যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-৪৪

0
13

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৪ [দ্বিতীয় খণ্ড]

“তাশরিফ ভাই আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করছেন? মানে এটা কীভাবে সম্ভব?”

তাশরিফের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো,
“আশ্চর্য! তোমার সাথে আমি মজা করব কেন বলো তো? আমাদের সম্পর্ক তো মজা করার সম্পর্ক নয়।”

“কিন্তু তানিয়ার বিয়েটা কীভাবে হুট করে হয়ে যেতে পারে। আমরা কেউই জানলাম না। ও আমাদের কাউকে একবারও জানালো না।”

মোহের কণ্ঠে অস্থিরতা স্পষ্ট। তাশরিফ হাসে। তার হাসিটা তাচ্ছিল্যের। মোহ ধারণা করতে পারে তানিয়ার বিয়ে স্বাভাবিকভাবে দেওয়া হয়নি। নিশ্চয় এমন কিছু ঘটানো হয়েছে যাতে সে বাধ্য হয়। তাশরিফ হুট করে শক্ত কণ্ঠে বলল,
“কেন মোহ? তুমি জানলে বিয়েটা আটকানোর চেষ্টা করতে? না জানানোর জন্য সবকিছু বিফলে গেল?”

মোহের ভ্রু কুঁচকে আসে। গলা উঁচু করে বলে ওঠে,
“মানে?”

“আমি দেশের বাহিরে আছি বলে কিছু জানিনা এসব মনে করো না। সব জানি আমি। তুমি তো একজন ক্রিমিনাল, অমানুষের ছেলেকে বিয়ে করেছই। আমার বোনকেও সেদিকে ঠেলে দিচ্ছিলে? এত সাহস কী করে হয় তোমার?”

মোহের সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে এবার। কঠোর গলায় প্রতিবাদ করে বলে,
“সাবধানে কথা বলবেন। জন্ম থেকে কেউ ক্রিমিনাল হয়না। মানুষ অপরাধী হয় কেউ লোভে, কেউ প্রতিশোধের তাড়নায় আবার কেউ ইগো বজায় রাখতে। যেমনটা আপনি। এক্ষেত্রে আপনিও ক্রিমিনাল। তানিয়াকে জোর করে বিয়ে দিয়েছেন তাই তো? এমন কোনো মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছেন যেন সে বাধ্য হয়। নয়ত তার ফোন কেন বন্ধ? তার সঙ্গে যোগাযোগ কেন করা যাচ্ছে না?”

তাশরিফ স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যুত্তর করল,
“ও যোগাযোগ করবে কী করে? ওর ফোন আমার কাছেই রয়ে গেছে। বিয়ের পরেও সে ফোনটা পায়নি। আমি চাইনি অতীতের কোনোকিছু নতুন জীবনে ওর সঙ্গে যাক। তাই ফোনটা রেখে দিয়েছি। আর একটা কথা, তানিয়া আমার বোন। ওর বাবা মানে আমার বাবা আর ওর ভাই মিলে ওর জন্য ভালো কিছুই ভেবে রেখেছে। আমি ওর ভাই হয়ে জীবন থাকতে কখনো ওই লাফাঙ্গা ছেলের সাথে বিয়ে দেব না। আর ওই সরোয়ারের বাড়িতে তো নয়ই। আর তোমাকে একটা উপদেশ দিই। বিয়ে যখন করেছ তখন নিজের জীবন গুছিয়ে নাও। আর আমার বোনের জীবনে নাক গলাতে যেও না। ওকেও ভালো থাকতে দাও।”

“ওর ভালো থাকা নষ্ট করে দিয়ে আপনি আমাকে বলছেন ওকে যেন ভালো থাকতে দিই?”

তাশরিফ এবার ভীষণ বিরক্ত হলো। মোহের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে সে গটগট করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। মোহ তানিয়ার মায়ের দিকে ফিরে তাকায়। আহত কণ্ঠে বলল,
“আন্টি, আমি সবার কথা বাদ দিলাম। আপনি সবসময় তানিয়ার কাছে থেকেছেন। আপনার কী মনে হয় ওর মনে কেউ একজন ছিল তাকে সরিয়ে সে ভালো করে সংসার করতে পারবে? কেন এত হটকারিতা করলেন? ওর মনের কথা একবার বোঝার চেষ্টা করতেন।”

তানিয়ার মা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। গাম্ভীর্যের সাথে বললেন,
“ওর কয়েকদিনের প্রেমের জন্য বাড়ির মান সম্মান মিশিয়ে দিতাম? ওর মনের কথা মানলে সবাইকে কী করে বলতাম ওই ছেলের বাবার পরিচয়? আর ওই ছেলের তো কোনো ভবিষ্যতই নাই। আমার তাশরিফ এমনি এমনি এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। ওই সৌমিত্র নামের ছেলের ব্যাপারে সব জেনেছে। কোন মা চায় নিজের মেয়ের জীবন অন্ধকারে ঠেলে দিবে? সবার সিদ্ধান্ত তো একরকম হবে না তাইনা?”

মোহ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। নিরাশ হয়ে বলল,
“জানি আপনি আমার মা-বাবার দিকে ইঙ্গিত করলেন আপনার শেষ কথাতে। তাই আপনাকে জানিয়ে রাখি আমার মা-বাবা আজকালকার তথাকথিত মা-বাবার থেকে অনেক আলাদা। আমার মা-বাবা সমাজের নিষ্ঠুর নিয়মের ছায়াও মারে না। তাদের কাছে তাদের সন্তানের অনুভূতি, সুখ, শান্তি সবচেয়ে দামি। তারা সহজেই ক্রিমিনালের ছেলে ট্যাগ লাগিয়ে সেই মানুষটার চরিত্র, গুণগুলোকে আড়াল করে না। তারা আপনাদের মতো জাহিল নয়।”

এমন কথা শুনে ক্রোধে চোখ লাল হলো তানিয়ার মায়ের। কড়া কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“মোহ, খবরদার! এত সাহস দেখাবে না।”

“সাহস আর দেখাতে পারলাম কই? যেই সুখে মেয়েটাকে দেখবেন বলে এভাবে নিজেদের থেকে পাষাণের মতো দূরে ঠেলে দিলেন সে আদেও সুখ-শান্তি পাবে তো? ভেবে দেখবেন।”

মোহের আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করল সেই বাড়িতে থাকতে। অসহ্য রকম রাগ উঠল তার। হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো সে। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই সৌমিত্রের মুখটা ভেসে উঠল তার লোচন দুটোর সামনে। কী করে সৌমিত্রের সামনে দাঁড়াবে? কী জবাব দেবে? সেই জবাবের পরিণতি কী হবে? মোহ আর কিছু ভাবতে পারল না। কোনোমতে সিএনজিতে উঠে পড়ল। মাথা নিচু করে সে চোখমুখ ঢেকে বসে রইল। খানিকক্ষণ পর তার ফোনটা বাজতে শুনে ফোন বের করে ঘোলা দৃষ্টিতে অচেনা নম্বর দেখল সে। তবুও রিসিভ করে কানে ধরতেই কারোর কণ্ঠের চাপা কান্নার স্বর পাওয়া গেল।
“মোহ! সব শেষ হয়ে গেল।”

ফোনের ওপরপাশের মানুষটাকে চিনতে পেরে কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল মোহের। ঢক গিলে বলল,
“তানিয়া? কেমন আছিস?”

“শ্বশুরবাড়িতে নতুন বউ যেমন থাকে। সারাদিন সেজেগুজে কাগজে-কলমে রেজিস্ট্রি করা স্বামীর সাথে বসে থেকে সবাইকে সালাম দিচ্ছি। সবাই ভিড় করছে নতুন বউ দেখতে।”

মোহ বাকহারা হয়ে বসে রইল। অনেকক্ষণ পর বলল,
“আই এম স্যরি তানিয়া।”

“তুই কেন স্যরি বলছিস?”

“কিছু করতে পারিনি তোর জন্য। বুঝতেও পারি নি তোর সাথে এমন হয়ে যাবে।”

তানিয়া কান্নার মাঝেই হেসে যেন নিজের প্রতিই উপহাস জানাল। বলল,
“আমি তো নিজেই বুঝিনি। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই সব ধ্বংস হয়ে গেল। আমার স্বপ্ন আর যত্ন দিয়ে গড়ে তোলা জগৎ আমার বাবা আর ভাইয়ের সো কলড সম্মানের সামনে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল।”

“তুই কেন ভড়কে গেলি তোর ভাইয়ের হুমকিধামকির সামনে বল তো? একটু সাহস রাখতে পারতি।”

তানিয়া চোখের পানি মুছে নিতেই আরো অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বলল,
“অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু নিজের পরিবার যদি ম’রে যাওয়ার হুমকি দেয় তাহলে কী করতি তুই আমার জায়গায় থাকলে? সেদিন বাবা আর ভাই ফিরল দেশে। আমি কত খুশি ছিলাম! প্রথমে সব স্বাভাবিক লাগছিল। আমার ভাই যে কিনা আমার কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেনি। সে আমার সাথে এমন করল। সন্ধ্যা অবধি সব স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ বাবা আমার বিয়ের কথা তুলল। আমি বাবা সহ সবাইকে স্পষ্ট জানালাম আমি আরো কয়দিন পরে বিয়ে করতে চাই। তখনি ভাইয়া আমায় চেপে ধরল। বলল, আমি যতই অপেক্ষা করি তারা আমাকে সৌমিত্রের হাতে তুলে দেবে না। খুব ঠাণ্ডা মাথায় হুমকি দিলো আমি যেন তাকে ভুলে যাই। আমি চমকে গেছিলাম এই ভেবে যে তারা কীভাবে সৌমিত্রের কথা জানল। পরে জানতে পারলাম ভাইয়ার কিছু বন্ধু আমার আর সৌমিত্রের ছবি তুলেছিল। এরপর তার বন্ধুরা সৌমিত্রের বিষয়ে খবর নেয়। মূলত একারণে তারা দেশে তাড়াতাড়ি ফিরেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সম্মান আমি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার আগেই যেন তারা আমায় বিয়ে দিয়ে দিতে পারে।”

মোহ বড়ো নিশ্বাস নেয়। এসব কথা যেন তারই মনের আনচান বাড়িয়ে তুলছে। অতঃপর বলে,
“তারপর?”

“তারপর আর কী! আমি সব স্বীকার করি তাদের সামনে। বাবার পায়ে পড়ে গেছিলাম।”

তানিয়া সবটা বলতে থাকে মোহকে।

চারদিন আগে…

সোফায় ভারাক্রান্ত মুখে বসে ছিলেন তানিয়ার বাবা। মেয়ের প্রতি ভীষণ হতাশ তিনি। তানিয়া হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে উনার সামনে বসল। চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে বলল,
“বাবা, আমি জানি তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ আমার জন্য। কিন্তু বিশ্বাস করো ওই ছেলেটা খারাপ নয়। একটা বার তার সাথে কথা বললে তোমাদের সব ভুল ধারণা ভেঙে যাবে।”

তানিয়ার বাবা তানিয়ার মুখের দিকে তাকালেনই না। কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলেন,
“তুমি আমার বিশ্বাসের মান রাখো নি। তোমায় নিয়ে আমার যা গর্ব ছিল সেই গর্ব তুমি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছ। তুমি কি জানো তোমার আচরণের ব্যাপারে আমি যেদিন জানতে পেরেছি সেদিন থেকে কতটা কষ্ট নিয়ে আছি?”

তানিয়ার মাথা নত হয়। ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
“আমি দুঃখিত বাবা। কিন্তু ওই ছেলেটার দোষ নেই। সে অনেক ভালো। আর আমি এমন কোনো কাজ করিনি যাতে তোমার মাথা নত হয়। আমি নিজের সীমানায় থেকেছি সবসময়। একটু বিশ্বাস করো বাবা।”

তাশরিফ ক্ষেপে গিয়ে কথার মাঝে বলে,
“আমাদেরও তো কোনো দোষ নেই। তাহলে কেন শুধু শুধু আমাদের মান-সম্মান নিয়ে খেলছিস? ওই ছেলেটার কী আছে? ওর হাতে তোকে দিয়ে আমরা বাইরে মুখ দেখাব কীভাবে? বল?”

তানিয়া কিছু বলার আগেই তানিয়ার বাবা বললেন,
“জীবন অনেক বড়ো। সেই জীবনের পথে চলতে এসব আলতু ফালতু ছেলে নয় একজন দায়িত্বশীল পুরুষ মানুষ দরকার হয়। জেনে-বুঝে আমি তোমার জেদ রাখতে পারব না তানিয়া। তোমার জন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছি আমি। মিরাজ ইংল্যান্ডেই থাকে। তাশরিফের সঙ্গে সেখানেই পড়াশোনা শেষ করে খুব ভালো মানের চাকরি করছে। তোমাকে ছবিতে পছন্দও করেছে। সেও দেশে ফিরেছে আমাদেরই সাথে। তার পরিবারও আগ্রহ দেখিয়েছে তোমার প্রতি। যদি তুমি আমার সম্মান বজায় রাখতে চাও তাহলে পুরোনো আবেগ ভুলে নতুন করে জীবন সাজাও। আমি তোমায় আরেকটা সুযোগ দিলাম। যদি আমার সম্মানের পরোয়া না করো তাহলে তোমার মুখ আমাকে কখনো দেখাবে না।”

তানিয়ার জবান বন্ধ হয়ে যায়৷ তার বুকে জমে থাকা যাতনার পরোয়া কেউ করে না৷ তাই সে অভিযোগ করা ছেড়ে দেয়। কিন্তু তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর একেকটা ফোঁটা তার অনুভূতিকে দুদিনের আবেগ বলায় প্রতিবাদ জানায়। সেটাও কারো চোখে পড়ে না। তাশরিফ তার বাবার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“ও বিয়ের জন্য রাজি হবে বাবা। আমি রাজি করানোর জন্য আছি। জীবন থাকতে ওরে ওই ছেলের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক রাখতে দেব না।”

একটু থেমে তাশরিফ তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ঘরে যা। অযথা কান্নাকাটি করা বন্ধ কর। কাল মিরাজকে বলব আসতে পরিবার সহ। তার ছুটি এখন বেশি নেই। হয়ত তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে নিতে চাইবে। তার জন্য তৈরি থাকতে হবে তোকে।”

উঠে দাঁড়ানোর শক্তিও পায়না তানিয়া। তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে ফেলে দিচ্ছে কেউ। তাশরিফ তার হাত ধরে জোর করে টেনে তোলে। তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায়। তানিয়ার বোবা মুখে কথা ফোটে। অস্ফুটস্বরে বলে,
“এমনটা হলে আমি মরে যাব।”

তাশরিফের নজরে আসে তানিয়ার ফোনটা। বিছানার উপর থেকে ছো মে/রে ফোনটা নিজের কবলে নিয়ে নির্দয়ের ন্যায় বলে ওঠে,
“দরকার হলে মরেই যা। তবুও আমি আর বাবা আমাদের সিদ্ধান্ত নড়চড় হবে না। যদি তুই বিয়েটা না করিস তাহলে বাবা মরে যাবে। তোর কীর্তি জেনে বাবাকে কত বার ডাক্তার দেখাতে হয়েছে জানিস? আমাদের খুন করে তুই ভালো থাকতে পারবি তোর ওই প্রেমিকের সাথে?”

তানিয়া ভেবেছিল তার ম/রে যাওয়ার কথা শুনে একটু হলেও তার ভাইয়ের মনে নাড়া দিবে। কিন্তু ভাইয়ের এমন আচরণে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল সে। ফোনটা নিতে দেখে সে এবার উদ্ভ্রান্তের মতো বলল,
“ফোনটা কেন নিলে? অন্তত ফোনটা নিও না প্লিজ। আমার ফোন আমায় দাও।”

অজস্র মিনতি সত্ত্বেও অনড় রইল তাশরিফ। ফোনটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
“নারীদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা, অতি আদর তাদেরকে নষ্ট করে দেয়। তার উদাহরণ তুই। সারারাত ভাবতে থাক কী করবি! রাত শেষে একটা বাধ্য মেয়ের মতো রাজি হলেই তোর জন্য ভালো। নয়ত খুব খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলব আমি।”

তাশরিফ ঘর থেকে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে ঘরের দরজাও ওপাশ থেকে আটকে ফেলল। চকিতে তাকায় তানিয়া। দৌড়ে গিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে কেঁদে সেখানে বসে পড়ল সে। তাকে এভাবে বন্দি করা হবে সেটা যেন কল্পনাতীত ছিল। সারারাত তার কেটে গেল অনিদ্রায়। অন্তরে বেড়ে ওঠা অনিশ্চয়তায় সে ডুবে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে ভোরের আলো দেখল তানিয়া। কিন্তু সেই আলো দিয়ে কী লাভ? তার অন্ধকার তো নিভিয়ে দিতে পারছে না! বেডের সাথে মাথা লাগিয়ে ফ্লোরেই চোখ দুটো বুঁজে বসে থাকে সে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ আসে কর্ণকুহরে। চোখ মেলে তাকিয়ে মাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তানিয়ার মা মেয়ের পাশে বসে গালে হাত রেখে তার লাল চোখজোড়া দেখে বলেন,
“সারারাত ঘুমাস নি?”

“আমার ঘুম তোমরা কেঁড়ে নিয়েছ। কেন এমন করছ? আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমাকে একটু সময় দাও না! তোমরা যাকে লাফাঙ্গা বলছ সে অনেক বদলে গেছে। নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সে নিজেকে তোমাদের চাহিদা মতো সাজাতে চাইছে। একটু সময় দাও না মা! তোমার কাছে তো আমি সময় চেয়েছিলাম।”

তানিয়ার মা জোর গলায় জবাব দিলেন,
“আমি তো আর জানতাম না তুই এসব করার জন্য সময় চাইছিস। জেদ যত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবি ততই ভালো। তোর বাবা আর ভাইকে তুই চিনিস। আর সবচেয়ে বড়ো কথা মিরাজ নামের ছেলেটা সম্পর্কে জেনে আমার ভালো লেগেছে। তুইও সুখী হবি আমার বিশ্বাস।”

তানিয়া ক্ষোভে ফেটে পড়ল। মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে গেল। মাও তাকে বুঝছে না ভেবেই আরো বিষাক্ত হয়ে উঠলো তার মন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমার সুখ শব্দ একজনের সাথে জুড়ে ছিল। সে আমার জীবনে না থাকলে কোনো সুখ আর আসবে না। কখনো আসবে না।”

তানিয়ার মা নিজেকে ধাতস্থ করলেন। মেয়েকে মোলায়েম কণ্ঠে বোঝাতে গেলেন।
“মেয়ে হয়ে জন্মেছিস। তোর ভালো তোর মা-বাবা আর ভাই বুঝবে। আবেগে ভেসে নিজের জীবন নির্ধারণ করতে যাস না। ওই ছেলে তোকে বিয়ে করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের কথা শোন।”

তানিয়া অন্যদিক ঘুরে গেল। উঁচু স্বরে বলল,
“আমাকে কেউ জোর করবে না বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু আমি মরে যাব।”

“না, তুই বরং আমাদের মে/রে দে। সেটাই ভালো হবে। তোর বাবা রাতে ঘুমাতে অবধি পারছে না। প্রেশার এতটা বেড়েছে যে সবসময় হাঁসফাঁস করছে। তোর বাবার যদি কিছু হয়ে যায় খুব খুশি হবি?”

তড়িৎ গতিতে মায়ের দিকে ফিরে তাকায় তানিয়া৷ ডুকরে কেঁদে উঠে বলে,
“মা! এসব বলো না। দয়া করো আমাকে।”

তানিয়ার মা তানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তানিয়া নীরবে কাঁদতে থাকল। এর মধ্যে তাশরিফ ফের ঘরে প্রবেশ করল। তাচ্ছিল্যের কণ্ঠে বলে উঠল,
“তোর আবেগ এখনো শেষ হয়নি? এখনো ওই ছেলের জন্য ঘরের শান্তি হারাম করছিস?”

তানিয়া নিরুত্তর থাকে। তার সকল অনুভূতি সে জাহির করতে করতে ক্লান্ত। তানিয়ার মা শান্ত গলায় ছেলেকে বোঝালেন,
“ওকে একটু সময় দে তাশরিফ। ধীরে ধীরে সে সব বুঝবে।”

তাশরিফ মায়ের কথা কানে না নিয়ে নিজের প্রখর জেদ নিয়ে বলল,
“কিন্তু এত সময় কোথায় আমাদের হাতে? এমন পরিস্থিতি তোমার মেয়ে করে তুলেছে যে একটু সুন্দর করে বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করব সেটাতেও সংশয় হচ্ছে। নিজের মান মর্যাদা ডুবিয়ে তো ফেলেছে আর যদি বেশি সময় দিই নিজের মানও থাকবে না।”

তানিয়া হুট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করল ভাইয়ের দিকে কথাটা শুনে। বিরস মুখে বলল,
“মান নাকি ইগো? তুমি নিজের সম্মানের কথা ভাবছ না আর না তোমার বোনের কথা ভাবছ। তুমি যেটা নিয়ে ভাবছ সেটা তোমার প্রিয় ইগো। নিজের ইগো ধরে থাকতে কারোর পরোয়া করো না তুমি।”

‎তাশরিফ দায়সারাভাবে উত্তর করল,
‎”তোর যা ইচ্ছা তুই ভাবতে পারিস। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখিস। যদি তুই ওই ছেলের মাধ্যমে বাবার আর এই পরিবারের মান খারাপ হয় বা মানুষ আঙ্গুল তোলার সাহস পায় তাহলে কিন্তু ওই ছেলেটারও ভালো হবে না।”

‎তানিয়ার হৃদয়ে নাড়া দিলো তার ভাইয়ের বলা শেষ কথাটি। মোমবাতির আগুনের ন্যায় ধপ করে নিভে গেল সে। কিয়ৎক্ষণ মাথা নত করে রইল। নিজের অশ্রু চেপে রেখে কোনোরকমে বলল,
‎”আমি শুধু একটু সময় চাই ভাইয়া। একটু বোঝো আমায় তোমরা। আমি ভালো থাকব না। এই সিদ্ধান্তে কারোর ভালো হবে না। সৌমিত্র নামক মানুষটাকে নিজেকে প্রমাণ করার একটু সুযোগ দাও। তাকে তার বাবার চরিত্র দিয়ে মাপতে যেও না। আমি কথা দিচ্ছি, সে যদি নিজেকে তোমাদের মনের মতো প্রমাণ করতে না পারে তাহলে আমি নিজে তাকে প্রত্যাখান করব।”

‎তাশরিফ হাফ ছেড়ে বলল,
‎”এসব আবেগের কথাতে শুধু সময় নষ্ট। তুই এখন তোর ভাইকে বিশ্বাস করতে পারছিস না ওই ছেলের পাল্লায় পড়ে? আমি তোর ক্ষতি চাইব নাকি বাবা তোর ক্ষতি চাইবে? শেষ বারের জন্য বলছি বিয়েটা করে নে। দেখবি অনেক ভালো থাকবি।”

‎কাউকে বোঝাতে না পেরে নিজেকে পাগল বোধ হলো তানিয়ার। বারবার বিয়েটা মেনে নেওয়ার কথা শুনে অসহ্য হয়ে তেজ নিয়ে বলল,
‎”আমি মরে যাব তাও অন্য কাউকে বিয়ে করব না। কাউকে না।”

‎বরাবরের মতো যেকোনো বিষয়ে অধৈর্য ও অশান্ত তাশরিফ বারবার বোনের মুখে একই কথা শুনে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়। চোয়াল শক্ত করে প্রথমে মনে করে যে মেয়েটার গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই উন্মাদের মতো হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। কয়েক সেকেন্ড পরেই ফিরে এলো তানিয়ার কাছে। তাশরিফের হাতে একটা ধারালো ছুরি দেখে পিলে চমকে গেল তার। তাশরিফ কোনোকিছুর পরোয়া না করে সেটা নিজের গলার একবারে নিকটে ধরে তানিয়ার পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলল,
‎”তোকে মরতে হবে না। আমি মরে যাই। তাহলেই তোর ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।”

‎নিজের সমস্ত জোর হারিয়ে ফেলল তানিয়া। সমগ্র দুনিয়া উল্টে গেল তার। গগনবিদারী চিৎকার দিলো সে।
‎”ভাইয়া, এমন করো না। দয়া করে ছুরি সরাও।”

‎তানিয়ার এমন চিৎকারে তার বাবা-মাও ছুটে এলেন। ছেলের এমন কাণ্ড দেখে উনাদের চোখও কপালে উঠে গেল। তাদের মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তাশরিফ কঠিন স্বরে জানাল,
‎”না, না। আমি এত অসম্মান নিয়ে মাথা তুলে তো বাঁচতে পারব না। লোকে বলবে ওই দেখো বোনকে একটা অপরাধীর ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। সবাই হাসবে। আমি মেনে নিতে পারব না।”

ভয়ে কাঁপুনি ওঠে তানিয়ার। তানিয়ার মা বারবার ছেলেকে গলার কাছ থেকে ছুরি সরাতে বলেন। কিন্তু সেটা তাশরিফ কানেই তোলে না। তানিয়া মিনতি করে বলে ওঠে,
“সৌমিত্র ভালো ছেলে ভাইয়া। অনেক ভালো সে। তাকে ভুল বুঝো না। আমি যে তাকে কথা দিয়েছি তার জন্য অপেক্ষা করব। আমাকে দিয়ে এই কথার ভঙ্গ করিও না ভাইয়া প্লিজ!”

তাশরিফের জেদ ভর্তি মস্তিষ্কে তানিয়ার কোনো অসহায় বানী তার মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছায় নি। উল্টো সে আরো ক্ষেপে যায়। তার বাবা আদেশ করা সত্ত্বেও আরো নিকটে গলার চামড়া ঘেঁষে ছুরি ধরে সে। তাশরিফ গর্জন করে বলল,
“তুই আমার কথা মানবি না তাই তো? আমার দাম কোনো দাম নেই তোর কাছে? আমি মরলেও তুই নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবি?”

তানিয়ার মা তানিয়ার দিকে অসহায় পানে চেয়ে কান্নারত অবস্থায় অনুরোধ করলেন,
“তোর ভাইকে তুই জানিস। আমার ছেলেটার কিছু হতে দিস না। ওর কিছু হয়ে যাবে রে!”

ভাইয়ের গলার চামড়া কেটে সামান্য রক্তের লাল আভা দেখে আর মায়ের কথা শুনে চোখ খিঁচে বন্ধ করল তানিয়া। শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। নেতিয়ে পড়ল ফ্লোরে। মাথার দুপাশের চুল শক্ত করে চেপে ধরে গলা বের করে কোনোরকমে বলল,
“ভাইয়া তুমি থেমে যাও। তুমি যা বলবে আমি তাই করব। তুমি নিজের কোনো ক্ষতি করো না। দোহাই লাগে ভাইয়া। আমি বিয়েও করব তুমি যাকে বলবে তাকেই করব।”

তানিয়ার জবানবন্দি শুনে স্বস্তি পায় তাশরিফ। তার উন্মাদনা কমে আসে। হাতের ছুরি আলগা করতেই তার বাবা দ্রুত ছুরি টেনে নিয়ে ফেলে দিলেন। তাশরিফকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
“পাগল হয়ে গেছো তুমি তাশরিফ? এসব কেমন আচরণ?”

তাশরিফ কিছু বলল না। শুধু ক্লান্ত মুখে সামান্য বিজয়ের হাসি দিলো। সে নিশ্চিত তার বোনকে সে যেখানে বিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে শুধু সেখানেই ভালো থাকবে। মা-বাবা দুজনেই ছেলের গলায় কাটা অংশ দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কেউ তাকায়নি সেদিন তানিয়ার দিকে। একবারও জানতে চায়নি তার মনের অবসাদ। কেউ বুঝতে চায়নি সকলের জেদের স্তরে চাপা পড়ে যাওয়া সেই নির্মল অনুভূতি। সে শুধু নির্জীব হয়ে পড়ে ছিল ঘরের এক কোণায়। বুঝে গিয়েছিল এই হয়ত জীবনের প্রতীক্ষার অধ্যায় অসমাপ্তই রইল।

শেষ অবধিও তানিয়া আশা ধরে রেখেছিল। বিকেলে তানিয়াকে দেখতে আসে মিরাজ নামক যুবকটির পরিবার। মিরাজও আসে। তানিয়া খুব করে চায় মিরাজের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে। তাকেই বিয়েটা নাকচ করে দিতে চায়। কিন্তু তানিয়ার বাবা সেটা হতে দিলেন না। সবাইকে জানিয়ে দিলেন বাবা যেটা চায় মেয়েও সেটাই চায়। বাবার পছন্দই মেয়ের পছন্দ। সবাই মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো। মিরাজের ছুটি মোটেই পনেরো দিনের। যদিও এরপর আরো দুই মাসের ছুটি পাবে সে। কিন্তু আগে ইংল্যান্ড ফিরতে হবে। মিরাজের পরিবার চাইল যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে সম্পন্ন করতে। বন্ধুর বোনের সঙ্গে সম্বন্ধ হওয়াতে মিরাজও বেশ বিশ্বস্ত হলো তানিয়ার প্রতি। তাই বিয়ে ঠিক হয়েই গেল পরেরদিন বিকালের দিকে। তানিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তার ভাবনার আগে সবকিছুর সমাপ্ত ঘটে যাবে সেটা ভাবতেও পারেনি। কোনোকিছুতেই আর পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি সে। ভাই ম/রার ভয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। বাবার অসুস্থতার জন্য তাকে দায়ী করা হয়েছে। খুব চেষ্টা করেছে সৌমিত্র অথবা মোহকে একটা খবর দেওয়ার। কিন্তু ফোনও ছিল না তার কাছে। ঘরের বাহিরেও বের হতে দেওয়া হয়নি তাকে। পরিবারের মানুষগুলোকে মাত্র একদিনে অন্য রূপে চিনে ফেলেছিল তানিয়া। যেই রূপ সে কস্মিনকালেও দেখেনি। শুধু হতবিহ্বল হয়েছিল। চোখের জলরাশি বেয়ে চিবুক অবধি পৌঁছাচ্ছিল। কিন্তু কেউ তার যাতনার পরোয়া করেনি। সবাই দেখেছে সমাজ, সমাজের দেওয়া সম্মান।

সবশেষে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে দেয় তানিয়া। তার জন্য কেনা হয়েছিল মেরুন আর গোলাপি রঙের শাড়ি। বরপক্ষ থেকে এসেছিল সবকিছু। তানিয়ার মা মেয়েকে গোলাপি রঙের শাড়ি পরিয়ে দিতে চাইলেন বিয়ের আসরের জন্য। তৎক্ষনাৎ সেটা বর্জন করে সে। হুংকার দিয়ে জানায়,
“গোলাপি শাড়ি আমি পরব না। কোনোদিনই গোলাপি রঙ আর নিজের সাথে মাখাব না।”

তানিয়া প্রতিজ্ঞা করে সেই মানুষের প্রিয় গোলাপি রঙটাকে আর নিজের নিস্ক্রিয় জীবনে জড়াবে না। যদি কোনোদিন উড়তে পারে মুক্ত পাখির মতো তবেই এই গোলাপি রং আপন করবে সে নিজের সাথে।

রেজিস্ট্রি খাতায় সই করার আগ মুহূর্ত অবধি তানিয়া চেয়েছিল কোনো আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যাক। বিয়ে আঁটকে যাক নয়ত সে শেষ হয়ে যাক। এক ঘোরের মাঝে নিজেকে মিরাজ নামক মানুষটির সাথে বাঁধনে আঁটকে পড়ল সে। তার ঘোর কাটে মিরাজের হাতের ছোঁয়ায়। তানিয়া হকচকিয়ে তাকায়। মিরাজ তার হাতে হাত রেখেছে। কী করে সরাবে সেই হাত? সরানোর অধিকার তো নেই তার। তানিয়া উপলব্ধি করে তার জীবনের বইয়ের খুশির পাতাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। শুঁকনো চোখেমুখে তার পরিবারের দিকে তাকায়। সবাই কতই না খুশি। তাশরিফের খুশি উপচে পড়ছে। কত প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে! দেখাবে না-ই বা কেন? তানিয়া তো তাদের মান রেখেছে।

বিদায়বেলায় বাবা-মা আর ভাইয়ের দিকে একপলকও তাকায়নি তানিয়া। তার দৃষ্টি মাটিতে আঁটকে থাকে। যেন সে এক আস্ত পুতুল! তার পরিবার ভাবে, এখন মেয়ের অভিমান হয়েছে। কয়দিন গেলে সেই মান নিশ্চয় ভাঙবে।

বর্তমান…

সবটা শুনে স্তম্ভিত মোহ! কেন পরিবার হঠাৎ এত স্বার্থপর হয়ে যায়? মোহ নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর পায়না। তানিয়ার থেমে থেমে চাপা কান্নার শব্দ মোহের কানে আসছে। মোহেরও গলা ধরে আসে। তানিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“আর বেশি সময় তোর সাথে কথা বলতে পারব না। বাড়ি ভর্তি মেহমান। আমি মাথাব্যথার নাম করে ঘরে বসে আছি। তোকে সবকিছু জানাতে ইচ্ছে করল। কারণ কেউ আমার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেনি।”

“কাঁদিস না, কাঁদিস না৷ যা হয়ে গেছে তার কোনো সমাধান নেই। তোকে কোন আশা দেখাব আমি জানি না।”

মোহের উত্তরে তানিয়া বলে ওঠে,
“আশা দেখাতে হবে না। শুধু আমার একটা উপকার কর। সৌমিত্রকে এসব জানতে দিস না। আড়াল করে রাখ। মানুষটা খুব কষ্ট করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে। সে যেন ভালো করে পরীক্ষা দেয়। আমার মতো স্বার্থপরের জন্য তার জীবন নষ্ট হতে দিস না। আমি চাই লোকটার একটা সুন্দর ক্যারিয়ার হোক। নিজের দায়িত্ব বুঝতে শিখুক। দায়িত্বশীল পুরুষ হোক।”

মোহ তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে৷ তার বুকটা ভার হয়ে গেছে। তানিয়ার কাছে জানতে চায়,
“তুই কী করে ভালো থাকবি?”

“থাকব। চেষ্টা করব। সৌমিত্রকে ঠকিয়েছি। মিরাজকেও ঠকাব? যেখানে আঁটকা পড়েছি সেখান থেকে নিস্তার তো পাবো না। মিরাজ মানুষটার দোষটাই বা কোথায়? তাই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব। আমার কোনো আচরণে যেন কষ্ট না পায় সেটা খেয়াল রাখব৷ এভাবেই জীবন চলে যাক। আমি ফোন কাটছি।”

“আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস প্লিজ!”

তানিয়া মলিন হেসে বলল,
“রাখব। অবশ্যই রাখব।”

তানিয়া ফোন কাটে। অশ্রু আর বাঁধ মানে না। চিৎকার করে নিজের মনের বোঝা হালকা করতে ইচ্ছে করে। তাও পারেনা। নিজের মুখ চেপে ধরে কাঁদে সে। বারংবার বিড়বিড়িয়ে বলে,
“আমি মানুষটাকে ঠকিয়েছি। আমি অপেক্ষা করতে পারিনি। আমি আপনার বিশ্বাস রাখতে পারিনি। আমি অযোগ্য, অভাগী।”

এলোমেলো চরণে বাড়িতে পা রাখে মোহ। তার চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। সৌমিত্রকে কী উত্তর দেবে সেটা খুঁজতে হয়রান হয় সে। বড়ো ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই সে দেখল ইথানকে সৌমিত্রের ফোন নিয়ে খেলতে। ইথানের পাশে বসে ছিল সৌমিত্র। অন্যদিন সৌমিত্র নিজেও ইথানের সাথে গেম খেলায় মজে থাকত। কিন্তু আজ তার চেহারায় চিন্তার রেশ। তাকে দেখেই ঘাবড়ে যায় মোহ। সৌমিত্র তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় উদ্ভ্রান্তের মতো মোহের দিকে ধড়ফড়িয়ে আসে।
“আপনার হৃদয়হীনা বান্ধবীটা কী করছে ভাবি বাড়িতে আমায় চিন্তায় ফেলে?”

সৌমিত্রের অস্থির দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মেলাতে পারেনা মোহ। সেই চোখে তাকিয়ে সে কী করে অন্য কথা বলবে? মোহ দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামান্য হেসে বলে,
“জামাকাপড় গোছাচ্ছে। ফুপির বাড়িতে ঘুরতে যাবে তো তাই৷ বাবা আর ভাইকে পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে গিয়েছে।”

সৌমিত্রের চেহারায় দেখা গেল স্বস্তির আভা। এতক্ষণের মনের উচাটন ঠাণ্ডা হলো। তবুও ফের ভ্রু কুঁচকে অভিমান নিয়ে বলল,
“তাই বলে আমার মতো অভাগা প্রেমিককে ভুলে যাবে? নারী এত নির্দয় হয়? ভাবি এর বিচার আপনাকে করতে হবে। আপনি দেবরের পক্ষে নাকি বান্ধবীর পক্ষে তাই বলেন।”

সৌমিত্রের এসব কথায় মোহের ভেতর পুড়তে থাকে। সৌমিত্রকে মিথ্যে বলা মুশকিল হয়ে পড়ে। নিজের কপালের ঘাম মুছে সে জানালো,
“আমি তো নিরপেক্ষ। সেও নিজের ভাই আর বাবার জন্য যোগাযোগ করছে না। তারা ভীষণ স্ট্রিক্ট। আপনার ভাবনার চেয়েও বেশি। আর আপনার পরীক্ষা তাই সে ইচ্ছে করেই আরো যোগাযোগ করবে না। পরীক্ষা আগে ভালো করে শেষ করুন। তবেই সে কথা বলবে।”

হাফ ছেড়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয় সৌমিত্র। হতাশার সহিত বলে,
“সবই কপালের দোষ ভাবি। প্রেমটা করলাম এক হৃদয়হীনার সাথে। আপনার সাথে থেকেও প্রেমিকের প্রতি করুণা করা শিখল না। বিয়ের পরেও আপনার বান্ধবী বলবে এটা ওটা না করলে ভালোবাসাই বন্ধ৷”

বুক ভার হয় মোহের। বিয়ের কথা শেষ শ্বাস রোধ হয়ে আসে তার। ছেলেটার দুচোখে কত আকাঙ্ক্ষা তার প্রণয়িনীকে নিয়ে। এতসব অভিলাষ যে কত আগেই মাটির সাথে মিশে গেছে সেটা এখনো বিন্দুমাত্র টের পায়নি সৌমিত্র। সে ফের মোহকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“বিয়েশাদির দায়িত্ব তো সব আপনারই কাঁধে ভাবি। বিয়ের পরেও নিষ্ঠুর মেয়েটাকে সংসারী করে বরকে কীভাবে যত্ন করতে হয় সেই দায়িত্বও আপনার।”

মোহ আর সহ্য করতে পারল না। গলা খাঁকারি দিয়ে কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করে সব কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“আমি ঘরে যাচ্ছি। খুব ক্লান্ত লাগছে বাহির থেকে এসে।”

সৌমিত্র সায় দেওয়ার সাথে সাথেই হন্তদন্ত করে নিজের ঘরের দিকে ছুটল মোহ। সৌমিত্র ইথানের সাথে ব্যস্ত হলো দুষ্টুমিতে। ভাবির কথায় বিশ্বস্ত হয়ে শান্ত মনে মেতে উঠল চাঞ্চল্যে।

কেটে গেল প্রায় তিন সপ্তাহ। সৌমিত্র পরীক্ষা, ভাইবা নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এই প্রথম তাকে পরীক্ষা নিয়ে এতটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে দেখল সকলে। সৌমিত্র দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়েছে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করার। আজই শেষদিন ছিল তার ভাইবার। অপরদিকে মোহ যার দিন কেটেছে দুশ্চিন্তায়। রাতে চোখের পাতা এক করতে পারেনি কয়েকদিন যাবত। ভিত নড়ে আসছে তার। মুখটা শুকিয়েছে এই কয়দিনে। স্বচ্ছের নজরে এসেছে সবই। স্বচ্ছ ভেবেছে হয়ত আবারও ঈশানীর স্মৃতি তাড়া করছে তাকে। আবারও অতীত নিয়ে মগ্ন হচ্ছে সে। স্বচ্ছ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে গরমে গোসল সেরে নিলো। ওয়াশরুম থেকে খালি গায়ে বেরিয়ে বিছানায় বসতেই ইথান দৌড়ে এসে স্বচ্ছের ভেজা চুল হাত দিয়ে দুষ্টুমি করে এলোমেলো করে দিলো। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। স্বচ্ছও তার বিপরীতে হাসি দিয়ে ইথানকে কোলে তুলে বসিয়ে ফাইজলামি তার শরীরে সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করল। হাসির ঝুড়ি খুলে বসল ইথান। বাবার থেকে ছাড়া পেতে আকুপাকু করল। অবশেষে তার গালে একটা চুমু দিয়ে ছেড়ে দিলো স্বচ্ছ। ইথান তার একটা খেলা বাস নিয়ে ভোঁ দৌড় দিলো। স্বচ্ছ হেসে ফেলল সামান্য শব্দে। মোহ ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করায় ধ্যান ভাঙে তার। মোহ ঠাণ্ডা পানির গ্লাস স্বচ্ছের সামনে ধরে তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“চুলই তো ঠিক করে মুছলেন না। মুছে নিন।”

স্বচ্ছ মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“ভালো বউরা চুল থেকে পানি পরতে দেখলে মুছতে বলে না। তারা চুল যত্ন করে মুছে দেয়।”

মোহ পানির গ্লাসটা পাশের টেবিলে রাখে। ভ্রু উঁচিয়ে তেজি স্বরে প্রশ্ন করে,
“তা আগে কয়টা বিয়ে করেছিলেন?”

“মানে এই যে আগে কয়টা বিয়ে করেছিলেন যে সেই এক্সপেরিয়েন্স থেকে ভালো বউরা কী করে সেসব কিছু জানেন?”

স্বচ্ছ মোহের হাত ধরে নিজের সন্নিকটে টানে আর বলে,
“আমি তো প্রতিদিন বিয়ে করি। স্বপ্নে একবার, কল্পনায় একবার। কন্টিনিউয়াসলি চলতে থাকে। কিন্তু বড়ো কথা হচ্ছে বিয়েতে সেই একটাই কনে থাকে। সেটা হচ্ছে মোহময়ী।”

মোহ একটি মন ভোলানো হাসি দেয়। তাতে সন্তুষ্টি হয়না স্বচ্ছ। কিছুটা ভার গলায় বলে ওঠে,
“তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”

“কী কথা?”

স্বচ্ছ বিছানায় থাকা টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে মোহের হাত ধরে বসায়। মুখে গাম্ভীর্য এনে বলে,
“তুমি আমাকে তোমার মনের সব কথা জানাও তো?”

মোহ ঢক গিলে মাথা নুইয়ে ফেলে। সে জানত স্বচ্ছের কাছে বিষয়গুলো সে এড়িয়ে চলতে পারবে না। আজ তার ধরা পড়ার পালা। সে সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি জানালো,
“আপনাকে আমি কথাগুলো কী করে জানাব বুঝতে পারছি না।”

স্বচ্ছ বড়ো শ্বাস নিয়ে মোহের পাশ ঘেঁষে তার বাহুতে নরম স্পর্শ করে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“কী বলতে চাও? বলো! তোমাকে কয়েকদিন ধরে ঠিক দেখাচ্ছে না।”

মোহ স্বচ্ছের চোখে চোখ রেখে বলে,
“বিষয়টা তানিয়াকে নিয়ে।”

একে একে স্বচ্ছকে বিস্তারিত জানিয়ে ফেলল মোহ। তানিয়ার বিয়ে, তাকে কীভাবে বিয়ে দেওয়া হলো সবটা জেনে নিজেই হতবিহ্বল হলো সে। দিশাহারা হলো নিজের ভাইয়ের কথা ভেবে। স্বচ্ছ অস্ফুটস্বরে বলল,
“সৌমিত্রের কী হবে তাহলে?”

মোহ অনুতাপের স্বরে নিচু গলায় বলে ওঠে,
“আমি দুঃখিত। আমি আপনার ভাইকে মিথ্যে আশা দিয়ে রেখেছি। সে জানে তার পরীক্ষা আজ শেষ হলেই তানিয়া তার সাথে কথা বলবে। তার বন্ধুরা তাকে জোর করে বাহিরে নিয়ে গেল কিন্তু বাড়িতে আসলেই সে পাগল হয়ে যাবে তানিয়াকে নিয়ে। আমি বুঝতে পারছি না ওকে কী জবাব দেব। ইতিমধ্যে সে আমাকে সন্দেহ করছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে তানিয়া ভালো আছে তো? আমি একবার ইডিট আর কাট করে তানিয়ার আগের ভয়েস ওকে শুনিয়েছি। অন্তত যেন তার পরীক্ষাগুলো ভালো যায়। এখন আর আমার মাথায় কিছুই আসছে না।”

স্বচ্ছ আশাহত হয়ে বলে উঠল,
“সৌমিত্রকে আমি কখনো কোনো মেয়েকে নিয়ে এতটা আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখিনি। ও আগে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করত, পরীক্ষায় ফেইল করলেও কিছুই হতো না তার। ও তানিয়াকে নিয়ে এতটা ভেবেছে যে তার জন্য নিজের জীবন নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেছে। যেই সিরিয়াসনেস আমরা এত বছর ধরে কেউ আনতে পারিনি তার মধ্যে। সে এখন নিজের চাকরি নিয়ে ভাবে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে শুধু মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য। নিজের করে ধরে রাখার জন্য। এখন যদি চরম সত্যিটা ওর সামনে আসে ও তো মরেই যাবে।”

“তাহলে এখন আমাদের কী করা উচিত?”

স্বচ্ছ মোহের পানে তাকিয়ে মলিন স্বরে বলল,
“আমাদের আর কিছু করার নেই মোহ। এতদিন তুমি সামলে নিয়েছ। এখন যা হবে সামাল দিতে হবে।”

রাত প্রায় সাড়ে আটটার কাছাকাছি। মোহ ইথানকে পড়ানো শেষ করল সবে। বাচ্চা ছেলেটা হুট করেই তার দাদিমাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছে। এখন মিসেস জেবার কাছেই ঘুমায় সে। সবসময় উনার পেছন পেছন ঘোরে ইথান। এমন অদৃশ্য টানের কারণ মোহের জানা নেই। এখন সোফায় বসে মিসেস জেবার সোয়েটার বুনতে থাকা দেখছে সে। আর কাজটা কীভাবে করে সেসব নিয়ে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করছে মিসেস জেবাকে। প্রথম প্রথম সোয়েটার বোনার সময় জিনিসটা কার জন্য বুনছেন নিজেও জানতেন না মিসেস জেবা। এখন ইথানের জন্যই বুনছেন তিনি। মোহ রাতের খাবার গরম করার জন্য রান্নাঘরে উদ্যত হলো। পরক্ষণেই থেমে গিয়ে মিসেস জেবাকে শুধালো,
“মা, রাতে কি সৌমিত্র বাড়িতেই খাবে?”

মিসেস জেবা ব্যস্ত কণ্ঠে উত্তর করলেন,
“মনে হয় না। এমনিতেই অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে গেল বাহিরে। তাও তো ওরা জোর করে নিয়ে গেছে। আজ বাড়ি ফিরবেই দেরি করে।”

“ঠিক আছে।”

মোহ রান্নাঘরে ঢুকে চুলা জ্বালায়। মিসেস জেবা নিজের কাজে নিমগ্ন হলেন। তৎক্ষনাৎ পায়ের ধুপধাপ শব্দে কাজের প্রতি মনোযোগ ছাড়া হলেন মিসেস জেবা। সৌমিত্র এলোমেলো পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। তার চোখমুখের দিকে তাকাতেই চমকালেন মিসেস জেবা। ঘেমে অস্থির হয়ে চেহারার চঞ্চল রং পাল্টে গেছে। সৌমিত্র উচ্চস্বরে ডেকে উঠল,
“ভাবি! ভাবি আপনি কোথায়?”

রান্নাঘর থেকেই হকচকিয়ে ওঠে মোহ। সৌমিত্রের কণ্ঠ শুনে অজানা সংশয়ে জেগে ওঠে মন। সৌমিত্র আতঙ্কের সহিত ডেকে ওঠে,
“ভাবি, আপনার সাথে কিছু কথা আছে। এখানে আসবেন একটু?”

মিসেস জেবা তড়িঘড়ি করে কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?”

চিৎকারে স্বচ্ছও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মোহও গুটি গুটি পায়ে সৌমিত্রের সামনে এসে দাঁড়ায়। সৌমিত্র মোহের বরাবর দাঁড়িয়ে ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বলে,
“আজকে কয়েকটা ছেলের সাথে দেখা হলো রেস্টুরেন্টে। ওরা আমার দিকে এগিয়ে আসে। পরিচয় দিলো তারা তানিয়ার ভাইয়ের বন্ধু। ওরা আমাকে কেন বলল তানিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে?”

মুখটা চুপসে গেল মোহের। উত্তরে কী বলবে তা বুঝতে না পেরে স্বচ্ছের পানে তাকায় সে। সৌমিত্র ফের অধৈর্য হয়ে জানতে চায়,
“ভাবি, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। ওরা মিথ্যে বলেছে তাই না? তানিয়া কেন ফোন রিসিভ করছে না? আমাকে বলুন প্লিজ। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। দমবন্ধ লাগছে। আমাকে সত্যিটা বলে শান্ত করুন প্লিজ।”

সৌমিত্রের কণ্ঠে আকুতি। মোহের কণ্ঠস্বর কাঁপে। সে ফের স্বচ্ছের পানে তাকায়। স্বচ্ছ তাকে ইশারা করে জানায় সে সব সামলে নেবে। স্বচ্ছ এগিয়ে এসে সৌমিত্রকে ভার স্বরে বলে,
“তানিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে সৌমিত্র। ওর বাবা আর ভাই ওর কাছে আর কোনো রাস্তা খোলা রাখেনি। এটাই সত্যি। তোকে মানতে হবে।”

সৌমিত্রের বোধ হলো তার পায়ের নিচের জমিন সরে যাচ্ছে। নিজের শরীরের ভারই আর সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল সে। সেসময় পায়ে আঘাত লাগল টেবিলের সাথে। টাল সামলাতে না পেরে পেছন দিকে পড়ে গেল সে। স্বচ্ছ আর তার মা দৌড়ে ধরতে এলেও সে পিছিয়ে যায়। সবটা অবাস্তবিক লাগছে তার। সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“কেউ ধরবে না আমাকে। কেউ না।”

সৌমিত্র তাড়াতাড়ি করে নিজের ফোন বের করল। বারবার উন্মাদের মতো কল করতে থাকল তানিয়ার নম্বরে। কেউ কল ধরল না। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ফোন একদিকে গায়ের শক্তি দিয়ে ছুড়ে মারল সে। নিজমনে আওড়ালো,
“এখনি আমি ওর বাড়িতে যাব। ও নিশ্চয় ওখানেই আছে আমি জানি।”

সৌমিত্র তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। মিসেস জেবা ছেলের কাণ্ডে বুঝে উঠতে পারলেন না কী করবেন, কীভাবে সামলাবেন। বিষয়টাকে তিনি নিজেও ধাক্কা খেয়েছেন। সৌমিত্র যেতে উদ্যত হলেই মোহ স্বচ্ছকে বলে ওঠে,
“তাকে আটকান।”

স্বচ্ছ ছুটে গিয়ে সৌমিত্রকে টেনে ধরল। কয়েকবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজের গায়ের ভার ছেড়ে দিলো সৌমিত্র। স্বচ্ছ তাকে জড়িয়ে ধরতেই হাত-পা ছড়িয়ে ছোটো বাচ্চায় ন্যায় কেঁদে ফেলল সে। ভাইকে জড়িয়ে ধরে প্রলাপ বকতে থাকল,
“এটা কেন হলো ভাইয়া? ভাবি কেন মিথ্যা বলল? কেন ও বিয়ে করল? আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। ও কেন আমায় বুঝল না।”

ছেলের কান্না দেখে মিসেস জেবার চোখও টলমল করে উঠল। একটা মেয়ের জন্য ছেলেটার কত পরিবর্তন! এখন কী হবে তার ছেলের ভবিষ্যৎ? স্বচ্ছ সৌমিত্রকে নিয়ে বসে পড়ল ফ্লোরে। তার পিঠে হাত বুলিয়ে ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
“সে তোকে বুঝলেও ওকে কেউ বোঝেনি সৌমিত্র। তাই ওকে বিয়েটা করতে হয়েছে। আর তোর পরীক্ষার জন্য মোহ তোকে সত্যিটা বলেনি।”

সৌমিত্রের কানে যেন কিছুই ঢুকল না। ফের উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ভাইকে জাপ্টে ধরে বলে উঠল,
“সে কেন আমার জন্য অপেক্ষা করল না?”

চলবে…