#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২
তনয়া বাসায় ফিরে আসল। ঘরের সামনে তালা ঝুলছে। চাবি সাথেই ছিলো। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট। মাঝে বিশাল একটা ড্রয়িং রুম। এর এক কোণায় পুরনো সোফা নতুন পোশাকে রাখা হয়েছে। মাঝে একটা টি টেবিল। ব্যস এতো টুকুই। জুতো জোড়া ভেতরে রেখে দক্ষিণ দিকের ঘরে গেল। ওটা তারই রুম। পাশের ঘরে মৌ থাকে। এই দু রুমের একটা মাত্র বাথরুম যেটা রান্নাঘরের পাশে। দুই বান্ধবী শেয়ারে এই ফ্ল্যাটে থাকে। তনয়া এতিম। তবে তার আত্মীয় স্বজন কিছু হলেও আছে। মা বাবাকে দশ বছর বয়সে হারিয়ে ফেলে। ট্রেন দুর্ঘটনা/য় মারা যায় তারা। এর পর থেকেই এক খালার কাছে মানুষ। ফুফু ছিলো, মামা ছিলো। তবে কেউ তার ভার সামলাতে চায়নি। মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিল তনয়া। ছোট তাদের পরিবার। কিন্তু মা বাবাকে হারিয়ে তনয়া পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে ফিরল। অর্নাসে পড়ার আগ অবধি খালার কাছেই ছিলো। খালার তিন ছেলে মেয়ে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি পাঠানো হয়েছে অনেক আগেই। আর তার দুই ভাই ও বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে। দুই ভাইয়ের বউ কে নিয়ে খালার থাকতেই কতো শত যন্ত্রণা। সেখানে আর সে ঝামেলা বাড়াতে যায় নি। চলে এসেছে আলাদা। ভাইয়েরা তো বিয়েও ঠিক করেছিলো। বহু ঝামেলা পাকিয়ে এডমিশন দিয়েছিল ভার্সিটিতে। ভাগ্যের জোরে ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তিও হয়ে যায়। ব্যস! এরপর আর পিছন ফিরতে হয়নি। তাই তো অর্নাসের পরপরই একটা চাকরি জুটে গেল। মাস্টার্সও শেষ করেছে দু বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। বয়স হচ্ছে। মাঝে মাঝেই খালা আসে দেখা করতে। সাথে থাকে তার একমাত্র নাতি। বড় ভাইয়ের ছেলে। ভালোই বড় হয়েছে সে। খালার ও বয়স বেড়েছে। চুল পেকে যাচ্ছে। বুড়িকে দেখলেই মনে হয় কাল তার শেষদিন অথচ সে এসে বিলাপ গাইতে শুরু করে। তনয়ার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে করছে না কেন? কতো শত ছেলের ছবি অবধি দেখাল। অথচ তনয়া বিয়ে করতে নাকোচ। তার কারণ বোধহয় ছিলো তন্ময়! যাক তবে সেসব। তন্ময় বোধহয় এতোক্ষণে হোটেলে পোঁছে গেছে। হ্যাঁ, মেসেজ এসেছে। ফোন নাম্বার আবারো এক্সচেঞ্জ হয়েছে। তন্ময় জিজ্ঞেস করেছিলো, “তোর আগের ফোন নাম্বার টা কি হয়েছিলো? কতো ফোন দিলাম কিন্তু একবারও গেলো না!”
তনয়া হাসল! মুখ ফুটে বলল, “ফোনটা ছিনতাই হয়ে গেছিলো!” মিথ্যে বলল! তার মনের ভেতর কেমন শান্তি শান্তি লাগছিলো। এতো দূরে গিয়েও তন্ময় তাকে ভুলে যায়নি তবে। খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু সে তো সবকিছু পিছনে ফেলে চলে এসেছিলো। শুধু ফেলে যেতে পারেনি তন্ময় কে। তন্ময়ের স্মৃতিগুলোকে! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিছানার উপর বসে পড়ল। পর্দা ভেদ করে তীব্র বাতাস ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। এই ঘরে আজ সে অনেক বছর। নিজের মন মতো সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে প্রতিটা জিনিস। তার ছোট টেবিলের উপর পুরনে ফ্যামিলি ফটো। মা বাবা আর সে!
ধপ করে বিছানার উপর শুয়ে পড়ল তনয়া। জীবনের অনেকটা সময় তার পেরিয়ে গেছে। পঁচিশের গণ্ডি পেরিয়ে যাবে কিছু মাস পর। যৌবন ফুরিয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। অথচ এখনো হাত ধরার এমন একটা মানুষকে পেলো না সে। হয়তো খোঁজার চেষ্টাই করেনি। বিছানা থেকে উঠে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজেকে দেখতে লাগল খুতিয়ে। বহু দিন পেরিয়ে গেছে এভাবে নিজেকে দেখে না। চুল গুলোর বেহাল অবস্থা! চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। কপালে দুটো ব্রন হচ্ছে বোধহয়। কেন এতো অযত্ন তার! আজ হঠাৎ যত্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছেই বা কেন? তন্ময়ের জন্য! সামনে থেকে খোঁপা নিয়ে চুলগুলো বাঁধল। সে কি করছে জানে না কিন্তু তার মন চাইছে এমনটা করতে। ইনকাম তার কম নয়। যা পায় তার একার মানুষের দিব্যি চলে যায়। প্রতি মাসে কিছু হাত খরচ ও দেয় খালা কে। তিনি ছাড়া আর কে আছে? ভালো একটা জব ও তার। বিরাট বড় একটা কোম্পানিতে জব করে। এসকে শেহনেওয়াজ চৌধুরী লিমিটেড কোম্পানি। তাদের কোম্পানি বিভিন্ন ধরণের গ্রোসারি আইটেম তৈরি করে। কোম্পানির গ্রো ভালো। দেশের প্রায় প্রতিটা সেক্টরে তাদের পণ্যের মান ভালো। ঢাকায় দুটো ফ্যাক্টরি ছাড়াও আর ৫ টা ফ্যাক্টরি আছে তাদের। বিরাট বড়লোক তার বস। সেই কোম্পানির অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার তনয়া। ইনকাম কি আর মন্দ তার!
এটিএম বুথ থেকে কিছুটা টাকা বের করল। অনেকদিন কেনাকাটা করেনি। আজ করবে! যদিও ফালতু খরচ করার স্বভাব তার কখনোই নেই তবে আজ তার মন চাইছে। ঘুরে ঘুরে ভালোই শপিং করল। তন্ময়ের জন্য একটা ভালো শার্ট ও কিনল। বেশ পছন্দ হয়েছিল। দেখেই মনে হচ্ছিল তন্ময় কে মানাবে। এরপর সোজা চলে গেল স্যালনের। আজ নিজেকে টাইম দিবে। ভেবেছিল শুধু ফেসিয়াল করবে। কিন্তু স্যালনের আপুর ফাঁদে পড়ে চুল কাটিয়ে নিল। তার আগে শ্যাম্পু, হেয়ার ট্রিটমেন্ট এর আলাদা ফি তো ছিলোই। ভালোই খরচ হয়েছে। না আর কিছু করা যাবে। বাসায় ফিরে আয়নায় নিজের চুলগুলোকে বার বার দেখছে। একটু বেশিই যেন কেটে ফেলেছে। ইশ, বলা দরকার ছিল। যদিও সে বার বার বলেই ছিল কিন্তু ওতোটা জোর দিয়ে বলেনি। কিন্তু হঠাৎ নিজের এই বদলে অনেকটা স্যাটিসফাইড সে।
.
তনয়ার ফিরতে ফিরতে ৮ টা। সাড়ে ৮ টার দিকেই আবারো কলিং বেল বেজে উঠল। মৌ এসেছে বোধহয়। দরজা খুলতেই তনয়া কে দেখে ভ্যাবাছ্যাকা খেলো মৌ। ক্লান্তির ছাপ চোখ মুখে অথচ উৎসুক কণ্ঠে বলে উঠল, “কি ব্যাপার? তোকে হঠাৎ এতো সুন্দর সুন্দর লাগছে কেন?”
তনয়া দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। “কিসের কি বলছিস?”
“এই তুই চুল কেটে ফেললি? এতো খানি!”
“না, ওই বলেছিলাম একটু কাটতে এতোখানি কেটে দিছে।”
থিতুনিতে হাত রেখে বলে উঠল, “ব্যাপার কি? মনে হচ্ছে অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস! ফেসিয়াল করালি নাকি। হুমম। ঠিক ধরেছি। কি হলো হঠাৎ বল না? কার প্রেমে পড়লি আচমকা?”
“কারো প্রেমে না। সর তো এখান থেকে!”
ঘরে ঢুকে গেল তনয়া। মৌ পিছন পিছন হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল। বলল, “ফ্রেস হয়ে আসছি! তখন শুনব কে এলো?”
মৌ হচ্ছে তনয়ার একমাত্র বান্ধবী। ছোট বোনের মতো। তারা দুজনেই দুজনের খুব কাছাকাছি। মৌয়ের মা বাবা দুজনেই অন্য শহরে থাকে। শুরুতে মৌ পড়াশোনার জন্য এখানে এসে থাকা শুরু করে এখন অবশ্য চাকরিও করছে। মৌ এবার অর্নাস ফাইনাল ইয়ারে সাথে আবার ছোট একটা জব ও করে। তনয়া খাবার বাড়ছে। মৌ এসে সোজা খাবার টেবিলে বসে পড়ল। দুজনে সবে খাওয়া শুরু করেছে। মৌ ফোনে ব্যস্ত। তনয়া খেতে খেতে বলে উঠল, “তন্ময় এসেছে!”
“কি! সত্যি!”
“হ্যাঁ।”
“এবার বুঝলাম। এই তবে ব্যাপার! এতো সাজগোজ এতো প্রস্তুতি কিন্তু ওর তরী…
তনয়া জবাব না দিয়ে একমনে খেতে লাগল। মৌ ফের খোঁচা মেরে বলল, “বলো না।”
“ভেঙে গেছে সম্পর্ক!”
“ওহ, তাই এখন তোমার কাছে ফিরে এসেছে।”
“এমন কিছু না ।”
“দেশে ফিরে এসেছে মানে তো তোমার কাছেই।”
“এমনটা মোটেও না মৌ।”
“হ্যাঁ, সেটাই তো। কারণ তরী কে খুব ভালবাসত। কিন্তু তুমি যে এখন নিজের করতে চাইছো।”
“সুযোগ আছে তাই।”
মৌ মৃদু হেসে বলল, “সম্পর্ক ভেঙেছে, ভালোবাসা শেষ হয়নি কিন্তু!”
তনয়া চুপসে গেলো। এই সত্যটা এতোক্ষণ সে শুনতে চাইছিলো না। এখন শুনতে পেরে আর ভালো লাগছে না।
.
পরদিন অফিসের ম্যানেজার দেখে প্রশংসা করে বলল, “আজ বেশ গ্লো করছো তুমি, বিউটিফুল লেডি!”
তনয়া হেসে উড়িয়ে দিলো। ম্যানেজার সাহেব মধ্য বয়স্ক লোক। তবে একটু ফানি টাইপের। কেবিনে নক করে ঢুকল শরীফ। তনয়াকে দেখেই শুধালো, “এখন কেমন আছো?”
“হুম ভালো!“
ম্যানেজার সাহেব বলে উঠলেন, “তোমাদের দু’জনকে ডেকেছি একটা কাজে। আজ কয়েকটা ইন্টারভিউ আছে। বস নিজে বলেছে তাদের ইন্টারভিউ নিবে। তাই একটু দেখে। তনয়া, এখানে সবার ডিটেলস আছে। তুমি গিয়ে স্যারের রুমে রেখে আসো।”
“ওকে স্যার।” বলে কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল তনয়া। স্যারের কেবিনের দিকে যেতেই চোখ পড়ল রিসেপশনে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে তন্ময়। কাছে এগিয়ে এসে তন্ময় কে দেখতে পেয়ে যেন একটু ঘাবড়ে গেল। তন্ময় এখানে! তবে কি ও এখানের জবের কথা বলছিলো। কাগজপত্র গুলো উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। হ্যাঁ, তন্ময় ও আছে! চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে লাগল। চাইল, তন্ময়ের চাকরিটা যেন এখানেই হয়। তবে তার পাশে পাশে থাকতে পারবে সে!
#চলবে