বিষন্ন বসন্ত পর্ব-০১

0
3

#বিষন্ন_বসন্ত
#সানা_শেখ
#সূচনা_পর্ব

“Hi.”

“হ্যালো, আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি, আমার পরিবারের সবাইও ভালো আছে। আমি সিঙ্গেল, আপনাকে বিয়ে করতে আমি রাজি আছি, আমার কোনো আপত্তি নেই, আমি আপনাকে কবুল করে নিচ্ছি কবুল কবুল কবুল।”

পুরো মেসেজ টা লিখে সেন্ড করে রাগে ফোস করে শ্বাস ছারে মিহি পুরো নাম “আবিরা মিহি” আদর করে সবাই মিহি ডাকে।
একটু আগেই “অভিরাজ জাওয়াদ” নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছিল। প্রোফাইলে একটি ছেলের বুকের নিচ থেকে পা অব্দি দেখা যাচ্ছে, হাতে একটা ব্ল্যাক কালার গিটার। রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করার মিনিটও পার হয়নি ইনবক্সে মেসেজ চলে এসেছে। মেসেজ দেখেই মিহির রাগ উঠে যায়। রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেছে বলে কি ইনবক্সেও আসতে হবে? প্রথমে Hi দিয়ে কথা শুরু করবে, তারপর কেমন আছো? বাড়ির সবাই কেমন আছে? বাড়ি কোথায়? পরিবারে কে কে আছে? তুমি ছোট নাকি বড়? কয় ভাই বোন? সিঙ্গেল নাকি? আরো নান প্রশ্ন তো আছেই, কথা শেষ করবে গিয়ে “আমি তোমাকে ভালোবাসি” দিয়ে। গত তিন মাসে এসব অভিজ্ঞতা মিহির হয়ে গেছে । রাগের কারণে এমন একটা মেসেজ লিখে সেন্ড করে দিয়েছে।

ওর এমন মেসেজ দেখে অপর পাশের মানুষ টা বোধহয় তব্দা খেয়ে গেছে। সিন হয়েছে সাথে সাথেই কিন্তু এখনো কোনো রিপ্লাই আসেনি।
মিহি রাগ কমিয়ে ভিলেনি হাসি দিচ্ছে অপর পাশের মানুষটার রিয়াকশন কল্পনা করে। ওর কেমন আনন্দ ফিল হচ্ছে এখন। ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে। আরো দে মেয়েদের ইনবক্সে মেসেজ।

মিহি কে অবাক করে দিয়ে অপর পাশ থেকে মেসেজ আসে,

“আমিও তোমাকে কবুল করে নিলাম কবুল কবুল কবুল।”

মেসেজ দেখে মিহি নিজেই তব্দা খেয়ে যায়। এটা কি হলো? ভেবেছিল অপর পাশ থেকে আর কোনো রিপ্লাই আসবে না। ব্যাটা তো দেখা যায় ওর এক কাঠি উপরে।
রাগের মাথায় কি অকাজ করলো এটা? সত্যি সত্যিই বিয়ে হয়ে গেল নাকি?
মিহি হাতের ফোন বেডের উপর ছুঁড়ে ফেলে চুপ হয়ে বসে থাকে। কি হবে এখন? রাগের মাথায় কি উল্টা পাল্টা কাজ করে বসলো! সব ঠিক আছে কিন্তু কবুল কেনো বলতে গেলো আগ বাড়িয়ে?

পর পর তিন বার ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ টোন বেজে ওঠে। পা দিয়ে ফোন টা কাছে এনে স্ক্রিনে তাঁকিয়ে দেখে অপর পাশ থেকে দুটো মেসেজ আর একটা চোখ উল্টিয়ে তাকানোর ইমোজি এসেছে।
প্রথম মেসেজ,

“আমার ভার্চুয়াল বউটার নাম কি?”

দ্বিতীয় মেসেজ,

“বিয়ে তো হয়ে গেল এখন ভার্চুয়ালে বাসর করবো কিভাবে?”

মেসেজ দেখেই মিহির বুকের ভেতর দরাস দরাস করতে শুরু করে। অস্বাভাবিক ভাবে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। বুকের সাথে সাথে হাতও কাপছে। চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছে!

ফোনের এপাশে থাকা অভিরাজ ছোট ছোট চোখ করে ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে আছে। ওর পাশে আর সামনে বসে আছে ওর চার জন বন্ধু। সকলের দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে। ট্রুথ অর ডেয়ার গেম খেলছিল। ওদের এই গেমের নিয়ম ছিল আলাদা। ছোট ছোট পেপারে ট্রুথ আর ডেয়ার লিখে ছোট ছোট ভাঁজ করে সব গুলো একসাথে ঝাকানো হবে সেখান থেকে একটা চিরকুট তুলতে হবে যার ভাগ্যে যা লিখা উঠবে তাকে সেটাই করতে হবে।

সকলের শেষে আসে অভিরাজের পালা। ও যেই চিরকুট তোলে সেটাতে ডেয়ার লিখা ছিল। ওর বন্ধুরা ওকে ডেয়ার দেয়, ফেসবুকে লগইন করার পর ফ্রেন্ড সাজেশনে যেই মেয়ের আইডি প্রথমে থাকবে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে মেসেজ করতে হবে এবং মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করতে হবে। সবাই জানে অভিরাজ রসকষ হীন নিরামিষ একটা মানুষ। এর মধ্যে কোনো অনুভূতি নেই। বয়স আটাশ বছর অথচ এখনো একটা প্রেম অব্দি করেনি, বাড়ি থেকে বিয়ে করাতে চায় সে বিয়ে করতেও নারাজ। তার বিয়ে শাদী করার কোনো ইচ্ছে নেই। একা একাই ওর ভালো লাগে।
বন্ধুদের চাপে পড়ে “মায়াবী কন্যা” নামের আইডি তে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, মেসেজ দেওয়ার পর অপর পাশের মেসেজ দেখে তো ওর মাথা পুরো ঘুরে গেছিল।
বড় বড় চোখ আর মুখ টা হা করে ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে ছিল। মেসেজ দেখে হাসতে হাসতে ওর বন্ধুদের অবস্থা নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল।
বন্ধুদের প্যারাপেরিতে ওদের বলা কথা গুলোই আবার মেসেজ করেছে।

এখন ওপাশ থেকে আবার কি রিপ্লাই আসে কে জানে? অভিরাজের বুকের ভেতরেও একটু একটু শব্দ হচ্ছে। এমনিতে প্রেম, ভালোবাসা, মেয়ের প্রতি সেরকম কোনো অনুভূতি না থাকলেও এখন যেন কেমন অনুভূতি হচ্ছে।
আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সবাই ফোনের স্ক্রিনে।
বন্ধুদের প্যারাপেরিতে আবার মেসেজ করে,

“হেই মায়াবী কন্যা আমার ভার্চুয়াল বউ কোথায় তুমি? কথা বলছো না কেন? তোমার আদরের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছি আমি।”

মেসেজ দেখে মিহি ক্যাবলার মতন তাঁকিয়ে রইলো। ব্যাটা তো মহা খচ্চর, কেমন উল্টা পাল্টা মেসেজ করছে। মেসেজ টায় অ্যাংগ্রি রিয়েক্ট দিয়ে ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ থেকে বেরিয়ে আসে। কত্ত বড় শ য় তা ন লোক সামনে পেলে মাথা ফাটিয়ে দিত এখন।

অ্যাংগ্রি রিয়েক্ট দেখে অভিরাজের বন্ধুরা হো হো করে হেঁসে বলে,

“মেয়ে ক্ষেপে গেছে ভাই।”

আরেক জন বলে,

“আবার মেসেজ কর।”

অভিরাজ বিরক্ত চোখে মুখে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আর একটাও না, জীবনে যা কল্পনা করিনি সেসব করাচ্ছিস তোরা আমাকে দিয়ে। গিয়ে দেখ মেয়েটা আমার গুষ্টির পিন্ডি চটকাচ্ছে।”

একজন অভিরাজের হাত থেকে ফোন টা থাবা দিয়ে নিয়ে দ্রুত টাইপ করে,

“রেগে যাচ্ছো কেন ভার্চুয়াল বউ? বাজারে যাচ্ছি কি কি লাগবে লিস্ট তৈরি করে দাও, আমি রেডি হয়ে আসছি এক্ষুনি।”

মেসেজ সেন্ড হতেই অভিরাজ থাবা দিয়ে নিজের ফোন টা নিয়ে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে মেসেজ টা দেখে নিজেও ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ থেকে বেরিয়ে আসে।
রাত অনেক হয়ে গেছে, বারোটা বাজতে বেশি দেরি নেই। বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে,

“তোরা থাক আমি গেলাম ঘুমোতে।”

“তোর ভার্চুয়াল বউ কে ছাড়াই ঘুমিয়ে যাবি? প্রথম রাত তোদের দুজনের, বউ কে নিয়ে ঘুমা।”

রাগী চোখে তাকায় অভিরাজ। ওর বন্ধুরা সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। অভিরাজ নিজের রুমে এসে ডোর লক করে ফ্রেস হয়ে এসে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতেই বন্ধুর কথা গুলো কানে বেজে ওঠে, “তোর ভার্চুয়াল বউ কে ছাড়াই ঘুমিয়ে যাবি? প্রথম রাত তোদের দুজনের, বউ কে নিয়ে ঘুমা।”

বিরক্ত হয়ে পাশ থেকে একটা বালিশ তুলে মাথায় উপর চেপে ধরে।

অভিরাজ ওর দুই বন্ধুর সাথে শেয়ারে এই ফ্ল্যাটে থাকে। ওরা তিন জনেই ব্যাচেলর বাকি দুই বন্ধু বিয়ে করেছে, বাচ্চাও আছে। ওই দুই বন্ধু ফ্যামিলি নিয়ে এই ফ্লোরেই থাকে পাশের ফ্ল্যাটে।
_____________

সকালে অভিরাজ ঘুম থেকে ওঠে এগারোটা নাগাদ।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ওরা তিন জনের একজনও রান্না করে খায় না, তিন জনেই বাইরের খাবার খায়।

লিফটে উঠে ফোন আনলক করে। ম্যাসেঞ্জারে অনেক গুলো নোটিফিকেশন জমা হয়ে আছে।
ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ ওপেন করতেই প্রথমে চোখে পড়ে মায়াবী কন্যা আইডি টা। একটা মেসেজ এসেছে।
মেসেজ ওপেন করবে না করবে না করেও কৌতূহলী হয়ে ওপেন করে।
ওর ফোন থেকে পাঠানো লাস্ট মেসেজের রিপ্লাইএ একটা মেসেজ এসেছে।
লিফট থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মেসেজ টা পড়তে শুরু করে।

“এক কেজি মুলা, এক আটি মুলা শাক, মোটা মোটা ভাতের চাউল, পুঁটি মাছ, চ্যাপা শুঁটকি, রান্নার জন্য সব রকম মসলা। আপনাকে রান্না করে খায়াবো আমি নিজ হাতে, যদিও আমি রান্নার র ও পারি না কিন্তু ব্যাপার না আপনার জন্য কষ্ট করে রান্না করে দেব। আর টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য হারপিক, টয়লেট ব্রাশ, টয়লেট আপনি পরিষ্কার করবেন নিজ হাতে।
ভার্চুয়ালে সংসার করার জন্য যা যা লাগবে সেসবও মনে করে নিয়ে আসবেন ভার্চুয়াল জামাই।”

মেসেজ পড়ে গম্ভীর চোখে মুখে মৃদু হাসি দেখা যায়। যদিও অভিরাজ এমন স্বভাবের ছেলে না কিন্তু আশ্চর্য ভাবে এখন ওর রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করছে। দেরি না করে নিজেও শ য় তা নি করে মেসেজের রিপ্লাইএ লেখে,

“আমি তো এসব খাই না ভার্চুয়াল বউ। আমি টয়লেটও পরিষ্কার করতে পারি না। তুমি যদি খাও তাহলে আমি নিয়ে আসবো আর টয়লেট টাও যদি তুমি পরিষ্কার করো তাহলে হারপিক আর টয়লেট ব্রাশও নিয়ে আসব।”

মেসেজ সেন্ড করে সামনের দিকে এগিয়ে পাশের একটা রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে।
খাবার অর্ডার দিয়ে বসে ছিল তখনই মেসেজ টোন বেজে ওঠে। টেবিলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ওর ভার্চুয়াল বউয়ের মেসেজ।
মিহি রিপ্লাই দিয়েছে।

“আমিও এসব খাই না, ভেবেছিলাম আপনার পছন্দের খাবার এগুলো। যাই হোক বাজারে কি করছেন এখনো?”

“রান্না তো করোনি তাই খেতে আসলাম।”

“বাজারে খাবেন?”

“রেস্তোরাঁয়।”

“বাড়িতে রান্না হয়নি?”

“তুমি তো রান্না করোনি।”

মেসেজ টা দেখে মিহি হেসে মেসেজ করে,

“বললাম না রান্না পারি না।”

“বউ যখন রান্না করতে পারে না তখন তো বাইরেই খেতে হবে।”

“আপনার বাবা-মা নেই?”

“আছে।”

“আন্টি রান্না করেননি নাকি বাড়িতে নেই?”

“আমিই বাড়িতে থাকি না, জবের সূত্রে বাইরে থাকি।”

“ওওও।”

“বিয়ে করেননি?”

“গত রাতেই তো করলাম।”

“সেটা তো ভার্চুয়াল জগতে করেছেন। রিয়েল লাইফে বিয়ে করেননি?”

“নাহ্।”

“কেন?”

“ইচ্ছে করে না।”

“কেন?”

“জানিনা।”

“গার্লফ্রেন্ড নেই?”

“না। তোমার বিয়ে হয়নি?”

“নাহ্।”

“কেন?”

“আমি ছোট মানুষ।”

“কত ছোট?”

“অনুমান করুন।”

“20 বা 22 বছর।”

মিহি মেসেজে হা হা রিয়েক্ট দিয়ে বেশ কয়েক টা হা হা স্টিকার সেন্ড করে।
অভিরাজ মেসেজ করে।

“বেশি বললাম নাকি?”

“একটু।”

“আমি কিন্তু তোমার থেকে অনেক বড়।”

“সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা খেয়ে নিই।”

“সাবধানে খাবেন গলায় আটকে ম’রে টরে যাইয়েন না তাহলে আমি আবার ভার্চুয়াল বিধবা হয়ে যাব।”

মেসেজে হা হা রিয়েক্ট দিয়ে বেশ কয়েক টা হা হা স্টিকার সেন্ড করে অভিরাজ নিজেও।
ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ থেকে বেরিয়ে ফোন রেখে খাওয়া শুরু করে। জীবনের প্রথম আজ কোনো মেয়ের সাথে এমন চ্যাটিং করলো। চ্যাটিং করে ওর কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে, এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। অদ্ভুত ভীষণ অদ্ভুত, অভিরাজ এমন হয়ে গেল কিভাবে? একটা মেয়ের সাথে এমন উল্টা পাল্টা মেসেজ কিভাবে করল? এমন টা তো অভিরাজের ক্যারেক্টারের সাথে যায় না, অভিরাজ তো এমন ছেলে নয়, একদমই না।

চলবে।