#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#সূচনা_পর্ব
দীর্ঘ কয়েক বছর পর নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে থমকে গেল তনয়া। তার নির্লিপ্ত আঁখি দুটি চঞ্চল হয়ে উঠল। ওষ্ঠজোড়া কাঁপছে। সে তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিঞ্চিৎ দূরে। হয়তো এখনো দেখেনি তাকে। কিন্তু তনয়া দেখেছে। তাকে দেখামাত্র তার শরীর ঝনঝন করে উঠল। পুরো শরীর কেঁপে উঠল আচমকা। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাতের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এয়ারপোর্টে এসেছিলো তাদের কোম্পানির ক্লাইন্টদের রিসিভ করতে। কিন্তু তন্ময়কে দেখামাত্র যেন তার সমস্ত টাই গুলিয়ে গেল। শরীফ তাকে ডেকে বলল, “কি হলো তনয়া? আর ইউ ওকে? শরীর খারাপ লাগছে তোমারে?”
তনয়া কপালের ঘাম মুছল। থেমে থেমে বলল, “একটু শরীর খারাপ লাগছে। তুমি একটা কাজ কর না শরীফ। ক্লাইন্টদের নিয়ে হোটেলে চলে যাও। পারবে না যেতে!”
“অবশ্যই পারব। কঠিন কি? তুমি একা ফিরতে পারবে।”
“পারব। আমি একটু ওয়াশ রুমে যাচ্ছি!”
তড়িখড়ি করে সেখান থেকে চলে গেল। সে কোনভাবেই চায় না এই দীর্ঘ বছর পর তন্ময়ের মুখোমুখি হতে। বহু কষ্টে মনকে বুঝিয়েছে। তবু যদি ভালোবাসাটা দুতরফা হতো। এই এক তরফা ভালোবাসার চরম ব্যাথা/য় ক্লান্ত সে। কুঁকড়ে গেছে। মনে মনে যতো ভালোবেসেছিলো তার চেয়ে দ্বিগুণ সে কষ্টটাই পেল। অবাক করার কথা হলো, অপর ব্যক্তি সেই কথাটা জানতেও পারলো না! ভালো তো আজও বাসে। এই কথা ভাবলে হৃদয়ে অসহ্য য/ন্ত্রণা শুরু হয়। কান্না পায় ভীষণ। আফসোস হয় এটা ভেবে, এই মানুষটি কখনো তার ভালোবাসা টের পেলো না। কখনোই না!
তন্ময় যখন বলল সে তরী কে ভালোবাসে তখন বহু কষ্টে সে হেসে উঠেছিলো। অজুহাতে দূরে সরে গিয়ে চোখের অশ্রু মুছে ফেলল। কেউ জানতে পারল না সেটা। তার অজান্তেই সে যেন তন্ময়কে প্রচন্ড রকম ভালো বাসতে শুরু করল। এই কথা জানা সত্ত্বেও! সে কখনো তার হবে না! তবুও ভালোবাসা কমল না। একটি বারের জন্যও না! ওয়াশরুম থেকে মুখ হাত ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুছে নিল। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সামনের আয়নাতে। মনকে শক্ত করল। না, বহু বছর পেরিয়েছে। একা একা এভাবে কষ্ট পাওয়া তাকে মানায় না। মুভ অন করতে হবে। এই কথা এর আগেও বহুবার বলেছে কিন্তু কখনোই সম্ভব হয়নি। সে পারেনি। অনেকটা দুর্বল মনের অধিকারী তনয়া। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলো। জেন্স আর লেডিস টয়লেট পাশপাশিই ছিলো। সে বেরিয়ে আসতেই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের সাক্ষী হলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে তন্ময়। না চাইতেও তাদের দেখাটা হয়েই গেল। এমনটাই বহুবার হয়েছে। যতবার চেয়েছে দূরে সরে যেতে ততোবারই যেন কাছে চলে এসেছে।
একরাশ বিস্ময় নিয়ে তনয়া চেয়ে রইল। তন্ময় চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। এতো বছর পর পুরনো বন্ধুকে দেখতে পেয়ে সে যেন বিরাট খুশি। শেষবার দেখা হয়েছিল দেশ ছেড়ে চলে যাবার সময় আজ আবারও।
“কিরে তুই! তনয়া! এতো বছর বাদে, এখানে। আই কান্ট বিলিভ ইট। আমি ভাবতেই পারিনি তোর সাথে দেখা হবে। জানিস, ফ্লাইট থেকে নেমেই প্রথমে তোর কথা মনে পড়ল। কিন্তু ভাবিনি এতো তাড়াতাড়ি দেখা হবে। কিরে? এভাবে কেন তাকিয়ে আছিস? কিছু বল! তনয়া!”
তনয়া ভিমড়ি খেয়ে উঠল। তন্ময় তার সামনে দাঁড়িয়ে। দেখতে সুদর্শন! একটু না বেশিই। লম্বা ও হবে হয়তো ৬ ফুটের কাছাকাছি। কি জানি? সে কখনো মাপে নি। তবে তার চেয়ে ভালোই লম্বা। তনয়া হা হয়ে দেখছে। হ্যাঁ, এখনো এক রকমই আছে। শুধু মুখের দাড়ি টুকু জুড়েছে। আগে তো ছিলো না। তন্ময় বলেছিলো সে দাড়ি রাখতেই চায় না। হঠাৎ মন বদল হলো কি? খুশিতে তন্ময় জড়িয়ে ধরতে না পারুক হাতটা চেপে ধরল। বলে উঠল, “ওহ গড! এটা রিয়েল। না, আমি ভাবছিলাম স্বপ্ন দেখছি নাকি? আচ্ছা তুই জানলি কি করে আজ আমি দেশে ফিরছি। আই’ম রিয়েলি সারপ্রাইজ!”
তন্ময় কথা বলে ভালো। তনয়া মৃদু হাসল। এই ছেলেটা মিশুকে। সবার সাথে মিশে যায়। তার সাথেও গিয়েছিলো! আচমকা মনে পড়ল সে ছুঁয়ে আছে। ঘোরে চলে গেল। তন্ময় তাকে টেনে বের করল।
“স্ট্রেইঞ্জ! তুই কি বোবা হয়ে গেলি? কথা বলতে পারিস না। ভুলে গেছিস?”
তনয়া হাত ছাড়িয়ে বলে উঠল, “কথা বলতে কেউ ভুলে যায়।”
“তাহলে এতোক্ষণ বো/বা হয়ে ছিলো কেন? কি, আমায় দেখে! হ্যান্ডসাম হয়ে গেছি বস তাই না।”
“হুম তা অনেকটা!” ফিরে চাইল ঠিক করে। এতোক্ষণের দেখায় ও যেন ঠিক করে দেখা হলো না। না এটা অজুহাত! তাকে দেখলেই শুধু দেখতে হচ্ছে করে। তন্ময় দেখতে অনেক ফর্সা! একটু বেশিই। ওর চুল গুলো হালকা বাদামী রঙের। এর কারণ আছে বৈকি। ওর মা ছিলো বিদেশিনী আর বাবা দেশীয়। তাই একটু মিক্সড টাইপের। যেমন মায়ের গায়ের রং, ধবধবা সাদা, বাদামী চুল, বাদামী চোখ সবকিছু্ই সে পেয়েছে। আবার চেহারার গঠন কিছুটা বাবার মতো। তনয়া পা থেকে মাথা অবধি চাইল। পুরোটাই কালো। কালো জুতা থেকে শুরু করে কালো জ্যাকেট। মৃদু স্বরে বলল, “হ্যাঁ, হ্যান্ডসাম লাগছে বটে।”
”সেটা তো আমি শুরু থেকেই। আচ্ছা এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবি নাকি? লোকজন অন্যকিছু ভাববে। আয় কফি শপে যাই। অনেক কথা আছে তোর সাথে!”
বলেই খপ করে তনয়ার হাতটা ধরে ফেলল। তনয়া কি চায় সেটাও জিজ্ঞেস করল না। সে ধরেই নিল তনয়া তার সাথে যাবে। আর সেটাই হলো!
.
কফি শপে দুজনে বসে আছে। পাশেই তন্ময়ের ট্রলি ব্যাগ। একটা না অনেক গুলো। সেদিকে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে তনয়া শুধালো, “তুই কি একবারের জন্য চলে এসেছিস?”
তন্ময় মাথা নাড়ল। এর মধ্যে ওয়েটার দুটো কফি মগ নিয়ে এলো। তনয়া নিজের কফি মগে হাত দেবার আগেই তন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, “ওয়েট!” বলেই সেটা কেড়ে নিল। প্রথমে নিজের কফি মগে চুমুক দিল। অতঃপর ওটাতে! তনয়ার কফির টেস্ট ভালো। সেটা নিজের কাছে রেখে বলল, “এটা তোমার জন্য!”
তনয়া কিঞ্চিত হাসল। এটা বহু আগের অভ্যাস তার। তনয়া সামনে কফি মগটা আঁকড়ে ধরল। চেয়ে রইল দৃষ্ট আঁখিতে। এখানেই তো চুমুক দিয়েছিলো ও! আচমকা কি ভেবে শুধালো, “তুই একা কেন? ও আসেনি!”
মূহুর্তের মধ্যেই চোখে মুখের রঙ পাল্টে গেল তন্ময়ের। তাকে দেখতেই যেন মনের ভাষা পড়ে নিল তনয়া। মনে মনে যা ভাবছিলো তাই। তরী আর তার সম্পর্ক টিকলো না তবে! সে কি অনেক কষ্ট পেলো! পাবার তো কথাই। কতোই না ভালো বাসত। এ তো দুদিনের প্রেম নয়। বহু বছরের প্রেম। তার জন্যই তো সে তাকে ছেড়ে বিদেশ চলে গেল কয়েকবছর আগে। তখন তনয়া সবে অনার্স শেষ করেছে। মাস্টার্সের পাশাপাশি একটা চাকরির যেন খুব দরকার ছিলো। তন্ময় তখন মাস্টার্স করতে চলে গেল দেশের বাইরে। হ্যাঁ, সেটা তো অজুহাত। আসল কারণ ছিলো তো তরী! তার জন্যই সব ফেলে তার চলে যাওয়া।
তন্ময় হঠাৎ হেসে উঠল! বলল, “ওই আর টিকলো না!”
“এতো সহজে?”
“সহজ কোথায় ছিলো? কতো ঝগড়া, কতো অভিমান। শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। শেষে ভাবলাম সব না হয় শেষ করে দিই!”
“আর শেষ হয়ে গেল!”
চাপা হাসি হাসল সে। তার এই চাপা হাসিতে কতো শত ব্যাথা লুকিয়ে আছে তনয়া টের পেলো। এই মেয়েটার জন্য কম তো করেনি। রাগ হচ্ছিল তনয়ার। এই মেয়ের জন্য তন্ময় তার ফ্যামিলি বন্ধু সব ছেড়ে চলে গেল আর সেই মেয়েটা কি না! আহ, আর ভাবতে পারছে না। মুখের দিকেও তাকানো যাচ্ছে না। ও যেন ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। তনয়া করা ঘুরানোর চেষ্টা করল, “আচ্ছা। এখন কোথায় যাবি? বাসায়! আঙ্কেলের সাথে সবকিছু ঠিক হয়েছে?”
তন্ময় ফের হাসল। মাথা দুলিয়ে বলল, “না ঠিক হয়নি কিছু। বাবা তো শেষবার বলেই ছিলো আমার মুখ আর দেখবে না। আমিও দেখাই নি।” অতঃপর কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল, “যাবো এক বন্ধুর বাসায়। সেখানেই কিছুদিন থাকব। ওখানে থাকতে একটা কোম্পানিতে সিভি জমা দিয়েছিলাম। তারা এপ্রুভ করেছে। এবার ইন্টারভিউ দিয়ে দেখি। জব ফাইনাল হয়ে গেল আমিও এখানে ফাইনাল! হি হি!” দাঁত বের করে হেসে ফেলল। তনয়া দু হাতে কফি মগ চেপে ধরল। ফাইনাল মানে! ও কি তাহলে আবারো চলে যাবে। না এমনটা এবার হতে দেওয়া যায় না। আবার যখন তাকে ফিরে পেলো এবার আর হারাতে দিবে না। মুচকি হেসে আশ্বাস দিয়ে বলল, “সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে!”
”জানি! তুই সাথে থাকলেই আমার সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।”
”আমি সাথে থাকলেই হয়!”
“হ্যাঁ, হয় তো। এই তো তোর সাথে দেখা গেল দেখবি আমার চাকরি ফাইনাল হয়ে যাবে। আমি শিউর! তুই হচ্ছিস আমার লাকি চার্ম, বুঝলি তনয়া।”
তনয়া বিস্মিত বিমূঢ়! খুশিতে আনন্দে তার গাল দুটো যেন লাল হতে শুরু করল। মাথা নামিয়ে সে মিটিমিটি হাসল। তন্ময় ওসব খেয়াল করেনি সেভাবে। বলে উঠল, “দ্রুত শেষ কর! আমাকে উঠতে হবে!”
তনয়া মাথা দুলিয়ে দ্রুত কফি মগে চুমুক দিলো। সাথে সাথে তার জিহ্ব পুড়ে গেল। আহ,কি কাণ্ড! সে দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে হাতে ধরিয়ে দিলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,“ঠিক আছিস! আহ কি যে করিস না তুই। দেখে খেতে পারিস না। চোখ কোথায় থাকে তোর!”
তনয়া শব্দ করে হাসল। তন্ময় হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। তাকে বিচলিত দেখে তনয়ার যেন ভারী খুশি। তার আনন্দ লাগছে। সে তাকে বকছে!
#চলবে