যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-৪৩

0
15

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৩ [দ্বিতীয় খণ্ড]

গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখে ইথান হাতে ললিপপ নিয়ে খেতে খেতে স্বচ্ছের কোলে চড়ে বাড়ির দিকে ফিরছে। তাদের সাথে আছে মোহ নিজেও। গ্রামের এটা-সেটা দেখে ইথানের প্রশ্নের অন্ত নেই। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে স্বচ্ছ। ইটের করা পাকা রাস্তার দুপাশে ধানের ক্ষেত। সন্ধ্যার হালকা আলোয় বাতাসে ধান গাছের দোলা দেওয়া দেখছে মোহ। পরক্ষণেই সে খেয়াল করে স্বচ্ছ আর ইথান দুজনেই পাতলা ফিনফিনে গেঞ্জি পরেছে। মাঝে মোহ হঠাৎ স্বচ্ছের হাতের বাহু স্পর্শ করে দেখল স্বচ্ছের হাত প্রচুর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মোহের গায়ে হালকা শাল ছিল। সে জানে গ্রামের বৃষ্টির আবহাওয়া আর চারিদিকে এত গাছপালার প্রভাবে সন্ধ্যার পর কিছুটা ঠাণ্ডা পরে। মোহ দ্রুত নিজের শাল খুলে বাবা-ছেলের গায়ে জড়িয়ে দিলো। স্বচ্ছ কিছুটা বিস্ময়ের সাথে হাঁটা থামায়। তার কিছুটা ঠাণ্ডা অনুভূত হলেও প্রকাশ করেনি। ইথানকে ঠাণ্ডা লাগতে দেয়নি। জড়িয়ে ধরে হাঁটছিল নিজের সঙ্গে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী করে বুঝলে ঠাণ্ডা লাগছে?”

“আপনি একাই আমার মন বোঝার দায়িত্ব নিয়েছিলেন?”

মোহের এক বাক্যই স্বচ্ছের জন্য যথেষ্ট ছিল। মোহ বিড়বিড়িয়ে বলল,
“মাথায় তো একটুও কমন সেন্স নেই। বৃষ্টি হচ্ছে তাহলে ঠাণ্ডা তো লাগবেই।”

“তোমারও তো ঠাণ্ডা লাগবে।”

“লাগবে না। আমার কাছে ওড়না আছে। আপনাদের মতো খালি বের হইনি।”

বলেই মোহ নিজের ওড়না মাথায় দিয়ে ভালো মতো জড়িয়ে স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল। সেই মুহূর্তে বয়স্ক পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো তাদের কর্ণকুহরে।
“এইডা কে? মোহ না তুমি?”

মোহ মনোযোগ দিয়ে দেখে চিনতে পেরে বলল,
“জি, জাবেদ কাকা। আমি মোহ।”

মোহ ভদ্রতার সহিত সালাম দিলো। যদিও মোহ কিছু অতীত কারণে সালাম দিতে চায়নি। তবুও দিলো। জাবেদ সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বলে উঠলেন,
“অনেকদিন পর দেখতেছি গ্রামে। এইডা আবার কে তোমার সাথে? স্বামী নাকি অন্যকিছু? কম কাহিনী তো করো নাই। আবার চুনকালি মাখানোর জন্য কারে ধরছ এইডা? একবার বাচ্চা পেটে ধরছ। আরেকবার ধরার ফন্দি?”

মোহের শরীর রাগে রি রি করে উঠল। কিছু বলার আগেই স্বচ্ছ ইথানকে কোল থেকে নামিয়ে মোহের পাশ কাটিয়ে জাবেদ সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে চোখ বড়ো করে বলল,
“এক মিনিট, এক মিনিট! কার সম্পর্কে কী বলছেন মুরব্বি? মুরব্বি না আপনি? আমার স্ত্রীর সম্পর্কে বলার অধিকার কোথা থেকে পেলেন? হ্যাঁ?”

জাবেদ সাহেব আগের মতোই গজগজ করে বলে উঠলেন,
“ও, তুমি তাইলে এই মাইয়ার স্বামী লাগো! তা বাচ্চা কি তোমারই আছিল? মনে তো হয়না। টুপি পরাইয়া বিয়া করছে তোমারে তাই না? নাইলে ওর মতো মাইয়ারে বিয়া করলা কেমনে? পাত্রীর আকাল পড়ছিল নাকি?”

ক্রোধে স্বচ্ছের কাঁপুনি উঠে গেল। এত কথা আর কানে নিতে পারল না সে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আগপাছ না ভেবে জাবেদ লোকটির পাঞ্জাবির কলার পাকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে আনলো স্বচ্ছ। মোহও চমকে গেল। কী করবে ভেবে না পেয়ে ইথানকে টেনে নিয়ে তার পেছনে রাখল। স্বচ্ছের চোখ দুটির তাকিয়েই ভয় পেয়ে গেলেন জাবেদ সাহেব। তার দৃষ্টিই যে কাউকে পুড়িয়ে ফেলবে এখন ক্রোধের আগুন দিয়ে। স্বচ্ছ হিসহিসিয়ে বলল,
“এই চাচা, কান পরিষ্কার করে শুনুন। ইথান আমার বাচ্চা, আমার ছেলে, আমার অংশ। আর আমার মোহকে নিয়ে যদি আর একটা খারাপ কথা বলেছেন তাহলে এই ধানের ক্ষেতের মধ্যে আপনার লা/শ গেঁড়ে রেখে দেব। বোঝা গেছে?”

জাবেদ সাহেব মনে মনে আতঙ্কে থাকলেও প্রকাশ করলেন না। ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
“আরে, এই পোলা আমারে হুমকি দেয়। সাহস কত বড়ো! চরিত্রহীন মাইয়াকে নাকি চরিত্রহীন বলা যাইব না। গ্রামের সবাই জানে ওর কীর্তি।”

মোহের আঁখিতেও তখন ভীতি কাজ করছে। মাঝ রাস্তায় এসব হট্টগোল করলে অনেক বড়ো ঝামেলা হয়ে যাবে। কিন্তু স্বচ্ছ এবার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়ে ফেলল। সরাসরি হাত মুঠি করে ঘুষি মা/রল জাবেদ সাহেবকে। ছিটকে গিয়ে রাস্তার ধারে পড়লেন তিনি। স্বচ্ছ এগিয়ে গিয়ে আরো মা/রতে চাইল উনাকে। তার হাত টেনে ধরল মোহ। কিন্তু স্বচ্ছ তখন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। মোহের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে নিজের তর্জনী আঙ্গুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে বলল,
“হুঁশশ! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমাকে আটকাবে না।”

স্বচ্ছ তেড়ে গেল জাবেদ সাহেবের দিকে। জাবেদ সাহেব চিল্লিয়ে আর্তনাদ করে বলল,
“আমারে মাইরা ফেলল রে। কেউ বাঁচাও।”

স্বচ্ছ ফের উনার কলার ধরে টেনে তুলে বলল,
“যখন মানা করলাম তখন গায়ে লাগাস নি কেন আমার কথা? ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছি মনে হলো? কী হবে তোকে মারলে? নিজের মন্ত্রী বাপের মতো আমিও জেলে যাব। এইটুকুই তো।”

জাবেদ সাহেবের ভয় বাড়ল। ঢক গিলে শুধালেন,
“কার পোলা তুমি?”

“সরোয়ার সাহের।”

থমকে গেলেন জাবেদ সাহেব। তিনি ছিলেন সরোয়ার সাহেরের কঠিন ভক্ত। তার দলে যুক্ত ছিলেন। গ্রামের শক্তিশালী নেতা ছিলেন সরোয়ার সাহেবের জেরেই। সেই ক্ষমতা দেখিয়ে মোহ আর তার পরিবারকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে পেরেছিলেন তিনি। আজ তার প্রিয় মন্ত্রীর ছেলেই উনাকে মারছে। কী অদ্ভুত নিয়তির প্রতিশোধ! স্বচ্ছ জাবেদ সাহেবকে ছেড়ে পাশে কাঁদা মেখে থাকা রাস্তা থেকে কাঁদা নিয়ে জাবেদ সাহেবের চোখমুখে ইচ্ছেমতো মাখায়। ফের তাকে ঘুষি মা/রতেই দুজন লোক দেখে স্বচ্ছকে ধরে জাবেদ সাহেব থেকে দূরে নিয়ে আসে। স্বচ্ছ চিৎকার করে বলে,
“যেই আঙ্গুল আমার স্ত্রী আর বাচ্চার দিকে উঠবে সেই আঙ্গুল আমি কেটে ফেলে দেব। শেষ করে দেব।”

উপায়ন্তর না পেয়ে মোহ স্বচ্ছের সামনে এগিয়ে গিয়ে অসহায় মুখে বলল,
“থেমে যান আপনি। ইথান আছে এখানে। সব দেখছে ও।”

স্বচ্ছের রাগ নিয়ন্ত্রণে এলো মুহূর্তেই। লোক দুটির মধ্যে একজন বললেন,
“রাস্তার মধ্যে ঝামেলা কইরেন না। মারামারিও করা যাইব না। আর জাবেদ চাচার ভুল হলে ক্ষমা চাইয়া নেন।”

জাবেদ সাহেব চুপচাপ ক্ষমা চেয়ে সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়ে গেলেন। কাছে নেই ক্ষমতা। যদি থাকত তাহলেও কী কিছু করতে পারতেন? প্রিয় মন্ত্রী সাহেবের ছেলের বলে কথা! কিন্তু অপমানটা উনার মনে গেঁথে গেল। তবুও চাইলে কিছুই করতে পারবেন না উনি।

স্বচ্ছ বড়ো নিশ্বাস নিয়ে ইথানের কাছে গিয়ে তাকে তুলে জড়িয়ে নিলো। ইথান মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল,
“বাবা, লোকটাকে মারলে কেন? লোকটা খারাপ কিছু করেছে?”

“তোমার মাম্মাকে বাজে কথা বলেছে ওই লোকটা। আমি কী করে ছাড়তাম বলো?”

ইথান এবার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“তাহলে ঠিক করেছ। একদম ঠিক হয়েছে।”

স্বচ্ছ মোহের পানে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“আমার আচরণে কষ্ট পেয়েছ? আই এম স্যরি।”

মোহ নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“রাগ উঠলে একদম কন্ট্রোল করা যায়না আপনাকে। রাগটা একটু কমান।”

“পারব না। তোমাকে আর ইথানকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারব না।”

মোহ স্বচ্ছকে আর উত্তেজিত না করে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আচ্ছা। যাই তাহলে? দাদিমা চিন্তা করছে হয়তো।”

স্বচ্ছ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে ইথানের গালে খুব যত্ন করে চুমু খেয়ে মোহের সাথে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো।

নিজের ডিজাইন করা নতুন এক পোশাক ল্যাপটপে ভালো করে আর্ট করে ঘড়ির দিকে তাকাল ফারাহ। সাতটা বাজতেই চলেছে। ল্যাপটপ বন্ধ করে হুড়মুড়িয়ে উঠল সে। ফোন হাতে নিয়ে দেখল শৌভিক কল করেছে কিনা! এখনো শৌভিকের কল না আসায় নিশ্চিন্ত হলো ফারাহ। নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকল ডিজাইনার ড্রেস স্টক রুমে। তাকে দেখে বেশ চমকায় সেখানকার স্টাফরা। একজন মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে,
“ম্যাম, আপনার কিছু লাগবে?”

ফারাহ একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠল,
“হুঁ। একটা ড্রেস নিতে এসেছি নিজের জন্য।”

ফারাহ ঝুলিয়ে রাখা প্রতিটা পোশাক দেখতে আরম্ভ করে। প্রথমে দেখে গাউন। কালো রঙের লং গাউন নিয়ে নিজের সাথে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। এপাশ-ওপাশ দেখে। তারপর বিভ্রান্ত হয়ে একজন স্টাফকে শুধায়,
“আমাকে মানাচ্ছে?”

স্টাফ লেডি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,
“অভিয়েসলি, ম্যাম। আপনি এমনিতেই এত সুন্দর যে যেকোনো ড্রেস মানিয়ে যাবে।”

ফারাহর মুখ ভার হয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে বলে,
“এসব মাখন লাগানো বন্ধ করো। এতে আমি আরো কনফিউজড হয়ে যাব।”

ফারাহ আরো গাউন দেখেও সন্তুষ্ট হয়না। তারপর ভাবে শৌভিকের পছন্দের কথা। শৌভিক বাংলা পোশাক বেশি পছন্দ করে। ফারাহ সালোয়ার কামিজের সেকশনে খুঁজে একটা মেরুন রঙের কামিজ বের করে৷ আয়নায় নিজের সাথে ধরে দেখতেই তার মনের উল্লাস বেড়ে যায় দ্বিগুন। খুশিতে আয়নার সামনে ঘুরপাক দিয়ে নেচে নেচে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে চেঞ্জিং রুমে যায় সে। উপস্থিত থাকা স্টাফ ফারাহর এমন কাণ্ড দেখে হাসি চেপে রাখতে ব্যর্থ হয়। ফিক করে হেসে একজন অন্যজনকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ম্যামের সাথে বোধহয় উনার হাজবেন্ডের কোনো স্পেশাল ডেট আছে। হ্যাপি লাগছে উনাকে।”

“আসলেই। এমন অফিসে থাকা অবস্থায় এমন খুশি কখনোই দেখা হয়নি উনাকে। এমনভাবে তাকান আর কথা বলেন যে মনে হয় হৃদপিণ্ড খুলে বেরিয়ে আসবে।”

আকাশ সম আগ্রহ নিয়ে তৈরি হয় ফারাহ। বাধাঁ চুল ছেড়ে দিয়ে আয়নায় নিজেকে বারবার দেখে নেয়। হাতের ঘড়ি খুলে ড্রেস শ্যুটিং সেট থেকে ম্যাচিং চুড়ি হাতে দেয়। অফিসে এখন আর তেমন কেউ নেই। বেশিরভাগ এমপ্লয়ির কাজের সময় শেষ। দুয়েকজন আছে তারাও চলে যাবে একটু পরেই। নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই গান গাইছে ফারাহ। ইশারায় নিজেকেই চুমু খাচ্ছে। খুশিগুলো কিছুতেই মনে চেপে রাখা যাচ্ছে না। কতগুলো দিন পর শৌভিকের সাথে সময় কাটাবে সে! এটারই অপেক্ষায় তার দিন কেটেছে। কেউ জানেনি তার অন্তরের খবর।

সাড়ে সাতটা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও শৌভিক এলো না বা তার ফোন কলও পেল না ফারাহ। একটু ধৈর্য নিয়ে নিজেই এবার কল দিলো ফারাহ। প্রথমবার বেজে কেটে গেল। পরেরবারও একই ঘটনা ঘটল। হতাশা দেখা গেল ফারাহর সদ্য খুশি মুখে। পরক্ষণেই এলো শৌভিকের মেসেজ। ফের আনন্দ ফিরল ফারাহর মনে। দ্রুত মেসেজ ওপেন করে পড়ল,
“ফারাহ, আমি এখন কাজ ছেড়ে আসতে পারছি না। তার জন্য স্যরি। হয়ত অনেক রাত হবে আজকেও। তুমি সাবধানে বাড়ি ফিরে যাও। বাড়ি ফিরে আমাকে মেসেজ দিও একটা।”

মস্তিষ্ক শূন্য লাগল ফারাহর। কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সেখানকার চেয়ার ধরে। তারপর জেদ চাপিয়ে আবারও কল করল বারবার শৌভিককে। এক পর্যায়ে কল রিসিভ করে শৌভিক। ফারাহকে আশ্চর্য করে দিয়ে শৌভিক অনেকটা রেগে কঠোর গলায় বলতে লাগল,
“আমি তো তোমাকে মেসেজ দিয়ে সব বললাম। তাও কেন বারবার কল করে বিরক্ত করছ? বুঝতে পারছ না যে আমি এখন কল ধরতে পারছি না? প্লিজ সিচুয়েশন বুঝে কাজকর্ম করো। আমি কল কাটছি। বাড়ি গিয়ে মেসেজ… ”

শৌভিক তার কথা শেষ করার আগেই ফারাহ কল কেটে দেয়। গায়ের শক্তি দিয়ে ফোন চেপে ধরে কাঁপতে থাকে সে। আয়নার দিকে তার দৃষ্টি পড়ে। একটু আগেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হওয়া ফারাহ এবার নিজেই নিজেকে দেখে বিষ অনুভব করে। মনের উল্লাস বিষাক্ত হতে থাকে। আয়নার দিকে নিজের ফোনটা ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে ফারাহ। আয়না মাঝখান দিয়ে ভেঙে টুকরোগুলো ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়। টুকরো আয়নায় দুই ফোঁটা অশ্রু পড়ে। ফোনটার অবস্থাও করুণ হয়। অফিসে উপস্থিত থাকা কিছু স্টাফ আর এমপ্লয়ি সকলেই হকচকিয়ে ওঠে। তবে কারোর সাহস হয়না ফারাহর কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার। ফারাহ কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে অফিস ত্যাগ করে।

তানিয়া নিজের ঘরে লুকিয়ে সৌমিত্রের দেওয়া বক্সটা এনে রাখে। দরজা বন্ধ করে বক্স খুলতেই প্রায় বিশটার মতো গোলাপ ফুল আবিষ্কার করে তানিয়া। গোলাপের রঙ গোলাপি দেখে মুচকি হাসে সে। গোলাপ হাতে নিতেই সে একটা চিরকুট পায়৷ সেখানে লেখা,
‘মিস গোলাপির জন্য গোলাপি গোলাপ। আপনি আর রেগে থেকে মিস গোলাপি থেকে মিস লাল হয়ে যাবেন না প্লিজ। আপনার মিস্টার গোলাপির মনে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। বিশ্বাস না হলে এরপর সামনাসামনি হলে আমার হৃদয় কেটে দেখবেন। ঠিক আছে? যদি পারেন তাহলে চুলে গোলাপ লাগিয়ে কিছু ছবি পাঠিয়ে দিয়েন। আমি অপেক্ষায় থাকব।’

তানিয়ার হাসি প্রগাঢ় হয়। ভাবে, মানুষটা এত পাগলাটে কেন? তানিয়া আয়নার কাছে গিয়ে নিজের চুলে কয়েকটা গোলাপ গুঁজে ছবি তোলে। অতঃপর সৌমিত্রের হোয়াটসঅ্যাপে সেটা সেন্ট করে। সেখানে এক্টিভই ছিল সৌমিত্র। ছবি পাঠানোর সাথে সাথে সে ছবিটা দেখল। যেন ছবিরই অপেক্ষা করছিল সে। তানিয়ার নিকট সৌমিত্রের মেসেজ এলো।
‘অমায়িক লাগছে মিস গোলাপিকে গোলাপ ফুলে। পরেরবার ওই চুলে ফুল গুঁজে দেওয়ার সৌভাগ্য যেন আমার হয়।’

তানিয়া হেসে রিপ্লাই করে,
‘জেগে জেগে স্বপ্ন অনেক দেখলেন। এখন পড়তে বসা দরকার।’

সৌমিত্রের অনুভূতিতে পানি ঢেলে দেওয়ায় কান্নার কয়েকটা ইমোজি পাঠায় সৌমিত্র। তা দেখে তানিয়ারও মায়া লাগে আবার হাসিও আসে। কিছুটা সময় মেসেজে চলে তাদের কথা। তানিয়া জানায়, হয়ত তার বাবা আর ভাই এলে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে না। তাই যেন চিন্তা না করে সৌমিত্র। সৌমিত্রও তানিয়ার কথায় সায় দেয়।

রাত প্রায় দশটায় খাবার খাওয়াদাওয়া শেষে ইথানের খুব ঘুম পেল। তাই আজকে ঘুমানোর জন্য মশারি নিয়ে এলো মোহ। তা দেখে স্বচ্ছ বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
“এটা কী? মশারি?”

“জি, আমাকে এটা ঠিক করতে হেল্প করুন। টানিয়ে নিই দুজন মিলে।”

স্বচ্ছ হতবাক হয়ে বলে উঠল,
“অসম্ভব। মশারিতে আমার দমবন্ধ লাগবে।”

“মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া হওয়ার চেয়ে একটু দমবন্ধ লাগা ভালো। গত রাতের কথা মনে নেই? অজস্র মশা এখানে।”

স্বচ্ছ বুঝল আসলেও কিছু করার নেই। তাই সে টুলে দাঁড়িয়ে মশারির দড়ি টানাতে নিলো। মোহ মশারির ভেতরে ইথানকে নিয়ে ঢুকে মশারির চারিদিকে ঠিকঠাক করতে নিলো। দড়ি টানানোর এক পর্যায়ে স্বচ্ছ উপলব্ধি করল টুল বেশ নড়বড়ে। পায়ের গোড়ালি উঁচু করতে গিয়েই সে বাঁধায় বিপত্তি। নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে ফট করে বিছানার দিকে মশারির দড়ি ছিঁড়েই পড়ে যায়। ভেতরে থাকা ইথান হম্বিতম্বি করে সরে গেলেও মোহ নিজেকে সামলে ওঠার আগেই স্বচ্ছ ঠিক মোহের নিকট এসে উপুড় হয়ে পড়ল। মোহ চকিতে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে মশারির নিচ থেকেই বলল,
“আপনি ঠিক আছেন? ভাগ্যিস বিছানার উপর পড়লেন। কোথাও লেগেছে?”

স্বচ্ছ এক পলক মোহকে মশারি জড়িত অবস্থায় দেখে একটু ভেবে বলল,
“লেগেছে তো।”

“কোথায়?”

“এখানে।”

মোহ বুঝতে পারল না। তৎক্ষনাৎ মশারির উপর থেকেই তার ঠোঁটে আলতো চুম্বন দিয়ে বসল স্বচ্ছ। তারপর ঠোঁট কামড়ে হেসে এক চোখ টিপে উঠে বসল সে। ইথান দুই গালে হাত দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“বাবা তুমি মাম্মাকে চুমু খেলে? আমিও খাব।”

মোহ মশারি থেকে বের হতেই ইথানও দৌড়ে এসে চুমু দিলো মোহের বাম গালে। স্বচ্ছ চোখ ছোটো করে বলল,
“ইথান বাবু কি কম্পিটিশন করতে চাচ্ছো চুমু খাওয়ার?”

“ফার্স্ট কিন্তু আমি হবো বাবা।”

বলেই ইথান আরেকটা চুমু দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। স্বচ্ছও পালাক্রমে মোহের অন্য গালে ফের চুমু খায়। ইথানও আবার চুমু খেতে থাকে। বাবা ছেলের কাণ্ডে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোহ। হতবিহ্বল হয়ে বসে থেকে হুঁশ এলে দুজনেরই ঠোঁট চেপে ধরে কড়া গলায় বলে ওঠে,
“দুইটাকেই ঘরের বাহিরে বের করে দিয়ে আমি একা ঘুমাব এবার।”

ইথান ঠোঁট উল্টিয়ে ভীরু স্বরে জানতে চায়,
“আমরা তো আদর করছিলাম।”

ইথানের কথায় কান না দিয়ে নিজে মশারি টানিয়ে বিছানা করে তাকে বিছানার একপাশে শুইয়ে দিলো মোহ। মাঝখানে শুয়ে পড়ল স্বচ্ছ ইথানকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে। মোহও অন্যপাশে শুতেই তাকেও আরেক হাতে জড়িয়ে নিলো স্বচ্ছ। প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও মোহ স্বচ্ছের পাশ ঘুরে তার বুকে হাত রাখে। স্বচ্ছও যেন শান্তির শ্বাস নিচ্ছে। ইথান স্বচ্ছকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল অবশেষে। জেগে রইল মোহ আর স্বচ্ছ। মোহ নরম স্বরে বলে উঠল,
“ঘুম আসছে না?”

“একটা কথা ভাবছি।”

“কী কথা?”

“এই যে আগের মোহময়ীকে কোনো কথাই বলা যেত না। কথার আগে উত্তর রেডি থাকত। কেউ অপমান করলে তার দ্বিগুণ সে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখনকার মোহময়ীর দাবানল নিভে গেছে। তাকে কেউ কিছু বললেও প্রতিবাদ করে না। যেমনটা আজ দেখলাম।”

মোহ মৃদু হাসে। স্বচ্ছের দুটো গাল একহাতে চেপে উত্তর দেয়,
“কারণ এখন সে প্রতিবাদ করার আগে তার হয়ে তার প্রিয়তম গর্জে ওঠে। মোহের মুখ থেকে শব্দ বের হওয়ার আগে আরেকজনের হাত চলে। তাহলে তার প্রতিবাদের দরকার কী?”

স্বচ্ছ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নির্লিপ্তে বলে,
“কেউ তোমাকে অসম্মান করুক সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। ইথানও আমার। ওর দিকে আঙ্গুল উঠলে আমি ওই আঙ্গুলের অস্তিত্ব রাখব না। তোমাদের আমি অনেক ভালোবাসি।”

মোহ স্বচ্ছকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। সুখের সাগর অতিক্রম করছে সে। সেই সাগরে কোনো দুঃখ নেই। তার দুনিয়া এতটুকুতেই আঁটকে গেছে।

শৌভিকের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটারও বেশি বেজে যায়। তার বাবাও জেগে নেই। কাজ থেকে ফিরে দ্রুত খেয়ে ঘুমিয়েছেন। শৌভিক মনে মনে অনুতপ্ত হয়। ফারাহকে সে এই প্রথম এত কড়া শুনিয়েছে। অনুতাপে মাথা নত হয় তার। অশান্ত মনে নিজের ঘরে ঢুকতেই তার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি ফারাহকে তন্নতন্ন করে খোঁজে। কিন্তু ফারাহ ঘরে নেই। ঘর থেকে বের হতেই সামনে বাঁধে গৃহকর্মী মেয়েটি। শৌভিক ভারাক্রান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ফারাহ কোথায়?”

মেয়েটি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চুপ থেকে বলল,
“ভাবি? ভাবি তো বাসায় এখনো আসে নাই। বড়ো স্যার কইল আপনে আর ভাবি মিলে নাকি ঘুরাঘুরি করবেন। তাই আসতে দেরি হইব। এজন্য তো আপনাদের লাইগা রান্নাও করি নাই।”

বুকটা ধক করে ওঠে শৌভিকের। মেয়েটি চলে যেতেই নিজের ঘরে এসে বিলম্ব না করে কল করে মিসেস জেবাকে। মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম তার। মেয়েটা কিনা অভিমান করে বাড়িতেই ফিরল না! অবশ্য দোষটাও তার নিজেরই। রাতে ফোন ধরতে একটু দেরিই হলো মিসেস জেবার। কল ধরেই তিনি উদ্বিগ্ন সুরে বললেন,
“হ্যালো, শৌভিক? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? এত রাতে কল করলে যে?”

শৌভিক সালাম দিয়ে কোনো ভণিতা ছাড়া জানতে চায়,
“ফারাহ কি ওই বাড়িতে গেছে, মা?”

মিসেস জেবা আরো অস্থির হয়ে উঠলেন।
“ফারাহ? না তো। ও তো এখানে একবারও আসেনি। কী হয়েছে? আমার ফারাহ কোথায়?”

শৌভিক বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। মাথাটা এবার ভনভন করছে তার। মর্মাহত কণ্ঠে সে বলে ওঠে,
“কিছু ঠিক নেই মা। সব দোষ আমার। ও শুধু একটু প্রায়োরিটি চেয়েছে আর আমি তাও দিতে পারিনি।”

“আবার তোমাদের মাঝে ঝামেলা হয়েছে?”

“জি। ঝামেলার মূল কারণ আমি।”

মিসেস জেবা দুশ্চিন্তা নিয়ে বললেন,
“দেখো বাবা, আমার ফারাহ ছোটো থেকে একটা জিনিস দেখে বড়ো হয়েছে। সেটা হচ্ছে অবহেলা। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা। আর সেই স্ত্রী হচ্ছি আমি। একটা সময় ফারাহর বাবা এতটাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে আমাকে সময় দিতে ভুলেই গেল। আমি কেমন আছি সেটা জানার প্রয়োজনবোধও করত না সে। বছরের পর বছর শুধু অপেক্ষা করে গেছি কবে মানুষটা আমার খবর নেবে। আমার সাথে বসে দুটো গল্প করবে, সময় কাটাবে। কিন্তু মানুষটা তখন ক্ষমতায় অন্ধ। ক্ষমতা উনার কাছে সব হয়ে গেল। অথচ আমাদের সম্পর্কের শুরুটা তোমাদের মতোই অনেক সুন্দর ছিল।”

শৌভিক ভারি গলায় বলল,
“আই এম স্যরি, মা। আমি আপনার মেয়েকে খুশি রাখতে পারছি না।”

“ফারাহর মনে আতঙ্কে ছেয়ে আছে। সে ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে যদি তোমাদের সম্পর্কের পরিণতি আমাদের মতো হয়। যদি তুমি শুধুই ক্ষমতাকে ভালোবাসো? ও আমাকে গতকাল কল করেছিল। আমাকে সব বলেছে। ওর মনে যেই ভীতি তৈরি হয়েছে সেটা বলেছে। বারবার জানতে চেয়েছে, ও তোমাকে পুরোপুরি পেয়েছে তো? নাকি কোনো খামতি রয়ে গেছে? ওর মনের সংশয়কে দূর করে দাও। ওর মনের আজেবাজে ভাবনা শেষ করার দায়িত্ব তোমার। আমি হয়ত জানি ও কোথায় আছে।”

আরো কয়েকটা কথা বলে কল কাটলেন মিসেস জেবা। শৌভিক তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি। ফারাহ কোলবালিশ জড়িয়ে গভীর ঘুমে বিভোর। সে অফিস থেকে বেরিয়ে সরাসরি নিজের সেই ফ্ল্যাটে এসেছে যেখানে মোহ আর স্বচ্ছের বিয়ে হয়। ব্যস…সেখানেই এসে রাগে-দুঃখে হাত-পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে ক্লান্ত শরীরে। ‎
‎হাতে থাকা চুড়িগুলো ফ্লোরে ছিটিয়ে ফেলে রেখেছে। তার চেহারায় এখনো ফুটে আছে যাতনার চিহ্ন। যেই যাতনায় কোনো ব্যথা নেই। তবুও ভীষণ পীড়া দেয়। ঘুম হালকা হয় ফারাহর। নড়েচড়ে উঠে অন্যদিকে ফিরতেই গরম হাওয়া অনুভব করে সে। তার নিশ্বাসের সাথে আরেক নিশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে। আঁচড়ে পড়ছে চোখমুখে গরম নিশ্বাস। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে তার। নিজ ব্যতীত আরেক অস্তিত্ব টের পায় সে। চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না। সবই অন্ধকার। এবার বোঝে কেউ তাকে হাত দিয়ে আঁটকে রেখেছে। কারো গায়ে গা ঘেঁষে শুয়ে আছে সে। ফারাহর স্মরণে আসে সে তো পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে একা। মাথা চক্কর দেয় তার। ছোটোবেলায় শুনেছিল যেই বাড়িতে কেউ থাকেনা সেখানে জ্বীনের আনাগোনা হয় বেশি। এখন সেটাই বারবার মনে আসছে তার। হাত-পা ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে।গেল ফারাহর। কোনোকিছু না ভেবেই সেই অজানা অস্তিত্বকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করা শুরু করে একাধারে। ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে চাদরের প্যাঁচে পা পড়ে আঁটকে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরেই পড়ে যায় ফারাহ। বেশ জোরেশোরেই লাগে তার হাঁটুতে। কিন্তু চিৎকার করা থামে না। অবশেষে দোয়া দরুদ পড়ে জোরে জোরে। এবার অপরপাশের অস্তিত্বের কণ্ঠস্বর পায় সে।
‎”ফারাহ, কী হলো তোমার? ভয় পেও না। এটা আমি।”

‎আতঙ্কে কণ্ঠস্বর চেনা লাগলেও বুঝে উঠতে পারে না ফারাহ। অবশেষে শৌভিক তার পাশে ল্যাম্প জ্বালায়। ঘরটাতে সামান্য আলো ছড়ায়। শৌভিকের মুখটা দেখতে পায় ফারাহ। ফ্লোরে হাঁটুতে হাত দিয়ে বসে থাকে হতবাক হয়ে শৌভিকের উপস্থিতি দেখে। তারপর শান্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। শৌভিক নেমে ফারাহর কাছে আসতে চাইলে চুপচাপ পিছু সরে যায় ফারাহ। শৌভিক আরো কাছে যায়। ফারাহও নাছোড়বান্দার মতো পিছু হটতে থাকে বসে বসে। একসময় পিঠ গিয়ে ঠেকে দেয়ালে। না সরতে পেরে মাথা নিচু করে বসে রইল সে। শৌভিক তার অনুরাগী মুখখানার দিকে চেয়ে রয় কিয়ৎক্ষণ। কী বলবে বুঝেই উঠতে পারে না। কারণ ইতিমধ্যে সে একই ভুলের জন্য বারবার ক্ষমা চেয়েছে। শৌভিক নির্বিঘ্নে শুধায়,
‎”খুব ভয় পেয়েছ? দোয়া দরুদ অবধি পড়ছিলে।”

‎ফারাহ তার উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‎”কেন এসেছেন এখানে? আমি তো আর কাজে বিরক্ত করিনি।”

‎”আমি তোমার সাথে ওভাবে কথা বলতে চাইনি।”

‎”আমি চাইনি আপনার সাথে লং ড্রাইভে যেতে, আপনার সাথে একান্তে ডিনারে করতে। কিন্তু আপনি আমায় আশা দিয়েছিলেন। আর আপনিই ভেঙে দিলেন।”

‎ফারাহর গলা ধরে আসে কান্নায়। তা রোধ করে জোর গলায় কথা বলতে থাকে সে। ফারাহ আরো বলে,
‎”চেয়েছিলাম বাবার মতো কেউ আমার জীবনে না আসুক। এমন কেউ আসুক যে সব ব্যস্ততার মাঝেও আমায় নিয়ে ভাববে। কিন্তু সব রাজনীতিবিদ বোধহয় একই হয় তাই না? আপনি তো আলাদা ছিলেন। কেন বদলে যাচ্ছেন বাবার মতো? কেন?”

‎কথাগুলো বুকে বিঁধতে থাকে শৌভিকের। আর শুনতে না পেরে ফারাহকে বুকের সাথে চেপে ধরে অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“আমি তোমার আগের মানুষটাই আছি ফারাহ জান। বিশ্বাস করো। আমি বদলাইনি। একটুও বদলাইনি। আমাকে একটু এক্সপ্লেইন করতে দাও।”

ফারাহ নিজেকে শক্তি দিয়ে ছাড়ায়। হাঁটুতে মুখ গুঁজে অন্যদিকে ফিরে। কঠোর গলায় বলে,
“চলে যান। কিছু শুনব না আমি।”

শৌভিক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আজ আমাকে নিয়ে একটা এআই ক্রিয়েট ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে আমাকে একটা মেয়ের সাথে বাজে আচরণ করতে দেখা যায়। পুরো ভিডিওটা দেখে একদম সত্যি মনে হচ্ছিল। ঘটনাটা কে ঘটাল সেসব খুঁজতে, ভিডিও ডিলেট করতে খুব ব্যস্ত ছিলাম। ভিডিওতে আসল আমি নয় জানা সত্ত্বেও অস্বস্তি বোধ কাজ করছিল। হয়ত তুমি অনলাইনে ছিলে না সারাদিন তাই ভিডিও দেখতে পাওনি। কিন্তু বিষয়টা তুমি জানলে আমার আরো খারাপ লাগত। তাই এতকিছু সমাধান করতে গিয়ে আমি পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম আমি যেন তোমার অস্বস্তির কারণ না হয়ে দাঁড়াই। আর মুহূর্তে তোমার এত কল পেয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি।”

ফারাহ নিস্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শোনে। টনক নড়ে তার৷ ফিরে শৌভিকের দিকে তাকায়। শৌভিক ফারাহকে কাছে টানলে আর তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে না ফারাহ। শৌভিক থেমে থেমে বলে,
“আমি তোমাকে দূরে ঠেলে দেইনি। কখনোই না। আমি তোমার হাতে হাত রেখে একসাথে জীবনটা পার করতে চাই। তুমি ছাড়া আমার পৃথিবীটা ফিকে।”

ফারাহ মাথা নুইয়ে বলল,
“যে এসব কাণ্ড করেছে আপনাকে নিয়ে সে ধরা পড়েছে?”

“হুমম। ভিডিওগুলো অলরেডি ডিলেট হয়ে গেছে।”

ফারাহ আবার চুপ থাকে। শৌভিক তাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আমার দ্বারা আর কখনো এমন হবে না। তুমি এই আতঙ্কে আছো আমি জানতাম না। আমাদের সম্পর্ক কখনো রঙ হারাবে না। তোমার আশা আর কখনো ভাঙব না। আই প্রমিস।”

ফারাহ এবার শৌভিককে সাড়া দেয়। শৌভিকের পিঠে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমিও স্যরি। আপনার পরিস্থিতি আমি না বুঝেই আমি বাজে রিয়্যাক্ট করেছি। আমারও আপনাকে বোঝা উচিত। আই প্রমিস আমিও এবার থেকে আপনাকে বুঝতে চেষ্টা করব।”

শৌভিক ফারাহর মাথায় চুমু খায় আলতো করে। ফারাহ তৎক্ষনাৎ সরে গিয়ে সন্দেহান হয়ে জানতে চায়,
“আপনি ফ্ল্যাটে ঢুকলেন কী করে?”

শৌভিক হেসে বলল,
“তোমার বোধহয় নেই ফ্ল্যাটের আরেকটা চাবি তুমি আমায় দিয়েছিলে।”

ফারাহর এবার মনে পড়ে। ফের মুখ ফুলিয়ে বলে,
“আমার এখন খিদে পেয়েছে। রাতে কিছু খাইনি।”

শৌভিক স্মিত হেসে বলে,
“তা তো আমিও খাইনি ম্যাডাম। চলেন দেখি বাহিরে ঘুরে ঘুরে কী খাওয়া যায়!”

গোল গোল চোখে তাকায় ফারাহ। হতবিহ্বল হয়ে বলে,
“কোথায় যাব?”

“কেন? লং ড্রাইভে যাওয়ার প্ল্যান ছিল যে আমাদের।”

“এই রাতে?”

শৌভিক উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা ফারাহকে কোলে তুলে বলে,
“কেন? রাতেই তো ভালো। এই রাত তোমার আমার!”

ফারাহ শব্দ করে হেসে উঠে শৌভিকের কাঁধ চেপে ধরে। শৌভিক ফারাহকে বিছানায় বসিয়ে চুড়িগুলো তুলে তার হাতে একে একে পরিয়ে দেয়। তার এলোমেলো চুল ঠিক করে দিয়ে দুজনেই বের হয় ফ্ল্যাট থেকে। শৌভিক নিজের গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসায় ফারাহকে। ফারাহর গাল টিপে বলে,
“চলুন হারিয়ে যাই!”

ফারাহ সম্মতি জানায়। এই মুহূর্তে যেন তার চেয়ে খুশি আর কেউ নেই!

মোহ আর স্বচ্ছ আরো একদিন গ্রামে থেকে রাবেয়া বেগমকে বিদায় দিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। এরপর কাটে আরো তিনদিন। আজ থেকে অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বচ্ছ। সেটাও শুধু মোহের কথা রাখতে। তবে খুব দ্রুত সে নিজের বন্ধুর সাথে নিজের ব্যবসা শুরু করবে। তার জন্যও হাতে টাকা থাকা প্রয়োজন। স্বচ্ছ অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। মোহ একাই রুমে ছিল। ঘরটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছিল সে। দরজার কাছে কড়া নাড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে সৌমিত্রকে দেখে মোহ। খানিকটা অবাক হয় সে। সৌমিত্র সচরাচর এই ঘরে আসেনা। সৌমিত্র খানিকটা উত্তেজিত হয়ে সরাসরি বলে,
“ভাবি, আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

মোহ সৌমিত্রের কণ্ঠে অস্থিরতার উপস্থিতি টের পেয়ে বলে,
“কিছু হয়েছে?”

সৌমিত্র ঘরে ঢুকে বলল,
“আপনার বান্ধবী তানিয়ার সাথে আপনার কথা হয়েছে? আসলে তিন দিন ধরে সে ফোন বন্ধ রেখেছে।”

মোহের স্মরণে আসে গতকাল সেও তানিয়াকে কল করে পায়নি। সে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ। আমিও গতকাল সন্ধ্যায় ওকে কল করেছিলাম। ফোন বন্ধ। তাই ভাবছিলাম আজ ওর বাড়িতে যাব।”

“তার সঙ্গে লাস্টবার যখন দেখা হয় তখন বলেছিল তার বাবা আর ভাই দেশে আসছে। উনারা একটু কঠোর হওয়ায় হয়ত ঠিক করে যোগাযোগ করতে পারবে না। কিন্তু ভাবিনি যে একবারে ফোন বন্ধ করে রাখবে।”

মোহের চিন্তা হলেও সেটা এড়িয়ে মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলে,
“চিন্তার কোনো কারণ নেই। ও এমনই পাগল। আর বাবা ভাইকে একটু ভয় পায়। আমি যাব ওর বাড়িতে বিকালে। আমি খোঁজখবর নিয়ে আসব।”

সৌমিত্র খানিকটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়। মোহকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের ঘরে যায়।

বিকাল হতেই তানিয়ার বাড়ির দিকে রওনা হয় মোহ। সে আজ একা রয়েছে। ইচ্ছে করেই একা বেরিয়েছে। তানিয়ার বাড়ি পৌঁছে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খোলেন তানিয়ার মা। মোহ সালাম দেয় এবং বলে,
“কেমন আছেন আন্টি?”

“হ্যাঁ, ভালো আছি। বিয়ের পর থেকে তোমায় দেখা যায়না। এসো ভেতরে।”

মোহ বসার ঘরে এসে বলে,
“সেজন্যই তো দেখা করতে চলে এলাম। শুনলাম আঙ্কেল আর ভাইয়া এসেছে দেশে। আর তানিয়া কোথায়? অনেকদিন দেখা হয়না ওর সাথে।”

তানিয়ার মায়ের মুখ গম্ভীর হলো। ভারি স্বরে বললেন,
“ও তো বাড়িতে নেই।”

“কোথাও ঘুরতে গেছে?”

তানিয়ার মায়ের উত্তর দেওয়া হলো না। তানিয়ার ভাই তাশরিফ আপেল খেতে খেতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে উঠল,
“আলহামদুলিল্লাহ, আমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।’

মোহের ধাক্কা লাগল কোথাও একটা। অবিশ্বাস্য লাগল পুরো বাক্য। মিথ্যে মনে হলো দুনিয়া। পরক্ষণেই তাশরিফ ফের বলল,
“স্যরি, মোহ তোমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। আসলে বড়ো করে অনুষ্ঠান করা হয়নি তো। ভাবলাম দেশে এসেছি যখন ভালো কাজটা সেরে ফেলি৷”

মাথা ভনভন করতে আরম্ভ করে মোহের। মস্তিষ্ক যেন পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে। কী বলবে, কী করবে সব বোধ হারিয়ে ফেলল সে। শুধু ঠাঁই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]