যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
21

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩১ [দ্বিতীয় খণ্ড]

থা/প্পড় খাওয়ার পর কিছুটা বিস্ময়ের মাঝেই ছিল স্বচ্ছ। মোহের শান্ত দৃষ্টি তখন তার দিকে। বেশ জোরেশোরেই মে/রেছে সে। মোহ এগিয়ে গিয়ে স্বচ্ছের সেই গালে হাত রেখে বলল,
“আমি ওসব যোগ্যতা, অযোগ্যতার ছক কষতে বসিনি। ওসব মেপে আমার কাজ নেই। আমি আপনার পাশে থাকতে চাই এটা আমার শেষ কথা!”

স্বচ্ছের দাড়ি ভর্তি গালের উপর থেকে হাত সরায় মোহ। শক্ত গলায় বলে,
“সিগারেট খাওয়ার জন্য মা/রিনি। যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটা পুরুষ যখন একটা নারীর সঙ্গে এতদিন চুটিয়ে প্রেম করে এরপর সে যখন বলে সে নারীর যোগ্য নয়। তখন তাকে একটা নয় দশটা থা/প্পড় দেওয়া উচিত। নেহাৎ আমি নরম মানুষ। তাই একটাই মে/রেছি। জোরে লেগেছে?”

স্বচ্ছ মোহের দিকে কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। তার দৃষ্টি নির্জীব। ক্লান্তিতে ভরা। ম্লান চোখমুখের দিকে একনাগাড়ে চেয়েও থাকতে পারছে না মোহ। মানুষটার এত প্রচেষ্টা শুধু এবং শুধু তার জন্য। হঠাৎ স্বচ্ছ আবদার করে বসে,
“আমাকে একটু সময় দিবে? আমার সঙ্গে কোথাও বসবে?”

মোহ কোনো প্রত্যুত্তর করে না। শুধু স্বচ্ছের কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি ধরে তাকে টেনে হাঁটতে আরম্ভ করে। ধীর পায়ে যেতে যেতে মোহ শুধায়,
“এইযে আমাকে এড়িয়ে চলছিলেন। সারাজীবন এড়িয়ে চলতে পারবেন?”

স্বচ্ছ ঠাণ্ডা সুরে বলে ওঠে,
“তুমি উত্তরটা জানো।”

“আমার জানাতে ভুলও থাকতে পারে।”

স্বচ্ছ হাঁটা থামায়। কণ্ঠস্বর শক্ত হয়।
“তার মানে তুমি আমার অনুভূতি নিয়ে সন্দেহ করছ?”

“সেই সন্দেহটা আপনি হতে দিলেন কেন? আমার চিন্তার মোটেও কদর করেন না আপনি।”

স্বচ্ছের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। বিষণ্নচিত্তে বলে,
“প্রতিদিন কল করে তোমাকে একই বাণী শোনাতে আমি পারছিলাম না। আমি জানি তুমি প্রতিদিন আশা নিয়ে বসে থাকো। সেই মিষ্টি আশা ভাঙতে ভাঙতে আমি নিজেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলাম।”

মোহের মাঝে হেলদোল হলো না। শুধু ভাবল, মানুষটা তার জন্য এত ভাবে কেন? মৃদু হাসল সে এবং বলে উঠল,
“আমি জীবনে যতকিছু দেখেছি, সয়েছি এসবের পরে আমার আশাগুলো বড্ড কঠিনভাবে জমা হয়েছে। ওরা সহজে ভাঙে না। ততক্ষণ আশা আলো ফুটিয়ে রাখে যতক্ষণ না তা পূরণ হয়। আপনার মিস মোহকে এতটা দুর্বল মনে হয়?”

স্বচ্ছ উল্টো উত্তরে নীরব থাকল। আকাশ কেমন ছলকে উঠছে। চাঁদকে আবৃত করে এলোমেলো হয়ে বেড়াচ্ছে কালো মেঘ ঠিক স্বচ্ছের জীবনের কালো মেঘের মতো। চাঁদ নিজের শোভা দেখাতে পারছে না ঠিক স্বচ্ছের জীবনের মতো। সামনে একটা মুদি দোকানের নিচে ছাউনির নিচে বেঞ্চ দেখে বসে সেখানে ধপ করে বসে গেল স্বচ্ছ। খুব শান্ত সুরে মোহের কাছে আবদার করল,
“আমার পাশে বসো।”

মোহ বসে। টিপটিপ করে করে বর্ষাধারা আরম্ভ হতে লাগল। রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা কম হতে শুরু করল। তারা বসেই রইল সেই বেঞ্চে। মোহ বলে,
“উত্থান আর পতন দুটোই জীবনের অংশ, স্বচ্ছ। আপনি যদি উত্থানকে বরণ করে নিতে পারেন তবে তার সহোদর পতনকেও মেনে নিতে হবে। জীবনে যখনই খারাপ সময় আসবে তখন আপনি আপনার আশেপাশে তাকাবেন আর দেখবেন আপনার পাশে কারা আছে? আপনার মা, ভাই-বোন আর আমিও আছি। তবুও কেন আপনি নিজেকে অন্ধকারে ঠেলছেন? ইউ আর দ্যা লাকি ম্যান!”

স্বচ্ছ মোহের দুটো হাতে হাত রাখে। কোমল, শীতল হাত দুটো নিজের হাতে গুজে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার গাল দুটোর কাছে স্পর্শ করিয়ে বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ। ততক্ষণে খানিকটা জোরে বৃষ্টি এসেছে। স্বচ্ছের টনক নড়ে না। বৃষ্টি বেশিক্ষণ হলো না। মিনিট দুয়েক জোরে বর্ষণের পরপরই কমতে লাগল। স্বচ্ছ মোহের হাত দুটিকে রেহাই দিলো তখন। নিজের চোখ মেলে মোহের দিকে প্রশান্তির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“ইটস অ্যা ম্যাজিকাল টাচ ফর মি!”

মোহ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়। স্বচ্ছ ফের বলে,
“তোমার কণ্ঠস্বর আর স্পর্শ দুটোই আমার উপর জাদুর মতো কাজ করে। আমি উপলব্ধি করেছি আমি ভুল করছিলাম।”

আস্তে করে মোহের মুখে দারুণ উজ্জ্বল হাসি ফুটে ওঠে। ঠিক যেন কোনো ফুল ফুটে গেল! ঝলমলে সেই হাসির কারণ এই একজন পুরুষই। স্বচ্ছ মোহের ডান গালে হাত রেখে সামান্য টেনে ধীর গলায় বলে,
“আই এম স্যরি মাই ডিয়ার।”

মোহ স্বচ্ছের হাত নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে। তবে এটাই যেন শেষবার হয়। এই ভুল যেন রিপিট না হয়। নয়ত কতটা নিষ্ঠুর আমিও হতে পারি দেখতে পাবেন। এখন আমি আসছি।”

স্বচ্ছও দাঁড়িয়ে পড়ে। মোহ ততক্ষণে ছাউনি থেকে বেরিয়ে হনহনিয়ে টিপটিপ বৃষ্টিতে হাঁটতে আরম্ভ করেছে। স্বচ্ছ পিছু ডেকে বলে,
“আরে দাঁড়াও! বাইকটা নিয়ে আসি। বাড়িতে ছেড়ে দিই।”

মোহ ফিরে তাকায়। উত্তর করে,
“কোনো দরকার নেই। মা জানে, আমি বাজারে এসেছি ইথানের দরকারী জিনিস কিনতে। তাছাড়া আমি সিগারেটখোর লোকজনের সাথে চলাফেরা করিনা।”

ভ্রু কুঁচকায় স্বচ্ছ। আহাম্মকের ন্যায় শুধায়,
“মানে কী?”

“মানে একটাই। সোজা কথার মেয়ে আমি। আমি সিগারেট পছন্দ করিনা। তাই সিগারেটখোর লোকের সঙ্গে বিয়েশাদি করতে পারব না। কাছে গেলেই রোমান্টিক ফিল হবার আগে সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ নাকে এসে ঠেকবে আর সব অনুভূতির দফারফা হবে। সিগারেট একবারে ফেলে দিতে পারলেই বিয়ের কথা ভাববেন!”

কথা শেষ হলো স্বচ্ছকে আর সুযোগ না দিয়েই ফাঁকা অটো পেয়ে তাতে উঠে গেল মোহ। গাড়ি থেকে মাথা বের স্বচ্ছের বোকা বোকা মুখখানা দেখে গাড়ির ভেতরে সোজা হয়ে বসে হাসতে আরম্ভ করল সে।

আজ কোর্টের রায় দেওয়ার দিন। সরোয়ার সাহেব কাঠগড়ায় ছিলেন। কামাল নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। এছাড়াও উনার জানা সরোয়ার সাহেবের সমস্ত অপকর্মের কথা জানিয়েছেন। সরোয়ার সাহেবের বিপরীতের আইনজীবী সকল প্রমাণ পেশ করেছেন। তবে এতদিন যার এত উদ্ধত দেখা গেছে তিনি নিশ্চুপ। উনার পক্ষে কোনো আইনজীবী অবধি নেই। বিচারক জানতে চেয়েছিলেন সরোয়ার সাহেবের মন্তব্য তবে তিনি আজ নিরপক্ষ। সরোয়ার সাহেব পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে,
“আমার নিজের পক্ষ থেকে কিছুই বলার নেই।”

অহমবোধ এবং নিজের ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে যাওয়া লোকটি আজ নিজের গা বাঁচাতে চান না। নিজেকে অন্ধকারে রেখেই যেন সুখ খুঁজে পান। বিচারক রায় দিলেন। দীর্ঘ কয়েক বছরের কারাদণ্ড হলো সরোয়ার সাহেবের। সেসময় উনার দুচোখ খুঁজছিল অন্যকিছু। উনার নিজের র;ক্তের ছেলেদের খুঁজেছিলেন তিনি। তবে এতে হতাশা ছাড়া কিছু খুঁজে পেলেন না। কারণ স্বচ্ছ ও সৌমিত্র অনুপস্থিত!

গুটিকয়েক পুলিশ ধরে সরোয়ার সাহেবকে নিয়ে কোর্ট থেকে বের হলেন। বাইরের পরিবেশে তখন কিছু সাধারণ জনগন উপস্থিত ছিলো। সরোয়ার সাহেবকে দেখা মাত্র সকলে উনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে আরম্ভ করল। সকলে ‘হায় হায়’ করতে লাগল। সেসব যেন কানে ঢুকেও ঢুকছে না সরোয়ার সাহেবের। তিনি এক নিস্ক্রিয় জীবের মতো শুধু যেন দুটো পা-ই চালাচ্ছেন।

উনাকে গাড়িতে তোলা হলো। গাড়ির ফাঁকা অংশ দিয়ে হঠাৎ তিনি দেখলেন চেনা দুটো মুখ। উৎসুক হয়ে উঠলেন তিনি। স্বচ্ছ ও সৌমিত্র পুলিশের সঙ্গে কথা বলে সরোয়ার সাহেবের সামনে এলো। সরোয়ার সাহেবের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে দুটো ছেলের মুখ! তিনি ভেবেছিলেন তাদের ঘৃণা এতটাই বেড়েছে যে এই জন্মে তারা আর এই বাপের মুখোমুখি হবে না। সৌমিত্র এগিয়ে এসেই কোনোরকম দ্বিধা না করেই জিজ্ঞেস করল,
“বাবা কেমন আছো?”

সরোয়ার সাহেব ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন,
“ভালো আছি এখন। চিন্তামুক্ত! মাথায় কোনো দায়ভার নেই।”

অতঃপর তিনি স্বচ্ছের পানে তাকালেন। তিনি জানেন, সৌমিত্র ভোলাভালা ছেলে। মনে কোনো সংকোচ নেই। কথা বলতে ছেলেটা কোনো দ্বিধায় পড়বে না। কিন্তু স্বচ্ছের মনটা শক্ত। যতটা সে ভালো ততটাই নিষ্ঠুর হয়ে যায় সময়ে সময়ে। ছেলেটা উনার সঙ্গে মেপে কথা বলবেন তিনি জানেন। তাই তিনি নিজেই ডাকলেন,
“স্বচ্ছ!”

অবশেষে স্বচ্ছ মুখ খুলল। ঢক গিলে নিজের কণ্ঠস্বরের কঠোরতা বজায় রেখে বলল,
“কেমন লাগছে নিজের তৈরি করা এই অন্ধকার জীবন, মন্ত্রী সাহেব?”

সরোয়ার সাহেব এই প্রশ্নের জবাবে কী বলবেন তা খুঁজে পেলেন না। স্বচ্ছ উনার পানে চেয়ে মেলানোর চেষ্টা করছে সেই আগের সরোয়ার সাহেবের চেহারা। সেই মুখটা কেমন অচেনা! শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। গাড়ির ফাঁকা একটুখানি জায়গা থেকে মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে। সরোয়ার সাহেব ভাঙা গলায় জানতে চাইলেন,
“তোমার মা আর ফারাহ কেমন আছে?”

“ফারাহ ভালো আছে। মাও বাহিরে থেকে ভালো আছে। কিন্তু ভেতরে থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছেন।”

সরোয়ার সাহেব চুপ করলেন। পুলিশ তাড়া দিলো। দ্রুত গাড়ি ছাড়বে। হাতে সময় নেই। স্বচ্ছ নিজের হাতের ফাইলটা দেখিয়ে বলে উঠল,
“চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি। মা বলে, ভালো কাজের সময় মা-বাবা উভয়ের দোয়া দরকার। আপনি কি দোয়া করবেন?”

“আমি যদি দোয়া করি তাহলে তুমি বিশ্বাস করবে, স্বচ্ছ?”

কেমন শান্ত কণ্ঠস্বর সরোয়ার সাহেবের। স্বচ্ছ হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
“এতগুলো দিনে বহু ইন্টারভিউ দিয়েছি। কেউ আমায় গ্রহণ করেনি। কেন জানেন? কারণ আপনার ছেলে।”

সরোয়ার সাহেব তপ্ত নিশ্বাস ফেললেন। এটা উনার বুকে তীব্র আঘাত ফেলল। উনি উনার নিজের ছেলের ক্যারিয়ারে বাঁধা! এই ট্যাগ স্বচ্ছ কী করে মুছবে? সরোয়ার সাহেব বললেন,
“আই এম স্যরি, স্বচ্ছ।”

“আশা করব কখনো আপনি এক অন্য সরোয়ার সাহের হয়ে আমাদের মাঝে ফিরবেন। সেই সরোয়ার সাহেরের মাঝে কোনো অন্যায়, অপ/রাধমূলক চিন্তাধারা থাকবে না।”

গাড়ি ছেড়ে দিলো। সরোয়ার সাহেবের থেকে উনার ছেলেগুলো দূরে যেতে থাকল। সৌমিত্র চিল্লিয়ে বলল,
“মাঝে মাঝে দেখা করব কিন্তু বাবা।”

স্বচ্ছের মুখ থেকে বাবা শব্দ বের হলো না। তবে তার মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু ‘বাবা’ শব্দটাই বাজছে। বাবার সঙ্গে আগের সুন্দর স্মৃতি তাজা হচ্ছে।

মনে প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে তীব্র গরমের মধ্যে ইন্টারভিউয়ের জন্য উপস্থিত হলো স্বচ্ছ। কয়দিনের ব্যবধানে তার শরীরের রঙটা আগের থেকে শ্যামলা হয়ে গিয়েছে। তার মনে কোনো আশা নেই। সে জানে এবারও হয়ত তাকে একই কারণে অপদস্ত করা হবে। অপমানগুলো সয়ে কী করে চুপ থাকবে কোনোরকম সিনক্রিয়েট না করে সেটাই ভাবছে স্বচ্ছ। তাছাড়া কোম্পানিটা নতুন। তার চাকরিটা ট্রান্সলেটরের। মেইন ট্রান্সলেটরের পদ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। স্বচ্ছ বিদেশ যাওয়ার জন্য চারটি ভাষা শিখেছিল। তার মাঝে ইংলিশ, ইতালিয়ান অন্যতম। পরবর্তীতে স্বচ্ছ নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবং দেশেই থেকে যায় নিজ ইচ্ছাতে।

অবশেষে তার ডাক পড়ল। না চাইতেও প্রতিবারের মতো হাজির হতে হলো দুজন ভদ্রলোকের সামনে। তবে উনারা কেউই কোম্পানির মালিক নন। স্বচ্ছ চেয়ারে বসল। তার পরিচয় জানতে চাওয়া হলো। স্বচ্ছ বেশ ভালোভাবে নিজের পরিচয় দিলো। উনারা স্বচ্ছের ফাইল এবং বাকি সার্টিফিকেট চেক করলেন। তাদের মধ্যে একজন ভদ্রলোক জানতে চাইলেন,
“লিস্টে যেই চারটি ভাষা দেওয়া আছে সব ভাষা কি আদেও জানা আপনার?”

স্বচ্ছ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ইয়েস।”

আরেকজন জানতে চাইলেন,
“আপনার অন্য কোথাও কাজ করার এক্সপেরিয়েন্স আছে?”

“নো স্যার।”

“কিন্তু আমাদের এক্সপেরিয়েন্সড কাউকে প্রয়োজন।”

স্বচ্ছ ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দেয়,
“তার জন্য তো কাজের সুযোগ দিতে হবে। সবাই এক্সপেরিয়েন্সড কাউকে খোঁজে। কিন্তু কেউ সুযোগ না দিলে অভিজ্ঞতা অর্জিত হবে কী করে?”

টেবিলের ওপারে বসা ভদ্রলোক দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলেন। বুঝলেন, ছেলেটার কমন সেন্স আছে বটে। এমন চটপটে কাউকে লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া উচিত নয়। এরপর উনারা কোম্পানি বিষয়ক আরো প্রশ্ন করলেন স্বচ্ছকে। যার কারণে প্রচণ্ড বিস্মিত হলো স্বচ্ছ। এই প্রথম তার সাথে এমনটা ঘটছে। সবটা যেন জাদুর মতো ঘটে যাচ্ছে। উনারা একবারও প্রশ্ন তুললেন না স্বচ্ছের পরিচয় সম্পর্কে। শুধু বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে স্বচ্ছের সঙ্গে দুজন উঠে দাঁড়ালেন আর একজন বললেন,
“আপনাকে আমরা বাদ দিতে পারছি না আবার ফাইনালও করতে পারছি না। লিস্টে আরো অনেকে আছেন। অপেক্ষা করুন। আজকে সন্ধ্যার মাঝে আমরা ইমেইল পাঠানোর চেষ্টা করব।”

স্বচ্ছ অপ্রস্তুত হেসে ছোটো করে বলল,
“থ্যাংক ইউ।”

বাইরে এসেও কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল স্বচ্ছ। এমন ইন্টারভিউ যেন অবিশ্বাস্য! তার শরীর এখনো কাঁপছে উত্তেজনায়। মোহকে কি কল করে জানানো উচিত? তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছ ঠিক করল যদি চাকরিটা পায় তবে সামনাসামনিই জানাবে।

স্বচ্ছ বিল্ডিং থেকে একবারে বাইরে সামনে ছোটো গার্ডেনে চলে এলো। পাশেই পার্কিংয়ে তখন গাড়ি পার্ক করা হচ্ছে। গাড়ি থেকে নামে এক আধুনিকা। সুন্দর পোশাক পরিহিতা নারী। মাথায় সানগ্লাস আটকে রাখা। স্বচ্ছের নজর আঁটকে গেল। অন্বেষা নিজের হাতের উপরের দিকে আঁটকে যাওয়া চেইনের ঘড়ি ঝাড়া দিয়ে নিচে নামাতে নামাতে গার্ডেনের দিকে এলো অফিস বিল্ডিংয়ে ঢুকতে। স্বচ্ছের সামনাসামনি হলো অন্বেষা। মেয়েটি বেশি স্বাভাবিকভাবেই শুধাল,
“হাউ ওয়াজ ইউর ইন্টারভিউ মিস্টার স্বচ্ছ?”

স্বচ্ছ আরেক দফা চমকায়। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“আপনি?”

“কোম্পানি আমার। সেভেন্টি পার্সেন্ট শেয়ারহোল্ডার আমি। তবে আমার এখানে থাকা কি অ্যাবনরমাল?”

স্বচ্ছ কিছুটা ধাক্কা খেল। সে এটা একদমই আশা করেনি। নিজের শুকানো ঠোঁট ভিজিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“ওহ, স্যরি। আমার জানা ছিল না।”

অন্বেষা স্মিত হেসে বলল,
“কিন্তু আমার জানা ছিল। যে আপনি এখানে ইন্টারভিউ দিতে আসবেন। প্রত্যেক ক্যান্ডিডেটের প্রোফাইল দেখছিলাম গতরাতে। আপনার প্রোফাইলও দেখলাম। ভেরি নাইস!”

স্বচ্ছ খানিকটা বিব্রতবোধ করল। সে এখনো ভাবে সে এই মেয়েটিকে ঠকিয়েছে। মাথা তুলে সে দাঁড়াতে পারে না। এক্ষেত্রে সে অবশ্যই অপ/রাধী। স্বচ্ছের নীরবতা দেখে অন্বেষা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“দিস কোম্পানি ইজ নিউ। নিজের কিছু করার ইচ্ছে ছিল আমার। চেষ্টা করছি। আমি ট্যালেন্ট আর যোগ্য মানুষ চাই। সেটা হোক, আপনি কিংবা অন্যকেউ।”

স্বচ্ছ আরো কিছুটা সময় ভেবে আচানক জিজ্ঞেস করল,
“আজ পর্যন্ত আমি কোথাও সঠিকভাবে ইন্টারভিউ দিতে পারিনি। এই প্রথম পারলাম। এতে কি আপনার কোনো ক্রেডিট আছে?”

দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে রইল অন্বেষা। সত্যিটা বলা উচিত কি উচিত নয় সেটা ভাবতে থাকল। আর বেশি চিন্তা না করে বলে ফেলল,
“ইয়েস। ঘটনা দুদিন আগের। তখন আমি অন্য এক কোম্পানির সিইও এর সাথে মিটিংয়ে গেছিলাম। আপনি হয়ত সেই কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন। বাহিরে এসে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন হয়ত। আই নো ইটস ব্যাড ম্যানার্স। বাট আমি আপনার কথা শুনে ফেলেছি। এটা জেনে গেছিলাম যে কোনো কোম্পানি আপনার ইন্টারভিউ নিতেই চাইছে না। এরপর যখন আপনার প্রোফাইল দেখলাম তখন আমি ম্যানেজার কল করে পরিস্কার করে বলেছিলাম সবার ইন্টারভিউ যেন সমানভাবে হয়। মানুষটা যে-ই হোক না কেন! ডাজ নট ম্যাটার।”

স্বচ্ছ নিজের ধারণা থেকে নিশ্চিত হলো। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে জানালো,
“আমাকে পরবর্তীতে কোনোরকম সাহায্য করবেন না প্লিজ, মিস অন্বেষা৷ ইটস মাই রিকুয়েষ্ট!”

স্বচ্ছ অন্বেষার পাশ কাটিয়ে হনহনিয়ে চলে যেতে আরম্ভ করল। তবুও পিছু ডেকে বসল অন্বেষা। নজরকাঁড়া হাসি দিয়ে বলল,
“ও হ্যালো! আমি কোনো হেল্প করিনি। যা করেছি আমার কোম্পানির ভালোর জন্য করেছি। আপনি যদি সত্যি যোগ্য হয়ে থাকেন আর আপনার ইন্টারভিউ না নিয়ে বের করে দিলে লস তো আমারই। অন্বেষা যা করেছে নিজের প্রয়োজনে করেছে। এতে আপনার হেল্প হলো কিনা সেটা জানার আমার প্রয়োজন নেই।”

“ওকে, দেন! থ্যাংকস।”

অন্বেষার হাসি প্রগাঢ় হলো। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সহিত বলল,
“অন্বেষা ইজ ডিফরেন্ট। সে অন্যদের মতো নয়। সেটা সে প্রতি পদে পদে প্রুভ করতে ভালোবাসে।”

অন্বেষা নিজের কথা শেষে বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে গেল। স্বচ্ছ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে নিজের মস্তিষ্ক চিন্তায় ওলটপালট করে ফেলল।

দোতালায় নিজের কেবিনে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁচের গ্লাস ভেদ করে স্বচ্ছের যাওয়া দেখছে অন্বেষা৷ তার দৃষ্টিতে কোনো ক্ষোভ নেই, ক্রোধ নেই৷ শুধু রয়েছে কৌতূহল। সীমাহীন জানতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। একটা মানুষ কী করে এতটা ভালোবাসতে আরেক মানুষকে তা বুঝতে চায় সে। অন্বেষা জানে, মূলত মোহকে পেতেই চাকরির জন্য মরিয়া ছিল স্বচ্ছ। সে খবর নিয়েছিল স্বচ্ছের। নিজে নিজে সে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,
“আই হ্যাভ নেভার সিন এনিওয়ান লাইক হিম হু লাভস্ সামওয়ান দ্যাট মাচ!”

গতকাল থেকে স্বচ্ছের খোঁজ নেই। আজকেও বিকাল হয়ে এসেছে। মোহ সবে ইথানকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। স্বচ্ছ কাল থেকে ফোন কল রিসিভ করছে না। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে মোহের। ফ্যানের নিচে বসেও যেন দাউদাউ করে জ্বলছে মাথার ভেতরটা৷ মাথার চুল থেকে ওড়না সরিয়ে ফোনটা নিয়ে ফের কল করল স্বচ্ছকে। কল বেজে গেল তবে রিসিভ করল না। ফোনটা বিছানার অন্যপাশে ছুঁড়ে ফেলল মোহ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এবার পাঁচটা থা/প্পড়ের মে/রে আসব গাধা লোকটাকে। এরপর যদি আমি আর জীবনে উনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তবে আমার নামও মোহ নয়।”

মোহের ঘরে মিসেস সুফিয়া এলেন। ইথানের জন্য এক বাটি নুডুলস রেখে বললেন,
“আজ আবার স্বচ্ছের মা আসার কথা। কোথাও হুটহাট বাহিরে বেরিয়ে যাস না যেন।”

মোহ গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললেন,
“কেন? মানে হঠাৎ আসছেন কেন উনি? কোনো বিশেষ কারণ আছে?”

“তা তো আসলেই জানতে পারবি। চোখমুখ ধুয়ে একটু ভালো মতো পরিপাটি হয়ে থাক দেখি৷ ভূতের মতো চেহারা বানিয়ে রাখিস সবসময়!”

মোহ পাত্তা দিলো না মায়ের কথায়৷ বাড়ির কলিংবেলটা বাজলো। মিসেস সুফিয়া দ্রুত গেলেন দরজার দিকে। ঘরে ইথানের জামাকাপড় পাল্টে দিতে লাগল মোহ।

দরজা খুলেই প্রথমে স্বচ্ছকে দেখে কিছুটা চমক পেলেন মিসেস সুফিয়া। স্বচ্ছ সালাম দিলো। মিসেস সুফিয়া সালাম গ্রহণ করে শুধালেন,
“তোমার না মা আসার কথা? তুমি আসার কথা বলেনি তো।”

স্বচ্ছ স্মিত হয়ে বলে উঠল,
“আমার এত বলে কয়ে আসতে হবে নাকি আন্টি?”

মিসেস সুফিয়া ভ্রু কুঁচকে রইলেন ছেলেটার দিকে। অতঃপর বললেন,
“এসো ভেতরে।”

দরজায় দাঁড়িয়েই হঠাৎ করেই মিসেস সুফিয়ার সামনে গোলাপ তুলে ধরল স্বচ্ছ। এই মুহূর্তের জন্য যেন প্রস্তুতই ছিলেন না মিসেস সুফিয়া। ভরকে তাকালেন তিনি। চক্ষু চড়কগাছ হলো। এক গাল মিষ্টি হাসি দিয়ে স্বচ্ছ বলল,
“প্রেমিকাকে পটানোর আগে বিয়ের জন্য তার মা-বাবাকে রাজি করানো দরকার। তাই ভাবলাম গোলাপটা আপনার মেয়ের জন্য নয় আপনার জন্যই নিয়ে আসি। সবাই তো প্রেমিকাকে উপহার দেয় ফুল বাট আহিয়ান স্বচ্ছ ইজ ইন অ্যানাদার লেভেল!”

হাসিটা আরো প্রশস্ত করে খুবই নিষ্পাপ একখানা চাহনি দিয়ে ফের স্বচ্ছ বলল,
“আমাকে আপনার একমাত্র কন্যার জামাই হিসেবে মেনে নিবেন আন্টি?”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২ [দ্বিতীয় খণ্ড]

স্বচ্ছের প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন মিসেস সুফিয়া। তারপর স্বচ্ছ নির্লজ্জের মতো আবদার করল,
“ফুলটা গ্রহণ করে আমাকে জামাই বলে মেনে নিন প্লিজ, আন্টি!”

এমন লাগাম ছাড়া কথা শুনে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলেন মিসেস সুফিয়া। গলা খাঁকারি দিয়ে দরজার পাশ থেকে সরে গিয়ে কঠিন সুরে বললেন,
” ছি, ছি। আজকালকার ছেলেপেলে এমন লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছে ভাবা যায়না! আমাদের সময়ে আমাদের অভিভাবকরা আমাদের হয়ে প্রস্তাব দিতো। আমরা সব মুখ বুঁজে মেনে নিতাম। এখনকার ছেলেপেলের এ কী অবস্থা!”

অতঃপর স্বচ্ছের পানে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন মিসেস সুফিয়া। কড়া গলায় আদেশ করলেন,
“ভেতরে এসে বসো।”

স্বচ্ছ ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,
“ইশশ… নিজের অভিভাবকদের এত কষ্ট দিতেন আপনারা? আমরা মা-বাবাকে এত কষ্ট দিতে চাইনা বলে নিজেরটা নিজে সেটেল করে নিই।”

একটু থেমে স্বচ্ছ ফের জিজ্ঞেসা করল,
“আচ্ছা, আন্টি! মোহের এই কথায় কথায় চোখ রাঙানোর বিষয়টা আপনার থেকে পেয়েছে তাই না বলুন? আপনার মেয়েটাও আপনার মতো চোখ রাঙায় কথায় কথায় জানেন?”

হতভম্ব হলেন মিসেস সুফিয়া। ছেলেটা তো ভারী দুষ্টু! সেসময় মিসেস জেবা এলেন। মৃদু হেসে বললেন,
“এসব কী কথা বলছ স্বচ্ছ? চুপ করো!”

স্বচ্ছ দমে না। ফের নির্লিপ্ত হয়ে মিসেস সুফিয়ার দিকে গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনি কিন্তু এখনো আমার গোলাপ নিলেন না। এভাবে আমার হৃদয় ব্যথিত করবেন না। আজ আপনার ছেলে থাকলে তার হাত থেকে ফুল নিতেন না?”

মিসেস জেবা নিজের হাসি প্রসারিত করে মিসেস সুফিয়াকে সাধলেন,
“নিয়ে নিন ফুলটা। ও আপনার জন্যই ফুলটা কিনেছে৷”

অবশেষে গোলাপটি হাতে নিলেন মিসেস সুফিয়া। হাসি পাচ্ছে উনার। তবুও মুখে কঠোরতা বজায় রেখেছেন। অতঃপর বললেন,
“মোহের বাবা এখনো আসেনি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে। তারপর না হয় বিয়ে নিয়ে আলোচনা হবে। ততক্ষণ শরবত বা চায়ের ব্যবস্থা করি।”

মিসেস জেবা ভদ্রতার সহিত বললেন,
“আচ্ছা ব্যস্ত হবেন না।”

বসার ঘরে চেনা পরিচিত কণ্ঠ কর্ণগোচর হলো মোহের। সবে হাত-মুখ ধুয়ে ভেজা চোখমুখ মুছতে ব্যস্ত ছিল সে। টাওয়াল রেখে ভ্রু কুঁচকে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতেই পিলে চমকে উঠল তার। চোখজোড়া কপালে উঠে গেছে যেন স্বচ্ছকে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের মতো জ্বলে উঠল সে। এখনো স্বচ্ছ তার কল মেসেজ কোনোটার উত্তর দেয়নি। অথচ নাচতে নাচতে তার বাড়িতে চলে এসেছে? এটা মোহ মানতে পারল না।

আচানক স্বচ্ছের ফোনে কল আসে ফারাহর। সেও মোহের বাড়ি আসবে কিন্তু চিনতে পারছে না। তাকে আনতেই বাড়ি কিছু সময়ের জন্য আবার বের হয় স্বচ্ছ। তখনি মোহ বসার ঘরে আসে। মিসেস জেবা তার দিকে তাকালে সালাম দিতেই তিনি মোহকে শুধালেন,
“কেমন আছো?”

মোহ মাথা নাড়িয়ে ভদ্রতার সহিত উত্তর দিলো,
“জি, ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো আছি।”

মোহ আর দুয়েকটা কথা বলে দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে গেল। তখন তার মা শরবত বানাতে মগ্ন প্রায়। উনাকে তাড়া দিয়ে মোহ বলল,
“আন্টি ওখানে একা বসে আছে। আর তুমি চা বানাচ্ছো? যাও তো ওখানে। আমি বানাচ্ছি শরবত।”

“কিন্তু শরবতের সাথে তো আরো কিছু ফল কাটতে হবে।”

মোহ অধৈর্য হয়ে বলে,
“সব করে দিচ্ছি। তুমি ওদিকে যাও।”

মিসেস সুফিয়াকে একপ্রকার জোর করেই স্বচ্ছের মায়ের কাছে পাঠালো মোহ। এরপর লেগে পড়ল কাজে। একটা আলাদা গ্লাস বের করে সেখানে স্বচ্ছের জন্য ভালো করে শরবত বানিয়ে নিলো সে। শরবতের উপকরণ হিসেবে থাকল সীমাহীন লবণ আর সামান্য মরিচ গুঁড়ো। তার একমাত্র লক্ষ্য শরবতের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়া। তার মতে, যার অন্যের চিন্তার কোনো দাম নেই তাকে এই শাস্তি দেওয়া বাধ্যতামূলক।

মিনিট দশেক পরে আজহার সাহেব ফিরলেন বাড়িতে। পরপর ফারাহকে নিয়ে এলো স্বচ্ছ। পেছন পেছন কোত্থেকে যেন সৌমিত্রও ঢুকে গেল। বড়ো ভাইয়ের বিয়ের আলোচনার মধ্যে না থাকলেই নয়!

একে একে সব ফলমূল সাজিয়ে তা স্বচ্ছের পরিবারের সামনে মিসেস সুফিয়া নিয়ে গেলেও শরবত নিয়ে যেতে দিলো না মোহ। জেদ ধরে বসে রইল এটা সে নিজে নিয়ে যাবে। মিসেস সুফিয়া হতভম্ব হলেন আর বললেন,
“দিনদিন বেশ নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস তুইও।”

মোহ পাত্তা দিলো না মায়ের কথাতে। উল্টে জিজ্ঞেসা করল,
“আচ্ছা উনারা হঠাৎ কেন সপরিবারে এসেছেন?”

“কেন আবার? বিয়ে করবি বলে তো ঠিক করেছিস। তো চূড়ান্তভাবে সব ঠিক করতে হবে না? কী আজব প্রশ্ন করিস!”

মিসেস সুফিয়া চলে গেলেন বসার ঘরে। মোহের মন নাড়া দিয়ে উঠল। স্বচ্ছের কি চাকরি হলো তবে? এরমধ্যে বিয়ের আলোচনা জমে উঠেছে। আজহার সাহেব স্বচ্ছের কাছ থেকে শুনছেন তার চাকরি সম্পর্কিত কথা। ইথানও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সকলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বসেছে সৌমিত্র ও স্বচ্ছের মাঝে। আগ্রহের সহিত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সবার কথা শুনছে। মিসেস জেবা তখন মোহের মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“মোহ কোথায়? তাকেও নিয়ে আসুন।”

মুখের কথা শেষ হতেই মোহকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখা গেল। স্বচ্ছ উদ্ভ্রান্ত, বেহায়ার ন্যায় তাকিয়েই রইল তার সাদামাটা রমনীর দিকে। মেয়েটা বিশেষভাবে সাজগোজ করেনি বা করার সময় পায়নি। গরমে চোখমুখে লেগে আছে হালকা ঘাম। খোলা চুলগুলো কোনোমতে ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছে। চোখে কাজল দেওয়া হালকা করে। তাও বোধহয় ইথানকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময় দিয়েছিল। স্বচ্ছের কাছে এটাই অমায়িক লাগছে। তার ভ্যাবলার ন্যায় চেয়ে থাকা দেখে ফিক করে হেসে উঠল ফারাহ।

মোহ এসে একে একে সবার হাতে শরবত তুলে দিচ্ছে৷ সবশেষে, সবার চেয়ে আলাদা গ্লাসটা স্বচ্ছের সামনে ধরতেই সৌমিত্র চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠল,
“আজ সাধারণ মানুষ বলে আমাদের জন্য একরকম গ্লাস আর ভাইয়ের জন্য আলাদা গ্লাস? এ কেমন বৈষম্য?”

স্বচ্ছ গ্লাসটা হাসিমুখে নিলো। সৌমিত্র মুখ ভার করে মন খারাপ করার ভান করে বলল,
“থাক মন খারাপ করে আর কী হবে! আমাদেরও সময় আসবে। এখন না হয় সাধারণ শরবতই খাই।”

সৌমিত্র ঢকঢক করে শরবত শেষ করল। কথাবার্তার মাঝে সবে মুখে শরবত নিলো স্বচ্ছ। মোহের মুখে তৎক্ষনাৎ ছেয়ে গেল বিশ্বজয়ের হাসি। মুখে হাত দিয়ে সেটা লুকাতে চাইল সে। স্বচ্ছের চোখমুখের রঙ ততক্ষণে পাল্টে গেছে। ভেতরের সবকিছু বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঢক গিলতে আর পারছে না। প্রচণ্ড বিপত্তিতে ফেঁসে গিয়ে নয়ন দুটো লাল করে মোহের দিকে দৃষ্টিপাত করে সে। এবার বুঝেছে আলাদা গ্লাসের রহস্য। মেয়েটা তলে তলে এত কূটবুদ্ধির কারখানা রয়েছে সেটা জানা ছিল না স্বচ্ছের। হঠাৎই আজহার সাহেব স্বচ্ছকে একটা প্রশ্ন করলেন।
“বিয়ের অনুষ্ঠান ছোটো করে হলেও ছুটি তো নিতে হবে দুয়েকদিনের জন্য। নতুন চাকরি পেলে তুমি সবে। ছুটি কি পাবে?”

বিপাকে পড়ে গেল স্বচ্ছ। নিজের উপর জোর খাঁটিয়ে ঢক গিলে দ্রুত পানি খেয়ে হাফ ছেড়ে বলল,
“আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। সমস্যা নেই।”

এরপরেই আচানক স্বচ্ছ সকলের সামনে মোহকে ডেকে ওঠে,
“মোহ!”

কিছুটা চমকায় মোহ। স্বচ্ছ বসা থেকে উঠতেই ফারাহ তাদের পরিকল্পনা মাফিক স্বচ্ছের হাতে একটা আংটি গুঁজে দেয়। মোহের সংলগ্নে এসে বিলম্ব না করেই তার বাম হাতটা ধরে ফেলে স্বচ্ছ। লাজুক মোহ নুইয়ে পড়ে। ভেতরের হৃদপিণ্ড যেন ঘোড়ার ন্যায় ছুটতে চাইছে। অস্থিরতা সামলানো অসাধ্যকর হয়ে উঠেছে। তখনি স্বচ্ছ বলে উঠল,
“ইথানের মা, শোনো! আমাকে ইথানের বাবা হবার অনুমতি দেবে? প্লিজ!”

এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বাঁধা পড়েছে মোহ। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যেন তার আশেপাশের আবহাওয়া। সে বহু কষ্টে আঁড়চোখে সকলের দিকে দেখে। সবাই তাদের দিকে এক আকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিতে দেখছে। মোহের হাত-পা কাঁপছে। মাঝখান থেকে ইথান বলে ওঠে,
“মাম্মা, আমার কিন্তু এবার বাবাও লাগবে। প্লিজ!”

কথাটা সৌমিত্র শিখিয়ে দিয়েছে তাকে কানে কানে। ইথান হুবহু সেটা বলে দেওয়ায় রাজ্য জয়ের হাসি হাসল সে। স্বচ্ছ এবার তার সামনে একটা ছোট্ট স্বর্ণের আংটি ধরল। এটা তার মা তাকে দিয়েছে। স্বচ্ছ ফের বলল,
“ইথান যখন বড়ো হয়ে যাবে। আমরা যখন বৃদ্ধ হবো। আমাদের শরীরের চামড়া যখন ঝুলে যাবে তখন বুড়ো বুড়ি ছেলে আর ছেলের বউকে রেখে সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দূরে কোথাও চলে যাব। সেখানে আমি তোমার খেয়াল রাখব, তুমি খেয়াল রাখবে। এসব কিছু তখনই সম্ভব হবে তুমি যখন আমার হাতের আংটি পরতে সম্মতি জানাবে। উইল ইউ ম্যারি মি, মাই স্ট্রং ওমেন?”

মোহের গভীর নেত্রপল্লবের থেকে নিজের দৃষ্টি সরায়নি স্বচ্ছ। সে জানে তার প্রথম সম্মতি তার বিধ্বংসী চোখ থেকেই আসবে। মোহ কয়েকটি ঘনঘন শ্বাস ফেলে একটি চোখের পলক ফেলে সম্মতি জানায়। তৎক্ষনাৎ ঝলমলিয়ে ওঠে স্বচ্ছের চেহারা। মোহ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানানোর আগে তার অনামিকা আঙ্গুলে পরিয়ে দেয় আংটি। হাত তালিতে সৌমিত্র আর ফারাহ মুখরিত করে তোলে বাড়ির পরিবেশ। ফারাহ প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে বলে,
“ভাবির বিয়ের জন্য সব পোশাক কিন্তু আমি নিজ হাতে আগে থেকে ডিজাইন করে রেখেছি। ভাবিকে শহরের সবথেকে সুন্দর নববধূ লাগবে আমার ডিজাইন করা শাড়িতে।”

সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,
“আমার ভাইটাকে কি বাতিলের খাতায় ফেলে দিলি?”

“তা না অবশ্য৷ আমার দয়ামায়ার কমতি নেই। ভাবির পাশে আমার ডিজাইন করা পোশাক ছাড়া ভাইয়াকে মানাবে না। তাই মায়া করে তার জন্যও কিছু প্ল্যানিং করে রেখেছি।”

সৌমিত্র আরো উৎসুক হয়ে শুধাল,
“আর আমার জন্যও কিছু ভাব। নেক্সট টার্গেট তো আমারই কিনা! মানে বিয়ে করার পালা এরপর তো আমার। তাই আমাকেও কোনো অংশে কম লাগা উচিত না।”

হাসিঠাট্টা চলতে থাকল। মিসেস জেবা স্বচ্ছ ও মোহের কাছে জানতে চাইলেন,
“তোমাদের কি কোনো ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা করার দরকার আছে? থাকলে সেরে নাও।”

স্বচ্ছ যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে,
“আমার কিছু কথা বলার আছে।”

আজহার সাহেব পরামর্শ দিলেন,
“কথা বলার থাকলে ছাঁদে যাও। ওখানে নিরিবিলি আলাপ করতে পারবে।”

অতঃপর স্বচ্ছ মোহের দিকে ইশারা করে স্মিত হাসি দিয়ে ভদ্রতার সহিত বলে,
“তাহলে ছাঁদে নিয়ে চলুন মিস।”

হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় মোহ। পেছন পেছন ধীর পায়ে হাঁটে স্বচ্ছ। ছাঁদে এসেই হালকা বাতাসে ভরে যায় প্রাণ। ছাঁদের দুদিকে নানান ফুলের গাছ লাগানো। একটি নীল অপরাজিতার গাছ ছাঁদ থেকে বেয়ে বেয়ে নিচ অবধি নেমেছে। রেলিংয়ে হাত দিয়ে সেটাই দেখতে ব্যস্ত হলো স্বচ্ছ। সেভাবেই হুট করে মোহের পানে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এত সুন্দর শরবত দেওয়ার কারণটা কি আপনার মেসেজ, কলের উত্তর না দেওয়া?”

মোহ স্বচ্ছ থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দায়সারাভাবে প্রত্যত্তুর করল,
“হুঁ। প্রতিটা অন্যায়কারীর সাজা হওয়া উচিত।”

স্বচ্ছ এবার মোহের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে বলে উঠল,
“তা আর কতটা কূটবুদ্ধি রয়েছে আপনার মনে?”

“ভবিষ্যৎ তো পড়েই আছে। দেখতে পাবেন।”

মোহের নিকটে আসে স্বচ্ছ৷ এবার তার চাকরির পুরো ঘটনা খুলে বলার পালা। নিজ থেকে বলতে শুরু করে,
“জানো, সেদিন প্রথম যখন কেউ ভালোভাবে আমার চাকরির ইন্টারভিউ নিলো তখন আমার মনে আনন্দের শেষ ছিল না। অন্ধকার দেখলাম তখন যখন জানলাম কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারে মিস অন্বেষা রয়েছে। খুব বিব্রতবোধ করলাম। অস্বস্তি হলো। সেদিন তোমাকে জানাতে চেয়েও জানাইনি। সব ফাইনাল হলে জানাব বলে।”

হতবিহ্বল হয়ে স্বচ্ছের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করল মোহ। অস্ফুটস্বরে বলল,
“মিস অন্বেষা?”

“হুঁ। এরপর অস্বস্তিতে যখন শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম তখন সন্ধ্যায় মেইল আসে আমি চাকরির জন্য সিলেক্টেড। আমি নিজের অস্বাচ্ছন্দ্য আর বাড়াতে চাইনি। বুকের উপর পাথর তুলে প্রথমবার চাকরি পেয়েও সেটা রিজেক্ট করতে যাচ্ছিলাম।”

“তারপর?”

“মিস অন্বেষার পারসোনাল মেইল আসে। সে আন্দাজ করেছিল আমি হয়ত চাকরি রিজেক্ট করতে পারি। তাই সে প্রুফ দেখায় যে আমি সিলেকশনের দ্বিতীয় ক্যান্ডিডেট। মানে প্রথমে যাকে চাকরির জন্য তারা নিতে চেয়েছিল সেই লোকটা আরো ভালো জায়গায় চাকরি পাওয়াতে সেটা রিজেক্ট করেছে। তাই চাকরির অফারের ইমেইল পরবর্তীতে আমাকে পাঠানো হয়েছে। সেখানে সে রিকুয়েষ্ট করে জানায়, পারসোনাল ইস্যু বাদ দিয়ে ভাবতে। তাছাড়া অন্বেষার সঙ্গে মাসে দুয়েকবার কাজের খাতিরে দেখা হতে পারে। কোম্পানির অন্য শেয়ার হোল্ডারের সঙ্গে কাজ করতে হবে আমাকে। সব জেনে, আমি তখন তোমার কথা ভাবি। আর কিছু না ভেবে অফার এক্সেপ্ট করেছি। জানি না, আমি ঠিক করেছি নাকি ভুল করেছি। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছ?”

এমন বোকা প্রশ্নে নিঃশব্দে মুচকি হেসেই ফেলে মোহ। স্বচ্ছের সামনাসামনি এসে ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“আপনাকে যদি বিশ্বাসই না করি তবে বিবাহের অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম কেন? নিজের বাকি জীবনটা আপনার আবদ্ধে কাটাতে চাইলাম কেন?”

স্বচ্ছের মুখটা থেকে চিন্তা দূর হয়না৷ বেশ অস্থির হয়ে বলে,
“আদেও জানিনা সিদ্ধান্তটা ভুল নিয়েছি নাকি ঠিক!”

“এই মুহূর্তের জন্য ঠিক নিয়েছেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবন দূরে রেখে ভাবুন। তাছাড়া মানুষ বদলায়। তাদের চিন্তাধারা বদলায়। কে বলতে পারে অন্বেষারও চিন্তাধারা বদলেছে। সে যেই ক্ষমতায় রয়েছে সেটাতে চাইলে বহু আগে আপনার, আমার বাকিদের ক্ষতি করতেই পারত। কিন্তু সে করেনি৷ জীবনের সব নেতিবাচক ভাবনা সরিয়ে ইতিবাচক ভাবনা আনুন মনের মধ্যে।”

স্বচ্ছের মস্তিষ্ক থেকে দুঃশ্চিন্তা গায়েব হয়। মুখে হাসি এনে বলে,
“নিজের হবু স্বামীর প্রতি এত ভরসা মিস মোহ?”

মোহের হাসিখানি প্রগাঢ় হয়। স্বচ্ছের নাকের ডগা ছুঁইয়ে বলে,
“আপনি প্রচণ্ড চালাক হবার ভান করেন। আসলে আপনি দেখি বোকা!”

“প্রেমিকার কাছে সব প্রেমিক বোকা। প্রেমিকারা হয় স্বৈরাচারী! আমরা হলাম স্বৈরশাসনে শোষিত অসহায় প্রেমিক।”

মোহের চোখমুখ কুঁচকে যায়। মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“অসহায় প্রেমিক!”

স্বচ্ছ একটু নিচু হয়ে মোহের চোখেমুখে ফুঁ দিয়ে বলে,
“সব কথার শেষ কথা, সারাজীবনের জন্য আপনাকে আমি আমার স্বৈরাচারী বানিয়ে রাখতে চাই।”

এরপর স্বচ্ছ ও মোহের বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া আরম্ভ হলো। হাতে আছে এক সপ্তাহ। আর সাতটা দিন পরেই প্রণয়ের পূর্ণতা। বহু প্রতীক্ষার অন্তিম!

সন্ধ্যার পর থেকে শৌভিকের ফোন বন্ধ। ক্ষণে ক্ষণে মেজাজ হারাচ্ছে ফারাহ। অথচ লোকটার মোহের বাগদানের সময় উপস্থিত থাকার কথা ছিল। এখন কিনা তার খোঁজই নেই। ঘড়ির সময় এখন রাত এগারোটা পয়তাল্লিশ। সময় যত বাড়ে ফারাহর চিন্তা বাড়ে। এই প্রিয় মানুষটাকে কতদিন নিজ চোখে দেখেনি ফারাহ। সেদিন শৌভিক শ্বশুরবাড়ি আসার পথে গোলাপ, চকলেট কিনলেও তা ফারাহ অবধি পৌঁছানো হয়নি। তাকে তার রাজনৈতিক সময়ের সঙ্গী নীলয়ের গ্রামে যেতে হয়েছিল ইমারজেন্সিতে। কারণ সরোয়ার সাহেরের এমন পতন উনার কিছু সমর্থক মানতে পারেনি। ফলে নীলয়কে পেয়ে আক্র/মণ করেছিল তারা। অবস্থা বেগতিক বুঝে শৌভিক চুপ না থেকে ছুটেছিল গ্রামে। সেখানে আবার নেটওয়ার্কের জটিল সমস্যা। দিনে স্বল্প সময়ের কথা কথা বলতে পারত ফারাহ। আজ সেটাও হয়নি। শৌভিকের ক্ষতির কথা ভেবেই দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে সে। একসময় ছটফট করে ওঠে। সৌমিত্রকে শুধায়,
“এই ভাই, উনি কোন গ্রামে গেছে জানিস?”

সৌমিত্র গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“আমি কী করে জানব?”

ফারাহর কান্না পায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“লোকটাকে পেলে গণধলায় দেওয়ানো উচিত।”

“তোরই ভালোবাসার স্বামী।”

ফট করে মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলে নিজের ফোনে মনোযোগ দিলো সৌমিত্র। ফারাহ তার দিকে কুশন বালিশ ছুঁড়ে মা/রে আর বারবার শৌভিকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে স্বচ্ছ তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ফারাহকে হাঁসফাঁস করতে দেখে বলে,
“কী হয়েছে তোমার? এমন মুখ শুকনো কেন?”

বড়ো ভাইকে পেয়ে যেন নিজের দুঃখ উজাড় করে ফারাহ।
“দেখো না ভাইয়া লোকটার ফোন বন্ধ।”

“শৌভিক?”

ফারাহ মাথায় ঝাঁকায়। স্বচ্ছ ফারাহকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“জানোই তো ওখানে নেট প্রবলেম। তাই যোগাযোগ করতে পারছে না। একটু পর আবার ট্রাই করো। আর টেনশন নিতে হবে না। আমি বাইরে পেছনের বাগানে হাঁটতে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে চলো। মন শান্ত হবে।”

ফারাহ প্রথমে যেতে চাইল না। তবে বড়ো ভাইয়ের জেদের কাছে হার মানতে হলো তাকে। তার হাত ধরেই টানতে টানতে বাইরের দিকে হাঁটা দিলো স্বচ্ছ। সঙ্গে সৌমিত্রও দাঁত কেলিয়ে পিছু নিলো তাদের।

পেছনের আমবাগানটা অন্ধকার। অন্যদিন আলো জ্বালানো থাকে। বেশ বিরক্ত হলো ফারাহ। মুখ ফুলিয়ে বলল,
“অন্ধকারে কি নাচতে নিয়ে এলে ভাইয়া?”

তার কথা শেষ হওয়া মাত্র ঝলমলিয়ে উঠল চারিপাশ। আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। হকচকিয়ে উঠে স্বচ্ছের হাত খামচে ধরা মাত্র ফারাহর নজরে এলো আলোর মাঝে একটি টেবিলের কাছে শৌভিক তার মুগ্ধকর হাসি দিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। স্বচ্ছ বলে,
“পেয়েছ তাকে? দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও তার কাছে।”

শুকনো ঢোক গিলে গুটি গুটি পায়ে শৌভিকের নিকটে এগিয়ে গেল ফারাহ। দুটো গাছ জড়িয়ে রাখা ছোটো লাইটগুলো অসাধারণ লাগছে। গাছের সঙ্গে বাঁধা দুটো লাইনে কিছু লেখা,
‘হ্যাপি বার্থডে ফারাহ।”

আজ সকাল থেকে বিকাল অবধিও ফারাহর নিজের জন্মদিনের কথা মনে ছিল। পরক্ষণে শৌভিকের চিন্তায় বিষয়টা মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। চোখ বড়ো বড়ো করে শৌভিককে দেখল ফারাহ। মেয়েটার চোখ ভর্তি অভিমান। শৌভিক অভিমানী মেয়ের গাল ছুঁইয়ে শান্ত গলায় বলে,
“পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার চব্বিশ বছর বয়স পূর্ণ হলো আপনার। পঁচিশ বছরে আপনাকে স্বাগত!”

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩ [দ্বিতীয় খণ্ড]

ফারাহর চোখে পানি টলমল করছে। অশ্রুর চোটে আশপাশটা ঘোলা দেখছে। ভেতরে ভেতরে রাগ উপচে পড়ছে তার সামনের মানুষটার প্রতি। গহীনে বইছে মিশ্র অনুভূতির জোয়ার। সৌমিত্র ফারাহর এমন প্রতিক্রিয়া দেখে ফিক করে হেসে বলে দিলো,
“শৌভিক ভাই, এখনি আপনার বউ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠবে। সামলানোর জন্য রেডি থাকেন।”

মুখ ফুলিয়ে সৌমিত্রের পানে তাকায় ফারাহ৷ স্বচ্ছ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“নিজের জন্মদিনে কাঁদলে খারাপ দেখায়। কান্নাকাটি করে নিজের সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করো না।”

ফারাহ নাক টেনে ভাইয়ের কাছে আহ্লাদী হয়ে শুধাল,
“এসব তোমরা প্ল্যান করে করেছ তাই না?”

স্বচ্ছ এক গাল হাসি দিয়ে বলল,
“আপনার জামাইয়ের প্ল্যান এটা। আমরা নিষ্পাপ!”

গাল ফুলিয়ে একপা দুইপা করে শৌভিকের পানে এগিয়ে যায় ফারাহ। শৌভিক প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে ক্ষোভে ফারাহ তার বুকে দুহাতে চাপড় মে/রে বলল,
“আপনি খুব খারাপ একটা মানুষ। আমি যে চিন্তা করছিলাম সেসবের পরোয়া করেন না।”

শৌভিক তাড়াহুড়ো করে ফারাহর দুহাত ধরে খপ করে ধরে বলল,
“খুব টেনশন করছিলে?”

“তো কী মনে হয় আনন্দে নাচানাচি করছিলাম? ওখানে এমনি নীলয় ভাইকে দেখতে গেলেন কারণ ও আপনার দলের লোক বলে মে/রেছিল। আপনাকে পেয়ে আপনার উপর হা/মলা হবেনা তার কোনো গ্যারান্টি আছে?”

শৌভিক হাফ ছেড়ে বলল,
“আমি ঠিক আছি তো।”

ফারাহ নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু তার ক্ষোভে ভরা দুটো আঁখি কথা বলছে। দৃষ্টি দিয়ে রীতিমতো হুমকিধামকি দিয়ে যাচ্ছে যেন। তার মাঝে সেখানে এলেন মিসেস জেবা। হতবাক হয়ে ফারাহ মায়ের কাছে জানতে চাইল,
“মা তুমিও জানতে এসব প্ল্যানিং?”

মিসেস জেবা সোজা জবাব দিলেন,
“হ্যাঁ। না জানার কী আছে? দায়িত্ব নিয়ে শৌভিক আমায় জানিয়েছে।”

এরপর টেবিল এনে সেখানে কেক রাখল সৌমিত্র। প্রতিবার নিজের পরিবারের সাথে বড়ো করে অনুষ্ঠান করা হতো ফারাহর জন্মদিনে। বাড়ির ছোটো হওয়ার কারণে বাকিদের থেকে তার জন্মদিন হতো জাঁকজমকপূর্ণ। কোনো কিছুর কমতি রাখতেন না সরোয়ার সাহেব। কেক দেখেই হঠাৎ নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল ফারাহর। মলিনতা ছেয়ে গেল মিষ্টি মুখটায়। আজ তার আশেপাশে বাবা নেই। বাবার চিন্তায় মশগুল থাকা অবস্থায় মিসেস জেবা ফারাহকে ডাকল। মায়ের ডাকে ম্লান হাসি দিলো ফারাহ। কেকের দিকে তাকাল সে। তার প্রিয় চকলেট কেক। একবার ভুল করে চকলেট কেকের বদলে ভ্যানিলা কেক আসার কারণে মন খারাপ করেছিল ফারাহ। সেদিনই বাবার কাছ থেকে দুটো চকলেট কেক পেয়েছিল সে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফারাহ। মিসেস জেবা তার মতিগতি বুঝে পাশে এসে দাঁড়ান। ধীর গলায় জিজ্ঞেস করেন,
“বাবার কথা ভাবছিস?”

ফারাহ জবাব দেয় না। কিন্তু তার মুখভঙ্গি জবাব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মেয়ের চুল ঠিক করে দিতে দিতে মিসেস জেবা বললেন,
“সবাই সবসময় পাশে থাকে না। তোর বাবা অন্যায় করেছে। সে নিজেকে শুধরে নিতে একটা জায়গায় গেছে এটাই ধরে নে। মন খারাপ করে থাকিস না।”

ফারাহ মৃদু হাসি দেয় প্রত্যুত্তরে। কেক কাটা হয়। এর মাঝে কোত্থেকে যেন শৌভিকের বাবা। শৌভিক বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল,
“বাবা তুমি না বললে তুমি এত রাতে আসতে পারবে না!”

মীর সাহেব ছেলেকে এক প্রকার ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বললেন,
“ধুর বেটা! প্রথমবার নিজের ছেলের বউয়ের জন্মদিন এভাবে মিস করব?”

ফারাহর কাছে এসে দাঁড়ালেন মীর সাহেব। ফারাহ সালাম দিতেই তিনি সালাম নিলেন। এরপর বললেন,
“শুভ জন্মদিন! আমি জানি আমার তার কাঁটা ছেলে অনেক চিন্তায় ফেলেছে তোমাকে। তুমি পারলে তাকে উচিত শিক্ষা দিবে। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। সারাজীবন আমার পাগল ছেলের বউ হয়ে থেকে যেও।”

এত কিছু শুনে চুপ থাকল না শৌভিক।
“বাবা, তুমি আমার বউকে উইশ করছ নাকি আমাকে ইনসাল্ট করছ বুঝতে পারছি না। আমাকে অপমান করার কোনো রাস্তা বাদ রাখো না তুমি।”

এবার আরো কড়া ধমক খেল শৌভিক মীর সাহেবের কাছে।
“তুমি চুপ থাকো উজবুক কোথাকার! আমার আর বউমার কথার মাঝখানে আসছ কেন?”

নীরব হয় শৌভিক। ফারাহ মজা পেয়েছে। সে প্রথমদিন থেকেই বাবা ছেলের এমন কাণ্ড দেখে আসছে। তাদের দেখে বাবা ছেলে কম বন্ধু যেন বেশি মনে হয়। এসব বেশ উপভোগ করে ফারাহ। মীর সাহেব এবার ফারাহর হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট তুলে দিলেন। গোল গোল চোখে ফারাহ প্যাকেটগুলোর দিকে নজর দিতেই মীর সাহেব বললেন,
“আমি তো জানিনা জন্মদিনে কী উপহার দিতে হয়। ওসব বুঝিনা। শুধু শৌভিকের মুখে শুনেছিলাম তুমি নাকি চকলেট অনেক পছন্দ করো। তাই এটাই দিলাম।”

বেশ কয়েক রকমের অনেকগুলো চকলেট উপহার দিয়েছেন মীর সাহেব। ফারাহর মুখে ঝলমলে হাসি দেখা যায়। বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বানার প্রতিচ্ছবি যেন মীর সাহেবের মাঝে দেখতে পায়। বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে,
“থ্যাংক ইউ, বাবা।”

ফারাহর প্রশান্তির হাসি দেখে বেশ খুশি হোন মীর সাহেব। স্বচ্ছ এগিয়ে এলো তার বোনের কাছে। বেশ সহজ স্বীকারোক্তি জানালো,
“তোমার জন্য আমার কাছে কোনো গিফট নেই। যেদিন নিজের প্রথম স্যালারি পাব সেদিন তুমি আমার থেকে গিফট পাবে।”

ফারাহ গালে হাত দিয়ে একটু ভেবে খানিকটা আবদার করে বলল,
“গিফট হিসেবে আমি একটা জিনিসই চাই৷ সেটাই তোমাকে দিতে হবে।”

স্বচ্ছ বোনের মুখের আবদার শুনে বেশ উৎসুক হয়ে শুধাল,
“কী সেটা বলো!”

“মোহ ভাবি। ভাবি আমার বেস্ট গিফট হবে। এখন যত তাড়াতাড়ি পারো এই গিফটের ব্যবস্থা কর ফেলো।”

কথা শেষ করে ফিক করে হাসে ফারাহ। আঁড়চোখে সৌমিত্রকেও বলে,
“তোকেও বলছি। আর লুকিয়ে প্রেম না করে চাকরি করে ভাবি এনে দে। দুই ভাবির একমাত্র ননদ শুধু আদর আর আদর পাবে। এরচেয়ে বেস্ট গিফট আর কী হতে পারে।”

বেশ হাসিখুশির মহল তৈরি হলো সেখানে। সবশেষে সকলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেও বাইরে রয়ে গেল ফারাহ এবং শৌভিক। নিজের চকলেট কেক খেতে ব্যস্ত ফারাহ৷ হাতে ক্রিম লেগে মাখো মাখো অবস্থা।ফারাহর পাশাপাশি দাঁড়াতে চাইলে দুইহাত সরে গিয়ে শৌভিককে না দেখার ভান করল ফারাহ। শৌভিক প্রচণ্ড আদুরে গলায় তাকে সম্বোধন করল,
“এই শত্রুর মেয়ে, শোনো!”

ফারাহ ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি ভাব নিয়ে তাকালে শৌভিক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“এভাবে রাগ করতে নেই অসহায় স্বামীর প্রতি।”

ফারাহ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে উঠল,
“অসহায় না ছাই!”

আর বিলম্ব করল না শৌভিক৷ ঝড়ের বেগে ফারাহর হাত টেনে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে ধরল তাকে। ফারাহ ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করল। লাভ হলো না। উপরন্তু শৌভিকের ঠোঁটের পরশ পড়ল গালে। রেগেমেগে তার হাতের ক্রিম শৌভিকের হাত, বাহু, জামা সবখানে মাখিয়ে দিলো ফারাহ। কিন্তু শৌভিক রইল নিশ্চুপ। একভাবে জড়িয়ে তার কাঁধে থুঁতনি রেখে চোখ বুঁজে রইল। কেটে গেল অনেকক্ষণ। ফারাহ ক্লান্তি নিয়ে বাকশূন্য হয়ে রইল। নিজের প্রিয়র উষ্ণতম স্পর্শ তাকে শান্ত করতে বাধ্য করল। শৌভিক হাফ ছেড়ে বলল,
“আপনি যে আমার জড়িয়ে ধরার আশায় রাগে কটমট করছিলেন আমি জানি।”

ফারাহ তৎক্ষনাৎ ফুঁসে উঠে বলল,
“একদম বাজে কথা বলবেন না।”

“আচ্ছা চুপ রইলাম। তুমি কথা বলো। আমি শুনি।”

“আজকে তো ভাইয়ার বিয়ের ডেট ফাইনাল হওয়ার কথা ছিল। ভাবি নিশ্চয় আশা করছিল তার ভাই মানে আপনি থাকবেন। থাকলেন না কেন?”

শৌভিক এবার ফারাহকে ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“থাকতে তো চেয়েছিলাম। তবে গ্রাম থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেল। মোহকে কল করেছিলাম। ও আমার ঝামেলা বুঝে আমাকে তাড়াহুড়ো করতে মানা করেছে।”

ফারাহ এক রাশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল,
“আর এক সপ্তাহ পর ভাইয়ার বিয়ে। জানেন, আমি ভাবির জন্য এডভান্স বেনারসির ডিজাইন করে রেখেছিলাম।”

ফারাহর এত উৎসাহ দেখে শৌভিকও আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,
“তাই? সেটা কেমন ডিজাইন?”

“একদম আনকমন। খয়েরী রঙের বেনারসিতে ভারি কাজ থাকবে। ভাবির গায়ে বেনারসিটা উঠলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে নিশ্চিত! তার সাথে ম্যাচিং গয়না কেনার প্ল্যানিং আছে। এটার জন্য কিন্তু আপনাকে আমার সাথে মার্কেটে যেতেই হবে।”

“আরে বাবা, যাব যাব। আমার বোন বলে মানি তাকে। এইটুকু তো করতেই হবে।”

“আর ভাইয়ার জন্য সাদা রঙের শেরওয়ানি। তার উপর সোনালী রঙের কাজ। কেমন লাগবে বলুন তো? ভালো লাগবে তাই না?”

ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে নানান কল্পনা জল্পনা শুরু করে ফারাহ। সঙ্গ দেয় শৌভিক। দুজনে নানানরকম পরিকল্পনা করতে আরম্ভ করে।

আজ স্বচ্ছের কর্মজীবনের প্রথম দিন। অথচ সে দাঁড়িয়ে আছে মোহের বাড়ির গলির সামনে বাইক নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ যাবত অপেক্ষা করার পর গলির ভেতরে নজর রাখতেই স্বচ্ছ দেখা পেল আসমানী রঙের কামিজ পরিহিত তার প্রেয়সীকে। মাথার ওড়না একহাতে ঠিক করতে করতে এবং অন্যহাতে ইথানকে ধরে তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছে সে। স্বচ্ছের সংলগ্নে তারা আসতেই স্বচ্ছ শুনতে পেল মোহের ইথানকে সামান্য বকাঝকা করছে।
“তুমি আজকাল ক্লাসে কি অমনোযোগী হচ্ছো ইথান? তোমার টিচার বলল তুমি হোমওয়ার্ক করো নি দুইদিন হলো? এমন করলে রেজাল্ট ভালো হবে কী করে বলো?”

ইথান কিছু বলে না। মোহ প্রথমে খেয়াল না করলেও ইথানের সঙ্গে কথা বলা শেষে সামনে ফাঁকা অটো পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাকালেই হাস্যোজ্জ্বল স্বচ্ছের মুখ দেখে খানিকটা চমকে ওঠে। দ্রুত মোহ নিজের হাতের ঘড়ির সময় দেখে বলে,
“আপনার না আজকে অফিসে প্রথম দিন? আপনি এখানে কী করছেন?”

স্বচ্ছ বাইক থেকে নেমে ইথানকে বাইকে তুলে বলল,
“এখনো অনেক সময় আছে। তাই ভাবলাম তোমাদের রেখে তারপর যাব অফিসে।”

“প্রথমদিন অফিসে দ্রুত যাওয়া উচিত।”

স্বচ্ছও পাল্টা জবাব দিলো,
“প্রথমদিন অফিসে যাওয়ার পথে হবু বউ ও বাচ্চার মুখ দেখে যাওয়া উচিত যেন সারাদিন হৃদয় শান্ত থাকে।”

মোহ আর প্রত্যুত্তর না করলে স্বচ্ছ ফের ভার মুখে থাকা ইথানের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল,
“তা আমার ইথানকে বকছিলে কেন? হাউ ডেয়ার ইউ ডিয়ার?”

“আজকাল পড়াশোনা বাজে করছে সে। রাতেও ঠিকঠাক পড়ছে না।”

মোহের কণ্ঠে খানিকটা হতাশা৷ স্বচ্ছ বেশ নরম হয়ে ইথানের কাছে কিছু জানতে চাওয়ার আগেই ফট করে ইথান বলে বসল,
“আচ্ছা, স্কুলে আমার ফ্রেন্ডদের সবার অনেক আগে থেকে মা আর বাবা আছে। আমার শুধু মা ছিল। বাবা এত দেরিতে আসলো কেন?”

থমকায় মোহ। মনটা অস্থির হলো তার৷ স্বচ্ছের পানে অসহায় হয়ে তাকালো৷ স্বচ্ছ মোহের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তরে বলল,
“আমি একটু অলস মানুষ তো। তাই আসতে লেইট করেছি বাবু৷ স্যরি।”

“এটা কেমন কথা? আমি যখন আমার ফ্রেন্ডদের বলেছি তখন তারা বলেছে বাবা নাকি শুরু থেকে থাকে।”

মোহের বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। এখন না হয় ইথান তেমন কিছুই বোঝেনা। কিন্তু যখন বড়ো হবে তার প্রশ্নগুলো আরো ধারালো হবে। সে আসন্ন ইথানের প্রতিটা তীরের মতো প্রশ্ন এখন থেকেই যেন শুনতে পাচ্ছে। স্বচ্ছ ইথানকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমিও তো শুরু থেকেই ছিলাম। কিন্তু আমার চাকরি পেতে পেতে দেরি হয়ে গেল জানো তো? এই যুগে চাকরি না পেলে বিয়ে হয়না। তাতে কী? আমার ইথান অন্যের কথাতে কান দিবে কেন? সে তো স্পেশাল তাই না?”

ইথান শুধু মাথায় ঝাঁকায়। স্বচ্ছ আরো বলে,
“তোমাকে এখন থেকেই ভালো করে পড়তে হবে কিন্তু। নয়ত তোমারও চাকরি পেতে দেরি হবে। বুঝলে?”

অনেকভাবে বুঝিয়ে ইথানের মনটাকে ভুলিয়ে দিলো স্বচ্ছ। তবে মোহের ভয় কমেনা। সারা রাস্তা সে প্রচন্ত চিন্তায় ছিল। ইথানের স্কুলে থামে স্বচ্ছের বাইক। ইথান নেমেই মোহ ও স্বচ্ছের দিকে হাত নাড়িয়ে টাটা দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে স্কুলের ভেতরে ঢুকে যায়। মোহ তখনি বলে ওঠে,
“ইথানকে এখন না হয় যা ইচ্ছা বোঝালেন। কিন্তু একদিন তো সে বড়ো হবে। তখন?”

স্বচ্ছ মোহের হাতে হাত রেখে প্রগাঢ় আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ওকে আমরা দুজন মিলে সামলে নিব। ট্রাস্ট মি!”

মোহ নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল,
“এখন দ্রুত যান অফিসে।”

স্বচ্ছ হালকা কেশে বলল,
“বেস্ট অফ লাক বলো।”

মোহ না হেসে পারে না। খেয়াল করে স্বচ্ছের শার্টের কলার সামান্য কুঁচকে আছে। কথা না বাড়িয়ে তার শার্টের কলার সুন্দর করে ঠিক করে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। সঙ্গে এলোমেলো চুলগুলো একপাশে হাত দিয়ে পরিপাটি করে দিলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“অগোছালো লোক একটা!”

“গুছিয়ে দেওয়ার জন্য মহারানি আছে। তাই অগোছালোই ঠিক আছে।”

মোহ মৃদু হেসে আরো জানতে চায়,
“দুপুরের জন্য টিফিন নিয়েছেন?”

“না। মা দিতে চাইল কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলাম। ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেব।”

মোহ চোখ ছোটো হয়ে এলো। বাইক স্টার্ট দিলো স্বচ্ছ। এবার দেরিই হয়ে যাচ্ছে তার। হঠাৎ মোহ তাকে ডেকে বসল।
“শুনুন!”

মোহের পানে তাকাতেই মোহ বলে উঠল,
“আপনাকে ফর্মাল লুকে সুন্দর দেখাচ্ছে।”

বাইক বন্ধ করল স্বচ্ছ। এই প্রথম নিজের প্রেয়সীর মুখে এরূপ প্রশংসা পেয়ে যেন আকাশে উড়ছে তার মন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসছে মোহ। স্বচ্ছ কৌতূহলী হয়ে বলে উঠল,
“অন্যদিন সুন্দর লাগেনা?”

মোহ এবার ভ্রু কুঁচকায়। নিজের লজ্জার মাথা খেয়ে এই প্রথম লোকটার প্রশংসা করেছে সে। কিন্তু এতে যেন স্বচ্ছের শান্তি হয়নি। মোহ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
“জানি না। এখন যান তো। আর বেস্ট অফ লাক।”

“তুমিও সাবধানে বাড়ি যেও।”

মোহকে বিদায় জানিয়ে নিজের কাজের উদ্দেশ্যে রওনা হয় স্বচ্ছ। মোহ অনেকক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে তাকে দেখার পর অটো ধরে নেয়।

আজ স্বচ্ছের কাজের তিনদিন হয়েছে। নিজের সমস্ত প্রচেষ্টা ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে কাজে। কোনোভাবেই বর্তমানে সে এই চাকরি হারাতে চায় না। আজ জরুরি একটি মিটিংয়ের জন্য একটু দ্রুত অফিসের জন্য বের হতে হয়েছে তাকে। আজকে বিদেশি ক্লায়েন্ট আসার কথা। তাকে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেই হবে। অফিসের পার্কিংয়ে নিজের বাইক রাখতে গিয়ে স্বচ্ছর ফোনে কল আসে। সেখানেই ফোন বের করে মোহের নম্বর দেখে রিসিভ করে সে। মোহ বলে,
“হ্যালো। রেডি হয়েছেন আপনি?”

“অলরেডি আমি অফিস,মোহ। আজকে বিদেশি ক্লায়েন্ট আসবে।”

মোহ বুঝল স্বচ্ছ বেশ তাড়ার মাঝে আছে। তাই সরাসরি জিজ্ঞেসা করল,
“আজকে টিফিনে কিছু নিয়ে গেছেন?”

“না। ওসব মনে থাকেনা আমার।”

“আমি আজকে মাটন বিরিয়ানি বানিয়েছি। ভাবলাম যাওয়ার সময় আপনাকে দেব। এটা তো আপনার পছন্দের খাবার তাই না?”

স্বচ্ছ কিছুটা ম্লান হয়ে বলল,
“কিন্তু আমি তো চলে এলাম।”

মোহ একটু ভেবেই বলে উঠল,
“ইথানকে দিতে তো স্কুলে যাব। সেখান থেকে আপনার লোকেশন পাঠিয়ে দিন। আমি খাবার দিয়ে আসি?”

স্বচ্ছ প্রথমে রাজি না হলেও মোহের হাতের রান্না খাবার লোভটা যেন বেশিই চেপে ধরে। তাই সম্মতি জানিয়ে মোহকে লোকেশন পাঠায় সে।

মিটিং শেষ করে নিজের ডেস্কে কম্পিউটারে কিছু ফাইল চেক করছিল স্বচ্ছ। তবে মনোযোগ বসছিল না তার৷ বিরক্ত লাগছিল। এই বিরক্তির কারণটা অফিসের ম্যানেজার মি. মুহিব। লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। কোম্পানি নতুন হওয়ায় স্বচ্ছের সঙ্গে অনেক স্টাফকে নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কিছু মেয়েদের সঙ্গে সবসময় হেসেখেলে কথা বলার চেষ্টা করেন মি. মুহিব। মেয়েদের প্রতিটা ডেস্কে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করছেন কাজ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, কোথাও বুঝতে সমস্যা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি। মেয়েরা সাবলীল ভাবে উত্তর দিলে আরো অহেতুক কথা বাড়ান তিনি। এছাড়াও সবসময় মেয়ে স্টাফকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠান যখন তখন। কর্মজীবী পুরুষ যারা রয়েছে তারা বেশ বুঝেছে লোকটির মতিগতি সুবিধার নয়। কিন্তু তার উপরে কেউই কিছু বলে না। কেননা, মি. মুহিব কোম্পানি দুজন মেইন শেয়ারহোল্ডারের ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। স্বচ্ছের পাশের ডেস্কে কাজ করা ছেলে সাফোয়ান স্বচ্ছকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ম্যানেজার সাহেবকে দেখেছ? মেয়েদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেন?”

স্বচ্ছ নিজের কাজে মনোযোগী হয়েই বলে,
“না দেখে উপায় আছে? সবাই দেখছে। হি ইজ অ্যা ক্যারেক্টারলেস।”

সাফোয়ান তড়িঘড়ি করে বলল,
“এই চুপ চুপ। এসব কথা জোরে বলতে যেও না। চাকরি হারাতে দুই মিনিটও সময় লাগবে না।”

স্বচ্ছ দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। কম্পিউটার মনিটর ছেড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মি. মুহিবের দিকে। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে তার পক্ষে। কিন্তু নিজেকে শান্ত করতেই হবে। স্বচ্ছ জানে সে নিরুপায়।

দুটো ফাইল রেডি করে ম্যানেজারের কথা মতো তার কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“মে আই কাম ইন?”

ভেতরে থেকে মি. মুহিব বললেন,
“ইয়েস।”

ভেতরে প্রবেশ করতেই মি. মুহিবের এসিস্ট্যান্ট মিস লিমাকে দেখে তার মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করল স্বচ্ছ। লিমা মেয়েটার চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লিমা দেরি না করে দ্রুত পায়ে কেবিন ছেড়ে বের হলো। বিষয়টা সুবিধার ঠেকল না স্বচ্ছের কাছে। মি. মুহিবের কাছে ফাইল জমা দিয়ে এসে নিজের ডেস্কের সামনে বসে স্বচ্ছ। মিনিট পাঁচেক পড় লিমার ডেস্কের দিকে তাকায়। লিমা সেখানে নেই।

ওয়াশরুমে যাওয়ার পথে লিমার সামনাসামনি হয় স্বচ্ছ। তখনও মেয়েটির কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। এবার সংকোচবোধ না করে স্বচ্ছ সরাসরি জানতে চাইল,
“মিস লিমা, আর ইউ ওকে?”

লিমা কেমন যেন হকচকিয়ে উঠল। ঢক গিলে বলল,
“ইয়েস। হোয়াই নট? আমার কী হবে?”

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়ে রয়েছেন।”

“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”

স্বচ্ছ নিজেকে আরেকটু ঠাণ্ডা করে লিমাকে বোঝাতে গেল।
“আমরা অফিসের সবাই অলরেডি জানি মুহিব স্যার সুবিধার নয়। আপনি কি উনার জন্য কোনো সমস্যায় পড়েছেন? আমাকে বলতে পারেন।”

লিমা এবার অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া জানাল। চোখমুখ লাল করে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,
“অদ্ভুত তো আপনি! আমি বললাম তো কোনো সমস্যা নেই। অযথা কেন মুহিব স্যারকে নিয়ে টানাটানি করছেন? রিডিকিউলাস!”

লিমা হনহনিয়ে চলে গেল। স্বচ্ছেরও রাগ উঠে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে গিয়ে নিজের কাজে বসতেই কল আসে মোহের। তার কল পেয়ে বাইরে চলে যায় স্বচ্ছ।

সামনের গার্ডেনে দাঁড়িয়ে ছিল মোহ। বিল্ডিং থেকে স্বচ্ছকে বের হতে দেখে আলতো হাসি দিয়ে হাত নাড়ায় সে। স্বচ্ছ কাছাকাছি আসতেই প্রশ্ন করে,
“মিটিং শেষ? নাকি আমি ডিস্টার্ব করলাম?”

“মিটিং অনেক আগেই শেষ। তোমার তো আরো আগে আসার কথা ছিল। দেরি করলে যে?”

“রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। এইযে আপনার টিফিন।”

স্বচ্ছের দিকে ব্যাগ এগিয়ে দেয় মোহ এবং বলে,
“খেয়ে রিভিউ দেবেন অবশ্যই।”

স্বচ্ছ জবাবে হালকা হাসে। তবে হাসিটা ঠিক স্বাভাবিক লাগে না মোহের কাছে। চোখ বড়ো করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনার কি কোনো কারণে মুড খারাপ? রেগে আছেন আপনি?”

কিছুটা বিস্মিত হয় স্বচ্ছ। মেয়েটা কীভাবে এত সহজে তাকে বুঝে যায়? সে কি মন পড়তে পারে? তবে স্বচ্ছ অস্বীকার করে বলল,
“না তো। এমনি অফিসের কাজের চাপ। তুমি তো জানো এসবের অভ্যেস আমার নেই।”

“আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না? এভাবে জীবনযাপনের অভ্যেস তো আপনার নেই।”

স্বচ্ছ শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
“কষ্ট একটু হয়। কিন্তু শান্তি হয় যে নিজে কিছু করছি। আগে যা মন চেয়েছে তাই করেছি কিন্তু এই শান্তি আর আত্মবিশ্বাস কখনো উপলব্ধি করতে পারিনি।”

মোহ স্বচ্ছের উল্টো আইডিকার্ড সোজা করে দিয়ে বলল,
“আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যখন তখন বিস্ফোরণ ঘটাবেন। কেমন যেন লাল হয়ে গেছে।”

হঠাৎ স্বচ্ছের মুখে ফুঁ দিয়ে দেয় মোহ। চোখ বুঁজে নিয়ে স্বচ্ছ অনুভব করে তার উত্তপ্ত মন শীতল হয়ে যাচ্ছে। এরপর মোহ বলে,
“আমি আসি তবে।”

মোহ স্বচ্ছকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যায় অফিসের গার্ডেন থেকে। অফিসে ফিরে আসে স্বচ্ছ।

তখন প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। সকলে অফিস থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য নিজের ডেস্ক গুছিয়ে নিয়েছে। স্বচ্ছও ড্রয়ারে নিজের কাজের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রেখে মোহের দেওয়া টিফিনবক্সের ব্যাগ হাতে নেয়। বাড়ি যেতে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসেন মি. মুহিবও। সবাইকে বিদায় জানাতে থাকেন। এরপর স্বচ্ছের দিকে তাক করে এগিয়ে এসে জানতে চেয়ে বসেন,
“মি. স্বচ্ছ! সকালে মিটিং শেষে একটা মেয়েকে দেখলাম আপনার সাথে গার্ডেনে। কে হয় উনি আপনার?”

স্বচ্ছ হতবাক হয়। এরপর মাথা গরম হতে শুরু করে। এই লোকটার নজর থেকে কিছুই এড়ায় না। নিজের রাগ চেপে উত্তর দেয়,
“আমার হবু স্ত্রী।”

মি. মুহিব আরো আগ্রহ প্রকাশ করে বললেন,
“ওহ হো! তো কবে বিয়ে করছেন?”

“সামনের সোমবারে।”

মি. মুহিব মুচকি হেসে বলেন,
“ভালো, ভালো। বেস্ট অফ লাক।”

দ্রুত বাইরে চলে এলো স্বচ্ছ। মি. মুহিবের নজর যে ভালো নয় সেটা সে হারে হারে টের পেয়েছে। মোহের প্রসঙ্গ তোলাতে বিষয়টা তার কাছে গলার কাঁটার মতো বিঁধে গিয়েছে। এই রাগটাকে উপড়ে ফেলার মতো উপায় সে খুঁজে পাচ্ছে না। অসহ্য অনুভূতি ঘিরে ধরল তাকে।

চলবে…