যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
12

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৭ [দ্বিতীয় খণ্ড]

সপ্তাহখানেক স্বচ্ছকে ভুগতে হলো যন্ত্রণায়। দিন যেতে যেতে রুগ্ন শরীরে কিছুটা বল ফিরে পেতে থাকল। কপালের সেলাই কে/টে ছোটো মতো ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেওয়া হলো। তবে এতকিছুর মধ্যে স্বচ্ছের কাছে সবচেয়ে মারণ সম যাতনার কারণ ছিল মোহের কোনো দেখা না পাওয়া। এমনকি তার কোনো কণ্ঠ শোনারও সুযোগ মিলেনি স্বচ্ছের। মেয়েটা কল রিসিভ করছে না। কারোর কাছে তার খবর জানতে চাইলে কেউ খোলাসা করে কিছু বলছে না। হাঁসফাঁস করতে করতে এতগুলো সময় কেটে যাওয়ার পরে ডক্টর আজকে তাকে ডিসচার্জ করতে চাইছে। প্রচণ্ড জেদ ধরে পায়ে এখনো টনটনে ব্যথা থাকার পরেও মাটিতে পা ফেলে হাঁটতে আরম্ভ করছে সে। স্বচ্ছের এরূপ উতলা মন দেখে ফারাহ অধৈর্য হয়ে বলল,
“আরো দুইদিন হসপিটালে থাকা উচিত ছিল না তোমার? এখনো কিন্তু সেরে উঠতে পারো নি তুমি।”

স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চেপে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর করে,
“আমার দম বন্ধ হয়ে আসে এখনো এখানকার গন্ধে। আমি আর একঘণ্টার বেশি দুই ঘণ্টা কাটালেই ম;রে যাব। তাছাড়া আরো দুইদিন থাকলে হসপিটালের বিলের খরচ বাড়বে।”

ফারাহ খানিকটা অবাক হয় বটে। আগের সময়ের অযথা টাকা উড়ানো ভাইটা এখন কত হিসাব-নিকাশ করে চলতে শিখেছে। স্বচ্ছ ফের প্রশ্ন করে,
“মোহের কোনো খোঁজ পেলে? কল করেছিলে?”

ফারাহ এবার দায়সারা এবং উদাস মনে বলল,
“আমার কথা তো বাদ দাও। শৌভিকের কলও রিসিভ করছে না। ওর কাছ থেকে আমি আর পজিটিভ ভাইব পাচ্ছি না। কেমন দূরে দূরে সরে যাচ্ছে।”

বুক চিরে দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো স্বচ্ছের। আনমনে বলল,
“হতে পারে ওর পরিবার এখন ওকে যোগাযোগ করতে দিতে চাইছে না। হয়ত এখন এই সম্পর্কটা মানবেও না। মানার কথাও নয়। যাকে নিজের ভালোবাসার সংজ্ঞা বলি তার সম্মানে আঘাত হানা হয়েছিল আমার জন্যই। এজন্য হয়ত তারা পিছু হটে যাচ্ছে।”

ফারাহ স্বচ্ছের বাহু ধরে তাকে বসিয়ে স্বচ্ছের একগাল টেনে বলে,
“তারা যদি এমন ভাবে তাহলে তারা একটা হিরার টুকরো জামাইকে হারাবে। অনেক হলো এসব কথা। এখন এই পাঞ্জাবিটা পরো তো ভাইয়া। আমার নিজের ডিজাইন করা। পুরো নিউ কালেকশনে আসবে। তোমাকে সর্বপ্রথম ট্রাই করতে দিচ্ছি।”

স্বচ্ছ ভ্রু কুঁচকায়। সাদা রঙের পাঞ্জাবি এবং গাঢ়ো খয়েরী রঙের কটি নেড়ে বলে,
“হসপিটাল থেকে ফিরছি। কোনো বিয়ে করতে যাচ্ছি না এসব পরাবে আমাকে। শার্ট বা টিশার্ট আনো নি?”

ফারাহ মাথা নাড়িয়ে সোজা বলে দেয়,
“ভালোর জামানা নেই। কোথায় লেখা আছে যে বিয়েতেই মানুষ পাঞ্জাবি পরে? আরে বাবা সুস্থ হয়ে মায়ের কাছে ফিরবে। তো একটু ফিটফাট হয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ালে খুশি হবে না? কোনো রকম কমপ্লেইন না করে এসব চেঞ্জ করো। তোমার গায়ে এক হসপিটালের জামা দেখতে দেখতে আমারও চোখ পঁচে গিয়েছে।”

ফারাহ পোশাক স্বচ্ছের হাতে ধরাল। মেজাজ বিগড়ে থাকা স্বচ্ছ এবার কর্কশ গলায় চিল্লে উঠল,
“আমার ভালো লাগছে না। সবকিছু বিষ লাগছে। নিজেকে অবধি বিষ লাগছে। এমন কিছু করো না যেটাতে আমার রাগ হয়।”

ভয়ে খানিকটা হকচকিয়ে উঠলেও নিজেকে সামলায় ফারাহ। তবে মুখ মলিন করল সে ইচ্ছেকৃত। স্বচ্ছের কথার জবাবে নিরুত্তর থেকে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। তারপরই স্বাভাবিক হলো তার মুখভঙ্গি। সে জানে সামান্য মন খারাপের ভান করলেই তার কথা মেনে যাবে স্বচ্ছ। নীরবে ফারাহর দেওয়া পোশাক পরিধান করে ফেলবে। তাই নিশ্চিন্ত হয়ে ফারাহ শৌভিককে কল করল বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে। সেই উচ্ছ্বাস নিমেষে মিশে গেল শৌভিক কল রিসিভ না করায়। কয়েকদিন ধরে এভাবেই চলছে। ফারাহর কল রিসিভ হয়না। এত ব্যস্ততা শৌভিকের! ফারাহ নিজের জেদি ও ব্যাকুল মনকে সায় দিয়ে নিজেকে বোঝায়।

নিজের পোশাক পরিধান করে আস্তে করে খুঁড়িয়ে হেঁটে নিজের ভাঙা ফোনে হাত দেয় স্বচ্ছ। স্ক্রিনের অবস্থা বেজায় খারাপ। সেই ফোন থেকে কল করে মোহকে। কিন্তু তার কল মোহ ধরেনা। অগুনতি কল, অগুনতি মেসেজ কিন্তু মেয়েটা যেন হারিয়েই গেল। স্বচ্ছ এতদিন ধৈর্য ধরে গেছে। এবার নিজেকে ধাতস্থ করা বড্ড মুশকিল হয়ে পড়ছে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে মোহকে মেসেজ করে,
“কল রিসিভ করো মোহ। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না আর। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে আমার ভেতরের খারাপ মানুষকে জীবিত করে তুলো না।”

পাঁচ মিনিটেও রিপ্লাই আসে না। ফোনটাই ছুঁড়ে মারে স্বচ্ছ মেঝেতে। ফোনের যেটুকু প্রাণ আছে সেটাও যেন শেষ হয়ে যায় নিমিষে। শব্দ শুনে কেবিনে ঢোকে ফারাহ। রাগে চোয়াল শক্ত করে ফোনের উপর পা তুলে দিয়ে চিল্লিয়ে বলে,
“যেটাই হোক অন্তত আমাকে খবর তো দিতে পারে! যোগাযোগ করে তো বলতে পারে সমস্যা কী! ইথানের খবর চেয়েছিলাম গতকাল সেটাও দেয়নি। সমস্যা কী ওর?”

চেঁচিয়ে উঠে মুখ লাল করে ফেলল স্বচ্ছ। এমন আওয়াজে দুয়েকজন নার্স জমা হলো। ফারাহর মুখ দিয়ে কোনো সান্ত্বনা বানী বের হলো না ভয়ে।

ল্যাপটপ নিয়ে নিজের পছন্দের জায়গা অর্থাৎ বাড়ির রুফটপে বসে কিছু ডকুমেন্টস চেক করছিল অন্বেষা। তার রুফটপ যেন আস্ত সবুজে ঘেরা বাগান। ফুলের গন্ধ চারিদিকে যেন মাখিয়ে থাকে। এসবে যত্ন রাখার জন্য আলাদা লোক করা হয় অন্বেষার আদেশে। সেখানে আচানক জুতা পরে প্রবেশ করে তার ভাই নাহিয়ান। রাগের মাথায় উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করেন,
“মি. মুহিবের বিরুদ্ধে তুমি কে/ইস করলে কী করে? তুমি জানো ও আমার অফিসে কত বছর ভালো সার্ভিস দিয়ে এসেছে? আজ কার কথায় তুমি এসব করছ অন্বেষা?”

অন্বেষার যেন ভ্রুক্ষেপহীন। সে শুধু ভাইয়ের পায়ের দিকে লক্ষ্য করে বলল,
“আমার এখানে কেউ জুতো পরে আসুক সেটা পছন্দ নয়। আই ডোন্ট লাইক ইট। উঁচু আওয়াজও আমার পছন্দ নয়।”

“ঠিক আছে। ভালো করেই জিজ্ঞেসা করছি যে ওই স্বচ্ছের কথায় তুমি এত বড়ো স্টেপ কেন নিলে অন্বেষা? হোয়াই? দেশের বাহির থেকে এসে এসব শুনতে হবে ভাবতেও পারিনি।”

নিজের কাজেই মনোযোগ দিতে চাইছিল অন্বেষা। কিন্তু এসব কথা তার আর হজম হলো না। ল্যাপটপ বন্ধ করে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“উনাকে জেলে কেন ফাঁ/সির দড়িতে ঝুলতে দেখার ইচ্ছে আমার। আপাতত জেলে আছে। যদি বাইরেও থাকত হয়ত স্বচ্ছ এতদিনে ওকে মে/রেও দিতো।”

নাহিয়ান রাগে কটমট করে বলল,
“পাগল হয়ে গেছো তুমি অন্বেষা।”

অন্বেষা মৃদু হেসে বলে,
“নো, মাই বিগ ব্রাদার। আমাকে একটা কথা বলো। কেউ যদি কখনো আমাকে নোংরা ইঙ্গিত, এবিউজ করে অথবা তোমার ওয়াইফকে নিয়ে বাজে কথা বলে কী করবে তুমি?”

নাহিয়ান চোখ মুখেই যেন আগুন ধরে গেল। হাতের মুঠো শক্ত করে বলল,
“এত সাহসই কেউ পাবেনা যে তোমাকে আর আমার স্ত্রীর দিকে নজর দেবে।”

“কিন্তু সবার তো তোমার মতো ভাই বা হাজবেন্ড নেই। তোমার মতো পাওয়ারও নেই। সেসব মেয়েরা কী করবে ব্রো? দিনের পর দিন সব সহ্য করবে?”

“তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে স্বচ্ছের কথা ব্যতীত? কী গ্যারান্টি আছে যে ও মিথ্যে বলছে না?”

অন্বেষা দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানাল,
“আছে। আমার অফিসের আরেকজন এমপ্লয়ি লিমা। এতদিন ও চুপ করে ছিল। কিন্তু স্বচ্ছের সাহস দেখে সব বলেছে। সেদিন স্বচ্ছ ও মি. মুহিবের কথোপকথনের সাক্ষী ছিল সে।”

দমে গেল নাহিয়ান। অন্বেষা ফের বলল,
“না জানি তোমার অফিসের কত লেডি এমপ্লয়িকে হ্যারাজ করেছেন ওই লোক! কাউকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করো না ভাইয়া।”

দীর্ঘশ্বাস নিলো নাহিয়ান। অন্বেষা আনমনে বলল,
“জানো, ভাইয়া! স্বচ্ছের কাছে কোনো ক্ষমতা নেই। হি হ্যাজ নো পাওয়ার। তবুও সেদিন ও মি. মুহিবের এমন দশা করেছিল। স্ট্রেঞ্জ না? তার একটুও ভয় নেই।”

আনমনা অন্বেষা শুধু ভাবনায় পড়ে। মনে মনে মোহকে চরম ভাগ্যবতী হিসেবে দাবি করে।

ফারাহর একটি নিজস্ব ছোটোখাটো ফ্ল্যাট ছিল। যেটা সে নিজের পরিশ্রম দিয়ে কিনেছিল বিশেষ উদ্দেশ্যে। স্বচ্ছকে নিয়ে সেখানেই এসেছে ফারাহ। এই এক জায়গায় আসতে আসতে স্বচ্ছের বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে ফারাহকে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই স্বচ্ছ ফারাহকে আবারও অধৈর্য হয়ে শুধায়,
“আমরা হঠাৎ এখানে এলাম কেন? কী হয়েছে ফারাহ?”

ফারাহ এবার দাঁত কিড়মিড় করে চুপ রইল। উত্তরই দিলো না। সামনের ছোটো ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ছিল সৌমিত্র ও মিসেস জেবা। ছেলেকে দেখে শান্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলে বসালেন নিজের কাছে। নির্বিঘ্নে জানতে চাইলেন,
“শরীর কেমন আছে তোমার? কোথাও ব্যথা করছে এখনো?”

স্বচ্ছ সেই প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে উল্টো প্রশ্ন করল,
“আমাকে ছাড়ো। তোমাদের কী হয়েছে? আমাকে এখানে নিয়ে আসা হলো কেন? আমাকে কিছু বলবে তোমরা কেউ?”

মিসেস জেবা শব্দহীন হেসে বলেন,
“তোমার শরীরের অবস্থা দেখেছ? আমাদের বাড়ি এখান থেকে অনেকটা দূরেই হয়। এই অবস্থায় তোমার এতদূর জার্নি না করা ভালো।”

স্বচ্ছ এই প্রসঙ্গ থেকে এবার সরে গেলেও হন্তদন্ত হতে উঠে দাঁড়ায়। তাড়াহুড়ো করে বলে,
“ঠিক আছে। কিন্তু আমার বাইরে একটু কাজ আছে। আমি বাইরে যাব।”

মিসেস জেবা বিচলিত হলেন। চিন্তিত হয়ে বলে উঠলেন,
“কোথায় যাবে?”

স্বচ্ছ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“মোহের বাড়ি।”

আবারও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে এক বুক যাতনা নিয়ে বলে,
“ও আমার সাথে যোগাযোগই করছে না মা। মনে যেন হচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার মতো। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।”

মিসেস জেবা স্বচ্ছকে যেতে দিলেন না। বাহু ধরে বসিয়ে নির্বিকার সুরে বললেন,
“এভাবে বলতে নেই। সবকিছুতে ধৈর্যের ব্যাপার থাকে। তুমি এত অধৈর্য কেন স্বচ্ছ? কিছু হবে না। দরকার হলে আমি নিজে মোহের বাড়ি গিয়ে কথা বলব।”

মায়ের কথায় অস্থিরতা কমে না স্বচ্ছের। একরোখা জেদ ধরে বসে থেকে বলেন,
“আমি এখনি যেতে চাই।”

কথোপকথনের মাঝে হঠাৎই উদয় হলো শৌভিক। হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করতে করতে বলে ফেলল,
“আমি এসে গেছি, এসে গেছি। সব কি মিস করে গেলাম নাকি?”

নিজের প্রিয় স্ত্রীর অগ্নিদৃষ্টি দেখে শৌভিকের বোধগম্য হয় সে ভুল সময় ভুল কথা বলে যাচ্ছে। স্বচ্ছের বিভ্রান্তিপূর্ণ চেহারা দেখে বোকা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো, স্বচ্ছ? ভালোই তো তাই না?”

স্বচ্ছের দৃষ্টিতে এবার সবার মাঝে থাকা উদ্ভট এক রহস্যের জট ধরা পড়ল। সন্দিহান হয়ে বলল,
“আমি তো ঠিকঠাক। কিন্তু তোমাদের ঠিকঠাক লাগছে না মনে হচ্ছে। আচ্ছা সবাই এত সাজগোজ করেছ। কোথাও যাওয়া হচ্ছে?”

সৌমিত্র এবার রাখঢাক না করে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বলে দিলো,
“আরে আমার ভাইয়ের বিয়ে তো!”

সৌমিত্রের কথায় থতমত খেয়ে গেল সবাই। ফারাহ ইচ্ছে করে জোরে কেশে উঠল সৌমিত্রকে ফাইনাল বিপদ সংকেত দিতে। সেটা বুঝে ভোলা সৌমিত্র ভাইয়ের দিকে চাইল। ততক্ষণে স্বচ্ছের নিখুঁত দৃষ্টি তার দিকেই একভাবে চেয়ে আছে। সেই চাহনি যে কারো মুখ থেকে চরম সত্যি উগলে নিতে বাধ্য করবে। তবুও সে তীব্র সাহস জুগিয়ে বলল,
“আরে ওইযে আমাদের খালামনির ছেলের দাদার নাতির একটা ভাতিজার বিয়ে।”

স্বচ্ছ সম্পর্কের সমীকরণ মনে মনে মিলাতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। এই পর্যায়ে তার কানে ভেতরের ঘর থেকে গুনগুন আওয়াজ এলো। এবার ফারাহকে প্রশ্নবিদ্ধ করল সে।
“ভেতরের ঘরে কি আর কেউ আছে ফারাহ?”

“না, তো। কে থাকবে?”

ফারাহর মুখ থেকে কথা শেষ হওয়া মাত্র একটি বাচ্চা ছেলের গলা জোরেশোরেই পাওয়া গেল। তা কর্ণপাত হওয়া মাত্র স্বচ্ছ চোখ বড়ো করে বলে দিলো,
“ইথান!”

ভেতরের ঘরের দরজাটা লাগানো স্বচ্ছ দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে। ইতিমধ্যে ভেতরের ঘরের কথাবার্তা বেশ ভালোভাবেই শোনা যাচ্ছে। চেনা পরিচিত আওয়াজে অস্থির চিত্তে ছুটতে চায় মন। সে এবার চিল্লিয়ে উঠে প্রশ্ন করে,
“কারা আছে ঘরের ভেতরে?”

কারোর কাছে কোনো জবাব পেল না স্বচ্ছ। এরপর কিছু স্পষ্ট কথা ভেসে এলো তার কানে। কেউ একজন বলে চলেছে,
“মোছা: মোহ আনবীর আপনি কি মো: সরোয়ার সাহেরের বড়ো ছেলে মো: আহিয়ান স্বচ্ছের সঙ্গের দুই লাখ এক টাকা মোহরানায় বিয়ে কবুল করছেন?”

কিছুক্ষণ নীরব কাটে সময়। মধুময় সুরে ভেসে আসে নারী কণ্ঠীর কবুল করার সেই বাণী।
“আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”

স্বচ্ছের শরীরের রগে রগে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ভেতরের উন্মাদনা বুক চিড়ে বেরিয়ে আসার পায়তারা করছে। নিজেকে যেন অন্য এক দুনিয়ায় আবিষ্কার করে বসল স্বচ্ছ। সেখানে বসে যেন সে ঘোরে আঁটকে গেছে। বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই কবুল করা নিকাহ।

সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। স্বচ্ছ উদ্ভ্রান্তের মতো পাশে থাকা সৌমিত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সৌমিত্র দাঁত কেলিয়ে বলল,
“জি ভাইয়া! আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। আপনার হিল্লে হয়ে গেল!”

কাজি সাহেব বাহিরে এলেন। সামনের চেয়ারে বসলেন এবং কাগজপত্র সব রাখলেন টেবিলে। শুধালেন,
“শুরু করি?”

শৌভিক দ্রুত সম্মতি জানায়। গলা খাঁকারি দিয়ে বিয়ে পড়ানো আরম্ভ করেন কাজি সাহেব। তখনও স্বচ্ছ যেন এক স্বপ্নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথা ভনভন করছে তার। কাকে কী বলবে বুঝে ওঠার আগেই কাজি সাহেব স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“মো: আহিয়ান স্বচ্ছ আপনি কি মো: আজহার আহমেদের একমাত্র মেয়ে মোছা: মোহ আনবীরকে দুই লাখ এক টাকা মোহরানায় বিয়ে কবুল করছেন?”

জবান বন্ধ স্বচ্ছের। নীরবতার মাঝে সৌমিত্র স্বচ্ছের কানে কানে গিয়ে বলল,
“তোমার জন্য একটা মেসেজ এসেছে ভাবির তরফ থেকে। প্লিজ চেক!”

সৌমিত্র স্বচ্ছের একটা পুরোনো ফোন ধরিয়ে দিলো। স্ক্রিনে মোহের মেসেজে বিশাল একখানা ধমকি দিয়ে লিখেছে,
“আমি কিন্তু কবুল করে নিয়েছি। আপনি কি এখনি এই মূহুর্তে কবুল বলবেন? নাকি বিয়ে সম্পূর্ণ হবার আগেই ডিভোর্স ডেট ফাইনাল করব?”

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৮ [দ্বিতীয় খণ্ড]

মোহের পাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তা দেখার পর মুহূর্ত অপেক্ষা না করে স্বচ্ছ বাধ্য ছেলের মতো কবুল করে নিলো নিজের সঙ্গে মোহের বিয়ের সম্পর্ক। কবুল বলার পর স্বচ্ছের হুঁশ হলো। কী হলো তার সাথে? এক জবানবন্দিতে বুঝি সে বিবাহিত হয়ে গেল? মোহের নামে নিজেকে বন্দি বানাল! অদ্ভুত অনুভূতিতে শিউরে উঠল শরীর। শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলার স্বর কাঁপতে থাকল। ততক্ষণে সৌমিত্র তাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাসের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আহা, কী আনন্দ! আমার লাইন পরিষ্কার করার জন্য তোমায় একটা চুমু দিতে ইচ্ছা করছে ভাইয়া।”

ফারাহ ফিক করে হাসল। কাজি সাহেব সই করতে কাবিননামা এগিয়ে দিলেন। বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে হাতে কলম ধরল স্বচ্ছ। এবার লিখিতভাবে মোহকে নিজের করে নেওয়ার পালা এসে গেলো যে! সই করতে গিয়ে হাতের লেখা সামান্য বিগড়ে গেল তার। এই প্রথম সাইন করতে গিয়ে হাত কাঁপল। অন্যহাতে সে হাত চেপে ধরল সাইন করে। শরীরের প্রতিটা রগ শিরশির করছে তার।

এরপরেই তানিয়াকে দেখা গেল। সেই দিনের গোলাপি শাড়ি পরিহিত অবস্থায়। মুখশ্রীতে দারুণ হাসি। সে ধরে নিয়ে আসছে মোহকে। বধূয়া মেয়ের মাথা থেকে মুখ অবধি পাতলা কাজ করা ওড়না দিয়ে ঢাকা। তবুও সেই পর্দা ভেদ করেই দেখা যাচ্ছে তার মুখের স্মিত হাসিখানা। স্বচ্ছ মাথা তুলে মোহকে দেখতে চায়। মেয়েটার হাসি দেখেই দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে তার। বুকের ভেতর কী আশ্চর্য রকম অনুভূতিরা খেলা করছে। ঢোক গিলে মোহের পরতে পরতে সৌন্দর্য দেখে নিচ্ছে সে। সৌমিত্র স্বচ্ছের পাশ থেকে উঠে যেতেই মোহকে বসানো হলো। স্বচ্ছ অবাকপানে সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার মনে প্রশ্ন অনেক৷ কেন এই লুকোচুরি? তবে প্রশ্নটা আর করা হলো না। হইচইপূর্ণ হয়ে উঠল পরিবেশ। এর মাঝে মোহ স্বচ্ছকে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
“যেই হাতটা ধরেছেন সেটা সম্পূর্ণ ধরে রাখতে শিখুন। কারণে অকারণে নিজেকে অযোগ্য ভেবে ছেড়ে দিতে চান কেন? এই ভুলটা যেন আর কস্মিনকালেও করবেন না।”

স্বচ্ছ কিছুটা রূঢ় স্বরে বলে,
“তুমিই তো যোগাযোগ করছিলে না। আমি ভেবেছিলাম…”

মোহ স্বচ্ছকে থামিয়ে ধীর গলায় বলল,
“রাগ হয়েছিল আপনার উপর। হসপিটালের বেডে শুয়ে আমাদের সম্পর্কের মাঝে যোগ্যতা-অযোগ্যতার কথা টেনেছেন। আপনিই তো নাকি ফারাহকে বলেছেন আপনি আমাকে সারাজীবন আগলে রাখার যোগ্যতা অর্জন করেন নি। বিয়েটা হওয়া উচিত নয়। কেন বলেছেন?”

“কারণ আমার মনে হয়েছিল আমি ব্যর্থ।”

“সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি নিজেও তো ব্যর্থ। আপনার শরীরে প্রতিটা আঘাতের দাগের জন্য আমি দায়ী৷ তবুও কিছু করতে পারিনি।”

স্বচ্ছ আচানক মোহের ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হাত মুঠোয় ধরে বলল,
“তবে চলো ব্যর্থতা থেকে শুরু করি৷ তুমি, আমি আর আমাদের ছেলে ইথান!”

পাতলা ওড়নার পেছনে মোহের চোখ ঝলকানি হাসিটা দেখা যায়। কথার মাঝে হঠাৎ আগমন হয় ইথানের। মুহূর্তের মধ্যে স্বচ্ছের গলা জড়িয়ে ধরে মায়া ভরা কণ্ঠে শুধায়,
“কেমন আছো পাপা? তোমার তো অনেক লেগেছিল। ঠিক হয়েছে?”

স্বচ্ছ ইথানের গালে চুমু খেতে বলল,
“তোমাকে চুমু খেলাম আর সব ব্যথা ঠিক হয়ে গেল।”

ইথান তার আরেকটা গাল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তাহলে আরো একটা খাও তাহলে একবারে ফিট হয়ে যাবে।”

মোহ আর স্বচ্ছ ফিক করে হেসে দিলো। স্বচ্ছ ইথানের গালে আরেকটা চুমু খেয়ে ইথানের কানে কানে মোহের দিকে চেয়ে বলল,
“আরেকটা তোমার মাম্মামের গালে চুমু খাব৷ তাহলে আমি ফিটের ওপর একশ ফিট হয়ে যাব।”

ইথান তার মুখ চেপে ধরে খিলখিল করে হেসে দিলো। কথাগুলো ঠিকই কানে এলো মোহের। কড়া দৃষ্টিপাত করে স্বচ্ছের হাতের তালুতে চিমটি কেটে বলল,
“কী শেখাচ্ছেন ওকে এসব? ছি! চুপ করুন।”

সেই রাগে রাঙা নেত্রপল্লব দেখার ইচ্ছে পোষণ করল স্বচ্ছের উতলা মন। উঁকি দিয়ে ঘোমটার নিচ দিয়ে দেখতে গেলেই তৎক্ষনাৎ ফারাহ স্বচ্ছের কাঁধ ধরে সোজা করে দিয়ে বলল,
“একেবারে বাসর ঘরে বউয়ের পরিপূর্ণ চাঁদের মতো মুখ দেখবে। তার আগে চিন্তাও করবে না।”

তানিয়া দ্রুত এসে মোহের ঘোমটা আরো টেনে দিলো। অতঃপর একপাশে সরে যেতেই ফাঁকতালে সৌমিত্র তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে জানতে চাইল,
“আমার ক্ষেত্রেও কি একই রুলস? আই মিন, বাসর ঘরেই মুখ দেখতে হবে?”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় তানিয়া। সৌমিত্রের মুখে নিষ্পাপ হাসি। তানিয়া কটমট করে বলে উঠল,
“আমি ঠিক করেছি বিয়েই করব না। যান তো এখান থেকে।”

হনহনিয়ে অন্যদিকে দূরে ছিটকে গেল তানিয়া। একবারের জন্যও সৌমিত্রের মুখের দিকে তাকাল না।

বিদায় ক্ষণে মোহ কাঁপছিল। অসহায় দুচোখ খুঁজছিল বাবাকে। এত লোকের মাঝে আজহার সাহেব নেই। মিসেস সুফিয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। নিঃশব্দে ফেলা অশ্রু মেয়েকে দেখতে দিলেন না। মাকে জড়িয়ে ধরার পর মোহ জানতে চাইল,
“বাবা কোথায়?”

মিসেস সুফিয়া কথা বলতে পারছেন না। কান্না উনার গলা আঁটকে ধরেছে। মোহ অস্থির চিত্তে ডেকে ওঠে,
“বাবা!”

সবকিছু ছেড়ে ফের ভেতরে দ্রুত ঢুকে আসে মোহ। ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে আজহার সাহেবকে না দেখে ছোটো ঘরটায় ঢুকতেই আজহার সাহেব চমকে যান। টলমলে চোখ ভর্তি পানি লুকাতে সক্ষম আর হলেন না। মেয়ের সামনে এভাবে যাওয়ার সাহস ছিল না উনার। যেন মনে হচ্ছে উনার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। মোহ হঠাৎ ছুটে এসে বাবার বুকে মাথা রেখে বাচ্চার মতো কেঁদে ফেলে বলল,
“বাবা আমি যাব না তোমাকে ছেড়ে।”

কষ্টের মাঝেও হাসার চেষ্টা করলেন আজহার সাহেব। মেয়ের মাথায় স্নেহের সহিত হাত বুলিয়ে বললেন,
“পাগলি মেয়ে! একটা কথা শোনো, যখনি তুমি কবুল বলেছ, কাবিননামায় সাইন করেছ তখনি তোমার ফার্স্ট প্রায়োরিটির জায়গায় তোমার স্বামী, সংসার চলে এসেছে। তুমি আমার বুঝদার মেয়ে সেই ছোটো থেকে। একটু জেদি! কিন্তু সেই জেদ সবসময় ভালো কাজে লাগিয়েছ। তাই সোজাভাবে বলছি, এখন তোমার নিজের সংসার আছে। সেখানে তোমাকে বাঁচতে হবে।”

মোহ কোনো কথা বলে না। শুধু ভাবে, এমন নিয়ম কেন? এত নিষ্ঠুরতা কেন? আজহার সাহেব আরো বলেন,
“আমি জানি তুমি সেখানে শুধু বাঁচবে না। সেখানকার রানি হবে। সেই যোগ্যতা তোমার রাজার আছে।”

মোহ এবার মাথা তোলে। ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকায়। আজহার সাহেব থামলেন না। মৃদু সুরে মনের সব কথা উগড়ে দিতে লাগলেন।
“তুমি যখন জন্ম নিলে তখন আমার সংসার এতটা আলোকিত হলো যে আমি আর তোমার মা চাইলামই না আর কোনো সন্তান নিতে। আমাদের সমস্ত জুড়ে তুমি দখল করেছিলে। আমি চেয়েছি তোমাকে শুধু আমার মেয়ে নয় একটা আদর্শ বানাতে। চেয়েছি সৎ শিক্ষা দিতে। আমি যে সেটা পেরেছি তার প্রমাণ ইথান৷ আরো প্রমাণ হচ্ছে তোমার এমন সাহসিকতা। তুমি আপোষ করো না। এখানেই আমার শান্তি। তুমি আমার বাঘিনী মেয়ে। তুমি বারবার স্বচ্ছের হাত ধরেছ। স্বচ্ছ ধরেছে তোমার হাত। সব জেনেও ধরেছে। একটা মেয়ের বাবা সবথেকে বেশি সুখী তখনি হয় যখন সে বুঝতে পারে মেয়ের জীবনসঙ্গী সেই বাবার মতোই মেয়েকে আগলে রাখছে।”

মোহ নিস্তব্ধ হয়ে রয়। শুধু কর্ণকুহরে আসছে বাবার কথাগুলো। সে বাবার হাতটা ধরে নিজের গালে ঠেকিয়ে বলে,
“যত যাই হয়ে যাক আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি বদলাবে না। হ্যাঁ, আমার প্রথম গুরুত্ব এখন আমার সংসার যেমন হয়েছে তোমরাও তেমন আমার প্রথম গুরুত্ব।”

আজহার সাহেবের বুক হাহাকার করে উঠলেও ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে হালকা করেন। নম্রভাবে মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে বলেন,
“বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। চলো।”

বাইরে আসতেই মিসেস সুফিয়া বাবা-মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“বাবা-মেয়ের কথাবার্তা হলো অবশেষে?”

আজহার সাহেব মাথা নাড়ান। মোহ খেয়াল করে ইথান মিসেস সুফিয়ার কোলে চুপটি করে রয়েছে। অথচ বাবার কাছে যাওয়ার আগেই সে ইথানকে স্বচ্ছের কোলে দেখেছিল। নতুন বাড়িতে যাওয়ার জন্য উৎসুক ছিল বেশ। মোহ ইথানের হাত ধরে বলে,
“কী হলো? মন খারাপ কেন?”

ইথান ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“নানুমনি, নানুভাইকে ছাড়া নতুন বাড়িতে যাব না। ওদেরকে নিয়ে চলো না মাম্মা, প্লিজ!”

মোহ কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। দিশাহারা হয়ে স্বচ্ছের পানে তাকাল। স্বচ্ছও বাকহীন। মিসেস সুফিয়া বললেন,
“মোহ, তুই আজকে যা। ইথানকে কালকে আমরা নিয়ে যাব। ও আপাতত আমাদের কাছে থাক আজকের দিনটা। বাবুটাও তো আমাদের ঘর ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে। একটু সময় দিতে হবে।”

মোহ ইথানকে ছেড়ে যেতেই চাইল না। কিন্তু ইথানেরও একগুঁয়ে জেদ দেখে যেতে হলো ইথান ছাড়াই। ইথান কিছুটা খুশি হয়ে ভাবল কাল নানুভাই ও নানুমনির সঙ্গে একবারে নতুন বাড়ি যাবে। মাকে হাসি মুখেই বিদায় জানাল সে। একবার জানালার কাঁচ দিয়ে বাবা-মাকে দেখল সে। মনটা আনচান করছে। আবারও দম ফেটে কান্না পাচ্ছে। গাড়ি ছেড়ে দিলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইল মোহ। স্বচ্ছ আচমকা বলে উঠল,
“কান্না আঁটকে রাখার মানে কী? কাঁদতে মন চাইলে কাঁদবে।”

মোহ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে স্বচ্ছ সামনের দিকে চেয়ে আছে। এরপর স্বচ্ছ মোহের মাথা ধরে আস্তে করে নিজের বুকের কাছে নিয়ে এলো। নিজের সঙ্গে আস্তে করে চেপে ধরে বলল,
“কাঁদো। প্রায় পঁচিশটা বছর যাদের সঙ্গে কাটিয়েছ তাদের ছেড়ে যেতে আকাশ সমান কষ্ট হবে। সেই কষ্ট বের করে দেওয়া প্রয়োজন।”

সায় পেয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো মোহ। স্বচ্ছের শেরওয়ানি খাঁমচে ধরে খানিকটা শব্দ করে অশ্রু ফেলতে লাগল সে। খানিকটা পর অনেকটা হালকা লাগল তার। প্রিয় মানুষের বুকে ঝাপটে পড়ে কান্নাকাটি করার মাঝেও একটা অন্যরকম শান্তি খুঁজে পেল মোহ। ভাগ্যিস গাড়িতে আর কেউ নেই। ফারাহ ইচ্ছে করেই গাড়িতে আর কাউকে বসতে দেয়নি। মোহ এবার সোজা হয়ে বসল। স্বচ্ছ রুমাল বের করে মেয়েটার গালে গড়িয়ে থাকা পানি ধীরে ধীরে মুছে দিয়ে বলল,
“আমি বলব না যে তোমার জীবনে কোনোদিন দুঃখ আসতে দেব না। কারণ মানুষের জীবনটাই দুঃখের৷ মাঝে মাঝে সুখ আসে। কিন্তু দুঃখ যখন আসবে যখন আঁকড়ে ধরে কান্না করার জন্য তুমি আমার বুকটা পাবে। তোমার দুঃখটা আমি শুষে নিতে চাই।”

“ইথানটাও এলো না। আরো বেশি খারাপ লাগছে।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে মোহ। স্বচ্ছ মোহের চুলের সাথে আটকানো ক্লিপ খোলার চেষ্টা করে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার এত ভারি জিনিসপত্রের কারণে গরম লাগছে। আস্তে আস্তে বলে,
“ইথান ছোটো থেকে তোমাদের আদরে যেমন ছিল তোমার মা-বাবার আদরেও ছিল। তাদের স্নেহ ছেড়ে বেচারা বের হতে পারছে না। দোটানায় পড়ে যাচ্ছে। ওকে একটু সময় তো দিতে হবে।”

মোহ নিশ্চুপ। নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় জানালার বাইরে তাকায়।

গাড়ি ড্রাইভ করছে শৌভিক। পাশেই ফারাহ রয়েছে তবে একদমই নীরব। রাস্তার থেকে মনোযোগ সরিয়ে মাঝে মাঝেই ফারাহর দিকে লক্ষ্য করছে সে। পেছনে আছে ফারাহর মা ও সৌমিত্র। তাই কিছু বলতে চাইছে না শৌভিক। তবুও গলা খাঁকারি দিয়ে সৌমিত্রকে বলে বসল,
“সৌমিত্র, তোমার বোন কি সকাল থেকে আজ ভালো করে খাওয়াদাওয়া করেনি?”

“খাওয়াদাওয়া তো করেছিল ভাই। বরং আজকে ভাইয়ের বিয়ের উপলক্ষে আরো বেশিই খেতে দেখলাম। আপনাকে বিয়ে করে খাওয়ার রুচি ওর আরো বেড়েছে। গাল নাদুসনুদুস হয়েছে দেখছেন না?”

“হুমম! তাহলে তোমার বোন আমার উপর রাগ করে আছে।”

ভ্রু কুঞ্চিত করে রূঢ় স্বরে ফারাহ প্রতিবাদ করে বলল,
“এমনটা কেন মনে হলো?”

“কারণ ডিজাইনার ফারাহ দুটো কারণে মুখ ফুলিয়ে রাখে। প্রথমটা ভালোমতো খাওয়াদাওয়া না হলে, দ্বিতীয়টা আমার ওপর রাগ করে থাকলে। কোনো রাগ থাকলে এখান মান ভাঙাভাঙি করে নিই শাশুড়ির সামনে। নইলে সহজে আপনার মান ভাঙতেই চায়না। ঘাম ছুটে যায় মিসেস।”

সবটা শুনে মিসেস জেবা মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কী হয়েছে ফারাহ? কোনো কারণে জামাইয়ের ওপর রাগ করে থাকলে মিটমাট করে নে৷ একটুতেই রাগারাগি কিন্তু ভালো স্বভাব না।”

ফারাহর কণ্ঠস্বর আরেকটু শক্ত হলো। চোখমুখ জড়িয়ে বলে উঠল,
“আজ আমার ভাইয়ের বিয়ে। বিশেষ একটা দিন। তাড়াতাড়ি আসতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার কথা কেউ কি শোনে?”

শৌভিক কিছু বলার আগেই মিসেস জেবা মেয়েকে শান্ত স্বরে বোঝালেন,
“তোকে বুঝতে হবে ওর দায়িত্ব। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরকে বুঝতে হয়। অনেককিছু স্যাক্রিফাইজ করতে হয়।”

ফারাহর মন মানে না। ধীরে ধীরে শৌভিক একেবারেই বদলে যাচ্ছে যেন। তার কাছে বাইরের সব কাজ আগে। ফারাহর কথা যেন সবার পরে। অভিমান হলেও কথা বাড়ায় না সে।

স্বচ্ছের ঘরটাতে বসে আছে মোহ। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সে। ঘরদোরে পুরোনো হাতের কাজের চিহ্ন। দরজা, খাট, জানালা সবকিছুতে কারুকাজ। বোঝা যাচ্ছে স্বচ্ছের নানাভাই অনেক শৌখিন মানুষজন ছিল। মোহ নেমে ঘরের জিনিসপত্র হাত দিয়ে দেখে। কাঁচের থেকে কাঁসার জিনিসপত্র বেশি। কাঁসার ফুলদানিও আছে। সেখানে তাজা রজনীগন্ধা দিয়ে সাজিয়েছে ফারাহ। পুরো ঘরটাই রজনীগন্ধা দিয়ে ভরা। খাটের ওপর দিয়ে মালার মতো সাজিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফুল। গোলাপের শুধু বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ কর্ণকুহরে টিপটিপ শব্দ এলো। একেবারে খোলা বারান্দার দিকে ছুটল মোহ। সেটি স্বচ্ছের ঘরের সাথেই লাগানো। রেলিং ঘেঁষতেই একটু একটু করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল চোখেমুখে। বারান্দার শুরুর দিকে ছাঁদ থাকলেও মাঝখান থেকে কোনো ছাঁদ নেই। অনায়াসে রোদ পোহানো যাবে, বৃষ্টিতে ভেজা যাবে। বেশ দারুণ উল্লাসিত হলো মোহ।

একটু পরেই ঘরে ফিরে এলো। স্বচ্ছের টেবিলে রাখা একটি এলবামে কৌতূহলবশত খুলল মোহ। কাঠের কারুকার্য ভরা সোফাতে বসে দেখল স্বচ্ছের পরিবারের ছবি। মূলত এখানে স্বচ্ছের বাবার ছবিই বেশি। মোহের বুঝতে বাকি রইল না স্বচ্ছ কতটা স্মরণ করে তার বাবাকে। এক পাতায় কী সুন্দর এক পরিবারের ছবি। বাম পাশে মিসেস জেবার কাছে সৌমিত্র এবং ডান পাশে সরোয়ার সাহেবের কোলে ফর্সা ফুটফুটে মেয়ে। কী সুন্দর গোল মুখ তার। বয়স এক বছরের মতো হবে হয়ত। মোহ একটু সময় নিয়ে বুঝল এটা ফারাহ। বাবার একপাশ ঘেঁষে তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ। বেশ খুশি দেখাচ্ছে স্বচ্ছকে। ছোটো স্বচ্ছকে চিনতে মোহের একবিন্দুও ভুল হয়নি। কারণ চেহারা একই রয়ে গেছে। কিন্তু তাদের সামনের চেয়ারে থাকা দুজন বৃদ্ধ মহিলা ও পুরুষকে চিনতে পারেনি মোহ। তাদেরকে চেনার চেষ্টায় সে যখন বিভোর আচমকা স্বচ্ছের কণ্ঠস্বর তার কানে এলো।
“উনারা আমার দাদি আর দাদুভাই। সবাই বলে আমি দাদির মতো দেখতে হয়েছি। কিন্তু উনার মতো শান্তশিষ্ট না হয়ে বাবার মতো রাগচটে হয়েছি।”

মোহের খেয়ালেই আসেনি স্বচ্ছকে। বধূ বেশে থাকা নারীটির মুখে হালকা হাসি এলো। বলল,
“আপনি কখন এলেন?”

“আপনি যখন নিজের সদ্য পাওয়া স্বামীর অপেক্ষা না করে এলবাম দেখতে মগ্ন ছিলেন তখন।”

“লিখে তো নিয়েছি আপনাকে। তাই আপনি পালিয়ে বা হারিয়ে যাবেন এমন কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এজন্য নিশ্চিন্ত মনে এলবাম দেখছিলাম।”

স্বচ্ছ একটু একটু করে মোহের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ভীষণ ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
“আপনার থেকে পালিয়ে যাব এমন দুঃসাহস আমার নেই। কারণ আপনার থেকে পালিয়ে যাওয়া মানে নিজের থেকে পালানো, নিজেকে হারিয়ে ফেলা।”

কথা শেষে স্বচ্ছ নিজের পেছনে রাখা ডান হাত সামনে এনে মোহের দিকে এগিয়ে দেয়। তার হাত ভর্তি একগুচ্ছ কদমফুল। বৃষ্টির পানিতে তারা নিজের আরো স্নিগ্ধতা আর সুগন্ধ ছড়িয়েছে। মোহ উঠে দাঁড়ালে স্বচ্ছ বলল,
“আমি জানি এই ঘরেও অনেক ফুল আছে। চাইলে যেকোনো ফুল দিতে পারতাম কিন্তু কদমফুল দেওয়ার কারণ হলো বর্ষাকাল আর বর্ষণ। যে বর্ষণে মোহ এসেছে প্রেমের মোহ নিয়ে। এই বর্ষণ আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে জুড়ে থাক।”

মোহ কিছুটা সময় অপলক তাকিয়ে রইল স্বচ্ছের পানে। লোকটার ঘোলাটে চোখের মনিতে শুধু সে আঁটকে আছে। মোহ স্বচ্ছের কাছ থেকে ফুলগুলো গ্রহণ করে স্বচ্ছের আরেক হাত ধরে রাখল। মন খুলে ফুলের সুবাস গ্রহণ করল মোহ। ভেজা ভেজা ফুলের দিকে তাকিয়ে সে কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল,
“ভেজা ফুলগুলো দেখে আমার ভিজতে ইচ্ছে করছে।”

স্বচ্ছ চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“এই রাতে?”

স্বচ্ছ আর জবাব পেল না। তার হাত ধরেই টেনে নিয়ে ফুল সমেত ঝমঝমিয়ে আসা বর্ষণের দিকে বাচ্চাদের মতো আনন্দ নিয়ে ছুটল মোহ। বৃষ্টির ফোঁটা বেয়ে পড়ল তাদের সারা শরীরে। চোখ বন্ধ করে ভিজতে গিয়ে মোহ হঠাৎই উপলব্ধি করল তার খোঁপা স্বচ্ছ ধরেছে। মোহ নড়াচড়া বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠল,
“কী করছেন?”

স্বচ্ছের জবাব পাওয়া গেল না। খোঁপায় থাকা ফুলগুলো খুলে ফেলে মোহের চুলগুলো খুলে দিলো স্বচ্ছ। মোহের কানে যত্ন করে গুঁজে দিলো একটা গোলাপ। অতঃপর স্বচ্ছ তাকে নিজের ফিরিয়ে গোলগোল চোখে দেখতেই থাকল। ভেজা গুলো পেছনে করে বলল,
“নিজেই নিজেকে মা/রার ব্যবস্থা করে দিলাম।”

“কোথায় মা/রতে হবে?”

ফট করে প্রশ্ন করে ঠোঁট টিপে হাসল মোহ। স্বচ্ছ তার হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলল,
“ক্রমাগত আমার মেরেই যাচ্ছেন আবার জিজ্ঞেসা করছেন কোথায় মারবেন? সরাসরি আমার বুকে আক্রমণ হচ্ছে। যেখানে মারলে বাঁচার চান্স জিরো।”

“বাজে কথা।”

মোহ কথা সম্পূর্ণ করতে পারল কিনা জানে না। যেন তার আগেই স্বচ্ছ ঝড়ের গতিতে খুব কাছে এসে গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল মোহের সংলগ্নে। অনুভব করল মোহের বড়ো বড়ো শ্বাসপ্রশ্বাস। তেজস্বিনী নারীর এমন সামান্য বিষয়ে নিভে যাওয়া দেখে মৃদু হাসল সে। এরপরেই ভেজা ঠোঁটে চুম্বন এঁকে ফেলল তার মনকন্যার ডান গালে। এই প্রথমবারের মতো সে এক গভীরভাবে মোহকে ছুঁয়ে ফেলল। এ যেন ভিজে যাওয়া ফুলকে ছোঁয়া। মোহের প্রতিক্রিয়া দেখতে আগ্রহী চোখে তাকায় স্বচ্ছ। মেয়েটা শুধু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বচ্ছ তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখতেই চোখ সরিয়ে নিলো মোহ। এই ঠাণ্ডা বৃষ্টিতেও তার কান গরম হয়ে গেল। রেলিং ধরে মাথা নিচু করে চোখ খিঁচে বন্ধ করল সে। মিশ্র অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তার মন। অন্যদিকে ছিটকে যেতে নিলে তার কোমড় পেছন থেকে ধরে কিছুটা উপরে তুলে নেয় স্বচ্ছ। হকচকিয়ে উঠে মোহ ছটফট করে ওঠে।
“কী করছেন? আপনার শরীরের ক্ষত এখনো সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি। লেগে যাবে।”

কে শোনে কার কথা! স্বচ্ছ তাকে তুলে নিয়ে ঘুরতে আরম্ভ করে। এমন কাণ্ডে মোহের হাসি চলে আসে। মোহকে নামিয়ে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তার গালে লেগে থাকা চুলগুলো মনোযোগ দিয়ে সরায় মোহ। একহাতে মোহকে আরো নিজের নিকটে টেনে আনে স্বচ্ছ। মোহের গালে হাত রেখে বড়ো করে হেসে বলে,
“নাউ, আই হ্যাভ লাইসেন্স। মনে যত ব্যাড ইন্টেনশান আছে ফুলফিল করতেই পারি।”

মোহের কাছ ঘেঁষে স্বচ্ছ এগোতেই মোহও সহজে ধরা না দিয়ে তার একহাতে থাকা ফুল তাদের মুখের সামনে ধরে বলল,
“আই অবজেক্ট।”

কপাল জড়িয়ে নিলো স্বচ্ছ। সে বাঁধা মানতে নারাজ। ফুলগুলো এক টানে নিচে ফেলল আর বলল,
“অবজেকশন ওভাররুলড্।”

চমকে উঠে তাকাল মোহ ফুলের দিকে। অসহায় গলায় বলল,
“আরে আপনার দেওয়া ফুলগুলো…”

সব কথা শেষ করা বুঝি হলো না। মনে রয়ে গেল। স্বচ্ছের আঁকড়ে ধরার মাঝে মোহ হারিয়ে গেল৷ স্বচ্ছ তার প্রেয়সীর কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিভেজা অধর স্পর্শ করে ফেলল। প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়লে খোলা আকাশের নিচে থাকা মোহ হকচকিয়ে উঠে আঁকড়ে ধরে ফেলল স্বচ্ছের পিঠ। আগে থেকেই ক্ষত থাকা স্বচ্ছের পিঠে ব্যথা লাগল। চোখ খিঁচে সামান্য সরে এসে মৃদু আর্তনাদ করল স্বচ্ছ। মোহ তৎক্ষনাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।
“স্যরি। খুব লেগেছে? আমি বুঝতে পারিনি।”

স্বচ্ছ বড়ো একখানা নিশ্বাস ছেড়ে প্রসারিত হাসি দিয়ে বলল,
“আমার তো দারুণ লেগেছে। না জানি আপনার কেমন লেগেছে!”

নির্বাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইল মোহ। ভ্রু কুঁচকে ক্ষেপে উঠে বলল,
“নিতান্তই অসভ্য লোক। আমি কতটা ভয় পেলাম।”

মোহ ঝুঁকে পড়ে থাকা ফুলগুলো তুলে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকল। পেছন থেকে স্বচ্ছ তাকে জোরে ডেকে বলল,
“তোমার কেমন লেগেছে জানালে না কিন্তু মোহ!”

মোহ কিছু না বলে শুধু চোখ রাঙালো। টাওয়াল হাতে নিয়ে চুল মুছতে আরম্ভ করল। স্বচ্ছ শব্দ করে হেসে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাড়িয়ে মোহের দিকে চেয়ে রইল। মেয়েটা হয়ত আরো কিছু সময় ভিজতো। স্বচ্ছের নির্লজ্জ প্রশ্নে সে পালিয়েছে। সাহসী নারীটি যেন এখানেই অসহায়। মোহ ড্রেসিংটেবিলে একে একে নিজের গহনা খুলতে লাগল। স্বচ্ছও ঘরে ঢুকল। মোহের পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কৌতূহল নিয়ে গয়না খোলা দেখে বলল,
“আমি খুলে দিই?”

“আপনার শরীর ভেজা। নিজের চুল মুছে ফেলুন। আমি আমার কাজ করছি।”

কানেও নিলো না স্বচ্ছ মোহের কথা। মোহের ভেজা চুল সরিয়ে কানের দুলে হাত দিয়ে বলল,
“নিজের বিয়ের প্রথম রাতে বউয়ের প্রতি যদি এতটুকুই রোমান্টিক না হতে পারি তাহলে আমার রোমান্টিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। লেট’স আনপ্যাক মাই গিফট।”

মোহ চোখ ছোটো করে শুধাল,
“গিফট?”

স্বচ্ছ আর প্রত্যুত্তর না। মোহের হাতের আংটি খুলে নিলো শুধু অনামিকা আঙ্গুলের আংটি বাদে। গলার গয়না খুলে নিয়ে বলল,
“তোমরা মেয়েরা এত ভারি জিনিসপত্র পরে থাকো কী করে?”

“মেয়ে হলে আপনিও পরে থাকতে পারতেন। অসুবিধা হতো না।”

“আরে ধুর। মেয়ে হলে তোমাকে পেতাম না। ওটা আরো বড়ো অসুবিধার ব্যাপার হতো।”

মোহ খিলখিল করে হেসে বলল,
“তাহলে আপনাকে আমি বোন বানাতাম।”

স্বচ্ছকে রাগতে দেখা গেল এবার। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে মোহের গাল সামান্য চেপে ধরে বলল,
“শাট আপ।”

মোহ হাসতে হাসতে তার কাছে থাকা টাওয়াল দিয়ে স্বচ্ছের মাথা সহ মুখ ঢেকে দিয়ে বলল,
“চেঞ্জ করুন।”

মোহ স্বচ্ছের কথায় আলমারিতে হাত দিয়ে গোলাপি রঙের সুন্দর শাড়ি পেল। বেশ কয়েকটা শাড়ি ভর্তি আলমারিতে। সব ফারাহর কারসাজি। বেশ শখ করে ভাবির জন্য এতকিছু রেখে দিয়েছে। মোহ গোলাপি রঙের শাড়িটাই পড়ল। দুজন নিজের বিবাহের প্রথম রাতের নামাজ একসঙ্গে আদায় করেই বারান্দায়। যেখানে উপরের ছাঁদ দেওয়া আছে সেখানে সামনাসামনি বৃষ্টি উপভোগ করা যাচ্ছে। সেখানকার দেওয়ালে বালিশ রেখে সেখানে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে মোহকে কাছে টানল সে। দুজনের উপরিভাগ চাদর দিয়ে ঢাকল ঠাণ্ডা বাতাসের চোটে। মোহকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরল স্বচ্ছ। মোহ আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি এখনো অসুস্থ। শরীরের অনেক জায়গায় চোট। আমার মতো আস্ত মানুষ এভাবে ভর দিলে ব্যথা লাগবে না?”

স্বচ্ছ মোহের ঘাড়ে থুঁতনি রেখে চোখ বন্ধ করে থেমে থেমে উত্তর দিলো,
“উঁহু, আমার অনেক শান্তি লাগবে। প্লিজ, চুপ করো।”

মোহ কথা বলে না। স্বচ্ছের হাতের উপর হাত রাখে। আর বাঁধা দিতে চায় না সে। স্বচ্ছ চোখ বুঁজেই থাকে। নিজেকে এত পূর্ণ সে এর আগে কখনো অনুভব করেনি। এত পূর্ণতা সে আজীবন ধরে রাখতে চায় এভাবেই। স্বচ্ছ বিড়বিড়িয়ে বলল,
“বুকের একপাশে তুমি আছো। আরেকপাশে ইথান থাকলে নিজেকে শ্রেষ্ঠ সুখের মানুষ মনে করতাম। কাল শুধু ও আসুক। দুজনকে এভাবে ধরে বসে থাকব।”

মোহ স্বচ্ছের হাতে হাত বুলিয়ে বলে,
“আপনিও ইথানকে মিস করা শুরু করে দিয়েছেন!”

“খুব মিস করছি।”

মোহ নিস্তব্ধ থাকে। সেও ভাবছে এতক্ষণ নিশ্চয় ইথান ঘুমিয়েছে। নাকি জ্বালাতন করছে? সে অবশ্য কল করেছিল শাড়ি চেঞ্জ করে। ততক্ষণে ইথান শুয়ে পড়েছিল। বড়ো শ্বাস নেয় মোহ। স্বচ্ছ ধীর গলায় বলে,
“খুব করে চেয়েছিলাম আমাদের বিয়ের প্রথম রাতের সূচনা এমন বর্ষণ দিয়েই হোক। বর্ষণ দেখুক আমি কাকে পেয়েছি। যে আমার মাঝে প্রেমের বর্ষণ ছড়িয়েছিল তাকে আমি পেয়েছি। আমার মনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।”

মোহ আনমনে বলে,
“আসলেই এই বর্ষণ ভীষণ ভয়ংকর। কার মাঝে কীভাবে প্রেম বীজ বুনবে বোঝা দায়। তবে আমি এই বর্ষণ বারবার চাই। সেই বর্ষণে আমার কাছে রয়ে যাক মি. আহিয়ান স্বচ্ছ।”

উতলা হয় স্বচ্ছের মন। মোহকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়ায়। মোহ তার দিকে ফিরে তার বুকে আলতো করে মাথা রাখে কিছুক্ষণ। হালকা উপরে তাকাতেই নাগালে পায় স্বচ্ছের থুঁতনি। পাগলামি করে এই প্রথম নিজ থেকে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া দেয় মোহ। স্বচ্ছের উন্মাদনা যেন আরো প্রশ্রয় পায়। মোহ মিশে যায় স্বচ্ছের মাঝে। বর্ষণের রাত্রী আরো দীর্ঘ হয় যেন।

সকালবেলা খাওয়াদাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করল তানিয়া। প্রচুর ক্ষিদে পেয়েছে। অথচ বাজে সবে সাতটা। তানিয়া খেতে বসে দেখল তার মা চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে। মুখখানা উনার গম্ভীর। তানিয়া খাবার মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে মা? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

তবুও বেশ কিছু সময় চুপই রইল তার মা। খানিকক্ষণ পরে কাপে চামচ নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
“কয়েকদিন পর তোর বাবা আর ভাই আসছে দেশে।”

বিষয় খেল তানিয়া। কাশতে কাশতে পানি পান করে নিজেকে শান্ত করল সে। চোখমুখ ঝলমলিয়ে উঠল তার। খুশিতে আটখানা হয়ে বলে উঠল,
“হায় হায়! আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি? তুমি এই খবরে মুখ গোমড়া করে বসে আছো কেন? যেন মনে হচ্ছে তোমার শত্রু আসছে।”

তানিয়ার মায়ের প্রতিক্রিয়া পাল্টায় না। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গম্ভীর সুরে বললেন,
“বাড়ি থেকে আর কারণে অকারণে বের হবি না। আজকালকার যুগ ভালো নয়।”

ভ্রু কুঁচকে যায় তানিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করে,
“কেন? এতদিন বের হলাম কোনো সমস্যা তো হয়নি। আজ থেকে হঠাৎ যুগ এত খারাপ কী করে হলো?”

“তোর বাবা এমনিই পছন্দ করে না তোর অযথা এখানে-সেখানে যাওয়া সেটা তো তুই জানিস। তোর বাবা এসেও তোর এমন আচরণ দেখলে আমার উপর প্রশ্ন তুলবেন। তাই আগে থেকে নিজেকে একটু পরিবর্তন কর।”

তানিয়ার মন মানতে চায়না। মুখটা ভার করে জেদ ধরে বলে,
“মা, আমি বাড়িতে সারাদিন বসে বসে কী করব?”

এবার ফট করেই প্রচণ্ড রাগান্বিত হলেন। চিৎকার দিয়ে বললেন,
“তো বাইরে গিয়ে কী করিস তুই? বল আমাকে?”

মায়ের এমন আচরণে ভড়কে গেল তানিয়া। নেত্রপল্লব বড়ো হলো তার। শুকনো ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল,
“মা, কী হয়েছে? এভাবে কেন বলছ?”

তানিয়ার মা চায়ের কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাগটা দমিয়ে বলল,
“খাবার খা তুই।”

এই বলে নিজের ঘরে গটগট করে চলে গেল। তানিয়ার মনে চিন্তার উদয় হয় মাকে নিয়ে। অনেক ভেবে সে মায়ের এমন আচরণের কারণ হিসেবে তার বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে বলে মনে করে। বাবার সাথে ঝগড়া হলেই তেতে থাকে তার মা। আজও হয়ত তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজের মন থেকে দুশ্চিন্তা ছেড়ে খাবার মুখে নিলো সে।

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৯ [দ্বিতীয় খণ্ড]

হাত চুলকাতে গিয়ে সামান্য ব্যথায় নেত্রপল্লব খোলে মোহ। আলোতে চোখ ছোটো করে ফেললেও হাত উঠিয়ে দেখল আঁচড়ের লম্বা লাল দাগ হয়ে গেছে সেখানে। দ্রুত উঠে বসে অন্যদিকে ফিরে প্রথমে স্বভাবগত কারণে তার মন ইথানকে খোঁজে। পরক্ষণেই স্মরণ হয় বাচ্চাটা এখানে নেই৷ মুখ ভার হয় তার। বিছানা থেকে নেমে আরেকবার আঁচড়ের দাগ পর্যবেক্ষণ করে মোহ বুঝে ফেলে এটা তার করা আঁচড় নয়। এটা স্বচ্ছের কর্মকাণ্ড। তবে ঘরে স্বচ্ছকেও দেখল না সে। কাঁধে আঁচল ঠিক করতে গিয়েও দুর্ভোগ পোহাতে হলো তার। এ বিষয়ে খানিকটা বিরক্ত হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল সে।

গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি বেছে নিয়ে দ্রুত তা পরিধান করে ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে দেখে ঘর থেকে বের হলো মোহ। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে কাউকে দেখল না সে। সকালবেলা কেউ না থাকা স্বাভাবিক। মোহ নিজেও হাই তুলছে। নিচে নেমেই সে রান্নাঘর থেকে শব্দ পেল। বড়ো ড্রয়িংরুমের ডান পাশে রান্নাঘর অর্ধেক ওয়াল তুলে আলাদা করা। বাড়িটা পুরোনো হলেও বাড়ি করার ধরণ বেশ আধুনিক৷ রান্নাঘরের নিকটে গিয়ে স্বচ্ছকে দেখল মোহ। তার চেয়ে বেশি বিস্মিত হলো সঙ্গে ইথানকে দেখে। সকাল সকাল কি সে ভুল দেখতে শুরু করেছে? এবার ইথানের কণ্ঠস্বরও মোহের কর্ণকুহরে এলো।
“উহ্…বাবা চায়ে কেউ এত চা-পাতি দেয়না। মাম্মাকে দেখেছি অল্প একটু দিতে। তুমি এত বড়ো হয়েও কিছুই জানো না।”

স্বচ্ছ তড়িঘড়ি করে চা-পাতির পরিমাণ কমিয়ে বলল,
“তুমি সব জানো বলেই তো রান্নাঘরে এসিস্ট করতে এনেছি বাবু।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোহ। স্বচ্ছ ইথানকে তার পেছনে রেখে নিজেও দূরে সরে গিয়ে এমনভাবে চা-পাতি এমনভাবে গরম পানির দিকে ছুঁড়ল যেন বো/ম ছুড়ছে। এসব দৃশ্য দেখে কী প্রতিক্রিয়া করবে সেটাই ভেবে পেল না মোহ। না পেরে দুজনের কাণ্ডে হেসে ফেলল সে। তার হাসির ঝংকার গিয়ে পৌঁছায় স্বচ্ছ ও ইথানের কানে। মোহ ভেতরে ঢুকে বলল,
“এটা সামান্য চা-পাতি। বো/ম না যে বিস্ফোরণ ঘটবে।”

হতচকিত হয় দুইজনে। ইথান দৌড়ে এসে মোহের হাত চেপে ধরে টেনে ধরে প্রবল আগ্রহ নিয়ে বলে,
“আমি আর বাবা মিলে তোমার জন্য চা বানাচ্ছি। দেখবে এসো।”

মোহ স্বচ্ছের দিকে এগোয়। উৎসুক হয়ে জানতে চায়,
“ইথান এত সকালে এখানে কী করে এলো?”

“আমি এনেছি। আমি জানি সকাল হলে তোমার চোখ আগে ওকে খুঁজবে তাই।”

মোহ আরো এক দফা মুগ্ধ হলো তার সামনের মানুষটার প্রতি। লোকটা কী করে বোঝে তার মনে কখন কী চলে? মনে হয় যে সে দুর্দান্ত ম্যাজিক করে। ইথান স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“বাবা, চায়ে তো চিনিই দিলে না। চিনি ছাড়া চা হয়?”

স্বচ্ছ তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে চিনি খুঁজল। মোহ বুঝল স্বচ্ছ কখনোই রান্নাঘরের আশেপাশেও আসেনি। আসলে কোথায় কী থাকে তা খুঁজতে এত বেগ পেতে হতো না। শেল্ফে চিনি খুঁজে পেল স্বচ্ছ। নিশ্চিন্ত মনে আন্দাজে চিনি ঢালতে গিয়ে অনেক বেশি চিনির পরিমাণ দিয়ে ফেলল সে। মোহ চকিতে তাকিয়ে বলল,
“এতটুকু চায়ে এত চিনি? একদিনেই ডায়াবেটিস ধরিয়ে ফেলবেন আপনি।”

স্বচ্ছ হতাশ হয়ে চিনি রেখে হতবুদ্ধি হয়ে বলল,
“আমি কি জানি নাকি! কোনোদিন তো কিছু রান্না করিনি।”

“তো আজকে চা বানাতে কে বলল আপনাকে? কোনোদিন না করলে আজকে করার কী দরকার ছিল।”

“এই বাড়িতে তোমার প্রথম দিন। জানি না অন্য বাড়িতে নতুন বউ গেলে কী করে। কিন্তু আমি মায়ের কাছে শুনেছি এই বংশে নতুন বউ এলে তার আপ্যায়ন করা হয়। আমি জানি মা হয়ত অনেককিছু করবে তোমার জন্য। কিন্তু আমি তোমার জন্য কিছু করতে চাইছিলাম। আমি ইথানকে নিয়ে এসে দেখি তুমি তখনো ঘুমিয়ে আছো। ইথান আমাকে বলল তুমি সকাল মাঝে মাঝে চা খাও। তাই এটাই সহজ মনে হলো। বানাতে চলে এলাম বাপ-ছেলে মিলে।”

মোহ শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বচ্ছের পানে। তারপর চুলা বন্ধ করে হাসিমুখে বলে,
“তবে চা পরিবেশন করে দিন। টেস্ট করে দেখি।”

স্বচ্ছ দুটো কাপে সাবধানে চা ঢেলে দিলো। এবার কোনো ভুল না করে খুশি হলো সে। মোহের হাতে একটা কাপ ধরিয়ে দিলো। মোহ বাড়ির আশেপাশে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধাল,
“এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি?”

“মা উঠেছে। কিন্তু একবারে আটটার সময় রান্নাঘরের দিকে এসে নিজের জন্য চা বানায়। আমরা সকালের ব্রেকফাস্ট একটু দেরিতে করি। তোমার আর ইথানের কি কোনো সমস্যা হবে তাতে? তাহলে মাকে জানালে দ্রুত ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করে দেবে।”

“উঁহু, না৷ আমরাও দেরিতেই সকালে খাই।”

মোহ এবার চায়ে চুমুক দিতেই আঁখি জোড়া বৃহৎ করে বলল,
“এত মিষ্টি হয়েছে বলার বাহিরে। তাছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক আছে।”

স্বচ্ছ ফুঁ দিয়ে ইথানকে চা খাওয়ায়। ইথান মুখ চটকাতে থাকে মিষ্টিতে। অতঃপর মোহের থেকে কাপ নিয়ে বলে ওঠে,
“দেখি কেমন মিষ্টি!”

কাপে চুমুক দিয়ে সামান্য চা মুখে দিতেই মোহ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“ডায়াবেটিস কনফার্ম!”

স্বচ্ছ ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে বলল,
“উঁহু, তোমার আগে আমার ডায়াবেটিস কনফার্ম। কারণ এই চায়ের থেকেও মিষ্টি জিনিস খাওয়ার নেশা হয়েছে আমার।”

মোহ তার কথার আগামাথা খুঁজে পেল না। ইথান লাফিয়ে শুধাল,
“কোন মিষ্টি? আমিও খাব বাবা।”

স্বচ্ছ ইথানের মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“এই মিষ্টি ছোটোদের খাওয়া বারণ। বড়ো হও আগে।”

ইথান প্রবল বিশ্বাস রেখে বলল,
“আমি তাড়াতাড়ি বড়ো হবো।”

মোহের কাছে এবার স্বচ্ছের অস্পষ্ট দুষ্টু বার্তা স্পষ্ট হলো। বিস্ফোরিত চোখে দৃষ্টিপাত করে স্বচ্ছের হাত চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ইথানের সামনে কী বলছেন এসব?”

স্বচ্ছ মোহের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“আই কান্ট ফরগেট ইউর কিসেস, মোহময়ী।”

ইথান শুনতে না পেলেও তার সামনে লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে মোহ। রাগও সৃষ্টি হয়। কাছেই থাকা গরম কাপ নিয়ে আকস্মিকভাবে হালকা করে স্বচ্ছের ঠোঁটে চেপে ধরতেই তা তৎক্ষনাৎ সরিয়ে নিজের ঠোঁট হাত দিয়ে চেপে ধরে স্বচ্ছ। চোখ রাঙায় মোহের পানে। মোহ বিজয়ের হাসি ভ্রু উঁচিয়ে বলে ওঠে,
“ইউ উইল নেভার ফরগেট দিস অলসো, আহিয়ান স্বচ্ছ।”

“আই উইল টেক মাই রিভেঞ্জ। বি রেডি।”

রান্নাঘরে এত কথাবার্তা দেখে উদয় হোন মিসেস জেবা। মোহ আর স্বচ্ছকে দেখে হাসিমুখে বলে,
“তোমরা উঠে পড়েছ। আমি ভাবলাম একটু হবে তোমাদের উঠতে।”

কথা শেষ হতেই তিনি ইথানকেও দেখেন। শুধান,
“ইথান কখন এলো?”

স্বচ্ছ সোজাসাপটা উত্তর দেয়,
“আমি নিয়ে এলাম। ওকে খুব বেশি মিস করছিলাম আমরা।”

ইথান গুটি গুটি পায়ে মিসেস জেবার কাছে এগোয়। গোলগোল চোখে তাকিয়ে উদগ্রীব হয়ে বলে,
“আমার নানুমনি গতকাল বলেছে সে না থাকলেও আপনি আমার দাদুমনি থাকবেন এখানে সবসময়। নানুমনির চেয়ে বেশি আদর করবেন আমাকে। সত্যি?”

মিসেস জেবা থতমত খেয়ে গেলেন। অস্বস্তি নিয়েও স্বচ্ছ আর মোহের দিকে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, ইথান বাবু। তুমি কী কী খেতে পছন্দ করো আমাকে বলবে। আমি বানিয়ে দেব।”

ইথানের মন যেন খুশিতেই নেচে উঠল। মিসেস জেবা চুলায় চায়ের বাসন খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“চা কে বানালো?”

স্বচ্ছ গলা খাঁকারি দিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“আমি বানিয়েছি।”

“তুমি তো চা খাও না। তাহলে?”

“এমনিই। আমি ইথানকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।”

স্বচ্ছ বিষয়টার পাশ কাটিয়েই চলে গেল যেন। মিসেস জেবা বুঝলেন এসব নতুন বউ আর স্বামীর ব্যাপার। তাই আর ঘাঁটালেন না।

আজ বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙে ফারাহর। পাশে হাত দিয়ে শৌভিকের অনুপস্থিতি অনুভব করে। ফোন অন করতেই সে দেখল নয়টা বাজে। নিশ্চয় শৌভিক নিচে তার বাবার সাথে গল্প করছে। এই ভেবে নিজমনে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল সে।

ফারাহ বসার ঘরে প্রবেশ করে দেখল তার শ্বশুরমশাই মীর সাহেব টিভি খুলে একা বসে রয়েছেন। শৌভিককে আশেপাশে না দেখে মনটা অস্থির হলো তার। গলা খাঁকারি দিতেই মীর সাহেব একগাল হেসে ইশারা করে বললেন,
“এখানে এসে বসো।”

ফারাহ গিয়ে উনার পাশে বসে। মীর সাহেব গৃহকর্মীকে আরেক কাপ কফি আনতে বলেন। আদুরে কণ্ঠে ফারাহকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঘুম ঠিক মতো হলো? দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছো তুমি। খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করো না? এখানে সমস্যা হয়?”

“না, তেমন কিছুই না বাবা। আপনি তো জানেন আমার নিজের কেমন কাজের চাপ থাকে। তাই শুকিয়ে যাওয়া আর মোটা হওয়া চলতেই থাকে।”

টুকটাক কথা হয় বউ আর শ্বশুরের মাঝে। মীর সাহেবের মিনি স্ট্রোক হয়েছিল কয়দিন আগেই। তারপর থেকে তিনি বেড রেস্টে রয়েছেন। কাজকর্ম সব শৌভিক সামলাচ্ছে। সব মিলিয়ে ফারাহকে সময় দেওয়া হচ্ছে না। যদিও তা নিয়ে ফারাহর খুব একটা অভিযোগ নেই। তবুও কোথাও একটা ভয় হয়। তাই সে উশখুশ করতে করতে প্রশ্ন করেই বসল,
“বাবা, আপনার ছেলে বাড়িতে নেই?”

মীর সাহেব খানিকটা চিন্তিত হয়ে বললেন,
“সে কী! হতচ্ছাড়া ছেলে তোমাকে বলে যায়নি? আজকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে ওর।”

ফারাহ দীর্ঘশ্বাস নেয়। এর মাঝে মিশে আছে অনেক অনুরাগ। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“না। হয়ত ব্যস্ত তাই বলেনি।”

“এটা কোনো কথা? ব্যস্ততার কথা তো জানিয়ে যেতে পারে! একটু পরেই ওকে টিভিতে দেখাবে। দেখো।”

ফারাহর মনে সংশয় জাগে। শৌভিক সচরাচর মিডিয়ায় আসে না। আজকে কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে মিডিয়ার সামনে আসছে কে জানে! কিছু সময় পর শৌভিককে বেশ পরিপাটিরূপে টিভিতে দেখা গেল। সকল মন্তব্য শুনে ফারাহ বুঝল এখন থেকে মীর সাহেবের দলের দায়িত্ব অফিসিয়ালি শৌভিক নিচ্ছে। এতদিন শুধু বাবার পাশে থেকেছে। এখন তার বাবা অসুস্থ হওয়ায় শুধু নিজের পদের কাজগুলোই সামলাবেন। বাকিসবটা শৌভিক দেখবে। পুরো ইন্টারভিউ দেখে নির্বাক রইল ফারাহ। অকারণে ঘামতে থাকল। তারপর কফি না খেয়েই নিজমনে উঠে রোবটের মতো চলে গেল ঘরে। মীর সাহেব ফারাহর আচরণে সামান্য অবাক হলেন। ফারাহ সাধারণত সময় থাকলে মীর সাহেবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় পার করেন। আজ মেয়েটার কী হলো সেটা বোধগম্য হলো না।

দুপুরে সব ঝামেলা সেরে বাড়ি ফিরল শৌভিক। গরমে আর ক্লান্ত শরীরে নিজের পাঞ্জাবির উপরের বোতামটা খুলতে খুলতে ঘরে ঢুকল সে। ঘরে পা রাখতেই ফারাহর দিকে নজর গেল তার। মেয়েটা বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। সাদা শার্টের উপরে মেরুন রঙের ব্লেজার পরিধান করে পারফিউম লাগাচ্ছে। শৌভিক বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“ফারাহ, কোথায় যাচ্ছো?”

ফারাহ ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“কাজে।”

“আজ তো ছুটির দিন। আজকে কীসের কাজ?”

“কেন? ছুটির দিনে আপনার এত বড়ো কাজ থাকতে পারে। তো আমার কাজ থাকতে পারে না কেন?”

ফারাহর কথার তেজে শৌভিকের বোধগম্য হলো মেয়েটা ক্রোধের আগুনে লাল হয়ে আছে। তাই সে ফারাহর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
“আমি জানি আমি বলেছিলাম আজকে সারাদিন আমরা নিজেদের ছুটির দিন একসাথে কাটাব। কিন্তু তুমি তো সব জানো। বাবার এই অবস্থা আর আমি…”

শৌভিকের কথা শেষ হলো না। তার আগেই ফারাহ থামিয়ে রাগে কটমট করে বলল,
“আমি সব জানি। আপনার কাজের প্রেশার, আপনি সময় দিতে পারেন না। আমার কমপ্লেইন এসবে নয়।”

“তবে?”

ফারাহ কিছুক্ষণ নীরব থেকে শৌভিকের চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল,
“আমি আপনার স্ত্রী, জীবনসঙ্গিনী তাই তো? আমাদের সম্পর্ক বিশ্বাসের। আমাদের কি উচিত নয় আমাদের নিজেদের জীবনের সব কথা একে অপরকে শেয়ার করা? নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো একে অপরকে জানানো উচিত নয়?”

শৌভিক বড়ো নিশ্বাস ফেলে ফারাহকে নিজের কাছে দাঁড় করিয়ে বলল,
“তুমি তো আমার সব জানো। তবুও কেন এসব বলছ?”

“সব জানি? তবে কেন টিভিতে দেখে আমাকে জানতে হলো যে আপনি দলের দায়িত্ব নিচ্ছেন অফিসিয়ালি? কেন আমি আপনার জীবনের এত বড়ো খবর জানি না? আপনি কখন কাজে যান সেটা আমি জানতেই পারিনা। আমাকে একবারও বলে যান না। আমাকে এতটা অপ্রয়োজনীয় মনে হয় আপনার?”

শৌভিক বিছানায় বসে ফারাহকে নিজের সংলগ্নে টেনে নিচু স্বরে বলতে থাকল,
“তুমি আমার জীবনে কী সেটা তুমি জানো। আমার জীবনটাই তুমি। আমার জীবনের সব সতেজতা, উচ্ছ্বাস, আকাঙ্ক্ষা সবটাই তুমি। কেন নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বলছ? আমার হাতে সময় ছিল না বিশ্বাস করো। আর তোমাকে এসব বললে কি তুমি বাঁধা দিতে? দিতে না তো।”

“সেজন্য আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজনবোধ করলেন না? ছাড়ুন আমাকে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

ফারাহ নিজেকে প্রায় ছাড়িয়ে নেয় জেদের বশে। শৌভিক তাকে পুনরায় ধরে ফেলে। জোর করে আঁটকে রেখে বলে,
“না তুমি কাজে যাবে না আজকে। প্লিজ যেও না। আমি যেতে দেব না।”

ফারাহ প্রথমে নিজের জেদে অটল থাকে। তবে শৌভিকের কবল থেকে নিজেকে ছড়াতে ব্যর্থ হয়। শৌভিক তার কোমড় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে তার পেটে মাথা রেখে চোখ বুঁজে বলে,
“তুমি আমাকে না বুঝে এমন করো না। যেতে দেব না তোমায়। থাকো আমার কাছে। থেকে যাও।”

ফারাহ হার মানে। জেদ ছেড়ে নরম হয়। শৌভিকের চুলে হাত রাখে। ধীরে ধীরে তার মাথার চুল বুলিয়ে দেয়। প্রশান্তিতে শৌভিক চোখ বন্ধ করেই থাকে।

দুপুরের হরেক রকম খাবারে ভর্তি হয়ে গেছে টেবিল। মিসেস জেবা যত্ম করে একে একে সব সাজিয়ে নিচ্ছেন। অপেক্ষা করছেন কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আসার। কিছু সময় পর লাল রঙের ভারী কাজের শাড়ি পড়ে নামে মোহ। হাত ভর্তি মিসেস জেবার দেওয়া সোনার চুড়ি ও বালা পরেছে সে। মাথার খোঁপায় গুঁজেছে সোনার কাঁটা। গলার পড়েছে সুন্দর ফুলের নকশার হার। মিসেস জেবা চেয়ার এগিয়ে দিলেন মোহকে বসতে। মোহ ইতস্তত হয়ে বললেন,
“আমি পারব৷ আপনি প্লিজ এভাবে চেয়ার এগিয়ে দেবেন না। আমি তো আপনার ছোটো।”

“এটা এই বংশের নিয়ম। আমি যখন শ্বশুরবাড়ি আসলাম তখনি আমার শাশুড়ী এসব করেছিলেন। আমাকে রানী হওয়ার অনুভূতি বোধ করিয়েছিলেন। এইযে শাড়ি পরেছ সেটা আমার শাশুড়ীর শাশুড়ীর ছিল। তখনকার মসলিন কাপড়ের শাড়ি। এটা আজকে পরলে এরপর নিজের ছেলের বউয়ের জন্য রেখে দেবে তুমি। এই বংশে বউ আদর করা হয়। জামাই আদর হতে পারলে বউ আদর কেন হবে না বলো দেখি?”

মোহ আর কিছু বলে না। সে সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ। বাড়ির বউয়ের সাথে এমন ব্যবহার আর কোথায় করা হয় তার জানা নেই। স্বচ্ছকে নিয়ে ইথান আসে এবার। হম্বিতম্বি করে সৌমিত্রও উদয় হয়। তড়িঘড়ি করে চেয়ারে বসে এত খাবার দেখে যেন মুখে পানি চলে আসে।
“মা, কত কী বানিয়েছ! আমার আর খিদে সহ্য হচ্ছে না।”

কারোর অপেক্ষা না করে সৌমিত্র নিজের পছন্দের কাবাবের দিকে হাত বাড়ায়। তখনি মিসেস জেবা খুন্তি দিয়ে তার হাতে আঘাত দিতেই আর্তনাদ করে ওঠে সৌমিত্র। মিসেস জেবা কঠোর সুরে জানিয়ে দিলেন,
“এসব বাড়ির নতুন বউয়ের জন্য করেছি। আগে ও খাওয়া শেষ করবে। তারপর তোর খাওয়া। চুপচাপ বসে থাকো। খবরদার খাবার এঁটো করবে না।”

গাল ফুলিয়ে বসে রইল সৌমিত্র। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এটা কোনো কথা? এখন পেটে ইট বেঁধে ঘুরতে হবে? এখন দেখছি খেতে গেলেও বিয়েশাদি করা প্রয়োজন।”

স্বচ্ছ পাশ থেকে বলল,
“বিয়ে করলেও তোর বউয়ের ভাগে এসব খাবার পড়বে আর তুই বসে হা করে বসে থাকবি। বউরাই এই আদর পায়।”

সৌমিত্র ঠোঁট উল্টিয়ে মোহকে বলে,
“তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন ভাবি। নয়ত আমাদের কপালে খাবার জুটবে না।”

মোহ মিসেস জেবার দিকে চেয়ে বলল,
“আপনারাও বসে খেতে শুরু করুন। আমি একা কী করে খাব? ওদিকে সৌমিত্রের খিদে পেয়েছে।”

“ওর সবসময় খিদে পায়। তুমি খাও আগে। তারপর বাকি সবাই।”

টেবিলে এসে বসল স্বচ্ছ। ইশারায় মোহকে খেতে বলল সে। মোহ আর উপায় পেল না। মিসেস জেবা তার বড়ো সাজানো প্লেটে ভাত তুলে দিলো। খেতে আরম্ভ করল মোহ। মাঝে ইথানকেও খাওয়ালো। একটু খাওয়ার পর সে বায়না ধরল তার দাদুমনির হাতে খাবে। ফের অস্বস্তিতে পড়লেন মিসেস জেবা। প্রথমে খাওয়াতে না চাইলেও মুখের উপর কিছু বলতে না পেরে ইথানকে খাইয়ে দিলেন তিনি। মোহ খাওয়ার মধ্যে লক্ষ্য করল স্বচ্ছ নিজের গালে হাত রেখে একনাগাড়ে তার খাওয়া দেখছে। খাওয়া বন্ধ হলো তার। চোখের ইশারায় জানতে চাইল স্বচ্ছ কী দেখছে। কিন্তু উত্তর পেল না। স্বচ্ছ শুধুই ডুবে রয়েছে মোহের কঠিন মোহতে। সে আঁটকে গেছে। তবে নিজেকে ছাড়ানোর কোনো চেষ্টার তার নেই।

বিকেল হয়ে এলো। মোহের এত গয়নাগাটি গায়ে দিয়ে অসহ্য লাগছে এখন। তবে মিসেস জেবা এসব খুলতে বারণ করেছেন। কারণ কিছুক্ষণ পরেই মোহের বাড়ির লোক আর ফারাহ আসার কথা। অগত্যা মোহ সোফায় বসে আছে। আশেপাশে সৌমিত্রের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে ইথান। সৌমিত্র আগের থেকেই চঞ্চল টিনএজার ছেলের মতো। ছোটো ইথানকে পেয়ে বাচ্চাদের খেলায় মেতে গেছে সে। সুযোগ পেয়ে মোহের পাশে বসে স্বচ্ছ। মোহ তখন নিজের হাত চুলকানোতে ব্যস্ত। এত গয়না পরে তার হাত-গলাতে অস্বস্তি লাগা শুরু করেছে। স্বচ্ছ বুঝল মোহের বেশি ভারি অলংকার পরিধানের অভ্যের নেই। হালকা কেশে স্বচ্ছ বলল,
“সমস্যা হলে এখন খুলে ফেলো এসব। এতক্ষণ ধরে পরে থাকার দরকার নেই।”

কথা শেষে স্বচ্ছ নিজেই মোহের হাত ধরে একে একে মোটা চুড়ি খুলতে আরম্ভ করল। হাত থেকে চুড়ি বেশি জোরে টান দেওয়াতে ‘উহ্’ শব্দ করে আর্তনাদ করল মোহ। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিচু গলায় বলল,
“একে তো হাতের বেহাল দশা করেছেন। লম্বা দাগ পড়ে গেছে। এর মধ্যে খবরদার চুড়ি নিয়ে টানাটানি করবেন না। এত মাতব্বরির দরকার নেই।”

মুখ ঘুরিয়ে নিলো মোহ। স্বচ্ছ তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমার পিঠের যা অবস্থা আপনি করেছেন সেসব প্রসঙ্গে গেলে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে হবে আপনার। রাতে বসে থেকে মলম লাগিয়ে নেব আপনার থেকে। মনে থাকে যেন।”

মোহ দাঁতে দাঁত চেপে উঠে গেল সেখান থেকে। মিনিট দুয়েক পর সদর দরজার দিক থেকে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। মোহ ভাবল তার বাড়ির লোক এসেছে। মনে মনে আনন্দের সীমা রইল না তার। কিন্তু ঘটল বিপরীত। অপ্রত্যাশিতভাবে অন্বেষার প্রবেশ ঘটল বসার ঘরে। স্বচ্ছ বিস্ময়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। বাড়ির সবারই প্রতিক্রিয়া পাল্টে গেল। অন্বেষা সবাইকে দৃষ্টিপাত করে ইতস্ততভাবে বলে উঠল,
“আই এম স্যরি ফর কামিং হেয়ার। উইদাউট ইনভাইটেশনে চলে এসেছি।”

স্বচ্ছ সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনার সঙ্গে যেই কাজের সম্পর্ক ছিল সেসব শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে কি আপনি অন্য কোনো প্রয়োজনে এসেছেন?”

অন্বেষার আওয়াজ ধীর হলো।
“কাজের প্রয়োজনেই এসেছি। শুধু কয়েকটা বলতে চাই। মে আই সিট?”

মিসেস জেবা এগিয়ে বিনয়ের সাথে বললেন,
“হ্যাঁ, বসো। কাজ থাকলে ধীরেসুস্থে বলো। তাড়াহুড়ো করতে হবে না।”

“আসলে আন্টি, আমার অফিসে যেই বাজে ঘটনা ঘটেছে সেসব নিয়ে আমার কিছু বলার ছিল। আমি আসতে চাইছিলাম না। কিন্তু উপায় আর কিছুই দেখছি না। আমি প্রথমে মি. স্বচ্ছকে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হয়ে মোহের সঙ্গে যোগাযোগ করি। মোহ এই ঠিকানা দিয়েছিল আমায়।”

অন্বেষার দুচোখ মোহকে খুঁজল। সিঁড়ির কাছে ইথানের সাথে দেখা গেল তাকে। লাল শাড়ি পরিহিত অবস্থায়, আঁচল দিয়ে ঘোমটা দেওয়া, গায়ে অলংকার আর কোনো ভারী সাজ নেই। চোখে ডগডগে করে কাজল দেওয়া আর ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক! আগেকার দিনের রানির ন্যায় লাগছে তাকে। এই রূপেই হারানো উচিত। স্বচ্ছ কার জন্য নিজেকে ছিন্নভিন্ন করেছে সেটা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করল অন্বেষা। সে আজ নিজের অফিসের কাজ সহ স্বচ্ছ ও মোহকে দেখতে এসেছে তা অপ্রকাশিতই করে রাখল। মোহের মুখে এক আলাদা দ্যুতি ছড়িয়েছে। এ যেন স্বচ্ছের প্রণয়ের প্রলেপ তার জ্যোতি বহুগুণে বাড়িয়েছে। ভালোবাসা পেলেও বোধহয় মানুষ সুন্দর হয়!

স্বচ্ছ আচমকা ভারী গলায় বলল,
“আপনার কোম্পানি থেকে অনেক আগে আমি রিজাইন করেছি। তাই এ সম্পর্কে আমাদের কোনো কথা থাকতে পারেনা। থাকলেও আমি শুনতে চাইনা।”

এবার মোহ যেচে এগিয়ে মুখ খুলল,
“আপনার একবার হয়ত উনার কথা শোনা উচিত। আমি নিজেও শুনেছি বলে আপনাকে বলছি শুনতে।”

স্বচ্ছ নিশ্চুপ রয়। মনের মধ্যের দ্বন্দ্ব রেখে শুনতে চায়,
“বলুন কী বলতে চান?”

অন্বেষা হতবাক হয়। যেই স্বচ্ছ কিছু শুনতে রাজিই ছিল না সে কী সুন্দর মোহের এক কথায় কথা শুনতে প্রস্তুত হয়ে গেল! অন্বেষা সটান হয়ে বসে বলতে শুরু করল,
“আপনি জানেন আমি প্রথম নিজে কিছু করতে চেয়েছিলাম। কোম্পানির বয়স বেশিদিন নয়। তবুও আমার আর এত এমপ্লয়িদের পরিশ্রমে আমি নিজের ধারণার চেয়ে বেশি এগিয়ে যাই। কিন্তু আপনার সঙ্গে যেই জঘন্য ঘটনা ঘটে গেল তারপর আপনি কাজ ছেড়ে দিলেন। এসব কিছু মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে গেছে। আমার কোম্পানিতে জব করতে এখন সবাই ভয় পাচ্ছে। বেশ কয় নতুন জবের অফার করলে সবাই পিছিয়ে যাচ্ছে। আমি ভালো ট্রান্সলেটর পেতে ব্যর্থ হচ্ছি। এসব কিছুর প্রভাব আমার নিজের ভাইয়ের ওপরেও পড়ছে। ভাইয়ার স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে কোয়শ্চন করছে। আই ফিল লাইক অ্যা লুজার।”

স্বচ্ছ সবটা শোনবার পর গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এক্ষেত্রে আমি আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?”

“আমার কোম্পানিতে ব্যাক করুন। মিডিয়া অন্তত এটা জানুক আমি অপরাধীকে বের করে দিয়ে ঠিক মানুষকে কাজে রেখেছি। সকলের ভয় কমুক। প্লিজ!”

স্বচ্ছ কিছুটা সময় ভাবতে অতিবাহিত করল। অন্বেষা তার সম্মতি জানতে উন্মুখ হয়ে বসে আছে। সব শেষে স্বচ্ছ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বলল,
“আমি আমার সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়েছিলাম রেজিগনেশন লেটার দিয়ে। ওই কোম্পানিতে আমি ফিরতে পারব না।”

অন্বেষা হতাশ হয়ে জানাল,
“আমি আপনাকে সারাজীবন কাজ করতে বলছি না। ব্যস এসব ঝামেলা মিটে যাক। তারপর আপনি যা ইচ্ছে করবেন। আমার আপত্তি থাকবে না।”

“আমি জানি মুহিবকে জেলে দেওয়া গেছে আপনার জন্য। এজন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে। কিন্তু যেখানে আমার স্ত্রীকে অসম্মান করা হয়েছে সেখানে আমি মুখ তুলেও তাকাতে চাইনা। নেভার এভার!”

অন্বেষা চুপ হয়ে গেল। এই মুহূর্তে তার নিজেকে খুব অসহায় বোধ হলো। এরপর বলে উঠল,
“আপনি যখন আমার সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দিয়ে বলেছিলেন আমি যা শাস্তি দেব আপনি মাথা পেতে গ্রহণ করবেন। আপনি শাস্তির যোগ্য। আজ আমি আপনার থেকে সেই বিষয়ের বদৌলতে শাস্তি নয় একটা হেল্প। আই নিড ইউর হেল্প। তাই আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখবেন। অ্যান্ড আই এম স্যরি। পারসোনাল কথাগুলো আমি টেনে আনতে চাইনি। বাধ্য হয়ে বললাম।”

স্বচ্ছ কিছু বলতে উদ্যত হতেই মোহ পাশ থেকে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“উনার ভাবতে আরেকটু সময় প্রয়োজন। উনি ভেবে উত্তর দেবেন।”

“থ্যাংক ইউ, মোহ। অ্যান্ড আই এম ভেরি হ্যাপি ফর বোথ অফ ইউ। আমি আসি।”

একটি বিনয়ের হাসি দিয়ে বিদায় নেয় অন্বেষা। স্বচ্ছ ঘরে চলে যায়। কিছুসময় পর মোহও স্বচ্ছের জন্য ঘরে আসে। মানুষটাকে বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মোহ তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল স্বচ্ছের মুখ ভার। স্বচ্ছ শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল,
“কেন তুমি আমাদের বাড়ির এড্রেস দিতে গেলে? আমি ওখানে কাজ করতে চাইনা।”

“দিয়েছি কারণ আমার মনে হয়েছে এসব বিষয় শান্ত হওয়া দরকার। অন্বেষা কোম্পানি আসলেই লসে পড়ে যাচ্ছে। আর ও যা যা করল তার বিপরীতে আপনার কিছু তো করা উচিত। আপনি তো এতটা সেলফিশ নন।”

স্বচ্ছ উদ্ভ্রান্তের মতো মোহের হাত জড়িয়ে বলল,
“আমি তোমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো স্বার্থপর মোহ। তোমাকে যেখানে এত হ্যারাজ করা হলো সেখানে আমি কাজ করার কথা ভাবলেও এতটা ঘৃণা আসে যে গা গুলায় আমার।”

মোহ স্মিত হেসে স্বচ্ছের চুল নাড়াচাড়া করতে করতে বলে উঠল,
“তবে ঘৃণা মন থেকে ফেলে দিন। অসম্মান করার সাথে সেই অমানুষটা জড়িত। সেই জায়গাটা নয়। জেদ নয়। লজিক্যালি ভাবুন। আপনাকে তো সারাজীবন একই জায়গায় কাজ করতে হবে না। মিডিয়া এক বিষয় নিয়ে বেশিদিন পড়ে থাকেনা আপনিও জানেন। মিডিয়া শান্ত হোক। সবাই সব ভুলে যাবে। আপনিও তখন অন্য জবের চেষ্টা করবেন। আর আমিও চাইনা আপনি ওখানে অন্বেষার আন্ডারে সারাজীবন জব করুন।”

স্বচ্ছের মুখের উজ্জ্বলতা এবার ফিরে আসে। সামান্য হেসে মোহের হাতে চুম্বন এঁকে বলে,
“তাহলে আপনার ভেতরেও জ্বালাপোড়া হয়, ম্যাডাম?”

মোহ স্বচ্ছের দুটো গাল একহাতে চেপে ধরে বলে উঠল,
“শুধু জ্বালাপোড়া নয়। আমার মনের অভ্যন্তরে সম্পূর্ণ আগ্নেয়গিরি রয়েছে। সেটাতে একবার ফাটল ধরলে আপনার বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে। সো বি কেয়ারফুল।”

তাদের কথোপকথনের মাঝে নিচ থেকে ডাক আসে। ফারাহ এসেছে। স্বচ্ছ আর মোহ নিচে যেতেই ফারাহ খুশিতে গদগদ হয়ে মোহকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে,
“হাউ বিউটিফুল ইউ আর! ভাইয়া তোর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে না? মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে এতে তো হার্টবিট মিস করে যাওয়ার কথা।”

স্বচ্ছ সামান্য হেসে বলল,
“আমার তো সেই প্রথম থেকেই হার্টবিট মিস হওয়া শুরু করেছে। এতদিনে আমি অভ্যস্ত। নাহলে সংসার হবে কী করে?”

দুই ভাই-বোনের কথোপকথনে মোহ লাজুক মুখে চুপ করে থাকে। সৌমিত্র মাঝে ফারাহ্কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“কী রে, শৌভিক কোথায়?”

ফারাহ হাফ ছেড়ে বলে,
“তার কী আর সময় আছে? বেরিয়েছে পার্টির কাজে। তবুও বলেছে আসার চেষ্টা করবে। তুই এত খোঁজ করছিস কেন? উনার সঙ্গে মিলে আমাকে টিজ করতে খুব সুবিধা হয় তাই না?”

সৌমিত্র শব্দ করে হেসে বলল,
“তা আর বলতে!”

কিছুক্ষণ পর মোহের বাড়ি থেকে সবাই এলো বাড়িতে। কথাবার্তা, আড্ডায় জমে উঠল বাড়ির পরিবেশ। সকলে এবার সৌমিত্রের বিয়ের বিষয় নিয়ে ঠেলাঠেলি শুরু করল। আদেশ করল ভালো করে পড়াশোনার। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। এই অসময়ে বাড়ির দারোয়ান এসে স্বচ্ছের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে গেল। সবার মনোযোগ সেদিকে গেল। মিসেস জেবা শুধালেন,
“কী ওটা?”

স্বচ্ছ খামের ভেতরের কাগজ ভালো করে পড়ে মোহের মুখের দিকে তাকিয়ে ভারী স্বরে বলল,
“কোর্টের নোটিশ। আরিদ্রের কেইস দুদিন পর কোর্টে উঠবে। আমাদের কয়েকজনকে উপস্থিত থাকতে হবে সেখানে।”

মোহের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। মুখের রঙ বদলায়৷ মস্তিষ্কে নাড়া দেয় দুর্বিষহ যেই স্মৃতি। চোখে ভাসে ঈশানীর সেই মৃত মুখ। জ্বলে ওঠে মোহের হৃদয়। সে নিজ হাতে নিশ্চিত করতে চায় আরিদ্র নামক কীটের ধ্বংস।

চলবে…