#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৮
তিলোত্তমা বেগম এখনো বাপের বাড়ি থেকে ফেরত আসেনি। জাওয়াদ চৌধুরী আনার চেষ্টা ও করেনি। রাগ কমলে এভাবেই চলে আসবে। তার ছোট ছেলে রোজ গিয়ে একবার মায়ের সাথে দেখা করে আসছে। মা ছেলের ভালোই মিল। কিন্তু দিনকে দিন তাঁর আর ছেলেদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ঠেকছে না। ঊষাণ তার সাথে কথাবার্তা বললেও উষ্ণ একদমই বলে না। যেন কথা বলার দরকারই নেই। ইরিশার সাথে এমন আচরণের জন্য কিছু বলার দরকার ছিলো। কিন্তু জানতে পারলেন ইরিশা অফিসে এসে কি কাণ্ড করেছে। এরপর আর কিছু বলার আছে। চারদিকে তাঁর চরিত্র নিয়ে কথাবার্তা রটছে। তিনি আর কতো সামলাবেন। টাকা যেন শুধু ঢেলেই যাচ্ছেন। জামান সাহেবও চুপচাপ বসে নেই। পুলিশে মামলা করতে চেয়েছিলেন সেটাও তুলে নিলেন বোনের কারণে তার মানে এই নয় তিনি দমে গেছেন। সুযোগের অপেক্ষায় কাতরাচ্ছেন। শত্রু*র সংখ্যা যেন দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ইজি চেয়ার থেকে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। উষ্ণ হনহনিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছেন। তিনি ডাকলেন না। দূরত্ব যেন এখান থেকেই বাড়ছে!
ঝর্ণার পানি ঝমঝমিয়ে পড়ছে। তাঁর নিচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে উষ্ণ চৌধুরী। পানি তাঁর বলিষ্ঠ দেহের সর্বত্রে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে দ্রুত গতিতে। বক্ষ যুগল উঠানামা করছে। সিংহের ন্যায় মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠল। কেশর নেই তবে কি? তাঁর ঘন লম্বা চুলগুলো এদিক ওদিক ছুটে চলল। ঝর্ণার পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল। উষ্ণ চৌধুরী চোখ মেলে তাকাল। মুখ খুলে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। হাত দিয়ে সামনের আয়নাখানা মুছে নিল। তার মুখশ্রী ভেসে উঠল তাতে। দীর্ঘক্ষণ সেখানে তাকিয়ে থাকলে তনয়ার মুখস্রীর একঝলক দেখা মিলল। কেমন স্বপ্নের মতো। ভ্রম যেন মনের সব অপূর্ণ ইচ্ছে কে বাস্তবে রূপ দেয়। কিন্তু ভ্রম নিয়ে তো বাঁচা যায় না। বাস্তবতা বড় নি*ষ্ঠুর। তাঁর নিষ্ঠু*র মনের এক কোণায় পদ্মের ন্যায় ফুটে আছে তনয়ার ভালোবাসা। চারদিক তার আলোয় আলোকিত। কোনো তিক্ততা ছুঁয়ে দেখতে পারেনি বটে। শুকনো ঢোক গিলল সে। তাঁর আকর্ষণীয় দেহের লোভনীয় এই রূপ দেখে কতো রমনী এক নিমিষে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে এই প্রমাণ সে পেয়েছে। বিদেশে অহরহ ঘটছে এসব। কোনো এক রমনীর বেডরুম অবধি চলে গেছিলো সে। তাঁর গায়ের শার্টটি খামচে ধরে তাকে কাছে টানছিলো সেই রমনী। কি যেন নাম ছিলো তার? হ্যাঁ, এলিসা! বিশ্বসুন্দরী বললেও ভুল হবে না। তাঁর নীল চোখের মায়ায় পড়ে গেছিলো সে। একদম যেন গভীর সমুদ্রের মতো ঘন স্বচ্ছ আঁখি জোড়া। চিকন চিকন কোমল ঠোঁটের স্বাদ ও সে নিয়েছিলো। রসালো ঠোঁট জোড়ার স্বাদ আজ আর মনে করতে পারেনা। এসব তার ভুল ছিলো। নেশার ঘো*রে সেই রমনীর অনেক কাছেই চলে গেছিলো সে। পাগলের মতো চুষে দেখছিলো সেই ঠোঁটজোড়া। বিদেশি মেয়েগুলো যেন একধাপ এগিয়ে হয়। কিন্তু ঘনি*ষ্টতা বাড়ায়নি সে। মনের কামনার কাছে দেহের কামনা হার মেনে গেল। কেমন করে যেন নে*শা কেটে গেল। কি আশ্চর্য! ততোক্ষণে এলিসা জামাকাপড় খুলে ন*গ্ন হয়ে বিছানায় শুয়ে তাকে কাছে ডাকছে। কিন্তু সেই সৌন্দর্য তাকে টানেনি। রমনী মোহনীয় ভঙ্গিতে তাকে কাছে ডাকছিলো। কিন্তু উষ্ণ যেতে পারেনি। তার মন মানে নি। মনের মধ্যে অতৃপ্ত বেদনা তাকে কষ্ট দিচ্ছিলো। সে বেরিয়ে এলো। এলিসা স্তব্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছিলো। এমন প্রত্যাখ্যান সে আশা করেনি। কোনো ছেলে তাকেও প্রত্যাখান করতে পারে! বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর!
সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে ঘরে ঢুকল উষ্ণ। বিছানার উপর ঊষাণ চৌধুরী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। উঠে বসল। হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই ব্রো!
-তুই এখানে কেন?
– দেখতে এলাম তোমায়। বাহ ব্রো কি বডি তোমার। জিমে তো যাও না। এতো ফিট থাকো কি করে? সিক্রেট কি হ্যাঁ?
– এখানে কেন এসেছিস সেটা বল।
ঊষাণ চৌধুরী রহস্যময় হাসি দিল। উষ্ণ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আলমারি থেকে একটা টি শার্ট বের করে পরে নিল। ঊষাণ কোনো কথাবার্তা না বলে তাকে দেখছে। অতঃপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাতে লাগল। ঊষাণ বলল,
– বাড়িতে মা নেই জানো।
– জানি। এজন্য বাড়িতে এতো শান্তি।
– সৎ বলে আমায় আর মা কে তুমি পছন্দ করো না তাই না।
– আমার আপন বাপকেও আমি পছন্দ করিনা।
– আর আপন মা কে?
উষ্ণ চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। ঊষাণ চৌধুরী হেসে উঠে বলল,
– চিল ব্রো! রেগে যেও না। আমি তো কেবল জিজ্ঞেস করলাম।
– ঘর ছেড়ে বের হও।
– যাচ্ছি যাচ্ছি। কিন্তু তুমি জানো সবাই কি করছে?
– কি?
– তাঁরা সবাই এখন তোমার বউ খুঁজতে ব্যস্ত। হন্তদন্ত হয়ে এখন সবাই তোমার বউকে খুঁজছে। সাবধানে থেকো। তাঁরা ভাবী কে খুঁজে পেলে কিন্তু তুমি আর ভাবীকে পাবে না!
দাঁত বের করে পৈশা*চিক হাসি দিল ঊষাণ চৌধুরী। উষ্ণ এখনো হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাচ্ছে। হাসতে হাসতে ঊষাণ চৌধুরী বেরিয়ে গেল। অথচ সে নির্মল, নিশ্চুপ। তাঁর নিশ্চুপতা রহস্য হাতছানি দিচ্ছে। তার রহস্যময় দুটো ছোট স্থির চিত্তে কেবল আয়নার প্রতিবিম্ব দেখছে!
.
বাইকে করে তনয়া যাচ্ছে তন্ময়ের সাথে। পেছন থেকে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আছে। তন্ময়ের ঘামে ভেজা শার্টের গন্ধ শুকছে সে। এভাবে থাকলে কতোই না ভালো হতো। সময় ফুরিয়ে এসেছে। সময়ের সাথে যেন দীর্ঘদিনের তার শত্রুতা। তাঁর ভালোলাগার সময়গুলো ইচ্ছে করে ফুরিয়ে দেয়। রাগ হচ্ছে। কিন্তু মেনে নিল। হেলমেট খুলে তন্ময়ের দিকে এগিয়ে দিল। তন্ময় তাঁর গাল ধরে টেনে হাসল। বলল, “যেভাবে চিপকে ছিলি আমি তো ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছিস!”
“না ঘুমাই নি।”
“তোকে ক্লান্ত লাগছে। যা তবে আমি আসি।”
“রাতের খাবার খেয়ে যা।”
“উহু লাগবে না। মা কয়েকদিন পর পর এসে রান্না করা খাবার দিয়ে যায়। ফ্রিজে রেখে গরম করে খাই।”
“আন্টি কে এতো কষ্ট কেন দিচ্ছিস!”
“আমি কি দেয় নাকি। বলেছিলাম একজন রান্না করার লোক রেখে দিবো। তবুও সে যদি এসে খাবার দিয়ে যায় আমার কি করার বল। এই বয়সেও শরীরে তেজ আছে।
“একটা মাত্র ছেলে থাকবে না আবার। একটা বিয়ে করে মা কে রেহাই দে।”
“তুই আর এক কথাই বলিস কেন বলতো? যাই আমি। রাত হচ্ছে!”
“সাবধানে যা। গিয়ে মেসেজ দিস কিন্তু।”
“আচ্ছা!”
ভোনভোন শব্দ করে বাইক নিয়ে চলে গেল তন্ময়। তনয়া ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ আঁখি মেলে তাকে দেখছিলো। যতদূর চোখ যায়। আচমকা বৃষ্টি নেমে এলো। আগাম কোনো বার্তা নেই, মেঘের গর্জন নেই হঠাৎ বৃষ্টি! এই বৃষ্টি থামবে না। ছুটে বাসার মধ্যে ঢুকল। ইশ্! ছেলেটা এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। একগাল খারাপ লাগা কাজ করছে। ক্ষুণ্ন মন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠল। মৌ যেন তাঁর অপেক্ষাই করছিলো। কলিংবেল বাজতেই ছুটে এসে দরজা খুলে দিল। প্রথমেই প্রশ্ন,
– দেখা হলো তার সাথে?
– কার সাথে?
– তোমার বসের সাথে। কেমন আছে?
– ভালোই আছে। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তাকে দেখে বলতেই পারবে না জ্বরের ঘোরে ওই রাত তিনি বেহুঁশ ছিলেন।
– এভাবে কেন বলছো? লোকটার খোঁজ নিচ্ছি।
– তোকে বললাম না অচেনা লোকের জন্য আদিখ্যেতা কম করবি।
মৌ আর কথা বাড়ালো না। মুখ ভেংচি কেটে ঘরের চলে গেল। মেয়েটাকে নিয়ে পারা যায় না। সবকিছুতে কৌতুহল। ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে ফিরতেই ঘুমে চোখ লেগে আসছে। কিন্তু এভাবে ঘুমানো যায় না। মনকে বাঁধা দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকল শাওয়ার নিতে।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। কি বৃষ্টি! আজই যেন ঢাকা শহর ডুবিয়ে দিবে একদম। উষ্ণ কফির মগ হাতে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করছে। কিন্তু একা একা বৃষ্টি বিলাস হয় না। তাঁর কথা ভীষণ মনে ধরছে। ফোন বের করে একবার কল করল। ধরল না। জানাই ছিলো। কফি মগে শেষ চুমুক দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। এতো রাতে ছেলেকে বাড়ি থেকে যেতে দেখে খানিকটা সন্দেহ করলেন জাওয়াদ চৌধুরী। ঊষাণ চৌধুরী কিঞ্চিত হেসে ফোন করল কাউকে। শুধু বলল, “বেরিয়েছে!”
এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো ইরহান হাসান। উষ্ণের গাড়ি বের হতে দেখেই নিজের গাড়ি নিয়ে পিছু দিল সে। রাতের আঁধারে এই বৃষ্টির মধ্যে জোকের মতো পিছু নিল উষ্ণ চৌধুরীর।
বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো তনয়া। মাথার তোয়ালে ভালো করে পেঁচিয়ে সামনে ফিরে তাকিয়ে অবাক হলো। মৌ তার বিছানার উপর হেসে হেসে কারো সাথে যেন ফোনে আলাপ করছে। একটু পর পরই খিলখিলিয়ে হাসছে। কার সাথে কথা বলছে এতো। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আয়নার সামনে দাঁড়াল। দু’জনের চোখাচোখি হলো। তনয়া তোয়ালে দিয়ে চুল গুলো ঝারল। বেশ স্বস্তির এক নিঃশ্বাস নিয়ে বিছানায় এসে বসল। অমনি মৌ বলতে লাগল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ এসে গেছে। নাও কথা বলো!”
ফোন এগিয়ে দিল। তনয়া বাকরুদ্ধ! এতো তার ফোন। তার ফোনে এতো মধুর আলাপ কার সঙ্গে করছিলো মৌ। মৌ ইরাশা দিচ্ছে। তনয়া ফোন হাতে নিয়ে দেখল ভাদাইম্যা স্যারের কল। ওহ! মৌ এর সাথেও ভাব করা হয়ে গেছে তাহলে। কি লোক রে বাবা! আর মৌ ও তো কম যায় না। ফিসফিসিয়ে বলল, “তোমার ফোন বাজছিলো। তাই এসে রিসিভ করলাম। তাঁর সাথে কথা বলে একটু খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। নাও কথা বলো আমি যাই!”
তনয়া ফোন কানের কাছে নিল। বৃষ্টির শব্দ আসছে। ওপাশের ব্যক্তি নিশ্চুপ। সে নিজে থেকেই বলল,
– হ্যালো!
– নিচে আসবে একটু?
– নিচে আসব মানে? আপনি আমার বাসার সামনে।
– হ্যাঁ বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।
– পাগল নাকি আপনি? পাগলামি কেন করছেন?
– পাগল বলেই তো পাগলামি করছি।
– আসব না আমি। বাড়ি ফিরে যান।
– এতো নিষ্ঠু*র ভাবে বলো না। সবে সবে জ্বর থেকে সেরেছি। তুমি চাও আমি আবারো বৃষ্টিতে ভিজি।
– যা মন চায় করুন!
ফোনটা কেটে দিল। কি অদ্ভুত ইচ্ছা! সে বলছে আর তাকে এখন যেতে হবে। হয় এসব কখনো? এতো কেন তার আহ্লাদ পূরণ করতে হবে? যাবে না সে। ভিজলে ভিজুক গে! বিছানায় মাথা এলিয়ে দিল। তাঁর ঘুম আসছে। কখন চোখ লেগে গেলো টের পেলো না। আধঘন্টা পর ঘুম ভাঙল। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। ঘড়ির দিকে তাকাল। হ্যাঁ! আধঘণ্টাই তো হবে। বৃষ্টি এখনো পড়ছে। ফোনটা সবার প্রথমে হাতে নিয়ে চোখ বুলাল। না! তিনি আর মেসেজ দেননি। আচমকা পিছন ফিরল। ঘাবড়ে গেল! জানালার খুলে সামনে দাঁড়িয়ে মৌ।
– কি করছিস?
– ঘুম ভাঙল তোমার?
– জানালা বন্ধ কর। বৃষ্টির পানি আসবে তো।
– সে বৃষ্টিতে ভিজছে।
– কে?
বিছানা ছেড়ে নামল তনয়া। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। রাগে তার সর্বা*ঙ্গ জ্বলে উঠলো। এই লোক সত্যি সত্যি দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। মৌ মলিন কণ্ঠে বলল,
– অনেকক্ষণ ধরে ভিজছে। ভাবলাম তোমায় ডাক দিই কিন্তু তুমি তো ঘুমে বিভোর। আর ডাকলাম না।
– একটা লোক এতো পাগল হয় কি করে?
– প্রেমে পড়লে!
রক্তচ*ক্ষু দৃষ্টি ফেলে তাকাল মৌ’র দিকে। মৌ তা উপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে চলে গেল। নাটক হচ্ছে! সবাই তামাশা করছে আর সে বসে বসে দেখছে। উফ্! মাথা অসহ্য যন্ত্রণায় গ্রাস করে ফেলছে। এই লোক তো নিজেই আস্ত একটা মাথাব্যথা! মৌ ফের এলো। হাতে ছাতা নিয়ে। এগিয়ে দিয়ে বলল, “যাও না। লোকটা না হলে সারারাত ধরে ভিজবে। শেষে অসুখ বাঁধিয়ে আবার তোমার কাছেই আসবে!”
একরাশ অনিচ্ছা নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো তনয়া। এসব আর সহ্য হচ্ছে না তাঁর। এবার স্যারকে দু একটা কথা না বললেই নয়। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে ভিজতে উষ্ণ। সে একা নয়। রাস্তার দু’টো কুকুর ও তার সাথে ভিজছে। তাকে দেখেই বোধহয় তাদের মধ্যে সাহস এসেছে। এরা লাফালাফি করছে। আবার উষ্ণ কে শাসাচ্ছে। উষ্ণ কেন বার বার তাদের এলাকায় আসছে? সন্দেহজনক লাগছে তাদের কাছে। দূরে দাঁড়ানো সেই লোকটা ধমক দিয়ে বলল, “এই চুপ কর তোরা!”
কুকুর দুটো চুপসে গেল। লোকটা একগাল হেসে বলল, “স্যার! আর কতোক্ষণ ভিজবেন? ম্যাডাম কি আইবো? না আইলে ভিজার এতো দরকার নাই! মাইয়া মানুষ গো হে*ডাম অনেক। আমার জনের এতো হে*ডাম দেইখা ছাইড়া দিছি। ম্যাডাম আইবো না।”
উষ্ণ কিঞ্চিত হাসল। বৃষ্টিতে পুরো কাকভেজা সে। বৃষ্টির পানি মুখ গড়িয়ে পড়ছে তার চিবুক হয়ে। হঠাৎ এই বৃষ্টি থেমে গেল। তার মাথার উপর আর বৃষ্টি পড়ছে না। উষ্ণ মাথা উঁচু করে তাকাল। মাথার উপরে ছাতা। পিছনে ঘুরে ফিরে তাকাল। তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। ধমকে উঠে বলল, “সমস্যা কি আপনার? আপনি এখানে কি করছেন?”
উষ্ণ মৃদু হাসল। মেঘ গর্জে উঠল। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সেই আলোয় দূর থেকে এক ঝলক দেখল ইরহান হাসানকে। পৈ*শাচিক হাসি হেসে ফোন বের করল সে। “ইরিশা জামান” লেখাটা ফোনের স্ক্রিনের উপর ভাসছে!
#চলবে
#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৯
তনয়ার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। তিরিক্ষি মেজাজে আবারো শুধাল, “কথা বলছেন না কেন? কি ভাবছেন আবার অসুখ বাঁধিয়ে আমার বাসায় এসে উঠবেন। একদম না। এবার আর আপনাকে আমি জায়গা দিবো না!”
“রা*গ করো না। আমি চলে যাবো।”
“তো যান। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। অদ্ভুত লোক তো আপনি। যা বললেন তাই করলেন। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে কার লাভ হলো শুনি? অসুখ কি আমার হবে?”
“না আমার, কিন্তু আমার থেকে মনে হচ্ছে তোমার চিন্তাটাই বেশি তনয়া!”
তনয়া বলতে গিয়ে থেমে গেল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। মেঘ আবারো গর্জে উঠল। আকাশে দীর্ঘ রেখা টেনে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মাথার উপরে ছাতাটা নজরে পড়ল উষ্ণর। মৃদুস্বরে বলল, “এই ছাতা টা এখনো রেখেছো তুমি?”
“ছাতা! কোন ছাতা?”
মাথা উপুড় করে চাইল। এটা সেদিনকার ছাতা টা না? কোন এক আগন্তুক যে তাকে দিয়েছিলো। অঙ্কে তনয়া তেমন কাঁচা ছিলো না। হিসেব কষতে কষ্ট হলো না। তবে ততোক্ষণে সে ভারী চমকে উঠল। আকস্মিক কণ্ঠে বলল, “আপনি!”
উষ্ণ হেসে গাড়ির কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার কুকুর গুলো আবারো ডাকাডাকি শুরু করেছে। তনয়া পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “আপনার ছাতা টা নিয়ে যান!”
“না। তোমার কাছে রেখে দাও। আমি যাই, আমার কাজ শেষ!”
“কোন কাজে এসেছিলেন?”
“কেন আবার? তোমায় একটি নজর দেখার জন্য!”
শক্ত হাতে ছাতা আঁকড়ে ধরল তনয়া। উষ্ণ গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তনয়া দাঁড়ালো না। ছুটে চলে এলো। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো, গাড়িটা চলে যাচ্ছে। মনের মধ্যে অদ্ভুত উত্তেজনা টের পাচ্ছে না। এই লোকটা কতোটা অদ্ভুত, রহস্যে পেঁচানো। রহস্যের জালে নিজেকে তার সাথে সেও মিশিয়ে ফেলছে। নিজ ইচ্ছায় নয়। তাকে ক্রমশ মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে!
.
ইরহান হাসানের জ্ঞান ফিরল সবে মাত্র। কোথায় আছে কিভাবে আছে কিছু আন্দাজ করতে পারছে না। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আধো আধো চোখ মেলতেই সামনে কাউকে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে না! চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছে। শেষবার তো বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। হ্যাঁ! মেয়েটার খোঁজ পেয়ে গেছিলো। ম্যাডাম কে ফোন করতে যাচ্ছিল ঠিক তখনি.. আহ্! মাথায় এখনো য*ন্ত্রণা হচ্ছে। হাত পা শক্ত করে বাঁধা। মুখ খুলে শ্বাস নিতে হচ্ছে তাকে। শরীর ভীষণ ক্লান্ত আর দুর্বল। সর্বোচ্চ দিয়ে চোখ মেলে তাকাল সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে রীতিমত ভিমড়ি খেয়ে উঠলো সে। জেএস কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরহান হাসান হতভম্ব! এই লোকটাকে সে চিনে! এতো উষ্ণ চৌধুরীর সেক্রেটারি! চেঁচিয়ে উঠল ইরহান হাসান! তাকে এভাবে আটকে রাখা। ম্যাডাম জানলে কি হাল করবে তারা কি জানে? তাকে আটকে রাখা হচ্ছে কেন? নিজের সবটুকু দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার অদম্য প্রচেষ্টা। তার সাথে মুখ তো আছেই। হঠাৎ পেছনে উষ্ণ চৌধুরীকে দেখতে পেয়ে তার আওয়াজ দমে গেল। বাকরুদ্ধ চাহনিতে স্থির নয়নে সামনে তাকিয়ে আছে সে। উষ্ণ চৌধুরী তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে শুধাল, “জ্ঞান ফিরেছে!”
“মাত্রই স্যার!”
তোয়ালে জেএসর হাতে দিয়ে ইরফানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। ইরহান এবার নতুন উদ্যমে বলতে শুরু করল, “আপনি! আপনি আমায় এভাবে আটকে রেখেছেন। ম্যাডাম জানলে আপনাকে ছাড়বে না। আপনি খুব বিপ*দে পড়বেন বলে দিলাম!”
উষ্ণ বিরক্ত স্বরে বলল, “শাট আপ!” কিন্তু ইরহান এতে বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে গেলো না। গলার জোর বাড়িয়ে বলেই যাচ্ছে, “আপনি খুব বি*পদে পড়বেন বলে দিচ্ছি। আমার পিছনে কারা আছে আপনি কিন্তু কিছু জানেন না!”
উষ্ণ চৌধুরী এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ার পেতে তার সামনে বসে তার পায়ের উপর পা রেখে বলল, “কারা আছে শুনি?”
ইরহান সাহেব এবার যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। কিন্তু ভয় পাচ্ছেন তা তো বুঝতে দেওয়া যাবে না। সে আবারো বলে উঠল, “আছে! জামান সাহে… ! চেঁচিয়ে উঠলো সে। উষ্ণ তার পায়ের উপর জোরে পা*ড়া দিয়ে ধরে রেখেছে। আবার ছেড়ে দিল। ইরহান এখন ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। উষ্ণ সিগারেট মুখের সামনে ধরে সবটুকু ধোঁয়া তার মুখের দিকে ছেড়ে বলল, “কি হলো? থেমে গেলি যে! বল, কি বলছিলি!”
“আমায় ছেড়ে দিন। আপনি অনেক বড় ভুল করছেন। অনেক বড়!”
বিকট শব্দে হেসে উঠল উষ্ণ চৌধুরী। অর্ধেক খাওয়া সিগারেট পায়ের তলায় ফেলে পিষি^য়ে দিল। হেসে বলল, “আমি ভুল করছি। তুই তো নিজেই বাঘের লেজে পা রেখেছিস। বাঘ তোকে এতো সহজে ছেড়ে ভেবেছিস!”
ইরহান রা*গে চোখ রাঙিয়ে তাকাল তার দিকে। উষ্ণ চৌধুরীর হাসি পাচ্ছে। এই নেংটি ইঁদুর নিয়ে খেলার শখ তার নেই। আচমকা উঠে তার চুলগুলো মাথার পিছনে টেনে ধরে ধারালো ছু”রি তাক করে রাখল তার চোখের দিকে। ইরহান ভয়ে চুপসে গেছে। ভয়ে তার চোখ মুখ রক্ত*শূন্য হয়ে উঠেছে। সারা শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছে। উষ্ণ বাঁকা হেসে ছু*রি নিয়ে এসে ঠেকাল তার গ*লার কাছে। টানটান চুলগুলো ধরে রেখে গলার কাছে ছু*রি নিয়ে খেলছে। যন্ত্র*ণায় সে শব্দ ও করতে পারছেন না। এরা কি তার গলা কে*টে দিবে নাকি? কা**টছেও বোধহয়। একটু একটু ব্যথা লাগছে। চোখের সামনে ছু*রি ধরতেই সে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসে। ছুরিতে র*ক্ত লেগে আছে! তাহলে কি সে সত্যিই মা*রা যাচ্ছে। যতই ভয় পাক। তেজ কিন্তু একটুও কমেনি তার। উঁচু গলায় আবারো কিছু বলতে নিল উষ্ণ চৌধুরী সজোরে একটা ঘু*সি মার*ল তাকে। নাক বেয়ে গড়গড়িয়ে র*ক্ত পড়তে শুরু করল। আবারও জ্ঞান হারালো। উষ্ণের রাগ তবুও কমেনি। লাথি মেরে চেয়ার সমেত তাকে মেঝেতে ফে*লে দিল। পেছন থেকে জেএস এসে সামলে নিল সময়মতো। উষ্ণ রা*গে হাপাচ্ছে। জেএস তার ধরে শান্ত হতে বলল। চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “ওর থেকে কি পাওয়া গেছে?”
– আপনার আর ম্যাডামের কিছু ছবি। সবকিছু ডিলেট করা হয়েছে। আর একটা পি*স্তল ও পাওয়া গেছে!
– কি! গান! জেএস তুমি জেনো ছাড়ো ওর মতলব কি ছিলো? কেন ছিলো ও ওখানে?
– মনে হচ্ছে শুধু খোঁজ নেবার জন্যই পাঠানো হয়েছে।
– ফোন কোথায়?
– আমার কাছে। বন্ধ করে রেখেছি। ইরিশা জামান বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো।
– ফোন ভে”ঙে ফেলো। আর একে! এই বান্দা কে আর কিছুদিন এখানেই রাখো। ও যেন বাইরের আলো দেখতে না পারে সেই ব্যবস্থা করো। আমার তনয়ার দিকে নজর রাখা। আমি ওর চোখ উপড়ে ফেলব। উষ্ণ চৌধুরী কে চিনে না ও!”
– স্যার শান্ত হন আমি দেখছি। আপনি বাড়িতে ফেরত যান অনেক রাত হয়েছে বাকিটা আমি সামলে নেবো।
উষ্ণ রেগে তার দিকে ফিরে তাকিয়ে চলে গেলো। এর শেষ এখানেই হবে না।
.
মৌ ছাতা উল্টে পাল্টে দেখল। ভ্রু কুঁচকে বলল, “বলেছিলাম না তোমায়। এই ছাতা কোনো মস্ত বড়লোকের হবে। দেখলে তো!”
“আমি কি আর জানতাম এই ছাতা তার হবে!”
“জানতে না এখন তো জানলে। সামলে রেখো। দুই তিন হাজারের কম তো হবেই না ছাতার দাম!”
“পাগল হলি? আমি ৪০০ টাকা দিয়ে এমন ছাতা এনে দেখাতে পারব!”
“৪০০! হাসিও না। এই ছাতার ডিজাইন দেখেছো? আর এখানে দেখো। মনে হচ্ছে ব্র্যান্ডের নাম। এই সকল ছাতা ব্র্যান্ডের নামে চলে বুঝলে।”
“রাখ তো তার ছাতা তাকেই দিয়ে দিবো। আমি রেখে কি করব। এক ছাতা নিয়ে কতো কথা!”
“যা মন চায় করো। তবে ছাতা টা কি সুন্দর। না দিলেই ভালো হয়!”
তনয়া মুখ ঘুরিয়ে বিছানার উপর উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল। ফোন হাতে নিয়ে নড়াচড়া করছে। তন্ময় ফোন দিলো না যে একবার। বলতে বলতে তন্ময়ের ফোন চলেও এলো। মৌ উঁকি মেরে বলল, “বাহ ভালোই!”
“কি বলছিস?”
“কিছু না, তুমি কথা বলো আমি যাই।”
ছাতা নিয়ে মৌ বেরিয়ে গেলো। তার বেশ কৌতূহল হচ্ছে ছাতা নেই। কোথাকার ছাতা এটা! তাকে জানতেই হবে।
#চলবে