বিষন্ন বসন্ত পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
3

#বিষন্ন_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_5 (অন্তিম পর্ব)

বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় মিহি। মেসেজ টা দেখে চোখ দুটো পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেছে। বুকের ভেতর ভীষণ রকমের কষ্ট হচ্ছে, দম বন্ধ লাগছে।

ফোনের স্ক্রিনে আবার একটা মেসেজ ভেসে ওঠে।

“কিছু বলছো না কেন? কেমন আছো?”

মিহি কাপা কাপা হাতে টাইপ করে,

“আমি ভালো নেই অভিরাজ, আমি ভালো নেই। আপনার সাথে কথা বলতে না পেরে আমারও দম বন্ধ লাগছে।”

“মিস করো আমাকে?”

“ভীষণ।”

“আমিও করি।”

মিহি চোখের পানি মুছে নেয়, সাথে সাথেই আবার টুইটুম্বর হয়ে যায়। বেলকনিতে থাকা বেতের চেয়ারে বসে কাপা কাপা হাতে আবার টাইপ করে,

“অভিরাজ।”

“হুম, বলো।”

“আমার না বিয়ে আগামী কাল কিন্তু আমি এই বিয়ে করতে চাই না। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।”

মেসেজ টা দেখে শেহজাদ কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে। টুইটুম্বর চোখ জোড়া থেকে টুপ টাপ কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
মিহির আরেক টা মেসেজ ভেসে ওঠে ফোনের স্ক্রিনে,

“আমি অন্য কারো জন্য বউ সাঁজতে চাই না অভিরাজ, আমি আপনার জন্য লাল শাড়ি পড়ে লাল টুকটুকে বউ সাঁজতে চাই। বউ সেজে আপনার জন্য অপেক্ষা করতে চাই। আপনি আসবেন আমাকে নিতে, সাদা ধবধবে শেরওয়ানি পড়ে।”

মেসেজ টা পড়ে ডান হাত টা বুকের বা পাশে চেপে ধরে শেহজাদ। ভীষণ রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে জায়গা টায়। এত কষ্ট! শেহজাদ আজকের আগে এত কষ্ট কোনো দিন অনুভব করেনি।

মিহির আরেক টা মেসেজ ভেসে ওঠে ফোনের স্ক্রিনে,

“অভিরাজ আমি ভীষন ভালোবাসি আপনাকে।”

অভিরাজ কম্পিত হাতে টাইপ করে,

“আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মায়াবী কন্যা।”

“আপনি কি আমার হবেন না?”

“আমি তোমার ভাগ্যে নেই। তুমি আমার চেয়ে বেটার লাইফ পার্টনার ডিজার্ভ করো মায়াবী কন্যা।”

“আমি বেটার চাই না অভিরাজ, আমি আপনাকেই চাই।”

“আমিও তো তোমাকেই চেয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য তো আলাদা।”

“আপনি কিছু একটা করুন।”

“কিছু করার নেই। সব কিছু আমার-তোমার হাতের বাইরে। আমরা একে অপরের ভাগ্যে নেই।”

“কেনো এমন হলো?”

“সব আমার দোষ।”

“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে গত কাল থেকে।”

“আমারও।”

“আমি এই বিয়ে করবো না। আপনি আব্বু কে বলুন আমার আর আপনার কথা। আপনি বলতে না পারলে আমিই বলছি।”

“না মায়াবী কন্যা, এটা আর সম্ভব না। এমন টা তুমি ভুলেও করবে না।”

“আমি শুভ ভাইয়া কে বিয়ে করতে চাই না।”

“শুভ অনেক ভালো ছেলে, তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমাকে নিয়ে শুভর অনেক স্বপ্ন।”

“আমিও তো আপনাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম অভিরাজ। কত শত স্বপ্ন আপনাকে ঘিরে।”

“তুমি কাল লাল টুকটুকে বউ সাজবে মায়াবী কন্যা। তোমাকে বউ সাঁজে দেখার অনেক ইচ্ছে আমার, বলা যায় আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন তোমাকে বউ সাঁজে দেখার। আমি তোমাকে নিতে নয় দেখতে আসবো, সাদা ধবধবে শেরওয়ানিতে নয় সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পড়ে আসবো আমি। তুমি সাজবে তো লাল টুকটুকে বউ?”

মেসেজ পড়ে ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে মিহি।
শেহজাদ ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে রইলো মিহির রিপ্লাই এর আশায়।
মিহি কান্না থামায়, চোখের পানি মুছে রিপ্লাই করে,

“আমি অন্য কারো জন্য কিভাবে বউ সাজবো অভিরাজ? আমি তো আপনার জন্য বউ সাজবো বলে অপেক্ষায় ছিলাম।”

“তোমাকে বউ হিসেবে পাওয়ার জন্য অন্য কেউ যে তিন বছর ধরে অপেক্ষা করছে মায়াবী কন্যা। তুমি তার বলা কথা গুলো শোনোনি, শুনলে বুঝতে পারতে সে তোমাকে কতটা ভালোবাসে। সে নিজের চেয়ে তোমাকে নিয়ে বেশি ভাবে, ভালোবাসে।”

“আপনি ভাবেন না? ভালোবাসেন না?”

“তোমার জীবনে আমার আগে সে এসেছে।”

“আপনি কেনো আগে আসেননি? যখন আগে আসেননি তাহলে পরে কেনো আসলেন?”

“ভালো থেকো, এটাই আমাদের শেষ আলাপ।”

“আমি আপনাকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকবো অভিরাজ? আপনি ছাড়া অন্য কিছুই তো ভাবতে পারি না আমি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে অভিরাজ, এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না।”

“সহ্য হয়ে যাবে, কয়েক দিন কষ্ট হবে তারপর সহ্য হয়ে যাবে।”

“আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”

“তাতো হচ্ছেই।”

“কোনো একদিন আমরা একে অপর কে ভুলে যাব তাইনা?”

“এটাই যে নিয়ম।”

মিহি আর কিছু লিখতে পারে না। শেহজাদের শেষ মেসেজ আসে।

“আমি তোমাকে না চিনে না জেনে ভীষণ ভালোবেছিলাম মায়াবী কন্যা। আমি যেই মায়াবী কন্যা কে ভালোবেসেছিলাম সেই মায়াবী কন্যার কোনো অস্তিত্ব কোনো দিন ছিল না নেই, আমি মিহি কে ভালোবাসিনি মায়াবী কন্যা। তুমি যেই অভিরাজ জাওয়াদ কে ভালোবেসেছিলে তারও কোনো অস্তিত্ব নেই, ছিল না। তুমি অভিরাজ কে ভালোবেসেছিলে শেহজাদ কে না। তুমি শুভর সাথে ভালো থেকো, শুভ কে ভালো রেখো। খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে যেও। স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলো অভিরাজ জাওয়াদ এর সাথে কোনো দিন তোমার কথা হয়েছিল। আজকের পর আমাদের আর কোনো দিন কোনো কথা হবে না। একটু পর থেকে অভিরাজ জাওয়াদ এই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে, যে থাকবে সে শেহজাদ খান জারিফ। আমার বিষন্ন বসন্ত বিষন্নই রয়ে গেল সাথে তোমার এই বসন্ত টাও বিষন্ন করে দিল।
বিদায় প্রিয় মায়াবী কন্যা, চিরো বিদায়।”

মেসেজ টা সেন্ড করে মায়াবী কন্যা কে ব্লক করে দেয় শেহজাদ। মায়াবী কন্যা রিপ্লাই এ কি বলে সেটা আর সে জানতে চায় না। আর মায়া বাড়াতে চায় না শেহজাদ। নিজেকে দমাতে না পেরে তখন মেসেজ করে ফেলেছিল।

শেহজাদ নিজের ফেক আইডি টা চিরো দিনের জন্য ডিলিট করে দেয়। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ফেক আইডি টা খুলেছিল, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে অচেনা একটা আইডি তে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল, মেসেজ করেছিল। তারপর, তারপর কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই সেই অচেনা মেয়ে টা কে ভালোবেসে ফেলেছিল সময়ের ব্যবধানে।

মিহি মেসেজ টা পড়ে কাদতে থাকে। অভিরাজ ব্লক করে দিয়েছে ওকে। আজকের পর আর অভিরাজ জাওয়াদ এর সাথে কথা হবে না। দুজন মিলে নানান প্ল্যান করা হবে না আর কখনও। দুজন প্রথম দেখায় কেমন রিয়াকশন দেবে সেটা বলে আর হাসা হবে না। বিয়েতে কিভাবে সাজবে সেটাও আর কখনো বলা হবে না। শত শত স্বপ্ন, মেসেজ, মুচকি হাসি, সব এখানেই শেষ, সমাপ্ত।

মিহি নিজেও নিজের আইডি টা ডিলিট করে দেয়।
ফোন টা পাশে রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে তারপর বলে,

“আমি প্রতিদিন আকাশ দেখতাম। ভাবতাম, আপনিও দেখেন। আরো ভাবতাম এই একটাই আকাশ আমাদের দূরত্ব পেরিয়ে জোড়া দেয় অদৃশ্য ভাবে।”
______________

মিহি দের বাড়িতে খুব বেশি মেহমান আসেনি। মিহির নানির বাড়ি থেকে সবাই এসেছে আর মিলির নানির বাড়ির সবাই। মিহির ফুপুর বাড়ির সবাই তো বর পক্ষ হয়ে এসেছে যদিও মাত্র ছয় জন এসেছে তারা।

মিহি লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পড়েছে। মিলি সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে মিহি কে।
মিহির রুমে ওর কাজিনরা সবাই বসে আছে ওকে ঘিরে।

শেহজাদ মিহির রুমের দিকে এগিয়ে আসে, গায়ে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি। রুমের সামনে এসে গলা খাঁকারি দেয় শেহজাদ। সকলের সাথে মিহি নিজেও চোখ তুলে তাকায় ডোরের দিকে। শেহজাদ রুমে প্রবেশ করে।
মিহির হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, শরীরে কাঁপুনি অনুভব করে আবার। ঠেলে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
চোখ দুটো আগে থেকেই পানিতে টুইটুম্বর হয়ে আছে।

শেহজাদ মিহির সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মিহির মুখের দিকে তাকায়। মিহি নিজেও শেহজাদের দিকে তাকায়।
শেহজাদ হেঁসে বলে,

“তোকে অনেক সুন্দর লাগছে ছোট পাখি।”

মিহি বলতে পারে না কিছু। শেহজাদ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে দ্রুতই বিয়ে পড়ানো হয়ে যায় শুভর এর মিহির।

শুভ আজকে এই বাড়িতেই থাকবে মিহির সাথে। চার দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল। দুদিন এই বাড়িতে থেকে চলে যাবে।

বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ার পর নিজের রুমে ফিরে আসে শেহজাদ। অল্প কিছু সময় পর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ড্রইং রুমে আসতেই শুভ সহ বাড়ির সকলের সাথে দেখা হয়।
শেহজাদের মা বলেন,

“আগামী কাল সকালে গেলে হতো না? এখনই চলে যাবে?”

“না যেয়ে উপায় নেই আম্মু। আগামী কাল আমাকেই ক্লাস করাতে হবে।”

“যত দ্রুত সম্ভব আবার ছুটি নিয়ে এসো।”

“হুম।”

সকলের সাথে একটু আধটু কথা বলে বিদায় নেয় শেহজাদ। আবার এগিয়ে আসে মিহির রুমের সামনে। গলা খাঁকারি দিয়ে আবারও ভেতরে প্রবেশ করে।
মিহি শেহজাদের কাঁধে ব্যাগ দেখে বলে,

“তুমি কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া?”

“ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি।”

“আজকেই?”

“হুম। ভালো থাকিস, নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা। সারা জীবন ভালো থাকিস আর সবাই কে ভালো রাখিস।”

বেড থেকে নেমে দাড়ায় মিহি।
শেহজাদ মিহির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“ভালো থাকিস, শুভ কে কখনও কষ্ট দিস না। শুভ যা বলে সব সময় শুনবি, ওর কথার অমান্য করবি না।”

মিহির চোখ থেকে টুপ টাপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
মাথা নাড়িয়ে শেহজাদের কথায় “হ্যাঁ” বলে। বড় ভাইয়ের বাধ্য বোন মিহি, বড় ভাই যা যা বলেছে মিহি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।

নিজের বোন সহ সকল কাজিন বোন দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে শেহজাদ। বাড়ির অর্ধেক মানুষ ওর পেছন পেছন বেরিয়ে এসেছে।

সিএনজি থামিয়ে উঠে বসে শেহজাদ। সকলের কাছ থেকে আরো একবার বিদায় নিয়ে সিএনজি ছাড়তে বলে। সিএনজি চলতে শুরু করে স্টেশনের দিকে।
শেহজাদ ফোস করে শ্বাস ছারে, বিকেল থেকে যেন শ্বাস আটকে রেখেছিল। ওর ছুটি আরো দুদিন আছে কিন্তু শেহজাদ এই বাড়িতে আর দুই মিনিটও থাকতে পারবে না। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল, অনেক কষ্টে এতক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছিল।
ছেলেদের কাদতে নেই কিন্তু শেহজাদের দুই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে তবে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। হা করে শ্বাস নিতে নিতে চোখের পানি মুছতে শুরু করে দুই হাতের সাহায্যে।
না পাওয়ার যন্ত্রণা অনেক বেশি, সহ্যের বাইরে এই যন্ত্রণা। শেহজাদ এত শক্ত হৃদয়ের মানুষ হয়ে নিজেকে সামলাতে পারছে না তাহলে নরম কোমল হৃদয়ের মিহি নিজেকে কিভাবে সামলাবে? কিভাবে?

~সমাপ্ত~