#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৫০
স্বচ্ছ আয়নায় আরো কাছ থেকে নিজেকে পরখ করছে তনয়া। সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি জানালার ফাঁক দিয়ে সোজা এসে ঠেকেছে আয়নাতে। চিকন সরু সোনালী তীক্ষ্ণ রশ্মি জানান দিচ্ছে বাইরে ভোর হয়ে গেছে। আজ দুদিন ধরে তনয়া অফিসে যেতে পারেনি। যেতে পারেনি ওই ভদ্রলোকের কারণে। ঠোঁট কা*মড়ে বেহাল দ*শা করে সেরেছে। ক্ষ*ত তো আরো ছিল, সেগুলো না হয় ঢেকে রাখা যায়। কিন্তু এই ঠোঁটের জন্য কিইবা করতে পারত সে। অগত্যা দুদিনের ছুটি কাটাতেই হলো। পুরোপুরি না সারলেও ক্ষ*ত স্থা*নের দাগটা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটু গাঢ় লিপস্টিক দিলে বোধহয় ঢেকে ফেলা যাবে। তনয়ার চোখ মুখ কুঁচকে আয়নার দিকে তাকাল। অসভ্য, ইতর লোকটার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে সেখানে। উষ্ণ বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে তনয়াকে দেখছে। তনয়া তার দিকে ফিরতেই ইচ্ছে করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল সে। খোঁচা মা*রা যাকে বলে আর কি। তনয়া ভীষণ গম্ভীর মুখে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল। কোনো ব্যাপার নিয়েই কিছু বলতে তার ইচ্ছে করছে না। তন্ময়ের বাবার খবরটাও আর জানা হলো না। উষ্ণের ভয়ে*তে তো ফোন ও করেনি সে।
উষ্ণ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল, “আজ অফিসে যাচ্ছ তাহলে?”
“হ্যাঁ, যেতে তো হবেই। আপনার জন্য আমার দুদিন নষ্ট হলো।”
“কেন? আমি আবার কি করলাম?”
“আপনিই তো ঠোঁট কা….
বাকি কথা মুখেই আটকে গেল। উষ্ণ ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে আছে। তনয়া কথা শেষ না করেই উল্টো দিকে পা বাড়িয়ে চলে গেল।
অফিসে এসে খোঁজ নিল। তন্ময় ও নাকি দুদিন অফিসে আসেনি। কেন? আংকেলের অবস্থা কি আরো খারাপ করল নাকি? টেনশনে তনয়ার হাল খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফোন হাতে নিয়েও স্যারের কেবিনের দিকে তাকাল। ফোনটা রেখে দিয়ে নিজের টেবিলে গিয়ে বসল সে। ওদিকে আয়নার দেয়ালের ওপাশে দাঁড়ানো উষ্ণ কিঞ্চিত হেসে বলল,
“তোমায় আমি চোখে চোখে রাখি তনয়া, তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমার জানা!”
অতঃপর নিজের টেবিলে রাখা কাগজটার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল।
নিজের ডেস্কে বসে কোনোভাবেই কাজে মন দিতে পারছে না তনয়া। ল্যাপটপ অন করে কেবল সামনে বসে আছে। জ্যোতি আর শফিক এসেছিলো দেখা করতে। দুদিন কেন আসলো না, কি খবর জানার জন্য। তনয়া কোনোভাবে তাদের এড়ানোর ধান্দায় ছিলো। এমনি সময়ে তন্ময়ের আগমন ঘটল অফিসে। তাকে আগের থেকে আরো বি*ধ্বস্ত আর অগোছালো লাগছিলো। তনয়া তাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। নিজেকে আর কোনোভাবেই আটকে রাখতে না পেরে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আংকেল কেমন আছে এখন?”
আচমকা তনয়ার স্বর পেয়ে তন্ময় কিছুটা ভড়কে গেল। সে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইল তার মুখ পানে। তনয়া উৎকণ্ঠা দেখে সে অবাক হচ্ছে আরো অবাক হচ্ছে এটা ভেবে দুদিন সে কিভাবে লাপাত্তা হয়ে ছিল। কারণ তন্ময় ভেবেছিলো তনয়া পরদিন আসবে বলে। কিন্তু না, সে আর আসেনি। বাবাকে দেখে যাবার দুদিন পরেও তার কোনো খোঁজখবর নেই। ফোন ও দেয়নি। তনয়াকে তো এভাবে চিনত না সে। তাই অবাক হচ্ছে বড্ড।
শফিক আর জ্যোতি ও এসে দাঁড়াল পাশে। অফিসের প্রায় সবাই জানত তার বাবার অবস্থা। তন্ময় ছোট করে জবাব দিল, “ভালো। কাল রাতেই আইসিইউ থেকে বের করা হয়েছে!”
“জ্ঞান ফিরেছে? ডাক্তার কি বলল?”
তন্ময়ের একটুও হচ্ছে ছিলো না জবাব দেবার। জ্যোতি আর শফিককে দেখে জবাব না দিয়ে পারল না। বলল, মাঝরাতে জ্ঞান ফিরেছিল।”
কথাগুলো শুনে যেন স্বস্তি পেলো তনয়া। সেখানে না যেতে পারার যে নিদারুণ যন্ত্র*ণায় ভুগছিল তা কিছুটা হলেও কমে আসল। জ্যোতি বলল,
“যাক আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। চিন্তা করিস না তন্ময়, দেখবি সব ঠিক যাবে।”
শফিক এসে তার ঘাড়ে হাত রাখল। তন্ময় পিছন ফিরতেই আশ্বস্ত করে চেয়ে বলল, “দুদিন যাক, এরপর আমরা গিয়ে দেখে আসব।”
তন্ময় মাথা নাড়ল। জ্যোতি বলল, “এবার একটু তোর দিকে নজর দে তন্ময়। কি অবস্থা হয়েছে তোর? কিরে তনয়া, একটু দেখে রাখিস না কেন?”
তনয়া হকচকিয়ে ফিরে তাকাল। অবাস্তব হলেও সত্য অফিসের তাদের সব কলিগ ধরে নিয়েছে তন্ময় আর তনয়া প্রেম করছে। তারা শতভাগ নিশ্চিত এরা দুজন প্রেম করে বিয়ে করবে। এরপর তাদের জানাবে!
তনয়া হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইল। কি যে বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। কিছুটা দূরে পেছনে এসে দাঁড়াল জেএস। সামনে ভিড়ের দিকে লক্ষ্য করে গলা উঁচু করে বলে উঠলো, “মিসেস তনয়া চৌধুরী!”
তনয়ার সাথে সাথে বাকি সবাইও পিছন ফিরল। ডাক দেবার এই ভিন্ন পদ্ধতি তনয়াকে স্তব্ধ করে দিল। প্রথমে বাকি ৩ জন না বুঝতে পারলেও পরে সকলেই বুঝল। এমনকি সামনের দু তিনজন তো উঠেই দাঁড়াল। জ্যোতি তার বাহু শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল, “কিরে তনয়া? তুই মিসেস কবে হলি? বিয়ে করলি কবে?”
তনয়া বাকরুদ্ধ! সে হম্বিতম্বি করে ফিরল তন্ময়ের পানে। আকস্মিক ঘটনায় তন্ময় কম অবাক হয়নি। বাকিরাও এদিকেই ঢেলে আসছে। হঠাৎ সবাই এভাবে তাকে জেকে ধরায় বেচারির অবস্থা কাহিল। ভাগ্যিস জেএস ফের তাকে ডাকল। বলল, মিসেস তনয়া, স্যার আপনাকে ডাকছে!”
এই অজুহাতে তনয়া সবার চোখের আড়াল হয়ে গেল। প্রাণভরে শ্বাস নিল। সবাই এবার তনয়াকে ছেড়ে তন্ময়কে ধরেছে। জ্যোতি বলে উঠলো,
“কিরে? তনয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। তুই বললি না কেন?”
“আমি তো আজ জানলাম।”
শফিক বলে উঠলো, “আজ জানলি মানে? তোরা না বেস্ট ফ্রেন্ড? আর এদিকে আমরা ভাবলাম তুই… বাকি কথা বলার আগেই জিহ্ব কেটে ধরল। সকলের উৎসুক চাহনি তার উপর। তন্ময় মুচকি হেসে বলল,
“আমরা বোধহয় আর আগের মতো বন্ধু নেই! বন্ধুত্ব আর রইল না আমাদের!”
———
তনয়ার হাত কাঁপছে! তার হাতে সাদা কাগজে কালো কালি দিয়ে গোছানো লেখা। কাগজটা পেয়েছে উষ্ণ স্যারের ডেস্কের উপর। স্বয়ং উষ্ণ স্যারই বলেছেন কাগজের ভাঁজ খুলে পড়তে। এখন পড়ার পর তার গলা শুকিয়ে আসছে। হাত কাঁপছে! মাথায় চাপছে হাজার হাজার চিন্তা। উষ্ণ ডেস্কের ওপাশ থেকে ঘুরে এদিকে এলো। তনয়ার হাতটা চেপে ধরে বলল,
“অবাক হচ্ছো বড্ড?”
তনয়া ফিরে চাইল। আঁখি ভরা আকুতি মিনতি। উষ্ণ তার থিতুনিতে হাত রেখে শুধাল,
“নীলাম্বরী!”
“আপনি প্লিজ এমন টা করবেন না। তন্ময়ের চাকরিটা এখন খুব দরকার। ওর বাবা অসুস্থ, মায়ের অবস্থা ও ভালো না। এখন চাকরিটা চলে গেলে একদম সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে! আমি কথা দিচ্ছি, আর কখনো ওর সাথে কথা বলব না। কখনো দেখাও করব না। প্লিজ এমনটা করবেন না!”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল তনয়া। উষ্ণ তখনো ভাবলেশহীন। কেবল দৃঢ় স্বরে বলে উঠলো, “বেবী, আমায় ছাড়া অন্য কারোর জন্য চিন্তা তোমার চোখে কি মানায়?”
থিতুনিতে রাখা হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল তনয়া। কাঁপা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো, “আমি আপনার সব কথা শুনব, যা বলবেন চাই করব। প্লিজ তন্ময় কে ছেড়ে দিন।”
উষ্ণ রে*গে পেল। ঠোঁট চেপে তনয়ার বাহু শক্ত করে চেপে বলল, “লাইক সিরিয়াসলি তনয়া? তুমি আমার! শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরীর যা চাই সে তাই পায়। এজন্য তোমার কিছু করতে হবে না। আর শান্ত হও। আমার এসব একদম ভালো লাগছে না!”
তনয়া শান্ত হলো। কিছুক্ষণের জন্য একটু অস্থির হয়ে গেছিলো। দুদন্ড দাঁড়িয়ে নিজেকে শান্ত করল। শব্দ করে শ্বাস নিল। উষ্ণ ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করল,
“কি চাও তুমি?”
“আপনি ওকে অন্য কোথায়ও বদলি করে দিন। এই কোম্পানির আরো অনেকগুলো ব্রাঞ্চ আছে। চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিন, নাহলে রাজশাহী। দূরে কোথাও, ঢাকা থেকে দূরে!”
উষ্ণ তনয়ার চোখে মুখের উচ্ছ্বাস দেখে মুচকি হাসল। এই মেয়েটাই কিছুদিন আগে যাকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষায় মগ্ন ছিল আজ তাকেই বলছে দূরে সরিয়ে দিতে। কি সাংঘা*তিক মনবদল!
“দিলাম! তাহলে খুশি তুমি?”
তনয়া চমকে গেল। কি জবাব দিবে ভেবে পেলো না। উষ্ণ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে তার গালে হাত বুলিয়ে বলল, “ট্রাস্ট মি! তোমার খুশির জন্য আমি সব করতে পারি। সব! তার বদলে তুমি যাস্ট আমার পাশে তাহলেই হবে!”
কথাটা শেষ করেই মিষ্টি একটা চুমু খেলো তনয়ার কপালে!
———
সেদিনই তন্ময়কে ট্রান্সফার লেটার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার বাবা এখন কিছুটা সুস্থ কিন্তু পুরোপুরি না। বেড থেকেই নামতে পারছে না। এই মুহূর্তে অন্য কোথাও শিফট হওয়া মহাঝামেলার। তাও এই সপ্তাহের মধ্যে। ৪/৫ দি তো এভাবেই লেগে যাবে ঘর খুঁজতে। তার মধ্যে আবার বাবার বিষয়টা। তাকে তো হাসপাতাল ভর্তি করাতে হবে। তখন এসব ভাবনা মাথায় নিয়ে তন্ময়ের কাছে ট্রান্সফার লেটারটা বি*ষের চেয়ে কম লাগছিলো না। তিক্ত ব্যাপারটায় মুখ পুরোপুরি তিতকুটে হয়ে গেল। সেই সময়ের কথা ভাবলে জীবনটাকে জাহান্নামের পর্যায়ে মনে হয়। এসব ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কি আছে এই জীবনে? ব্যর্থতা আর আপনজন হারানো ছাড়া কোনোকিছুই না। প্রথমে ভালোবাসার মানুষ তরী এরপর তনয়ার মতো বন্ধু! সবাইকে চোখের নিমিষেই হারিয়ে ফেলল সে। মা বাবার এই ক*রুণ দশাও চোখে দেখতে পারছে না সে। যখন জীবনটা পুরোপুরি বোঝার মতো মনে হলো তখনি তার কাছে একটা সুখবর নিয়ে এলো জেএস।
এখন জেএস কে তার কাছে কোনো দেবদূতের চেয়ে কম লাগছে না।খোদা তায়ালা যেন সাত আসমান থেকে জেএসকে পাঠিয়েছেন তাকে সাহায্য করার জন্য। এসকে শেহনেওয়াজ চৌধুরী লিমিটেড কোম্পানির পক্ষ থেকে চট্রগ্রামে তার একটা থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো পরিবার নিয়ে সেখানে থাকতে পারবে। এমনকি তার বাবার হাসপাতালের ব্যাপারটাও তারা দেখছেন। এসব শুনে তন্ময় রীতিমতো হতভম্ব! তার এতো সহযোগিতা করার জন্য উষ্ণ স্যার কে কি একটা ধন্যবাদ দিবে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে এখন ঢাকা ছেড়ে চলে গেলে এই একটি মানুষের ভীষণ লাভ। তাই এতো শত করছে প্রস্তুতি শহর ছাড়ার জন্য। নিজের ভাগ্যের করুণ দ*শার উপর হাসল তন্ময়। তবুও সমীকরণ মিলছে না। উষ্ণ ছাড় এখন এতো সদয় হয়ে লাভ কি? তনয়ার তো বিয়ে হয়ে গেছে? তবে কি? সং*শয় টা মনের ভিতরই রেখে দিল সং*গোপনে!
বিদায়ের দিন দেখা হবার কথা তনয়ার সাথে। দেখা করার প্রস্তাব টা সেই দিয়েছে। বাবাকে এয়ারপোর্টে নেওয়া হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। মা তার সাথে গেছেন। তন্ময় যাবে সবার শেষে। ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলে অপেক্ষা করছে তনয়ার জন্য। ফোন করে বলেছিলো আসতে। শেষবারের মতোই না হয় দেখা করুক তারা। একটিবারের জন্যই না হয়।
তনয়া এসেছে। তন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। বোধহয় ছোটাছুটি করে এসেছিলো। তন্ময় মুচকি হেসে বলল, “শেষমেষ তাহলে এই অধমের সাথে দেখা করতে এলি তনু?”
তনয়া সামলে উঠে বলল, “সরি দেরি হয়ে গেল। শোন সাবধানে যাবি আর আন্টি আংকেল কে একদম চোখে চোখে রাখবি। তারাই কিন্তু তোর শেষ সম্বল। এই সময় তাদের বড্ড প্রয়োজন তোকে। বুঝলি!”
“হুম!”
তার পানে চাইল। তনয়া ও মুখোমুখি হলো। বেশ অনেকদিন পর। তিক্ত স্মৃতি গুলো যেন ভুলতে পেরেছে দুই পক্ষই। তনয়া মৃদু হেসে বলল, “সাবধানে যাস আর নিজের খেয়াল রাখিস!”
“হুম। আর তুই ও নিজের খেয়াল রাখিস। আচ্ছা তনয়া, আর কি দেখা হবে না আমাদের!”
জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল তনয়া। মাথা দুলিয়ে জবাব দিল হবে। যদিও সে জানত এটাই তার শেষ দেখা। উষ্ণ স্যারকে এই কথা দিয়েই এখানে এসেছে দেখা করতে। তন্ময় ফের হাসার চেষ্টা করল। অতঃপর বলল, “একটা আবদার করব?”
“কি বল!”
“না জানিয়ে বিয়ে তো করে ফেললি? হাসব্যান্ড কে দেখাবি না?”
তনয়া পড়ল বিপাকে। তন্ময়ের এই শেষ আবদার তার মনে ঝড় তু*লে দিল। তন্ময় অপেক্ষা করছে জবাবের। এই মুহূর্তে সাই সাই শব্দ করে দুটো গাড়ি এসে থামল। একটা গাড়ি থেকে কালো শার্ট আর ফরমাল প্যান্টে পরিহিত অবস্থায় বেরিয়ে এলো উষ্ণ চৌধুরী। এসেই দাঁড়াল তনয়ার পাশে। তনয়ার চিকন কোমরে হাত আটকে নিজের দিকে টেনে নিল। অন্য হাতে নিজের রোদ চশমা খুলে নিয়ে মুচকি হাসল সে। তন্ময় বিস্মিত হলো! ধারণা একটু একটু ছিল কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। সত্যি সত্যি তনয়া উষ্ণ স্যারকে বিয়ে করেছে। তাকে একটিবার জানালোও না। তনয়া মুখটা কাচুমাচু করে ফেলল। অতঃপর একটু সাহস সঞ্চয় করে তন্ময়ের চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
“মিট মাই হাসব্যান্ড তন্ময়, শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী!”
উষ্ণ ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠল। তনয়ার কথা শুনে গর্বে তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। তন্ময় মুচকি হাসল। মাথা দুলিয়ে বলল, “তবে আমাদের বন্ধুত্ব এখানেই শেষ তাই তো! ইটস ওকে, আমি এটারই যোগ্য। বাই দ্যা ওয়ে, কনগ্রাচুলেশন বোথ অফ ইউ!”
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই গাড়িতে উঠে বসল সে। তনয়া দেখল, তার চোখের সামনে সে দূরে চলে যাচ্ছে। তনয়ার কষ্ট হচ্ছে না। অস্বস্তি হচ্ছে না। নিজেকে মুক্ত পাখির মতো লাগছে। উষ্ণ কোমরের হাত সরিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তনয়া মাথা নিচু করে ফেলল। তন্ময় যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেল। পরিবর্তে বদলে গেল তার জীবন। কি অদ্ভুত জীবন!
উষ্ণ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “আজ কি রান্না করবে বউ?”
#চলমান
#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৫১
পার্কের নাম ছিল “নন্দন পার্ক!” তখন পার্কের পরিবেশ আজকালকার মতো এতো শোচনীয় ছিল না। পার্কটাও এতো বিশাল ছিলো না। ছোট তবে বিকেল বেলা উপভোগ করার জন্য দারুণ জায়গা। তখনকার সেই সময়ে ছোট এই পার্কে প্রেমিক প্রেমিকারা এসে মাখামাখি করার সাহস পেতেন না। তার মধ্যে ছিল আবাসিক এলাকার মধ্যে। আশেপাশের সকল মায়েরা বিকেল হলেই বাচ্চাকে নিয়ে এখানে চলে আসতেন। মায়েরা গল্প করে সময় নষ্ট করতেন কিন্তু বাচ্চারা একে অপরের সাথে খেলে ধুলে।
সময়টা আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগের। “নন্দন পার্ক” তবে এলাকার মধ্যে বিশেষ পরিচিতি পার্ক। নন্দন পার্কের আশেপাশে ধনবান মানুষদের বসবাস। মায়েরা এই নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও বাচ্চাদের এসব বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিলো না। তখন এলাকার সবাই চিনত শেহনেওয়াজ পরিবারদের। বাপ দাদার রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে মন্দ ভাবেই পরিচিত ছিল তারা। মাঝে একবার শোরগোল বেঁধেছিল জাওয়াদ চৌধুরী কে নিয়ে। কোন মেয়েকে জানি তু*লে এ*নে বিয়ে করেছে। মেয়ের বা*বা পুলি*শ নিয়ে বাড়ি অবধি গেছে। কোনো সুবিধা করতে পারেনি। চৌধুরী পরিবারের সাথে আজ অবধি পেরেছে কেউ? এতো পুরোনো কথা আজ ফের উঠেছে নতুন কারণে। যে মেয়েকে তু*লে এনে*ছিলো সেই মেয়ে নাকি পালি*য়ে গেছে।
মায়েরা সব অবাক হয়ে চোখ কপালে তুলে নিলেন। একজন গালে হাত দিয়ে বললেন, “কি বলেন ভাবি? এতো বড় একটা ছেলেকে ফেলে গেলো কিভাবে?”
“জানি না ভাবী। গেছে এটা সত্য। পুরান প্রেমিকের হাত ধরে পালি*য়ে গেছে।”
“জাওয়াদ চৌধুরী নাকি মেয়েটাকে তু*লে এনে বিয়ে করেছিল। গিয়ে দেখুন মার*ধর ও বোধ হয় করত। এইজন্যই ফেলে* চলে গেছে। বুঝেন না ভাবী, নিজের জীবনে শান্তি না থাকলে স্বামী সন্তান নিয়ে কি করবে?”
“ভেতরে কি ঘটেছে তা জানি না ভাবি। কিন্তু আমরা কখনো কি এমন করতে পারতাম না। ছেলে সংসার ফেলে চলে যেতাম? যাই হয়ে যাক না কেন? মাটি কা*মড়ে পড়ে থাকতাম। দেখেন কি হয়? বাচ্চা ছেলেটার অভি*শাপ লেগে না হয়..
“ভাবী, ভাবী চুপ করুন।”
“কি হলো?”
চোখ তুলে সামনে ইশারা করতেই তিন চারজনের গলা নিচু হয়ে গেল। তাদের পাশে ছোট্ট উষ্ণ কে দেখেনি কেউই। দেখলে বোধহয় মায়ের নামে একের পর এক অপ*বাদ দিতে পারত না। উষ্ণের কানে মায়ের অপবা*দ এসেছিলো। সে চুপ করে ছিল। জবাব দিতে পারে নি। গুটি গুটি পায়ে সেখান থেকে চলে গেল। দূরে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। শোরগাল হচ্ছে ভীষণ।
উষ্ণ সেদিক না গিয়ে পথ ঘুরে নিরিবিলি পরিবেশে চলে গেল। তার বয়সী কতো গুলো ছেলেমেয়ে এখানে লুকোচুরি খেলছে। উষ্ণ কে কেউ খেলতে ডাকলো না। সেও যেচে যায় নি। তার বন্ধু বান্ধব বলে কেউ নেই। আগে সর্বক্ষণ মায়ের পিছন পিছন ঘুরঘুর করতো। মা একবার আদর করতেন একবার বকাঝকা করতেন। তাও পিছু ছাড়ত না। সাত বছর বয়সী ছোট উষ্ণের কাছে ওসব তখন বকাঝকা মনেই হতো না। আরো কতো জটিল কথা, জটিল ব্যাপার। সবই মাথার উপর দিয়ে চলে যেত। দিনশেষে বাবা বাড়ি ফিরে এলেই ভালো লাগত। তখন আর মা বকতেন না। ভালো ভালো কথা বলতেন। দিনের মা আর রাতের মায়ের মাঝে যেন অনেক তফাৎ তখন।
উষ্ণের দাদি ছিলো, দাদা নেই। দাদি অসুস্থ, বিছানায় পড়ে থাকতেন। মা খুব সেবাযত্ন করত। দাদির কাছে থাকতেও উষ্ণের ভালো লাগে। দাদি অনেক অনেক গল্প বলেন। কিন্তু এখন দাদির মন ভালো না। সবসময় মুখ ভার করে থাকেন। কারণ মা চলে গেছেন! মা নাকি আর কখনো ফিরে আসবে না। কখনোই না!
মা চলে কেন গেল? উষ্ণের ভালো লাগছে না। একটু ভালো লাগছে না। মা কেন থাকতে চায় না তাদের সাথে। সে তো খুব ভালো ছেলে, সবসময় মায়ের কথা শুনে। কোনো দুষ্টুমি করে না। তাও মা চলে গেল। কেন গেল?
এই কেন এর উত্তর ছোট্ট উষ্ণের জানা ছিল না। সে মুখ ভার করে রইল। ছেলেমেয়ে গুলো এখন লুকানোর ফন্দি আটছে। একজন গাছের কাছে গিয়ে গুনছে এক, দুই, তিন, চার… বাকি সবাই ছুটল।
উষ্ণ তাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। ওরা সব লুকিয়ে গেছে। সে লুকায় নি। তার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। এখানে সবাই তার মা কে নিয়ে খা*রাপ খা*রাপ কথা বলছে। মা তো খারাপ না। সবাই খারাপ কেন বলে? রা*গে সামনের একটা ইটের টুকরো ছু*ড়ে ফেলল দূরে। ইট গিয়ে পড়ল ঝোপের ভিতর। ঝোপ নড়েচড়ে উঠল।
উষ্ণ ওদিক পা বাড়াতেই শুনতে পেলো একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। পিছন ফিরল। আরে এটা তো মানুষের বাচ্চা না বিড়ালের বাচ্চা। কুচকুচে কালো,সবুজ চোখ ওয়ালা বিড়ালের বাচ্চা। উষ্ণ বির*ক্ত হলো। বিড়ালের ডাক তার ভালো লাগছে না। সে আরো একটা ইটের টুকরো হাতে তুলে নিল। বাচ্চা বিড়ালের গায়ে ইটের টুক*রো ছুড়া*র জন্য হাত তুলতেই পিছন থেকে কে যেন তার দিকে ছুঁ*ড়ে মারল। সেটা এসে লাগল পুরো তার মাথায়। উষ্ণ রে*গে পিছন ফিরে বলল,
“কে রে?”
লাল ফ্রক পরা এক পিচ্চি মেয়ে নাক উঁচু করে বলল, “আমি!”
“আমায় মার*লে কেন?”
“প্রথমে তুমি আমায় মে*রেছো। এজন্য মে*রেছি। শোধবোধ!”
“আমি তোমায় কখন মার*লাম? মিথ্যে কথা কেন বলো?”
মেয়েটা রে*গে ছুটে সামনে এলো। বলল,
“আমি মিথ্যে বলছি? একটু আগে তুমি মা*রো নি আমায়? ওই তো, ওখানে বসে আমি সব দেখেছি তুমিই মেরে*ছো!”
উষ্ণ ওদিক তাকাল। ঝোপের কাছে একটু আগে ইটের টুকরো ছুঁ*ড়ে মা*রার কথা মনে পড়ল। তাই চুপ করে গেল। অযথা কথা না বাড়িয়ে সামনে তাকাল। বাচ্চা বিড়াল এখনো ডাকাডাকি করছে। উষ্ণ সেটা দেখছে। হাতে এখনো ইটের টুকরো। সেটা ফের ছুঁ*ড়ে মা*রতে যাবে ওমনি মেয়েটা ঠাস করে তার মাথায় চা*টি মারল। উষ্ণ হকচকিয়ে উঠল। চোখ মুখ লাল করে বলল, “তুমি আবার আমায় মা*রলে?”
“তুমি বিড়ালকে কেন মার*ছো? বিড়াল মা*রা কি ভালো? এটা তো পঁচা কাজ। তোমার আম্মু তোমাকে বলেনি!”
উষ্ণের রাগ ক*মেনি। মায়ের কথা শোনায় রা*গ বেড়েছে। কিছু বলবে তার আগেই মেয়েটা তাকে টেনে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গেলো। মেয়েটা শক্ত করে তার হাত চেপে আছে। উষ্ণ কিছু বলতে যাবে ওমনি তার মুখ চেপে বলল,
“একদম কথা বলো না। চো*র এসেছে। আমাদের ধরে ফেললে চো”র বানিয়ে ফেলবে!”
উষ্ণ তার হাত সরিয়ে বলল, “আমি তোমাদের সাথে খেলছি না।”
মেয়েটা ফের তার মাথায় বাড়ি মে*রে বলল, “বললাম না আস্তে কথা বলতে। চো*র ধরে ফেললে না ১ থেকে ৫০ বার গুনতে হবে জানো।”
মেয়েটার বাড়াবাড়ি উষ্ণের কাছে অ*সহ্য লাগছে। কি আশ্চর্য! তবুও মেয়েটাকে কিছু বলছে না সে। মেয়েটা ভীত আঁখি জোড়া দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। চো*র কোথায় যাচ্ছে। উষ্ণ এবার তার সঙ্গ দিয়ে! দেখল চোর চলে গেছে। মেয়েটা বলে উঠলো,
“উহ বেঁচে গেছি। চো*র ধরলে আজ ১ থেকে ৫০ পর্যন্ত গুনতে হতো। তুমি পারো ১ থেকে ৫০?”
উষ্ণ মাথা নাড়ল। মেয়েটা একটু ভার গলায় বলল, “আমি পারি না। ১ থেকে ৩০ পর্যন্ত গুনতে পারি। কিন্তু জানো ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত লিখতে পারি!”
তার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে উষ্ণ চট করে হেসে ফেলল। অনেকদিন সে হাসে না! মা চলে যাওয়ার আজ ১৫ দিন হয়ে গেছে তার হাসি উধাও।
এমন সময় এক মহিলার কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল। তিনি চেঁচিয়ে ডাকছেন, “তনু! এই তনু!”
মেয়েটা সটাং করে দাঁড়িয়ে গেল। বলল, “এই রে মা ডাকছে। আমি যাই হ্যাঁ। ওদের বলো আর খেলব না মা ডাকছে!”
বলেই সে ছুটে চলে গেল। তার পিছন পিছন উষ্ণ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। দেখল একজন ভদ্রমহিলার হাত ধরে লাল ফ্রক পরা মেয়েটা হেঁটে চলে যাচ্ছে। সে মৃদু হেসে উঠল আবারো!
#চলমান
#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৫২
( পরবর্তী অংশের পরের ঘটনা! )
ছোট উষ্ণের মায়ের খবর পাওয়া যায়নি এখনো। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে সকলেই ভু*লে গেল। আগের মতো আর কেউই তার মা কে নিয়ে আলোচনা করে না। বাবাও বোধহয় মা কে ভুলে গেছেন। ভুলতে পারেনি কেবল উষ্ণ। তার মস্তিষ্কে সর্বক্ষণ মা বিরাজ করে। মাঝরাতে খুব বেশি মায়ের কথা মনে পড়লে ড্রয়ার থেকে মায়ের শাড়ি বের করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। শাড়িতে এখনো মায়ের গন্ধ লেগে আছে। খুব বেশি মা কে মনে পড়লে এই কাজটাই করে সে।
সেদিনের পর ওই মেয়েটাকে আর দেখল না সে। উষ্ণ এখন রোজই পার্কে যায়। কিন্তু সেই ছোট লালপরীর দেখা আর পায় না। লাল পরীর নামটা জানি কি ছিল? জিজ্ঞেস ই তো করা হয়নি।
সেদিন পার্কের আম গাছের নিচে বসে ছিল উষ্ণ। বাতাসের দমকা হাওয়ায় গাছের কয়েকটা উড়ে এসে মাটিতে পড়ে গেল। উষ্ণ সেদিকে দেখতে মগ্ন। বাতাসের তীব্রতা প্রখর হলো। উষ্ণের মাথার চুলগুলো উড়ছে। মুখটা ভার করে সামনে চেয়ে দেখল গাঢ় নীল রঙের ফ্রকে দৌড়ে আসছে তার লাল পরী। লাল পরী কে আজ নীল পরী লাগছে। সে এসেই উষ্ণ কে দেখে হাত নাড়ল। দেখাদেখি হাত নাড়ল উষ্ণ ও। মেয়েটা ছুটে এসে পিছন হয়ে দাঁড়াল। বলল,
“দেখো আমার নতুন স্কুল ব্যাগ! আমি এই ব্যাগটা নিয়ে কাল স্কুলে যাব!”
বলেই কোমর দুলিয়ে নাচল। উষ্ণ দেখল, গোলাপী রঙের ব্যাগে কতো গুলো পুতুল লাগানো হয়েছে। সামান্য ব্যাগটা দেখেই মেয়েটা কি খুশিতে নাচছে। উষ্ণ মাথা নিচু করে লুকিয়ে হাসল। যেন তার হাসি দেখাও অন্যায়। মেয়েটা বলল,
“তুমি স্কুলে যাও না?”
“যাই! তুমি কোন স্কুলে পড়?”
“সূর্যমুখী স্কুলে!”
“ওহ। কাল আসো নি কেন পার্কে?”
“আমি তো শুধু শুক্রবারেই পার্কে আসি। আম্মু নিয়ে আসে!”
বলেই খিলখিলিয়ে হাসল সে। ব্যাগ খুলে দেখাল তার নতুন খাতা পেন্সিল। সাথে কিছু চকলেট ও আছে। সে দুটো চকলেট উষ্ণ কে দিয়ে বলল, “নাও খাও। বাবা কিনে দিয়েছে আমায়!”
উষ্ণ চকলেট দুটো হাতে নিয়ে পকেটে পুড়ে ফেলল। মেয়েটা হঠাৎ পিছিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা ছোটাছুটি খেলি!”
“সেটা কিভাবে খেলে?”
“আমি ছুটব আর তুমি আমায় ধরবে। আচ্ছা আমি ছুটি!”
বলেই ছুটতে লাগল। উষ্ণ ছুটতে লাগল তার পিছন পিছন। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কিছুদূর ছোটার পরই সে হাঁপিয়ে গেল। উষ্ণ তবুও তাকে এসে ছুঁয়ে দেখল না। দূরে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা পিছন ফিরে উষ্ণ কে দেখতে পেয়ে আবারো ছুটতে লাগল। ছুটতে লাগল উষ্ণ ও!
উষ্ণের স্কুল বদলে গেল। ইংলিশ মিডিয়াম ছেড়ে বাবাকে বলে সে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি হলো। ঠিক সেখানে যেখানে ওই নীলপরী ও আছে। ক্লাসের প্রথম দিন সুন্দর পরিপাটি হয়ে নতুন ব্যাগ আর জুতা পরে ক্লাসে হাজির হলো সে। একটু দেরি করেই এসেছিলো। এরপর আবার হেড টিচারের সাথেও দেখা করতে হয়েছিল। তার সাথে বাবা ছিলো না, ছিল জেএস! বলা বাহুল্য, জেএসের বয়স তখন বেশ কমই ছিল। সুদর্শন যুবক তখন সে। বিয়ে শাদি তখনো করেনি। জাওয়াদ চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে বাকি সব কাজই তিনি করেন। উষ্ণের এতে অবশ্য মন খারাপ হয় না। বাবা আর তার সম্পর্ক কিছুটা গিভ অ্যান্ড টেকের মতো। কেবল দরকার পড়লেই বাবার সাথে কথা বলে সে।
ক্লাসে ম্যাম যখন তাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো তখন তার ছোট্ট আঁখি জোড়া কেবল খুঁজে যাচ্ছিল ওই নীল পরীকে। কোথায় তার পরী? এদিক ওদিক খুঁজে শেষমেষ তাকে পেলো পিছনের বেঞ্চে। সে খিলখিলিয়ে হাসছে! ক্লাসে ম্যাম যে কিছু বলছে সেসব কথা আদৌও শুনতেই পারেনি। সবার সামনে ম্যাম তার নাম বলেছিলো। পরী বোধহয় সেটাও শুনেনি। ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রী যেন সেই।
ম্যাম এবার ধ*মক দিয়ে বলে উঠলেন, “তনয়া!”
ছোট লাল পরী ভ*য়ে কেঁপে উঠলো। তার চোখে মুখে ভ*য় বিরাজমান। এদিক ফিরে তাকাল সে। ম্যাম বলে উঠলেন,
“সবসময় এতো কেন দুষ্টুমি করো তুমি? কথা বলছি তো আমি।”
“সরি ম্যাম!”
“দেখো, পরিচিত হও তোমাদের নতুন ক্লাস মেট। ওর নাম শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী!” নাম বলে ম্যাম বিভ্রান্ত হলেন। উষ্ণকে আস্তে করে বললেন,
“এতো বড় নাম? এছাড়া আর কোনো নাম নেই তোমার?”
উষ্ণ মাথা দুলিয়ে না করল। ম্যাম বলল, “আচ্ছা উষ্ণ কে বসতে দাও!”
তনয়ার নজর এতোক্ষণে পড়ল উষ্ণের উপর। তাকে চিনতে একটু কষ্টই হচ্ছিল যেন। আসলে ছেলেটার নাম সে জানত না। আজই জানল। দুজনের চোখাচোখি হতেই তনয়া হাত নাড়ল। উষ্ণ মৃদু হেসে উঠল। গিয়ে বসল তনয়ার বরাবর পাশের বেঞ্চিতে!
ম্যামের ক্লাস শেষ হবার পরই তনয়া গিয়ে ধরল তাকে। চুল টেনে বলল, “এই তুমি এখন আমাদের সাথে পড়বে!”
উষ্ণ মাথা নাড়ল। তনয়া খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল। বলল, “তোমার নাম জানো কি?”
“উষ্ণ!”
“উষ্ম, উষ্, উম উফ! এতো কঠিন নাম কেন রেখেছো তুমি? সহজ নাম বলো!”
“আর নাম নেই তো।”
“আর নাম নেই? তাহলে তোমার নতুন নাম দেই। হ্যাঁ, বুটকু! তোমার নাম আজ থেকে বুটকু!”
“বুটকু মানে?”
তনয়া তার গাল টেনে বলল, “যারা মটু তাদের আমরা বুটকু বলি। হি হি হি বুটকু!”
তনয়ার আশেপাশে সকলে হেসে উঠল। কিন্তু উষ্ণ লজ্জা পেয়ে গেল। সে আসলেই তখন একটু মটুসটু ছিল। একটু বেশিই গলুমলু! দুটো তনয়া মিলে সে হবে এমন সাইজের।
“তনু, এই তনু!”
চিকন চাকন একটা ছেলে তনয়া কে ডেকে এদিকে এলো। তনয়া তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “দেখো ও আমার আরেকটা বন্ধু। ওর নাম তময়!”
তন্ময় তার হাত ছাড়িয়ে বলল, “তময় না তনু, তন্ময়!”
“ওই হলো। তোমরা এতো কঠিন কঠিন নাম কেন রাখো? যে নাম আমি বলতেই পারি না। উফ!” বিরক্ত তার নীল পরী। কি ভীষণ বিপ*দে পড়ল সে। বন্ধুদের নামটাই মনে রাখতে পারে না। পারবে কি করে? ওতো শক্ত নাম মুখে বলা যায় নাকি। তন্ময় তার হাতটা ধরে বলল, “আয় ছোটাছুটি খেলি!”
তনয়া মাথা নেড়ে উষ্ণের হাত ধরে বলল, “বুটকু আসো আমরা খেলতে যাই। তোমায় বুটকু বলি বলে তুমি আবার রা*গ করছো না তো? তুমি আজই বাসায় গিয়ে একটা সহজ নাম ভেবে আসবে। আমি তোমাকে সেই নামেই ডাকব ঠিক আছে!”
উষ্ণ মাথা নাড়ল। তারা তিনজন ছুটে বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। বিরাট মাঠে গিয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল একসঙ্গে। কিন্তু উষ্ণ আর নাম বদলায়নি। তনয়ার দেওয়া নামটা তার ভালো লেগেছে। সাথে তনয়াকেও। নীলপরীকে খুব মনে ধরেছে যেন!
তনয়া ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ছাত্রী ছিল। পড়াশোনার ধারে কাছেও থাকত না। অন্য দিকে তন্ময় সবচেয়ে ভালো ছাত্র। তার রোল সবসময় ১ থাকত। এর মাঝামাঝি উষ্ণ। তার ইচ্ছে হলে সে পড়াশোনা করত আবার নাম্বার ও ভালো পেত। অন্যদিকে তনয়ার মনোযোগ নেই কিছুতে। সারাদিন খেলতে পারলেই সে খুশি। একদিনও বাড়ির কাজ করে আনে না। মাঝে মাঝে লুকিয়ে তার খাতায় লিখে দেয় উষ্ণ। একবার ধরাও পড়ে গেল। ম্যাম সেবার খুব বক**লো। কিন্তু তাকে না, তনয়াকে! উষ্ণের কি ভীষণ খা*রাপ লাগল। তাদের ম্যাম খুব বা*জে! তাকে আর ভালো লাগে না উষ্ণর!
কিন্তু উষ্ণের দিন ভালো কাটছিলো। একমাত্র বন্ধু বলতে কেবল তনয়াই ছিলো। কিংবা তার জীবনে কেউ থাকলে সে তনয়াই ছিল। তন্ময়ের সাথে তার সখ্য ছিলো না ওতো আবার ছেলেটাকে খারাপ লাগত না। মাঝামাঝি! উষ্ণ সুখে ছিল, আনন্দে ছিল! কিন্তু এই আনন্দ বেশিদিন কাটলো না। যখন তার নতুন মা চৌধুরী বাড়িতে পা রাখল তখনি সবকিছু উলোট পালোট হয়ে গেল। বদলে গেলো তার জীবনও!
অসুস্থ মায়ের কথা ভেবেই জাওয়াদ চৌধুরী আবার বিয়ে করেন। নাহলে তার বিয়ের করার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না। এ জীবনে ইধিতা বেগমকে ছাড়া আর কাউকে ভালো বাসতে পারেনি সে। তবে অসুস্থ মা কেও একা ছাড়া যায় না। পরপর এই নিয়ে অনেকবার কতো গুলো নার্স বদলে রাখা হলো। কিন্তু দাদির একটাই দাবি, ছেলেকে তিনি বিয়ে দিবেন। ছেলের বউয়ের হাতে সেবাযত্নে মর*বেন। অন্য কারোর হাতে ওষুধ খাবেন না। মায়ের জেদের কাছে হারতে হলো তাকে। তিনি বিয়ে করে আনলেন বিবাহিতা তিলোত্তমা বেগমকে। হ্যাঁ, তিলোত্তমা বেগম ও বিবাহিতা ছিলেন কিন্তু তার বিয়ে টিকেনি। সেই কারণ বলব ক্ষণে। আজ ওদিকে না যাই। ছেলের জীবনে নতুন মা এলে ছেলেটাও শুধরে যাবে, মানুষ হবে এসব চিন্তা ও ছিলো। কিন্তু উষ্ণ মানতে না*রাজ। তার মায়ের জায়গা অন্য কেউ নিয়ে নিবে এসব সে ভাবতেই পারেনা। তবুও চাইছিলো নতুন মায়ের সঙ্গে সঙ্গ করতে। নতুন নতুন তিনিও খুব আদর করতেন উষ্ণ কে। উষ্ণের ও নতুন মা কে ভালো লাগতে শুরু হলো।
কিন্তু এই ভালো লাগা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যখন তিলোত্তমা তার স্কুল বদলে তাকে আবারো ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে দিল তখন থেকেই নতুন মা তার চোখের বি*ষ হয়ে গেল। সে তখন আর নতুন মা ছিলো না। সৎ মা হয়ে গেল। নীলপরী থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিল। এমনকি উষ্ণ খেয়াল ও করল, বাবা এখন আর তার কথা শুনতে চায় না। সৎ মা যা বলে তাই হয়। এসব উষ্ণের ভালো লাগছিলো না। অতঃপর সে হয়ে উঠল এক*রোখা, রা*গী আর অভদ্র একটি ছেলে। যে কারোর কথাই শুনতে চায় না!
স্কুল বদলে যাওয়ায় আর নীলপরীর সাথে দেখা হচ্ছিল না। সৎ মায়ের কারণে এখন বিকেল বেলাও তার পার্কে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আগে রোজ শুক্রবার সে পার্কে গিয়ে তনয়ার সাথে খেলত। কিন্তু এখন আর যেতে পারেনা। তাকে যেতে দেওয়া হয় না। নিত্যনতুন তাকে চাপে রাখা হয়। বেশ কয়েকজন টিচার পড়াতে আসে। নাহয় সৎ মায়ের সাথে তার বাপের বাড়ি যায় সে। তার নতুন নানা বাড়ী। এর আগে কখনো মায়ের সাথে নানাবাড়ি যায়নি সে। আসলে মায়ের ঘর থেকে বের হওয়াই বারণ ছিল। তাই কোথাও যেতো না তারা। কিন্তু প্রায়ই তিলোত্তমা বেগমের সাথে তার বাবা আর ভাইয়ের বাড়ী যাওয়া হতো উষ্ণের। তাকে যেতেই হতো!
একমাত্র যে আপন ছিল, সেই দাদীও তাকে ফেলে চলে গেল। অতঃপর উষ্ণ পুরোপুরি একা। দিনকে দিন তার অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। না কথা শোনা, রা*গ দেখানো এক কথায় অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিল সে। তিলোত্তমা বেগমও দেরি না করে হাত তো*লা শুরু করেন তার উপর। এরপর হিতে বিপরীত হয়ে যায়। বেশিদিন না যেতেই উষাণ চৌধুরীর আগমন ঘটে সেই বাড়িতে। এরপর তো উষ্ণ চৌধুরী পুরোপুরি ফেলনা হয়ে যায় চৌধুরী বাড়িতে!
উষ্ণের পড়াশোনা জলে যাচ্ছে, কোনো কিছুতে মনোযোগ নেই তার। ছোট বাচ্চা সামলে উষ্ণ কে দেখতেও পারেনা তিলোত্তমা বেগম। তার উপর উষ্ণের একরোগা জেদি ভাব, অবাধ্যতা বাধ্য করল জাওয়াদ চৌধুরী কে তাকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে। উষ্ণর তখন ভালোই লাগল। সেও আর চায় না এখানে থাকতে। অ*বহেলা, অ*বজ্ঞা কিছুই আর সইতে পারছিলো না সে। অবশেষে সেও যেতে রাজি হলো। কিন্তু যাবার আগে একবার নীলপরীকে দেখবে না। তা কি হয়?
তখন নীলপরী হয়ে গেছে নিঃস্ব। মা বাবা হা*রা এতিম মেয়ে। বহু মাস বাদে নীলপরীর দেখা পেয়েছিলো সে। কিন্তু নীলপরী আর আগের মতো নেই। তার সেই চাঞ্চল্যতা, অস্থিরতা, ছটফটে ভাব আর নেই। কারো সাথে কথাও বলে না। কেমন গুম*রে থাকে সর্বক্ষণ। মুখে লেপ্টে থাকে বিষণ্ণতার ছায়া। এই নীলপরীকে সে চিনে না। নীলপরীর এমন অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
স্কুল শেষে এখন একাই যায় সে। আজও যাচ্ছিল। আগের মতো এখন আর মায়ের হাত ধরে যাওয়া হয় না। মন খারাপ হয়, কষ্ট লাগে! তবু গুটি গুটি পায়ে একাই হাঁটছিল সে। সেদিন তার পিছু নিল উষ্ণ ও। আজ রাতেই তার ফ্লাইট। চলে যেতে হবে তাকে। শেষবারের মতো দেখতে এসেছিলো নীলপরীকে। ভেবেছিলো একফালি হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখবে। সেখানে তিমিরে ঢাকা মৃত*প্রায় মুখটা দেখে তার বুক কেঁপে উঠল।
রাস্তার উপর বেশ দূরত্ব রেখে হাঁটছে দুজন। হঠাৎ আকাশ দানবের মতো কালো হয়ে উঠল। মেঘ গর্জে উঠে বর্ষণ শুরু হলো তীব্র। তনয়া বৃষ্টি দেখে ছুটে যাচ্ছে না। বরং দু হাতে ব্যাগটা চেপে ধরে হাঁটছে। তার পিছন পিছন যাচ্ছে উষ্ণ ও। দেখতে দেখতে বৃষ্টির তোপে রাস্তা ঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। কাঁদায় মাখামাখি সবকিছু। তনয়া এবার ছুটছে। তার পিছন পিছন ছুটছে উষ্ণ ও। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। উষ্ণ আজ তাকে ধরতে পারল না। ভা*ঙা রাস্তায় পড়ে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে কাঁদতে লাগল সে। ব্য*থা পেয়েছে ভীষণ! সর্বক্ষণ হাসি লেপ্টে থাকা মুখে এই কান্না দেখে ক্ষত*বিক্ষত হতে থাকল ক্ষুদ্র হৃদয় খান। নীল পরীর এই ছিন্ন*ভিন্ন অবস্থা তার মনকে ছিন্ন*বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। কেন তার প্রিয় মানুষগুলো সবসময় এতো কষ্ট পায়। কেন?
উষ্ণ পা বাড়াল তার দিকে। কিন্তু যেতে পারল না। মূহুর্তেই এক গাড়ি এসে তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। উষ্ণ কতো ছটফট করল, কতো ঝাপটাঝাপটি করল কোনো লাভ না। জেএস শক্ত হাতে তাকে চেপে ধরে বলল, “আমাদের যেতে হবে উষ্ণ, স্যার যেতে বলেছেন!”
উষ্ণ ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নীল পরী ওখানে একা বসে কাঁদছে। সে কেন যেতে পারবে না? কেন থাকতে পারবে না তার পাশে? শূন্যস্থান কি খালি রয় কখনো? সেটা তো পূরণ হয়েই যায়। তেমনি উষ্ণের জায়গাটা নিয়ে নিল আরেকজন। তন্ময় ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। বলল, “তনু, আয়। আর কাঁদিস না। আয় তনু!”
এসব হচ্ছে বহু বছর আগের কথা। ওতো পুরনো ঘটনা সবার মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু কিছু স্মৃতি মনে দাগ কেটে রয়ে গেলে থেকেই যায়।
এই যে এখন, চৌধুরী ভবনের সবচেয়ে সুন্দর কামরায় বসে তনয়া। এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখছে সে। এই কক্ষে এর আগে একবারই আসা হয়েছিল তার। তখন এতো ঘোরাঘুরি করে দেখেনি। আজ দেখছি। বিছানার পাশেই টি টেবিলের উপর উষ্ণের কয়েক দফা ছবি। সবগুলোই বিদেশের। গোটা একটু যুগ যেন বিদেশেই কেটেছে তার।
উষ্ণ আজ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এখানে আসার পর থেকে সকলের মুখে তালা লেগে গেছে। জাওয়াদ স্যারের সাথে এখনো দেখা হয়নি। তাদের বিয়ের কথা নাকি সকলেই জেনে গেছে। এজন্য এখানে নিয়ে আসা। উষ্ণ অফিস থেকেই এখানে ফিরেছে। তাই এসেই সোজা গেছে শাওয়ার নিতে। তনয়া এই সুযোগে ঘর ঘুরে দেখছিলো। তার শাশুড়ি আর দেবর বাড়িতেই আছে কিন্তু উষ্ণ স্পষ্ট স্বরে বলে গেছে, আমি না থাকলে বাড়ির কারোর সাথে কথা বলবে না। কারোর সাথে না!
ব্যস তনয়াও তাই লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘরেই বসে আছে। পুরো ঘর ঘুরা শেষ দেখে বিছানায় বসে পা দুলছিল সে। তৎক্ষণাৎ বাথরুমের দরজা ভেদ করে উষ্ণ এসে দাঁড়াল। কোমরে তোয়ালে বেঁধে উন্মুক্ত শরীরে। মেদহীন, বলিষ্ঠ দেহে পানি ঝরছে মুক্তোর মতো। তাকে এক ঝলক দেখেই চট করে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল তনয়া। চোখ বন্ধ করে নিল সাথে সাথে!
উষ্ণ হাসল। তার হাসির শব্দ কানে যেতেই তনয়া চোখ মেলে তাকাল। উষ্ণ বলল,
“এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আমরা তো স্বামী স্ত্রী!”
তনয়া নিরুত্তর! কি বলবে সেটাই জানে না। উপায়ান্তর না পেয়ে মাথা তুলল। তার সামনের বিপরীত আয়নাতে উষ্ণের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে। দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো ঝারছে সে। তনয়া স্তব্ধ! দু সেকেন্ডের জন্য কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে? তার শরীর, মন সবকিছুতে ঘোর তন্দ্রা লেগে গেলো। উষ্ণ ওদিক না ফিরেই বলল,
“আয়নাতে লুকিয়ে না দেখে সোজাসুজি দেখতে পারো আমায়। পারলে কাছে এসে ছুঁয়েও দেখো। আমি না করব না!”
লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল সাথে সাথে। ইশ! কি লজ্জা! এভাবে কেউ বলে। সে না হয় একটু দেখছিলো। তাতে কি কমে যেত! উষ্ণের মুগ্ধতা এসে ভর করছে তাকে। রুমে এসি থাকা সত্ত্বেও ঘামছে সে। উষ্ণ তার দিকে পা বাড়ানোর আগেই সেখান থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু লাগবে?”
“হ্যাঁ, ড্রয়ার থেকে আমার জামাকাপড় গুলো দাও।”
তনয়া মাথা নাড়ল। ড্রয়ার থেকে একে একে তার জন্য একটা পেস্ট রঙের শার্ট আর ফরমাল প্যান্ট বের করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। তাকালো না অবধি এখানে। উষ্ণ আড়চোখে তাকে দেখছে। ড্রয়ার বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল তনয়া। সেখানেও একটা ফটো ফ্রেম আছে। উল্টে রাখা হয়েছে। কৌতূহলবশত তনয়া সেটা উল্টে দেখল।
দুটো বাচ্চার ছবি। তনয়া বুঝতে পারছে না এরা কারা। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিছুক্ষণ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে উপলব্ধি করল, আরে এটা তো আমি! হ্যাঁ এটা আমারই বাচ্চা কালের ছবি। কিন্তু পাশের এটা কে? আমি কবে তার সাথে ছবি তুললাম?
ছবিটা ছিল তখনকার যখন তারা একই স্কুলে পড়ত। এবার স্কুল থেকে যখন ট্যুরে নেওয়া হলো তখন সবাইকে একসাথে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হলো। তন্ময়, তনয়া আর উষ্ণ সিরিয়াল বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে সবার ছবি কেটে উষ্ণ তাকে আর তনয়ার ছবি একসাথে ফ্রেম বানিয়ে রেখে দিল। তনয়া এবার ভীষণ আশ্চর্যান্বিত হলো। উষ্ণ স্যার কি তাহলে তার সাথেই কিন্ডারগার্টেনে পড়ত। কই? তার তো মনেই পড়ছে না। এইজন্যই কি তন্ময় বলত, উষ্ণ স্যার কে তার চেনা চেনা লাগছে! তারা ক্লাসমেট ছিল?
সরু কোমরে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেয়েই তনয়া কেঁপে উঠলো। তার মাতাল করা সুবাস কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারছে না সে। উষ্ণ তার হাতের ছবিটা দেখে মৃদু হেসে বলল,
“আমায় মনে করতে পারছো নীলাম্বরী? আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল সেই নন্দন পার্কে? মনে পড়ে তোমার?”
না! তার কিছুই মনে পড়ে না। মাথা নুইয়ে মাথা নাড়ল সে। উষ্ণ ছবিটা হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে। অস্বাভাবিক কিছু না। মনে নাই পড়তে পারে। ভীষণ পুরনো সম্পর্ক আমাদের। বেশ কয়েকবার তুমি জোর করে আমার সাথে পুতুল নিয়ে খেলতে। আমি তো খেলতেই চাইতাম না। তন্ময় আর আমাকে জোর করে বসিয়ে রাখতে!”
কথাবার্তা শুনে তনয়া স্তব্ধ! লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। উষ্ণ হেসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার পুরো জীবনের অতি ক্ষুদ্র অংশ ছিলাম আমি, তাই তোমার কিছু মনে নেই, মনে নেই আমাদের বন্ধুত্ব! আমাকেও ভুলে গেছো। কিন্তু আমার পুরো জীবনটাই যে তুমি নীলাম্বরী, ভুলি যাই কি করে বলো!”
তনয়া মুখ তুলে তার পানে চাইল। উষ্ণ তার চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বলল, “মা যখন চলে গেল, বাবাও কথা বলে না তখন প্রায় অতল তিমিরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম, সেখান থেকে আমায় টেনে বের করেছিলে তুমি। অজান্তেই জড়িয়ে গেলে আমার সাথে। অথচ তোমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ে আমি থাকতে পারিনি। জানো শত চেষ্টা করেও আমি থাকতে পারিনি। সেই আফসোস আমার আজীবন থাকবে!”
তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়? সেটা তো সেই মা বাবাকে হারানোর পর। সেই খবরও তাহলে তিনি জানতেন। তিনি কি সবই জানতেন! সপ্তম আকাশের চূড়ার সমান অবাক হলো তনয়া। এরই মধ্যে তাড়াহুড়ো করে ঘরে প্রবেশ করল একজন। দুজনেই ফিরে তাকাল। ইরিশা জামান দাঁড়িয়ে। রা*গে টুইটুম্বর একদম।
উষ্ণ তনয়ার বাঁকানো কোমর আরেকটু চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে অন্য হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ড্রয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বলল,
“নিউ ম্যারেড কাপলের ঘরে অনুমতি না নিয়ে ঢুকতে হয় না। এতো টুকু ভদ্রতা জানো না ইরিশা!”
তনয়া অস্বস্তি বোধ করছে। ইরিশার নজর তার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে হাতে পেলেই চি*বিয়ে খাবে। একটু নড়চড় করতেই উষ্ণ বলে,
“বেবী এমন কেন করছো? যাস্ট অ্যা মিনিট। আর ইরিশা তুমি..
ততোক্ষণে ইরিশা বেড়িয়ে চলে গেছে। উষ্ণ হেসে উঠল। এক সার্ভেন্ট এসে জানাল, “স্যার আপনাকে যেতে বলেছে!”
উষ্ণ তনয়ার হাত চেপে ধরতেই সে আবারো বলল, “স্যার শুধু আপনাকেই যেতে বলেছে!”
উষ্ণ তনয়ার হাত তখনো ছাড়েনি। আবার একটু ভেবে ছেড়ে দিল। সেখানে তো সবাই থাকবে। তার সৎ মা, ভাই, ইরিশা। সবার সামনে তার বউকে কেউ কটু* কথা বলুক সেটা উষ্ণ চায় না। তার *ভয় হয়। নিজের পরিবার কে বিশ্বাস হয় না তার। এইজন্যই সর্বক্ষণ চেষ্টা করে এদের থেকে তনয়াকে আড়াল করে রাখতে। তাই হাত ছেড়ে মাথায় হাতটা রেখে বলল, “শোনো, তুমি এখানেই থাকো। আমি কথা বলে আসছি।”
“আমরা কি এখন থেকে এখানেই থাকব?”
উষ্ণ কিঞ্চিত হেসে বলে,
“না, তুমি আমার সাথে থাকবে!”
——–
উষ্ণ ঘরে ঢুকেই সোফার উপর পায়ে পা তুলে বসল। তার সামনের চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছে জাওয়াদ চৌধুরী। তার বিপরীত সোফায় বসা তিলোত্তমা বেগম। উষ্ণ আর সে মুখোমুখি! এই ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ঊষাণ চৌধুরী আর ইরিশা। ইরিশা দু হাতে তার ব্যাগ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের রাগ*কে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তনয়া! ওই তুচ্ছ মেয়েটার কাছে কিভাবে হেরে গেল সে। ঊষাণ মিটিমিটি হেসে তার রাগে*র মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দেখলে বলেছিলাম না, তনয়াই আছে এর মাঝে। দেখলে তো? মিলল আমার কথা। তনয়া নিশ্চিত অসাধারণ কেউ!”
বলেই ফিরে তাকাল। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল। ইরিশা জামানের দৃষ্টি ঝ*রে যেন আ*গুন পড়ছে।
জাওয়াদ চৌধুরী গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“শেহনেওয়াজ পরিবারের মানসম্মান নিয়ে এভাবে খেলার কি মানে উষ্ণ?”
“আমি কি করলাম?”
“কি করেছো বুঝতে পারছো না? এভাবে লুকিয়ে বিয়ে করার মানে কি? মানুষজন এখন জানতে পেরে তোমার নামে কি রটাচ্ছে জানো?”
তিলোত্তমা ফোড়ন কেটে বললেন, “তাও সাধারণ একটা মেয়ে যে কি না তোমার অফিসেই চাকরি করে। অফিসে কাজ করতে যাও নাকি রঙ্গলীলা! আর মেয়েটাই বা কেমন? বড়লোক স্যার দেখে গলায় ঝুলে পড়ল।”
উষ্ণ চোয়াল শক্ত করে নিল। কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিল, “আমার স্ত্রীর ব্যাপারে কথা বলার আগে দু বার ভেবে নিন। তার ব্যাপারে আর একটা বাজে কথা আমি বরখাস্ত করব না।”
তিলোত্তমা বেগম চোখ মুখ শক্ত করে জাওয়াদ চৌধুরী দিকে ফিরলেন। জাওয়াদ চৌধুরী বলে উঠলেন, “তুমিও আমার স্ত্রীর সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না উষ্ণ!”
উষ্ণ উঠে দাঁড়াল। বলে উঠলো, “আমি যাচ্ছি।”
“কোথায়?”
“আমার ফ্ল্যাটে। সেখানেই থাকব।”
“না, তুমি এখানেই থাকবে। চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে বউ নিয়ে আলাদা থাকবে সেটা কখনোই ভালো দেখায় না।”
“মিস্টার জাওয়াদ চৌধুরী, আপনি কতোটা কনজারভেটিভ আমি জানি না। কিন্তু আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমি খুব কনজারভেটিভ। তার অসুবিধে হবে এমন জায়গায় আমি থাকব না।”
তিলোত্তমা বেগম চোখ মুখ গ*রম করে বললেন, “বিয়ে কি তুমি একাই করেছো উষ্ণ?”
“না আপনিও তো করেছেন। আর তার অবস্থাও এখন দেখতে পারছি। খুবই শোচনীয়!”
“উষ্ণ!”
চেঁচিয়ে উঠলেন জাওয়াদ চৌধুরী। সবাই চুপসে গেল। থমথমে ঘরের মধ্যে হঠাৎ কিসের শব্দ। উষ্ণ টনক নড়ল। সে এক মূহুর্ত নষ্ট না করে ছুটে বেরিয়ে গেল। তার পিছন পিছন ছুটল বাকি সবাই। চৌধুরী ভিলার উপর থেকে নিচ অবধি যেই লম্বা সিঁড়ি উঠে গেছে, সেখানেই মেঝেতে লুটি*য়ে আছে তনয়া। “তনয়া!” বলে চেঁচিয়ে উঠলো সে। ছুটে গেল তার নিকট। তনয়ার জ্ঞান নেই। কপাল কে*টে র*ক্ত ঝরছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে একদম। উষ্ণ উন্মাদের মতো আচরণ করছে। তার দেহটা বুকে জরিয়ে ধরে করুণ স্বরে ডাকছে, “নীলাম্বরী! এই নীলাম্বরী! চোখ খুলো। কি হয়েছে তোমার? তুমি এখানে এলে কি করে? নীলাম্বরী!”
তনয়া জবাব দিচ্ছে না। উষ্ণ চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাওয়াদ চৌধুরীর পানে চেয়ে বলল, “বাবা!”
জাওয়াদ চৌধুরী ছেলেকে দেখে থমকে গেলেন। সামলে নিয়ে বললেন, “ঊষাণ জলদি গাড়ি বের করো!”
ঊষাণ বাইরে ছুটে গেল। উষ্ণ তার দেহটা কোলে তুলে নিল। জাওয়াদ চৌধুরী বেরিয়ে গেলেন পিছু পিছু। তিলোত্তমা বেগম চো*রের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। খুঁজছেন বোধহয় কাউকে!
#চলমান