#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪ [দ্বিতীয় খণ্ড]
সবেমাত্র নিজের স্টাডি টেবিলে গরম কফির কাপটা রাখল সৌমিত্র। পাশে থাকা ফোনটার দিকে নজর গেলে খেয়াল করল তার বন্ধু রাফি অনবরত তাকে কল দিয়ে চলেছে। এক পর্যায়ে কল রিসিভ করতেই রাফি বলে বসল,
“কিরে, কোথায় তুই? দেখা কর। আমরা সবাই বাইরে আছি। সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছি না বেশ কয়দিন!”
“আমি তো এখন বের হতে পারছি না। অন্য কোনোদিন প্ল্যানিং কর।”
সৌমিত্রের এমন জবাব যেন আশা করেনি তার কোনো বন্ধুই। যেই সৌমিত্র সকলকে আগে ডেকে ডেকে রাত বিরাতে আড্ডা দিতো সে কিনা আজ মানা করছে। ভাবা যায়? রাফি ফের বলল,
“আরে আজকের ট্রিট আমি দেব। চলে আয় না! তুই ছাড়া জমে না।”
সৌমিত্র চিন্তিত হয়ে বলল,
“এক্সামের ডেট দিয়েছে। এবার আমাদের পাশ করতেই হবে। তোরা কী করবি জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা আমার মূল লক্ষ্য। আড্ডা অন্য কোনোদিন হবে। আমি রাখছি।”
রাফি হতভম্ব হয়ে শুধাল,
“ভাই তোর কি কিছু হয়েছে? তোকে চিনতে পারছি না। তুই আমাদের সৌমিত্র?”
সৌমিত্র হেসে ফোনটা কেটে দেয়। নিজের মোটা মোটা বই, গাইড আর নোটস্ এর দিকে তাকায়। সিলেবাস দীর্ঘ। তার মাঝে আত্মবিশ্বাস শূন্য। সে শুধুই মোটামুটি রেজাল্ট নিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তাও যেন এক কঠিন যুদ্ধ মনে হচ্ছে। নিজের বড়ো ভাইয়ের মতো ভালো স্টুডেন্ট কোনোকালেই ছিল না সে। না ছিল কখনো সিরিয়াস। এসব ভাবতে ভাবতে কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিজের ফোন থেকে মিস গোলাপির নম্বর ডায়াল করে ফেলল সে। আজ প্রায় দুই দিন পর কল দিয়েছে সৌমিত্র তানিয়াকে। এই কাজটা তার ইচ্ছাকৃত। সে দেখতে চেয়েছিল মেয়েটা তাকে নিজ থেকে কল করে কিনা। কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রথমবারেই কলটা রিসিভ করে বসল তানিয়া। সৌমিত্র বেখেয়ালে বলে ফেলল,
“এত মিস করছিলেন আমাকে? তাহলে কলটা করে নিতে পারতেন মিস গোলাপি?”
সৌমিত্রের এহেন কথায় ওপাশ থেকে তানিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আপনাকে কে বলল যে আমি আপনাকে মিস করছিলাম?”
“করছিলেন না? তাহলে ফোন ধরতে এতটা কম সময় লাগল কেন? মনে হচ্ছিল ফোনের কাছে বসে আমার কলের অপেক্ষা করছিলেন।”
তানিয়া খানিকটা ভড়কালেও নিজেকে ধাতস্থ করে ফেলল। আর কিছুটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমার হাতেই ফোন ছিল। ফেসবুকে ছিলাম আমি।তাই কল করার সাথেই ধরতে পেরেছি।”
সৌমিত্র তানিয়ার চেয়েও দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“কিন্তু সেখানে তো আপনি পাঁচ ঘণ্টা আগে এক্টিভ ছিলেন লাস্ট। এর মাঝে আর একবারও এক্টিভ হোন নি।”
ধরা খেয়ে যেন মুখ ভোঁতা হলো তানিয়ার। খুব রাগ হলো সৌমিত্রের প্রতি। এভাবে গোয়েন্দাগিরি করতে হবে কেন? তবুও পুরোপুরি সে মচকালো না। বলল,
“হোয়াটসঅ্যাপে ছিলাম। কিছু কাজ ছিল তাই ওখানে এক্টিভ ছিলাম।”
“ওখানেও আপনি লাস্ট পাঁচ ঘণ্টা আগেই এক্টিভ ছিলেন মিস গোলাপি।”
তানিয়া রেগেমেগে দাঁত কিড়মিড় করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনার সমস্যা কী? আপনি আমাকে স্টক করেন?”
“হুমম মাঝে মাঝে করি। কোনো অন্যায় করে ফেলেছি আপনাকে ধরে? সত্যি করে বলুন তো মিস করেন নি আমাকে?”
তানিয়া চোখমুখ খিঁচে নাকচ করে ফেলল,
“বলব না।”
সৌমিত্র তীব্র হতাশা নিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“হায়রে! নারী মন আমার পড়াশোনার চেয়েও বেশি জটিল কেন?”
তানিয়া মৃদু হাসে। সৌমিত্র প্রসঙ্গ কাটিয়ে বলে উঠল,
“আমার বন্ধুরা ফোন করেছিল। বাইরে যেতে বলছে। অনেকদিন আড্ডা দেওয়া হয়না।”
“এখন নিশ্চয় বাহিরে যেতেই রেডি হচ্ছেন?”
“না। পড়াশোনা করার জন্য রেডি হচ্ছি।”
আচানক মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল তানিয়ার। ছেলেটা সত্যিই বেশ পাল্টেছে। যার জীবনে সিরিয়াসনেস বলতে কোনো বিষয় ছিল না সে এখন নিজেকে নিয়ে বড্ড সিরিয়াস। তার মূল কারণটা বোধহয় তানিয়া নিজেই। তানিয়া প্রত্যুত্তরে বলল,
“বেশ উন্নতি হয়েছে তো আপনার।”
“আগে নিজের জীবনে বিশেষ কোনো লক্ষ্য ছিল না। ভাবতাম এভাবেই চলতে চলতে জীবন ঠিক কেটে যাবে। কিন্তু পথভ্রষ্ট ছেলেটা হঠাৎই লক্ষ্য খুঁজে পেয়ে গেল।”
তানিয়া মনের গহীনে কৌতূহল জন্ম নিলো। জানতে চেয়ে বসল,
“কী লক্ষ্য?”
“আপনি।”
সৌমিত্র তার উদ্দেশ্য জানাতে এক সেকেন্ডও সময় নেয়নি। কিন্তু তা শুনে যেন থমকেছে তানিয়া। তার ভেতরে যেই অনুভূতির মেলা নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে একেবারে জব্দ হয়ে গিয়েছিল সেই মেলা আবার তার মন জুড়ে বসেছে। তানিয়া আর অতীত নিয়ে ভয় পেতে চায়না। সে নিজেকে সামলে ব্যগ্র হয়ে ডাকে,
“শুনুন।”
“শুনি নি কখন বলুন?”
সৌমিত্রের জবাবে তানিয়া থেমে থেমে বলল,
“আমি সত্যিই আপনাকে অনেক মিস করছিলাম। এমনটা যেন কখনো করবেন না। এই নম্বর থেকে যেন প্রতিদিন দুবেলা কল আসে।”
শেষ কথাগুলো জোরে বলেই কল কেটে দিল তানিয়া। তার বেশ অস্থির লাগছে। দ্রুত বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে তার পাশের গল্পের বই মুখে চাপা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করতে চাইল সে।
সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলে স্বচ্ছকে দেখেই মোহের হাত ছেড়ে স্বচ্ছের দিকে দৌড় লাগালো ইথান। স্বচ্ছ কোনো কথা না বলে তাকে কোলে তুলে ইথানের গালে চুমু দিয়ে বাইকের সামনে বসায়। মোহ তার সামনে এলেও প্রতিদিনের মতো তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না স্বচ্ছ। মোহ তাকে একবার পরখ করে নিয়ে বলল,
“আপনি কোনো বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করছেন?”
স্বচ্ছ গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়,
“না তো।”
“মনে তো হচ্ছে। আজকে গলার টাই ঠিক মতো বাঁধেন নি। যেই লোক ঘড়ি পরতে ভোলে না সে আজ ঘড়ি পরতে ভুলে গেছে।”
স্বচ্ছ বাইকে বসতে বসতে বলল,
“ওসব এমনিই। বাইকে বসো। লেট হয়ে যাচ্ছে।”
দেরি হবার কথা শুনে মোহ কথা বাড়ায় না। তবে রাস্তায় যেতে যেতে আরেকটি বিষয় নজরে এলো মোহের। যেই লোক সারারাস্তা ইথান আর তার সাথে কথা বলতে বলতে যায় সেই লোকটি আজ ভীষণ চুপচাপ। মোহের বিষয়টা সুবিধার লাগল না। ইথান নেমে সুন্দর করে টাটা দিয়ে স্কুলে ঢুকে গেল। মোহ স্বচ্ছের পানে মনোযোগের সহিত তাকাল। হঠাৎ দেখল স্বচ্ছ ঘামছে। অথচ আজকে আবহাওয়া বেশ সুন্দর। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। অতিরিক্ত গরম ভাবটা নেই। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে মোহ তার রুমাল দিয়ে স্বচ্ছের কপালে ঠেকিয়ে মুছে মুছে শুধাল,
“কোনো সমস্যা হয়েছে বাড়িতে বা অফিসে?”
স্বচ্ছ দ্রুত মোহের রুমাল দিয়ে মুছে দেওয়া হাত ধরে ছাড়িয়ে নিয়ে উগ্রভাবে বলে ওঠে,
“আমার অফিসের আশেপাশে আর কখনো যাবে না।”
চরম অবাক হয় মোহ। কী হলো সে বুঝে উঠতেই পারল না। বেশ মলিন হয়ে প্রশ্ন করল,
“কিন্তু কেন? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
ফের স্বচ্ছ কড়া জবাবে বলল,
“আমি মানা করেছি তোমাকে মোহ। তুমি কোনোদিন সেখানে যাবে না। যাবে না মানে যাবেই না। আমি মরে গেলেও না।”
মোহ এবার বিস্ময়ে ও রাগে নিজেও জোরে বলে উঠল,
“কী বলছেন এগুলো আপনি? নিজের মুখ সামলান। কী হয়েছে আপনার?”
স্বচ্ছ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালায়। নিজের ভেতরের ক্ষোভ রূপী আগুনকে দমনের প্রচেষ্টা করে। মুহিবের প্রতি রাগটা সে মোহের প্রতি ঝাড়তে চায় না। বড়ো শ্বাস নেয় সে। অতঃপর বলে,
“তোমার উপর কেউ সামান্যতমও খারাপ নজর দিক সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। আমি নিতেই পারব না। হয় তাকে মে/রে ফেলব নয়ত আমার কিছু একটা হয়ে যাবে।”
ঘোলাটে বিষয়টা সামান্য হলেও মোহের কাছে পরিষ্কার হয়। স্বচ্ছ বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ওই অফিসে আমি বেশিদিন থাকতে চাইনা। অন্য কোথাও চাকরি পেলে ওটা ছেড়ে দেব। ব্যস…!”
মোহ এই মুহূর্তে স্বচ্ছকে শান্ত করার জন্য বলে,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি সেখানে যাব না আর।”
স্বচ্ছের ভেতরটা স্থির হতে থাকে৷ তৎক্ষনাৎ একটি উবার থেকে গাড়ি আসে। চৌদ্দ কিংবা পনেরো বছর বয়সী একটি মেয়ে নামে সেখান থেকে। তার সঙ্গে গাড়ি থেকে নামলেন একটি ভদ্রলোক। স্বচ্ছের সেসব দিকে কোনো খেয়াল ছিল না। কিন্তু ভদ্রলোকটি তাকে চিনতে পেরে ডেকে ফেললেন।
“মি. স্বচ্ছ!”
চেনা কণ্ঠস্বরে যেন রগ খাঁড়া হয় স্বচ্ছের। ঘাড় ঘুরিয়ে মি. মুহিবকে দেখে কিছুক্ষণ আগের পুরোনো রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চোখ ঘুরিয়ে স্বচ্ছ মোহকে দেখে। স্বচ্ছ দ্রুত বাইক থেকে নেমে মোহের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে দমিয়ে বলল,
“হোয়াট অ্যা কয়েন্সিডেন্স।”
“আসলে মেয়েকে ছাড়তে এলাম স্কুলে। ওর মা আজকে একটু অসুস্থ। আপনি অফিসে যাবেন না?”
স্বচ্ছ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“জি। যাওয়ার জন্যই বেরিয়েছি।”
মি. মুহিব খেয়াল করেছেন মোহকে প্রথম। উবারের ভেতর থেকে মোহের দিকে নজর গিয়েছে উনার। মেয়েটা বেশ সাদামাটা সুন্দর। তবুও উনার চোখ চলে গিয়েছে। তাই তিনি হেসেই বললেন,
“আপনার পেছনে কি আপনার উডবি ওয়াইফকে লুকিয়ে রেখেছেন? পরিচয় করাবেন না?”
মোহের স্বচ্ছের হাবভাব, চোখমুখ দেখে বুঝতে বাকি নেই এই লোকটার জন্যই মেজাজ ভালো নেই স্বচ্ছের। সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,
“আমি সবার সঙ্গে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা। ইন্ট্রোভার্ট তো তাই! কিছু মনে করবেন না দুঃখিত।”
মোহের কথাকে কেন্দ্র করে স্বচ্ছ মি. মুহিবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“শুনলেন তো? ও কমফোর্ট ফিল করছে না।”
মোহ এবার হাঁটা দিলো সামনের দিকে পেছন থেকেই একবার তাকে পরখ করলেন মি. মুহিব। এমন সময় স্বচ্ছের আকস্মিক প্রশ্ন বিব্রত করল উনাকে।
“আপনারও তো মেয়ে আছে তাই না স্যার?”
মি. মুহিব হালকা কেশে বললেন,
“জি দেখলেনই তো। ক্লাস নাইনে পড়ছে।”
স্বচ্ছ হালকা হাসি টেনে বলল,
“যুগ তো ভালো নয়। অনেক খারাপ নজর পড়ে তাদের উপর। সাবধানে রাখবেন। অফিসে দেখা হবে।”
প্রকৃতপক্ষে স্বচ্ছের হাসিটা আসছে না। হাত মুঠো করছে বারবার। তাড়াতাড়ি নিজের বাইকে বসে অফিসের দিকে রওনা দিলো সে। মি. মুহিব খানিকটা কনফিউজড হলেন। স্বচ্ছ কি বাঁকাভাবে তাকে কোনো ইঙ্গিত দিলো? মনে মনে খানিকটা রাগ পুষলেন তিনি। পরিকল্পনা করলেন স্বচ্ছকে কীভাবে হাতের মুঠোয় করবেন।
অফিসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বচ্ছের ডাক পড়ল। হতবাক হয় স্বচ্ছ। মেইন কেবিনে ঢুকে অন্বেষাকে দেখে আরো একদফা অবাক হয়। অন্বেষা তাকে দেখেই বলে ওঠে,
“একটা কাজে এসেছিলাম। কাজটা শেষ। তাই আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম।”
স্বচ্ছ নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
“ইয়েস? এনি রিজন?”
“বিকজ আই এম ইম্প্রেসড।”
স্বচ্ছ ভ্রু কুঁচকায় এবং আবারও বলে,
“কেন?”
“আপনার কাজ আমাকে মুগ্ধ করেছে। লাস্ট যেই প্রজেক্ট ডিল ছিল বিদেশী ক্লায়েন্টের সাথে ওই প্রজেক্ট তো আমি হ্যান্ডেল করছিলাম। কিন্তু সেদিন ডিলের সময় থাকতে পারিনি। আমার পার্টনার ছিল তার এক্সপ্লেইন করতে প্রবলেম হচ্ছিল। কিন্তু আপনি নাকি সঠিকভাবে এক্সপ্লেইন করেছেন তাদের। বলা যায় ডিল ফাইনাল করার ক্রেডিট আপনার ছিল। দ্যাটস্ হোয়াই আই এম ইম্প্রেসড।”
“থ্যাংক ইউ।”
অন্বেষা এবার কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে বলল,
“ক্যান আই আস্ক আ পারসোনাল কুয়েশ্চন?”
স্বচ্ছের কিছুটা সংকোচবোধ হলো। তবে মুখে তেমন কিছু বলল না।
“সিওর। বাট আমি উত্তর দেব কিনা সেটা প্রশ্নের উপর ডিপেন্ড করবে।”
“বিয়ে কবে করছেন?”
কিছুটা অপ্রস্তুত হলো স্বচ্ছ। অন্বেষার এমন প্রশ্নের মানে খুঁজে পেল না। তবুও উত্তর দিলো,
“সোমবারে।”
অন্বেষার ভেতরে ভেতরে কোথাও একটু হলেও ধাক্কা লাগল যেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। সে স্বচ্ছকে পছন্দ করত। এখনো হয়ত করে। একটা মানুষকে ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়। অন্বেষা শান্ত গলায় বলল,
“ডোন্ট মাইন্ড বাট আমি আপনার বিয়ের জন্য গিফট হিসেবে এডভান্স স্যালারির ব্যবস্থা করতে চাই।”
স্বচ্ছের বিস্ময় যেন ফুরাচ্ছেই না। সে হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“স্যরি, আপনি এমনটা কেন করবেন?”
“বিকজ, আই এম দ্যা বস। আর সে হিসেবে আমার উচিত প্রতিটা এমপ্লয়ির সুবিধা অসুবিধার দিকে নজর রাখা। আমার ভাইয়াও সেটাই করে। কোনো এমপ্লয়ির অনুষ্ঠান থাকলে তাকে এডভান্স দেওয়ার চেষ্টা করে। আমিও সেটাই করতে চাই।”
স্বচ্ছ নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকেই বলল,
“আপনার কোম্পানি জয়েন করেছি এক মাসও হয়নি। তাই এডভান্স আহিয়ান স্বচ্ছ গ্রহণ করতে রাজি নয়।”
অন্বেষা হতবাক হয় বটে। সে স্বচ্ছের বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত। প্রচণ্ড এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও মাঝে মাঝে স্টক করে ফেলে স্বচ্ছকে। তবুও কিনা সে স্যালারি গ্রহণ করতে রাজি নয়! এত এটিটিউড? তবে অন্বেষা তো তারও ঊর্ধ্বে! সে মুখ ফসকে বলে ফেলল,
“একটা পারসোনাল কথা না বললেই নয় যে আমার জন্যই লাভ লাইফ ধ্বংস হতে বসেছিল। তাই এই সামান্য গিফট যেটাও কিনা আপনারই প্রাপ্য সেটা দিয়ে হেল্প করতে চাইছি। আপনি কি আমাকে গিল্টি ফিল করাতে চাইছেন?”
“তবুও পুরো মাস কাজ না করে আমি স্যালারি নিতে পছন্দ করব না।”
জেদ ধরে রইল স্বচ্ছ। অন্বেষা তখন বলল,
“প্লিজ, আই ইনসিস্ট!”
স্বচ্ছ একরোখা হয়ে থাকতে পারল না৷ সে মানে তার টাকার দরকার। সামনে বিয়ে। নিজে কিছুই করবে না স্ত্রীর জন্য? হতে পারে না। সে সৌমিত্রের ন্যায় মায়ের কাছে টাকাও চাইতে পারে না। প্রচণ্ড লজ্জা পায়। খারাপ লাগে। অনেকটা ভেবে সে বলল,
“ওকে। আমি অর্ধেক স্যালারি নিতে রাজি আছি। বাট পুরোটা নয়।”
অন্বেষা হাফ ছেড়ে বলল,
“তাই হবে। আর পারসোনাল কথা বলার জন্য অন্বেষা স্যরি বলছে। আমি বলেছিলাম এখানে আমি প্রফেশনাল থাকব। তা ভঙ্গ করলাম। আর করব না।”
স্বচ্ছ মাথা নাড়ায়। সেও চায়না এসব নিয়ে আর কোনোরকম কথা হোক।
আজ সকালটা স্নিগ্ধ। আশপাশটা বেশ জমজমাট। সূর্য মেঘের কোণে লুকানো। রোদ্দুর কাঁচা হলুদ রঙা শাড়ি পরিহিত মোহকে ছুঁতে পারেনি। ছুঁয়েছে মেঘলা আকাশ। সেই প্রথম দিনের মতো! স্বচ্ছ ও মোহের সাক্ষাৎকারের প্রথম দিন! হলদে রঙের শাড়িতে খয়েরী পাড়। ফারাহর দিনরাত জেগে খুশিতে নাচতে নাচতে একপ্রকার ডিজাইন করেছে নিজহাতে। তা মোহের গায়ে কী সুন্দর মানিয়েছে সেটাই চোখ ভরে দেখলেন মোহের মা। মিসেস সুফিয়ার নয়ন তখনও মেয়ের প্রতি মায়ায় আবিষ্ট। সকাল সাতটা বাজে এখন। এই সকালে ছোটো করে মোহের গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। মোহের আঁখি দুটো ঘুমে এখনো ছোটো ছোটো। সারারাত এই ঘুমটা কোথায় হারিয়েছিল ভাবছে সে। কত চেষ্টা করেছিল সে সারারাত ঘুমাতে। ঘুমই আসেনি। মোহ সেই ছোটো চোখে গাঢ় করে কাজল পরেছে। তানিয়া কী সুন্দর ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক দিয়ে দিয়েছে! লম্বা চুল ছেড়ে রেখেছে। মিসেস সুফিয়া মোহের চুলে হাত বুলিয়ে বেলি ফুলের মালা আঁটকে দিলেন। আর বললেন,
“মা তো আসতে পারল না। বাসে, ট্রেনে একটানা বসে থাকতে পারে না জেনেও কত জেদ ধরল যে নাতনীর বিয়েতে আসবেই। কিন্তু তোর বাবা মানা করে দিলো। কিন্তু মুখ ফুলিয়ে নাকি বসে আছে৷ হলুদ শেষে একটু তোর দাদিজানকে কল করে কথা বলে নিস।”
মোহ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। তানিয়া হাসতে হাসতে মোহের দুটো হাতে গাদা ফুলের মালা পেঁচিয়ে আঁটকে দিয়ে বলল,
“তোকে কেউ বিয়ে করবে না বলতে বলতে আজকে নতুন বউ হয়েই যাচ্ছিস।”
মোহ ছোট্ট করে তানিয়ার হাতে চিমটি কেটে উত্তর দিলো,
“তুই নিজেও লাইনে আছিস। আমাকে শরম দিস না। তোর শরমে পড়তে সময় লাগবে না।”
ইথানই সর্বপ্রথম হলুদ লাগালো তার মাকে। তাও প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে। মোহের কপাল আর এক গালে হলুদ মাখিয়ে যেন বিশ্বজয়ের হাসি দিলো। মোহ নিজেও ইথানের নাকে হলুদ ছোঁয়াতেই খিলখিল করে হেসে উঠল সে। এরপর মিসেস সুফিয়া এলেন। খুশি আর কষ্ট মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করতে না পেরে মেয়ের হাতে হলুদ লাগানোর সাথে সাথে কেঁদে ফেললেন। মোহ মায়ের হাতটা ধরে ফেলল। তার ভেতরটাও ডুকরে ওঠে। মিসেস সুফিয়া বললেন,
“খুব একা হয়ে যাব। তুই থাকবি না, ইথান থাকবে না। কী করব বল তো? সময় পেলেই মায়ের কাছে চলে আসবি কিন্তু।”
“সময় না পেলেও সময় বের করে ছুটে চলে আসব মা। তুমি কান্না করো না। আমারও চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসছে।”
ব্যস…নিজেকে রুখতে সক্ষম হলো না মোহ। চোখ দিয়ে পানি বয়ে পড়ে গেল। তানিয়া দ্রুত তাকে থামাতে বলল,
“এই মাইয়া, কাজল দিয়েছিস না? কান্না থামা। থামা বলছি।”
মায়ের কান্না থামে। শেষদিকে আজহার সাহেব আসেন। অথচ মোহ জানে মানুষটা ঘুম সবার আগে ভেঙেছে। কিন্তু মোহের সামনে আসেনি কেন? আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে বলে? আজহার সাহেব বেশ যত্নের সাথে মেয়ের গালে হলুদ ছুঁইয়ে নরম কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“আমার মেয়ে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। আমার জীবনের সব সুখ তার জীবনে চলে যাক। সুখে থাক সবসময়।”
আরো কথা বলতে চেয়েছিলেন আজহার সাহেব। তবে গলা ধরে আসছে উনার। সব কথা বললেন না। মেয়েকে বুঝতে দিলেন না নিজের ভেতরের হাহাকার।
ছোটো আয়োজন তখন শেষের দিকে। মিষ্টি খাওয়াদাওয়া চলছে ছাঁদে। তখন নিচ থেকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেল মোহ ও তানিয়া। তানিয়া দ্রুত নিচে নজর দিতেই তার চোখ হলো ছানাবড়া। ছেলেপক্ষ নিজের সব লজ্জা ভুলে চলে এসেছে। নিচে রয়েছে স্বচ্ছ ও সৌমিত্র। তানিয়া দ্রুত মোহের নিকটে গিয়ে মোহের হাত ধরে বলল,
“তোর বরের ধৈর্যশক্তি এত কম! কেমন বিনা দাওয়াতে হাজির সকাল সকাল।”
মোহ চকিতে তাকায়। ধীর পায়ে হেঁটে রেলিং-এর ধারে গিয়ে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বচ্ছকে দেখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। এই প্রথম সে স্বচ্ছকে পাঞ্জাবি পরতে দেখেছে। দারুণ লাগছে এটা মানতেই হবে। কিন্তু লোকটির উদ্দেশ্য কী? এই সকালে হাজির কেন? হুট করেই স্বচ্ছ উপরের দিকে দেখলে সরে আসে মোহ। সে এত সহজে স্বচ্ছকে দেখা দিতে চায়না। এবার সকল স্তরের লাজলজ্জা ভুলে সৌমিত্র চিল্লিয়ে উঠে বলল,
“ও ভাবি! আমার ভাইরে দেখা দেন। আপনেরে দেখার জন্য যে ভাইয়ের পরাণ ছটফট করে। এক দফা, এক দাবি। মুখখানা না দেখালে নড়ব না গো ভাবি।”
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫ [দ্বিতীয় খণ্ড]
সকালবেলা পুরোপুরি ফ্রেশ হয়ে শাওয়ার সেরে নিজের ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসেছে অন্বেষা। আয়নায় তাকাতেই জ্বলে ওঠে আয়নার দুপাশের লাইট। জ্বলজ্বল করে ওঠে অন্বেষার ফর্সা মুখ। নিজের বাথরোবটা ভালো করে টেনে বেঁধে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে চুল শুকাতে আরম্ভ করল সে। কিন্তু সম্পূর্ণ কাজটা না সেরেই মেশিনটা বন্ধ করে আয়নায় ফ্যালফ্যাল করে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল। সবকিছু পানসে লাগছে তার। আজ সোমবার। অন্বেষা খুব করে অপেক্ষা করেছে এই দিনের। কিন্তু দিনটা যখন এলো তখন কিছু অযাচিত অনুভূতি তার আধুনিক মনের দরবারে ঠকঠকাতে থাকল। সব ভাবনা কাটিয়ে যখন নিজের মসৃণ ত্বকে দামি মশ্চরাইজার লাগাতে গেল তবুও থামল অন্বেষা। তার ড্রেসিংটেবিল ভর্তি প্রসাধনী। তবে এগুলো দিয়ে লাভ কী? মোহ মেয়েটা নিশ্চয় নিজেকে ফিটফাট রাখতে এতকিছু ব্যবহার করে না। তবুও প্রণয়ের সমুদ্রে সে ভাসছে তো!
এবার ফোনটা ধরল অন্বেষা। ইন্সটাগ্রামে ঢুকে চেক করল ফারাহর আইডি। নতুন কোনো পোস্ট নেই সেখানে। বেরিয়ে সৌমিত্রের ফেসবুক আইডিতে ঢুকল সে। সৌমিত্রের সঙ্গে অ্যাড না থাকলেও ছেলেটার আইডি পাবলিক করা। তাই খুব সহজেই অন্বেষার নজরে এলো রিসেন্ট পোস্ট। সৌমিত্র ও স্বচ্ছ হলুদ রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা পরেছে। স্বচ্ছকে অমায়িক লাগছে দেখতে। এলোমেলো থেকে প্রচণ্ড পরিপাটি সেজেছে সে। হাতে ঘড়ি পরে স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে ভাইয়ের সাথে। মুখে অদ্ভুত হাসি। সবটায় মোহের জন্য বরাদ্দ। তবে অন্বেষার মাথায় একখানা প্রশ্ন এলো। স্বচ্ছ আজকেও অফিসের ছুটি নেয়নি। আজ তো তার বিয়ে। তবুও ছুটি নিলো না সে। কারণ সে বিয়ের পরে কয়েকদিন ছুটি চায়। কিন্তু কেন? এই বিশেষ দিন সে ছুটি নিলো না কেন? নিশ্চয় চাকরি হারানোর ভয়ে? কারণ সে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। অন্বেষার ধ্যান ভাঙে। গম্ভীর গলায় বলে,
“দ্যা ডোর ইজ ওপেন।”
অন্বেষার ভাবি গ্রীণ টি সমেত ঘরে ঢুকল। অন্বেষা ফোনটা রেখে বলল,
“তোমার চা দেওয়ার সময়ে কখনো ভুল হয়না।”
ভাবি বেশ নরম সুরে জবাব দিলেন,
“হওয়া উচিতও নয়। এখন তো আবার বিজনেস ওম্যান হয়েছ। বিজি অ্যান্ড টাইড শিডিউল। তাই সবকিছু সময় মতো করা তো দরকারই।”
অন্বেষা নিশ্চুপ রইল। নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রেখে হেয়ার ড্রায়ার অন করল সে। তার ভাবি বসে রইল বিছানায় পাশেই। অন্বেষা উপলব্ধি করতে পারল তার ভাবির কোনো কথা বা কাজ আছে। ভাবতে না ভাবতেই ভাবি বলে বসল,
“শুনলাম স্বচ্ছ বলে ছেলেটি নাকি তোমার অফিসে জব করছে?”
কথা শুনে হেয়ার ড্রায়ার বন্ধ করল অন্বেষা। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“ইয়াপ। হি ইজ এন ইন্টেলিজেন্ট পারসন। মেড ফর মাই কোম্পানি!”
“তোমার ভাইয়া বিষয়টা জেনে গতকাল রাতে ভীষণ রাগারাগি করেছে। তোমার ঘরে আসতে চেয়েছিল কিন্তু তুমি ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছিলে।”
অন্বেষা নিজেকে শান্ত রেখে চা খেতে খেতে হেসে বলল,
“এতে রাগারাগি করার কী আছে? আই থিংক ভাইয়া আজকাল তোমার থেকে ভালোমতো কেয়ার আর ভালোবাসা পাচ্ছে না। তাই ছোটো বিষয়ে মেজাজ হারাচ্ছে।”
অন্বেষার ভাবি বেশ সিরিয়াস হয়েই বলল,
“বিষয়টা নিয়ে মজা করো না অন্বেষা! এমনিতে ছেলেটার উপর তোমার ভাই প্রচণ্ড রাগান্বিত। শুধু তোমার জন্যই সে ছেলেটার বিরুদ্ধে কিছু করেনি। আচ্ছা, তুমি কি এখনো তার প্রতি দুর্বল?”
সঙ্গে সঙ্গে তেতে উঠল যেন অন্বেষা। কথার পৃষ্ঠে দ্রুত উত্তর দিয়ে বসল,
“নো, নো। নো চান্স। বাট আই লাইক হিম অ্যাজ আ এমপ্লয়ি।”
অন্বেষার ভাবি এবার যাওয়ার জন্য উঠলেন। কী যেন একটা ভেবে বললেন,
“আরেকটা কথা! তোমার ভাইয়ার ছেলে দেখছে। সে ভাবছে তুমি স্বচ্ছের জন্য এখনো ভাবো। তাই সেই ভাবনা ছাড়াতে সে ছেলের খোঁজ করছে।”
অন্বেষা বেশ প্রফুল্ল হয়ে জবাব দিলো,
“বাট এবার আমি আর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের দিকে পা বাড়াব না। আমি লাভ ম্যারেজ করতে চাই।”
অন্বেষার কথাতে বিষম খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন ভাবি। বুঝে উঠতে পারলেন না অন্বেষার মনের গহীনে থাকা জল্পনা।
অনেকক্ষণ দরজার বাইরে থাকা সৌমিত্রের এক স্লোগান মোহের মায়ের কান অবধি পৌঁছায়। কেউ দরজা খুলছে না দেখে তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর থেকে তিনি এগোলেন। দরজার কাছাকাছি যেতেই হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে পড়ল তানিয়া। মিসেস সুফিয়াকে ধরে বলল,
“আন্টি কোথায় যাচ্ছেন?”
মিসেস সুফিয়া ঝাঁজালো সুরে বললেন,
“কোথায় যাব আর? জামাই এলো মনে হচ্ছে। তোমাদের কারোর তো হুঁশ নেই। দরজায় কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা খেয়াল আছে?”
“আপনি ওদের দরজা খুলে দিলে কিন্তু ঠিক হবেনা আন্টি। ওরা কেন সকাল সকাল মেয়েদের অনুষ্ঠানে আসতে গেল? এভাবেই নতুন বউয়ের মুখ দেখে চলে যাবে? এটা কিন্তু হবে না।”
মিসেস সুফিয়া অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন,
“তো কী করতে চাইছ তোমরা শুনি?”
তানিয়া নিজের ছোটো মুখটা আরো কাচুমাচু করে বলল,
“দেখুন কেমন অভদ্র ছেলের মতো বাইরে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। ভেতরে ঢুকলে আরো ঝামেলা করবে। ওদের চলে যেতে বললে ভালো হয়না? এই অভদ্রতা করার একটা বিহিত তো হওয়া উচিত।”
মিসেস সুফিয়া খানিকটা ভেবে বুঝলেন তানিয়ার কথা মন্দ নয়। আসলেই ভীষণ বেয়ারা ছেলে দুটো। শিক্ষা হওয়া উচিত। মিসেস সুফিয়া রুক্ষ ভাবমূর্তি নিতে দরজা খুলে বাড়ির সামনের ছোটো ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এই ভদ্রলোকের বাড়ি এটা। আর একবার চিল্লাচিল্লি করলে খুব খারাপ হবে। কী পেয়েছ তোমরা হ্যাঁ? জামাই আর জামাইয়ের ভাই বলে তোমাদের মাফ করব?”
স্বচ্ছ বেশ গম্ভীর গলায় সালাম জানানোর পর সৌমিত্রও খানিকটা ভদ্র ভাব এনে সালাম দিলো মিসেস সুফিয়াকে। হঠাৎই সকালের সুমিষ্ট সূর্যের রোদের মাধ্যমে স্বচ্ছ দেখতে পেল মেয়েলি এক ছায়া। উপরে ঝটপট করে নজর দিতেই সরে গেল সেই মায়াবিনী। এক ঝলকে শুধু দেখল হলুদ রঙের শাড়ির আঁচল। স্বচ্ছ বেশ ভালোভাবেই বুঝে যায় তার নিজস্ব রমণী তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। একটা স্মিত হাসি দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে নিজের হবু শাশুড়ীর পানে চেয়ে বলল,
“আপনি মাফ না করলে কে আর মাফ করবে? নিজের হবু বউকে দেখতে বহু সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছি শাশুড়ি আন্টি। খালি হাতে হবু জামাইকে ফিরতে দিবেন না প্লিজ।”
ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন মিসেস সুফিয়া। ছেলের লাগামহীন কথায় বিড়বিড়িয়ে বললেন,
“এ কেমন নির্লজ্জ জামাই!”
দরজার সামান্য ফাঁকা সরু জায়গা থেকে গোলাপ বেরিয়ে আসতেই কিছুটা হকচকিয়ে উঠলেন মিসেস সুফিয়া। সকালের লাল তাজা গোলাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এটা যে স্বচ্ছের কাজ তাও মিসেস সুফিয়া বেশ বুঝতে পারলেন। ছেলেটা আবার তার মন গলাতে চাইছে। কিন্তু এবার বেশ শক্ত থেকে মিসেস সুফিয়া গর্জে উঠলেন,
“একবারে বিয়ের সময় পরিবার সাথে করে নিয়ে আসবে। এখন যাও।”
পরপর আরো দুটো গোলাপ বেরিয়ে এলো সেই দরজার ছোটো ফাঁক থেকে। স্বচ্ছ বলল,
“দিস আর ফর মাই এনাদার মাদার।”
মিসেস সুফিয়া নীরব রইলেন। ছেলেটা প্রচণ্ড ধূর্ত। কী সুন্দর কথা বলে মন গলাতে চাইছে! মিসেস সুফিয়ার নীরবতা দেখে স্বচ্ছ ফুলগুলো নিজের কাছে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জীবনের প্রথম স্যালারি পেয়ে দুজন মায়ের জন্য দুটো উপহার কিনেছি। প্রথম মা তো গ্রহণ করল কিন্তু আরেক মা আমাকে একবারে রিজেক্ট করে দিলো! কী আর করার! আহিয়ান স্বচ্ছের কপালই খারাপ।”
মিনিট দুয়েক পরও ওপরপাশ থেকে যখন কোনো আওয়াজ এলো না সত্যিই কিছুটা হতাশ হলো স্বচ্ছ। কিন্তু তাদের বিস্মিত করে দিয়ে মিসেস সুফিয়া দরজা খুলে দিলেন। হাসিতে উজ্জ্বল হলো স্বচ্ছের চেহারা। হলুদের জামাকাপড়ে যেন আরেকটু বেশিই মানিয়ে গেছে তাকে। স্বচ্ছ মিসেস সুফিয়ার হাতে গোলাপ ধরিয়ে দিলো। মিসেস সুফিয়ার যেন মায়া পড়ে গেছে স্বচ্ছ ছেলেটার প্রতি। মায়াও অদ্ভুত এক জিনিস! মানুষ ভেদে মায়া পড়েনা। সময় ভেদেও পড়েনা। তাদের আচরণ ভেদে মায়া পড়ে। মিসেস সুফিয়া কড়া গলায় বলে উঠলেন,
“মন গলানোর কাজ ভালোই শিখেছ।”
স্বচ্ছ সাবলীলভাবে প্রত্যুত্তর করে,
“মন গলানো নয়। এটা আমার অনুভূতি। মায়ের প্রতি সন্তানের অনুভূতি। আপনি তো আমার মায়েরই মতো একজন। আমার প্রিয়তমার মা। আমি মনে করি বিয়ে হওয়া মানে শুধু সেই নির্বাচিত ছেলে আর মেয়ের মাঝে সম্পর্ক নয়। বিয়ে মানে আরেকটা পরিবার পাওয়া। আর সেই পরিবারের মানুষজনও তখন নিজের লাগে৷ একটা সময় ছিল আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতাম না। প্রচণ্ড চেপে রাখার চেষ্টায় থাকতাম। নিজেকে পারলে নিজের থেকেই লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু আমার শাশুড়ী আন্টির মেয়ে আসার পর কেমন কেমন হয়ে গেছি। নিজের ব্যাপার চাপিয়ে রাখা তো দূর দিনদিন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছি। সত্যি কিনা বলুন? আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিতে পারি যে আমার এই বেহায়াপনা দেখে নিশ্চিত আপনি একশটার বেশি গালি দিয়েছেন নিজের হবু জামাইকে।”
নিজে আর না হেসে পারলেন না মিসেস সুফিয়া। সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,
“এবার তো আমরা যেতে পারি তাই না আন্টি?”
মুহূর্তের মধ্যেই স্বচ্ছ আর সৌমিত্রের কান টেনে ধরেন মিসেস সুফিয়া।
“আর এইযে সকাল সকাল বাড়ির সামনে এত চেঁচামেচি করলে তার শাস্তি কী হবে?”
স্বচ্ছ চোখমুখ খিঁচে কোনোরকমে বলে দিলো,
“আমি তো টু শব্দও করিনি। সৌমিত্র করেছে। ওকে ধরে রাখুন। আমি ইনোসেন্ট। ছেড়ে দিন প্লিজ! আমি না আসা অবধি ধরে শাস্তি দিতে থাকুন কোনো অসুবিধা নাই।”
মিসেস সুফিয়া ইচ্ছে করেই ছাড়লেন স্বচ্ছকে। সৌমিত্রের এই মুহূর্তে নিজের জীবনটা বৃথা মনে হতে লাগল নিজের ভাইয়ের এরূপ কথা শুনে। মানুষ বোধহয় প্রেম করেও এত পরিমাণ ধোঁকা খায়না যতটা সৌমিত্র স্বচ্ছের কাছে ধোঁকা খায়। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে ভাইকে উদ্দেশ্য করে কাতর স্বরে বলল,
“তুমি এটা করতে পারলে ভাইয়া? তোমার জন্য আমি নিজের ঘুম নিঃস্বার্থে ত্যাগ করলাম। আর তুমি আমাকে বিপদের মুখে ফেলে যাচ্ছো?”
স্বচ্ছের কানে যেন সৌমিত্রের কাকুতি পৌঁছায়ই না। সে দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সৌমিত্র চিল্লিয়ে উঠে বলল,
“ও আন্টি ছেড়ে দিন প্লিজ। ভাইয়া আপনার জামাই বলে তাকে ছেড়ে আমার সঙ্গে নাইনসাফি করবেন? ছাঁদে তো আমারও ইয়ে আছে।”
ভ্রু কুঁচকে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া জানালেন মোহের মা। যেন বোকা বনে গেলেন। চোখমুখ জড়িয়ে বললেন,
“ইয়ে আছে মানে?”
তানিয়ার কথা মুখে আনতে খানিকটা ইতস্ততবোধই করল সৌমিত্র। এখনো তার মাও ঠিকঠাক এসব ব্যাপারে জানে না। সেখানে মোহের মাকে মুখে কী জানাবে? এখন ইয়ের মানে কী বোঝাবে সৌমিত্র? সেটা ভেবেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেল সে।
বেশ কিছুক্ষণ আগে মিষ্টি আনতে গিয়ে ছাঁদে আর আসছেন না মিসেস সুফিয়া। তা দেখতে হলুদে রাঙা কনে মোহ নিচে যাবার উদ্দেশ্যে ছাঁদের দরজার কাছে আসতেই তার সামনে পুরুষ মানুষ দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে আরো বেশি আশ্চর্য হলো স্বচ্ছকে দেখে। আঁতকে উঠে বলল,
“আপনি এখন এখানে কী করছেন?”
স্বচ্ছ নিজের মুখে স্বভাবসুলভ হাসি রেখে বলল,
“চমকালে হবে ম্যাডাম? লুকোচুরি তো ভালোই খেললেন। লাভের লাভ কিছু হলো? যাই করুন। ধরা তো দিতেই হবে।”
মোহ ধৈর্যহারা হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“মা আপনাকে ঢুকতে দিলো কী করে?”
“তিনিও খুব ভালো করে জানেন জামাইয়ের হকের বিষয়ে। আপনারও জানা দরকার। আমার হবু বউকে আমার থেকে লুকিয়ে লাভ নেই।”
স্বচ্ছকে দেখামাত্র ঝড়ের বেগে তার নিকট এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইথান। স্বচ্ছ একহাতে তাকে কোলে তুলে নিতেই ইথান নিজের হলুদ পাঞ্জাবি দেখিয়ে বলল,
“নতুন জামা পরেছি। বলো আমাকে কেমন লাগছে?”
স্বচ্ছ ইথান গালে হাত দিয়ে আদুরে গলায় জবাব করল,
“ইউ আর লুকিং ভেরি হ্যান্ডসাম মাই ডিয়ার।”
একটু একটু ইংলিশ শিখে ওঠা ইথান হ্যান্ডসামের মানে বেশ বুঝতে পারল। মন ভোলানো হাসি দিয়ে মাথা কাঁত করে বলল,
“ইউ ঠু, পাপা।”
তানিয়া ধীর পায়ে এসে মোহের পাশে দাঁড়িয়ে এদিকওদিক উঁকিঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সৌমিত্রের অবস্থান। স্বচ্ছের তীক্ষ্ণ নজরে সেটা ধরা পড়া মাত্র বলল,
“তোমার অভদ্র প্রেমিক নিচে আমার শাশুড়ীর কানমলা খাচ্ছে। গিয়ে একটু সাহায্য করতে পারো তুমি।”
লজ্জায় মুখ চুপসে গেল তানিয়ার। চোখ বন্ধ করে একহাতে চোখ ঢেকে ফেলল মাথা নিচু করে। মোহ না চেয়েও শব্দ করে হেসে ফেলল। অতঃপর শুধাল,
“কেন এসেছেন এই সময় শুনি? মোটেই উচিত হয়নি এখন আসা। আপনার বাড়িতেও নিশ্চয় অনুষ্ঠান হচ্ছে? সেখানে থাকা উচিত আপনার।”
স্বচ্ছের সূক্ষ্ম সেই দৃষ্টি দ্বারা মোহ নামধারী সেই হলুদিয়া ফুলের ভাঁজে ভাঁজে পরখ করে নিজের হৃৎস্পন্দনকে অস্থির করে তুলে শান্ত হলো। এই হলুদের সাজ যে শুধু তার জন্য সেটা ভেবে তার হৃদকম্পন আরো টগবগিয়ে চলল। মোহের প্রতি মনোমুগ্ধ হয়ে বলল,
“গায়ে হলুদটা আমাদের বিয়ের। অথচ সবাই আমার হবু স্ত্রীকে হলুদ ছোঁয়াবে। কিন্তু আমি হলুদ ছোঁয়াতে পারব না? এরকম নিয়ম আমি মানি না। তাই হলুদ ছুঁইয়ে দিতে আমি হাজির হয়েছি।”
তানিয়া এবার সম্মতি জানিয়ে বলে,
“কথাটা খারাপ নয়। আমি তবে নিচে গিয়ে হলুদ নিয়ে আসি।”
আর অপেক্ষা না করেই নিচে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল তানিয়া। তার প্রকৃত অভিপ্রায় তো অন্যকিছু। যার নাম সৌমিত্র। ধুপধাপ করে খালি পায়ে নিচে নেমে বসার ঘর থেকে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যাওয়ার সময় মনে হলো সোফায় কেউ বসে আছে। ঘুরে তাকিয়ে সৌমিত্রকে দেখতেই যেন তানিয়ার চক্ষু চড়কগাছ! সবেমাত্র খিদের চোটে মিসেস সুফিয়ার দেওয়া মিষ্টি খেতে বসেছিল সৌমিত্র। একটা মিষ্টি মুখে দিতেই যেন তার আসল জীবনের মিষ্টি হাজির। হলুদ শাড়িতে এই সুন্দরীকে দেখে হঠাৎই হলুদ রঙের ভোমরার কথা মাথায় চলে এলো সৌমিত্রের। এই মিষ্টতা সহ্য করতে না পেরে মিষ্টি মুখেই ভয়ানক বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে চোখমুখ লাল করে ফেলল সে। বেচারার এমন দুর্দশা দেখে দিকবিদিকশুন্য হয়ে রান্নাঘরে পানি দিতে যেতে উদ্যেগ নিতেই মিসেস সুফিয়া দ্রুত পানি নিয়ে হাজির হলেন। অস্থির কণ্ঠে বললেন,
“এই ছেলে বিষম লাগালে কী করে?”
সৌমিত্র দ্রুত ঢকঢক করে পানি পান করে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রিয় রমণীর চিন্তিত ও উদাস মুখশ্রীর দিকে চাইলো। সে মুখ ফসকে বলে দিলো,
“কী করব আন্টি? মুখে মিষ্টি, সামনে মিষ্টি। শুধু মিষ্টিই!”
মিসেস সুফিয়ার বোধগম্য হলো না সৌমিত্রের কথা। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“ধুর! সাবধানে খাও। তাড়াহুড়ো করলে অসুবিধা আছে।”
মিসেস সুফিয়া ফের রান্নাঘরে চলে গেলেন। হাতে অগুনতি কাজ। সাহায্য করার মতো শুধু তার ভাইয়ের বউ আছে। তাও আবার আরো কিছু সময় পর তাদের পরিবার হাজির হবে। তানিয়া বিচলিত হয়ে জানতে চায়,
“আপনি এখন ঠিক আছেন?”
সৌমিত্র একটু ভেবে বলে ওঠে,
“আপাতত ঠিক আছি। কিন্তু এত রূপ, লাবণ্য আমাকে কতটুকু ঠিক থাকতে দেবে সেটাই ভাববার বিষয়। তা আপনাকে আজকে মিস গোলাপি বলব নাকি মিস হলুদিয়া?”
“মিস গোলাপি! ওই নামটা আপনার মুখে শুনতে ভালো লাগে।”
সামান্যতমও বিলম্ব না করে নিজের মতামত জানিয়ে দিলো তানিয়া। সৌমিত্র বাধ্য ছেলের মতো জানাল,
“যথা আজ্ঞা মিস গোলাপি!”
সৌমিত্র ও তানিয়া উভয়ে হাজির হলো ছাঁদে। স্বচ্ছ নিজের ভাইকে দেখা মাত্র বলে উঠল,
“শাশুড়ী আন্টি এত দ্রুত তোকে ছেড়ে দিলো?”
সৌমিত্র চোখমুখ খিঁচে বলে ওঠে,
“উফফ…ভাইয়া আর বলো না! এখনো কান টনটনে ব্যথা করছে। আন্টি প্রথমে ঝাল মিটিয়ে একটু পর মিষ্টিও খাইয়েছে।”
তানিয়া মাঝখানে বলল,
“এইযে হলুদ এনেছি।”
স্বচ্ছ সামান্য হেসে ইথানকে বলল,
“আমি আর ইথান দুজন মিলে ইথানের মাম্মাকে হলুদ লাগাব।”
খিলখিলিয়ে হেসে হাতে হলুদ ভরিয়ে নিলো ইথান। স্বচ্ছও হলুদ মাখালো হাতে কিছুটা। ইথান মোহের একগালে এবং স্বচ্ছ আরেকগালে আলতো করে হলুদ ছুঁইয়ে দিলো। এই মুহূর্তটা ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠল মোহের কাছে।
হলুদ লাগানো শেষেই ইথান দৌড়ে গেল নিচে তার নানাভাইয়ের কাছে। তৎক্ষনাৎ গম্ভীর সুরে স্বচ্ছ সৌমিত্র ও তানিয়াকে সাফ আদেশ দিলো,
“আমার মোহের সাথে কিছু কথা আছে। তোমরাও বরং নিচে যাও।”
লাজুক তানিয়া সাথে সাথে নেমে গেলেও সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“বিয়ের আগে এসব ঠিক নয় কিন্তু ভাইয়া। ভাবিকে হলুদ ছোঁয়াতে দিলে না। মনে থাকবে আমার।”
স্বচ্ছ চোখ গরম করতেই সৌমিত্র চটপট করে সেখান থেকে বিদায় নিলো। মোহ চোখেমুখে হাজারো বিস্ময় নিয়ে স্বচ্ছের একহাত চেপে ধরে বলল,
“ওদের কেন তাড়িয়ে দিলেন? আপনিও যান। ফিরে যান নিজের বাড়িতে।”
মোহের সংলগ্নে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় স্বচ্ছ। মোহের দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে আওড়ায়,
“নিজের হবু শাশুড়ীর হাতে কানমলা খেয়ে, এত স্ট্রাগল করে তোমার কাছে এলাম এত দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য? আমার কাজ এখনো বাকি আছে।”
কথা শেষ করতে করতে হলুদের বাটি নিয়ে সেখানে একটা গোলাপফুল ধরে হলুদ ভরিয়ে নিলো স্বচ্ছ। সেই গোলাপফুল মোহের কপালে, ফোলা গালে, সরু থুঁতনিতে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলে,
“আপনাকে হলুদ ছুঁইয়ে শখ মিটেনি আমার।”
গোলাপফুল মোহের গলা অবধি চলে এলো। হলুদের ঠাণ্ডা আর শীতলতায় শিরশির করে উঠল শরীর। আকস্মিক মোহ এক থাবা হলুদ তুলে নিয়ে স্বচ্ছের দাড়িযুক্ত গালে ভরে মাখিয়ে দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল। তার হাসির ঝংকারে নিজেকে হারিয়েই ফেলল স্বচ্ছ।
খানিকক্ষণ পর স্বচ্ছ মোহের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাতে মেহেদি দিয়েছ?”
মোহ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“এখনো তো দিইনি। তবে হলুদের পর্ব শেষ হলে দিতে বসব।”
এবার স্বচ্ছ নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে টিউব মেহেদি বের করে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
“তার আর দরকার নেই আমি মেহেদি দিয়ে দেব।”
ফিক করে হেসে ওঠে মোহ।
“আপনি মেহেদি দিতে পারেন?”
“আমি শুধু আমার আর তোমার নাম লিখব। সেটাই আমার মূল লক্ষ্য।”
মোহও এবার উৎসাহের সাথে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“তাহলে দিয়ে দিন।”
এই প্রথমবার কাউকে এভাবে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে স্বচ্ছ। সে ভাবেনি মেহেদি দেওয়ার বিষয়টা এত কষ্টকর! লাইন সোজা হতেই চাইছে না। তবুও নিজের সকল পরিশ্রম আর মনোযোগ মোহের হাতের দিকে দিয়ে দিলো সে। বেশ কষ্ট করে মোহের বাম হাতে লাভ শেইপ আঁকাতে সক্ষম হলো সে। তারপরই বিজয়ের হাসি দিলো। তা দেখে মোহের বেশ মজা লাগল। তবে সময় নিয়ে উসখুস করতে করতে বলল,
“আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।”
ব্যস্ত স্বচ্ছ ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“হুঁ।”
“আমি আপনাকে না জানিয়ে একটা কাজ করেছি। স্কুল টিচার হওয়ার এক্সাম দিয়েছি। আমি ভাবিনি যে টিকে যাব। কিন্তু পাশ করেছি। কাল ভাইবা ছিল। সেখানেও সিলেক্ট হয়ে গেছি। কিছু মনে করবেন কিনা সেটা ভাবছিলাম তাই আর বলা হয়নি আপনাকে কিছু।”
মেহেদির টিউব ছাঁদের রেলিংয়ে রাখে স্বচ্ছ। মোহের দিকে তাকায় পলকহীনভাবে। কোনো কথা না বলে শুধু তাকিয়েই থাকে। মোহ তবুও নিরুদ্বেগ হয়ে বলে,
“বাবা সবসময় আমাকে একটা পারফেক্ট মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করেছে। যে সবসময় স্বনির্ভর থাকবে। আমার প্রতিবাদ, আত্মবিশ্বাস সব বাবার কাছ থেকে শেখা। বাবার এটা ইচ্ছা ছিল আমি ভবিষ্যতে কোনো চাকরি করব। তাই আমি আপনাকে না জানিয়ে…”
মোহের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিলো স্বচ্ছ। শান্ত গলায় বলল,
“চুপ! এত কৈফিয়ত আমি চেয়েছি? আমাকে সেই বর্বর প্রেমিক মনে হয় তোমার যে তার প্রেমিকার সব কাজে বাঁধা দেবে?”
মোহের ভেতর থেকে কথা বের হলো না। নিজের উপর জোর খাঁটিয়ে বলল,
“আগামী মাস থেকে জয়েনিং। কিন্তু আমি যেখানে চাকরি পেয়েছি সেখান থেকে আপনাদের ওই বাড়িটা বেশ কিছুটা দূর।”
“সেসব আমার ছেড়ে দাও। আমি সব সামলে নেব।”
একটা মানুষ কীভাবে নিজেকে এতটা উজাড় করতে পারে নিজের ভালোবাসার জন্য সেটা দেখে হতবিহ্বল হয় মোহ। এই মানুষটা তার জন্য আর কী কী করবে? মোহের আর কতটা হতবাক হওয়া বাকি আছে? স্বচ্ছ তার নিজের কাছে থাকা আরেকটি হলুদ গোলাপ বের করে মোহের কানে গুঁজে দিয়ে বলল,
“নিজের নতুন শিক্ষক জীবনের জন্য শুভকামনা, মোহ ম্যাডাম!”
এবার নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে রয় মোহ৷ স্বচ্ছ মোহের থুঁতনিতে হাত রেখে শীতল গলায় বলল,
“আমি জানি জীবন কোনো রূপকথা নয়। তবে নিজের প্রিয়র চেয়ে প্রিয় মানুষটা জীবনে থাকলে তা রূপকথার থেকেও সুন্দর হয়।”
মোহ বুঝেই উঠতে পারেনা একটা পুরুষ মানুষের প্রণয়ের ধরণ এতটা সুন্দর হয় কী করে? মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সেই বিকৃত আরিদ্রের কথা। সেই আরিদ্রকে দেখার পর থেকে মোহ নিজের বাবা ছাড়া কোনো পুরুষকে বিশ্বাস ভুলতে বসেছিল। কিন্তু এখন স্বচ্ছকে দেখে সে বুঝতে পারে এখনো এমন বিশ্বাসযোগ্য পুরুষও রয়েছে। তারা হারায়নি।
লাভ শেইপ এঁকে তার মাঝে ইংরেজিতে স্বচ্ছ ও মোহের নাম জোড়ায় লিখে ক্ষান্ত হলো স্বচ্ছ। মোহ ডান হাত এগিয়ে দিয়ে আবদার করে বলল,
“এই হাতে আপনার পুরো নামটা লিখে দিন।”
স্বচ্ছ উল্টে নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার হাতে তোমার নাম লিখবে না?”
“না লিখলেই বা কী বলুন তো? আমি জানি আপনার মনের অভ্যন্তরে আমার নাম লেখা আছে।”
তবুও নিজের আর মোহের নাম নিজের হাতে লিখে নিলো স্বচ্ছ। সে আগে কোনোদিন মেহেদি পরেনি। আজ তার নিজেরই ইচ্ছে করল মেহেদি পরতে। বদল হয়ত এভাবেই আসে। দুজন দুজনের হাত মেহেদি দিয়ে রাঙিয়ে দিতে দিতে বেশ সময় লেগে যায়। জড়ো হয় তানিয়া, সৌমিত্র আর পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাণ্ড মনোযোগ দিয়ে দেখছিল শৌভিক নিজে। মিটিমিটি হাসছিল সে। এমন দৃশ্য সত্যিই তার কাছে অতুলনীয়! এই বন্ধন শৌভিক তাদের মাঝে আজীবন দেখতে চায়।
অনেকক্ষণ লাগিয়ে মেহেদি পরানো শেষ করে স্বচ্ছ। তার ডান হাত ব্যথায় টনটন করছে। তবুও মোহের হাতটা দেখতে তার অদ্ভুত ভালো লাগছে এখন। মোহের ঘাড় লেগে গিয়েছে এতক্ষণ বসে থেকে। পেছন ঘুরে শৌভিককে দেখে হতবাক হয়ে গেল মোহ। খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে বলল,
“ভাইয়া কখন এলে?”
শৌভিক বড়ো নিশ্বাস ফেলে বলে,
“এই রোমিও যখন জুলিয়েটের হাতে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিল ঠিক তখন।”
“আমাকে একবার ডাকবে না তুমি?”
“ডাকার কী আছে? ভালোই লাগছিল এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে। চারিদিকে রোমান্টিক হাওয়া বইছিল। এই দেখ ছবিও তুলে রেখেছি এত সুন্দর মুহূর্তের।”
ছবিখানা দেখেই চোখমুখ লাল হয়ে এলো মোহের। শৌভিকের থেকে ছোঁ মেরে ফোন নেওয়ার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না কারণ হাতের মেহেদি এখনো শুকায়নি। শৌভিক এবার ফাইজলামি করে বলল,
“ঠিক বিশ বছর পর যখন ইথান বড়ো হয়ে যাবে, ইথান ভাই-বোন বড়ো হবে তখন তাদের ছবিগুলো দেখিয়ে বলব দেখ তোদের মা-বাবা কত রোমান্টিক ছিল।”
মোহ যেন এসব কথাবার্তা আর হজম করতে পারল না। কান গরম হয়ে উঠল। হালকা কেশে মুখ ফুলিয়ে কোনো কথা না বলে নিচে দৌড় দিলো। শৌভিক চিল্লিয়ে বলল,
“আরে ভাইয়ের থেকে হলুদ লাগিয়ে নিবি না? শোন এখানে!”
নিচে এসে মোহ দেখল তার মামা সাইফুল সাহেব এবং মামী এসেছেন। মোহ সালাম দিলো তাদের। সাদরে সালাম গ্রহণ করলেন সাইফুল সাহেব এবং আদুরে গলায় মোহকে কাছে ডাকলেন। অনেক কথাবার্তা জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন।
মোহের বাড়ির সকলের মাঝে বসে আছে স্বচ্ছ। তার সামনে সে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাগজ রেখেছে। সবার কৌতূহল সেই কাগজের উপর। মোহের মামী কিছুটা সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে দেখে মিসেস সুফিয়াকে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“এই ছেলের মতলব কী গো? আমার তো ভালো কিছু মনে হচ্ছেনা। হঠাৎ কাগজপত্র এনেছে নিশ্চয় কারণ আছে। তোমার মেয়েকে তোমার নাতিসহ মেনে নিবে তো?”
মিসেস সুফিয়া উত্তর করলেন না। করতে চাইলেন না। এই কয়দিনে স্বচ্ছের দুষ্টু-মিষ্টি ব্যবহারের পর তিনি ছেলেটার সম্বন্ধে নেতিবাচক ভাবনা আনতে চান না। স্বচ্ছ এবার চোয়াল শক্ত করে বলল,
“আমি মূলত দুটো কারণে এখানে আজ এসেছি। প্রথমটা মোহের সঙ্গে দেখা করতে, দ্বিতীয় কারণ এই কাগজগুলো।”
আজহার সাহেব বিচলিত হয়ে বললেন,
“কীসের কাগজ বাবা এগুলো?”
স্বচ্ছ আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“ইথান কোথায়?”
“ইথান ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব সকালে উঠেছে তো তাই। এত সকালে ওঠার অভ্যেস নেই ওর।”
আজহার সাহেবের কথাতে অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে স্বচ্ছ কাগজগুলো একহাতে তুলে বলল,
“এগুলো ইথানকে দত্তক নেওয়ার লিগ্যাল কাগজপত্র। আমি ওর বাবা এই মুহূর্ত থেকে হতে চাই। আমি মোহের স্বামী হওয়ার আগে ইথানের বাবা হতে চাই।”
সবাই চকিতে তাকাল। সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু স্বচ্ছ। শৌভিক সায় দিলো। কারণ সে কিছুটা জানত এই বিষয়ে। ইথানের ব্যাপারে মোহের চিন্তা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল সেই সম্পর্কে অবগত ছিল শৌভিক। আদেও ইথানের বাবা স্বচ্ছ হতে চাইছে নাকি মোহের কারণে মেনে নিচ্ছে তা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ছিল মোহের মনে। সেটা পরিষ্কার করতেই স্বচ্ছের এমন পদক্ষেপ। স্বচ্ছ ফের বলল,
“আমি এখানে সই করছি সবার সামনে। আর মোহের সাথে আমার বিয়ের পর মোহ এখানে সই করবে ওর লিগ্যাল মা হিসেবে। কিন্তু আমাকে নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি তাই আমি আগেই সিগনেচার করব।”
সময় নষ্ট না করে দ্রুত সিগনেচার কমপ্লিট করল স্বচ্ছ। অতঃপর ঘোলাটে নেত্রপল্লব দ্বারা মোহের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মেয়েটা সম্ভবত কাঁদছে। তার চোখে পানি টলমল করছে। কিন্তু তার মুখে ঠিকই অতি মৃদু হাসি। যা স্বচ্ছের মুখে হাসি এনে দেয়। আজহার সাহেব খুশিতে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। উনার বুঝতে আর বাকি নেই স্বচ্ছের মতো ছেলে তিনি আর তার মেয়ের জন্য পাবেন না। উনার মাথার চিন্তার ভার হুট করেই কমতে থাকল। মিষ্টি খাওয়াদাওয়া হলো। তানিয়া সৌমিত্রের দিকে মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আবার বিষম খাবেন না যেন।”
এরপর বেশ সময় চলে যাওয়ার পর বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো স্বচ্ছ। মোহের সামনে এসে বলল,
“আবার ফেরত আসছি খুব দ্রুত আপনাকে আর আমার ছেলেকে নিতে।”
স্বচ্ছের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়েই রইল মোহ। একটু পর লাজুক হাসি হাসল। স্বচ্ছ ফিসফিসিয়ে বলল,
“আশা করি ইথানকে নিয়ে আর বিভ্রান্ত হবে না। মনে রাখবে এখন কিন্তু তোমার চেয়ে আমার বেশি অধিকার ছেলের প্রতি। ইথান আমারও। এখন যাচ্ছি। অফিসে যেতে হবে। কাজ আছে।”
মোহ চকিতে বলল,
“ছুটি নেন নি আপনি?”
“না। আজ ছুটি নিইনি কারণ আমি বিয়ের পর বেশি ছুটি চাই যেন তোমার সঙ্গে আমার প্রতিটা মুহূর্ত কাটে।”
দূরে সরে এলো মোহ। কেমন খাপছাড়া কথা বলে বেকায়দায় ফেলে লোকটা। অবশেষে তারা চলে গেল নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রতিক্ষার অন্তিম প্রহর গুনতে আরম্ভ করল দুই নর-নারী।
খয়েরী রঙের বেনারসি বধূয়া মোহের গায়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। ফারাহর নিজ হাতে যত্ন করে করা ভারি ডিজাইন যেন মোহের জন্য একেবারে মানানসই। তাড়াহুড়ো করে বধূর হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলো তানিয়া। ম্যাচিং গাঢ়ো খয়েরী পাতলা ওড়নাটা মোহের মাথায় আঁটকে দিলো সযত্নে। ওড়নাটাতেও সুন্দর কাজ করেছে ফারাহ৷ মেয়েটা বারবার ভিডিও কল দিয়ে যাচ্ছে নিজের বড়ো ভাবিকে দেখবে বলে। সব শেষে তানিয়া দেখল লিপস্টিক কম হয়ে গেছে। সেটাও পূরণ করল সে। ঘাম ছুটে গেল তার। মোহকে সাজিয়ে নিজেই অবাক হয়ে বলল,
“ওহে, সুন্দরী! তোকে ডেডিকেট করে সুন্দরী গান গাইতে ইচ্ছে করছে।”
নিজেকে বধূ সাজে দেখে গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকে মোহ। সে বউ সেজেছে। তার মাঝে সে আলাদাই মাধুর্য খুঁজে পাচ্ছে। ইথান ঘরে উঁকি দিলো। মাকে এত সাজ দেখে মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে বলল,
“তোমাকে তো রূপকথার রানির মতো লাগছে মাম্মা। তুমি যেমন গল্পে শোনাও। ঠিক তেমন লাগছে।”
ইথানের গালে আলতো করে চুমু খায় মোহ। তারপর ছেলের কথায় শব্দ করে হাসে সে। অনেকক্ষণ কাটে। তানিয়া নিজে তৈরি হতে আরম্ভ করে। ফারাহ তার জন্য হুট করেই অনেক হালকা গোলাপি শাড়ি পাঠিয়ে চিরকুটে লিখেছে, ‘আমার গোলাপি ভাবির জন্য।’
সেই চিরকুট পড়ে তানিয়ার সে কী লজ্জা! মোহ তা দেখে হেসে কুটি কুটি। তবে তানিয়া নিজেও চেয়েছিল সৌমিত্রের পছন্দে সাজতে।
অনেকক্ষণ কেটে গেল। মিসেস সুফিয়া ঘরে ঢুকে এলেন। মেয়েকে দেখে নির্বাক হয়ে চেয়েই রইলেন। কাঁদতে চাইলেন মেয়েকে জাপটে ধরে। সেটা করলেন না। শক্ত রইলেন। কান্না রোধ করে ঢক গিলে মেয়ের চোখেমুখে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন,
“আমার রাজকন্যা!”
মোহ মায়ের হাতজোড়া ধরে চুমু খেল। মায়ের বুকে মাথা রেখে বসে রইলেন বেশ খানিকক্ষণ। অতঃপর বাবার কথা মনে পড়লে শুধাল,
“বাবা সারাদিনে একবারও আমার সাথে সেভাবে দেখা করল না। বাবা কোথায়? তোমাদের ঘরে?”
মিসেস সুফিয়া মাথা ঝাঁকালেন। শাড়ি সামলে উঠে দাঁড়াল মোহ। মুখ ফুলিয়ে অভিমান নিয়ে বাবার ঘরে পা রাখল। ঘরটা অন্ধকার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত লাইট জ্বালালো। আজহার সাহেব জানালার কাছে বসে দুয়েকটা জোনাকির আনাগোনা দেখছিলেন। হঠাৎ লাইট চোখে পড়লে চোখের কোণা থেকে অশ্রু মুছে চশমা পরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন বধূ বেশে উনার একমাত্র কন্যা দাঁড়িয়ে। আহা! এ যেন এক স্বপ্ন। মেয়েটাকে দেখে মনে হলো সেই ছোটোবেলার কথা। মোহ তখন সবেই আধো গলায় বাবা বলতে শিখেছিল। আজহার সাহেব সে কী খুশি! খুশিতে আত্মহারা হয়ে মিষ্টি এনেছিলেন তিনি। সারাদিন মেয়েকে বুকে করে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন। সেই মেয়ে আজ উনাকে ছেড়ে নিজের সংসারে চলে যাবে? এই নিষ্ঠুর নিয়ম উনার হৃদয় রক্তাক্ত করলেও এটা তো মানতেই হবে। আজহার সাহেব ইশারায় মোহকে কাছে ডাকেন। মোহ কাছে গিয়ে বলল,
“সারাদিনে একবারও আমার সাথে কথা বললে না কেন সেভাবে বাবা?”
আজহার সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়েকে তিনি বোঝাতে পারবেন না যে মোহের সামনে গেলেই বারংবার তিনি ভেঙে পড়ছেন। ভেতরটা গুড়িয়ে যাচ্ছে উনার। আলতো হেসে মোহের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। জিজ্ঞাসা করলেন,
“অভিমান হয়েছে বাবার উপর?”
মোহ নিরুত্তর। মাথা নিচু করে রয়েছে। ভালো করে মোহের দিকে চোখ বুলিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললেন,
“অপরূপা লাগছে আমার মেয়েকে। এ যেন এক ছোট্ট পরী।”
মোহের চোখ ভর্তি পানি আসে। অস্থিরতা চেপে বসে। নিজেকে সামলাতে থাকে। ঢক গিলে বাবার হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তো কিছুটা সময় এই আবেগঘন মুহুর্তের!
বিয়ে বাড়ির তোড়জোড় শেষ করে ক্লান্ত হয়ে নিজের সোফায় বসে মিসেস জেবা। ছেলের বিয়ে বলে কথা! তিনি নিজে আর যাবেন না আজ৷ এমনিতে বেশ ধকল গেছে শরীরের উপর। স্বচ্ছের কথা মনে পড়তেই ঘড়ি দেখলেন তিনি। সময় হয়ে এসেছে। দ্রুত ফোনটা বের করে কল লাগালেন স্বচ্ছকে। অদ্ভুতভাবে স্বচ্ছের ফোনটা বন্ধ বলছে। বেশ কয়েকবার আরো কল দিলেন মিসেস জেবা। তেমন কোনো লাভই হলো না।
বরযাত্রী তৈরি কিন্তু বর নেই। এখনো বাড়িতে হাজির হয়নি। বিষয়টা চিন্তাজনক। মিসেস জেবা তো চিন্তায় দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন। ফারাহ বারবার স্বচ্ছকে কল করার চেষ্টা করল। ফলাফল শূন্যই থেকে গেল। ফারাহ রেগেমেগে বলল,
“বিয়ের সময়ও এমন দায়সারা কাজ করবে ভাইয়া? আর ভালো লাগে না!”
সৌমিত্র কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,
“ভাইয়ার আরো এক ঘণ্টা আগে আসার কথা ছিল। বিয়ে নিয়ে সে যথেষ্ট সিরিয়াস ছিল। আর এমন সময় ফোন বন্ধ? মানতে পারছি না।”
সকলের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল যখন কনেপক্ষ থেকে ফোনকল এলো।
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৬ [দ্বিতীয় খণ্ড]
তীব্র চিন্তিত হয়ে ছটফট করছেন মিসেস জেবা। শান্তিতে শ্বাস নেওয়া ভুলে গেছেন যেন। হাঁসফাঁস করতে করতে তিনি সৌমিত্রকে বললেন,
“এই ফোনে পাওয়া গেল স্বচ্ছকে?”
সৌমিত্রের মুখ থেকে হতাশার সঙ্গে জবাব এলো,
“না, মা। ভাইয়ার ফোন বন্ধ। কিছুতেই কনটাক্ট করা যাচ্ছে না।”
মিসেস জেবার মাথায় হাত। একদিকে ছেলের চিন্তা, অন্যদিকে কনেপক্ষের চিন্তা! মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগল উনার। শৌভিক বলল,
“আমার মনে হয় ওর অফিসে গিয়ে খোঁজ করা দরকার এখন। হাতে সময় নেই। ওদিকে মোহ তৈরি। হয়ত স্বচ্ছ অফিসেই আছে।”
ফারাহ কপালে হাত ডলে বিচলিত সুরে বলল,
“ভাইয়াকে পইপই করে বললাম আজকে যাওয়ার কী দরকার? কিন্তু একটাই কথা নতুন জব তাই নিয়মিত থাকা জরুরি। শৌভিক, আপনি তাড়াতাড়ি যান অফিসের দিকে।”
সৌমিত্র এবং শৌভিক উভয়ে স্বচ্ছের অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলো। মোহের পরিবারকে বলা হয়েছে স্বচ্ছ রাস্তায় রয়েছে। সে এলেই তারা বেরিয়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে প্রেশার লো হতে আরম্ভ করল উনার। দোয়া করতে লাগলেন, ছেলে যেন ঠিক থাকে।
নিজের দাদিমার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে কল কাটে মোহ। বয়স্ক মানুষটির খুব শখ নিজের সোনার টুকরো নাতনিকে নববধূ সাজে দেখবার। তাই তো পাশের বাড়ির স্মার্ট ফোন নিয়ে নাতনিকে দেখার সাধ পূরণ করেছেন। ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে সময় দেখল মোহ। সময়কে আটকানোর সাধ্য নেই কারো। তাই সে ঠিকরে চলছে আপন গতিতে। সামান্য দেরি হলেও তাতে কারোর মাথাব্যথা নেই। বিয়েশাদির বিষয়ে একটুআধটু দেরি হতেই পারে। তবে মোহের মন মানছিল না৷ একপ্রকার নিজের মনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করে কল করেই ফেলল স্বচ্ছকে। এরপরই খানিকটা মলিনতা ঘিরে ধরল তাকে। স্বচ্ছের ফোন বন্ধ। পরক্ষণেই নিজেকে মানিয়ে নিলো। হয়তবা এত ব্যস্ততায় ফোনে চার্জ দেওয়া হয়নি! দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতেই হুড়মুড়িয়ে তানিয়া এলো। গোলাপি রঙের শাড়িতে গোলাপি রাজ্যের রানি লাগছে। যেন একখানা সুন্দর রঙিন প্রজাপতি। তানিয়া ইশারা করে শুধায়, তাকে কেমন দেখাচ্ছে? মোহ মুচকি হেসে বলে,
“তোকে দেখে একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে রে!”
একটু থেমেই মোহ খানিকটা সুর তুলে আপনমনে বলে উঠল,
“ও বন্ধু লাল গোলাপি, ও বন্ধু লাল গোলাপি!
কই রইলা রে?
এসো এসো বুকে রাখব তোরে!”
ফিক করে হেসে ফেলল তানিয়া। বলল,
“বিয়ে হওয়ার আগেই কেমন নির্লজ্জ হয়েছিস তুই?”
“নির্লজ্জতার আর কী দেখলি? মানুষ প্রেম করতে পারবে আর বললেই দোষ?”
হাসতে হাসতে নাকের নথ খুলে গেল মোহের। তানিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ল সেটা নিয়েই।
রাত আটটা বাজতে বাজতে খুশির মহলের ছড়িয়ে পড়ল বিষণ্নতার হাওয়া। জমে উঠেছিল প্রতিটা মুহূর্ত। আজহার সাহেব নিজের বিয়ের কথা স্মরণ করে স্ত্রীকে নিয়ে কী সুন্দর গান ধরেছিলেন বেশ খানিকক্ষণ আগেই। সব রঙ যেন ধুয়ে ধূসর হয়ে গেছে। পাত্রপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মাঝে একজনও কল রিসিভ করছে না। মিসেস সুফিয়ার চোখমুখ শুকিয়ে ছোটো হয়ে গিয়েছে। আজহার সাহেব শৌভিককে কল করেও পেলেন না তখন চিন্তা আরো বাড়ল। মোহের মামি নিরবতা ভেঙে বলেই ফেলল,
“কী পরিবারে মেয়ের দিয়ে দিচ্ছেন আপনারা? তাদের তো খবরই নেই। আদেও মেয়েকে বিয়ে করতে আসবে তো? নাকি খামোখা হয়রানি করাচ্ছে?”
মিসেস সুফিয়া নড়বড়ে কণ্ঠে বললেন,
“কীসব বলো ভাবি? কেন ওরা এমন করবে? হয়ত কোনো সমস্যা হয়েছে।”
মোহের মামি দমলেন না। আরো আগ বাড়িয়ে বললেন,
“বড়োলোক মানুষজনের ক্ষণে ক্ষণে মন পাল্টায় বুঝলে? আরো ভালো করে খোঁজখবর নেওয়া উচিত ছিল তোমাদের। চেষ্টা করে দেখো যোগাযোগ করতে পারো কিনা!”
এতসব কথা শুনে আরো চুপসে গেলেন মিসেস সুফিয়া। সত্যিই যেন এক চরম ধোঁকার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারা। এতসব আয়োজন শুধুই মরীচিকা লাগছে। সাইফুল সাহেব ইশারা করে নিজের স্ত্রীকে চুপ থাকতে বললেন। তানিয়া ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। সুন্দর করে সাজগোজ করা চেহারা ঘামতে আরম্ভ করেছে। একহাতে কপালের ঘাম সামান্য মুছে ফোনের দিকে চেয়ে আছে। সৌমিত্রকে বেশ কয়েকবার কল করা হয়ে গেছে তার। কিন্তু ফলাফল শূন্যই। গুটি গুটি পায়ে মোহের ঘরে ঢুকে গেল সে। দেখল মেয়েটা ভারী সাজ নিয়ে বিছানা জুড়ে বসে রয়েছে রানির মতো। তানিয়াকে দেখে বিষণ্ণ মোহের মুখে মলিন হাসি এলো। তানিয়া ঢক গিলে ওর পাশে বসে বলল,
“ওরা তো হঠাৎ এমন করছে কেন বুঝতে পারছি না। স্বচ্ছ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে তোর?”
মোহ ছোটো করে জবাব দিলো,
“না।”
“বাইরে তোর মামি…”
তানিয়ার কথা সম্পূর্ণ হলো না। মোহ বলল,
“জানি। মামি অনেক কথা বলছে। সব শুনেছি দরজার কাছ থেকে।”
তানিয়া আর কথা বলার মুখ পেল না। মোহ ফোনটা নিলো। শৌভিকের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। ছোটো ইথান আনন্দপূর্ণ বাড়ির সকলের উদাসীনতা দেখে ঘরে এসে মুখ ফুলিয়ে প্রশ্ন করেই ফেলল,
“বাবা কখন আসবে?”
মোহ একটু ভেবে গম্ভীর সুরে বলল,
“আসবে। সময় হলে ঠিক চলে আসবে।”
আরো সময় হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় নয়টায় ঠেকেছে। মিসেস সুফিয়া মেয়ের এমন অপমানে, লজ্জায় প্রায় কেঁদে ফেলেছেন। এটা শুধু মোহের অপমান নয়। তার পুরো পরিবারের অপমান। যেন ছেলেখেলা করে ছেড়ে দেওয়া হলো তাদের। আজহার সাহেব এবার স্বচ্ছের বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবলেন। উনার মেয়ে কোনো ছেলেখেলা করার জিনিস নয়। প্রচণ্ড রাগ চেপেছে এবার উনার মাথায়। সাফ মিসেস সুফিয়াকে জানিয়ে দিলেন,
“তুমি মেয়েকে সামলাও। আমি এখনি ওদের বাড়ি যাব। ওরা আমার মেয়েকে কী পেয়েছে? আমি ওদের একটুও ছাড় দেব না। আমার মেয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে দামি। ওরা ঠিক করল না এটা।”
মিসেস সুফিয়া মলিন মুখ নিয়ে মেয়ের ঘরে পা রাখলেন। উনার জানা নেই মেয়ের সামনাসামনি কীভাবে হবেন। মেয়েটা অনেক খুশি ছিল! দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকে দেখলেন মোহ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের পরনের চুড়িগুলো খুলে ফেলছে। অতঃপর বড়ো গলার হার থেকে শুরু করে আংটিগুলো খুলে ফেলল সে তবে স্বচ্ছের পরানো আংটি ছাড়া। নাকের নথ আর বড়ো কানের দুল খুলে পিছন ফিরে মায়ের দিকে একবার দেখল মোহ। মিসেস সুফিয়ার চোখ ছলছল করছে। তানিয়া হন্তদন্ত হয়ে মিসেস সুফিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আন্টি, মোহ স্বচ্ছ ভাইকে খুঁজতে যেতে চাইছে।”
বিস্মিত হলেন মিসেস সুফিয়া। কণ্ঠস্বর শক্ত হয়ে এলো। কাঠকাঠ গলায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“মানে? কোথায় যাবি তুই?”
মোহ বেশ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়,
“তানিয়া তো বলেই দিলো।”
মিসেস সুফিয়া মেয়ের কর্মকাণ্ডে যেন আকাশ থেকে পড়ছেন। মোহ ফের শুধাল,
“আমি তো একা যেতে পারব না। তানিয়া তুই যেতে পারবি? নয়ত অভিক ভাইকে বলতে হবে। তাও মামি উনার ছেলেকে যেতে দেবেন কিনা সন্দেহ!”
মোহের কথাবার্তা আর তার মা সহ্য করতে পারলেন না। অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন,
“মোহ! তুই নিজের জ্ঞানে আছিস? তুই এখন স্বচ্ছকে খুঁজতে যাবি? স্বচ্ছ কোনো ছোটোবাচ্চা নয় যে সে হারিয়ে যাবে। তোকে কে বলেছে ওকে খুঁজতে? তুই জানিস ও হারিয়ে গেছে? এমনটা হলে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না। আমার মনে হয় ওরা ইচ্ছে করে এমনটা করল।”
মোহের প্রতিক্রিয়া তবুও বদলায় না। অকপটে বলে,
“বিকেল থেকে স্বচ্ছের ফোন বন্ধ। উনার ফোন এমনি এমনি বন্ধ থাকেনা। নিশ্চয় কিছু ঘটেছে।”
কিছুটা থামলেন মিসেস সুফিয়া। চিন্তার রেশ মুখশ্রীতে ফুটে উঠল। কিন্তু আচানক পেছন থেকে আওয়াজ এলো মোহের মামি মিসেস আফিয়ার।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আবেগের বশে বিয়ে করতে চেয়েছিল হয়ত আবার হয়ত বিবেক ফিরে পেয়েছে তাই বিয়ে থেকে বাঁচতে কোথাও লুকিয়েছে।”
বহু সময় ধরে মামির এমন কথা সহ্য করতে করতে আগুন জ্বলে উঠল মোহের মস্তিষ্কে। অনর্গল বলতে থাকল,
“যেই মানুষটা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়েও আমার সাথ দিয়েছে সেই মানুষটা সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তে আমার হাত ছাড়বে না। সে কাপুরুষ নয় যে পালিয়ে যাবে।”
মিসেস আফিয়া এবার অবসন্ন হয়ে প্রত্যুত্তর করলেন,
“দেখো, তুমি আমাদের ঘরের মেয়ে। আজকাল বিয়ে ভেঙে যাওয়া হাতের মোয়ার মতো হয়ে গেছে। সেদিনই আমাদের পাড়ায় বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙল। তাছাড়া ছেলে মানুষের মন। ওদের মন বদলাতে সময় লাগেনা।”
মোহ শত নিরাশার মাঝে মৃদু হেসে বলে ওঠে,
“আপনি ছেলে মানুষের কথা আমাকে বলছেন। আর আমি পুরুষ মানুষের কথা বলছি। ছেলে মানুষের মন পাল্টায়। পুরুষ মানুষ যাকে একবার তার মনে বসায় তাকে আর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কথা ভাবে না। উদাহরণ যদি দিই তবে আমার বাবা, আমার মামা অর্থাৎ আপনার স্বামী এবং স্বচ্ছ।”
মিসেস আফিয়া মোহের সঙ্গে না পেরে আর পাল্টা জবাব দেওয়ার কথা ভাবলেন না। তবে মোহের মাকে ঠেস দিয়ে বললেন,
“দেখো, সুফিয়া! তোমার মেয়ের সঙ্গে তো আমি পারব না৷ নিজের ভুল কখনোই মানতে চায়না। শুধু আমি এটা জানতে চাই যে বিয়ের পাত্র হারিয়ে গেলে ওর পরিবারও কেন কল ধরছে না? এতে প্রমাণ হয় যে নিশ্চয় তাদের ছেলে এমন কিছু করেছে যে লজ্জায় কল ধরতেই পারছে না।”
মিসেস সুফিয়া অতিষ্ঠ হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়লেন। মোহকে ধমকে মুখের উপর বলে দিলেন,
“মোহ, এই রাতে তুই আর কোথাও বের হবি না। দরকার নেই স্বচ্ছকে খোঁজার। ও হারালে ওর পরিবার খুঁজবে। তোর মামির কথায় আমি আসলেই ভুল খুঁজে পাচ্ছি না। তোর ইচ্ছা অনুযায়ী সব মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু কী পেয়েছিস এতসব করে? তুই কোথাও যাবি না!”
মোহ মায়ের কথা মানতে নারাজ। স্বচ্ছ ইচ্ছে করে এমনটা করেছে এটা সে বিশ্বাস করবে না কখনো। সকালে যেই লোকটার চোখেমুখে এক অন্যরকম চাকচিক্য দেখেছে, এই বিয়েতে আবদ্ধ হওয়ার বুকভরা আকাঙ্ক্ষা দেখেছে সেই মানুষ এমন করবে না। করতেই পারে না। মায়ের সঙ্গে দুয়েকটা তর্ক করেও পেরে উঠছিল না। তর্কের অবসান ঘটল মোহের ফোনে শৌভিকের কল আসায়। কোনোপ্রকার কল রিসিভ করে মোহ রাজ্যের রাগ ঝেড়ে বলল,
“শৌভিক ভাই! এটা কী ধরনের আচরণ? বাকিদের কথা যদি বাদও দিই তুমি তো অনেক দায়িত্বশীল মানুষ। কেন তোমরা কেউ যোগাযোগ করছ না আমাদের সাথে?”
শৌভিক ওপাশ থেকে ভরাট গলায় বলল,
“তুই একবার হসপিটালে আসতে পারবি?”
কণ্ঠস্বর আঁটকে গেল মোহের। আতঙ্ক ছেঁয়ে গেল মস্তিষ্কে। নিজের মনে জমা উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা জেগে উঠল। শৌভিক ফের বলল,
“একবার আসলে নিজেই বুঝতে পারবি কেন আমাদের মধ্যে কেউ যোগাযোগ করার মতো অবস্থায় ছিল না। স্বচ্ছ হসপিটালে ভর্তি।”
হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে গেল মোহের ফোন। তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই পড়ে গেল ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুল। মেয়ের চেহারায় অন্ধকার নেমে আসা দেখে মিসেস সুফিয়া উপলব্ধি করতে পারলেন কোনো সমস্যা নিশ্চয় হয়েছে। মোহের ঘনঘন শ্বাস নেওয়া এবং হালকা কাঁপুনি দেখে আরো ঘাবড়ে যান তিনি। মোহের বাহু ঝাঁকিয়ে বলেন,
“কী হয়েছে?”
মোহ দ্রুত হাতের আরো চুড়ি খুলে দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বলল,
“আমি তো বলেছিলামই যে নিশ্চয় কোনো বিপদ হয়েছে। স্বচ্ছের কিছু একটা হয়েছে। ও হসপিটালে আছে। আমি উনার কাছে যেতে চাই। প্লিজ!”
আঁতকে গেলেন মিসেস সুফিয়া। মোহ হন্তদন্ত হয়ে বাইরের দিকে যেতে উদ্যত হলো। তার মাঝে মিসেস আফিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“মোহ, এত রাতে তোমার যাওয়া কি ঠিক হবে? স্বচ্ছের কী হয়েছে এখনো ক্লিয়ার করেছে কি? এটার কাহিনী কিন্তু অন্যও হতে পারে। এত আবেগী হয়ে যেও না। বড়োরা না হয় যাক। গিয়ে দেখুক ব্যাপারটা কী।”
মোহ পিছু ফিরে সোজা উত্তর ছুঁড়ল,
“যেই মানুষটা আমার বিপদে কোনোকিছুর তোয়াক্কা করেনি। তার বিপদে আমি এসব ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে পড়ে থাকব? আজকে আমি বেঁচে আছি শুধু উনার অছিলায়। নয়ত আমার মৃত্যু তো সেদিন নিশ্চিত ছিল ওই নদীর পানিতে। উনি আমাকে ফুরিয়ে যেতে দেননি। আমিও উনাকে ফুরিয়ে যেতে দিতে পারব না।”
শেষে মায়ের দিকে তাকিয়ে মোহ বিচলিত হয়ে বলে,
“ইথানকে দেখে রেখো মা।”
চোখ মেলতে যেয়ে ভীষণ যন্ত্রণায় পড়ে গেল স্বচ্ছ। ডান চোখের পাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে। বাম চোখ খুলে পুরোটা ঝাপসা দেখল সে। মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠল আজ তার বিশেষ একটি দিন ছিল। মোহকে হলুদ রাঙানোর মূহুর্ত নিজের মনে আসতেই মাথা ঝাড়া দিতে গিয়ে কপালের বাম পাশটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। শরীর নাড়ানো তো দূরের কথা নিজেকে অবশ লাগল তার। পরমূহুর্তে কিছু জঘন্য স্মৃতি মনে এলে হাত মুঠো করে ফোঁসফোঁস করে ওঠে সে। হাতের উপর আরেক হাতের ঠাণ্ডা স্পর্শে সম্পূর্ণ ঘোর কাটে স্বচ্ছের। এই কোমল সান্নিধ্য তাকে শান্ত করল। ধীরস্থির হয়ে রুগ্ন ছোটো দুটো নেত্রপল্লব গিয়ে ক্ষান্ত হয় এলোমেলো ভঙ্গিতে বসে থাকা বেনারসি পরিহিত অপূর্ব সেই রমনীর দিকে। ঢোক গিললো স্বচ্ছ৷ চমৎকার সেই নারীর চেহারা একটু একটু করে স্পষ্ট হলো। স্বচ্ছ যেন আবারও জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল এই রূপসীকে দেখে। গায়ে কোনো গয়না নেই তার। চোখেমুখে মলিনতা। চোখের পাতা ভেজা। কোন শব্দ দিয়ে প্রকাশ করলে স্বচ্ছ নিজের প্রেয়সীর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতে পারবে জানা নেই। তাই সে বাকশূন্য। মোহ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে জোর গলায় জানতে চাইল,
“নিজের শরীরের কী করেছেন এসব? কেন করেছেন? আর এখন কেমন লাগছে?”
স্বচ্ছের কথা বলার শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। ঢোক গিলে আধো গলায় খুব আস্তে করে বলল,
“কৈ মাছের জান আবার বেঁচে গেছে। হয়ত তোমাকে বিয়ে না করে মরবে না।”
“আমি আজেবাজে কোনো কথা শুনতে চাইছি না। কীভাবে আপনার এই হাল হলো? আপনার শরীরে কত আঘাত লেগেছে ধারণা আছে?”
স্বচ্ছ মোহের বধূ রূপে বিভোর হয়ে বলল,
“কোনো রাজ্যের এক ভয়ংকর রূপবতী রাজকন্যা লাগছে আপনাকে। এই মাধুর্যের সমুদ্রে ডুব দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করল আমার মতো বামন। কিন্তু দেখো ব্যর্থ হয়ে গেল!”
“কথা ঘুরাচ্ছেন আপনি। আমি জানতে চাই, এই বিশেষ দিনে কী এমন ঘটল আপনার সঙ্গে?”
স্বচ্ছের কথা বলতে কষ্টই হচ্ছিল। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে হাত মুঠো করল সে। যেই হাতে স্যালাইনের ক্যানোলা লাগানো ছিল সেটা টানতেই আঁতকে উঠল মোহ। স্বচ্ছ মৃদু কাঁপছে। চেহারা লাল হয়ে আসছে। যেন সে ক্ষেপে উঠছে। মোহ স্বচ্ছের হাত দ্রুত সামলে বলে,
“কী করছেন? হাতের ক্যানোলা এভাবে খুলে গেলে রক্ত বের হবে।”
নীরব হয় স্বচ্ছ। শান্ত দৃষ্টিতে মোহের দিকে তাকিয়ে মোহের হাত নিজের গালে রাখে। চোখ বুঁজে নেয় স্বচ্ছ। ঢোক গিলে বলল,
“হাত সরিয়ে নিও না, মোহ। তোমার স্পর্শের উষ্ণতা জাদুর মতো। আই নিড ইউর ম্যাজিকাল টাচ।”
মোহ হাত সরায় না। বরং স্বচ্ছের ব্যান্ডেজ করা কপালে হাত রাখে খুব আলতো করে। সেখানে পরপর তিনটা সেলাই করা হয়েছে। মোহের কৌতূহল বাড়তে থাকে আসল ঘটনা জানার জন্য। কিন্তু এই রুগ্ন স্বচ্ছকে আর ঘাঁটাতে ইচ্ছে করেনা তার। কিছুক্ষণ পর স্বচ্ছ ভাঙা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আঙ্কেল তোমাকে আসতে দিলো?”
“দিবে না কেন? ছোটো থেকে বাবা যেই জিনিসটা মানা করত সেটা আমি তাকে জোর করে মানিয়ে নিতাম। মাও আসার জেদ করছিল শেষ মুহূর্তে। আপনার জন্য খুব চিন্তা করছে। কিন্তু ইথানের জন্য এলো না।”
“ইথান নিশ্চয় আমার উপর রাগ করেছে?”
মোহ স্বচ্ছের ঠোঁটের পাশে হাতের আঙ্গুল বুলাতে থাকে। ঠোঁটের পাশেও বেশ কিছুটা জখম হয়েছে। এত নির্মমতা কে দেখাল তার প্রতি মোহের বোঝার সাধ্যের বাহিরে। একটু নিশ্চুপ থেকে সে প্রত্যুত্তর করল,
“সে একটু করেছে। কিন্তু ইথান বেশ বুঝদার। ওকে বুঝিয়ে বললে সব রাগ গলে যাবে। আপনার তো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আপনি রেস্ট করুন।”
স্বচ্ছ আর জবাব দেয় না। চোখ বুঁজে ছিল সে। মোহ বুঝে নিলো সে ঘুমিয়েছে। ঘুমের ঔষধ কাবু করেছে তাকে। নার্স এসে মোহকে ডেকে নিয়ে যায়। রোগীর একা থাকা দরকার। বাইরে বের হতেই অন্বেষাকে দেখে চকিতে তাকায় মোহ। এসময় অন্বেষাকে সে আশা করেনি। অন্বেষা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই স্বচ্ছ মোহকে পর্যবেক্ষণ করছিল। মোহের সামান্য হাতের ছোঁয়া স্বচ্ছকে কতটা ব্যাকুল করে সেটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিল সে। শৌভিক আর সৌমিত্র স্বচ্ছের কিছু যাবতীয় ঔষধপত্র নিয়ে ফিরল সবে। মোহের বাবা ঠাণ্ডা গলায় শুধালেন,
“স্বচ্ছকে কেমন দেখলে?”
মোহ মুখ ম্লান করে বলল,
“শরীরে অনেক আঘাত উনার। সারতে হয়ত সময় লাগবে।”
সৌমিত্র অস্থির চিত্তে বলে ওঠে,
“হাতের হাড় ভেঙে যেত। একটুর জন্য বেঁচে গেছে। ভাই তোমাকে কিছু বলল? কেন তার এই অবস্থা?”
মোহ মাথা নাড়ায়। শৌভিক আজহার সাহেব ও মোহের দিকে একবার তাকিয়ে অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“আই এম স্যরি। ওই সময় আমরা কেউ আপনার ফোন ধরতে পারছিলাম না। সৌমিত্রের ফোনের চার্জ শেষ হয়ে অফ হয়ে যায়। হসপিটালে থাকার কারণে আমার ফোন সাইলেন্ট ছিল। স্বচ্ছের হঠাৎ এই অবস্থার কথা শুনে আমাদের মাথায় কিছুই আসছিল না আর। বিয়ের কথা ভুলতে বসেছিলাম। ওদিকে স্বচ্ছের অবস্থার কথা শুনেই ফারাহর মা মানে আমার শাশুড়ির প্রেশার একেবারে লো হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়েছিল। ফারাহ উনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই ফোনটা ওর আশেপাশে ছিলই না। পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল।”
এত কথাবার্তার মাঝে সৌমিত্রের হঠাৎ নজর গেল অন্বেষার উপর। মেয়েটা এক কোণায় কেমন অস্থির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিও অশান্ত৷ নিজের ব্যাগ হাত দিয়ে চেপে কাকে কী বলবে বুঝতে পারছে না। কিছুটা সময় নিয়ে অন্বেষা সবাইকে উদ্দেশ্য করে জানায়,
“আসলে দোষটা আমার৷ ভুলটাও আমার। মি. আহিয়ান স্বচ্ছের সাথে যা কিছু হয়েছে সেটার দায়ভার হয়ত আমার।”
সকলের মনোযোগ তখন অন্বেষার দিকে গেল। সৌমিত্র নিজের ভাইয়ের এই অবস্থা দেখেই কতটা বিগড়ে গিয়েছিল সে-ই জানে একমাত্র। অন্বেষার কথা শোনামাত্র সে চটে গিয়ে বলল,
“মানে? কী করেছেন আপনি আমার ভাইয়ের সাথে?”
অন্বেষা নিচু স্বরে বলল,
“সৌমিত্র, আমার কিছু কথা শোনো। ঘটনাস্থলে আমি উপস্থিত ছিলাম না ঠিকই। কিন্তু ঘটনা আমার অফিসেই ঘটে গিয়েছিল। আমি এসব আমার একজন গার্ড আর আমার একজন এমপ্লয়ি মিস লিমার থেকে। আর আমার মুখের কথা বিশ্বাস না হলে আমার অফিসের গার্ড এখনো এখানে আছে। তিনি আর মিস লিমা স্বচ্ছকে হসপিটাল অবধি এনেছেন।”
এরপর অন্বেষার অফিসের সেই গার্ডকে ডেকে পাঠানো হলো। হসপিটালের বাহিরে সকলে উন্মুখ হয়ে রইল আসল ঘটনা জানতে।
“মি. মুহিব হলো আমার অফিসের ম্যানেজার। উনাকে আমরা খুব বিশ্বাস করে কাজে রাখি। কারণ আগে উনি আমার ভাইয়ার কোম্পানিতে ছিলেন। আমি বুঝিনি উনি এমন অমানুষ।”
অতীত…
আজকে অন্বেষার কোম্পানির লিডারশীপের আরেকজন পার্টনার সহ বেশ কয়েকজন মালয়েশিয়া যায় বিদেশি প্রজেক্ট হ্যান্ডেল করতে। স্বচ্ছের যাওয়ার কথা থাকলেও তার বিয়ের জন্য অন্বেষা সেটা কনসিডার করে। অফিসে এমপ্লয়ি খুব কম ছিল এবং কাজও কম ছিল। তাই তাদের বিকালের পরপরই ছুটি হয়। সাথে স্বচ্ছেরও ছুটি হয়। তাকে মি. মুহিব ডেকে পাঠায় কাজ শেষে। স্বচ্ছ তাড়াহুড়ো করে কেবিনে গিয়ে বলল,
“স্যার, কোনো কাজ আছে?”
মুহিব সামান্য হেসে বলল,
“কিছু কথাবার্তা ছিল আপনার সাথে। খুব তাড়া আছে আপনার?”
“হ্যাঁ। তাড়া তো আছে।”
“আচ্ছা, আপনি বসুন কিছুক্ষণের জন্য।”
না চাওয়া সত্ত্বেও বসতে হয় স্বচ্ছকে। মুহিব একটু পানি পান করে শান্ত গলায় জানতে চাইল,
“আচ্ছা, আপনি কি জানেন অনেক কোম্পানিতে কেন কিছু কিছু মেয়েদের ট্যালেন্ট না থাকা সত্ত্বেও কেন তাড়াতাড়ি প্রমোশন হয়ে যায়?”
কপালে ভাঁজ পড়ে স্বচ্ছের। এত ফালতু আলাপের জন্য সামনে থাকা জঘন্যতম ব্যক্তিকে চড় মারতে ইচ্ছে করে। তবুও নিজেকে দমিয়ে স্বচ্ছ খানিকটা রূঢ় কণ্ঠে বলল,
“না, জানি না। এসব আমার সঙ্গে কেন আলাপ করা হচ্ছে?”
মুহিব মৃদু হেসে বলল,
“মি. স্বচ্ছ হাইপার হচ্ছেন কেন? আপনার লাভের জন্য কথাগুলো বলছি। ধরে নিন লটারি নিজে থেকে আপনার কাছে এসেছে।”
স্বচ্ছ মুহিবের কথার কোনোকিছুই বোধগম্য হয়না।
“মানে?”
“মানে এটাই যে আপনি চাইলে আপনারও প্রমোশন হতে পারে। তাও এত পরিশ্রম না করেই।”
এবার চোখমুখও কুঁচকে যায় স্বচ্ছের। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করে। তাচ্ছিল্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আপনি তো ম্যাজিক জানেন দেখছি।”
মুহিব এবার শব্দ করে হেসে উঠে বলল,
“আপনি যদি একটু কনসিডার করেন তাহলে কিন্তু সত্যি ম্যাজিক দেখাতে পারি।”
স্বচ্ছ বুঝতে না পেরে জানতে চায়,
“কী কনসিডার করার কথা বলছেন?”
মুহিব এবার নড়েচড়ে বসল। চোখেমুখে অন্যরকম উল্লাস দেখা গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“নিজের উপরে উঠতে অনেক সময় বড়ো লোকজনের কাছে নিজের ছোটো ছোটো জিনিস বলিদান দিতে হয়। আপনার ওই হবু স্ত্রী আছে না? দারুণ দেখতে কিন্তু। আমার ভালো লেগেছে। এখন ভাবুন কী করবেন।”
কথা শেষ করা মাত্র কেমন বিকট শব্দ হয়ে গেল। মুহিব চারিদিকে অন্ধকার দেখল। বুঝল উনার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে গাল বেয়ে এসেছে। স্বচ্ছ গ্লাস তুলে সরাসরি তার মাথায় মেরেছে। টেবিলে মাথা লাগিয়ে পড়ে গেল মুহিব। স্বচ্ছ দমল না। যেই আগুনের লার্ভা মুহিব জ্বালিয়েছে সেটা এত সহজে নিভবে না। স্বচ্ছের অন্যরূপ বেরিয়ে এলো। অচেনা হয়ে উঠল। চেহারা যেন নিমেষে পাল্টে ভয়ানক আকার ধারণ করল। স্বচ্ছ মুহিবের চুল ধরে টেনে দাঁড় করালো। তখনও স্বচ্ছ ক্রোধে রীতিমতো কাঁপছে। স্বচ্ছ বলে উঠল,
“এই জানোয়ার! মোহকে নিয়ে আর একটা শব্দ বললে তোকে ঘাড় থেকে মাথা কেটে আমি জেলে যাব। বাঁচতে দেব না তোকে।”
চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় মুহিব। সে কথা বলতে পারছে না। এরই মাঝে আবারও আক্রমণ করে বসে স্বচ্ছ। নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে একেবারে সেইসময়ের মতো অকেজো করে ফেলে মুহিবকে। টেবিলে ধাক্কা লেগে যাবতীয় জিনিসপত্র পড়ে যায়। এত বিকট আওয়াজ শুনে দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে কেবিনে ঢোকে লিমা। ততক্ষণে স্বচ্ছ চেয়ার তুলেছে সেটা দিয়ে মুহিবের অন্তিম ঘটাতে। আগপাছ না ভেবে এগিয়ে যায় লিমা। স্বচ্ছের হাত থেকে চেয়ার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চিল্লিয়ে বলে,
“কী করছেন আপনি মি. স্বচ্ছ? মরে যাবে লোকটা।”
“মেরেই তো ফেলব।”
স্বচ্ছ যেন নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। লিমা চেয়ার ধাক্কিয়ে ফেলে দিলে সেই সুযোগে নিজের রক্তাক্ত মাথা ধরে সরে আসে মুহিব। লিমা স্বচ্ছকে থামানোর চেষ্টা করে। মুহিব খোঁড়াতে খোঁড়াতে কেবিন ছেড়ে বেরিয়েই যায়। লিমার প্রতি ক্ষোভ চলে আসে স্বচ্ছের। তবে লিমা বুঝিয়ে বলে,
“আমি বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনেছি। কিন্তু তার জন্য আপনি কেন উনাকে মেরে নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ বিপন্ন করতে চাইছেন? উনি হয়ত মরে যাবে কিন্তু শেষ ক্ষতিটা কার হবে?”
স্বচ্ছ অন্যদিকে তাকিয়ে শুধু লিমার কথা শুনে যায়। উত্তরে কিছু বলেনা। কিছু সময় কেটে যাবার পর দ্রুত পায়ে কেবিন ছেড়ে বের হতে উদ্যত হয়। যাওয়ার মাঝে পেছন ফিরে লিমাকে উদ্দেশ্য করে ফোঁসফোঁস করে বলল,
“ওই অমানুষের বাচ্চা আজ এতদূর অবধি করার এবং বলার সাহস পেয়েছে আপনার মতো কিছু মেয়ের জন্য। নিজেরা যদি সামান্য সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারতেন তবে এরা এতটা বাড়তো না। সুযোগ আপনারা করে দেন। ওকে তো আমি ছাড়ব না। কিছুতেই না।”
লিমার মনে কথাগুলো আচানক নাড়া দিয়ে ওঠে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে নিজের বাধ্যবাধকতার কথা ভাবে। এত জড়তা, ভয় কীভাবে কাটানো সম্ভব? আজকেও সে সবার চলে যাবার পরেও অফিসে রয়ে গেছে মুহিবের আদেশে। অবশ্য সে না থাকলে হয়ত মুহিবের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল!
আধঘণ্টা নিজের চেয়ারে বসে কাটায় স্বচ্ছ। কপালের রগ এখনো দপদপ করে জ্বলছে। তার শরীরের কাঁপুনি এখনো অনুভব করতে পারছে। অতঃপর আরো খানিকক্ষণ পর ঠিক করে ফেলল এই অফিসে আর সে কাজ করবে না। তবুও সে মুহিবকে ছাড় দিতে রাজি নয়। এতক্ষণ কল আসতে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে তার স্মরণ হলো আজকের বিশেষ দিনের কথা। যার জন্য এত প্রতীক্ষা তার। কিন্তু তার চাকরি তো সে ছাড়তে চায়। এরপরও মোহের মা-বাবা তাকে মানবে? এতকিছু ভেবে অনেকগুলো ফোনকল দেখে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো সে। যা হবার পরে দেখা যাবে। আগে সে মোহ অবধি পৌঁছাতে চায়।
এরপর গ্যারেজে নিজের বাইকটা নিতে এসে চারজন অচেনা লোকের দিকে দৃষ্টি যায় স্বচ্ছের। তারা আবার স্বচ্ছের বাইকের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। তেমন কোনো কথা না বলেই স্বচ্ছ তার পাশ কাটিয়ে অন্যদিক থেকে বাইকে হাত লাগাতে যায়। তৎক্ষনাৎ দুজন মিলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ফ্লোরে পড়ে যায় স্বচ্ছ। অচেনা লোকের এসব ব্যবহার নিতে না পেরে চিল্লিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কারা আপনারা?”
তাদের মধ্যে একজন বলে,
“নতুন মানুষ তাও ডানা ভালোই গজাইছে তোর। আয় কেটে দিই।”
চারজন মিলে ঘিরে পেলার পরেও স্বচ্ছ একজনকে ঠেলে সরাতে গেলে প্রথমেই ঘুষি খায়। নিজেকে সামলে ওঠার মতোও সময় পায়নি সে। চারজন মিলে বেধড়ক মার শুরু করে। কিল, ঘুষি, লাথি কিছুই বাদ যায়নি। নাক থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয় স্বচ্ছের। চারজনের সঙ্গে পেরে ওঠার মতো কোনোরকম রাস্তায় পায়নি সে। কেউ একজন তার হাতের উপর পা তুলে দিয়ে বলল,
“তুই ছোটো মানুষ বড়ো মানুষদের সাথে লাগতে যাস? বুকের পাটা বেশি?”
স্বচ্ছের বুকের উপরও পা দেওয়া হলো তারপর। স্বচ্ছ কেশে উঠল। কপালে আগে থেকেই আঘাত লাগা ছিল তার। আজ নতুন আঘাতে গলগল করে যেন রক্ত চুইয়ে পড়ে আশপাশ ভিজে গেল। পিটপিট করে সে শুধু দেখতে পেল চারজন লোক বিদায় নিলো। এরপর কোথা থেকে যেন এক গার্ড উদয় হয়। এই চারজন লোককে তিনি চিনতেন। মুহিবের কথায় এবং ভয়ে এদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল অফিস এরিয়ার ভেতরে। এর পরিণামে স্বচ্ছের এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান তিনি। কিছুক্ষণ আগের করা মুহিবের কলে সে স্পষ্ট বলে দেয়, সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ যেন ডিলেট করা হয় এবং গার্ড যেন মুখ না খোলে। তবুও স্বচ্ছের করুণ অবস্থা দেখে তিনি কোনোকিছুর পরোয়া না করে কোনোমতে উঠালেন। দূরে ছিটকে যাওয়া স্বচ্ছের ফোনটা তুলে দেখলেন ফোনটা বন্ধ। তিনিই সিদ্ধান্ত নিলেন স্বচ্ছকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে রওনা দিবেন এবং অন্বেষাকে সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত জানাবেন।
বর্তমান…
সবটা বলার পর অন্বেষা দীর্ঘশ্বাস নিলো। সৌমিত্রের মেজাজ তখন তুঙ্গে উঠে গিয়েছে। কড়া সুরে বলে উঠল,
“ওই কুত্তার বাচ্চাকে আমি ছাড়ব না। কোথায় ও? একটুও ছাড় পাবে না।”
অন্বেষা ধীর গলায় বলে,
“আপনারা কী করবেন ওই লোকটার বিরুদ্ধে সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু আমি নিজে থেকে অলরেডি অ্যাকশন নিয়েছি। খুব দ্রুত হয়ত লিমার স্টেটমেন্টে পুলিশ তাকে ধরবে। চাইলে আপনারাও মা/মলা করতে পারেন। আমার মনে হয়েছে সত্যিটা জানানো উচিত তাই জানালাম। ওই মুহিবের ব্যবস্থা নেওয়া আমার উপর ছেড়ে দিন। অ্যান্ড আই অ্যাম স্যরি ফর দিস।”
এতকিছুর পর শৌভিক আর সৌমিত্র চলে যায় ফের হসপিটালের দিকে। মোহ আর তার বাবাকে বাড়ি ফিরতে হবে। মোহের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরতেই হবে। মোহ বাবার কাছে গিয়ে অনুরোধ করে,
“বাবা, যাওয়ার আগে আর একবার উনাকে দেখে আসি?”
আজহার সাহেব মানা করতে পারেন না। সম্মতি জানালে মোহ এগোয় ভেতরের দিকে। তবে অন্বেষার ডাকে থামে সে।
“হেই, মোহ! লিসেন!”
পিছু ফিরে তাকালেন বিষণ্ণ মুখে এগিয়ে আসে অন্বেষা। মাথা নত করে বলে,
“আই ওয়ান্ট টু সে স্যরি টু ইউ।”
মোহ একটু ভেবে শক্ত গলায় বলল,
“এটা ক্ষমা চাওয়ার বিষয় নয়। এটা লজ্জার বিষয়। আপনি একজন মেয়ে। কিন্তু আপনার অফিসের ম্যানেজার দিনের পর দিন মেয়ের এভাবে অসম্মান করে গেছে। আর যা হলো তাতে বোঝা যায় আপনার অফিসে বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই। এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করুন যাতে কোনো মেয়ে অথবা আপনার অফিসের কোনো এমপ্লয়ির সাথে যেন আর কখনো খারাপ না ঘটে।”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে মোহের কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে অন্বেষা। না চাইতেও বলে ফেলে,
“একারণেই হয়ত মি. আহিয়ান স্বচ্ছের মুগ্ধতা আপনার প্রতি শেষ হয়না।”
অন্বেষার কথা বুঝে উঠতে সক্ষম হয়না মোহ।
“মানে? বুঝলাম না।”
“তোমার নাম শুনলে আহিয়ান স্বচ্ছের চোখে যেই চমকটা আসে সেই চমকটা অন্য কোনো বিষয়ে তার চোখে আসেনি। সেটা কিছু কারণ আমি আন্দাজ করতে পারছি।”
“এইসব মামলায় কোনো কারণ হয় বলে জানা নেই। এখন আসছি।”
মোহ গটগট করে হসপিটালের ভেতর ঢুকে যায়। স্বচ্ছের কেবিনের সামনে দাঁড়ায়। এখন ভেতরে ঢোকা যাবেনা। তবে বাইরে থেকে এক ঝলক দেখতে দোষ কী? এত শক্ত থাকার পরেও এবার মোহের সুন্দর আঁখি জোড়া বাঁধ মানে না। একফোঁটা অশ্রু মেঝেতে পড়ে। হাউমাউ করে সেই মানুষটাকে জড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কেন যে লোকটা নিজের প্রাণের তোয়াক্কা করল না?
রাত প্রায় দুটো। ইথান ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ। চোখে ঘুম নেই মোহের। শখের সুন্দর বেনারসি ছেড়েছে সে। বিছানায় আনমনে হাঁটু জড়িয়ে বসে থেকে অস্থির মনটাকে মানাতে গিয়ে আরো অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। এই সময় মিসেস সুফিয়া মেয়েকে দেখতে ঘরে আসেন। মোহকে জাগতে দেখে জানতে চাইলেন,
“এখনো ঘুমাস নি? কী ভাবছিস এত?”
মায়ের উপস্থিতি টের পায়নি মোহ। সামান্য চমকে গিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলে উঠল,
“উনার শরীরে কত ক্ষত জানো মা? এই ক্ষতগুলোর সাথে যেন আমি জড়িয়ে।”
মোহের পাশে বসেন মিসেস সুফিয়া। মোহ আরো বলে,
“আমার সম্মানটা বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনের পরোয়াই করলেন না? কেন করলেন না? এতকিছু করলেন উনি তার বদলে আমি কী করলাম উনার জন্য? কিছুই করতে পারলাম না।”
মিসেস সুফিয়া মেয়ের মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্পর্শ দিয়ে বললেন,
“সারাজীবন তো পড়ে আছে একে অন্যের জন্য করার জন্য। তোরা দুজন দুজনের সম্মান রক্ষার কবজ হবি না হয়! নয়ত একে অন্যের যত্নের কারণ হবি।”
চলবে….