বিষন্ন বসন্ত পর্ব-০২

0
1

#বিষন্ন_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_2

বিকেল চারটা।
অভিরাজ ক্লান্ত পায়ে ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। সরাসরি নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে আসে। সেখানে সোফায় আরাম করে বসে আছে ওর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইব্রাহিম আর সোয়েব। বাদাম খেতে খেতে টিভির দিকে চোখ দুটো আটকে রেখেছে দুজনেই।

অভিরাজ ওদের পাশে গিয়ে বসে। হঠাৎ চোখ পড়ে গত রাতের ডেয়ার গেম খেলার সেই ছোট ছোট চিরকুট গুলোর দিকে। এখনো সেসব গুছিয়ে রাখা আছে ছোট্ট একটি কাঁচের জারে।

হঠাৎ কৌতূহলবশত জারটি হাতে তুলে নেয় অভিরাজ। একটা চিরকুট বের করে খুলে দেখে,
ডেয়ার, আরেকটা সেটাতেও ডেয়ার। কপাল ভ্রু কুঁচকে যায় অভিরাজের।

একে একে সব গুলো খুলে দেখে সব গুলোতেই ডেয়ার লেখা কোনো টাতেই ট্রুথ লেখা নেই কিন্তু ওর বন্ধুরা যখন চিরকুট তুলেছিল তখন তো ট্রুথ লেখা চিরকুট ছিল তাহলে সেগুলো কোথায় গেল এখন?

একে একে দুই মিলাতে সময় লাগে না অভিরাজের। চোখ মুখ শক্ত করে তাকায় পাশে বসে থাকা দুজনের দিকে, দুজন ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
অভিরাজ দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“আমার সাথে ডবল গেম!”

দুজন কে ধরার জন্য হাত বাড়াতেই দুজন সোফা থেকে উঠে দৌঁড়ে রুমে এসে ডোর লক করে স্থির হয়ে দাঁড়ায় দুজন।
ইব্রাহিম সোয়েব এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“তোকে না রাতেই বলেছিলাম কাগজ গুলো ফেলে দিতে, ফেলিসনি কেন?”

“আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তুই ফেলতে পারলি না?”

“তোর এই ভুলো মনের জন্য আজকে কি আছে কপালে কে জানে!”

অভিরাজ ডোর ধাক্কাচ্ছে আর ওদের ডাকছে।
ইব্রাহিম ভেতর থেকে বলে,

“এবারের মতন মাফ করে দে ভাই, আমার কোনো দোষ নেই। এই সব ওদের তিন জনের প্ল্যান ছিল।”

সোয়েব বলে,

“একদম মিথ্যে বলবি না, এই বুদ্ধি প্রথমে তোরই ছিল।”

অভিরাজ বাইরে থেকে বলে,

“আজকে শুধু বের হ দুজন, আমার সাথে ডবল গেম খেলা বের করবো তোদের।
______________

কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে খাবার খেয়ে নিজের ফোন হাতে বেডের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে মিহি।
ফেসবুকে লগইন করে নিউজ ফিড স্ক্রল করতে শুরু করে। সেদিনের পর আর অভিরাজ জাওয়াদের আইডি থেকে কোনো মেসেজ আসেনি।
মাঝখানে কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে, মিহিও ভুলে গেছে অভিরাজের কথা।

এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার পর বাবা ফোন কিনে দিয়েছিল। তিন মাস আগে ফেসবুক আইডি খুলেছে মায়াবী কন্যা নাম দিয়ে। আজ পর্যন্ত অনেক ছেলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। প্রথম প্রথম উরু উরু মন নিয়ে অনেক ছেলের সাথে ধুমসে চ্যাটিং করেছে। যখন ছেলে গুলো লাইন ছেড়ে বেলাইনে গেছে তখনই ব্লক করে দিয়েছে। এভাবে অনেক ছেলে কে ব্লক করেছে মিহি। প্রথম প্রথম ছেলে গুলো যা যা জিজ্ঞেস করতো মিহি সব কথার উত্তর দিত। কিন্তু তারপর একটু একটু চালাক হয়েছে। কেউ মেসেজ দিলে সত্যি কথা বলে না, উল্টা পাল্টা বলে। আর এখন তো কেউ মেসেজ করলেই বিরক্তই হয়ে যায়। ইনবক্সে মেসেজ পেলেই রাগারাগি করে ব্লক করে দেয়। সেদিন রাতেও একজনের সাথে মেসেজে ঝগড়া করে ব্লক করে দিয়েছিল তারপর নিউজ ফিড স্ক্রল করছিল আর তখনই অভিরাজ জাওয়াদ এর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে। একসেপ্ট করার সাথে সাথেই আবার মেসেজ। মিহির মস্তিষ্ক রাগে বিগড়ে গিয়েছিল আর রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা রিপ্লাই দিয়ে দিয়েছিল।

আসরের পর মিহির মেসেঞ্জারের টোন বেজে ওঠে। নোটিফিকেশন চেক করে দেখে অভিরাজের মেসেজ।
মিহির চোখ দুটো প্রথমে ছোট ছোট হয়ে এলেও পরমুহুর্তেই আবার চোখে মুখে শ য় তা নি হাসি ফুটে ওঠে।

মেসেঞ্জার অ্যাপ ওপেন করে মেসেজ টা পড়ে মিহি। অভিরাজ লিখেছে,

“আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো? কয়েক দিন ধরে দেখি কোনো খোঁজ খবর নেই? হাওয়া হয়ে গেলে নাকি?”

রিপ্লাই এ মিহি লেখে,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনি কেমন আছেন? আপনি খোঁজ খবর নিচ্ছেন না তাই অভিমান করে আমিও আর কিছু বলছি না। আমি রাগ করেছি আপনার সাথে।”

মিহির মেসেজ পড়ে অভিরাজ হেঁসে ওঠে। ভেবেছিল মিহি কে আর কখনো মেসেজ দেবে না। কিন্তু আজকে হঠাৎ মেসেজ করতে ইচ্ছে করছে, একটু দুষ্টামি করাই যায়। অপর পাশের মানুষ টা কখনও জানতে পারবে না ও কেমন চরিত্রের মানুষ। পরিচিত বা আপন জনদের যা বলা যায় না তা অপরিচিত মানুষের কাছে বলা যায় নির্দ্বিধায় কারণ সে কখনো সামনে আসবে না।
অভিরাজ নিজের আসল খোলস ছেড়ে একটু বের হতে চায় আজকে।
অভিরাজ মেসেজ করে,

“রাগ ভাঙানোর জন্য এখন কি করতে হবে? চলো ভার্চুয়ালি ঘুরতে যাই দুজন।”

“হাঁটতে ভালো লাগে না।”

“আমি আছি তো, কোলে নিয়ে হাটবো।”

শব্দ করে হেসে ওঠে মিহি। লজ্জার ইমোজি দিয়ে লেখে,

“ইস্, লজ্জা করছে আমার।”

অভিরাজ হেসে ওঠে। মেসেজে লেখে,

“এত লজ্জা পেলে হবে? লজ্জা কমাও।”

“কমালাম।”

“তোমাকে কোলে তুলে নিলাম।”

“গলা জড়িয়ে ধরলাম।”

“এইতো কোলে নিয়ে হাটছি এখন।”

“গন্তব্য কোথায়?”

“যত দূর হাটা যায়।”

“কত দূর হাঁটতে পারবেন?”

“যত দূর হাঁটার শক্তি আছে।”

আরো অনেক কথা হয় দুজনের মাঝে। অভিরাজের মেসেজ গুলো পড়ে পড়ে একবার লজ্জায় নুইয়ে যায় তো আবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। অভিরাজেরও প্রায় একই অবস্থা। বেচারা জীবনের প্রথম কোনো মেয়ের সাথে চ্যাটিং করছে তাও আবার প্রেম প্রেম চ্যাটিং।

অনেকক্ষণ পর মিহি লেখে।

“আচ্ছা ফাজলামি বাদ দিন।”

“দিলাম।”

“সরি।”

“কেনো?” সাথে চোখ উল্টানো একটি ইমোজি।

“ওই দিন রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা রিপ্লাই দিয়েছিলাম সেজন্য। আসলে আমার ওমন বলা উচিত হয়নি।”

“মাথা গরম ছিল নাকি সেদিন?”

“ওই একটু আরকি।”

“প্রচুর রাগ বুঝি তোমার?”

“না সেরকম না।”

“আমিও আসলে তোমাকে মেসেজ করতে চাইনি বন্ধুদের দেয়া ডেয়ার পূরণ করার জন্য মেসেজ করেছিলাম। তোমার মেসেজ দেখে তো ওরা আরো পেয়ে বসেছিল। ওদের জন্যই আমাকেও অমন মেসেজ করতে হয়েছে। আমিও সরি।”

“ঠিক আছে।”

“কোন ক্লাসে পড়?”

“ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।”

“ওহ, আমিও এমন টাই ভেবেছিলাম।”

কিছু সময় কেউ কোনো মেসেজ করে না আর। অভিরাজ আবার মেসেজ লেখে,

“আচ্ছা ভার্চুয়াল সংসার বাদ, আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি? ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড।”

“হুম অবশ্যই, আপনি অনেক মজার মানুষ কথা বলতে ভালো লাগে।”

“তুমিও, তোমার সাথে কথা বলে আমি যত হেসেছি দুদিন এত হাসি আমি কয়েক বছরেও হাসিনি।”

মিহির মায়ের গলার স্বর ভেসে আসে ড্রইং রুম থেকে। গলা ছেড়ে মিহি কে ডাকছেন তিনি। মিহি অভিরাজ কে মেসেজ করে,

“আম্মু ডাকছে, পরে কথা হবে ভালো থাকবেন।”

মেসেজ টা সেন্ড করে ফোন বেডের উপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। মায়ের সামনে দাঁড়াতেই মিহির মা মিসেস রুবি বলেন,

“কলেজ থেকে এসে খেয়ে সেই যে রুমে ঢুকেছিস আর খবর নেই। পেয়েছে একটা মোবাইল, সারাটা দিন মোবাইলের মধ্যে ঢুকে থাকে, নামাজ কালাম কিচ্ছু নেই। যা ছাদ থেকে কাপড় চোপড় গুলো নিয়ে আয়।”

মিহি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

“সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বের হই বিকেল তিন টায় ফিরে আসি। এর মধ্যে আবার গোছল করি, খাবার খাই, পড়াশোনা করি আরো কত কিছু করি। সারাটা দিন মোবাইলের মধ্যে ঢুকে থাকলাম কখন তাহলে?”

মিসেস রুবি কিছু বলেন না, এগিয়ে যান কিচেনের দিকে। ওনার বড় জা রান্না বসিয়ে দিয়েছেন চুলায়।

মিহি কাপড় চোপড় এনে যার যার টা তার তার রুমে দিয়ে আসে।
________________

মাস পেরিয়ে গেছে কয়েক দিন আগে।
অভিরাজ আর মিহির মধ্যে রোজ কয়েক ঘণ্টা ধরে মেসেজে কথা হয়। দুজনেরই নেশা হয়ে গেছে কথা বলা। কথা বলতে না পারলে দুজনেই কেমন যেন ছটফট করে।

এখন রাত এগারোটা। সেই নয়টা থেকে অভিরাজের সাথে মেসেজে কথা বলছে মিহি।
আবার অভিরাজের একটা মেসেজ আসে।

“তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?”

মিহির কপাল ভ্রু কুঁচকে যায়। হঠাৎ এই প্রশ্ন করছে কেন? পরমুহুর্তেই হয়তো বুঝতে পারে কেনো করছে এমন প্রশ্ন।
মিহি উত্তরে লেখে,

“না, এসব প্রেম ট্রেম আমি করি না।”

“কেনো করো না?”

“ইচ্ছে হয় না।”

“ইচ্ছে হয় না নাকি সেরকম কাউকে এখনো পাওনি?”

“দুটোই।”

“পেলে প্রেম করবে নাকি?”

মেসেজ দেখে ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসে মিহি। মেসেজে লেখে,

“পাব কোথায়?”

“হঠাৎ যদি পেয়ে যাও?”

“সোজা বিয়ে করে নেব। প্রেম করার ইচ্ছে নেই বিয়ে করার ইচ্ছে আছে।”

অভিরাজ হাসে মিহির মেসেজ পড়ে। নিজে পরবর্তী মেসেজে লেখে,

“বিয়ে করার ইচ্ছে আছে?”

“অনেক।”

“কেমন ছেলে পছন্দ?”

“ভদ্র-সভ্য, লম্বা-চওড়া, শক্তিশালী যেন আমাকে কোলে তুলতে পারে। আমার সব কথা শুনবে, আমাকে বুঝবে যেমন আপনি বুঝতে পারেন।”

“আমি তোমাকে বুঝতে পারি?”

“পারেন তো, আমি কিছু বলার আগেই আপনি কিভাবে যেন বুঝে যান।”

“তাহলে আমাকেই বিয়ে করে নাও।”

মেসেজ টা সেন্ড করে ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে রইলো অভিরাজ। অপর পাশ থেকে কোনো রিপ্লাই আসছে না। ধৈর্য হারা হয়ে অভিরাজ নিজেই আবার মেসেজ করে,

“বউ হবে আমার? আমার জীবনের আগের বসন্ত গুলো কোনো কারণ ছাড়াই কেনো যেন বিষন্ন ছিল এবারের বসন্ত টা নাহয় প্রাণবন্ত হাসিখুশি হবে। বউ হবে আমার? ভার্চুয়াল জগতের বউ না, বাস্তব জীবনের বউ। আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় আছি।”

চলবে………….