প্রলয় পুতুল পর্ব-০৬

0
56

#প্রলয়_পুতুল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৬
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)

ঘড়িতে তখন রাত দুটো বারো। নেহাল ক্রমাগত সারা নাম্বারে কল করেই যাচ্ছে। কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। রোজের নাম্বারে কল করলো। কিন্তু তারও একি অবস্থা। নেহাল বিরক্ত হলো। নুহানের ফোনে কল দিলো তিনবার। শেষমেষ নুহান কল রিসিভ করে ঘুমু ঘুমু গলায় বলল,
“কেরে এতো রাতে কল করা কোন সভ্য জাতির উদাহরণ। ভাই নিজে ঘুমাসনা বলে কি আমরাও ঘুমাবো না।”

নেহাল খিটমিটিয়ে বলল,
“আরে হারামজাদা দরজা খুলে দে। না হয় আর দুই মিনিটের মধ্যে আমি ভেঙে দিবো বলে দিলাম।”

নুহান চকিতে উঠে বসলো। চোখ বড় বড় করে সময় দেখলো রাত দুইটা পয়ত্রিশ বাজে।
“দাদাই!”

“খুলবি নাকি বল!”

নুহান কোনোমতে উঠে দৌড়ে দরজার কাছে গেলো। দরজা খুলতেই নেহাল কিছু না বলে হনহনিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। নুহানের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। মনে হলো ঝড়ের মতো এলো তুফানের মতো গেলো।

নুহান মাথা চুলকাতে চুলকাতে দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে গিয়ে আবারো বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

নেহাল নিজের রুমের সামনে গিয়ে দেখলো দরজা চাপানো। কোনোরকম শব্দ না করেই রুমে ঢুকলো সে। বিছানার একপাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে সারা। আবছা আলোতেও নেহাল সারার চোখের পাশে শুকিয়ে যাও অশ্রুবিন্দু দেখতে পেলো। নেহাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধ থেকে ট্রাভেলিং ব্যাগটা নামিয়ে চেয়ারে রাখলো। বাদামী রঙের শার্টটা ঘামে ভিজে যবযব করছে। বৃষ্টির দিনগুলো এই এক সমস্যা হুট করে বৃষ্টি নামে আবার হুট করে থেমে গিয়ে ভ্যাবসা গরম বাড়িয়ে দেয়। নেহাল ধীর পায়ে কাবার্টের কাছে গিয়ে একটা ঢিলেঢালা পাতলা টিশার্ট আর একটা হাফ প্যান্ট নিলো।

ওয়াশরুমে গিয়ে ঘামে ভেজা জামাকাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রুমে এসে দেখলো সারা একই ভাবেই ঘুমিয়ে আছে। নেহাল দেড়ি না করে সারার পাশে গিয়ে নিশব্দে শুয়ে পরলো। সারার দিকে ফিরে পিছন থেকে হাত দিয়ে সারাকে নিজের দিকে টেনে নিলো। সারার খোলা চুলে মুখ গুজে দিলো। ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,
“কেন বোঝোনা তুমি আমায়? জানোই তো আমার রাগ বেশি। কোথায় আমাকে মানিয়ে নিবে তা না করে অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রাখো। আমি যে কষ্ট পাই তা তো বোঝো না। ছেড়ে চলে যেতে চাও আমাকে। এটা বোঝোনা তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। বিয়ের আগে তো কথা দিয়েছিলো আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাহলে এখন কেন এমন করো।”

ঘুমের মাঝে শক্ত হাতের বাঁধন অনুভব করতেই খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো সারা। ঘাড়ের উপরে উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করতেই ঘুম ভেঙে গেলো তার। তবুও সে আগের মতো থাকলো। কারণ স্পর্শটা তার বেশ পরিচিত। পরিচিত বললে ভুল হবে তার অস্তিত্বে মিশে আছে। নেহাল কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে বললেও সারার কাছে তা পরিষ্কার শোনাচ্ছে। সারার ভাবনার মাঝেই ঘাড়ে তরল কিছুর অস্তিত্ব পেতেই কেঁপে উঠলো সে। নেহাল কি তাহলে কান্না করছে।

নেহাল সারা ঘাড়ে নাক ঘষে নিজের কান্না আটকালো। হুট করেই সে সারাকে টান দিয়ে তার দিকে ঘোরালো। সারা চোখ বন্ধ করে ফেললো। নেহাল সেদিকে না তাকিয়েই সারার কপালে গাঢ় চুমু খেলো। সারার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো। নেহাল সারাকে বুকে জড়িয়ে ধীর গলায় বলল,
“সরি, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানিনা আসলে কিভাবে নিজেকে ঠিক করা যায় কিন্তু আমি চেষ্টা করি। মানসিক চাপ গুলো আমাকে ঠিক থাকতে দেয় না।”

সারা আর পারলো না চুপ থাকতে। নেহালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো। নেহালও সারাকে নিজের বুকের মাঝে সযত্নে লুকিয়ে নিলো।

সারার কান্নার বেগ কমে আসতেই নেহাল নিজের বুক থেকে প্রিয়তমার আদুরে মুখখানা তুলে দুইহাত ধরে উঁচু করে ধরে বলল,
“আমি এই চাকরি আর করবো না। যেই কাজের জন্য আমার মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। যার ফলে আমি আমার প্রিয় মানুষ কষ্ট পায় তা আমি করবো না। বেশ কিছুদিন ধরে বস আমার সাথে কেমন যেন করছে। তিনি আমাকে বেশি একটা পছন্দ করছেনা। অফিসের এই প্রভাব না চাইতেও তোমার উপর পড়ছিলো।”

সারা নেহালের মুখপানে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,
“করতে হবে না তোমাকে। আমাকে শুধু একটু ভালোবেসো আমি সারাজীবন তোমার হয়ে থেকে যাবো।”

নেহাল সারার মুখে এলোমেলো ভাবে বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল,
“আমি তোমাকে অনেকটা ভালোবাসি। তুমি মানিয়ে থেকে যেও। আমি চেষ্টা করবো তোমার মন মতো হয়ে উঠার।”

সারা আর কিছু না বলে নেহালে বুকে মাথা রাখলো। নেহালও সরাকে আগলে নিয়ে চোখ বুজলো।

——————-

মাঝে কেটে গেছে এক সপ্তাহের মতো। এরমাঝে রোজ ভার্সিটি গেলেও জুবায়ের এর সাথে তেমন দেখা হয়নি। নেহাল সেদিন সকাল উঠেই চাকরি ছাড়ার কথা ফ্যামিলির সবাইকে বলেছে। এতে কেউ কোনো আপত্তি করেনি। কারণ নেহাল বুঝদার ছেলে।

আজ ভার্সিটিতে নবীনবরণের অনুষ্ঠান। মালিহা আর আরুশার জোরাজোরিতে শাড়ি পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোজ। শাড়ি পড়ে বাসার ভিতরে ছবি তুললেও বাহিরে কখনো শাড়ি পড়ে বের হওয়া হয়নি। তাই রোজ একটু ইতস্তত বোধ করছিলো কোলের উপরে শাড়ি নিয়ে। তখনি রুমে সারা এলো। রোজকে শাড়ি হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখে সারা এগিয়ে এসে অবাক কন্ঠে বলল,
“কিহলো আবার তোমার? শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছো যে?”

রোজ ঠোঁট উল্টে বলল,
“রাস্তায় যদি সবার সামনে উষ্টা খেয়ে পড়ে যাই।”

সারা রোজের মাথায় গাট্টা বসিয়ে শাড়িটা ওর হাত থেকে নিয়ে বলল,
“আসো আমি সাহায্য করছি। কিছু হবে না। জাস্ট চিল করো তো।”

সারা রোজকে বাদামি রঙের শাড়িটা বেশ যত্ন করে পরিয়ে দিলো। রোজের চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে কানেপিঠে হালকা হলুদ রঙের দুটো ফুল গুজে দিলো। মুখে ফেসপাউডার, চোখে গাঢ় করে কাজল, ঠোঁট নুড কালার লিপস্টিক, কুন্দনের দুটো টানা পরিয়ে সারা রোজের বাহু ধরে ওর দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বলল,
“বাহ সেই লাগছে তো। আজ বড় ছোট সবাই তোমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকবে।”

“আর সেই হা তে মশা, মাছি ঢুকে যাবে।”

রোজ আর সারা দুইজন মিলে হেসে দিলো।

বাসার সবার কাছ থেকে মোটামুটি প্রশংসা নিয়ে নুহানের সাথে বেড়িয়ে পরলো। নুহান নেহালের বাইকটাই নিয়ে বের হয়েছে তারা। নেহালই আনতো কিন্তু নেহালের জ্বর আসায় বাধ্য হয়ে নুহানকে আসতে হলো।

—————-

জুবায়ের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো। অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান অতিথির জন্য ফুল আনার কথা ছিলো নাফির। এদিকে সে ভুলে মেরে দিছে বিষয়টা।

জুবায়ের এ নিয়ে বেশকিছুক্ষণ বকাবকি করলো নাফিকে। নিজেই ফুল আনার জন্য যেতে নিবে তখনি সে সামনে তাকাতেই থমকে গেলো। সে জানতো শাড়িতে মেয়েদের সুন্দর লাগে। তাই বলে এতোটা সুন্দর লাগে তা জানা ছিলো। মুখে নেই কোনো কৃত্রিমতা তারপরেও কি স্নিগ্ধ লাগছে।

হঠাৎ করেই জুবায়ের এর কপালে ভাঁজ পরলো রোজকে একটা ছেলের বাইক থেকে নামতে দেখে। যে তার জিন্সের পকেট থেকে টাকা বের করে রোজের হাতে দিচ্ছে আর হাসছে। মুহুর্তেই মেজাজ খারাপ হলো জুবায়ের এর। এই ছেলেটা কে হতে পারে ভাবনায় আসতেই কেন যেন বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভূত হলো। পরমুহুর্তেই মাথা দুই পাশে নাড়িয়ে নিজ মনে বলল,
“যা খুশি তাই করুক। জুবায়ের ভুলে যাস না ও তোর শত্রু পক্ষ।”

ছেলেটা হেলমেট খুলতেই জুবায়েরের ছেলেটাকে চেনাচেনা লাগছে। চিনতে পারতেই নিজেই নিজের মাথায় টোকা দিলো জুবায়ের। এটা তো মেয়েটার ভাই। সে কি না কি ভাবছিলো।

রোজ এরমাঝেই নুহানকে বিদায় দিয়ে সামনে এগোলো। জুবায়ের চলে গেলো ফুল আনতে।

রোজ অডিটোরিয়াম আসতেই মালিহা আর আরুশা দৌড়ে এলো। মালিহার পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি আর আরুশার পরনে নীল রঙের শাড়ি। দুইজনই রোজকে দেখে মুখে হাত রেখে একসঙ্গে বলল,
“মাশাআল্লাহ বান্ধবী”

রোজ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তোগো কথা বাদ তাড়াতাড়ি বসতে দে তো আমায়। কখন না আবার আমার শাড়িটা খুলে যায় সবার সামনে।”

অডিটোরিয়াম ইতোমধ্যেই জমজমাট। চারপাশে রঙিন আলো, কৃত্রিম ফুল আর ব্যানারে ভর্তি মঞ্চ। নতুনদের স্বাগত জানাতে সিনিয়রদের উৎসাহের ঘাটতি নেই।

রোজ মালিহা আর আরুশার সঙ্গে সামনের দুটো সারির পরের সারিতেই বসেছে। হালকা স্নিগ্ধ বাতাসে শাড়ির আচল উড়ে যাচ্ছে, রোজ বারবার সেটা সামলাতে ব্যস্ত। সবার সামনে এতবার শাড়ি ঠিক করা তার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরুশা ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন জীবনে শাড়ি পড়িস নি। এমন করছিস কেন?”

রোজ কটমটিয়ে আরুশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই মুখ বন্ধ রাখ। তাছাড়া তোরে সবার সামনে উষ্টা দিয়ে ফেলে দিবো বলে দিলাম।”

এইসব চলছিলো, তখনই মঞ্চের পেছন থেকে ঘোষণা ভেসে এলো,
“আমাদের প্রধান অতিথি চলে এসেছেন। সকলকে তাদের আসনে বসার অনুরোধ করা হচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে আরও কিছুক্ষণ পরে।”

জুবায়ের মঞ্চের একপাশে দায়িত্ব পালন করতে থাকা আবিদের হাতে থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল। ফুল আনতে গিয়ে ঘেমে একাকার বেচারা। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবীটা গায়ের সাথে লেগে গেছে। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো বাম হাতের সাহায্যে পিছনে ঠেলে দিলো। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে স্টেজের উপরে উঠে মুচকি হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলল,
“হ্যালো গাইস, আমি আপনাদের প্রিয় জুবায়ের ইব্রাহিম সায়েম। এরমাঝেই আমাদের মাঝে এসে হাজির হয়েছে যুবক মন্ত্রীমশাই সাফায়েত আল নবী।

জুবায়ের কথা শুনে রোজের পিছনের মেয়েরা হইহই করে উঠলো। একজন তো বলেই উঠলো,
“ইশ কি সুন্দর কথা বলে!ঠোঁটের হাসিটা জাস্ট সেই। একদম চকলেট বয়।”

রোজ বিরক্ত হলো ওদের কথায়। নিজের মনে মনে বলল,
“এই লুইচ্চা বেডিদের কথা শুনলে মনে হয় ওদের মাথার চুল টেনে মুখটা কাঁদায় চুবিয়ে দিই। এরা যারে দেখে তারে দেখেই অস্থির।

এরমধ্যে সাফায়েত স্টেজে উঠতে আরেকটা মেয়ে বলে উঠলো,
“মন্ত্রীমশাইও কম যায় নারে বান্ধবী।”

রোজে বিরক্তি বাড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে বসে রইলো। মালিহা রোজকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
“কিরে এতো চুপ করে আছিস কেন? কথা কইলে কি লিপস্টিক মুছে যাবে নাকি!”

রোজ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“নারে লাল মহিষের সুনাম শুনতে শুনতে আমার বলার ইচ্ছা মরে গেছে।”

আরুশা অবাক হয়ে বলল,
“লাল মহিষ আবার কে?”

রোজ তাকালো স্টেজে দাঁড়িয়ে সাফায়েতের হাতে ফুল তুলে দেওয়া জুবায়েরের দিকে। রোজের চোখ অনুসরণ করে আরুশা আর মালিহা তাকাতেই দুইজনের হাত আপনাআপনি মাথায় চলে গেলো।

জুবায়েরের চোখ মঞ্চের উপর থাকলেও মাঝেমধ্যে চোখ চলে যাচ্ছে রোজের দিকে। রোজ হুট করে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুইজনের। জুবায়ের অন্যদিকে তাকালো। এমন ভাব ধরলো যেন সে রোজ কেন এদিকেই তাকায়নি।

রোজ চোখ ছোট ছোট করে জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে আরুশাকে কুনুই দিয়ে ধাক্কিয়ে বলল,
“দেখ ওই লাল মহিষ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।”

আরুশা জুবায়ের এর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে হেসে হেসে কথা বলছে সাফায়েতের সাথে। আরুশা তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে বলল,
“ধুর উনি তোর দিকে তাকাতে যাবে কেন? তোর মনের ভুল।”

আরুশা গুরুত্ব না দিলেও রোজের মনটা খুতখুত করছে।

#চলবে