প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-১১+১২

0
173

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১১তম_পর্ব
#বর্ষা
৩২।
কয়দিন অতিবাহিত হলো।এখন সন্ধ্যা ছয়টা।সাউলের গিম্পো এয়ার পোর্টে বসে আছে আহসানুল আদ্র।পরনে গ্রীষ্মের পলো শার্ট আর শর্ট প্যান্ট।হেড ফোনে গান শুনতে শুনতেই একহাতে লাগেজ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সে। বাংলাদেশে যাওয়ার সময় চলে এসেছে।কত বছর পর যাচ্ছে?প্রায় ষোলো বছর পর।মেয়ে হবার পরও দুই বছর সে বাংলাদেশে ছিলো।তবে সবার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে।যখন আমেরিকা এসে অভিনেতা হয়ে কাজ শুরু করলো তারপরই পরিবারের সাথে নিজেই যোগাযোগ করেছিলো।

আধা ঘন্টা সময় ব্যয়ে প্লেনে ওঠে আদ্র উরফে সান। এখন থেকে নাহয় আদ্র বলেই সম্বোধন করলাম।মিডিয়া জগতের বাইরে তো তার সাধারণ এক পরিচয় রয়েছে।সে আজাদ মীর মুর্তজার ছোট ছেলে,অদ্রিতা জাবিনের বাবা,জেনিয়া ফিরোজের স্বামী।আদ্রের পাশের সিটটা ফাঁকা।হয়তো এখনো এসে পৌঁছায়নি।

কিছুক্ষণের মাঝে এনাউন্সমেন্টের সমাপ্তিতে প্লেন উড়তে শুরু করে।আদ্রর পাশের সিট এখনো ফাঁকা।হয়তো কেউ নেই এখানটায়।আদ্রর সিটটা জানালার পাশে।বেশ ভালো লাগে ওর এই পিঠটা।প্রায়শই সিট বুকিং এর সময় জানালার সাইড সে পছন্দ করে।অ্যারিনের প্লেন আলাদা।সে নিজের দেশে ফিরছে।আদ্র তাকে একমাসের ছুটি দিয়ে নিজেও যাচ্ছে ছুটি কাটাতে।একমাস সে সব কিছু থেকেই দূরে থাকবে বলে।

আজ সাতটায় সে প্লেনে উঠেছে।আগামীকাল দুপুর দুইটায় বোধহয় সে তার দেশে থাকবে। কতগুলো বছর পর!সে চিনবে তো সব?নাও চিনতে পারে। কতকিছুর পরিবর্তন হয়েছে।কত মানুষের পরিবর্তন হয়েছে বলার বাইরে। আচ্ছা অদ্রিতা কি তাকে জড়িয়ে ধরতে দেবে?সে কি তার মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে পারবে? সে কি পারবে মেয়েকে নিয়ে যেতে?কতসব প্রশ্ন আদ্রের মস্তিষ্কে ভার করে।আদ্র দিশেহারা পথিক যেন।সে জানে তার কেবল তার মেয়েকে চাই।

এয়ার হোস্টেজদের মাঝেও কয়েকজন তার ফ্যান।দুইজন এসে চুপিচুপি অটোগ্রাফ চেয়ে নিলো।আদ্র হাসি মুখেই তাদের অটোগ্রাফ দিয়ে আই মাস্ক পড়ে বসে রইলো।ভাব এমন যেন সে ঘুমিয়েছে।আদ্রের সামনের সিটে কাপল বসেছে। তাদের ছোট একটা বেবিও আছে। ছেলে-মেয়ে দুটোর বয়স খুব একটা হবে না।বেবিটাকে ছেলেটাই সামলাচ্ছে।কোরিয়ান ভাষায় কথা বলছে।আদ্র কোরিয়ান বলতে না পারলে কিছুটা বোঝে।সে থেকে দু একটা কথা ধরতে পারলো। ছেলে-মেয়ে দুটো তাদের বাচ্চাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাচ্ছে।মেয়ের পরিবার থাকে সেখানে।তা নিয়েই বাচ্চার সাথে গল্প করছে দুইজন।

আদ্রর বোধহয় সে আর জেনিয়াই এভাবে অদ্রির সাথে কথা বলছে।অদ্রি তখনই এভাবেই বোধহয় হাসছে।এসব আদ্রর কল্পনা। বাস্তবতা ভিন্ন।আদ্র নিজের পথ দেখেছে,জেনিয়াও নিজের পথ দেখেছে।এদিক দিয়ে অদ্রিতা বড় হয়েছে নিজের মতন করে।আদ্রের পরিবারের কাছে।

৩৩।

রাত দশটা বাংলাদেশে।অদ্রিতা আর রিয়ান দু’জনে আর গ্রুপ স্টাডি করছে।দুইজন দুইজনের নোট এক্সচেঞ্জ করেছে।এভাবেই তো ওরা পড়াশোনা চালায়। একজন পদার্থবিজ্ঞান নোট করলে আরেকজন করে জীববিজ্ঞান নোট। একজন রসায়ন করলে অপরজন করে উচ্চতর গনিত নোট‌।পরে আবার এক্সচেঞ্জ করে ছাপিয়ে নেয় দুইজনই।

পড়তে পড়তেই দুইজনের ঝগড়া লেগে গেছে।অদ্রিতা কথায় কথায় নুহানের নাম নিয়েছে।সেদিন কি কথা হয়েছে তা বলতেই রিয়ান ক্ষেপে গেছে।তখনই দুইটার ঝগড়া লেগে যায়।রিয়ান বলতে থাকে,

‘’তোর তো দুনিয়ার সবটিরই ভালো লাগে।সবার কথা গুরুত্ব দেস।আর আমি কিছু বললেই তুই চেতস বেয়াদব’’

‘’তুই বেয়াদব,তোর চৌদ্দ গুষ্টি বেয়াদব’’

‘’তুই তো আমার গুষ্টির বাইরে পড়স শয়তান ছেড়ি’’

‘’তুই শয়তান,বেয়াদব। তুই ওই আজলান বেহরান রে ওইদিন টেক্সট দিছিলি কেন?ওই শালায় ব্যবহার আমার ভালো লাগে না তুই জানস না!’’

‘’আমি কি করমু!তোর শালাই তো বলে বেড়ায় তুই হের।তো হের জিনিসে কেউ হাত দিলে আমি কি করমু? তুই তো আমারে প্রতিবাদ করতেও দেস না’’

দু’জনের ঝগড়া চাঙে ওঠার আগেই শোনা গেলো আজ আরিয়ারা আসছে।আয়েশা সিদ্দিকা ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন।আরিয়া আর ওর বড় ভাই আরাভ আসছে।ওরা পথে।দুইজন ঝগড়া থামিয়ে একে অপরের মুখ না দেখার কথা বলে রিয়ান ওই রুম থেকে বেরিয়ে যায়।অদ্রিও রাগের বসে ওকে বেরিয়ে যেতে বলে রুম লক করে দেয়।

রিয়ান ঘরে যাওয়ার পথে ড্রয়িংরুম থেকে বাকিদের কথা শুনতে পায়।খাওয়া দাওয়া শেষ।এখনও সবাই ড্রয়িংরুমে কি করছে এটা ভেবেই রিয়ান ওদিকে যায়। জানতে পারে ওর ছোট চাচ্চু আসছে।আগামীকাল ওদের বাবা তাকে আনতে যাবে।সঙ্গে যাবে মোয়াজ আর আরাভ।ছোট চাচ্চুর কথা শুনেই সবভুলে রিয়ান দৌড় লাগায় অদ্রির ঘরের দিকে।অদ্রির ভেতর থেকে বন্ধ।রিয়ান ডাকে তবে সাড়া পায় না।রিয়ান জানে এই মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি হলে এই মেয়ে আর ঘরে থাকে না। বারান্দায় গিয়ে ঘাপটি মারে।তাই আর না ভেবে সে নিজের ঘরে চলে যায়।দুটোর ঘর পাশাপাশি। বারান্দাও পাশাপাশি।

‘’ওই ছেমড়ি দরজা খোল কথা আছে?’’

‘’রিয়ানের বাচ্চা জ্বালাইস না।ঘুমা গা।আমার ভাল লাগতাছে না’’

‘’তুই দরজা খুলবি নাকি আমি এখান দিয়াই আসুম?পরে টরে গেলে তোর দোষ’’

‘’রিয়াইন্না’’

‘’পেত্নি’’

‘’তুই যা ভাই।আমারে জ্বালাইস না।যা তো’’

‘’আরে বাল আরিয়ারা আইছে। প্রতিশোধ নিবি না?থাক প্ল্যান যখন করবি না তাইলে বাদ দে’’

অদ্রিতা তখন আর রেসপন্স করে না।ভায়োলিন বাজাতে লাগে।তার রুমের থেকে একটু দূরেই কাঠগোলাপ গাছ। অবশ্য খুব একটা লম্বা না হলেও ওর বারান্দা থেকে টানা দিয়ে আনা যায়।কয়েকটা কাঠগোলাপ ছিড়ে সে তার কাছে এনে জমা করিয়েছে।ছাদে যাওয়া বারণ না হলে এখন সে কফি হাতে ছাদে যেতো। মাথাটা ব্যথা করছে।

৩৩।

দিনটা শুক্রবার।অদ্রিতা আজ প্ল্যান করেছে মায়ের সাথে লং ড্রাইভে যাওয়ার।দুপুরের লাঞ্চ বাইরে করার।অদ্রিতা আর তার মা যাবে।রিয়ানকে নিতে চেয়েছিলো তবে রিয়ান যাবেনা।তার কি যেন কাজ আছে! ইদানিং রিয়ানের কাজ বেশি।অদ্রিতা নীল গাউন পড়েছে।আর জেনিয়া ফিরোজের পড়নে নীল থ্রিপিস।মা মেয়ে মিলিয়ে পড়েছে।

গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতেই।যদিও হুটহাট জ্যাম পড়ে যাচ্ছে।ওরা এই সকাল সকাল যাচ্ছে দিঘীতে।বোর্ডে করে ঘুরবে।তারপর আরো বেলা হলেই যাবে মাওয়া ঘাটে।সেখানে গিয়ে খাবে পদ্মার ইলিশের ভিন্ন ভিন্ন আইটেম।বোর্ডে উঠতেই অদ্রিতা ভয়ে ঝিম মেরে থাকে।সে সাতার কাটতে পারে না।জেনিয়া ফিরোজ অভয় দেন।তিনি সাতার কাটতে পারেন।মেয়ের কিছু হতে দিবেন না তিনি।

মা-মেয়ে ভরা মৌসুমে দিঘীতে সুন্দর সময় কাটায়।ক্যামেরা বন্দি করে সেগুলো।অদ্রির মুখে খুশির ঝলক।তার খুব ভালো লাগছে।জেনিয়া ফিরোজ মেয়ের খুশিতে নিজেও খুশি হোন।কখনো ভাবেননি মেয়ের সাথে এতো সুমধুর স্মৃতি তিনি কখনো গড়তে পারবেন।

গাড়ি করে আবারো যাত্রা ওদের মাওয়ার পথে। আজকে অবশ্য ওরা উবার করে ঘুরছে।নয়তো কি আর জেনিয়া ফিরোজ নিয়ে যেতে পারতেন এসব জায়গায়!কখনোই না।তিনি চিনেন না।গুগল ম্যাপ দেখলে কোন না কোন রাস্তায় নিয়ে যেতেন কে জানে। তাইতো উবার করে ঘোরাঘুরি করা।

মাওয়া ঘাটে দোকান ঘুরে ঘুরে অদ্রিই মাছের দাম ঠিক করে।কি খাবে,কিভাবে খাবে সব ঠিক করে হোটেলের ভেতরে এসে বসে।মা-মেয়ে গল্পে মজে ওঠে।জেনিয়া ফিরোজ বাংলাদেশে এসেছেন তাও প্রায় দুই সপ্তাহ।সামনের মাসেই ওনাকে ফিরতে হবে। আর্কিটেকচার হয়ে যে কোম্পানি তিনি খুলে ছিলেন তার সম্পূর্ণটাই তিনিই দেখাশোনা করেন। অতিরিক্ত দূরে থাকলে সমস্যা আছে।কিছু বাঙালি আছে ওনার কোম্পানি। যাদের প্রতি গত কয়েক বছরে জেনিয়ার ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে।বুঝেছে,’’টাকার নেশায় মানুষ বেইমানি খুব সহজেই করে’’

বিকেল চারটার দিকে ঘোরাঘুরি শেষে অদ্রিতারা বাড়ি ফেরে।বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে।এতো মানুষ কেন!অদ্রিতা আর জেনিয়া জানেন না।ভেতরে ঢুকেই অদ্রিতা শুনতে পায় মৌসুমী বেগম আর আয়েশা সিদ্দিকার কান্না। দুইজনে কাঁদছে কেন দেখতে অদ্রিতা ছুটে যায়।দেখতে পায় একজন অতিব সুন্দর বিদেশীকে। অবশ্য লোকটা বাঙালি তবে চেহারা সুরতে বিদেশী।ওর বাবা আহসানুল আদ্র।অদ্রি যখন দাদি বলতে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে এসেছিলো তখনই আদ্র বুঝেছিলো তার মেয়ে আসছে।

অদ্রিতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় বাবাকে দেখে।জেনিয়া মেয়ের পেছনেই ছিলেন।মেয়ে কাঁপছে বুঝতে পেরে তিনি অদ্রিকে শক্ত করে ধরেন।রিয়ান বুঝতে পারে অদ্রির কিছু একটা হচ্ছে।অদ্রির মুখ হঠাৎ করেই লাল হয়ে যাচ্ছে।প্রেশার বাড়লো কি!আদ্র অদ্রির দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়ানোর পরপরই অদ্রিতা চোখ বুজে ফেলে।পড়ে যেতে নেয়।জেনিয়া আর রিয়ান ধরে ফেলে তাকে‌।আদ্র মেয়ের থেকে চোখ সরিয়ে তার স্ত্রীকে দেখে।মেয়ে যেন তার মায়ের কপি হয়েছে!

চলবে?

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১২তম_পর্ব
#বর্ষা
৩৪।
দেহে পোশাকের লেশ মাত্র নেই আজলানের।নগ্ন অবস্থাতেই চাদর টেনে উঠে বসলো সে। হাতে মোবাইল ফোন।বিছানার আরেকপাশে লিয়ানা শুয়ে আছে।আজলানের মাথা ভার হয়ে আছে।গতরাতে অতিরিক্ত নেশার ফলাফল ওর সামনে।রাগে ওর শরীর ফেটে যাচ্ছে।মোবাইল হাতে নিয়ে ও কল দেয় আযানকে।দশ বারোবার কল দেওয়ার পরও যখন ঢোকে না তখন ও বুঝতে পারে আযান ওকে ব্লক করেছে। দাঁত মুখ শক্ত করে ও বিছানা ছাড়ে।

ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখে লিয়ানা চাদর গায়ে বসে আছে।লিয়ানার মুখে প্রাপ্তির হাসি।আজলান রাগে গজগজ করতে করতে বলে ওঠে,

‘’তুই জানতি না আমি ড্রাংক!তাও কোন সাহসে আমার কাছে ঘেষছিলি?’’

লিয়ানার গলা চেপে ধরে আজলান কথার বান ছুড়ে মারে।লিয়ানার মুখে তাও হাসি।তবে তাচ্ছিল্যের।গতরাতে আজলান নিজে এসেছে ওর ঘরে।তাইতো মাঝরাতে সে মেয়েকে কোলে করে রেখে এসেছে আরমানের ঘরে।লিয়ানাকে হাসতে দেখে আজলান আরো খেপে যায়।লিয়ানাকে ছুঁড়ে মেরে সরে আসে। চিৎকার করে বলে ওঠে,

‘’আমি তোকে ভালোবাসি না,বুঝিস না তুই?তাও কেন আসিস আমার এতো কাছে’’

‘’আমি তো যাইনি। তুমি এসেছো। নিজের পুরুষত্ব দেখাতে।আমার প্রতি অনুরাগ না থাকলে আমাকে ছুঁলে কি করে’’

‘’একদম কথা বলবি না।জানে মেরে ফেলবো।যখন দেখেছিস আমি ড্রাংক,তুই তোর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলি না কেন ‘’

রিয়ানার কথা বাড়ায় না।সে চাদর মুড়িয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।একদম গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। চোখগুলো ফুলে গেছে।হয়তো বেশ কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলেছে সে। ঘরে এসে আর আজলানকে দেখে না সে।খুব একটা অবাকও হয়না।তাইতো হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে চলে যায় ছেলে-মেয়ের কাছে।

আরমান তার বোনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।এখন কেবল আটটা।ওরা ওঠে নয়টার দিকে।তাইতো লিয়ানা চলে যায় রান্নাঘরের দিকে।রান্না কতদূর তাও তো দেখতে হবে।যাওয়ার সময়ই দেখতে পায় আজলান লাগেজ নিয়ে বের হচ্ছে।লিয়ানা জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে।তবে উত্তর দেয় না আজলান। ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন রিজিয়া বেগম।আজলানের মা।তিনি গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

‘’আজলান কোথায় যাচ্ছো এই সকাল সকাল?আর হাতে লাগেজ কেন তোমার’’

‘’বাংলাদেশে যাচ্ছি।’’

‘’কেন যাচ্ছো?’’

‘’বিয়ে করতে।আমি একজনকে ভালোবাসি।তাকে বিয়ে করবো।আর সেই হবে আমার সন্তানদের মা’’

‘’আজলান..’’

লিয়ানা পেছন থেকে চিৎকার করে ওঠে।রিজিয়া বেগম গম্ভীর কন্ঠে আজলানকে বলে ওঠেন,

‘’তোমার আব্বার সামনে তোমার সাথে লিয়ানার বিয়ে হয়েছে।সে ঘরে তোমার লাইজা আছে।তোমার দু’দুটো সন্তান আছে।তাও কিসব কথা বলছো!’’

‘’আমি তো এই নারীকে বিয়ে করতে চাইনি।বলেছিলাম তো দরকার পড়লে এর খরচ আমি দিবো।আব্বাস বেহরান আমার জীবনটা শেষ করে মরেছে।আমি তো আমার জীবন এভাবে কাটাবো না।জোর করে কিছুই সম্ভব না’’

‘’আমাদের সন্তানদের কি হবে আজলান?’’

লিয়ানার গলায় আকুতি।আজলান পরোয়া করে না।সে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ানোর সাথে সাথেই আরমানের গলা শুনতে পায়।আরমান লিয়ানাকে বলছে,

‘’মাম্মা পাপা কি আর আসবে না?’’

আজলান দাঁড়ায়।লাগেজ নিয়ে বের হতে গিয়েও হয়না।লাগেজ রেখে আরমানের দিকে এগিয়ে যায়।বলে ওঠে,

‘’আমাকে ভুল বুঝিস না।এখানে সবাই সবার স্বার্থ দেখছে। আমিও আমারটা দেখছি।আমি আমার ভালো থাকাটা খুঁজছি ‘’

‘’পাপা তুমি আমাদের সাথে ভালো নেই?’’

আরমানের চোখ ছলছল করছে।আজলান দেখে তবে কিছু বলে না।ওর গলা শুকিয়ে এসেছে।ভাইয়ের মৃত্যুর সময় ও কথা দিয়েছিলো ওর ছেলেকে নিজের ছেলে করেই মানুষ করবে।সেই ছেলেকে কি করে কষ্ট দেবে আজলান!আরমানকে বুকে চেপে ধরে আজলান।বলে ওঠে,

‘’আমাকে যেতে হবে।আমি খুব শীঘ্রই ফিরবো। নতুন অতিথি নিয়ে। তোকে খুব ভালোবাসবে।’’

‘’লাইজাকেও বাসবে?’’

আজলান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লিয়ানা আর রিজিয়ার দিকে একপলক দেখে বলে ওঠে,’’হ্যা বাসবে’’

‘’ফিরে এসে তুমিও ওকে ভালো বাসবে তো?’’

‘’বাসবো’’

‘’প্রমিস?’’

‘’হুম’’

আরমান আজলানকে যেতে দেয়।আজলান লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসে।ওর এখন নতুন কাউকে খুঁজতে হবে যে কিনা ওকে বাংলাদেশে সার্ভাইব করতে সাহায্য করবে।আযান ওকে ওর টাকা ব্যাক করে তারপরই ব্লক করেছে।টাকা পেয়ে অবশ্য আজলান দুইবার ওকে কল করেছিলো।ভেবেছিলো ব্যস্ত।আর নিজের ব্যস্ততায় পরে আর কল করা হয়নি।ভিসা কনফার্ম হওয়ার পর আজ সকালে আবার কল করেছিলো।তখনই বুঝলো সে ব্লকড।

৩৫।

বাংলাদেশে বৃষ্টিমুখর দুপুর।সূর্যের উত্তাপ নেই।এসির ঠান্ডা বাতাসে আরো শীতের আবাস।অদ্রিতা বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।গতকাল থেকে এভাবেই পড়ে আছে।জেনিয়া এসে মেয়েকে খাইয়ে গেছেন।মা ব্যতীত কারো সাথে এখন অব্দি কথা বলেনি ও।রিয়ান বারান্দা টপকে এসে দেখে গেছে ওকে। বারান্দার দরজা বন্ধ থাকায় জানালা দিয়েই দেখে গেছে।

মোবাইলে টুংটাং ম্যাসেজের শব্দে অদ্রির ঘুম ভাঙে।রিয়ান ম্যাসেজ করছে। কতগুলোতে মিষ্টি কথা, কিছু হাস্যকর কথা আবার কিছু ইমোশনাল কথা বলেছে সে।অদ্রি অবাক হয়েছে অবশ্য।রিয়ান তো এমন বিহেভ করার মানুষ না।

‘’গাঞ্জা খাইছোস নাকি?কি লিখছ এইসব?’’

অদ্রির রিপ্লাই পেয়ে রিয়ান দ্রুত আগের ম্যাসেজগুলো ডিলিট করে।আজ ভেবেছিলো অদ্রিকে সব বলে দিবে।বাসায় যা শুরু হয়েছে।কবে জানি অদ্রি বাবা-মা কাকে বেছে নিয়ে কোথায় চলে যাবে কে জানে!মনকে কত শক্ত করে এসব লিখছিলো ও। কিন্তু হায় কপাল কি করতে চাইলো আর কি হলো!

‘’ম্যাসেজ আনসেন্ট করছ কে শয়তান?আমার চোখ নাই নাকি আমি পড়তে পারি না।সব তো পড়ছিই’’

রিয়ান কতক্ষণ থম মেরে বসে থাকে।সে ভেবে পায়না কি লিখবে।তারপর অনেক সাহস করে লেখে,

‘’তোর জবাব কি?’’

‘’আসলেই গাঞ্জা খাইছোস। দাঁড়া আমি লেবুর শরবত বানাইয়া আনতাছি।আর ঝাড়ুও আনতাছি’’

‘’ঝাড়ু কেন?’’

‘’গাঞ্জা নাই খাইলে তোরে তো ভূতে ধরছে।আর ভুত নামানোর জন্য ঝাড়ু লাগবো ‘’

ম্যাসেজ দিয়ে অদ্রিতা অফলাইনে চলে যায়।রিয়ান ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে দরজা লাগায়। আল্লাহ আল্লাহ করে যেন অদ্রিতা এসব বাড়ির কাউকে না বলে।

অদ্রিতা ম্যাসেজ পাঠিয়েই ফ্রেশ হতে চলে যায়।হাত মুখ মুছে চলে আসে নিচে।পেটটা খিদেয় চুচু করছে।এখন দুপুর দুইটা।সেই বারোটা থেকে ও ঘুমাচ্ছে।একবার শুনেছিলো মা ডাকছে।তাও আলসেমিতে ওঠেনি।আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলো।নিচে এসে দেখে পুরো অন্ধকার হয়ে আছে সব।লাইট জ্বালিয়ে প্রথমে নিজে খেয়ে নেয়।এতো বছর পর বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরেছে বলে গত দুইদিন ধরে বেশ ভালো মন্দ রান্না হচ্ছে।খাওয়া শেষে লেবু কেটে শরবত বানায় সে।মরিচের গুঁড়া অনেকটা ঢেলে দেয়।ভুত নামানোর উপায়।

রিয়ানকে এতো ডেকেও যখন সাড়া পায়না তখন অদ্রি চুপ করে যায়।ঘরে এসে ম্যাসেজ দেয়,

‘’আমি সব ম্যাসেজের স্ক্রিনশট নিয়ে রাখছি। তুই দরজা না খুললে আমি দাদারে দেখামু সব’’

তখনই ওপাশ থেকে সিন হয়।ধরাম শব্দ শোনা যায়। একপ্রকার দৌড়ে রিয়ান অদ্রির ঘরে আসে।ছিটকে পড়ে মেঝেতে।রিয়ান মেঝেতে বসেই বলে ওঠে,

‘’প্লিজ দাদারে বলিস না,বিদেশ পাঠাইয়া দিবো।জানস তো দাদার মাথায় ভুত চাপছে’’

‘’এক শর্তে’’

‘’কি শর্ত?আমি সব শুনমু’’

‘’এই যে এই শরবতটা খাবি’’

‘’কি মিশাইছোস এটায়?এমন কালার কেন?’’

‘’খাইয়া দেখ।খারাপ কিছু মিশাই নাই’’

রিয়ান এক চুমুক দিয়ে কাশতে শুরু করে।মরিচের গুঁড়ার ঝাঁজে এই অবস্থা ওর।কাশতে কাশতে চোখ মুখ লাল করে ফেলে।অদ্রি দ্রুত চিনি এগিয়ে দেয়। সঙ্গে দেয় তেঁতুল।ঝাল কমবে।রিয়ান তেঁতুল মুখে দিয়ে সোশাতে সোশাতে শাসাতে নিলে অদ্রি চোখ রাঙায়।রিয়ান চুপ করে যায়।

অদ্রি রিয়ানের অবস্থা দেখে হাসে।হাসতে হাসতে বলে ওঠে,

‘’আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখলে এমনই হবে
আর বিয়ে করলে তো তোর জীবন ঝালময় হয়ে যাবে’’

রিয়ান অদ্রির দিকে তাকিয়ে থাকে।অদ্রি আবার বলে ওঠে,

‘’জানিস গত পরশু ফুফি তার ছেলেকে নিয়ে কেন নিয়ে এসেছে?’’

রিয়ান না বোধহক মাথা নাড়ায়।অদ্রি বলে ওঠে,

‘’আহসানুল আদ্রের ব্রেন ওয়াশ করতে।মাম্মাকে ব্রেন ওয়াশ করার চেষ্টা করছিলো। পারেনি। আরাভ ভাইয়ের বউ করতে চায় আমায়’’

রিয়ানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।সবাই কেবল অদ্রিকে কেন চায় সে বুঝতে পারে না।রিয়ান কি করবে কিছুই ভেবে পায় না।দুইজনই সমবয়সী। রিয়ান যদি কিছু করতে পারতো তাহলে নাহয় সে জোর গলায় অদ্রিকে চাইতে পারতো। কিন্তু এখন কি করবে সে!রিয়ানকে অবাক করে অদ্রি বলে ওঠে,

‘’তুই কি আমায় সত্যি ভালোবাসিস?’’

‘’তোর মিথ্যে মনে হচ্ছে?’’

‘’অনেকেই তো তরুণ বয়সে ভালোবাসা দেখায়।আর যুবক হতেই আগেরজনকে ভালো লাগেনা।তখন নতুনত্ব চাই’’

‘’এই ফাহামিদুল রিয়ান,মীর মুর্তজা বংশের ছেলে তোকে পেলে জীবনের সব পেয়ে যাবে।এখন তুই আমার ভালোলাগা আছিস।এতোটুকু কথা দিতে পারি যদি তুই আমার একবার হোস,দুনিয়ার যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তোকে আমার প্রতি মুহূর্তে রাখবো’’

চলবে?