#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩
অলৌকিক ঘটনা বলবে নাকি ভাগ্যের লিখন। তবে কি তনয়ার ভাগ্য এবার তার সঙ্গ দিচ্ছে। তন্ময় কে নিজের করে পাবার ছোট্ট যে কুঁড়ি নিজের মনে ফুটে উঠেছে কিছুদিন পরেই সেটা পদ্মা ফুলের আঁকার ধারণ করবে। কিন্তু পদ্মের মতো আদৌও হতে পারবে তো তার জীবন। তন্ময় এখন তার কলিগ। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে একদিন প্রাণ পণে সে আশা করেছিলো তন্ময়ের চাকরিটা হয়ে যাক আজ সেখানে দাঁড়িয়েই দুই কলিগ আড্ডা দেয়, কথা বলে। তন্ময় নতুন জয়েন করেছে প্রায় দুটো মাস পেরিয়ে গেছে। তনয়া সিনিয়র হবার সুবাদে কাজকর্ম সবটাই বুঝিয়ে দিয়েছে। এতে কাছাকাছি এগিয়েছে কি তাদের সম্পর্ক। কি জানি? হয়তো! কিছু না বুঝলেই তন্ময় ফাইল হাতে ছুটে আসে তনয়ার কাছে। তনয়া যত্ন সহকারে তাকে বুঝাতে শুরু করে। বাকিদের নজরে পড়ে সবটা। তারাও কানাঘুষা শুরু করে। করবে নাই বা কেন? অফিসের শুরু থেকে শেষ অবধি তন্ময় আর তনয়া একসাথে। লাঞ্চ টাইমেও দুজন একসাথে। আবার বাড়িও ফিরে একসাথে। তন্ময় কিছুদিন আগেই নতুন একটা বাইক কিনেছে। সেই বাইকে চড়ে তন্ময় তাকে ছেড়ে আসে। বাইকের পেছনে বসে তনয়া হাত রাখে তন্ময়ের ঘাড়ে। তন্ময় বলে উঠে, “ভালো করে ধর। না হলে পড়ে যাবি। তখন আমার দোষ দিলে কোন লাভ হবে না।” তনয়া হেসে উঠে। সে তো চায় জড়িয়ে ধরতে কিন্তু পারে না যে!
বিদেশ থেকে তন্ময়ের একটা নেশা খুব ভালো হয়েছে। সে হচ্ছে ম/দের নেশা। হ্যাঁ, অ্যালকোহল। একদিন তাদের অফিসের জ্যোতি বলছিলো, “তন্ময় ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ। সবসময় হাসি মুখে থাকে। মজার মজার কথাও বলে। ছেলেটার সাথে তোমার কিছু চলছে নাকি তনয়া?”
“আমার! কই না তো।”
“না, তোমাদের যে দেখি সবসময় একসাথে থাকতে। আর থাকলেও বা খারাপ কি ভালোই তো হয়।”
তনয়া হাতের কাছে কাগজগুলো গুছাতে গুছাতে বলে, “ওই, আমরা ছোট বেলার বন্ধু কি না তাই। কিন্তু ওমন কিছু না গো!”
বলেই সরে আসে। সবার কাছে তন্ময় সুখী মানুষ। হাসিমুখে থাকে বলেই তার ভেতরের দুঃখটা কেউ বুঝে না। কিন্তু তনয়া বুঝে। তাকে যেন খুব ভালো করেই বুঝতে পারে। ভেতরে ভেতরে তন্ময় কষ্ট পাচ্ছে। কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করছে। এসব তনয়া তন্ময়ের চোখ দেখলেই বুঝতে পারে। কিছু বলার দরকার পড়ে না।
.
অফিসে নতুন ঘোষণা পরেছে। অফিসিয়ালি এবার নতুন বস আসবে। শেহনেওয়াজ স্যারের বড় ছেলে শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী! দুই তিন পরেই তিনি জয়েন করবেন। তাকে স্বাগত জানানোর পর অফিসের সকলে উঠে পড়ে লেগেছে। নতুন স্যার নাকি অনেক বদমেজাজি। দু তিন জন ভয় করছে তাদের চাকরি নিয়ে। এসেই না আবার ছাঁটাই করা শুরু করে। জান হাতে নিয়ে বসে আছে তারা। সকাল থেকে সেইসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলো তনয়া। ম্যানেজার স্যারের কথা মতো গত বছরের সব কাগজপত্র তনয়া গুছিয়ে রেখেছে। নতুন স্যার চাইলেই যেন হাতের কাছে পায়। কাজ শেষ করতে করতে রাত ১০টা পেরিয়ে গেছে। অফিসে কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। তন্ময়ের শিফট শেষ হয়েছিল সেই ৭ টার দিকে। সে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু তনয়া তাকে অপেক্ষা করতে নিষেধ করল। বলল বাড়ি ফিরে যেতে। তার বেশ দেরি হবে। ৯ টার দিকে বাকি সবাই বেরিয়ে গেল। তনয়া বের হতে হতে গেটের সামনে দারোয়ান চাচা কে দেখল। তিনি নাইট ডিউটি দিচ্ছিলেন। তনয়া কে দেখতে পেয়েই দাঁড়িয়ে গেল। বলল, “ম্যাডাম, আপনিই ছিলেন ভেতরে। সবাই তো বেরিয়ে গেছে।”
“হ্যাঁ, ওই একটু কাজ বাকি ছিলো। একদম শেষ করে বের হলাম।“
“আপনে এদিক দাঁড়ান। আমি একটা সিএনজি ডেকে আনি। এখন তো কিছু পাবেন না।”
তনয়া মুচকি হেসে গেটের কাছে দাঁড়ায়। দারোয়ান চাচা রাস্তার ওদিকে চলে গেল। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল। ভাবল তন্ময় কে ফোন দিবে। এর মধ্যেই চাচা ফিরে এলেন। ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলেন। হেসে বললেন, “পাইছি ম্যাডাম। আপনি যান!”
“আচ্ছা চাচা!”
তনয়া সিএনজিতে উঠে বসল। এর মধ্যেই তন্ময় কে ফোন দিল। পর পর কয়েকবার ফোন বাজল। ওপাশ থেকে কেউ তুলছে। এতো তাড়াতাড়ি কি ঘুমিয়ে গেলো? এসব কথাই ভাবছিলো। এর মধ্যেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো,
“হ্যালো।”
“এতোক্ষণ লাগে ফোন ধরতে। কখন থেকে ফোন করছিলাম।”
“কিচেনে ছিলাম। বল, কাজ শেষ হয়েছে।”
“হ্যাঁ, হয়েছে।”
“কিছু খেয়েছিস? না খেয়ে থাকলে বাসায় চলে আয়। একসাথে ডিনার করি।”
“এখনো ডিনার করিস নি?”
“না। তোর প্রিয় ইলিশ পোলাও ধারলাম। ভাবলাম তোর সাথেই খাই। চলে আয়!“
“তুই আবার রান্না করতেও পারিস নাকি? কই মনে নেই তো। আমি তো জানতাম তুই বাইরে থেকে খাবার আনিস। আচ্ছা আসছি আমি।”
ফোন কাটল। মামা কে বলল ওই দিকের রাস্তায় চলুন। সিএনজি চলছে। রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলছে তবে কম। তনয়া মনে অনেক রকম আশা। হঠাৎ রাস্তায় মৃদু হাওয়া তার উত্তেজনা কে বাড়িয়ে দিল। শরীর শিউরে উঠল। হঠাৎ করেই মন বদলাতে শুরু করল। সিএনজি এসে থেমেছে চার তলা একটা ভবনের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে তনয়া বেরিয়ে এলো। তিনতলায় থাকে তন্ময়। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। বোধহয় বৃষ্টি হবে। কলিং বেল বাজাতেই তন্ময় দরজা খুলে দাঁড়াল। মুচকি হাসি তার ঠোঁটের কোনে। ঘরে ঢুকতেই বলল, “ফ্রেস হয়ে আয়। আমি খাবার বাড়ছি!”
তনয়া মাথা দুলিয়ে ঘরের দিকে আগাল। পুরো একটা ফ্ল্যাট। তন্ময় একাই থাকে। অন্য জনের সাথে তার রুম শেয়ার কখনোই পছন্দ নয়। ও মানুষটা মিশুকে হলেও ভিতরে ভীষণ একা। সবসময় চায় একাকীত্ব তাকে আগলে ধরুক।
তন্ময়ের বেডরুমে এসে থমকে দাঁড়াল। এখানেই ঢুকে পড়বে। পড়ুক না সমস্যা কি? কে আছে এখানে তাদের যাচাই করতে। ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি ছিটালো। সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। সরতেই চাইছে না। অথচ সে খুব চেষ্টা করছে নিজেকে প্রাণবন্ত দেখাতে। ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে ঠোঁট রাঙাল। নিজেকে আয়নায় দেখতে খুব বিচলিত লাগছে। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। কি মনে করে বেরিয়ে যেতেই আবারো ফিরে চাইল। ব্যাগের ভেতর তার পারফিউম টা আছে বোধহয়। খুব অল্প করে তার গায়ে মাখল কিছুটা। অতঃপর বেরিয়ে গেলো। টেবিলে খাবার সাজানো। তনয়া কে দেখতে পেয়েই তন্ময় চেয়ার এগিয়ে দিলো। বলল, “বস না!”
তনয়া বসে পড়ল। দুজনে একসাথে খেতে বসেছে। ছোট ছোট সাইজের টেবিল। এর এক প্রান্তে সে অন্য প্রান্তে ও। তন্ময় মাছের কাঁটা বাছতে পারে না। আজ সে কি না ইলিশ মাছ রেঁধেছে। ভাবতেই অবাক লাগছে। কার জন্য এতো কিছু? তনয়ার জন্য! ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল তনয়া। হেসে উঠল, খাবার মুখে দিয়ে বলল, “বেশ হয়েছে।”
“ছাই হয়েছে। লবণ বেশি হয়ে গেছে।”
“অসুবিধে নেই। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমার দ্বারা কিছু হবে না বুঝলি। তোকে ডাকার আগে খাবার চেখে দেখা উচিত ছিলো।”
“হয়েছে। ছাড় না! তো এতো দিনে কি একবারও রান্না করিস নি তোর প্রেমিকার জন্য।”
“না, ওসব তো ওই করতো। মানে আমরা দুজন। একসাথে ব্রেকফাস্ট বানাতাম আবার ডিনার। লাঞ্চ টা আবার বাইরেই করা হতো।”
“ওহ আচ্ছা!”
বলেই ঢোক গিলল তনয়া। খাবার এখন আর তার পেটে ঢুকছে না। ক্ষিধে যেন মিটে গেছে এর মধ্যেই। তন্ময় উঠে দাঁড়িয়ে খাবার প্লেট হাতে নিয়ে বলল, “বুঝেছি এই অখাদ্য তোর পেটে ঢুকবে না। দেখি দে আমায়।”
“আরে না। আমি খাবো বললাম তো। খুব মজা হয়েছে। তুই ছাড় এটা।”
“এরপর হসপিটালে ভর্তি থাকলে আমায় দোষ দিবি না একদম বলে দিলাম।”
তনয়া মুখ ভেংচি কাটল। খেতে শুরু করল আবারো।
.
ঘড়ির কাঁটায় এখন সাড়ে ১১ টা বাজে। তনয়া হাত ধুয়ে নিচ্ছে। তন্ময় হঠাৎ এসে বলল, “বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।”
“সমস্যা নেই। আমি যেতে পারব।”
“বলছি তুই বরং রাতটা থেকে যা। এক্সট্রা রুম তো আছে কিন্তু খাট নেই। অসুবিধে নেই আমি সোফায় ঘুমিয়ে পড়ব। তুই আমার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে যাবি না হয়।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল তন্ময়। তনয়া হা হয়ে চেয়ে রইল। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই তন্ময় বলে উঠেল, “হ্যাঁ, বুঝে গেছি। তুই এখানেই থাকবি। ওয়েট।”
বলেই নিজের রুমে চলে গেল। তনয়া হকচকিয়ে গেল। সে তো না ও বলতে পারল না। কিংবা না বলতেই চায় নি।
.
রাত তখন ১২ টা ছুঁই ছুঁই। তনয়া রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে। ঘুমানোর আগে এটা যেন খুব দরকারি। খেলে পরে ঘুম ভালো হয়। হঠাৎ সেখানে আগমন হলো তন্ময়ের। তনয়া দেখল তন্ময় ফ্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে। আবারো এদিক ফিরে মগে কফি ঢালল। এবার পিছন ফিরে দেখল কেউ নেই। একটু অবাক হলো। দুই হাতে কফি মগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। ড্রয়িং এসে দেখল সব কিছু অন্ধকার। সেখানে কেউ নেই। সোফার কাছে কিছু জ্বলজ্বল করছে। এগিয়ে এসে বুঝল সামনে একটা কেক রাখা। কফি মগ দুটো টেবিলের উপর রেখে ভালো করে চেয়ে দেখল কেক এ কিছু লেখা। “হ্যাপি বার্থডে তনয়া!” হতভম্ব তনয়া! আজ তবে তার জন্মদিন ছিলো। অথচ তার নিজেরই মনে ছিল না। মৃদু স্বরে কেউ গাইতে গাইতে তার সামনে এলো, ”হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ তনয়া ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!“ তনয়া ফিরে তাকাল তন্ময়ের দিকে। বিস্ময়ে বিমূঢ় সে! বাকরুদ্ধ! তন্ময় কেক হাতে নিয়ে বলল, “কেমন লাগল সারপ্রাইজ? আমার একমাত্র ফ্রেন্ডের আজ জন্মদিন! এতো টুকু তো করাই যায়!”
অপ/মানে লাঞ্ছ/নায় তনয়া চোখ নামিয়ে ফেলল। তবে এটাই ছিলো তন্ময়ের মনে মনে। আর সে কি কি না ভাবছিলো। হয়তো ভুলে গেছিলো তন্ময় শুধু একমাত্র তরীর! তার নয়। তন্ময় এক নারীতে আসক্ত। সেই মনে অন্য কারো স্থান দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। তন্ময় তনয়ার হাত খানি ধরে বলল, ”নে কেক কাট। হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
তনয়া থেমে থেমে বলল, “এসব তুই আমার জন্য করলি?”
“হ্যাঁ, একমাত্র তোর। আমার বন্ধুর জন্য। আর কেউ করবে কখনো?”
”একমাত্র বন্ধুর জন্য!”
”হ্যাঁ, রে বাবা। নে কেক কাট। ওয়েট ওয়েট তার আগে চোখ বন্ধ করে উইস কর। এরপর মোমবাতি নিভা। ওকে!”
তনয়া মাথা দুলাল। আজ তার পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো। জীবনের এমন একটা সময়ে এসে এখন কি চাওয়া থাকতে পারে তার। তবুও চোখ বন্ধ করে উইস করল। সেই উইসে শুধুই ছিলো তন্ময়। তার ভালো থাকা। সুখে থাকা। আনন্দে থাকা! অন্যকে সবসময় খুশিতে রাখা এই মানুষটার জীবন যেন আনন্দে ভরে যায় এতোটুকুই তনয়ার চাওয়া!
#চলবে…