তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-৫৩+৫৪

0
44

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৫৩

সন্ধ্যার আলো তখন জানালার কাঁচে লেপ্টে আছে। সাদা বেডে উপরে শুয়ে আছে মেয়েটি। সুশ্রী মুখে ফ্যাকাশে ক্লান্তির ছাপ। ডান হাতে প্লাস্টার করা। কপালেও সাদা ব্যান্ডেজ করা। টান টান চিনচিনে ব্যাথা করছে। বুকটা ধড়ফড় করছে এখনো। সিঁড়ি বেয়ে প”ড়ার ঘটনা মনে করলে এখনো গা শিউরে উঠে। মানুষ এতোটাও হিং*স্র হয়ে উঠতে পারে? ইরিশা জামানকে তখন মানুষ মনে হয়নি। তার চোখজোড়া প্রমাণ দিচ্ছিলো তার হিংস্র*তার। উত্তেজিত হয়ে উঠল তার মনটা। ছটফট করছিলো। বা হাতে বুকটা চেপে ধরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল দ্রুত। চোখ বন্ধ করে নিল। দরজা খোলার শব্দে ওদিক ফিলল।

সামনের মানুষি যেন চার চেয়েও বেশি অসুস্থ। মুখটার কি হাল হয়েছে। নির্ঘাত তার চিন্তায় এই অবস্থা। হাসপাতালের কেবিনে এই এসি রুমেও তার পরনের শার্ট ভিজে একাকার। এতো ছোটাছুটি কেন করছে? ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে,‌ হাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে। ভয়ের কারণ নেই। মাসখানেক প্লাস্টার করা থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। কপালের ক্ষ”ত টাও সেরে যাবে দ্রুত। ঔষধ মলম সব দিয়েছে। এরপরেও কোন কারণে তারা হাসপাতালে পড়ে আছে? তনয়ার হাসপাতালে ফোবিয়া আছে। থাকতে একদম ইচ্ছে করে না। কোনমতে খালি করিডোরে টিকে থাকে। সেখানে হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে থেকে নিজেকে মানুষ কম ডে”ড বডি বেশি মনে হচ্ছে। ছোট থেকেই তার ধারণা, হাসপাতালের কেবিনে কেবল লা*শেরা শুয়ে থাকে যেভাবে তার মা আর বাবাও শুয়ে ছিল!

উষ্ণ নিজেকে শান্ত করে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বেডের পাশে এসে বসে। তনয়ার বা হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে অন্য হাতে তার কপালে হাত রাখে। গলায় হাত রেখে পরিক্ষা করে। শরীরটা গরম গরম লাগছে। জ্বর এলো নাকি? উষ্ণ স্যারের এতো ছটফটানি দেখে তনয়া হাসার চেষ্টা করল। ফ্যাকাশে মুখে হাসিটাও বেমানান লাগছে। ছোট করে বলল,

“আমি ঠিক আছি।”

“না, তুমি ঠিক নেই, সব দোষ আমার। আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে দেখে রাখব। ওখানে তোমাকে একা ফেলে রাখা আমার উচিত হয়নি তনয়া। আমায় ক্ষমা করে দাও।”
উষ্ণর করুণ স্বরে তনয়া আঁতকে উঠে। নড়চড় করে বলে উঠলো,

“কি বলছেন এসব? আপনার দোষ কোথায়?”

উষ্ণর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে। গলার স্বর ও কাঁপছে। সে বলে,

“তুমি বুঝবে না তনয়া, তুমি বুঝবে না। তোমায় ওই অবস্থায় দেখে আমার হৃদয়ের যে কি হাল হয়েছিল আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছিল আমার চারপাশ অন্ধ”কার হয়ে যাচ্ছে, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। অক্সিজেনের কমতি ছিলো না, কিন্তু আমার দেহ অক্সিজেন নিতে অস্বী”কার করছিলো। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ যেন বিদ্রুপ শুরু করে দিল। এই শরীর আর তারা চায় না। কি অ”সহ্য যন্ত্র”ণা। কখনো শুনেছো শরীর আ”ত্মাকে অস্বীকার করে? আমার শরীর অস্বীকার আমাকে করছিলো।”

কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলো উষ্ণ। কি ভয়ং কর কথা! এমনকি শরীরে কাঁ”টা দিয়ে উঠলো তনয়ার। উষ্ণের এমন বিচলিত, ব্যতিব্যস্ত, ছটফট মনোভাব দেখে সে বিস্মিত। তাকে নিয়ে এতোটা ছটফট করতে মা বাবা ছাড়া আর কাউকে দেখেনি সে। তাই অবাক লাগছে। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও মানুষ এতোটা ভালোবাসতে পারে! উষ্ণের প্রতিটা কথায় তার হৃৎপিণ্ড ধরাম ধরাম করে বেজে উঠলো।চোখে অশ্রু জমে গেল।

উষ্ণ আবারো অস্থির হয়ে উঠল,

”কাঁদছো কেন? ব্যাথা করছে? কোথায় করছে আমায় বলো? কাঁদছ কেন নীলাম্বরী! আমায় বলো কোথায় কষ্ট হচ্ছে!”

তনয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল। সে কিভাবে বুঝাবে তার কোথায় কষ্ট হচ্ছে। সে নিজেও তো জানে না!
উষ্ণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না । কেউ নেই। বুঝেছি, তুমি ভ*য় পেয়েছো। ভ*য় পেয়ো না নীলাম্বরী। আমি আছি তোমার পাশে, এই তো এখানেই আছি!”

তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল তনয়াকে। তনয়া চোখ বন্ধ স্বস্তির শ্বাস নিতে লাগল। হঠাৎ করে লোকটার বুকের মধ্যে শান্তি অনুভব করছে সে।

দরজায় আবারো করাঘাত। তনয়া সুন্দর হয়ে বসল। জেএস এসেছে খাবার নিয়ে। তার পিছন পিছন জাওয়াদ চৌধুরী আর ঊষাণ চৌধুরী। এনাদের সাথে এর আগেও দেখা হয়েছে। জাওয়াদ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,

“এখন কেমন আছো?”

প্রশ্নটা তনয়াকেই করল। সে একটু হকচকিয়ে উঠল। তার আগেই উষ্ণ জবাব দিল, “ঠিক আছে। ডাক্তার বলেছে আজকের রাতটা এখানে থেকে বিশ্রাম নিতে। কাল সকালেই বাসায় নিয়ে যেতে পারব।”

“আমি তাহলে সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দিব।”

তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। উষ্ণ বলে উঠল, “ও আমার সাথে আমার বাসায় যাবে।”

জাওয়াদ চৌধুরী থেমে গেল। উষাণ আগ্রহ নিয়ে তাদের দুজনকে দেখছে। চোখ চোখে কথা বলছে বাপ ব্যাটা। জাওয়াদ চৌধুরী শুধালেন,

“চৌধুরী ভিলা কি তোমার বাড়ি নয় উষ্ণ?”

“না। আমি সেখানে আমার বউকে নিয়ে থাকতে পারব না। তার সেফটি আমার কাছে আগে।”

জাওয়াদ চৌধুরী রে”গে চোয়াল শক্ত করে নিল। তার ছেলে কিভাবে ভাবতে পারল, তারা সবাই তনয়ার ক্ষ*তি করবে। ইরিশা তো পরের মেয়ে কিন্তু তারা তো ফ্যামিলি! পরিবার! পরিবারের প্রতি এতোটুকু আস্থা নেই উষ্ণর! হাসপাতাল বাকবিতন্ডা না করে তিনি বেরিয়ে গেলেন। উষাণ যাবার আগে তনয়ার দিকে ফিরে হেসে বলে উঠল,

“আসছি ভাবী! আবার দেখা হবে আমাদের!”

তার ভাবী ডাকটার মধ্যে ও যেন একটা কটুক্তির প্রভাব পেলো তনয়া। এই ছেলেটাকে সে চিনে। সম্পর্কে তার দেবর! রেস্টুরেন্টের কথা আজও ভুলতে পারেনি। ভালোই হয়েছে উষ্ণ স্যার তাকে ও বাড়িতে নিয়ে যাবে না বলে দিয়েছে। নাহলে এই ছেলেটার সাথে এক বাড়িতে থাকাও তার জন্য অসম্ভব! তার উপর আবার তিলোত্তমা বেগম। জাওয়াদ স্যারের চোখ রা*ঙানি। না! আর ভাবতে পারছে না। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই উষ্ণ বলে উঠলো,

“ঘুমিয়ো না। খেতে হবে!”

“আমি কিছু খাবো না এখন।”

জেএস বলে উঠলো,
“ম্যাডাম খেয়ে নিন। এরপর ঔষধ ও খেতে হবে!”

“হ্যাঁ, ওষুধ তো আছে। একটু খাও। কিছু না, ফল কেটে দিই ওগুলোই খাও।”

উষ্ণ বেডের পাশের চেয়ারে বসল। তনয়া না খাওয়ার শত বাহানা করছে। তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। পেট গুলিয়ে আসছে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। কিন্তু উষ্ণ ও নাছোড়বান্দা। একটা আপেল, কমলা খাইয়ে ছাড়ল। গরম স্যুপ ও এনেছিলো। সেটাও খানিকটা খাওয়ালো। এরপর আবার ডাবের পানি। তনয়ার এবার সত্যি সত্যি মাথা ঘুরাচ্ছে। উষ্ণ বলল,

“খাচ্ছো না বলেই মাথা ঘুরাচ্ছে। একটু খাও!”

তনয়া রক্ষে পেলো না উষ্ণের থেকে। অল্প একটু
হলেও তার ডাবের পানি খেতে হলো। খাওয়ার পরই এখন মাথা চক্কর দিচ্ছে। অস্বস্তি লাগছে। উষ্ণ তাকে শুইয়ে দেবার জন্য উঠে দাড়াতেই তনয়া বমি করে ফেলল। বমি করে পুরো গা ভাসিয়ে দিল উষ্ণের। উষ্ণ একফোঁটা বিরক্ত হলো না। বরঞ্চ তার চুলো গুলো সব পিছনে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলছে, আস্তে আস্তে। হ্যাঁ বমি করলে ভালো লাগবে। দেখি পানি খাও।”

সত্যি সত্যি এখন একটু ভালো লাগছে তার। তনয়া পানি খেলো। উষ্ণ তার চোখ মুখ পানি দিয়ে মুছে দিল। বলল, “তুমি শুয়ে পড়। আমি এগুলো পরিষ্কার করাচ্ছি!”

তনয়া দেখল লোকটার শার্ট প্যান্ট সবকিছু নষ্ট হয়ে আছে। কিন্তু সে বিরক্ত হয়নি। চোখে মুখে কোথাও বিরক্তির রেশটুকু নেই। মেঝে নোংরা হয়ে গেছে। তনয়া ক্লান্ত, বিরক্তি, লজ্জা সব লাগছে একসাথে। এরই মধ্যে নার্স এসে হাজির হলো। কেবিনের অবস্থা এরকম দেখে কিছুটা নারাজ বোধহয়।

বমিতে কাজ হয়েছে। শরীরে গুমরে থাকা জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। শরীর হালকা লাগছে। নার্স বিরক্তি মুখখানা নিয়ে ফিরে গেছে। এক সার্ভেন্ট এসে মেঝের নোংরা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। উষ্ণ নিজেও চেঞ্জ করে দশ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো। কোথায় গিয়ে চেঞ্জ করল কে জানে? হাসপাতালের বাথরুম ও হতে পারে। নার্স ফের এসেছে। তনয়াকে চেক করছে। উষ্ণ তখন ফোন নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। নার্স তার প্রেসার চেক করল। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর চেক করল। জ্বর নেমে যাচ্ছে। খড়খড়ে স্বরে বলল,

“বমি ক বার করলেন?”

“এক বারই হয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা। বিয়ের ক’দিন?”

“জি!”

নার্সের এমন প্রশ্নে তনয়া অবাক হলো। নার্স নিজেই সেধে বলল,

“তখন আপনার বর যা করছিলো, মনে হচ্ছিল পুরো হাসপাতাল যেন কিনে ফেলেছে। ডাক্তারের সাথেই একটু হলে মারা*মারি লেগে যেত। এতো হাই টেম্পারড হলে হয়। বর কে বুঝান।”

তনয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল। নার্স কাগজে লিখতে লিখতে বলে উঠলো, “রোজ রোজ অনেকেই দেখি। অনেক স্বামী স্ত্রী আসেন। সবার ভাগ্য একরকম হয় না। কোনো স্বামীকে স্ত্রীকে এভাবেই ফেলে রেখে চলে যায়। কেউ আবার দিন দুনিয়া সব ভুলে স্ত্রীর পাশে বসে থাকে। বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করে। এই তো আপনি বমি করে ঘর নোংরা করলেন। সাথে স্বামীর জামাকাপড় নষ্ট করলেন। আপনার হাসব্যান্ড বিরক্ত হয়েছে? হয়নি। আপনার পাশের কেবিনে সেম কাণ্ড ঘটিয়েছে এক পেশেন্ট। স্বামী নাক ছিকটে ফেলে চলে গেছে। সেই হিসেবে আপনার স্বামী টেক কেয়ার চোখে পড়ার মতো।”

তনয়ার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। লোকটার কাণ্ডকারখানায় এখানকার লোকজনের চোখে পড়ে গেছে। সবাই ভাবছে এমন স্বামী পেয়ে সে কতো ভাগ্যবতী! সত্যিই তো ভাগ্যবতী! এমন হাসব্যান্ড কয়জন পায়?

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৫৪

তখন মধ্যরাত। রাতের আঁধারে সব ঢেকে গেছে অতলে। পর পর কয়েকবার ড্রিংক করে ইরিশার নে*শা ধরে গেছে। মারা*ত্মক নে*শা যাকে বলে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। পা দুলছে, শরীর দুলছে। চোখে যা দেখছে সব ঝাপসা। ড্রিং*ক করে নিজের এই হাল কখনোই করে না সে। আজ করছে! কারণ তার মাথায় ভীষণ জটলা পেকে গেছে। আত্মবিশ্বাস, মানসম্মান সবকিছুতে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। লোকে আজ তাকে দেখে হাসছে। স্যোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে গেছে “শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী বিয়ে করেছেন তার অফিসের স্টাফ কে। তাহলে কি এই কারণেই ইরিশা জামানের মতো এতো বড় বিজনেস ওমেনকে ত্যাজ্য করল সে।” আরো কতো কতো কথা। ভিন্ন ভিন্ন অভিমত। সকলের কাছে এখন হাসির ফোরাক ইরিশা জামান। সে টের পাচ্ছে উষ্ণ সকলের সামনে তাকে চ*ড় মেরেছে। মুখ থুব*ড়ে পড়েছে সে। স্যোশাল মিডিয়াতে নিজের বিয়ের খবর ছড়িয়েছে হেয় করছে ইরিশা কে। ফূর্তি বাজ মানুষ এসব দেখে হাসছে। শত শত কথা বলছে। উষ্ণের বউ নির্ঘাত তার চেয়েও সুন্দরী। সবাই উপচে পড়ছে তার বউকে দেখার জন্য। পুরো একরাতের মধ্যে ইরিশা জামানের জীবন পাল্টে গেল। যেই দম্ভ আর প্রতিপত্তি খাটিয়ে সবর্দা মাথা উঁচু করে থাকত আজ সেই আসমান আর জমিনের ফারাক বুঝতে অপারগ। অফিসের সকল স্টাফ তাকে দেখে হাসছে। আহা! বেচারী বলে সান্ত্বনাও দিচ্ছে কেউ কেউ। এরপর মিডিয়ার ফোনের উপর ফোন। সবাই চায় তার ইন্টারভিউ নিতে। তার পক্ষের গল্প শোনাতে। কি আশ্চর্য! স্যোশাল মিডিয়া জুড়ে এখন সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতে হবে। ঢং যতসব। আর মিডিয়ার লোক গুলোও যা তা। একটা কিছু পেলেই হলো। রে*গে ফোনটাই ভে*ঙে ফেলেছে। রাগে শরীর জ্বল*ছে। তখন ধাক্কা*টা তনয়াকে না মে*রে উষ্ণ মার*লে খুব ভালো হতো। হাত পা ভেঙে বেডে বসে থাকত। তখন তনয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেত। চালে ভু*ল হয়ে গেছে। আরে রে*গে গেলে মাথা ঠিক থাকে কার। যতবার তনয়াকে দেখে ততোবারই মনে হয়, এই মেয়েটার জন্য উষ্ণ তাকে তুচ্ছ করেছে। সকলের সামনে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। বিয়ে বাড়ির এতো গুলো লোক তার উপর হাসাহাসি করেছে।

ক্রো*ধের আ*গুন জ্ব*লছে বুকের মধ্যে। অফিসে সাজানো নানা নামীদামী ফুলদানি ছুঁ*ড়ে মা*রল দেওয়ালে। রাগে চেঁচিয়ে উঠল। এতোরাতে অফিসে কেউ ছিলো না। কেউ ছিলো না বারণ করার জন্য কেউ না।

এদিকে জামান সাহেব ও তখন শহরের বাইরে। স্যোশাল মিডিয়ার এসব শুনে তিনি ঢাকা ফেরবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার উপর মেয়েকে শতশত কল। কোনো জবাব নেই। মেয়ের ফোনে কলই যাচ্ছে না। লোকবল লাগিয়েও কাজ হচ্ছে না। কেউ ভাবতেই পারছে ইরিশা এতোরাত অবধি অফিসে থাকতে পারে। আজ তো আবার অফিসে ছুটি ছিল।

মধ্যরাতে ইরিশা জামান অফিস ছেড়ে বেরুলো গাড়ি নিয়ে। নেশা ক্ত ইরিশা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে আর বিরবির করছে, বাস্টা*র্ড! উষ্ণ চৌধুরী ইজ অ্যা বিগ বা*স্টার্ড! আই যাস্ট ওয়েস্টেড মাই ফা”কিং টাইম অন হিম। ডেম ইট! আহ!”

আর কতোশত গালিগালাজ করছে। পিছনের চুলগুলো শক্ত করে চেপে ধরে ধীর গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মাতা*ল থাকলেও গাড়ি ড্রাইভের কৌশল এখনো তার হাত থেকে বেরুয়নি। হ্যাঁ, ঠিকঠাক ভাবে বাড়ি অবধি পৌঁছাতে পারবে বলে আশা রাখল। কিন্তু হলো না। ডান দিক থেকে তীব্র আলোর ঝলকানি এসে পড়ল চোখে মুখে। ইরিশা পাশ তাকাতেই চোখ দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে গেল। আলো যত কাছে আসছিলো ততোই তার চোখের তেজ কমে যাচ্ছিল। চোখ বুজে ফেলল সে।

পিটপিট করে চোখ মেলছে সে। চারদিকে অন্ধকার! কিছু দেখতে দেখতে পারছে না। শরীর পুরো ঝিম মেরে আছে। শরীরে একই সাথে বিভিন্ন জায়গায় আ*ঘাত পেলে শরীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অবস্থা সেরকমই। পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। হাত ঠাওর করতে পারছে না। শরীর পুরো অবশ হয়ে গেছে। চোখ মেলে মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। এতোক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। এখন বাস্তবে ফিরে এলো। মুখ খুলে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। এতোক্ষণ বাদে কারো মুখ দেখতে পেলো সে। মুখটা তার চেনা! উষ্ণ! হ্যাঁ সেই তো!

কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না। উষ্ণ ঘাড় বাঁকিয়ে উপুড় করে তাকে দেখছে। গাড়ি পুরো উল্টে গেছে। গাড়ির জানালা দিয়ে ইরিশা অর্ধেক শরীর বেড়িয়ে এসেছে বাকি অর্ধেক গাড়ির মধ্যে। পা নাড়াতে পারছে না। মাথা ভীষণ ব্যা*থা করছে। সেখানেও মারা*ত্মক আঘা*ত পেয়েছে। রাস্তা ভিজে উঠেছে তার র*ক্তে। দু হাত র*ক্তে মাখামাখি। ডান হাত তুলে উষ্ণের দিকে বাড়াতেই উষ্ণ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

“চিন্তা করো না, তোমাকে এতো সহজে মা*রব না! অনেক হিসাবনিকাশ বাকি তোমার সাথে!”

ইরিশা কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই তার কথা গলায় আটকে যাচ্ছে। উষ্ণ হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল। ইরিশা গালে হাত রেখে বলে উঠলো,

“আমায় তুমি শত অ*পমান করলেও আমি কখনো জবাব দেয়নি। কেন জানো? তুমি মেয়ে মানুষ! আমার ধারণা মেয়ে মানুষ মাথা মোটা হয়, বোকা হয়! এরা সবসময় দু লাইন বেশি বুঝে। রাস্তার ঘেউ ঘেউ করা কুকুরের সাথে তাল মিলিয়ে লাভ আছে। তুমি ঠিক তেমনটা ছিলে আমার কাছে।‌ কিন্তু তোমরা মেয়ে মানুষ আসলেই বোকা। আমার নিশ্চুপতাকে আমার দুর্বলতা ভেবে নিলে। তুমি কি জানো না, নিশ্চুপ মানুষ দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ং*কর মানুষ। এরা একবার বেঁকে বসলে দুনিয়া ছার*খার করে দিতে পারে!”

“কিছু বলবে? বলো না। তোমার কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করে না। আমার জানের দিকে হা*ত বাড়িয়েছো। ইচ্ছে করছে তোমাকে টু*করো টুক*রো করে কুকুরকে খেতে দিতে। ভ*য় পেলে? না না সেটা করব না। ওসব করলে তোমার ফুফুকে ভ*য় দেখাবে কে? আমার শ*ত্রু সংখ্যা অনেক ইরিশা। তোমাকে দিয়ে সবাইকে বুঝাব, শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরীর সাথে শত্রু*তা করতে আসলে কি ভ*য়ংকর অবস্থা হতে পারে। শেষবারের মতো দেখে নাও আমায়। কারণ এরপর আর কখনো আমার মুখ দেখতে পারবে না। মনে রাখো আমাকে, উষ্ণ চৌধুরী কে!”

ইরিশা ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। ঠোঁট বিড়বিড় করছে। কিছু বলবে, পারছে না। চোখের কোণে দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ইরিশাকে দেখে বিন্দুমাত্র মায়া হচ্ছে না উষ্ণর। এই মেয়েটার প্রতি কখনোই মায়া আসেনি তার।

জেএস পাশে এসে দাঁড়াল। উষ্ণ তার মুখের পানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাজ হয়েছে?”

জেএস মাথা নাড়ল। উষ্ণ উঠে দাঁড়াল। ইরিশা ছটফট করছে। উষ্ণ তার মুখের দিকে ঝুঁকে বলল,‌

“বললাম তো ছট*ফট করো না। সবচেয়ে কঠিন মৃ*ত্যু দিব তোমায়। ম*রার পরেও আমায় স্মরণ করবে। করবে তো!”

গলার ফাক দিয়ে এখন চিকন স্বরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জেএস তার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল। উষ্ণ সিগারেট ধরাল। সাদা বিষা*ক্ত ধোঁয়া শূন্য ছেড়ে বলল,

“মানুষের জীবনে সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটা জানো তো ইরিশা? নিজেকে মা*রা? নিজেকে মার*তে মানুষের অনেক সাহসের দরকার হয়। সেই সাহস তোমার আছে। তোমাকে মে*রে পাপের ভাগীদার হতে আমি চাই না!”

বলেই তারা দু’জন পিছন ফিরল। ইরিশা নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও একবিন্দু নড়াচড়া করতে পারেনি। জেএস গিয়ে গাড়িতে বসল। উষ্ণ পিছন ফিরে তাকাল। বলে উঠলো,

“বিদায় ইরিশা জামান!”

উষ্ণকে না দেখতে পেলেও এক জ্ব*লন্ত অ*গ্নিশিখা দেখতে পেলো সে। ভ*য়ে তার চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসে। লাইটারে আ*গুন জ্বা*লিয়ে এদিকে ছুঁড়ে ফেলতেই মূহুর্তে গাড়ি জ্ব*লে উঠল। আ*গুন ধরে গেল চারদিকে। ইরিশা আঁতকে উঠেছে ভ*য়েতে। এতো কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখতে পেয়ে তার আ*ত্মা অবধি কেঁপে উঠেছে। শ্বাস প্রশ্বাসের তীব্র শব্দ, দু হাতে লড়াই করছে। কোনোভাবে যেন গাড়ি থেকে বের হওয়া যায়। পারছে না! সম্ভবই না। তার শরীর পু*ড়ে যাচ্ছে। আহ, কষ্টে ছ*টফট করছে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্সের সাইলান্সের শব্দ। ইরিশা চোখ বুজে কেঁদে উঠল। তার কান্নার কোনো শব্দ নেই। মধ্যরাতে তীব্র দমকা হাওয়ায় সবকিছু যেন মিলিয়ে গেছে!

———

তনয়া বসে আছে বেডের উপর। আজকেই তাকে ডিসচার্জ করা হবে। তার কেবিনে বিশাল সাইজের একটা টিভি আছে। সময় কাটানোর জন্য টিভি ছাড়ল সে। কিছু নেই দু একটা খবরের চ্যানেল ছাড়া। ঘুরে ফিরে সেসবই দেখছে। সেখানেই জানতে পারল উষ্ণ স্যারের ব্যাপারে। সে বিমুঢ়! বিমূর্ত তার আঁখি জোড়া। তার আর উষ্ণ স্যারের বিয়ের ব্যাপারটা এখন গোটা দেশ জানে। তাদের বিয়ের খবর ছড়ালো কে? নিজের আর উষ্ণ স্যারের ছবি খবরের চ্যানালে দেখে চক্ষু চড়কগাছ তার।

ঠিক এই সময়ে উষ্ণ আর ডাক্তার শাফিউল ইসলাম রুমে এলো। তনয়ার নজর সরে গেল টিভি থেকে। ডাক্তার শেষবারের মতো তার চেকাপ করছে। উষ্ণ দেখলো, খবরের চ্যানালে মধ্যরাতের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছে। সাথে সাথে টিভি বন্ধ করে দিল। তনয়ার মনোযোগ ওতোদূর অবধি গেলোই না। সে ডাক্তারের সাথে কথা বলতেই ব্যস্ত। অবশেষে ডাক্তার তাকে বাসায় যাবার পারমিশন দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উষ্ণ স্যারের দিকে তাকাল সে। তাকে দেখেই বিরক্ত লাগছে। আবার লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল। একইসঙ্গে এই দুরকম অনুভূতির মায়াজালে অস্বস্তিতে জড়িয়ে গেল তনয়া!

~ চলমান