#শেখবাড়ির_বড়ছেলে
২
আমরা রাস্তায় নেমে এলাম। আমার হাত রিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। কিংবা হয়তো রিয়ার হাতই আমার হাতকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ভোরের আলোয় ধূসর পিচঢালা পথটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। দু-একটা রিকশা আর ভোরের সবজি নিয়ে যাওয়া ভ্যান ছাড়া রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা। আমার জন্মভিটা, আমার বেড়ে ওঠার সাক্ষী ‘শেখ বাড়ি’ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাটাকার দৈত্যের মতো। যে দৈত্যটা এইমাত্র তার এক সন্তানকে গিলে খেয়ে উগরে দিয়েছে পথের ধুলোয়।
আমার ভেতরটা অসাড় হয়ে আসছিল। মায়ের মুখ, সালিশে বসে থাকা লোকজনের কঠিন চাহনি—কিছুই আর আমার মস্তিষ্কে তোলপাড় তুলছিল না। আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে তখন শুধু একটা মুখ—রিয়ার। মেয়েটা আমার জন্য, আমার ভালোবাসার জন্য নিজের পরিবার ছেড়ে চলে এসেছে। আর আমি তাকে বিয়ের প্রথম সকালেই একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলাম। কী ভাবছে ও? ওর ফ্যাকাশে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভরসা দেওয়ার মতো কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরোল না। আমার ভেতরটা তখন একটা শব্দহীন শূন্যতার রাজ্য।
আমরা হাঁটছিলাম। কোথায় যাচ্ছি, তার কোনো গন্তব্য নেই। শুধু জানি, এই মুহূর্তে এই মেয়েটার হাত ধরে রাখাটাই আমার একমাত্র কাজ। তার আস্থার মর্যাদা আমাকে রাখতেই হবে।
ঠিক তখনই আমার পকেটে থাকা ফোনটা তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে উঠল। এই কাকডাকা ভোরে কে ফোন করতে পারে? আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা বের করলাম। স্ক্রিনে ‘রাহাত’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। আমার ছোট ভাই। ইতালি প্রবাসী। বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই ধক করে উঠল। অজানা এক আশঙ্কায় আমার হৃৎপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করল। মা কি এর মধ্যেই সব জানিয়ে দিয়েছে ওকে?
আমি ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাহাতের গলা ভেসে এলো, “হ্যালো ভাইয়া।”
ওর গলার স্বরে কোনো উষ্ণতা নেই। কেমন যেন শীতল, আনুষ্ঠানিক। আমি কোনোমতে বললাম, “হ্যাঁ, রাহাত। বল।”
“তোমার সাথে আমার একটা কথা ছিলো।”
আমি চুপ করে রইলাম। রিয়ার দিকে একবার তাকালাম। সে উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাহাত বলে চলল, “মা’র সাথে যা হয়েছে আমি তার সবটাই শুনেছি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। শুনেছি মানে! মা নিশ্চয়ই নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে বলেছে। আমাকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন, পরিবারের বোঝা হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।
“তবে তোমাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে ফোন করলাম,” রাহাতের কণ্ঠস্বর আরও কঠিন শোনাল। “সেটা হচ্ছে আজ থেকে তুমি কোথাও নিজেকে শেখ বাড়ির ছেলে হিসাবে পরিচয় দেবে না।”
কথাটা আমার কানে ঢোকার সাথে সাথে মনে হলো কেউ আমার কানের ভেতর উত্তপ্ত শিশা ঢেলে দিয়েছে। আমার পায়ের নিচের রাস্তাটুকুও যেন কাঁপতে শুরু করল। আমি কী শুনছি এসব?
ও বলে চলল, “আমাদের বাসার একটা সম্মান আছে। শেখ বাড়ির পরিচয় দিলে সম্মান যাবে, বিশেষ করে আমার। আমি এখানে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। দেশে আমার বিয়ের কথাবার্তা এগোবে। লোকজন যখন খোঁজখবর নেবে, তখন যদি শোনে শেখ বাড়ির বড় ছেলে, যে দেশের নামকরা একটা কোম্পানিতে চাকরি করত, সে এখন রাস্তায় রাস্তায় ফকিন্নির মতো ঘুরছে, তাহলে কেউ আমার সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে? সবাই বলবে, যার বড় ভাইয়ের এই অবস্থা, সেই পরিবারের ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়া যায় না। আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।”
‘ফকিন্নি’! শব্দটা আমার মাথায় হাতুড়ির মতো আঘাত করল। আমার নিজের ভাই, আমার রক্ত, আমাকে ফকিন্নি বলছে! যে ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে আমি দিনের পর দিন টিউশনি করেছি, নিজের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছি, ভালো একটা শার্ট না কিনে সেই টাকাটা ওর জন্য পাঠিয়েছি, সেই ভাই আজ আমার অস্তিত্বকে তার বিয়ের বাজারে সম্মানের কাঁটা মনে করছে। আমার চোখের সামনে সবুজের ষড়যন্ত্র, মায়ের নিষ্ঠুরতা, আর এখন রাহাতের এই বিশ্বাসঘাতকতা—সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। আমার ভেতরটা কেউ যেন ঠাণ্ডা লোহার সাঁড়াশি দিয়ে মুচড়ে দিচ্ছিল।
একটা তীব্র ক্রোধ আমার সমস্ত শরীর বেয়ে শিরশির করে উঠল। আমি এতদিন ধরে যে আবেগের বাঁধ দিয়ে রেখেছিলাম, তা এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে আমি বললাম, “তুই যে দেশে থেকে ফুটানি মারছিস আর ভালো বিয়ের স্বপ্ন দেখছিস, সেই স্বপ্নটা দাঁড়িয়ে আছে আমার টাকায়। তোর ইতালি যাওয়ার ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম, মনে আছে?”
ওপাশ থেকে রাহাত এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে কিছুটা থতমত খেয়ে গেল।
আমি আর ওকে কথা বলার সুযোগ দিলাম না। প্রায় চিৎকার করে বললাম, “আর ভয় পাস না! তোদের পরিচয় আমার দেওয়া লাগবে না। আমি আমার নিজের পরিচয়ে বড় হব।”
ফোনটা কেটে দিলাম। আমার হাত কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে একা এবং নিঃস্ব মানুষ আমি। পরিবার বলে আমার আর কিছু রইল না। মা আমাকে ত্যাগ করেছেন টাকার জন্য, আর ভাই ত্যাগ করল তার তথাকথিত ভবিষ্যতের জন্য।
আমার অবস্থা দেখে রিয়া হয়তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সে আমার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে নরম গলায় বলল, “কী হয়েছে? কে ফোন করেছিল?”
আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার চোখে জল চলে এসেছিল। এই প্রথম ওর সামনে আমি এতটা দুর্বল হয়ে পড়লাম। ধরা গলায় বললাম, “রাহাত।”
রিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। হয়তো আমার মুখের দিকে তাকিয়েই সবটা বুঝে নিয়েছিল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। তার চোখে তখন আর ভয় নেই, আছে এক ধরনের স্থিরতা। সে শান্ত গলায় বলল, “চলুন আমাদের বাসায়।”
কথাটা আমার কানে অমৃতের মতো শোনাল। এই চরম দুঃসময়ে, যখন আমার নিজের পরিবার আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন রিয়ার এই একটা কথাই আমাকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলল। আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।
আমার মনটা মুহূর্তের মধ্যে হালকা হয়ে গেল। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম, যাক, অবশেষে কদিন থাকার মতো একটা জায়গা হলো। এই কদিনে ঠিকই একটা কাজ ম্যানেজ হয়ে যাবে। আমার নিজের ওপর বিশ্বাস আছে। আমি পরিশ্রম করতে ভয় পাই না। একবার যখন শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করেছি, আবার না হয় করব। শ্বশুরবাড়িতে তো আর বেশিদিন থাকা যায় না, সেটা অসম্মানের। কিন্তু আপাতত মাথার ওপর একটা ছাদ তো পাওয়া গেল!
আমরা একটা রিকশা নিলাম। রিকশা চলছে রিয়ার বাড়ির দিকে। আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ভবিষ্যতের ছক কষতে শুরু করেছি। কোথায় কোথায় চাকরির জন্য আবেদন করা যায়, কার সাথে যোগাযোগ করা যায়—এসব ভাবতে ভাবতে পথ ফুরিয়ে এলো। রিকশাটা একটা সুন্দর দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল। দেখেই বোঝা যায়, রিয়ার পরিবার বেশ সচ্ছল।
রিয়া রিকশা থেকে নামল। আমিও নামতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ও আমাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
রিয়ার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। সেই শান্ত, স্থির মুখ। কিন্তু সেই স্থিরতার পেছনে যে এমন ভয়ংকর এক ঝড় লুকিয়ে ছিল, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। সে আমার দিকে না তাকিয়ে, তাদের বাসার গেটের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, “আমি দুঃখিত, রাফিদ।”
আমি বোকার মতো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। “দুঃখিত মানে? চলো ভেতরে যাই।”
রিয়া এবার আমার দিকে ফিরল। তার চোখেমুখে কোনো অনুশোচনা নেই, আছে এক কঠিন বাস্তবতা। সে বলল, “আমি আমার বাবা-মাকে কী বলব? বলব যে আমি এমন একজনকে বিয়ে করেছি, যার থাকার জায়গা নেই, চাকরি নেই? যার নিজের মা-ভাই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে?”
আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। আমি কী শুনছি এসব! এই কি সেই রিয়া, যে কাল রাতেও আমার বুকে মাথা রেখে সারা জীবন একসাথে চলার স্বপ্ন দেখছিল?
ও বলে চলল, “চাল-চুলোহীন একটা ছেলের সাথে থাকার চাইতে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়াও ভালো। অন্তত অন্ধকার ভবিষ্যতে পা তো বাড়াতে হবে না।”
প্রতিটি শব্দ আমার হৃৎপিণ্ডে বরফ-শীতল ছুরির মতো বিঁধছিল। আমার পায়ের নিচের শেষ মাটিটুকুও যেন এবার সত্যি সত্যিই সরে গেল। আমি এতক্ষণ যে অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলাম, সেই অবলম্বনই আমাকে অতল গহ্বরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে। আমার পরিবার আমাকে আঘাত করেছে, কিন্তু রিয়ার এই আঘাত ছিল সহস্র গুণ বেশি যন্ত্রণার। কারণ এই আঘাতটা এসেছে ভালোবাসা আর বিশ্বাসের মোড়কে।
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে, ভাঙা গলায় আমি শুধু বলতে পারলাম, “আমার ভালোবাসা কি মিথ্যে ছিল, রিয়া?”
রিয়া একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। যে হাসিটা আমার চেনা নয়। সে বলল, “অভাব যখন দরজা দিয়ে আসে, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়, রাফিদ। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। বাস্তবতাকে মেনে নিতে শেখো।”
কথাটা শেষ করে সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। গেট খুলে দ্রুত বাড়ির ভেতরে চলে গেল। আমার চোখের সামনেই ধাতব গেটটা একটা বিকট শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। শুধু আমার জন্য নয়, আমার ভালোবাসার জন্য, আমার ভবিষ্যতের জন্য।
আমি রিক্সা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম। একা। ভোরের সূর্যটা তখন পুরোপুরি উঠে গেছে। তার সোনালি আলো আমার চোখেমুখে এসে পড়ছে, কিন্তু আমার পৃথিবীজুড়ে তখন শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। আমার চাকরি নেই, পরিবার নেই, ভালোবাসা নেই। আমার কিচ্ছু নেই।
রাস্তার কোলাহল বাড়ছে। মানুষ ছুটছে নিজের গন্তব্যে। শুধু আমিই এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কোনো গন্তব্য নেই। চোখের জল গাল বেয়ে টপটপ করে পিচঢালা রাস্তায় পড়ছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমন আমার সব স্বপ্ন, সব বিশ্বাস এই মুহূর্তে মিলিয়ে গেল।
চলবে…