তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
53

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২৩

সাজেকের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে মেঘে ঢাকা আকাশ। পাহাড়ের চূড়া অবধি ঢেকে যায় ঘন মেঘে। সাদা মেঘের আড়ালে পাহাড়ের লুকোচুরি দেখে বিস্মিত হয়নি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। এখানে দাঁড়িয়ে কারো মন খারাপ থাকতে পারে না। উঁহু সম্ভবই না।

তাদের রিসোর্ট টা অনেক বড়। বিশাল জায়গাজুড়ে এই রিসোর্টের ঘরের সংখ্যা মন্দ নয়। এছাড়া সামনেও বিরাট জায়গা। রাতে এখানে বারবিকিউ হলে মন্দ হবে না। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় অবস্থান বলে উচু জায়গায় চারটে কটেজ রয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। যতখানি চোখ যায় কেবল সাদা মেঘের ভেলা। শুভ্রতার চাদরে আঁকড়ে যেতে ইচ্ছে করে। জীবনে এই প্রথম মেয়ে হয়ে তার আফসোস হচ্ছে। কিংবা সকলে একসাথে এসে। রিসোর্টের বাইরে চারটে কটেজ আছে। এই চারটেতেই ছেলেরা থাকতে পারবে। একটা উষ্ণ স্যারের জন্য বরাদ্দ। অন্যটা তার সেক্রেটারি জেএসের জন্য। বাকি দুটোতে কয়েকজন ছেলে মিলেমিশে থাকে। এই সুযোগ কেইবা হাতছাড়া করতে চায়। এদের মধ্যে তন্ময় ও আছে। শয়*তানটা সেই যে কটেজে ঢুকেছে এখনো বের হয়নি। এমনকি লাঞ্চ করতেও বের হয়নি। তন্ময়ের মতো আরো কজন আছে। এরা ঘুরতে এসেছে নাকি ঘুমাতে।

সবার সাথে ঘুরতে আসলে এই এক সমস্যা। সময়ের কাজ কখনো সময়ে হবে না। একেকজনের একেক মত। এই যে কথা ছিল,‌ লাঞ্চের পর সকলে বেরুবে। সেখানে কেবল তারা ১০ এসে লাঞ্চ করেছে। বাকি ১৫ জনের হুদিশ নেই। কেউ কেউ লাঞ্চ করে আবার ঘরে ঘুমোতে গেছে। এদের মাথা ব্যাথা, শরীর ব্যাথা অজুহাতের কমতি নেই। তনয়ার মেজাজ বি*গড়ে যাচ্ছে। কেবল তন্ময় থাকলে সে আর তন্ময় একাই বেরিয়ে যেত ঘুরতে। বাকিরা চুলোয় যাক।

পরনে ঢোলাঢালা একটা প্যান্ট। হাঁটুর একটু উপরে একটা টপস, তার উপর কালো রঙের কোটি। ঘন মেঘের আড়াল থেকে রোদের বিচরণ সম্ভব নয়। অথচ শহরে থাকলে এখন সূর্য থাকত মাথার উপরে। তাই একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। যদিও ওতোও না। সব কলিগ একসাথে বসে গল্প করছে আর চা খাচ্ছে। তনয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পুরো রিসোর্ট এক চক্কর দিল। এখানকার বেশিরভাগই উপজাতি। আর রিসোর্টের প্রায় অনেকটাই তাদের রিজার্ভ নেওয়ায় অন্য মানুষের আনাগোনা কম। এদিক ওদিক রঙ বেরঙের আলো সাজিয়ে রাখা।‌ রাতে নিশ্চিত এগুলো জ্বালানো থাকবে। তনয়ার ভারী ইচ্ছে রাতে এসব দেখার। চায়ের কাপ শেষ করে ফোনটা বের করল। চারদিক ঘুরিয়ে ভিডিও করতে লাগল। মৌ কে পাঠাতে হবে। ভাবতে ভাবতে মৌয়ের ভিডিও কল। তনয়া রিসিভ করল।

“কি ব্যাপার আপু, গিয়ে তো একদম ভুলেই গেলি।”

স্ক্রিনে মৌ কে দেখা যাচ্ছে। তনয়ার কানে হেডফোন। হেসে বলল, “তোকে একটা জিনিস দেখাই মৌ। দেখ!”
ফোনের পিছনের ক্যামারা অন করে চারদিক দেখাতে লাগল। মৌ হতভম্ব স্বরে বলল,

“বাহ ভারী সুন্দর তো। বিয়ের পর বরকে নিয়ে ঘুরতে যাবার পারফেক্ট প্লেস!”

“হ্যাঁ, তুই আসিস বর নিয়ে।”

“আরে ওটা কে? উষ্ণ স্যার না? হ্যাঁ ওই তো তোমার উষ্ণ স্যার!”

তনয়া এদিক ওদিক তাকাল। মৌ আবার উষ্ণ স্যারকে কোথায় দেখছে। খেয়াল হলো, ওই গাছের আড়ালে উষ্ণ স্যার দাঁড়িয়ে। তার চুলগুলো ছাড়ানো আজ। বারবি চুলগুলোয় সামনের কপাল ঢেকে গেছে। উষ্ণ স্যার মৃদু হাসলেন। এগিয়ে আসছে। তার পিছনের চুলগুলো ঘাড়কে স্পর্শ করছে। অদ্ভুত ভাবে উষ্ণ স্যারকে আজ কমবয়সী মনে হচ্ছে। এই ১৮ কি ১৯ বছরের কোনো তরুণ! তনয়া ভীষণ অবাক হলো। কেবল চুলগুলোয় ছেড়ে রাখায় এতো পরিবর্তন!

মৌ কানের কাছে চেঁচামেচি করছে। উষ্ণ স্যারের সাথে কথা বলবে সে। উষ্ণ স্যার সামনে দাঁড়িয়ে কিসব বলছে। তনয়া হেডফোনের কারণে শুনতে পারছে না। উষ্ণ স্যার আচমকা কানের থেকে একটা হেডফোন খুলে নিজের কানে লাগালো। মৌ আবারো বলছে, “আপাই তোমার উষ্ণ স্যার কে একটু দাও না!”

উষ্ণ বলে উঠলো, “মৌ নাকি?”

মৌ থেমে গেল সাথে সাথে। তনয়ার পাশে দাঁড়িয়ে উষ্ণ ফোনের স্ক্রিনে উঁকি মারল। মৌ হাত নাড়ছে।

“কেমন আছেন আপনি?”

“ভালো, তোমার খবর কি?”

“কিসের খবর? এখান থেকে যাবার পরই তো ছোট বোনকে একদম ভুলে গেলেন।”

উষ্ণ মুচকি হেসে বলল, “না না ভুলিনি একদম। তোমায় কি ভোলা যায় বোন!”

তনয়ার চোখে মুখে অবাকের রেশ। সে একবার উষ্ণ স্যার কে দেখছে আরেকবার দেখছে ফোনের স্ক্রিনে মৌ কে। আশ্চর্যের ব্যাপার! এদের মধ্যে এতো ভাব হলো কখন?

কথা শেষ হতেই মৌয়ের ফোন কেটে দিল। উষ্ণ হেডফোন ছেড়ে দিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল। ভ্রুযূগল নাচিয়ে শুধাল, “কি দেখছো?”

তনয়ার বোধ হলো। সে অনেকক্ষণ যাবত আড়চোখে উষ্ণ স্যারকে দেখছে। আজ প্রথমবার তার মনে হচ্ছে, উষ্ণ স্যার কে এর আগেও কোথায় জানি দেখেছে। অনেক বছর আগে।‌ বেশভূষায় কেমন জানি একটু চেনা চেনা লাগছিলো। উষ্ণ স্যার এগিয়ে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “এভাবে দেখলে তো প্রেমে পড়ে যাবেন মিস তনয়া!”

তনয়া চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে পিছিয়ে গেল। ভাবটা এমন, আমি কেন আপনার মতো ভাদাইম্যার প্রেমে পড়তে যাবো। নেহাত অন্যরকম লাগছিলো বলেই দেখছিলাম।
কথাবার্তা না শুনিয়ে সে ফিরে এলো রিসোর্টের কাছে। দেখল সবাই প্ল্যানিং করছে। ঘুরতে যাবার প্ল্যানিং। যারা আছে তারাই ঘুরতে বেরুবে। মন্দ নয়। তনয়ার নিজেও খুশিতে লাফিয়ে উঠল।

পরক্ষণেই তার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি মলিন হয়ে উঠল। পাংশু*বর্ণ মুখ নিয়ে বলল, “উষ্ণ স্যার ও যাবে।”

জ্যোতি কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বলল, “তা নয়তো কি? খুব মজা হবে। চল এখুনি বেরিয়ে পড়ি।”

“কিন্তু আমি তো…

বাকি কথা শোনার সময় হলো না কারো। সকলে নিজের রুমে ছুটে গেল। হ্যান্ডব্যাগ সাথে নিয়েই বেরিয়ে এলো। বাইরে একটা জিপ দাঁড়িয়ে। উষ্ণ বসে আছে জিপের উপর। তাদের সাথে মেয়ে আছে ৬ জন বাকি ৪ জনই ছেলে।এর সাথে উষ্ণ স্যার আর জেএস। মেয়েরা উষ্ণ স্যার কে দেখেই পাগল। লোকটার পরণে কালো রঙের টি শার্ট আর কালো রঙের ফরমাল প্যান্ট। পায়ের কালো সু গুলো নাড়িয়ে চোখের সানগ্লাস খুলে এদিক তাকাল। সকলে এসে পড়ায় উষ্ণ স্যার নেমে গেল। চুলগুলো আরেকদফা ছাড়িয়ে আরো শক্ত করে ঝুটি করল। তার টি শার্ট হাফহাতা হওয়ার পেশিবহুল হাত দুটো দেখা যাচ্ছে আকর্ষণীয়ভাবে। জ্যোতি তো দু হাতে তনয়ার বাহু ঝাপ্টে ধরে লাফাতে লাগল। বলে উঠলো, “এই স্যারকে আজ অনেক জুয়ান জুয়ান লাগছে তাই না? মনে হচ্ছে স্যারের বয়স ১০ বছর কমে গেছে!”

তার পাশে নূর তাকে খোঁচা মেরে বলল, “স্যারের বয়স নাহয় কমছে। তোরটা তো আর কমে নাই। লাফাস কম বইন।”

“এমনভাবে কেন বলছিস? আমাদের কি মানাবে না!”

“হু সেকেন্ড হ্যান্ড লায়লা মামুন। ভালোই লাগবে!”

সবগুলো মেয়ে হেসে উঠল শব্দ করে। তনয়া ও হাসছে তাল মিলিয়ে। রাগে জ্যোতির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। হিসেবে স্যারের চেয়ে ২ বছরের না হয় বড় সে। এজন্য তাকে লায়লা বানিয়ে দিবে! উষ্ণ স্যার, জেএস সহ বাকি সকলে এদিক ফিরে আছে। মেয়েগুলো হঠাৎ হাসলো কেন?

জিপের ড্রাইভিং সিটের পাশে আজ জেএস বসেছে। দুই সারির ছেলেমেয়ে গুলো আলাদা হয়ে বসেছে। অশালীন ব্যাপার থেকে তারা পুরোপুরি মুক্ত। কিন্তু এভাবে থাকলে সে তনয়ার সাথে বসবে কি করে? ভারী চিন্তায় পড়ে গেল উষ্ণ চৌধুরী! ইশারায় শফিককে বেরিয়ে আসতে বলল। শফিক বেরিয়ে আসতেই উষ্ণ চৌধুরী তার ঘাড়ে হাত রেখে ফিসফিস করল। কথার মর্মার্থ এই যে, তখন ওই কথা বলেছিলো কেবল ম্যানেজারের উস্কানিতে। ম্যানেজার সাহেব বলেছিলো ছেলেমেয়ে আলাদা বসার জন্য। এখন চাইলে তারা একসাথে বসতেই পারে!

শফিক খুশি হয়ে গেল। কারণ তার প্রেমিকা লিলির সাথে বসার জন্য মন আনচান করছিলো। এখন তার মন উৎফুল্ল। ৪ জন ছেলের সঙ্গী নিয়ে তারা বসে পড়ল। একমাত্র তনয়া আর জ্যোতি এক কোণায় বসে এই চারজন কাপল কে দেখতে লাগল। কি কপাল খারাপ তাদের। জ্যোতি দুঃখের চোটে তনয়ার ঘাড়ে মাথা রেখে কপাল চাপড়াতে লাগল। এতোক্ষণের কাহিনী তনয়া না বুঝলেও এখন বুঝল। যখন টের পেলো উষ্ণ স্যার এসে তার পাশেই বসেছে।

জ্যোতি হা হয়ে গেল। মনের দুঃখে তনয়ার কানে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “কি ভাগ্য তোর। বসলি তো বসলি একদম স্যারের পাশেই এসে বসলি!”

তনয়া আমতা আমতা করে বলল, “তুই বসবি এখানে? আয় সিট বদলে ফেলি!”

উষ্ণের কানে কথাটা যেতেই সে বলে উঠলো, “জিপ ছাড়ছে, ভালো করে বসুন মিস তনয়া!”
সত্যি সত্যি জিপ ছেড়ে দিল। জ্যোতি হতাশা প্রকাশ করল বলল, “থাক! লাগবে না!”

তনয়া দু ঠোঁট চেপে পাশে তাকাল। উষ্ণ হাসছে মিটমিটিয়ে। তার টি শার্টের গলায় ঝুলছে সানগ্লাস। জিপ চলছে হেলেদুলে। তনয়া একটু বাদে বাদে তার গা ঘেঁষে যাচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেও সে চাইছে না। সামনের মেয়েগুলো প্রেমিকের গায়ে হেলে পড়ায় খেসে কুটকুট অথচ তনয়ার ভারী বিরক্তিকর লাগছে। উষ্ণ স্যারের দিকে ফিসফিস করে বলে উঠলো, “ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসা না অশালীন ব্যাপার স্যার?”

“আপনি চান ওরা আলাদা বসুক!”
একটু জোরেই বলল ইচ্ছে করে যাতে বাকিরাও শুনতে পায়। একেকজন এদিক ফিরে তনয়ার দিকে তাকাল। তাদের দৃষ্টিতে অভিমান আর রাগ দেখে সে চুপসে গেল। মনে হচ্ছে, এদের প্রেমিক প্রেমিকার ট্রিপ খারাপ করতে একমাত্র তনয়া দায়ী। বেচারি আর কথাই বলল না!

#চলবে

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২৪

সাজেক ভ্যালির প্রধান আকর্ষণ কংলাক পাহাড় আর রুইলুই পাড়া। তনয়ারে জিপ এসে থেমেছে বাজারের মধ্যে। এখান থেকে তারা হেটে কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্য রওনা দিবে। যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সর্বোচ্চ ১৫ কি ২০ মিনিট। সময় নষ্ট না করে প্রত্যেকে শুকনো খাবার, পানির বোতল কিনে নিল। সাথে কিনে নিল ট্রেকিং স্টক। পাহাড়ে উঠতে গেলে দরকার পড়তে পারে। তাড়াহুড়োয় তনয়া কেবল হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছে। প্রায় সবগুলো মেয়েই এই কাজ করেছে। তাদের আর চিন্তা কি? প্রেমিক মহোদয় আছেন সবকিছু পিছনের ব্যাগে নিয়ে ফেলবে। কিন্তু তনয়ার তো কেউ নেই। এই চিন্তা আগে কেন করল না সে? এতো কিছু কিনে এখন মাথা চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।

সবকিছু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরই মধ্যে উষ্ণ স্যার এসে দাঁড়াল তার সামনে। তার পিছনে ব্যাগ ঝুলছে। উষ্ণ স্যার চোখে ইশারা দিচ্ছে। তার অর্থ তনয়া বুঝতে পেরেছে। ভনিতা না করে পানির বোতল খাবার সব ঢুকিয়ে দিল ব্যাগের মধ্যে। যাত্রা এবার শুরু। বিকেল হতে যাচ্ছে তাই মানুষের আনাগোনাও বাড়ছে। বাজারের মধ্যে ভিড় ভালোই। সবাই দলবেঁধে হাঁটছে, হারিয়ে গেলেই তো মুশকিল। উষ্ণ আর তনয়া হাঁটছে সকলের পিছন পিছন। চারপাশে নজর দিতে গিয়ে তনয়ার হাঁটার গতি কমে এসেছে। নতুন জায়গায় এসে সবকিছু না দেখলে মজা আর কোথায়? স্থানীয় লোকজন নিয়ে তনয়ার আগ্রহ কম না, তাই তো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কে জানতো একদম পিছিয়ে যাবে। আর উষ্ণ স্যার ও তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে পিছিয়ে গেছে। এতে যেন মহাখুশি সে। অতীতের কথা ভুলে উত্তেজনায় তনয়া আর উষ্ণ স্যারের সাথেই কথা বলছে চারদিক নিয়ে। ভালো একজন শ্রোতা পেলে কথার আগ্রহ যেন বেড়ে যায় দ্বিগুণ ভাবে।

পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে প্রত্যেকে সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ি গুলো আদৌও সিঁড়ি নয়। পাথর দিয়ে বানানো সিঁড়ির আকার দেওয়া। আশপাশ ঘন সবুজ গাছপালা, শান্ত নিরব পরিবেশে কেবল ঝর্ণার পানির শব্দ। তনয়ার মন নিশপিশ করছে ঝর্ণা দেখার জন্য। একটিবার যদি কেবল ঝর্ণার পানি ছুঁয়ে দেখতে পারত। সম্ভব না বোধহয়। কারণ সবাই পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আর কিছু না হোক সূর্যাস্ত দেখার আগ্রহ প্রত্যেকের।

গতরাতে কি বৃষ্টি হয়েছিলো? পাথর গুলো বেশ পিচ্ছিল। হাঁটতে হচ্ছে সাবধানে পা ফেলে। একেকজন কপোত কপোতী হাতে হাত রেখে সাবধানে পা ফেলে আগে আগে উঠে যাচ্ছে। তনয়া বরাবরের মতো পিছিয়ে গেছে। উষ্ণ স্যার একটু এগিয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য। ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে দিতে। তনয়া রাজি হবে না জানে, এই কারণেই অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ চলবে না। তনয়াকে অবাক করে দিয়ে উষ্ণ স্যার চট করে তার হাত ধরে ফেলল। নিজের হাতের মুঠোয় হাতখান আগলে ধরল। তনয়া রীতিমতো বোয়াল মাছের মতো লাফিয়ে উঠল। হতভম্ব হয়ে ফিরে চাইল।

উষ্ণ স্যার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, “তুমি এভাবে চলতে থাকলে রাতে গিয়ে পৌঁছাবো আমরা। কথা না বলে আমার সাথে চুপচাপ চলো!”

ধম*কেই বলল যেন। তনয়া ঢোক গিলে ধম*ক গিলে ফেলল। উষ্ণ স্যারের চোখে মুখে এমন ভাব, কেবল দ্রুত হাঁটার জন্যই হাতখান ধরেছে সে। কিন্তু আদলে তা তো নয়। অতঃপর অতি সন্তর্পণে ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে উপরে উঠতে লাগল দুজন। সব কলিগদের চোখে যেন লাগল বিষয়টি অথচ স্যারের ভয়ে কেউ মুখ ফুটে কিছু বলল না। কেউ কেউ ভাবল স্যারের মতো ভালো মানুষ হয় না। মেয়েটা উপরে আসতে পারছিলো না বলেই স্যার হেল্প করছিলো।

ঠিক সূর্যাস্তের আগেই তারা পৌঁছাল। এখান থেকে লুসাই পাহাড়, মেঘের সমুদ্র সব যেন স্বচ্ছ আর স্পষ্ট। মেঘের সমুদ্র কেটে গেলে তবে তো সূর্যের দেখা মিলবে। সময় মোতাবেক সূর্যাস্তের সময় হয়ে গেছে প্রায় অথচ আকাশ দেখে কেউ তা উপলব্ধি ও করতে পারব না। হাঁপিয়ে উঠে একেকজন আকাশ দেখে থমকে গেল। দু মিনিটের জন্য জীবনের সব গ্লানি ভুলে তৃপ্তি চোখে কেবল দেখতে লাগল আকাশকে। শুভ্রতার ছোঁয়া যেন চারদিক ঢেকে রেখেছে। কেবল একজনের চোখে অন্যকিছু, তার নজর ও অন্যদিকে। তার শান্তি, তার প্রশান্তি যেখানে তার নজরও সেদিকে।

অতঃপর সকলে আলাদা হয়ে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে সূর্যাস্তের। জুটি বেঁধে তারা গল্প করছে, খাওয়া দাওয়া করছে, ছবি তুলছে। তনয়ার সাথে চিপকে থাকা জ্যোতি বেগমের দেখা মিলছে না। স্যারের যেন অসুবিধে না হয় এই কারণে জ্যোতি ম্যাডাম কে নিয়ে ঘুরছে জেএস। এই মহিলা ইতিমধ্যে তার মাথা খেয়ে ফেলেছে। যেভাবে মুখ চলে সেভাবে হাত। হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল, ছবি তুলে দিন ভাইয়া!

না চাইতেও জেএসের এই কাজ করা লাগছে। বিরক্ত লাগছে। শখানেক ছবি তোলার পরেও তার মন ভরছে না। নারীদের মন ভরে কিসে আসলে?

তনয়া আর উষ্ণ দাঁড়িয়ে গাছের ছায়ায় নিচে। প্রবল বাতাসে সবকিছু যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। তনয়া দু হাতে চুলগুলো খোঁপা বেঁধে নিয়ে এদিক ফিরল। তার বা পাশে, যেখানে উষ্ণ দাঁড়িয়ে। উষ্ণের নজর সামনের দিকে। হাওয়াতে তার চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। কি আশ্চর্য, কি সুদর্শন! চোখ ফেড়ানোর উপায় নেই। দেখতে সিনেমার হিরোর মতো লাগছে। তার লম্বা ঘন চুলগুলো হাওয়াতে কেবল দোল লাগছে। এরই মধ্যে উষ্ণ তার দিকে ফিরে মুচকি হাসল। তনয়া নিজেকে উপলব্ধি করতে পারল। চোখ সরিয়ে নিল চটপট।

উষ্ণ হেসে শুধায়, “আমায় দেখছিলে বুঝি?”
“না, হ্যাঁ ওই আর কি, আপনার চুলগুলো দেখছিলাম। খুব যত্ন করেন বোধহয়।”
“তুমি শুরু থেকে আমার চুল নিয়ে পড়ে আছো তনয়া?”

তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় এদিক। উষ্ণ ঠোঁট চেপে হেসে বলে, “আমি জানি আমি হট এন্ড হ্যান্ডসাম।”
“কচু আপনি?”
“তোমার ওই জমজ ভাইয়ের থেকে তো বেটার!”
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। ও আমার ভাই না।”
উষ্ণ জবাব না দিয়ে হাসলো কেবল। মনে মনে আওড়ালো, “ভাই বানানোর দায়ভার নিয়ে নিলাম তবে!”
অতঃপর বলল, “তুমি জানো যখন ইউ কে তে ছিলাম তখন এই চুলগুলো সব লাল করিয়ে ফেলেছিলাম!”
“কেন?”
“ফ্যাশন।”

তনয়া হতবুদ্ধির মতো উষ্ণের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কল্পনা করার চেষ্টা করল। লম্বা লাল চুলে স্যারকে কেমন লাগবে আসলে? ভেবে গিয়ে ঠোঁট দুখান চেপে ধরল। উষ্ণ আঁচ করতে পেরে বলল, “এই আমায় সত্যিই অনেক হ্যান্ডসাম লাগছিলো। তোমায় ছবি দেখাবো আমি! দেখো!”
তনয়া মাথা নেড়ে শুধায়, “হু লাল বাঁদর!”
“তুমি আমায় লাল বাঁদর বললে?”

তনয়া হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। উষ্ণ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তনয়া তাকে লাল বাঁদর বলল। তনয়া চলেই যাচ্ছিল। উষ্ণ হুট করে তার বাহু টেনে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল, “তুমি সিরিয়াস তনয়া। সত্যিই, লাল বাঁদর!”

স্যারের হতভম্ব মুখখান দেখে তনয়া এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। দু সেকেন্ডের জন্য যেন থমকে গেল উষ্ণ। আঁখিযূগল মশগুল হয়ে গেল তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে। অস্থিমজ্জা চঞ্চল হয়ে উঠল হাসির কলরবে। সকলের শব্দ শোনা গেল। সূর্যের দেখা মিলছে। মেঘ কেটে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশের লাল আভা সবকিছু নতুন রূপে রাঙিয়ে দিচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে সকলে। ফটোগ্রাফি বাদ যায় না যেন!

———

কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তনয়ার সাথে এক রোমাঞ্চ মূহুর্ত কাটালো উষ্ণ। কোনো রকম ঝগড়া আর ভনিতা ছাড়া দারুণ এক টুকরো সময়। কিন্তু রিসোর্টে ফিরে আসতেই মন যেন চিড়চিড় করে উঠল। তার পাশে থাকা তনয়া তন্ময় কে দেখতে পেয়েই ছুটে তার কাছে চলে গেল। এই ঘটনা যেন মেনে নেওয়া যায় না। সারাদিনের আনন্দময় স্মৃতিটুকু পিষিয়ে দেবার জন্য এতোটুকুই যেন যথেষ্ট। তনয়া খুশিতে গদগদ করছে। কি দেখে এলো, কেমন সময় কাটালো সবটা যেন তন্ময় কে বলা চাই। একেকটা সময় যেন তাকে না বললে একটুও শান্তি পাবে না সে। উষ্ণের মুখের মলিন ভাব কেটে গেল। সে এবার শকুনে^র দৃষ্টিতে দেখছে তাদের। ঘাড় বাঁকিয়ে, চোখে মুখে তিক্ততা ছাপ। বিস্বাদ যেন সবকিছু। জেএস বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ স্যারকে নিয়ে কটেজে চলে গেল। স্যার উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেললেই বিপদ।

পরেরদিন তারা টানা ঘুরল। ভোরে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো উষ্ণ স্যার এই সারাটে দিনেও একবার তনয়াকে খুঁজে পেল না। তার টিকিটি অবধি ছুঁতে পারল না। সেই মেয়ে সারাক্ষণ তন্ময় তন্ময় করে তার পিছনই ছুটেছে। যেখানে বাকিসবাই চারদিক ঘুরে ক্লান্ত সেখানে উষ্ণ স্যারের অবস্থা ভয়াবহ। সে যেন কিছু দেখেনি। কোনো কিছু উপলব্ধি করতে পারেনি। তার নজর, দৃষ্টি জোড়া কেবল এক জায়গায়। তন্ময়ের কাছাকাছি! তাদের দুজনকে কাছাকাছি দেখে কেবল ছটফট করেছে সে। যেন আগু^নে জ্ব*লে পুড়ে ঝল*সে যাচ্ছে। শেষ অবধি সকলের সূর্যাস্ত না দেখেই সকলের আগে থেকে ফিরে এলো রিসোর্টে। আর যেন সহ্য হচ্ছিল না। তাকে এমনভাবে ছটফট করতে দেখে জেএসের রক্ত শীতল হয়ে উঠল। স্যারের এমন আচরণ মোটেও ভালো কিছু না।

তনয়ার ভালো দিনগুলোর মধ্যে আজকের দিন উল্লেখযোগ্য। বহু বছর পর এতো ভালো দিন কাটিয়েছে সে তাও তন্ময়ের সাথে। খুশিতে গদগদ, ক্লান্ত দেহ নিয়ে এসে পৌঁছাল রিসোর্টে। রিসোর্টের বাইরে স্যারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা অবাক হলো। স্যার কি তবে তাদের আগেই চলে এসেছে। তন্ময়ের ফোনটাও বেজে উঠল। একটু দূরে সরে গেল ফোন হাতে। তনয়া মাঝে একা দাঁড়িয়ে। পিছনে তন্ময়, সামনে উষ্ণ স্যার। তীক্ষ্ণ নজরে তাকেই যেন পরখ করছে।

তনয়া পিছন করল। তন্ময় হনহন করে হেঁটে আসছে। এসেই হুড়মুড় করে বলে উঠলো, “আমায় এখুনি ঢাকায় ফিরতে হবে তনয়া।”

“এখনি মানে? কি হয়েছে?”

“মা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি বাবা সামলাতে পারছেন না। আমায় যেতে হবে!”

তনয়া আঁতকে উঠল। শুধাল, “কি বলছিস? কখন হলো এসব? কিভাবে? আন্টির কি হয়েছে?”

তন্ময় হনহন করে কটেজের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “বলছি তোকে সব। এখন আমার হাতে সময় নেই। যেতে হবে!”

বলেই কটেছে ছুটে গেল। তনয়া ছুটল তার পিছু পিছু। উষ্ণ চৌধুরীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কিছুই আড়াল করতে পারেনি। সে কেবল বাঁকা হাসল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাগ পত্র নিয়ে তন্ময় বেরিয়ে এলো। তার পিছন পিছন তনয়াও। উষ্ণ আর ম্যানেজার সাহেব বাইরেই দাঁড়িয়ে। ব্যাগপত্র দেখে তাদের কপাল কুঁচকে গেল। অতঃপর সবটা শুনে ম্যানেজার সাহেব দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন,

“আমরা তো কালই চলে যাচ্ছি তন্ময়!”

“জানি স্যার, কিন্তু আমার হাতে এতো সময় নেই। যেতেই হবে।”

“এতো রাতে গাড়ি পাবে?”

উষ্ণ আগ বাড়িয়ে বলল, “আমি কি ব্যবস্থা করে দিব?”
তন্ময় কি বলবে বুঝে উঠতে পারল। তনয়া নিশ্চুপ ভঙ্গিতে স্যারকে দেখছে। এমনটা হলে তো মন্দ হয় না। ম্যানেজার সাহেব নিজেই অনুরোধ করলেন। উষ্ণ স্যার জেএস কে ডেকে পাঠালেন। সবটা যেন তৈরিই ছিল। তন্ময় জীপে উঠতেই যাবে অমনি তনয়া বলে উঠলো, “আমিও তোর সাথে যাই? ব্যাগ তৈরিই আছে আসতে দু মিনিট লাগবে।”

উষ্ণ চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল দ্রুত। মিনমিন স্বরে বলল, “এতো রাতে তুমিও যাবে?”

কথাটা তন্ময়ের কানে যেতে সময় লাগল না। ঠিকই তো, এতো রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় যাওয়া মোটেও ঠিক কাজ হবে না। রিস্ক আছে এতে। অতঃপর সেই বলে উঠলো, “না না, এতো রাতে তোকে নিয়ে যাবার দরকার নাই। আর কাল তো তুই আসছিসই। অসুবিধে নেই। আমি যেতে পারব। একা থাকলে দ্রুত যেতে পারব।”

এই জীবনে প্রথমবার উষ্ণ যেন তন্ময়ের কথা শুনে শান্তি পেল। সে কেবল মাথা নাড়ল। তনয়া কিছু বলতে পারল না। দেখতে দেখতে তার চোখের সামনে থেকে জীপ বেরিয়ে গেল। সারাদিনের ফুরফুরে মনটা সাথে সাথে তার খারাপ হয়ে গেল। ঠোঁট উল্টে উষ্ণ স্যারের দিকে চাইল। কি ভেবে মুখটা ঠিক করে তাকে ধন্যবাদ জানাল।‌ তার জন্যই যেন সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো, তন্ময় দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে স্যারের কারণে। লোকটা এতোটাও বুঝি খারাপ না। অতঃপর উদাস মনে রিসোর্টের দিকে চলে গেল সে। উষ্ণ পলকহীন ভাবে চেয়ে রইল তার চলে যাবার দৃশ্যে। পথটা কেন উল্টো হলো না? গন্তব্য ঠিক থাকলে যেন পথও আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়। তনয়ার গন্তব্য কি আদৌ?

#চলবে

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২৫

তন্ময় চলে যাবার পর থেকেই ট্রিপের আনন্দ যেন ফুরিয়ে গেছে তনয়ার। তন্ময় ভোরের মধ্যেই ঢাকায় পৌঁছে গেছে। কথা হয়েছে, আচমকা তার মায়ের শ্বাসক*ষ্টের সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাপারটা সিরিয়াস ছিল বিধায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। যদিও ডাক্তার বলেছিলো আর কোন অসুবিধা নেই তবুও অসুস্থ মায়ের মন মানে না, ছেলেকে দেখার জন্য মন আনচান করে উঠে সর্বক্ষণ। তাই তন্ময় কে এতো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে হলো। আন্টি এখন ভালো আছে শুনে তনয়ার স্বস্তি মিলল। এবার খুব জলদি ঢাকায় যেতে পারলে হয়। এখানে আর মন টিকছে না একদম।

তনয়ার মন ভালোর জন্য সব চেষ্টা করছে উষ্ণ। সেদিন ঝর্ণা দেখতে চেয়েছিলো পারেনি। আজ সেখানেও নিয়ে গেল। কিন্তু তনয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে পেলো না সে। সে কেবল উসখুশ করছে ফিরে যাবার জন্য। এমন হৃদয় ভাঙা বুঝি আর হয় না। যেখানে নিজের সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার জন্যসেখানে এক পলক চোখ মেলে দেখার সময় হয় না। অথচ সে কিছু না করেই হৃদয়ে এতোখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে যে মুছে ফেলা কষ্ট*সাধ্য। কিন্তু হে*রে গেলে যে হয় না। উষ্ণ চৌধুরী যে তা শিখেনি।

তনয়া মরি*য়া হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে আজ দিন কাটছে খুব ধীরে সুস্থে। সময় যেন শেষই হচ্ছে না। বেড়েই যাচ্ছে বরং। এভাবে হলে কিভাবে হবে?
ঝর্ণায় পানি পড়ার শব্দ কানে যাচ্ছে। কেউ কেউ এখনি পাজামা তুলে পানিতে নেমে গেছে। তনয়া খুশি হতে পারছে না। সে সত্যিই পারছে না। মনটা যে পড়ে আছে ওখানে।

ঝর্ণার অনেক কাছে দাঁড়িয়ে সে, হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। অথচ মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল সবকিছু্ই তিক্ততায় মিশে যায়। তার হয়েছে সেই হাল। আচমকা চমকে উঠল সে। তার হাতটা আগলে ধরে বাড়িয়ে ঝর্ণার পানি ছুঁয়ে দিল কেউ। ঝর্ণার ঠান্ডা পানি ছুঁতেই শীতল হয়ে উঠল পুরো দেহ। অদ্ভুত প্রশান্তির হুদিশ মিলছিল যেন। ঘাড় বাঁকিয়ে পাছে দেখতেই উষ্ণ চৌধুরী মুখখানি ভেসে উঠল। দুজনের মুখোমুখি থাকে হয়ে গেল অপ্রতুল ভাবে। তনয়া অনুভব করছে, তার উচাটন মন এবার শান্ত হতে শুরু করেছে। কি অদ্ভুত রকমের অশান্তি। কি কারণে? কেবল এই ঝর্ণার জন্য। উষ্ণ মৃদু হেসে বলল, “অন্যের জন্য নিজেকে কষ্ট দিতে নেই তনয়া, তাহলে কখনোই সুখী হতে পারবে না!”

হাত ছেড়ে দিল সে। সরেও গেল। তনয়া একা দাঁড়িয়ে ঝর্ণার কাছে। ঝর্ণার পানির ছন্দ যেন প্রকৃতির বন্দনা। কি অদ্ভুত শান্তি এখানে, কোলাহোল নেই, কষ্ট নেই, অস্থিরতা নেই আছে কেবল প্রশান্তি। শান্তির অন্যরূপ এই প্রকৃতি। কেন? এর উত্তর সে পেয়ে গেছে!
.
টানা তিনদিনের ঘোরাঘুরি শেষে এবার বাড়ি ফিরার পালা। একে একে বাসে উঠার পরই প্রত্যেকের এর্নাজি কমে অর্ধেক হয়ে গেল। অনেকখানি পথ এসেছে জিপে করে। এবার বাকি পথটুকু বাসে করেই যেতে হবে। তখন প্রায় মধ্যরাত। তনয়া সবেমাত্র তন্ময়ের সাথে কথা বলা শেষ করল। মা এখন অনেকটাই সুস্থ। প্রথমেও দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু মায়ের জন্য ছেলের মন মানে না যে।

তারা আসার জন্য রওনা দিয়েছে শুনে তন্ময় ও খুশি হলো। সাবধানে আসতে বলে ফোন রাখল অপ্রান্ত। তনয়া ফোনটা হ্যান্ডব্যাগে রাখতেই পাশে দাঁড়ানো উষ্ণ স্যার বলে উঠলো, “এখন কেমন আছে তার মা?”

তনয়া আঁতকে উঠল। হতভম্ব চোখে ফিরে চাইল। এই মাঝরাতে এভাবে হুটহাট কথা জিজ্ঞেস করলে যে কেউ হার্ট অ্যা*টাক করবে। বলে উঠলো,

“আপনি এখানে কখন থেকে?”

“অনেকক্ষণ ধরে। কথা শুনছিলাম তোমার। ভালো আছেন তাহলে এখন!”

তনয়া অবাক না হয়ে পারছে না। বিড়ম্বনা নিয়ে বলল , “কি সাহসের সাথে কথা বললেন। কাজটা কি ঠিক করছিলেন? লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শোনা কি ঠিক? কি আশ্চর্য, আরেকটু হলে আমায় হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতেন!”

উষ্ণ মুচকি হেসে বলল, “না না তুমি হার্ট অ্যাটাক করে ম*রবে না।”

“আপনি জানলেন কি করে? আজরাইল কি কাজের ভাগ আপনাকে দিয়েছে। যতসব উজবুগে কথাবার্তা।”

আর কতোকিছু বিড়বিড় করতে করতে সে বাসের মধ্যে উঠে চলল। উষ্ণ দু সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়াল। তার মনে হলো এই তো সে তনয়া কে দেখছে। এই তো তনয়া। কিরকম চটপট কথাবার্তা বলে। এমন ভাবেই তো দেখেছিল তাকে প্রথমবার। মোটুসুটু মেয়েটা মাথায় সিঁথি এঁকে দু পাশ বেনী করে সারাদিন ঘুরে বেড়াত। কেউ একটা কথা বললে দুটো কথা শুনিয়ে দিত। আগের রূপ যেন একটু একটু করে ফেরত আসছে!

বাসের মধ্যে একে একে সকলে উঠে জায়গা দখল করে নিয়েছে। তনয়া সিট খুঁজছিলো। পাছে থেকে কে যেন তাকে ডাকল। চেয়ে দেখল জেএস। সিটের উপর হাত রেখে তাকে ডাকছে যেন তার জন্য জায়গা ধরে রেখেছে। তনয়া ভ্রু দুখান কুন্চিত করে ফেলল। মুখ টিপে হেসে জেএসের পাশে বসে বলল, “কি ব্যাপার স্যার? আমার জন্য জায়গা ধরে রেখেছিলেন নাকি?”

জেএস উদাস গলায় বলল, “আর বলবেন না ম্যাডাম, এই জ্যোতি ম্যাডাম কথা বলে বলে আমার মাথা খারাপ করে ফেলেছে। প্লিজ আর যাই কিছু হোক না কেন আমার পাশ থেকে আপনি উঠবেন না!”

তনয়া খুশি হয়ে মাথা দুলাতে লাগল। কে চায় উঠতে? আসার কথা তার মনে আছে। উষ্ণ স্যারের চেয়ে তার সেক্রেটারির সাথে বসা একশ পার্সেন্ট ভালো। এই সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায়। একে একে সকলে উঠে বসল। বাস ছেড়েই দিবে এই মূহূর্তে উষ্ণ স্যার উঠলেন বাসে।

তনয়া তখন কথা বলছিলো জেএসের সাথে। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই জেএস উঠে দাঁড়াল। তনয়া তাকে লক্ষ্য করে মাথা ঘুরিয়ে পেছন তাকাল। সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উষ্ণ স্যার। ধম*কের সুরে বলে উঠলো, “ওদিকে যাও!”

“হু কি আমি?”

“ওদিকে বসো! কথা কি শোনো না!”

ধ*মক খেয়ে লজ্জা পেয়ে তনয়া জানালার সিটের পাশে বসে পড়ল। হঠাৎ ধম*ক শোনার কারণ ও সে জানে না। আচমকা তার গা ঘেঁষে উষ্ণ স্যার বসে পড়ল। তখন সে সবটা বুঝতে পারল। চোখ মুখ শক্ত করে এদিক ওদিক তাকাল। জেএসের বাচ্চাটা কোথায়? ওই তো, ম্যানেজারের সাথে। তাকে এমনভাবে ঠকালো। শা লা হাদারাম, এই ছিল তোর মনে?

উষ্ণ বোতল থেকে পানি খেয়ে সবে বোতলের ছিপি আটকে বলল, “ওকে এতো বদদোয়া দিও না, ওর কোনো দোষ নেই?”

“তার মানে? তার মানে এসব আপনার চালাকি?”

“এখানেই বসো তুমি, বমি, মাথা ঘোরা যা হবে আমি সামলে নিব।”

“হু মোটেও না। আপনার সাথে আমি একসাথে বসব না।”

“তাহলে কোথায় বসবে?”

তনয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সেখানে ইচ্ছে!”

“কিন্তু তনয়া এখন তো…

বলার সাথে সাথে বাস ছেড়ে দিল। বাসের ঝাকুনি খেয়ে তনয়া তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে এসে বসল উষ্ণের কোলে। মূহূর্তের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে যাওয়াই দুজনেই হতভম্ব। উষ্ণ বাঁকা হেসে দুই হাত সরিয়ে বলল, “ওহ আচ্ছা এই ছিল তোমার মনে? এখানে বসতে চেয়েছিলে?”

তনয়ার বুদ্ধি পুরোপুরি লোপ পাওয়ার আগেই ধপ করে উঠে পাশের সিটে বসে বলল, “একদম না।”

“হুম হুম আমি বুঝতে পেরেছি। এতো ইচ্ছে থাকলে আমায় বলেই দিতে। আমি আদর করে তোমাকে বসাতাম।”

“একদম ফালতু কথা বলবেন না। এটা একটা এক্সি*ডেন্ট ছিল।”

“হ্যাঁ, এক্সি*ডেন্টলি বসের কোলে বসা, ভালোই একটা অজুহাত।”

তনয়া রেগে চণ্ডা*র রূপ ধারণ করল। এদিক ফিরে আঙুল তুলে রু*ষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো, আর একটা আজেবাজে কথা বললেন না!

উষ্ণ মৃদু হেসে তার দিকে ফিরে হাতের আঙুল ধরে বলল, “তোমার ভাগ্য ভালো আমি কেবল উল্টাপাল্টা কথা বলি, উল্টাপাল্টা কিছু করি না!”

তনয়া আঙ্গুল ছাড়িয়ে নিল তৎক্ষণাৎ। ঠোঁট দুখান চেপে ধরে এদিক মুখ ফিরাল। লজ্জায় ম*রে যাচ্ছে, ছিঃ ছিঃ কি কাণ্ড এটা ঘটল। ভাগ্যিস রাতের অন্ধকারে বেশির ভাগ আলোই নিভানো। কেউ এতোটা খেয়াল করেনি। করলে কি হতো? মুখ দেখাতো কি করে? এমন বিচ্ছিরি একটা ঘটনা স্যারের সাথেই ঘটতে হলো। লজ্জায় মুখ ঢেকে নিল সে। এই মুখ কিভাবে মিলাবে সে!

#চলমান