মধ্যবিত্ত পর্ব-০৩

0
1

#মধ্যবিত্ত (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

কয়েক দিন কেটে গেল৷ বাবাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হলো। ডাক্তার কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে বললো। তবে বাবা সে কথা শুনলেন না। সে হাসপাতাল থেকে এসেই পরেরদিন কাজের উদ্দেশ্য অর্থাৎ তার অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। বাবা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সাধারণ একটি পোস্টে জব করেন। সকালে বাবাকে অফিসের উদ্দেশ্য বের হতে দেখে আমি থামালাম। শান্ত গলায় বললাম,“বাবা তোমাকে আর অফিসে যেতে হবে না। চাকরিটা ছেড়ে দাও। সংসার আমি সামলে নিবো।”

“কতটা সামলে নিবা সেটা আমি ভালোই জানি। তাই তো এতবড় একটা শিক্ষিত ছেলে থাকতে আবার নতুন করে চাকরি করতে হচ্ছে। তোমার পিছনে টাকাগুলো অপচয় না করে যদি জমাতাম তাহলেও অন্তত আজ চাকরি করতে হতো না। ঘরে বসে থাকতাম।”
বাবার এই কথা শুনে মাথানত করে ফেললাম। বাবা সেটা দেখেও কোন ভাবান্তর না দেখিয়ে বললেন,“কয়দিন অফিস যাইনি খবর আছে? আজ যেতেই হবে।”
এটা বলে ঘরের বাহিরে পা রাখলেন। আমি চুপ করে রইলাম। বাবা পিছন ঘুরে আমার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,“যেদিন ভালো চাকরি পাবা সেদিন বইলো চাকরি ছাড়ার কথা। সেদিন ছেড়ে দিবো।”
এই কথা বলে বাবা আর দাঁড়ালেন না। সে চলে গেলেন। এটাই মধ্যবিত্ত জীবন। যেখানে অসুখ বাঁধা হতে পারে না। বাবার কথা শুনে কষ্ট পেলেও মাঝে মাঝে যখন তার দিক দিয়ে ভাবি তখন উপলব্ধি করতে পারি সে ঠিক। কিন্তু আমার কী করার আছে? ভালো চাকরি পেতে হলে মামা, খালু লাগে। মামা, খালু ছাড়া চাকরি খুব কম মানুষ পায়। সেই কম মানুষ, বলা যায় অনেক মেধাবী মানুষের ভিড়ে আমি চাপা পড়ে যাচ্ছি।

___
টিউশনি শেষ করে রতনকে ফোন দিলাম। তাকে আমার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে কি-না জিজ্ঞেস করলাম। রতন জানালো,“হ্যাঁ কথা বলেছি। তোর সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে বিকালে দেখা কর। হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা।”
বলে ফোন রাখতে কেউ একজন এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। তাকে দেখে কয়েক মূহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার সামনে নীলা দাঁড়িয়ে আছে। নীলা আমাকে দেখে শান্ত গলায় বললো,“কেমন আছো শান্ত?”
এই মূহুর্তে নীলাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। তবুও বহু কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম,“ভালো আছি। তুমি?”

“আমিও বেশ আছি।”
কথা প্রসঙ্গে জানলাম নীলা এখানে তার স্বামীর সঙ্গে এসেছে। তার স্বামী পাশের দোকানে গিয়েছে তখন আমাকে নজরে পড়তে আমার কাছে আসলো। আমি কোনরকম কথা কাটাতে বললাম,“আজ আসি।”

কথাটি বলে যেই না সামনে পা বাড়াবো তখন নীলা বলে,“এখনো চাকরির পিছনে ছুটছো?”
এই কথাটি দ্বারা নীলা যে আমি বেকার কি-না জানতে চাচ্ছে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝলাম। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,“হ্যাঁ। এখনো বেকার।”

“তাহলে ভালোই করছি বলো?”
নীলার এই কথা ম্লান হেসে আমি বললাম,“ঠিকই করেছো। একজন বেকার ছেলের জন্য কতদিন অপেক্ষা করা যায়? তাছাড়া আমি মধ্যবিত্ত। তোমার পরিবার এমনিও মানতো না। তোমার মতো সুন্দরী শিক্ষিত মেয়ের জন্য তারা ভালো কাউকে আশা করে। তুমি সেটা ডিজার্ভও করো। তাই আমাকে ছাড়ার সিদ্ধান্তটা তোমার ভুল ছিলো না। খুবই ভালো ছিলো। আমি মনে করি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো।”
এই কথা বলে আমি আর দাঁড়ালাম না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা দূরে গিয়ে পিছনে তাকালাম। ইতিমধ্যে নীলার পাশে তার স্বামী এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনকে বেশ মানিয়েছে। তাদের একসঙ্গে দেখে খুশিই হলাম। যদিও আমার কষ্ট পাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না। কারণ নীলা সঠিক ছিলো। আমাদের দুজনার মধ্যে ভীষণ ভালোবাসা থাকলেও সেই ভালোবাসাকে পূর্ণতা দেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার মতো মধ্যবিত্ত ছেলের ছিলো না। যেই যোগ্যতা আমার ছিলো না সেটার জন্য অন্যকে দ্বায়ী কিভাবে করি? যদিও নীলা যখন হাত ছেড়ে দিয়েছিলো তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনকষ্টে কিছুটা বকাও দিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে এই বিষয় নিয়ে আমি যতবার ভেবেছি ততবারই মনে হয়েছে নীলা সঠিক। কারণ আমি আমার ভবিষ্যতের দিক তাকালে কিছু দেখতে পাই না। সেদিনও ভবিষ্যতটাকে অন্ধকারের মতো লাগতো। আজও সেটাই৷ এই অন্ধকার ভবিষ্যতের পথিকের সঙ্গ নীলা কতদিন দিবে? ভুলটা আমারই ছিলো। মধ্যবিত্ত এই সমাজে অভিশাপের মতো বোঝার আগেই নীলাকে জীবনে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। যদি সেই সময়ে মধ্যবিত্ত হয়ে জন্ম নেওয়ার অভিশাপটাকে চোখে দেখতে পেতাম তাহলে হয়তো নীলাকে জীবনে জড়াতাম না। এতটা ভালোও বাসতাম না। আর ভালোবাসাটা নাহলে ভালোবাসা হারানোর বেদনাও পেতাম না।
*
বাড়ি ফিরে মায়ের চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে গেলাম। বোনকে প্রচুর বকা দিচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম বোন নিরবে কান্না করছে। আর মা বকেই যাচ্ছে। মায়ের কথা হলো,“সংসারের অবস্থা তুই জানিস না? যেখানে সংসার চালাতে আমরা হিমশীম খেয়ে যাচ্ছি সেখানে তুই এখন তিন হাজার টাকার জামা পছন্দ করে বলিস, এটা কিনে দাও মা। এই কথাটা বলতে তোর বুকে বাঁধলো না। এত শখ কিসের? বাবা, ভাইয়ের কষ্ট দেখছিস না?”
এভাবে নানা কথা বলে যাচ্ছে মা। আমি মাকে বললাম,“এভাবে ওর সঙ্গে চেঁচামেচি করছো কেন মা?”
আমার কথার জবাবে মা যা বললো তাহলো, বোন তার বান্ধবীর গায়ে একটি জামা দেখে খুব পছন্দ করেছে। বাড়িতে এসে মায়ের কাছে তেমন জামা চেয়েছে। যার দাম তিন হাজার টাকা। এজন্য মা তাকে বকছে। আমি বোনের কান্না দেখে তার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,“কান্না করিস না বোন। মা একটু রেগে আছে তাই এমন বলছে।” তারপর মাকে বোঝালাম বোনকে এভাবে না বকতে। বোন সবে দশম শ্রেনীতে পড়ে। জীবনটা এখন তার কাছে রঙীন। আশেপাশের মানুষকে দেখে নানা ইচ্ছা, শখ মনের মধ্যে জেগে উঠছে। এখানে বোনের দোষ নয়। দোষটা হলো তার ভাগ্যের। সে এমন পরিবারে জন্ম নিয়েছে, যেখানে তিন হাজার টাকা অনেক টাকা। কিন্তু তার বান্ধবীর পরিবার তেমন নয়। তাদের কাছে এটা সামান্য টাকা। এখানে বোনকে বকে কোন লাভ হবে না? বরং তাকে বোঝাতে হবে আমাদের অবস্থা। সাধ্য অনুযায়ী স্বপ্ন দেখা উচিত। আমরা আমাদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে স্বপ্ন দেখি বলেই বোধহয় এত কষ্ট পাই। হতাশা আমাদের ঘিরে ধরে। আমি বোনকে বেশ ভালোভাবে কথাগুলো বোঝালাম। বোন কান্নারত অবস্থায় বললো,“আমি শুধু বলেছি ওটা পছন্দ। আমার এমন জামা থাকলে ভালো হতো। তাতেই মা প্রচুর কথা শোনাচ্ছে। আমি কী বলেছি আমার ওটাই লাগবে?”
বোনের এই কথায় তাকে কান্না করতে বারণ করলাম। তার মন ভালো করার জন্য বললাম,“চল দোকান থেকে ভাজাপোড়া কিনে নিয়ে আসি। খাবি তো?”

“হ্যাঁ। ইশ কতদিন পর ভাজাপোড়া খাবো জানো? আমি খাবো না মানে একশোবার খাবো।”
বোন মূহুর্তের মাঝে খুশি হয়ে গেল। তার খুশি দেখে আমারও মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।তৎক্ষনাৎ বোনকে নিয়ে কাছের একটি দোকানে গেলাম।

রাতে সার্টিফিকেটের কপি রতনকে দিয়ে আসলাম। বাসায় আসতে শুনতে পেলাম বাবা খাবার খাচ্ছে না। সে ঘরের মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছে। আমি মাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে মা জানালো,“তোর বাবার বয়স হয়ে গেছে। প্রায় সময় অসুস্থ থাকে তাই অফিস কতৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দিবে। এই কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছে৷ আসলে সংসারের এত খরচ, মেয়েটার পড়ালেখা, তুইও কোন চাকরি করিস না। সব মিলিয়ে ভেঙে পড়েছে।”

“বাবার চাকরি করতে হবে না। আমি সকালেই তো বললাম বাবাকে চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু সে রাজি হলো না।
ঠিকই তো বাবার বয়স হয়েছে, এখন চাকরি করা লাগবে না।”
আমার কথা শুনে মা হতভম্ব হয়ে তাকালো। তারপর বললো,“চাকরি না করলে সংসার কিভাবে চলবে?”

“আমি রতনের সঙ্গে রতনের অফিসে চাকরি নিচ্ছি। সেই সাথে টিউশনি তো আছে। সংসারটা আমি সামলে নিতে পারবো মা। তাছাড়া আমারও মনে হয় এবার তোমরা সংসারটা আমার উপরে ছেড়ে দাও, তাহলে অন্তত সংসারের জন্য হলেও আমার কিছু একটা হবে।”
আমার কথা শুনে মা কিছুটা খুশি হলো। আমার একটি চাকরি হবে এটা শুনেই সে খুশি৷ আসলে সে তো জানে না, কোন চাকরি হচ্ছে, কত স্বল্প বেতন, এই চাকরির স্বপ্নটা আমি দেখিনি। এসব আমার মা বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি। তার কাছে ছেলের একটি চাকরি আর সংসারটা কোনভাবে চলে যাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ৷ আমিও তাই ভেবে নিলাম মধ্যবিত্ত হয়ে এত স্বপ্ন দেখতে নেই। এখন সংসারের প্রয়োজনে যেই চাকরি পাবো সেটাই করবে। এখন সংসারটা চালানো প্রয়োজন। অতঃপর…..



চলবে,