মেঘের আড়ালে সূর্য খুঁজি
দ্বিতীয় পর্ব
২
আমাদের চার বোনের সবচেয়ে অপছন্দের দিন, শুক্রবার। সেদিন আব্বা সারাদিন ঘরে থাকেন।
সকালে চা নাস্তা শেষ করেই, রান্নার আয়োজন শুরু করি। ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজে খুঁজে পরিস্কার করি।
আব্বার সব জামাকাপড় ধুই, আর ধোয়া কাপড় ইস্ত্রি করে রাখি।
নিজেদের স্কুলের জামা জুতা ধুই।
সব কাজ যখন শেষ হয়ে যায়, আমরা আব্বার হাত-পা টিপে দেই … কিন্তু, বিশ্রাম করতে পারিনা কিছুতেই।
আব্বা বলেন, মহিলাদের বিশ্রাম করার অভ্যাস মোটেও ভালো নয়। পুরুষরা বাইরে অনেক খাটাখাটনি করে, অনেক পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে ,তাই পুরুষদের বিশ্রাম প্রয়োজন। মহিলাদের আবার কিসের বিশ্রাম? মহিলাদের কাজই হলো খেদমত করা।
মহিলারা যে বাড়িতে শুয়ে বসে থাকে, সে বাড়িতে কোনো দিন উন্নতি হয় না।তাই,বাবার বাড়িতে বেশি বিশ্রামের অভ্যাস হয়ে গেলে, স্বামীর বাড়িতে গিয়ে উন্নতি করতে পারবোনা আমরা। আব্বা আমাদের পরিশ্রমের সুশিক্ষা দিচ্ছেন।
আমরা বাধ্য প্রজার মতো, মনিবের সুশিক্ষা গ্রহণ করতে থাকি।মন আর মগজের ব্যবহার করতে শিখি না।
এমনই এক শুক্রবার দুপুরে, আমরা আব্বার হাত-পা মালিশ করে দিচ্ছিলাম। সেদিন খুব গরম ছিল। ইলেকট্রিসিটি ছিলনা ঘরে।বড় আপু হাতপাখা দিয়ে আব্বাকে বাতাস করছিল।
হাত পাখার বাতাসে, আব্বার চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। পাশের ঘরে আম্মা অসুস্থ শরীরে, গরমে কাতরাচ্ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আব্বা ছাড়া আমাদের বাকি সবার মাথা দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছিল। ঠিক তখন…
নানাভাইয়ের বাড়ি থেকে একজন এলো, আমাদের বাসায়। সে আমার দুঃসম্পর্কের মামাতো ভাই।
নানাভাই ভীষণ অসুস্থ। আম্মাকে দেখতে চান।
আম্মাতো উঠে বাথরুম পর্যন্ত যেতে, আধাঘণ্টা লেগে যায়। নানাভাইয়ের বাড়ি যাওয়া তো অসম্ভব।
একটা গাড়ি ভাড়া করে, আব্বাসহ সাথে গেলে হয়তো আম্মা যেতে পারবেন।
কিন্তু, তাতে বেশ কিছু টাকা খরচ হবে।
এই পৃথিবীতে একমাত্র নানাভাই আছেন, যিনি আমাদের সত্যিকারের ভালোবাসেন। তার কিছু হয়ে গেলে, আমাদের তো আর কেউ থাকে না।আমরা চার বোন আম্মাকে জড়িয়ে, কান্না জুড়ে দিলাম। তাতে যদি আব্বার মন কিছুটা নরম হয়।
কিন্তু আব্বার মনটা কেমন ভাবে তৈরি, কখনো বুঝতে পারিনি।কিসে সেই মন নরম হয়, আমাদের জানা নেই।
মামাতো ভাই এবং আমাদের সবাইকে বাসায় রেখে, আব্বা বেরিয়ে গেলেন। আমরা ভাবলাম, হয়তো গাড়ি বা টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করতে গেছেন।
সবাই মিলে জামাকাপড় গুছিয়ে বসে আছি , আব্বার খবর নেই।
প্রায় তিন চারঘণ্টা পার হয়ে গেলো, আব্বা ফিরলেন না।
আমরা বুঝে গেলাম, আব্বা কি চাইছেন।
সেই প্রথম,ভয়ের সাথে সাথে আব্বাকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম।
নানা ভাইয়ের বাড়িতে যাবার ব্যবস্থা করেননি বলে নয়, আব্বা কি চাইছেন সেটা স্পষ্ট করে বলতে পারেন নি বলে। মনে হলো, আমার আব্বা মানুষ হিসেবে অসৎ এবং কাপুরুষ।
বড় আপু বাদে বাকি তিন বোন, রাতের শেষ বাসে ঢাকায় আসার জন্য রওনা হলাম। আম্মার পক্ষে এভাবে যাওয়া সম্ভব না।আবার একা থাকতেও পারবেন না।তাই , বড় আপু রয়ে গেল।
সব মায়েদের কাছেই ,কিছু হলেও বিপদের সম্বল থাকে। আম্মার কাছে চারশো তিরিশ টাকা সম্বল ছিল। সাথে একটা আংটিও দিলেন আম্মা। বিশেষ প্রয়োজন হলে, বিক্রি করতে বললেন।
বিয়ের সময় নানাভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া কিছু গয়না, আম্মার কাছে অবশিষ্ট আছে দেখলাম। আংটিটা সেখান থেকেই দিলেন।
আমাদের কাছেও বিশ পঞ্চাশ করে টাকা ছিল। সবগুলো মিলিয়ে নিয়ে, রওনা হলাম আমরা। তখন পর্যন্ত আব্বা ফিরেন নি বাসায়।
আমার এইসব ঘটনা যাদের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে, তাদের আমি ভীষণ ঈর্ষা করি।কারন আমি বুঝি, কেউ তো আর ইচ্ছা করে অবিশ্বাস করবে না।কেউ তো আমার শত্রু নয়।
যারা অবিশ্বাস করে ,তাদের জীবনে এধরনের ঘটনা কোনো দিন ঘটেনি।এমনকি তাদের আশেপাশেও ঘটেনি।তারা তাই ভাবতেও পারেনা, আমার এই জীবনটা।
কি সৌভাগ্যবান তারা!এইসব কষ্ট… সবার থেকে কত দূরে!
আমি তাদের ঈর্ষা করি।
নানাভাই মারা গেলেন।
নানাভাই অনেকদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তিনি মারা যাবেন,এটা হয়তো ভাবেন নি আব্বা।
আম্মা এবং আমাদেরকে আব্বা কতটা যন্ত্রণা দিচ্ছেন, সে বিষয়ে নানাভাইকে কখনো কিছু জানান নি আম্মা।
চাইলে জানাতে পারতেন কিন্তু তাতে নানাভাইয়ের বোঝা বাড়তো, কষ্ট বাড়তো। নানাভাই তো নিজেও সেরকম স্বচ্ছল ছিলেন না। ছোট ব্যবসা ছিল তার।সেই ব্যবসাও গুটিয়ে নিয়েছিলেন, বহু আগেই।
এমনিতেই, অনেকগুলো দিন মেয়ে এবং নাতনীদের দেখাশোনা করেছেন তিনি। অসুস্থ বাবাকে আর কোনো দুশ্চিন্তা দিতে চাননি আম্মা।
তবে, নানাভাই সব বুঝতে পেরেছিলেন। মেয়ের সুখের সংসার, বাবা মা ঠিক বুঝতে পারেন। আম্মার সুখের আঁচ, নানাভাই কখনো টের পাননি।
তাছাড়া ,এবাড়ির আত্মীয় স্বজন দুএকবার আমাদের বাসায় এসেছে। আম্মা এবং আমাদের অবস্থা তারা দেখেছে।
মেয়ের নামে নিজের বাড়ির কাগজপত্র , আমাদের কাছে বুঝিয়ে দিলেন নানাভাই। সাথে কিছু নগদ টাকাও।
সোমবার সন্ধ্যায় নানাভাই মারা গেলেন।
মৃত্যু সংবাদ পেয়েই আব্বা চলে এলেন।এক ধমকে, জমির কাগজপত্র এবং টাকা নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। আব্বার কথা অমান্য করবো, সেই সাহস আমাদের নেই।
আম্মার শরীর বেশ খারাপ ছিল। নানাভাইয়ের
কুলখানি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলাম না, আমরা।
যখন আব্বার সাথে চিটাগাং ফিরছিলাম, বারবার মনে হচ্ছিলো কোনোভাবে যদি পালিয়ে যেতে পারি, তাহলে কতো ভালো হয়।
বাইরের পৃথিবীটা কতো বিশাল! কতো স্বাধীন!
কিন্তু আব্বা আমাদের এমনভাবে বড় করছিলেন , আমরা কারো দিকে তাকাতে পর্যন্ত ভয় পেতাম। পালিয়ে যাবার সাহস ,কেমন করে হবে?
তখনও জানি না, বাড়িতে ফিরে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সত্যি বলতে, আম্মাতো মানসিক ভাবে ভীষণ দূর্বল ছিলেন। তার সাথে যোগ হয়েছিল আব্বার অবহেলা, অসম্মান। ভালোবাসার আশা করে ,উপেক্ষা পাওয়ার অভিমান। আম্মা তাই কখনো সুস্থ হননি।
একটু ভালোবাসা, সহযোগিতা, ভরসা পেলেই হয়তো আম্মা উঠে দাঁড়াতেন। ছোটবেলায় নিজের মা’কে হারিয়ে কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এখন এই শরীরে, বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে, আম্মা পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন।
অবস্থা ভালো নয় বুঝতে পেরে, আম্মাকে পাশে একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেলেন আব্বা। ডাক্তার সাহেব বললেন,
__রোগীর অবস্থা ভালো না। বাচ্চার অবস্থাও ভালো না।জলদি ভালো কোনো হাসপাতালে নিয়ে যান।
আম্মার ডেলিভারি ডেট আসতে তখনো বেশ কিছুদিন দেরি ছিল। কিন্তু ডাক্তার বললেন, আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
ক্লিনিকে আল্ট্রাসাউন্ড করে আব্বা ততক্ষণে জেনে গেছে, আম্মার শরীরে আরো একটা কন্যা সন্তান বেড়ে উঠছে।
আব্বার হয়তো সেরকম কোনো তাড়া কাজ করে নি মনে।
ধীরে সুস্থে আম্মাকে নিয়ে হাসপাতালে যান।
আমরা চার বোন সারারাত একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম, নির্ঘুম।
সকালে আম্মার প্রাণহীন শরীরটা নিয়ে, ফিরে এলেন আব্বা। সঙ্গে আরও একটা, ফুটফুটে ছোট্ট মৃত শরীর।যে পৃথিবীতে আসেনি বলে, আমি কষ্ট পাই নি। বরং খুশি হয়েছিলাম।সে মরে গিয়েই বেঁচেছে।
আব্বাও এখন মুক্ত।
প্রচন্ড দূর্বল মনের এক ভিনদেশী নারী…যে রাঁধতে জানে না, পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারে না, দিনরাত পরিশ্রম করতে পারে না,রোজগেরে পুরুষের খেদমত করতে পারে না …সেই নারীর হাত থেকে, আব্বা পুরোপুরি মুক্ত।
এক সপ্তাহের মধ্যে, নানাভাই এবং আম্মাকে হারিয়ে আমরা চার বোন …এই পৃথিবীর আরো ভয়ংকর দিনের দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।
চলবে…