিয়ে করতে দেব না। আমি এত ভালো মানুষ নই। অনেকদিন ভালোমানুষি করে করে আমি ক্লান্ত।”

শৌভিককে রাস্তায় ঠেলে ফেলে দিলো স্বচ্ছ। তাকে এবার বাঁধা দিতে শুরু করল শৌভিক। সেও মেজাজও হারিয়ে ফেলছে এখন। দুজনের মাঝে ধস্তাধস্তি হতে লাগল এক পর্যায়ে। ফাঁকা মাঝরাস্তায় কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল তাদের এমন কাণ্ড দেখে। শৌভিক এবার দেহের শক্তি দিয়ে স্বচ্ছকে ফেলে দিতে সক্ষম হলো। নিজে দ্রুত উঠে বসল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“এমন আচরণ করে আপনি নিজের সম্মান নিজে নিচে নামাচ্ছেন।”

“সম্মানের চৌদ্দ গোষ্ঠী ম/রে যাক। আই ডোন্ট কেয়ার। এই সম্মানের গোষ্ঠীর সঙ্গে তোকেও মা/রব।”

কথাগুলো শেষ করে উঠে দাঁড়াল স্বচ্ছ। শৌভিকও দাঁড়ায়। এর মাঝেই তাকে আবারও ধা/ক্কা দেওয়া হয়। শৌভিকের সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়। স্বচ্ছকে জোরেই ধা;ক্কা দিয়ে ফেলে সে। গাড়ির জানালার কাঁচে গিয়ে বাড়ি খায় তার কপাল। সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের কিছু অংশ এবং স্বচ্ছের কপাল ফেটে যায়। স্বচ্ছেড রাগ বেড়ে যায়। সে ফিরে এসে আবারও ঘু/ষি মা/রে শৌভিককে। এবার চোয়ালে এবং ঠোঁটে লেগে ঠোঁটে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়ে র/ক্ত বের হয় শৌভিকের। তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। স্বচ্ছ আবার তাকে ধরে। শৌভিকও তাকে ধরে। দুজনের মাঝে বিপুল সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। বিভোর আর সাদিক দৌড়ে এসে তাদের আলাদা করতে পারে না। দুজনের সমান শক্তি, প্রশস্ত তাদের দেহ, প্রচণ্ড বল তাদের দুই হাতে। অবশেষে তাদের দুজনকে ছাড়াতে সক্ষম হয় সাদিক ও বিভোর। নীলয় ছাড়া পেয়ে দৌড়ে আসে শৌভিকের কাছে। ততক্ষণে শৌভিক ও স্বচ্ছ দুজনের মুখে, হাতে ক্ষ/তের ছাপ পড়ে গেছে। শৌভিক বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
“এইযে আপনি আমাকে এত মা/রলেন! আপনার বোনের কান্না কিন্তু আপনি থামাতে পারবেন না।”

স্বচ্ছের ক্রোধ নিভে আসতে আরম্ভ করে। ফারাহর প্রসঙ্গ ওঠার কারণ বুঝতে উঠতে পারল না সে। কপাল গড়িয়ে হালকা দাড়ির থুঁতনিতে এসে ঠেকেছে তাজা র;ক্ত। মাথা চিনচিন করে ব্যথা করছে। অন্য কিছু ভাবার শক্তি তার মাঝে নেই। সে কপাল কুঁচকে বলল,
“আমার বোন?”

“আপনার বোনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি বলে আপনি এত রাগ ঝাড়ছেন তো? আমার এত ক্ষ/ত দেখে তো বেচারি জ্ঞান হারাবে। আপনার বোন বা আপনার মা কারোর অসম্মতিতে আমি বিয়ে করছি না। আপনার বোন আমাকে নিজে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি তো আপনাদের সব জানাতে চেয়েছিলাম।”

কথাগুলো শুনে যেন ফাঁকা হয়ে গেল স্বচ্ছের মস্তিষ্ক। দুলে উঠল সম্পূর্ণ পৃথিবী। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। শরীর ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঁজল সে।

পাশাপাশি বসে আছে ফারাহ ও মোহ। ফারাহর পরনে শৌভিকের পছন্দ করা সেই ভারি বেনারসি, চুলে করা খোঁপা। বড়ো খোঁপার গোছায় মোহ বড়ো গোলাপের মালা গুঁজে দিয়েছিল। সেই মালার গোলাপ সবেমাত্র নেতিয়ে পড়া শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে চিন্তায় নেতিয়ে পড়ছে ফারাহ নিজেও। মেকআপ আর্টিস্ট থেকে করা সুন্দর মেকআপ তখন ঘামে অবস্থা খারাপ। মাঝে মাঝে ফারাহর দিকে রুমাল এগিয়ে দিচ্ছে মোহ ঘাম মুছতে। ফারাহ এবার বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মীর সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভাঙা কণ্ঠে শুধাল,
“আঙ্কেল! উনার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল?”

মীর সাহেব ফারাহর চিন্তিত ছোটো মুখখানা দেখে কিছু বলার সাহস পেলেন না। তবুও নিচু স্বরে জানালেন,
“না, মা। শৌভিক আর নীলয় দুজনকেই কল করছি। ওদের দুজনের ফোনই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বাড়িতে কল দিয়ে শুনলাম শৌভিক রেডি হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা আগে বেরিয়েছে। সেই হিসেবে এতক্ষণে ওর পৌঁছে যাওয়ার কথা। শৌভিক এমন বেখেয়ালি ছেলে তো নয়। ওর ফোন কখনো বন্ধ থাকে না।”

ফারাহর চিন্তা বাড়ে। মোহের বুকটাও ধকধক করছে। চোখেমুখে বিষণ্ণতার মেলা। তার সাজগোজ আজ এলোমেলো। শাড়ির কুঁচিটা কেমন যেন অগোছালো। চোখের কালো কাজল লাগাতে গিয়ে ডান গালের একপাশে ভরে গিয়েছে সেটা সে মুছতে ভুলে গেছে। লিপস্টিক কিছুটা ঠোঁটের বাহিরে চলে গিয়েছে। কিছুতে সে মনোযোগী হতে পারছিল না। তার একটাই কারণ ছিল। তা হচ্ছে স্বচ্ছ। সে জানে, স্বচ্ছের আজ বাগদানের অনুষ্ঠান। আচ্ছা, স্বচ্ছ কি মেয়েটাকে আংটি পরিয়ে হবু বউয়ের উপাধি দিয়ে দিয়েছে? এসব ভেবেই মন ভার হয়ে এসেছিল মোহের। সাজতে গিয়ে কয়েকবার চোখের টলটলে পানিতে কাজল লেপ্টে গিয়েছিল। এখন আবার আরেক ঝামেলার সৃষ্টি! শৌভিকের খোঁজ নেই। মোহ নিজেও জানে, শৌভিক এতটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন হয়। সে ভয় পাচ্ছে, শৌভিকের কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না তো?

কাজী সাহেব তাড়া দিয়ে চলেছেন। উনার আরো বিয়ের কাজ রয়েছে। একটা বিয়ে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। ফারাহ আশাহত হয়ে ফ্যাকাশে মুখে মোহের কাছে এসে ধপ করে বসে। মোহের চোখের পানে তাকিয়ে নিভে যাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে,
“উনি বিয়ে করতে আসবেন তো?”

মোহ তাকে শান্তনা দিয়ে হাতে হাত রেখে বলে,
“কেন আসবে না? তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে তুমি বিশ্বাস করো না?”

“উনি বলেছিলেন আমার আগমনের আগে থেকে উনি উপস্থিত থাকবেন। আমার আগমন সে আরো সুন্দর করে তুলবেন। কিন্তু আমি তো চলে এলাম। উনি তো আসলেন না। আচ্ছা, উনার কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

মোহ কী বলবে ভেবে পায় না। ফারাহ ফের বলে,
“আমাকে ক্ষমা করো। আমি পরিকল্পনা করেছিলাম উনি এলে আমি ভাইয়াকে কল করে আমাদের বিয়ের কথা জানাব। তাহলে ভাইয়া এঙ্গেজমেন্ট ছেড়ে চলে আসত এটা নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু উনি এখনো এলেন না। জানি না, মা ভাইয়াকে আমার বিয়ের কথা জানাতে পেরেছে কিনা! আমি চাইনা ভাইয়ার জীবনে তোমার বদলে অন্যকেউ আসুক।”

স্বচ্ছের প্রসঙ্গ উঠতেই অভিমানগুলো উপচে ওঠে মোহের মনে। লোকটার প্রতি অজস্র রাগ সে চাপা দিতে পারে না। সে বলে,
“তোমার ভাই যদি ওই মেয়েটাকে চেয়ে থাকে তাহলে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। সে যদি সুখি থাকতে পারে থাকবে। এমন নয় যে আমি তাকে ছাড়া বাঁচব না। দিব্যি ভালো আছি।”

ফারাহ বোঝে মোহের প্রতিটা অক্ষরে মিশে থাকা অভিমান। সে উত্তরে চুপ থাকে। এবার সে উঠে বলল,
“আমার আর ভালো লাগছে না। দম বন্ধ লাগছে। আমি বাহিরে যাব।”

কারোর কথার অপেক্ষা না করেই নিজের শাড়ি দুহাতে সামলে গটগট করল হাঁটা ধরল ফারাহ। অস্থির হয়ে তার পিছু পিছু গেল মোহ।

বাহিরের চনমনে ঠাণ্ডা আবহাওয়াও যেন ফারাহর মনে শান্তি এনে দিচ্ছে না। বিকেলে রাঙা আকাশ আজ কিছুটা অন্ধকার। বুঁজে আছে নিজের রং। হয়তবা হুটহাট নিজের বর্ষণ ছড়াবে। গাড়ির সামনে ভর দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছে সে। মোহ মীর সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জানল, শৌভিকের সঙ্গে উনার যোগাযোগ হয়েছে। শৌভিক গুরুতর সমস্যায় ফেঁসে গিয়েছিল। উদ্ধার হওয়ার পরেই রওনা দিয়েছে। সেটা বলার জন্যই ফারাহর নিকট হেঁটে আসতে আরম্ভ করল মোহ। আচানক বেজে ওঠে গাড়ির হর্ন। অন্যমনস্ক ফারাহর পিলে যেন চমকে ওঠে। কালো রঙের গাড়িটা তার অতি চেনা লাগে। পরক্ষণেই গাড়ির দুদিকের দরজা খোলার শব্দ হলে ফারাহ ও মোহ উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে। একদিক থেকে বের হয় শৌভিক। তার হাতে ব্যান্ডেজ, গাল ফুলে উঠেছে, ঠোঁটের কোণে কে/টে গিয়েছে। অন্যপ্রান্তে স্বচ্ছ। তার মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখের নিচের রগ ফুলে সবুজ হয়ে গিয়েছে, সাদা শার্টে প্রচুর ময়লা সঙ্গে শার্টের হাতা ছিঁড়ে গিয়েছে। যেন দুজনে কোথায় ময়লাতে গড়াগড়ি করেছে। ফ্যালফ্যাল করে পলকহীন চেয়ে রইল ফারাহ ও মোহ। তাদের এমন অবস্থা দেখে যে কোনো প্রশ্ন করবে সেই জ্ঞানেও নেই তারা।

শৌভিক ও স্বচ্ছ উভয়ে দুটো মেয়ের সামনে দাঁড়ায় খুঁড়িয়ে এসে। ফারাহ হা করে চেয়ে আছে। শৌভিক আচানক বলে বসে,
“এমন ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় কি আমাকে বেশি ভালো লাগছে? হা করে তাকিয়ে আছো যে?”

ফারাহর চোখের পলক পড়ে তখন। দৃষ্টি নামিয়ে চকিতে অস্থির হয়ে নিজের ভাই এবং হবু বরের এমতাবস্থা দেখে শুধায়,
“কী হয়েছে তোমাদের? এই অবস্থা কেন? এক্সি/ডেন্ট করেছিলে তোমরা? কিন্তু একসাথে এক্সি/ডেন্ট করেছিলে? কী করে?”

শৌভিক সামান্য হাসতে গিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। তার শালার হাতের জোর আছে বলতে হবে। এমন ঘু/ষি মে/রেছে যে হাসতে গেলেও ব্যথায় টনটন করছে। শৌভিক ঠাট্টা করে বলল,
“তেমন কিছু না। মাঝরাস্তায় তোমার ভাইয়ের আমার সাথে বক্সিং খেলার ইচ্ছে জেগেছিল। তাই আমরা মাঝরাস্তায় একটুআধটু নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করছিলাম।”

ফারাহর চোখমুখ কুঁচকে গেল। এমন সিরিয়াস সময় শৌভিকের কৌতুক তার মোটেও পছন্দ হলো না। সে তার ভাই আ/হত স্বচ্ছের দিকে চাইল। স্বচ্ছের তীক্ষ্ণ চাহনি তার দিকেই চেয়ে রয়েছে। যেন চোখ দিয়ে বোনকে শাসানো হচ্ছে। ফারাহ ভাইকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। ফের শৌভিককে রেগে জিজ্ঞেস করল,
“জোক্স করছেন? সব কিছু ফান মনে হচ্ছে আপনার? আমার ইমোশন, টেনশন এসব মজা? আপনার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আপনি বলেছিলেন আমার আগে আপনি উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু সেটা হলো না। আপনার নিখোঁজ হওয়া দেখে কাজী সাহেব বারবার এক কথা বলে যাচ্ছিলেন, যে আদেও আপনার আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে আছে কিনা! এসব আপনার মজা মনে হয়?”

মোহ স্বচ্ছের হাল অবস্থাই চোখ গোলগোল করে দেখছিল এতক্ষণ। তার কথা বলার শক্তি হারিয়েছিল যেন। যেই লোকটার এখন অন্য মেয়েকে আংটি পরিয়ে তাকে সময় দেওয়ার কথা তার এমন পরিস্থিতি দেখে মাথায় অজস্র প্রশ্ন কিলবিল করছে। স্বচ্ছকে প্রশ্ন করতে চেয়েও পারছে না। তার ইগোতে বাঁধছে ভীষণ। এই নিষ্ঠুর লোকের সঙ্গে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে গেলেও তার গলা ধরে আসবে। তাই দ্রুত সে শৌভিকের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল,
“ভাইয়া! তোমার সমস্যা হয়েছে সেটা আমাদের একবার কল করে জানাতে পারতে। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তোমার হবু বউটার কথা চিন্তা করেছ?”

“আরে বাবা, এত বকাবকি করিস না তোরা। আমার পুরো কথা শোন।”

মোহকে উদ্দেশ্য করে একথা বলে ফারাহর দিকে চাইল শৌভিক। শান্ত সুরে বলল,
“এইযে সুন্দরী! আমি তো আপনাকে নিজের জীবনে সুন্দর মতো বরণ করব বলে সেই উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝখানে আপনার ডেঞ্জারাস ভাই আমার পথ আঁটকে আমার উপর জুলুম করতে শুরু করে দিয়েছিল। আমি কী করব বলুন? আপনার অনুভূতি আমার কাছে মোটেই মজা নয়। আপনার অনুভূতির একেকটা ছোটো অংশ আমার কাছে অতি মূল্যবান। এমন সুন্দরীর অনুভূতি যে আমাকে নিয়ে জড়িয়ে তা ভাবতেই তো নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়।”

ফারাহর অস্থিরতা সামান্য শান্ত হলো। খুবই ব্যস্ত মনে বোঝার চেষ্টা করল এই দুজন আ/হত পুরুষের মাঝে কী হয়েছে? তবে কি তার ভাই বিয়েটা মেনে নিতে নারাজ? যার কারণে এত সংঘর্ষ বেঁধেছে? এই বিয়েতে মত নেই? ফারাহর ভাবনায় ছেদ ঘটে তখন যখন শৌভিক মোহের দিকে চেয়ে বলতে লাগল,
“এইযে ম্যাডাম আপনি! নিজের প্রেমিক পুরুষকে একটু নিজের মুখে বলুন, আপনি আর আমার সম্পর্ক ভাই-বোনের মতো। এই সম্পর্কটাকে পেঁচিয়ে আপনার প্রেমিক পুরুষ ভুলভাল বুঝে যে আমাকে আমার বিয়ের দিনে এত মা/রল! এর শাস্তি কী হতে পারে আপনি বলুন এখন। আর একটু হলে আমাকে খু;ন করতে যাচ্ছিল আপনার প্রেমিক এই ভেবে যে আপনাকে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। নাউজুবিল্লাহ্, তওবা তওবা।”

ফারাহ হতবিহ্বল। মোহ বি/স্ফোরিত দৃষ্টিপাত করল স্বচ্ছের পানে। স্বচ্ছের আপাদমস্তক দেখল ভালো করে। বোঝাই যাচ্ছে তার উন্মাদনার পরিমাণ। আ/ঘাত প্রাপ্ত তার চোখমুখ। তবে, শৌভিকের সঙ্গে তার বিয়ে ভেবেই লোকটার এত পাগলামি? এমন সংঘর্ষ? কিন্তু কেন? তার তো আজকে বাগদান। অনুষ্ঠানের জন্য অর্ধেক পোশাক তো গায়ে। সাদা শার্টের উপর ব্লেজার গায়েব। অনুষ্ঠান ছেড়েই কি তবে এমন ভুল বোঝাবুঝির টানে ছুটে এসে পাগলামি আরম্ভ করেছে? বিয়েটা যদিও বা তার হতো তবুও কেন স্বাভাবিক মানুষ এমন উদ্ভ্রান্ত হবে? স্বচ্ছের চোখেমুখে এমন ভাব যেন সে কিছু করেনি। কিচ্ছু না। সে কথা শুনেও শুনছে না। কারোর দিকে তাকাচ্ছেও না। মোহ কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করতে চাইল,
“আপনি কেন…”

মোহের সম্পূর্ণ কথা শুনলই না স্বচ্ছ। গরম চোখ করে মোহকে বলল,
“তোমার সঙ্গে হিসেব-নিকেশ আমি পরে করছি। যা জ্বালিয়েছ তার পাই টু পাই ফেরত নেব। এখন টু শব্দও করে মাথা খারাপ করবে না। বর্তমানে আমি নিজের বোনের সাথে বোঝাপড়া করব।”

মোহ প্রতিক্রিয়া শূন্য। তবে তার মনে ঝড়ের আরম্ভ হয়েছে। নিজেকে দমায় মোহ। এই লোকটার সঙ্গে সে কথা বাড়াবে না ঠিক করে। কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো ফারাহর। না জানি এখন স্বচ্ছের সিদ্ধান্ত কী হবে এই বিয়ের ব্যাপারে!

থমথমে পরিবেশ। মিসেস জেবাও ফারাহর বিয়ের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে সৌমিত্র। মিসেস জেবার মুখ থমথমে। সৌমিত্র হা করে রয়েছে একপ্রকার। এতসব কাহিনী জানার পরে তার চোখেমুখে বিস্ময়ের অন্ত নেই। কেমন যেন সব গোলমেলে লাগছে। কাজী সাহেব বিরক্ত। বিয়ের সিদ্ধান্ত এখনো গ্রহণ করা হয়নি। স্বচ্ছ ভার গলায় মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“ফারাহ না হয় জানাতে পারেনি ভয়ে। তুমি অন্তত তো আমাকে বলতে পারতে বিয়ের বিষয়টা। আমি কি ভাই হয়ে নিজের বোনের বিয়ের সম্পর্কে জানার অধিকার রাখি না? নাকি তোমরা আমাকে এতই খারাপ ভাবো?”

মিসেস জেবার মুখ শুকিয়ে গেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন,
“তোমাকে আমি বলতে চেয়েছিলাম আগেই। কিন্তু তুমি তোমার বাবার ওসব ব্যাপার নিয়ে খুবই চিন্তাই ছিলে। তোমাকে বাড়তি চিন্তাই ফেলতে চাইনি। তাছাড়া শৌভিকের সঙ্গে তোমার সম্পর্কও তো খুব একটা ভালো দেখিনি কোনোদিন। তাই…”

“তাই তোমরা আমার কাছ থেকে এত বড়ো একটা ব্যাপার লুকিয়ে যাবে? নিজেকে এখন কেমন যেন পরপর মনে হচ্ছে।”

সৌমিত্র মাঝখান থেকে বলে উঠল,
“হুঁ, এমনকি আমাকেও বলা হয়নি যে তলে তলে এরা এতদূর চলে গেছে। ফারাহ সেঞ্চুরি মে/রেছিস তোর ভাইকে জানাবি না?”

মিসেস জেবা উনার ছোটো ছেলেকে এক ধমক দিয়ে বললেন,
“তোর মুখ ঠিক থাকে? যখন তখন যা ইচ্ছে মুখ ফসকে বলে দিস যে।”

স্বচ্ছের চোখেমুখে হতাশা। মন তার বেশ খারাপ। নিজের বোনের বিয়ের ব্যাপারে সব ভাইয়ের অন্যরকম একটা স্বপ্ন থাকে। সেই পরিকল্পনা ভেঙে গেলে একটু তো কষ্ট লাগে। মোহ চুপচাপ ফারাহর পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছে। পারিবারিক এসব বিষয়ে কথা বলা তার মোটেই উচিত হবে না। তবে সে ফারাহকে ঠেলে দিলো স্বচ্ছের দিকে। বধূ বেশী ফারাহ ভাইয়ের কাছে গিয়ে সামনাসামনি দাঁড়াল। স্বচ্ছ বোনের দিকে কিছুটা কড়া নজরেই তাকাল। বেশ সুন্দর সাজ ফারাহর। ছোটো কপালে একটা টিকলি আর অন্যপাশে টায়রা দিয়ে কপাল যেন ঢেকে গেছে। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে ভারি সাজ। গলায়, কানে, হাতে সুন্দর গয়না। নীল বেনারসি ফারাহর ফর্সা গায়ে ফুটে উঠেছে যেন। বধূরূপি তার বোনটা মুখ মলিন করে ভাইয়ের দিকে একমনে তাকিয়ে রয়েছে। তার এই চাহনির পর রেগে থাকা মুশকিল। স্বচ্ছ উঠে দাঁড়াল। ফারাহ মিনমিন করে বলল,
“সরি ভাইয়া। তুমি কষ্ট পেয়েছ? খুব কষ্ট দিয়েছি তাই না? আমি তোমাকে অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম বিশ্বাস করো। তুমি মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না। আর মন খারাপের কারণ যদি আমি হই তবে আমারও কান্না পায়।”

স্বচ্ছের কড়া মুখের হাবভাব নিমেষে মিলিয়ে গেল। দৃষ্টি হলো নরম। স্বচ্ছ ফারাহর মাথায় হাত রেখে থেমে থেমে বলল,
“অনেক বড়ো হয়ে গেছো তুমি।”

ফারাহর সুন্দর চোখজোড়ায় পানি টলমল করে উঠল। স্বচ্ছ এক গাল হেসে ফারাহর একগালে হাত বুলিয়ে দিলো। যদিও হাত নাড়াতে তার সামান্য কষ্ট হচ্ছে। হাতেও বেশ লেগেছে তার।
“বোকা মেয়ে! কাঁদছ কেন?”

ফারাহ আচানক কাঁপা গলায় বলে দিলো,
“তোমার বিয়েতে মত না থাকলে আমি বিয়ে করব না। তাও মন খারাপ করো না। আমি তোমার মত ছাড়া এমনিতেও বিয়ে করতে পারতাম না। মাকে বলে দিয়েছিলাম আগেই। তুমি যা বলবে তাই হবে।”

স্বচ্ছ শৌভিকের দিকে একবার তাকাল। শৌভিক নির্বিকার। তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সেও হয়ত স্বচ্ছের মতের অপেক্ষা করে একনাগাড়ে চেয়ে আছে। শৌভিকের মতো একটা ছেলে সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে সম্মান করতে জানে, ভালোবাসতে জানে, যত্ন নিতে জানে। এতটুকু অন্তত শৌভিকের ব্যাপারে জানে স্বচ্ছ। যেকোনো ভাই তার বোনের বিয়ে দিতে গেলে শৌভিকের মতোই কাউকে খুঁজবে। ছেলেটার কাছে কোনো মেয়ে খারাপ থাকতে পারে না। স্বচ্ছ অনেক ভাবলো। সকলে তার উত্তরের জন্য আশায় চেয়ে রয়েছে। স্বচ্ছ বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে বলে ফেলল,
“আমার কোনো অমত নেই। একজন ভাই হিসেবে শৌভিক মীরের মতোই কারোর হাতেই আমি নিজের বোনকে তুলে দিতে চাইব। কারণ মি. শৌভিক আগলে রাখতে বেশ ভালোই জানে। এখানে কোনো ভাইয়ের আপত্তি থাকতেই পারে না।”

উত্তেজিত হয়ে নিজের ভাইকে চেপে ধরল ফারাহ। স্বচ্ছের ঘাড় পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ল একপ্রকার। এটা ফারাহর ছোটোবেলার অভ্যেস। যেকোনো খুশির সময় সে স্বচ্ছ অথবা সৌমিত্রের ঘাড় পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ত। স্বচ্ছ তাল সামলাতে গিয়ে কিছুটা বেগ পেতে হলো। সে নড়বড়ে হয়ে বলল,
“আস্তে, আস্তে। বিয়েশাদি হয়ে যাচ্ছে তোমার। এখনো কি সেই ছোটো আছো যে যখন তখন ঘাড় ধরে ঝুলবে?”

ফারাহ সেসব কানেই নিলো না। ভেংচি দিয়ে বলল,
“ম/রার আগ অবধি ঝুলব এভাবে।”

স্বচ্ছকে ছেড়ে সৌমিত্রের কাছে এলো ফারাহ। সৌমিত্রও মুখ ফুলিয়ে আছে। ফারাহ ভাবল, সেও হয়ত অভিমান করে আছে। তাই সে জোরালো সুরে জিজ্ঞাসা করল,
“এখন কি তোর সামনে কান ধরে উঠবস করতে হবে? আপেলের মতো মুখ করে রাখিস না। তোর চেহারা বিগড়ে যায়।”

সৌমিত্র কথা বলে না। ফারাহ এবার কণ্ঠ নিচে নামিয়ে মুখ ভার করে একটা কানে ধরে বলল,
“সরি ভাইয়া।”

সৌমিত্র ফট করে বলতে লাগল,
“আরে, তোর উপর রাগ করব না তো কার উপর করব? ভাইয়ার উপরেও রাগ আছে আমার। তোরা প্রেম করছিস, বিয়েশাদি করছিস ভালো কথা। আমাকে নিয়ে একটু ভাববি না? আমি যে সিঙ্গেল পড়ে আছি সেটা ভেবে একটা ছোটো বোন আছে এমন কারোর সঙ্গে তো প্রেম করতে পারতিস।”

ফারাহর নয়ন দুটো এবার বড়ো আকার ধারণ করল। তারপর সৌমিত্রকে আলতো ধা/ক্কিয়ে বলল,
“তোর তো একটা আছেই রে। সেদিন না বললি? মিস গোলাপি!”

“আরে আমাকে একটুও পাত্তা দেয় না। চোখ দিয়ে ফিরেও তাকায় না। কী করব বল? আমাকে ওর সাথে সেট করে দেওয়ার দায়িত্ব তোর।”

স্বচ্ছ এবার গম্ভীর গলায় বলল,
“সবারই একটা করে তাহলে একটা করে জুটে গেছে অথচ আমাকে জানানো হয়নি!”

সৌমিত্র এবার কোনো কিছু না ভেবেই দাঁত কেলিয়ে মুখ ফসকে বলে দিলো,
“তুমি কি মোহ ভাবির সাথে প্রেম করার সময় আমাদের পারমিশন নিয়েছিলে?”

ভূত দেখার মতো চমকে গেল মোহ। রসগোল্লার ন্যায় চোখদুটো রাখল সে স্বচ্ছের দিকে। লজ্জায় যেন মাথা কা/টা চলে গেল তার। কিছু যে মুখ ফুটে বলবে তার জন্যও কণ্ঠস্বর অনবরত কাঁপছে। কান গরম হয়ে গেছে স্বচ্ছের। আস্তে আস্তে মুখটা লাল হয়ে আসছে তার। সৌমিত্রকে ধমকাতেও পারছে না। ফারাহ একপ্রকার শব্দ করেই হাসছে। নিজের কথা বলে নিজেই বোকা বনে গেছে সৌমিত্র।

অবশেষে সন্ধ্যার রূপালী চিকন চাঁদের ফালি যখন আকাশে জ্বলজ্বল করছে তখন বিয়ে পড়ানো শুরু হয়। মোহ শখ করে বর আর কনের গলায় ফুলের মালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। কাজী সাহেব বিবাহের খুতবা শুনিয়ে মোহরানা নির্ধারিত করে কনে অর্থাৎ ফারাহর বড়ো ভাই স্বচ্ছের কাছে প্রস্তাব রাখল। স্বচ্ছ সম্মতি দিলেই কাজী সাহেব জোরে জোরে বলেন,
“যদি সরোয়ার সাহেরের কন্যা ফারাহ সাহের শায়েখ মীরের একমাত্র পুত্র শৌভিক মীরকে বিবাহ করতে আপত্তি না থাকে তাহলে সম্মতি জানাবেন।”

কিছুটা দূরে ফারাহর বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠল। শুধু তার সম্মতির অপেক্ষা এখন মাত্র। এরপরই তো তার নতুন জীবন। বিবাহিত জীবন! তার হাত সহ সর্বাঙ্গ শিউরে উঠেছে। ঠাণ্ডা হাতে সে মোহের হাতটা জোরে চেপে ধরল। সে জানে, শৌভিক তার দিকেই চেয়ে আছে তাও একনজরে। শৌভিকের দুটো লোচনে দৃঢ় প্রতিক্ষা। ফারাহর দুই নয়নে অজস্র আকাঙ্ক্ষা। কাজী সাহেব আবার শুধালেন,
“শৌভিক মীরকে স্বামী হিসেবে মানতে আপত্তি না থাকলে কবুল করুন তাকে।”

ফারাহ সম্মতি দিতে চাইছে কিন্তু কোথাও তীব্র আতঙ্ক ঘিরে ধরছে তার গহীনে। কোথাও সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে। সে অস্থির পানে শৌভিকের দিকে তাকায়। অতঃপর সে শৌভিকের স্মিত সেই হাসি এবং সেই দুটো চোখে কী দেখল জানে না তবে সে অবলীলায় বলে ফেলল,
“আমি কবুল করলাম উনাকে নিজের স্বামী হিসেবে।”

সঙ্গে সঙ্গে মোহের গোলাপি লিপস্টিক ঠোঁটে ফুটল সূক্ষ্ম হাসির রেখা। সবাই মৃদু কণ্ঠে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ।”

অতঃপর এলো শৌভিকের পালা। কাজী সাহেব বলতে লাগলেন,
“শায়েখ মীরের একমাত্র পুত্র শৌভিক মীর আপনি যদি সরোয়ার সাহেরের কন্যা ফারাহ সাহেরকে নিজের স্ত্রী রূপে মানতে কোনো আপত্তি না থাকে তবে কবুল বলবেন।”

শৌভিক ঠাণ্ডা গলায় পরপর দুইবার কবুল বলে শেষে বলল,
“আমি কবুল করলাম তাকে স্ত্রী হিসেবে। নিজের পরিপূরক হিসেবে আমি তাকে সারাজীবনের স্বীকৃতি দিলাম। আজীবনের জন্য আমি তার হলাম।”

সকলে এক কথায় বলে উঠল আলহামদুলিল্লাহ। ফারাহর ঠোঁটে লেগে থাকা লাজুক হাসি জানান দেয় তার নতুন এক পৃথিবীর। তারা দুজন সাইন করে কাবিননামায়। সাইন করতে গিয়ে আচানক বাবার কথা মনে পড়ে ফারাহর। কী এমন হতো যদি বাবা নামক লোকটি সঠিক পথে চলত? তাহলে বিয়েটা এভাবে হতো না। ধুমধাম করে বিয়ে হতো নিশ্চয়। ফারাহ জানে, তার মায়ের মনটাও খারাপ। তবুও এসেছেন। নিজের মেয়ের বিয়ে বলে কথা!

ফারাহর সাক্ষী হিসেবে সাইন করল তার দুটো ভাই। শৌভিকের দিক থেকে শৌভিকের বাবা এবং তার খালাতো ভাই সই করল।

সবশেষে শৌভিক নিজ হাতে ফারাহর হাতে তার মোহরানা তুলে দিয়ে বলল,
“আপনার হক আপনাকে বুঝিয়ে দিলাম বেগম সাহেবা।”

টাকা হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ফারাহ। শৌভিকের মুখে এক অদ্ভুত হাসির উদয় হলো। এক দুষ্টু হাসি। সে ফারাহর নিকটে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এবার আমার পালা আমার হক বুঝে নেওয়ার।”

টাকাগুলো পড়েই গেল ধড়ফড় করে ফারাহর হাত থেকে। পুরো চোখমুখে জ্বালা ধরল তার। কী অসভ্য কথা! মোহ শব্দ করে হেসে টাকা গুলো তুলতে তুলতে বলল,
“আমি কিন্তু সব শুনতে পেয়েছি। ভাইয়া, তুমি এত লাগামহীন ছেলে জানতাম না তো!”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
বোনাস পর্ব [দ্বিতীয় খণ্ড]

সবশেষে ফারাহ মায়ের সামনাসামনি এলো। মায়ের মুখটা মনমরা। ফারাহ এমন বিষণ্নতার কারণ জানে। মিসেস জেবা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বেশ মুগ্ধ হলেন। কী স্নিগ্ধ লাগছে বউয়ের সাজে! উনার কাছে এখনো মেয়ের বিয়েটা অবিশ্বাস্য লাগছে। এইতো সেদিন, ফারাহ হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেল। মাথাটা তার ফে/টে গেল। সে কী কান্না! তার এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়েছিল স্বচ্ছ এবং সৌমিত্র। পারে না যেন তারা বোনকে কোলে করে নিয়ে দৌড়ে হসপিটালে যাবে! সেদিন সরোয়ার সাহেব ছোটো ফারাহর দিকে নজর না দেওয়ার জন্য বেশ বকাঝকা করেছিলেন। দুটো ছেলে হবার পর মিসেস জেবার বেশ ইচ্ছে ছিল একটা মেয়ে সন্তানের। সৃষ্টিকর্তা উনার আশা পূরণ করেছিলেন। একটু একটু করে এত বড়ো হয়ে গেল ফারাহ? ভাবতেও পারেন না তিনি। আজ কিনা মেয়েটা আরেক বাড়ির পুত্রবধূ! আজ যদি মেয়েটার বাবা থাকত তাহলে কী এমন ক্ষতি হতো? মেয়েটার বিয়ে নিজ চোখে দেখার সেই অনুভূতির স্বাদ তিনি নিজেই হারালেন। মিসেস জেবা ফারাহর মাথায় দুহাত দিয়ে বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“সুখে থাকো আমার সোনার টুকরো।”

ফারাহর চোখ ভর্তি অশ্রু টলটল করছে। যখনতখন তার নয়ন জুড়ে বর্ষণ নেমে একাকার হয়ে যাবে। ফারাহ জাপটে ধরে মাকে। এবার থেকে তো যখন তখন আর মাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না সে। মায়ের কাঁধে লুকানো ফারাহর মুখ। নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সৌমিত্র ফারাহর কান্না থামাতে মজা করে বলল,
“এই ফারাহ, কাজল লাগিয়ে তো পুরা একটা কাজল শেষ করে দিয়েছি দেখলাম চোখে। এই অবস্থায় কাঁদলে কিন্তু ভূতনি হয়ে যাবি। শেষমেশ তোর জামাই তোকে দেখে পালাবে।”

ফারাহ মুখ উঠিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকায় ছোটো ভাইটার দিকে। অভিমান করে বলে,
“দেখব, এবার থেকে কার সাথে উঠেপড়ে লাগিস।”

“বলিস কী রে? তোর সঙ্গে লাগার ইচ্ছে করলেই তোর শ্বশুরবাড়ি হাজির হবো আমি। কী ভাবিস আমাকে? কী শৌভিক ভাই? আমাকে কি যেতে দেবেন না?”

শৌভিক শব্দ করে হেসেই বলল,
“পারলে তোমার বোনের সঙ্গে এখনি চলো আমাদের বাড়ি।”

সৌমিত্র ফারাহকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
“দেখ, দেখ তোর মতো নাকি শৌভিক ভাই? যথেষ্ট বড়ো মন তার।”

ফারাহ প্রত্যুত্তরে ভেংচি কাটে শুধু। ঘাড় ঘুরাতেই পেছনে টেবিল ঘেঁষে বুকে হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বচ্ছের দিকে ফারাহর উচ্ছ্বসিত দৃষ্টি গেল। স্বচ্ছের মুখ গম্ভীর। কোনো গভীর ভাবনায় সাঁতার কাটছে যেন। ধীর পায়ে তার সামনে গিয়েই থামল ফারাহ।

নিজের বোনের নতুন জীবনটা যেন নিজ চোখে কল্পনা করতে পারছিল স্বচ্ছ। স্মৃতিচারণ করছিল ছোটোবেলার কথা। যেন দুদিন আগের কথা! স্বচ্ছের কোলে উঠলেই ফারাহ তার কাপড়চোপড় অগুনতি বার ভিজিয়ে ফেলত। এমনটা করে যেন ছোটো ফারাহ কী যে আনন্দ পেত সেটা তার খিলখিল করে ফোকলা দাঁতের হাসি মুখ দেখে বোঝা যেত। একবার সৌমিত্রের ঘাড়ে চড়ে দুই নম্বর কাজ সেরে ফেলেছিল ফারাহ। সৌমিত্র যার কারণে দুটো সাবান শেষ করে ফেলেছিল ঘাড়ে মাখাতে মাখাতে। দিনগুলো কত দ্রুত পেরিয়ে যায়! সবগুলো স্মৃতির কাতরে পড়ে যায়।

ফারাহ স্বচ্ছের সামনে চুটকি বাজাতেই খানিকটা চমকেই তাকায় স্বচ্ছ। ফারাহর চোখের পাপড়িতে পানির ফোটন লেগে থাকলেও তার মুখে যেন এক অন্য উল্লাস দেখা যায়। তার মুখে প্রণয়ের পরিপূর্ণতার ছাপ বোঝা যায়। স্বচ্ছ তাতেই খুশি। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“শুধুমাত্র তোমার খুশির জন্য আমি বিনা আপত্তিতে বিয়ে দিতে রাজি হলায়। সৃষ্টিকর্তা তোমার মুখে যেন এই খুশিটা আজীবন রাখেন।”

ফারাহর গালের কাছে হাত উঠাতে একটু কষ্ট হলেও মেয়েটার গাল টিপে মৃদু হাসে স্বচ্ছ। হাতের বাহুর হাড্ডি সহ যেন নাড়িয়ে দিয়েছে শৌভিক। ফারাহর পাশে এসে দাঁড়ায় শৌভিক। স্বচ্ছ তার চোখে চোখ রাখে না। সে লজ্জিত। তার অবুঝ কর্মকাণ্ডে সে প্রচণ্ড লজ্জিত। তবুও গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“আমার একমাত্র বোনের খুশি, আনন্দ আপনার হাতে। তার জীবন সাজানো আপনার হাতে। আশা করি তার জীবন আপনি আনন্দ এবং শান্তি দিয়ে সাজিয়ে দেবেন। ফারাহ জেদি, একরোখা। তবে ওর গাল টেনে দিলে অথবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই তার মনের সরলতা বেরিয়ে আসে। তার ভালোমন্দ সব দায়িত্ব আপনার হাতে তুলে দিলাম। ওর সামান্যতমও কষ্ট কখনো হয় তবে আমি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নই।”

শৌভিক হাসতে চায় তবে ঠোঁটের কোণে জ্বালা ধরে। মৃদু স্বরে বলে,
“ভরসা যখন করেছেন তখন শৌভিক ভরসার মান রাখবে। আপনার বোনের ভালো থাকার মধ্যে আমি নিজের ভালো থাকা খুঁজে পাই। তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব নয় সেটা আমার ভালোবাসা।”

স্বচ্ছ জানে সে ভুল মানুষের প্রতি আশা করছে না। মানুষটা পারফেক্ট!

সন্ধ্যে পার হয়েছে। রাত্রীর কালো মেঘ আকাশের চাঁদ ঢেকে ফেলছে। আবারও মেঘ পেরিয়ে উঁকি দিয়ে ফেলছে চাঁদের আলো। ফারাহ ও শৌভিক বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই তাড়াহুড়ো করে রাস্তার দিকে যাচ্ছে মোহ। মৃদু আলোয় কিছু দেখতে না পেয়ে আচানক হিল জুতোর হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো সে। কোনো এক কঠিন কণ্ঠস্বর ভেসে আসে অদূর থেকেই।
“আস্তে, আস্তে! এই বয়সে পড়ে গিয়ে কোমড় ভাঙলে সারাজীবন আমাকে তোমায় কোলে করে নিয়ে বইতে হবে।”

মোহ ঘাবড়ে গেল। কণ্ঠ উপলব্ধি করে চোখ বড়ো বড়ো করে তার থেকে পাঁচ হাত দূরে থাকা গাড়ির দিকে তাকাল সে। গাড়ির সামনের অংশ ভর দিয়ে পকেটে সুন্দর মতো হাত গুঁজে যেন কারোর জন্য অপেক্ষামান যুবক। মোহ গজগজ করে বলে উঠল,
“আমার তো আকাল পড়েছে! উনার কোলে চড়ে ঘুরতে হবে!”

স্বচ্ছ এগিয়ে এলো। মোহ ভেতরে ভরকে গেলেও গম্ভীর এবং শক্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। স্বচ্ছ এগোতে এগোতে বলল,
“আপনার আকাল নাকি সুকাল পড়েছে তা তো আমি জানি না। কিন্তু আমি আমার সুকাল দেখতে পাচ্ছি অনেকদিন পর।”

মোহ ভাবতে লাগল, সুকাল বলে কোনো শব্দ আদেও বাংলা অভিধানে আছে কিনা! না, নেই। সবটাই এই লোকটার বানানো। আশেপাশে লাইট নেই। তবে সুপ্ত আলোয় বেশ ভালোই স্বচ্ছের আ;হত চেহারা ফুটে উঠেছে। তার সেই দৃষ্টি যা মোহ কতদিন হলো দেখতে পায়নি। ঘোর লাগানো সেই চাহনি দিয়ে ঘায়েল করার পন্থা যেন খুঁজছে স্বচ্ছ। মোহ মোটেই নরম হলো না। জমেছে তার অভিমানের পাহাড়। সেই পাহাড়ের চূড়া কোথায় গিয়ে থেমেছে তার জানা নেই। মোহ স্বচ্ছ পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে মুহূর্তেই তার চুড়ি পরা চিকন হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে ফেলে স্বচ্ছ। মোহ প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও ধাতস্থ করে রাগ নিয়ে বলে,
“সমস্যা কী? লজ্জা করে না? ফিয়ন্সে রেখে অন্য মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করেন?”

“না, একদম লজ্জা করে না। আর কোথায় পালাচ্ছো? আজকে সব হিসেব না নেওয়া অবধি তোমার তো বাড়ি যাওয়া হবে না, মোহ রানি।”

মোহ নিজের হাত ছাড়াতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। স্বচ্ছ এবার ক্রুদ্ধ স্বরে বলে ওঠে,
“এই মেয়ে, এমনি তোমার পাতানো ভাই আমার হাত প্রায় ভেঙে ফেলেছিল। তুমি পুরোপুরি ভাঙার তোড়জোড় করো না। শান্ত থাকো।”

“কে বলেছিল রাস্তার ছেলেদের মতো মা/রামা/রি করতে? আমি বলেছিলাম? আমার হাত ছাড়ুন আমি বাড়ি যাব। নাহলে এখানেই চিৎকার চেঁচামেচি করব আমি।”

স্বচ্ছের মাঝে ভাবান্তর হলো না। সে বরং একটা চমৎকার হাসি উপহার দিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
“চিৎকার করবে? করো, করো। আমার কাজটা সুবিধা হয়। দুই কদম পেরোলেই কাজী অফিস সামনে জ্বলজ্বল করছে। বিয়েশাদি দিয়েই দেবে লোকজন।”

দমে গেল মোহ। চোখ রাঙিয়ে চেয়ে রইল শুধু। স্বচ্ছ তাকে যত্নের সহিত কাছে টানে। তাদের মাঝে দূরত্ব এক ইঞ্চি মতো। চন্দ্র মৃদু আলো যেন মোহের রূপেই ছড়াচ্ছে। শাড়ি পরনে মেয়েটি যেন ক্রমে ক্রমে তার স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে। খোলা চুলের একপাশে সে গুঁজে রেখেছে তিনটি গোলাপ ফুল। এমন সাজে সজ্জিত মোহকে প্রথম দেখার সুযোগ পেয়েছে স্বচ্ছ। এর আগে যতবার দেখেছে সালোয়ার কামিজে। স্বচ্ছের দর্শনেন্দ্রিয় দুটি লোভ সামলাতে ব্যর্থ হয়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
“তোমার গলা দিয়ে তো এখনো আওয়াজ বের হলো না। এসো, তোমার চিৎকার করার জন্য সুবিধা করে দিই।”

মুহূর্তের মাঝে স্বচ্ছ মোহের দুটি হাত উঠিয়ে নিজের প্রণয় পিপাসু ওষ্ঠদ্বয় হাতের তালুতে স্পর্শ করে। ওলটপালট হয়ে যায় মোহের অন্দরমহল। ভূ-কম্পন সৃষ্টি হয় তার নিজস্ব পৃথিবী জুড়ে। ভ্যাপসা গরমেও যেন তার মনে লেগে যায় শীতল হাওয়া। মিশে যায় নানান অনুভূতি। কোথাও ভালো লাগা, কোথাও অভিমান, কোথাও ক্রোধ, কোথাও শান্তি।

স্বচ্ছ তাকে ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। মোহ মূর্তি রূপে পরিণত হয়েছে যেন। চোখমুখ প্রতিক্রিয়াহীন। স্বচ্ছ তার গালে হাত ঠেকাতেই নড়েচড়ে উঠে ছিটকে গেল মোহ। স্বচ্ছ হেসে হেসে বলল,
“এ কী! এই লজ্জাহীনের মানুষের চুম্বনে ভাবলাম আপনি আরো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবেন ম্যাডাম। কিন্তু আপনার গলা আওয়াজ দেখছি হারিয়ে গেছে।”

মোহের রাগ ফেরত এলো হঠাৎ। একহাতে স্বচ্ছের কলারের একপাশে হালকা টেনে ধরে বলল,
“আপনি অত্যন্ত একটা অসভ্য, অভদ্র আর ইতর ছেলে। যে না নিজে বিয়ে করবে আর না আমাকে বিয়ে করতে দেবে।”

“তাহলে চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।”

মোহ স্বচ্ছের এমন হুটহাট প্রস্তাবে হতবিহ্বল হলে স্বচ্ছের কলার ছেড়ে দিলো। মুখ ভার করে শুধাল,
“আপনার তো আজকে এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার কথা। আপনি কেন এখানে ছুটে এসে ঝামেলা করতে গেলেন? এঙ্গেজমেন্ট করবেন না আপনার সুন্দরী ফিয়ন্সের সাথে?”

স্বচ্ছ সাথে সাথে কপাল জড়িয়ে কড়া সুরে বলে দিলো,
“জাস্ট ফা* দ্যা এঙ্গেজমেন্ট।”

মোহ চোখমুখ জড়িয়ে তুলল। অসন্তোষ হয়ে বলল,
“দিনদিন মাত্রাতিরিক্ত বাজে হচ্ছে আপনার মুখের ভাষা।”

স্বচ্ছ মোহের কথাতে তেমন পাত্তা দিলো না। সে নিজমনে পূর্বের ন্যায় বলল,
“ফারদার আমি এসব নিয়ে কথা শুনতে চাই না। আমি শুধু মোহ আনবীরকে চাই।”

স্বচ্ছ থামে। মোহের দুচোখ যেন তার অভিমানের কথা জানাতে চাইছে। মেয়েটার স্মরণে ভাসে অতীতের বলা স্বচ্ছের কথা। মনটা ভেঙে আসে। সেই মন ভাঙা থেকে আজ অবধি তার সেই বিষণ্নতা কমেনি। মোহ নিজের অনুভূতির তাড়নায় তড়পেছে। স্বচ্ছ কি তা বুঝেছিল? বুঝলে বুঝি ওমন করত? সে ভাঙা গলায় স্বচ্ছকে বলল,
“আপনি নিজ থেকে একদিন আমাকে বলেছিলেন যে আপনার আর আমার মাঝে কিছুই নেই। যা ছিল সামান্য মুহূর্তের এট্র্যাকশন। তবে আবার কেন এসব বলে দুর্বল করছেন আমার মনকে? আমাকে দ্বিধায় ফেলবেন না। আপনি তো নিজের পথ বেছে নিয়েছিলেন। আমি মেনে নিয়েছিলাম। কেন ফেরত এসেছেন?”

“কারণ আমার পথ, আমার উদ্দেশ্য, আমার লক্ষ্য মোহতেই গিয়ে থামে। তাকে ছাড়া স্বচ্ছ শূন্য। সে ব্যতীত স্বচ্ছ দিশাহারা। সে বাদে অন্য সকল পথ আহিয়ান স্বচ্ছের জন্য নিষিদ্ধ।”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৪ [দ্বিতীয় খণ্ড]

“পুরুষ তো নারীদের মন গলাতে অনেক কথা বলে। জীবনে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থাকার কারণে পুরুষ মানুষকে আমি পাত্তা দিতেই চাইতাম না। একা বাঁচতে চেয়েছি। যখন কাউকে মনে ধরল তখনও আরেক অভিজ্ঞতা তৈরি হলো। এখনকার পুরুষ মানুষ বড়োই বিচিত্র।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল মোহ। তার বলা একেকটা কথা প্রাণনাশ করার মতো কথা। স্বচ্ছের সহ্যের সীমানার বাহিরে। মোহের চুড়ি ভর্তি হাতটা নিজের মুঠোর নিলো স্বচ্ছ। তীব্র কাঠিন্য বজায় রেখে বলল,
“এতদিন আমার কথার প্রতিটা তোমার কাছে মিথ্যে আর মন গলানো মনে হয়েছে মোহ? সত্যি করে বলো!”

মোহ কিছুটা ভড়কে গেলেও মচকাল না। নিজেকে শক্ত রেখে বলল,
“আপনি নিজে আপনাকে মিথ্যে প্রমাণ করেছিলেন। মনে নেই সেদিনের কথা? যেদিন বলেছিলেন আপনার আমার মাঝে যা হয়েছে সবটা না বুঝের রাগের মাথায় করেছিলেন। কোনোটা সত্যি ছিল না। মনে পড়ছে সেসব কথা? এখন হুট করে আবার এসব কথা বললে কোনটা আমি বিশ্বাস করব বলুন তো দেখি?”

এই মুহূর্তে স্বচ্ছের নিজেকে অসহায় বোধ করতে শুরু করল। কী করে মোহকে বিশ্বাস করাবে তার বাধ্যবাধকতা? সে শান্ত গলায় মোহকে অনুরোধ করল,
“আমাকে দশটা মিনিট সময় দেবে? আমি সব বলব তোমাকে। শুধু কিছু সময় চাই। প্লিজ!”

কোনোকিছু না ভেবেই সরাসরি নাকচ করে দিলো মোহ। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একপ্রকার ধমকে বলে উঠল,
“আমাকে স্পর্শ করার অধিকার আপনি রাখেন না। তাই আমার হাত আপনি ধরবেন না। আপনি অন্য এক মেয়ের হবু বর হওয়ার কথা। আর অন্যের বরের প্রতি আমার এত আকর্ষণ নেই। আশা করি আপনিও আমার প্রতি আকর্ষিত হবেন না এবং আপনাকে ১ মিনিটও সময় দিতে আমি প্রস্তুত নই। এরপরেও যদি আপনি আমার রাস্তা আটকান আমি সত্যি লোকজন ডাকব। আমি কী কী করতে পারি আপনি খুব ভালো করে জানেন।”

নিজের কথা শেষ করেই স্বচ্ছের পাশ কাটিয়ে হাঁটা ধরে মোহ। স্বচ্ছের চোখমুখের রং পাল্টে গেল এবার। গরম হয়ে যাচ্ছে শরীরের র;ক্ত। অধৈর্য হয়ে নাছোড়বান্দার মতো মোহের পিছু হাঁটা ধরল স্বচ্ছ। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতে লাগল,
“আমার অনুভূতি এতটা সস্তা নয় মিস মোহ। যদি এতটা সস্তা হতো আমি দিনরাত তোমার উপর নজর রাখতাম না। যদি এতটা মূল্যহীন হতো, বৃষ্টির দিনেও তোমায় দেখতে ছুটে যেতাম না। তুমি ভিজছিলে বলে, একটা বাচ্চাকে দিয়ে ছাতা ধরিয়ে দিতাম না! তোমার জন্য নিজের সম্পূর্ণ রাতটা নির্ঘুম কাটিয়ে দিতে পারতাম না। অন্য পুরুষের সঙ্গে দেখে হিংসায় নিজেকে পোড়াতাম না। এই আহিয়ান স্বচ্ছের প্রতিটা ভালোবাসার কথা যদি মিথ্যে হতো তাহলে নিজের জীবনটা ছেড়ে দিয়ে তোমাকে সেই নদীর গভীর থেকে উদ্ধার করত না। আহিয়ান স্বচ্ছের মাথা আর হৃদয় দুটোই শরীর ছিঁ/ড়ে বের করে এনে দেখো মোহ! সেখানে শুধু তোমার ভাবনা আর তোমার চিন্তা জুড়ে রয়েছে।”

মোহের চলা আঁটকে ধরল স্বচ্ছের প্রতিটা বাণী। সে থামতে বাধ্য হলো। হতবিহ্বলের ন্যায় মাথা ঘুরিয়ে পেছনে স্বচ্ছের দিকে তাকাল। লোকটা এত কথা বলার পর হাঁপাচ্ছে। মোহ চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখল। সেখানে অনেক লোকের উপস্থিতি। চিৎকার করে বলা স্বচ্ছের কথা তারা শুনেছে। মোহের অস্বস্তি লাগল তাদের দৃষ্টি। তবুও সে স্বচ্ছের চোখে চোখ রাখল। সেখানে কোনো মিথ্যে নেই। মোহ নিচু স্বরে জানতে চাইল,
“আপনি সেদিন আমাকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন? তাহলে আপনি আমাকে পরে মিথ্যে বললেন কেন?”

“আমি বলেছিলাম, তুমি আমার জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু তোমার প্রতিই আমার ভুবনের সমস্ত আকর্ষণ। তুমি সেই পজিটিভ চার্জ যার প্রতি এই নেগেটিভ চার্জ আকর্ষিত হয়। কিন্তু আমাদের মাঝে যত প্রকার বাঁধা ছিল সব ছাড়াতে মিথ্যে বলেছিলাম। এই নিষিদ্ধ ট্যাগ উঠিয়ে নিতে মিথ্যে বলেছিলাম। কারণ, আমার উদ্দেশ্য তোমাকে খানিকক্ষণের জন্য সময় কাটানো নয়। আমার উদ্দেশ্য সারাজীবন নিজের বাহুডোরে এই বীরনারীকে আবদ্ধ করা।”

মোহ চেয়ে রইল শুধু। তার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। শুধু মন চাইল শুনতে। ভুল যেতে ইচ্ছে করল মানুষটার দেওয়া শত শত যাতনা। তবে মোহের মৌনতায় যেন ক্ষান্ত হলো না স্বচ্ছ। সে মোহকে বিশ্বাস করাতে চায়, সে মিথ্যে নয়। স্বচ্ছ দম ফেলে বলে উঠল,
“তবুও যদি আমায় বিশ্বাস না হয় তাহলে তুমি গণ/ধোলাই খাওয়াতে যদি চাও আমি কিছু বলব না। আমি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি সবাইকে ডাকো। না, না। ওয়েট, আমিই বরং সবাইকে ডাকছি।”

উপায়ন্তর না পেয়ে স্বচ্ছের শার্টের হাতা খামচে ধরে তাকে আটকালো মোহ। চোখ রাঙাল স্বচ্ছকে। কণ্ঠ ভারি করে বলল,
“হয়েছে থাক। আপনি বলুন। আমি আপনার কথা শুনছি।”

স্বচ্ছের ক্লান্তি, ক্ষ/ত ভরা মুখে অবিলম্বে সুন্দর একখানা স্বস্তিদায়ক হাসি দেখা গেল। তা দেখে আগুনের শিখার ন্যায় জ্বলে উঠল মোহ। নাক ফুলিয়ে বলল,
“আপনি একজন উন্মাদ।”

“জানি।”

স্বচ্ছের নির্বিকার স্বীকারোক্তি। মোহ তার স্বীকার্য শুনে অপলক তাকিয়ে রইল কিছুটা মুহূর্ত। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে ইতস্তত হয়ে বলল,
“আপনার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে বলা কথা সবাই শুনেছে। কীভাবে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে!”

স্বচ্ছের মজা লাগছে মোহের এমন সংকোচ দেখে।
“এজন্য বলি বড়োদের কথা শুনতে হয়। আগেই হম্বিতম্বি করে চলে যেতে নেই।”

স্বচ্ছের এমন জ্ঞানী সাজার ভান দেখে আঁখি ছোটো হলো মোহের। ঠোঁট বাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,
“একটু সাইডে চলুন, বড়ো জ্ঞানী ব্যক্তি! এত লোকজনের মধ্যে কথা বলতে অসুবিধা হবে।”

চক্ষু দুটো বৃহৎ করে হকচকিয়ে ওঠার ভান ধরে নিচু স্বরে স্বচ্ছ ফিসফিসিয়ে বলে,
“কিন্তু এখনো তো আমাদের বিয়ে হয়নি। সামনে কাজী অফিসই তো আছে। বিয়ে সেরে নিলে ভালো হতো না? বিয়ের আগেই এত রিস্ক নেওয়ার কী দরকার বলো?”

মোহের মস্তিষ্কে অগ্নি যেন ক্রমে ক্রমে উত্তাপ ছড়িয়ে গেল। কী অসভ্য বাণী! দাঁতে দাঁত চেপে মোহ আচানক স্বচ্ছের হাতের পিঠে জোরে চিমটি কে/টে বসল। হুড়মুড়িয়ে হাত টান দিয়ে চোখমুখ খিঁচে নিলো স্বচ্ছ। মোহ হিসহিসিয়ে বলল,
“কাজী অফিস নয়। হসপিটাল আপনার জন্য উত্তম জায়গা। নির্লজ্জ!”

বহু অনুরোধের পর অবশেষে মেইন রাস্তার অন্য প্রান্তে অনেকটা হেঁটে গিয়ে ওভারব্রীজে উঠে দাঁড়াল দুজন। সন্ধ্যাতেই তাঁরার মেলা বসেছিল। হঠাৎ সব অন্ধকারে নিমজ্জিত। বড়ো বড়ো গাড়ি চলছে শাঁই শাঁই করে ফুল স্পীডে। স্বচ্ছ একের পর এক নিজের করা সব পরিকল্পনার বর্ণনা এবং নিজের বাবার দেওয়া হুম/কিগুলো বর্ণনা করতে ব্যস্ত। এছাড়াও আরিদ্র যে তারই সম্পর্কে ভাই হয় সেটা বলার পরই শিউরে ওঠে মোহের গায়ের লোম। শিরশিরে বাতাসে কম্পন ধরে। অবিশ্বাস্য গলায় শুধায়,
“ও আপনারই ভাই? তার মানে ওর ডিএনএ আপনার জোগাড় করা?”

“হ্যাঁ। শৌভিকের মাধ্যমে জেনেছিলাম সব। ওকে মা/রার ইচ্ছা ছিল কোনো কিছু না ভেবে পরিকল্পনা করে মে/রেছি। যদি পারতাম, যদি আমার হাতে থাকত ওকে শেষ আমি নিজের হাতেই করতাম।”

মোহ চুপ রইল। শুকনো ঢোক গুলে বলল,
“আমার কেমন জানি লাগছে।”

মোহের মনে অদ্ভুত সংশয়। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“কেমন লাগছে? আমি ওই আরিদ্রের ভাই বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? কী মনে হচ্ছে? আমিও ওমন ছেলে?”

মোহের মুখে এবার হাসি দেখা গেল। সূক্ষ্ম হাসি। স্বচ্ছের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই চিনলেন আমাকে? এটা কী করে ভাবছেন যে আমি আপনাকে চিনতে এতটা ভুল করব? এটা ঠিক যে একটা খারাপ পরিবার পেলে সন্তানের মাঝে খারাপ জিনিসটা চলে আসে। কিন্তু পরিবারের মধ্যমনি কিন্তু একজনই হয়। সেটা হচ্ছে মা। আপনার মা খারাপ ছিলেন না। তাই আপনি বা আপনার ভাই বোনকে হয়ত খারাপ স্পর্শ করতে পারে নি। যেই মানুষটা নিজের বাবার অন্যায় মেনে নিতে পারে না। সেই মানুষটাকে অবিশ্বাস করার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?”

স্বচ্ছের মুখটা হঠাৎ মলিন হলো। চোখেমুখে আঁধার নামলো। গলার স্বর হলো গভীর।
“আমার মা বাবা মানুষটাকে অনেক ভালোবেসেছে। যাকে অন্ধ ভালোবাসা বলে। তাই বাবা যখন যা করেছে তখন সেসবে কিছু বলে নি। মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমরা তো তার সন্তান। বাবার জন্য আমাদের জীবনে কষ্ট হয়ত সে মেনে নিতে পারে নি। একদিন হঠাৎ আমার পরিকল্পনার কিছু অংশ মা শুনে ফেলে। সেদিন মা আমার কাছে আসে। মায়ের কাছে নিজের সমস্ত দুঃখ উগড়ে দিয়েছিলাম। মা সেদিন কেঁদেছিল। তবে, বলেছিল এবার থেকে সে আমার সঙ্গে আছে। সেও হয়ত বুঝে নিয়েছিল, অনেক তো হলো স্বার্থের জন্য যা ইচ্ছে তাই করা এবার বাবার থামা দরকার। তাই আমার সঙ্গ দিয়েছিল।”

এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা। হয়ত স্বচ্ছকে সময় দেওয়া উচিত। মায়ের জন্য তার মন ভার। আশেপাশে লোকজন কম। মাঝে মাঝে দুয়েকজন হেঁটে যাচ্ছে। ওভারব্রীজের রেলিংয়ে হাতে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে আছে স্বচ্ছ। হঠাৎ মোহ জানায়,
“তবে আপনি দুটো অন্যায় করেছেন।”

মাথা উঠিয়ে অবাক চোখে চাইল স্বচ্ছ। মোহ নিজ থেকেই বলল,
“আপনি একটা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে হঠাৎ বিয়ে ভেঙে দিলেন তাও মেয়েটার বাগদানের দিনে। এটা একদম ঠিক করেন নি। বিয়ে নিয়ে একটা মেয়ের অনেক স্বপ্ন থাকে।”

স্বচ্ছ নির্বিঘ্নে স্বীকার করল,
“হ্যাঁ, আমি জানি এটা আমি ঠিক করিনি। তার সঙ্গে এমনটা করতে চাইনি আমি। বাবা যদি আমাকে বুঝত তাহলে বিষয়টা এতদূর যেতোই না। তবে মিস অন্বেষা নিজে থেকে বুঝেছিল আমি তাকে পছন্দ করি না। কিন্তু হয়ত এই অপছন্দের বিষয়টা তার ইগো হার্ট করে। তাই সে মানা করেনি। সব বোঝার পরেও, আমার প্রতি তার আগ্রহ নেই জানার পরেও পুরো দমে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকল। অন্য মেয়ে হলে হয়ত তা করত না।”

“আপনি সত্যিই তাকে পছন্দ করতেন না বুঝি?”

মোহের মনে অন্বেষাকে নিয়ে বড়োসড়ো দ্বন্দ্ব ধরে ফেলল স্বচ্ছ। মেয়েরা বুঝি এতই ইনসিকিউর হয়? না চাইতেও স্বচ্ছের মুখে মৃদু হাসি চলে এলো যা মোহের টানা কাজল দেওয়া চোখ এড়ায় না। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“না মানে তাকে তো আমিও শপিংমলে দেখেছিলাম। যথেষ্ট সুন্দরী, স্মার্ট, সুইট ছিল।”

স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ প্রচণ্ড অনাগ্রহ দেখিয়ে বলল,
“কী জানি! বলতে পারছি না তার মাঝে কী ছিল। তার মাঝে আমি এতটা মিষ্টতা খুঁজে পাইনি যতটা আমি যার প্রেমে পড়েছি তার মাঝে পেয়েছি। সে তিক্ত মিষ্টি। অদ্ভুত তার টেস্ট।”

মোহের আর কোনো অভিযোগ নেই। সে সবটা জেনেছে, বুঝেছে। লোকটা শুধু তার কথা ভেবে এত কিছু করে গেল। তাকে কেন জানাল না? এত যাতনা দেওয়ার মানে কী ছিল? সে ফের জিজ্ঞেস করে,
“আপনার দ্বিতীয় অন্যায় হচ্ছে আপনি এতকিছু করে গেলেন আমাকে কেন জানালেন না? একবার তো জানাতে পারতেন।”

“জানাতে পারিনি। সবসময় বুঝতে পারতাম আমার খবর রাখছে বাবা। যদি কোনোরকমে বুঝে ফেলত তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে তাহলে কিছু করার আগে একবারও ভাবতেন না। যা করেছি নিজের মনের সংশয়ে।”

ঠাণ্ডা চুড়ি পরা হাতটি স্বচ্ছের হাতে রাখতেই চুড়ি সামান্য শব্দ করে উঠল। মোহের হাতের কোমলতা স্বচ্ছের হাতের রগগুলো ‌যেন টানটান করে তুলল৷ মোহ উৎসুক হয়ে বলে,
“এতকিছু করে গেলেন শুধু আমার নিরাপত্তার জন্য! কী করে পারলেন?”

“পারতে হয় মিস মোহ। তবে মানতে হবে, আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যতটা যন্ত্র/ণায় ছিলাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট তুমি আমাকে দিয়েছ!”

মোহ ড্যাপড্যাপ করে চেয়ে বলল,
“কী করে?”

“কী করে মানে? আমাকে কী বলেছিলে? বিয়ে করবে কিছুদিনের মধ্যে, দেরি করবে না। খুব শীঘ্রই সুখবর দিয়ে দেবে। মনে নেই এসব? তার সাথে ওই শৌভিকটার সঙ্গে তোমাকে দেখে তো…”

মোহ এবার শব্দ করেই হেসে উঠল মুখে হাত দিয়ে। তার হাসিতে যেন আরেক দফা জ্বলে উঠল স্বচ্ছ। মোহ হাসতে হাসতেই জবাব দিল,
“সে এখন আপনার বোনের বর হয়।”

“তখন কি এসব জানতাম? তুমিও তো জানাও নি। তুমি জানো আমি নিজেকে কীভাবে সামলেছি? মাথার র;ক্ত টগবগ করত মোহ। যেদিন তুমি হসপিটালে ভর্তি ছিলে সেখানে শৌভিক উপস্থিত ছিল সারারাতের জন্য। আমি ফারাহর সঙ্গে তোমায় রাতে দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি তো ঘুমের ঔষধের প্রভাবে ঠিকই ঘুমাচ্ছিলে। ঘুমটা কেঁড়ে নিয়েছিলে আমার। শৌভিককে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমার দুজন বন্ধুকে দিয়ে হসপিটালে শৌভিকের আশেপাশে থেকে সারারাত পাহারা দিয়ে নিয়েছিলাম। ওদের দেখতে বলেছিলাম যেন শৌভিক কী কী করছে সবটাতে নজর রাখে। মিনিটে মিনিটে কল লাগিয়েছি। যদিও এসব শৌভিক বুঝতে পারেনি।”

মোহ কপালে হাত চাপড়ে বলল,
“এতকিছু করেছেন আপনি?”

“শুধু কী তাই? শপিংমলে একসঙ্গে বিয়ের শপিং করতে দেখে সেদিন থেকে আমি একপ্রকার পাগল হয়ে গেলাম। শৌভিক তোমাকে শাড়ি পছন্দ করে দেওয়ায় আমি তোমাকে বিশ্রী লাগছে অবধি বলে ফেলেছিলাম। তারপর তো ঝামেলা বাঁধালে।”

মোহ কপাল কুঁচকে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে ওঠে,
“আমি ঝামেলা বাঁধিয়েছিলাম? আপনি নিজেকে নিষ্পাপ দাবি করেন কোন মুখে?”

স্বচ্ছ মেজাজ খারাপ করেই বলে,
“জানি না আমি। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। আরেকটা জিনিস আছে। দেখবে?”

“কী?”

স্বচ্ছ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। কাগজের অবস্থা খারাপ। কোথাও ছিঁড়ে গেছে আর দেখে মনে হচ্ছে দুমড়েমুচড়ে ফেলা হয়েছিল। স্বচ্ছ কাগজটা মেলে মোহকে দেখাল। মোহের সামনে প্রথমে অস্পষ্ট লাগলেও নিজের লেখা দুটো লাইন বুঝতে দেরি হলো না। চোখ বড়ো বড়ো করে অস্ফুটস্বরে বলতে লাগল,
“এই কাগজটা তো আমি…”

“ফেলে দিয়েছিলে। সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। তুমি এটা লিখে টেবিলে ঘুমাচ্ছিলে। তুমুল বৃষ্টিতে চোরের মতো তোমায় দেখতে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড অভিযোগ মনে রেখে হয়ত এটা ছুঁড়ে দিয়েছিলে। আমি তুলে নিয়েছি।”

মোহ কিছু বলার মতো অবস্থায় রইল না। মনে একটাই প্রশ্ন, এতটা উন্মাদ কেন এই মানুষটা? সে চোখ নামিয়ে বলে,
“আপনি প্রচণ্ড ছেলেমানুষ।”

“হ্যাঁ, তা তো বলবেই। তখনই তো বোধহয় শৌভিক কল দিয়েছিল তোমাকে। আমি সবটা শুনে ভেবেছিলাম…”

স্বচ্ছকে পুরো কথা শেষ করতে দিলো না মোহ। নিজের মতো করে বলল,
“আমি বিয়ে করছি তাই তো? তাই আপনি কিছু না ভেবেই শৌভিক ভাইকে রাস্তায় ধরে মা/রামারি করলেন। বিয়ে ছিল বেচারার। বোনের বরকে মে/রে পুরো ইতিহাস তৈরি করে দিলেন।”

“কী করতাম? আমাকে তোমরা কেউ কিছু জানাও নি। আমার বোনটাও কিছু বলেনি।”

মোহের মনে কৌতূহল জেগে উঠল। আচানক প্রশ্ন করে ফেলল,
“তাই বলে সত্যি যদি কেউ বিয়ে করতে আসে তাকে মা/রবেন?”

স্বচ্ছ সময় না নিয়েই দৃঢ় ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“কিছু ভাববো না মোহ। তাকে শেষ করেই দম নেব। আর তোমার মুখেও যেন এসব কথা না শুনি কখনো। তোমাকেও কিন্তু ছাড় দেব না।”

মোহ কিছু বলল না। হয়ত চুপ থাকাই উচিত। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস নিলো। নিজের ভেতরের রাগ ঝেড়ে বলল,
“এই কয়দিনে তুমি যে আমার মনকে কতবার হ/ত্যা করেছ তার হিসাব নেই মিস মোহ। তুমি নির্দয়া নারী!”

“আমি কেন আপনার প্রতি দয়াশীল হবো? আমার বিয়ের কথাতে কেন আপনার মন ব্যথিত হবে?”

স্বচ্ছ এবার ক্ষেপে উঠল। মেয়েটা এতদিনেও কিছু বোঝে নি? না বোঝার ভান করছে? মোহ নিজের প্রশ্ন করে চুপচাপ গাড়ি যাওয়া আসা দেখছে৷ স্বচ্ছ একপ্রকার ধমকেই বলে উঠল,
“এই মেয়ে, আমার ভালোবাসা তোমার চোখে পড়ে নি? নিজের সমস্ত কিছু দিয়ে কখন একটা পুরুষ একটা নারীকে আগলে রাখার চেষ্টা করে জানো না? একটা পুরুষ কখন নারীর জন্য হিংসায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায় তোমার জানা নেই? বাবার সামনে গলা উঁচিয়ে বলেছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি। আজ এখানে আমি তোমাকে গলা উঁচিয়ে বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

মোহ কিছু বলল না। পরিবর্তে শুধু মুচকি হাসল। তবে তার মনে উষ্ণ হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় মিশে আছে প্রণয়। কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে স্বচ্ছের স্বীকারোক্তি। আচানক মোহ স্বচ্ছের কলারে হাতে রেখে কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“এটাই জানার ছিল আমার। আপনি কখনো আপনার অনুভূতি আমার কাছে স্বীকার করেন নি। মুখে কখনো ভালোবাসি বলেন নি। আমি এটাই জানতে চেয়েছিলাম।”

স্বচ্ছের কলার থেকে হাত নামাতে চাইলে তার হাত দুটো ধরে ফেলে স্বচ্ছ। মোহের চোখে চোখ রেখে জানতে চায়,
“ভালোবাসা অনুভব করতে হয়। তুমি কি কখনো আহিয়ান স্বচ্ছের ভালোবাসা অনুভব করো নি? মুখে স্বীকারোক্তি না দিলে না দিলে ভালোবাসা হয় না?”

“অনুভব করেছি বলেই জানতে চেয়েছি। ভালোবাসা ইশারায়, চোখে চোখে, মনে মনে হয়। তবে একটা পুরুষ তখন নারীকে স্বীকার্য জানায় তখন সেই উষ্ণ অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই।”

স্বচ্ছের চোখমুখ ঝলমলিয়ে উঠল যেন। এরপর সে কোমল সে আবেদন জানাল,
“তবে আমিও সেই অনুভূতি বুঝতে চাই।”

মোহের হাসি সামান্য প্রসারিত হলো। সে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। কোনো জবাব না দিয়েই সে উল্টোদিকে হাঁটা ধরল। স্বচ্ছ পেছন থেকেই জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?”

মোহ কিছু বলল না। সে হেঁটে যাচ্ছে প্রায় সিঁড়ির কাছে। স্বচ্ছও দ্রুত হাঁটা ধরল মোহের নিকট যাওয়ার জন্য।

নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে অন্বেষা। বাড়ি আসার পরই সেই সে দরজা বন্ধ করেছে এখনো দরজা খোলে নি সে। প্রথমে সে ভাই এবং ভাবিকে বলেছিল সে কিছুক্ষণ একা থাকতে চায় তাকে যেন বিরক্ত না করা হয়। তার কথা মেনে কিছু সময় একা থাকতে দেওয়ার পরই টেনশনে পড়ে গেছেন নাহিয়ান। দরজা ক্রমাগত ধাক্কিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অন্বেষার ভাবি দরজা খুলতে অনুরোধ করছেন। নাহিয়ান চিল্লিয়ে বললেন,
“অন্বেষা তুমি দরজা খোলো। সাড়া দাও। আমাদের টেনশনে ফেলে দিও না। তোমার কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। একবার বেরিয়ে এসো। তারপর দেখো আমি ওই আহিয়ান স্বচ্ছের কী অবস্থা করি!”

অন্বেষার ভাবি চিন্তিত হয়ে বলেন,
“ওদের কথা তুমি ছাড়ো। আগে ভাবো অন্বেষাকে কী করে বের করবে। দরজা ভাঙতে হবে নাহলে। বেশি দেরি না হয়ে যায়।”

নাহিয়ান রাগে কটমট করে বলে,
“ওদের জন্য যদি আমার বোনের কিছু হয় তাহলে আমি এক চুল পরিমাণ ওদের ছাড় দেব না।”

দরজার লক খোলার শব্দ হয়। নাহিয়ান ও তার স্ত্রী বিচলিত হয়ে থাকে। অন্বেষা দরজা খোলে। তার মুখে আর ভারি সাজ নেই, গায়ে সুন্দর কাজ করা দামি পোশাক নেই। চুলটাতে টাওয়াল পেঁচানো। মুখটা চুপসানো। অন্বেষাকে ঠিকঠাক দেখেই তার বাহু ধরে বিচলিত হয়ে নাহিয়ান বলতে লাগে,
“এত টেনশন কেউ দেয়, অন্বেষা? একটা ছেলের জন্য তুমি তোমার ভাই ভাবিকে টেনশনে ফেলে দেবে? আমি আগেই বলেছিলাম ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিতে। তুমি কী করলে? দ্রুত এঙ্গেজমেন্ট সারতে চাইলে। পরিণতি দেখলে কী হলো?”

“টেনশন করতে কে বলেছে তোমাদের? আই নিড টাইম। আমি একা থাকতে চেয়েছিলাম তো।”

অন্বেষার ভাবি ব্যাকুল হয়ে বলেন,
“তোমার ভাইয়ের তো তোমার জন্য চিন্তা হবেই অন্বেষা। তাছাড়া তোমার সাথে যা হলো অন্য যেকোনো মেয়ের সঙ্গে তা হলে সেই মেয়েটা ভেঙে পড়বে।”

অন্বেষা ভাবির কথার প্রত্যুত্তর করল না। নাহিয়ান অন্বেষার গালে হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“তুমি ওই ছেলেটার জন্য একদম দুর্বল হয়ে পড়বে না। আই উইল ডিস্ট্রয় হিম অ্যান্ড হিজ ফ্যামিলি। আমাকে ওরা চেনে নি। এমন অবস্থা করব মাথা উঠাতে পারবে না। তোমার পায়ের সামনে এনে ফেলব ছেলেটাকে।”

অন্বেষা এবারও কিছুই বলল না। নিজের ঘরে চলে এলো। পেছন পেছন এলেন তার ভাইও। আবার বললেন,
“আমার উপর বিশ্বাস রাখো। তোমাকে অপমান করে ওরা ঠিক থাকবে না।”

অন্বেষা নিজের হাতে হেয়ার ড্রায়ার ধরল। টাওয়াল থেকে চুল খুলে হেয়ার ড্রায়ার চালিয়ে চুল শুকাতে শুকাতে বলল,
“এসবের কোনো দরকার নেই।”

নাহিয়ান কপাল কুঁচকালেন।
“মানে?”

অন্বেষা হেয়ার ড্রায়ার বন্ধ করে রেখে দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি এসব নিয়ে ঝামেলা চাই না। তোমাকে এসব কিছু করতে হবে না।”

নাহিয়ান হতবাক হলেন। অন্বেষাকে সে যতটা চেনে তাতে যেন এসব কথা তার সঙ্গে যায় না।
“তুমি এই কথা বলছ?”

“হ্যাঁ। প্রথমে ভেবেছিলাম আমি নিজে রিভেঞ্জ নেব। মিস্টার স্বচ্ছকে টিকতে দেব না। কিন্তু অনেক ভাবার পর বুঝলাম এসব করে কী পাব? সে কি আমার দিকে তাকাবে? জানো ভাইয়া, সে আমার দিকে ভালো করে চোখ তুলে কোনোদিন তাকায় নি। আমি তার চোখে ধরতে পারিনি। আমি প্রথমেই বুঝে নিয়েছিলাম তাকে আমি আকর্ষণ করতে পারিনি। আর এটাই হয়ে উঠল আমার জেদ। সবটা জেনেও আমি বিয়েটা ঠিক করতে বললাম। খুব চেষ্টা করলাম তার চোখে ধরার। কিন্তু বুঝিনি তার দৃষ্টি জুড়ে অন্যকেউ রয়েছে। দোষটা আমার।”

নাহিয়ান কিছু বলতে পারলেন না আর। পুরোপুরি নীরব হয়ে গেলেন। অন্বেষা আবারও বলল,
“আই রিয়েলাইজড দিস ফর দ্যা ফার্স্ট টাইম দ্যাট, ভুলটা আমার৷ তাই এসব নিয়ে তুমি কিছু করবে না, ভাইয়া।”

নাহিয়ান দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সম্মতি দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”

অন্বেষা বিছানায় পড়ে থাকা নিজের পোশাকটার দিকে তাকায়। সে স্বচ্ছের প্রেয়সীকে দেখতে চায়। একটিবার চোখের দেখা দেখে বুঝতে চায়, কোন নারীর জন্য সে স্বচ্ছের নজরে নিজেকে আনতে পারেনি। কতটা সুন্দর সে?
.

“আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি।”

স্বচ্ছের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় মোহ। জিজ্ঞেস করে,
“কোন প্রশ্ন?”

“তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা?”

মোহ আবার নীরব হয়ে যায়। গাড়ির বাহিরের দৃশ্য দেখতে থাকে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের খবর অনুযায়ী টিপটিপ বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। স্বচ্ছ গাড়ি ড্রাইভ করছে আর বারংবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তবে মোহের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে মোহের বাড়ির গলির সামনে গাড়িটা এসে থামাল স্বচ্ছ। মোহ গেট খুলে নামতে চাইলে দেখল গেট লকড। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল সে।
“গেট লকড কেন? খুলুন। দেরি হয়ে গেছে। বাড়ি যাব।”

“আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে আমি লক খুলতে পারব না। সরি।”

স্বচ্ছের সোজা কথা। মোহ নিজেকে শান্ত করে বলল,
“আচ্ছা আগে দরজার লক খুলুন। তারপর উত্তর দিচ্ছি।”

“আরে আগে উত্তর দাও। যদি উত্তর না দিয়ে চলে যাও?”

মোহও পাল্টা জবাব দিলো,
“যদি জবাব দেওয়ার পরেও দরজার লক না খোলেন তখন?”

মোহের কথার সাথে পারা মুশকিল। আফটার অল, মেয়ে মানুষ! হাফ ছেড়ে স্বচ্ছ দরজার লক খুলেই দিলো। মোহ তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতেই স্বচ্ছ খপ করে তার হাতখানা ধরে বলল,
“হোয়ার ইজ মাই এন্সার?”

মোহ আবারও না জানার ভান করে বলে,
“কীসের উত্তর?”

“তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা?”

মোহ জোর করেই নিজের হাত ছাড়ায়। মৃদু হাসি নিয়ে বলে,
“আপনি একটা বোকা।”

স্বচ্ছের কপাল ভাঁজ হয়ে গেল। চোখ ছোটো করে বলল,
“কেন?”

মোহ এগিয়ে আসে স্বচ্ছের পানে। তার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“একটা নারীর হাতে অনুমতি ব্যতীত যখন একটা পুরুষ চুম্বন করে আর সেই নারী কখন তার কোনোরূপ প্রতিবাদ করে না জানেন? যখন সেই নারী তাকে ভালোবাসে।”

চলবে…