#বিষন্ন_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_4
“প্রথমে তুমি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছিলে, প্রথম তুমি মেসেজ করেছিলে, প্রথমে তুমিই প্রপোজ করেছিলে। এখন সব দোষ আমাকে দিচ্ছ কেন? আমি জানতাম নাকি অভিরাজ তোমার ফেক আইডি।”
শেহজাদ রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেডে দুই পা ঝুলিয়ে বসে আছে শেহজাদ। মিহি বেডের এক কোণায় দেয়ালের সাথে ঠেকে জড়সড় হয়ে বসে আছে।
মিহি কাদঁছে না কিন্তু ওর দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাথা ব্যাথায়। শেহজাদ এমন জোরে চুল ধরেছিল যে বেচারীর মাথা ব্যাথায় টনটন করছে এখন।
কিছু সময় চুপ থেকে শেহজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে আবার নিজের পেছনে তাকায় মিহির দিকে। শেহজাদ কে তাকাতে দেখে মিহি ভয়ে আরো চিপকে যায় দেয়ালের সাথে।
শেহজাদ গম্ভীর গলায় বলে,
“এদিকে আয়।”
মিহি আগায় না। শেহজাদ আবার ডাকে মিহি তবুও আগায় না। শেহজাদ অভয় দিয়ে বলে,
“মা’রবো না এদিকে আয়।”
“সত্যি মা’রবে না তো?”
“না।”
ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে মিহি। শেহজাদ ঘুরে এক পা বেডে তুলে ভাঁজ করে বসে। মিহি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। শেহজাদ হাত বাড়িয়ে মিহির মাথার পেছনে হাত রেখে বলে,
“ব্যাথা করছে?”
উপর নিচ মাথা নাড়ায় মিহি। শেহজাদ মিহির মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে বলে,
“আমি ইচ্ছে করে তোকে আঘাত করিনি। কি থেকে কি হয়ে গেল রাগের মাথায় ব্যাথা দিয়ে ফেলেছি। ভাইয়া কি কখনও তোকে মে’রেছে? ভাইয়া তো তোকে অনেক ভালোবাসে তাইনা? ভাইয়া তোকে ইচ্ছে করে আঘাত করেনি।”
শেহজাদের আদর মাখা গলার স্বর শুনে কেঁদে ওঠে মিহি। মাথার পিছনে অনেক ব্যাথা করছে।
শেহজাদ মিহির ওড়না দিয়েই মিহির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে দুই হাতে মিহির মুখ টা আগলে ধরে বলে,
“সোনা বোন আমার, কাঁদে না ভাইয়া তো তোকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দেয়নি। ভুল হয়ে গেছে আমার, আর কাদিস না।”
মিহি কাদতে কাদতে বলে,
“তুমি অনেক জোরে জোরে বকা দাও, ভয় দেখাও।”
“ভালোবাসি বলেই তো তোদের বকা দেই, ধমক দেই, ভয় দেখাই, শাসন করি। আমি কি কখনও তোদের তিন জন কে মে’রে’ছি? ভয় না দেখালে তো তোরা কথা শুনিস না। এখন কান্না বন্ধ কর আর আমার কথা শোন মন দিয়ে।”
মিহি নিজের কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করে।
কিছু সময় পর কান্না বন্ধ হয়ে যায়। শেহজাদ আবার মিহির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“এত দিন যা হয়েছে সব ভুলে যা। মনে কর অভিরাজ জাওয়াদ নামের কেউ কোনো দিন ছিলই না। অভিরাজের সাথে তোর কোনো দিন কথাই হয়নি। সব কিছু শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন, তুই লম্বা একটা স্বপ্ন দেখেছিস শুধু এর বেশি কিছু না। শুভ অনেক ভালো একটা ছেলে, তোকে অনেক ভালোবাসে। তোদের দুজনের বিয়ে আরো কয়েক বছর আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে। বড়রা সবাই জানে তোদের দুজনের বিয়ে ঠিক করে রাখা হয়েছে। তোর এইচএসসি পরীক্ষার পর তোদের বিয়ের কথা ছিল কিন্তু শুভ এখনই বিয়ে করে রাখতে চাইছে তাই হুট করে সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করেছে সবাই।”
“এত দিন আমাকে বলেনি কেনো কেউ?”
“আগে বলার প্রয়োজন হয়নি তাই।”
“দুদিন পর আমার বিয়ে আর আমি আজকে জানতে পারলাম।”
“বলছি না বিয়ের সিদ্ধান্ত হুট করে নেওয়া হয়েছে। চাচ্চু বাড়িতে আসার পর রাতে বোধহয় তোকে জানাতে চেয়েছিল। আগের কথা সব বাদ দে। পুরোনো সব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল শুধু পড়াশোনা ছাড়া। বিয়ের পরেও তোকে পড়াশোনা করতে হবে। এখন শুধু তোর আর শুভর বিয়ে পড়িয়ে রাখা হবে, উঠিয়ে নিতে দেরি আছে। শুভ অনেক ভালো ছেলে, তোকে অনেক ভালো রাখবে। আগের কথা ভুলে শুভ কে নিয়ে ভাব।”
মিহি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শেহজাদের মুখের দিকে।
না বুঝে নিজের অজান্তেই চাচাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করলো, ভালোবাসলো। এখন বিয়ে করতে হবে ফুপাতো ভাই কে। অদ্ভুত নিয়তি।
শেহজাদ আবার বলে,
“মন মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেল অভিরাজ জাওয়াদ নামের কেউ কোনো দিন ছিল। এই নামের কেউ নেই, কোনো অস্তিত্ব নেই, ছিল না কখনো।”
মিহির দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ে। শেহজাদ দ্রুত সেই পানি মুছে নিয়ে মিহির মাথা টেনে কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“ছোট্ট পাখি আমার, ভাইয়া তোকে ব্যাথা দিতে চায়নি। একটু শুয়ে থাক ব্যাথা ভালো হয়ে যাবে। আসছি আমি, মনের ভুলেও কখনও অভিরাজ জাওয়াদ এর কথা মুখে আনবি না, কাউকে কিছু বলবিও না। শুয়ে থাক এখন।”
শেহজাদ নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে ডোর খুলে বেরিয়ে যায়। এখনো ড্রইং রুমে কেউ নেই, না চাচী রান্না ঘরে রয়েছে।
সোজা নিজের রুমে চলে আসে শেহজাদ। ডোর লক করে বেডে বসে পড়ে। ফোন রেখে দুই হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে। কি হলো এটা? কেনো হলো? শেষ পর্যন্ত কাকে ভালোবাসলো? কেনো ভালোবাসলো?
ফেক আইডি দিয়ে প্রেম করার ভয়াবহ পরিণাম যে এমন হবে সেটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি শেহজাদ। রিয়েল আইডি থেকে মেসেজ করলে মিহি চিনতে পারতো, তাহলে এমন একটি ঘটনা ঘটতো না। দিনের পর দিন মিহির সাথে প্রেমালাপ করেছে ভেবেই কেমন যেন লাগছে। মিহির জায়গায় যদি ওর নিজের বোন থাকতো তাহলে কি হতো? মুখ দেখাতো কিভাবে? ওর বোন তো জানতো না ওইটা ও। না জেনেই নিজের ভাইয়ের সাথে ছিঃ ছিঃ ছিঃ, ভাবতেই শেহজাদের নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। বন্ধুদের ডেয়ার পূরণ করতে গিয়ে কি জঘন্য একটা কাজ করে বসেছে।
না চিনে, না জেনে মিহি কে কত ভালোবেসেছে, মিহি কে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখেছে, কল্পনায় মিহি কে নিয়ে সংসার সাজিয়েছে। যাকে এত ভালোবেসেছে দুদিন পর তাকেই বিয়ে দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে।
________________________
সারা বিকেল-সন্ধ্যা আর রুম থেকে বের হয়নি মিহি।
ওর মা কয়েক বার ডেকেছিল মিহি তবুও বের হয়নি।
সন্ধ্যার পর পর মিহির বাবা বাড়িতে আসে।
বাবা কে দেখে মিহির ছোট ভাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে হইহুল্লোড় শুরু করেছে।
মিহি ছোট ভাইয়ের গলার স্বর শুনে বুঝতে পারে ওর বাবা বাড়িতে ফিরে এসেছে।
হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে মুখে ক্রিম লাগিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
মিহি বাদে বাকি সবাই ড্রইং রুমে উপস্থিত আছে। শেহজাদ আর মিহির চোখাচোখি হয়। শেহজাদ দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নিজের ফোনের স্ক্রিনে তাকায়।
মিহি বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“কেমন আছো আব্বু?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই কেমন আছিস?”
“ভালো।”
মেয়ে কে নিজের পাশে বসান হাসান মাহবুব। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“মন খারাপ নাকি? চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”
মিহি হেসে বলে,
“কই মন খারাপ আব্বু? কিছু হয়নি, শুয়ে ছিলাম তো তাই মনে হয় এমন দেখাচ্ছে।”
“আমি কেনো বাড়িতে আসলাম জানিস?”
মিহি জানা সত্ত্বেও দুদিকে মাথা নাড়ায়।
হাসান মাহবুব সকলের দিকে একবার তাকিয়ে মেয়ের দিকে তাকান তারপর বলেন,
“তোকে না জানিয়েই আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মা’র ইচ্ছে ছিল শুভর সাথে যেন তোকে বিয়ে দেই। তখন বিষয় টা নিয়ে মাথা ঘামাইনি সেভাবে। মা বার বার বলেছিল শুভর সাথে তোর বিয়ে দিতে। তোর ফুপুও চেয়েছে তোকে ছেলের বউ করতে। তিন বছর আগেই তোদের দুজনের বিয়ে ঠিক করে রাখা হয়েছিল, তোর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতে হতে তোর আঠারো বছর পূর্ণ হবে তখন তোদের দুজনের বিয়ে হবে। তত দিন তোকে বিয়ে সম্পর্কে কিছু জানানো হবে না। কিন্তু শুভ এখনই বিয়ে করার জন্য পা’গ’লামি করছে। শুভ তোকে নিয়ে ভয় পায়। বিয়ে এখন হলেও শুভর সাথেই হবে আর এক বছর পর হলেও শুভর সাথেই হবে। তাই আগামী শুক্র বার ঘরোয়া ভাবে তোদের দুজনের বিয়ে পড়ানো হবে, এক বছর পর আয়োজন করে তুলে দেয়া হবে।”
মিহি কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শেহজাদের দিকে তাকায়, শেহজাদ তখনও ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে আছে।
___________
সকালে খাবার খেয়ে শেহজাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ কল করেছিল, ওকে যেতে বলেছে। শেহজাদ কে সাথে নিয়ে বিয়ের শাড়ি আর শেরওয়ানি সহ আরো প্রয়োজনীয় অনেক কিছু কিনবে।
শুভ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। ছয় মাস আগে প্রাইভেট কোম্পানীতে জয়েন করেছে। নম্র ভদ্র হাসিখুশি একটা ছেলে শুভ। যখন থেকে শুনেছে মিহি ওর বউ হবে তখন থেকেই মিহির প্রতি টান ভালোবাসা জন্ম নিতে শুরু করে। আর এখন মিহি কে ভালোবাসে মন প্রাণ দিয়ে। মিহি কে হারানোর ভয়ে এখনই বিয়ে করতে চাইছে তাড়াহুড়ো করে। একবার বিয়ে টা হয়ে গেলে আর ভয় থাকবে না।
দুপুরের দিকে মিলি আর ওর শশুর বাড়ির সবাই মিহি দের বাড়িতে চলে আসে।
বড় বোন কে পেয়ে মিহির খুশি হওয়ার কথা থাকলেও সেভাবে খুশি হতে পারছে না।
মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অভিরাজের কথা। অভিরাজ কে এত ভালোবেসে মিহি অন্য কাউকে কিভাবে বিয়ে করবে? অভিরাজ কে ঠকানো হবে না? অভিরাজ কে তো বলা হয়নি মিহির আজ বাদে কাল বিয়ে।
মিহি মোটেও শেহজাদ খান জারিফ কে ভালোবাসেনি। অমন গম্ভীর, রাগী, বদমেজাজি, একরোখা জেদী পুরুষ কে মিহি ভালোবাসতেই পারে না। মিহি তো ভালোবেসেছিল অন্য একটা পুরুষ কে, যে সম্পূর্ণ আলাদা, শেহজাদের বিপরীত চরিত্রের মানুষ ছিল অভিরাজ। অভিরাজ কে ভালোবেসে শুভ কে বিয়ে করবে, শুভ কে ঠকানো হবে না? প্রথম প্রেম ভুলে যাবে মিহি? মিহির তো কষ্ট হচ্ছে। কিভাবে ভুলবে অভিরাজ কে? ভুলতে পারবে? ভুলতে কত দিন সময় লাগবে? যত দিনে প্রেমে পড়েছিল? নাকি তার চেয়েও বেশি সময় লাগবে? ঠিক কত দিন লাগবে?
___________
শুভর বাইক মিহি দের বাড়ির সামনে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। বাইক থেকে নেমে দাড়ায় শেহজাদ। শুভর দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাড়িতে আয়।”
শুভ হেসে বলে,
“না একে বারে আগামী কাল আসব।”
“আগামী কাল তো আসবিই, এখন চা কফি কিছু খেয়ে যা।”
“না থাক এখন আর যাব না। আগামী কাল দেখা হচ্ছে তাহলে, আসি ভালো থেকো।”
শেহজাদ আরো কিছুক্ষন জোরাজুরি করে শুভ কে বাড়িতে যাওয়ার জন্য কিন্তু শুভ যায় না। মিহির জন্য কয়েক টা শপিং ব্যাগ শেহজাদের হাতে দিয়ে চলে যায় নিজের বাড়ির দিকে।
মিহি কে দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এখন আর দেখবে না, একে বারে আগামী কাল বউ সাঁজে দেখবে।
_________________
রাতের খাবার খেয়ে সোফায় বসে সবাই।
মিহি বড় বোনের পাশে জড়সড় হয়ে বসে আছে, একটু পর পর চোখ তুলে শেহজাদের দিকে তাকায়। শেহজাদ নিজেও একটু পর পর তাকাচ্ছে মিহির দিকে।
সময় গড়ায়, রাত দশ টা বেজে যায়।
শেহজাদ সোফা ছেড়ে উঠে রান্না ঘরে যায়, ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেয়ে আবার বেরিয়ে আসে ড্রইং রুমে।
সোফায় না বসে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।
মিহির সাইলেন্ট করা ফোন টা হাতের মুঠোয় কেঁপে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মিহি চমকে ওঠে। হাত থেকে ফোন টা ফ্লোরে পড়ে যায় শব্দ তুলে। মিহির হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সোফায় বসে থাকা সকলে মিহির দিকে তাকায়। মিহির মা রুবি বেগম বলেন,
“কি হয়েছে? ফোন পড়ল কিভাবে?”
মিহি দ্রুত ফোন টা কুড়িয়ে নিয়ে তুতলে বলে,
“ক কই কি কিছু হয়নি তো। হাত ফসকে প পড়ে গেছে।”
“এভাবে কথা বলছিস কেন?”
“হ হঠাৎ শব্দ শু শুনে ভয় পেয়ে গেছি।”
মিহি শেহজাদের দিকে তাকায়। শেহজাদ নিজের ফোন দেখিয়ে মিহি কে ইশারা করে বোঝায় ওর সাথে মেসেজে কথা বলার জন্য।
মিহি সোফা ছেড়ে উঠে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ফোনের স্ক্রিনে তাকায় আবার। অভিরাজের মেসেজ,
“মায়াবী কন্যা তোমাকে ভীষণ মিস করছি আমি। আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, আগে কোনো দিন এমন কষ্ট হয়নি। কেনো হচ্ছে এত কষ্ট? তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে আমার দম বন্ধ লাগছে।”
চলবে………….