শেখবাড়ির বড়ছেলে পর্ব-০৪

0
1

#শেখবাড়ির_বড়ছেলে


রাতের জমাট বাঁধা কষ্ট আর ভেজা কাপড়ের শীতলতা শরীরটাকে যেন অসাড় করে দিয়েছিল। কখন যে এই ঠান্ডা, কঠিন মেঝেতে চোখ দুটো লেগে এসেছিল, টেরই পাইনি। ঘুম ভাঙল হঠাৎ করেই, তবে কোনো পাখির ডাকে বা ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নয়। আমার শরীরের ওপর সজোরে এসে পড়া একটা লাথিতে আমার পুরো পৃথিবীটা আবার দুলে উঠল। দোকানি আমাকে কঠিন গলায় বলল,

“ঐ হারামজাদা! ওঠ! এটা কি তোর বাপের হোটেল পাইছস? বেলা দশটা বাজে, এখনো মরার মতো পইড়া আছস! ওঠ কইলাম!”

চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম, মাঝবয়সী এক লোক ঝাঁটার বাঁট হাতে আমার দিকে ঝুঁকে আছে। তার চোখে রাজ্যের ঘৃণা আর বিরক্তি। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। শরীরের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, তবে সেটা লাথির ব্যথার চেয়েও বেশি ছিল অপমানের ব্যথা। কাল রাত থেকে যেটুকু আত্মসম্মানবোধ নিজের ভেতর সযত্নে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম, এই একটা লাথিতে তা যেন ধুলোয় মিশে গেল। শেখ বাড়ির বড় ছেলে রাফিদ, যার দিকে চোখ তুলে কথা বলার সাহস কারো ছিল না, সে আজ রাস্তার এক নাম-পরিচয়হীন আবর্জনা, যাকে যে কেউ লাথি মেরে তুলে দিতে পারে।

আমি কোনো কথা না বলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। ভেজা শার্টটা গায়ে লেপ্টে শুকিয়ে খসখসে হয়ে আছে। সারা শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি আর তীব্র ক্ষুধা। দোকানদার লোকটা তখনও বিড়বিড় করে গালিগালাজ করছিল। আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। ওই জায়গা থেকে সরে আসাই শ্রেয় মনে হলো।

রাস্তায় নামতেই সকালের ব্যস্ত শহরের কোলাহল আমাকে ঘিরে ধরল। মানুষ ছুটছে, গাড়ি চলছে, জীবন তার নিজের গতিতে বহমান। শুধু আমিই যেন এক স্থির বিন্দু, যার কোনো গন্তব্য নেই, কোনো গতি নেই। পেটের ভেতর ক্ষুধার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় একটা আকাঙ্ক্ষা আমার ভেতরটা তোলপাড় করছিল—রিয়া।
আমার মস্তিষ্ক জানে, সব শেষ। আমার বিবেক বলছে, ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। কিন্তু আমার মন? সে এক অবুঝ শিশু। সে এখনো বিশ্বাস করতে চাইছে, রিয়া হয়তো রাগের মাথায় ওসব বলেছে। হয়তো এতক্ষণে তার রাগ কমেছে। হয়তো সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এই ‘হয়তো’-দের ওপর ভর করে আমার পা দুটো নিজে থেকেই রিয়ার বাড়ির দিকে চলতে শুরু করল। বুকের ভেতর একবুক ক্ষীণ আশা—যদি ও একবার ফিরে আসে? যদি একবার বলে, ‘চলো রাফিদ, আমরা আবার একসাথে শুরু করি’? এই একটা বাক্যের জন্য আমি হয়তো এই পৃথিবীর সব কষ্ট সহ্য করতে রাজি ছিলাম।

পরিচিত গলি, পরিচিত রাস্তা পেরিয়ে আমি যখন সেই ধাতব গেটটার সামনে এসে দাঁড়ালাম, আমার হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করে উঠল। কালকের সেই বিকট শব্দ করে বন্ধ হওয়া গেটটা আজ শান্ত, স্থির। আমি গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকালাম। বারান্দাটা খালি। চারপাশটা বড্ড বেশি চুপচাপ। আমি কি কলিংবেল চাপব? নাকি ওর নম্বরে ফোন করব? দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে কয়েকটা মিনিট কেটে গেল।

ঠিক তখনই গেটটা খুলে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রিয়া। পরনে তার দামি নীল রঙের একটা শাড়ি, পরিপাটি করে সেজেছে। মুখে হালকা লিপস্টিক, চোখে কাজল। চুলগুলো খোলা, বাতাসে উড়ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। আমার এই বিধ্বস্ত, নোংরা চেহারার সাথে তার ঝলমলে রূপের কী ভীষণ বৈপরীত্য!
রিয়া আমাকে দেখল। তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময় ফুটে উঠলেও পরক্ষণেই তা কঠিন হয়ে গেল। তার দৃষ্টিতে না ছিল কোনো মায়া, না ছিল কোনো অনুশোচনা। ছিল কেবল রাজ্যের উপেক্ষা আর একরাশ বিরক্তি। যেন আমি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুক, পথের ভিখারি, যে তার সুন্দর সকালটা নষ্ট করতে এসেছে। সে আমার দিকে আর দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসল। রিকশাটা আমার সামনে দিয়েই চলে গেল, কিন্তু রিয়া একবারের জন্যও ফিরে তাকাল না।

আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার শেষ আশাটুকুও চোখের সামনে ধুলিসাৎ হয়ে গেল। আমার মনে হলো, কেউ যেন আমার বুকের ভেতর থেকে হৃৎপিণ্ডটা টেনে বের করে নিয়েছে। আমি আর ব্যথা অনুভব করছিলাম না; আমার ভেতরটা অসাড়, অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছিল।
পকেট থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা বের করলাম। স্ক্রিনের আলো জ্বলে উঠতেই ভেসে উঠল রিয়ার সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটা। আমার ফোনের ওয়ালপেপার। ছবিটাতে কী নিষ্পাপ, কী সুন্দর লাগছে ওকে! এই হাসির জন্যই তো আমি সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলাম। এই হাসির আড়ালে যে এতখানি নিষ্ঠুরতা, এতখানি স্বার্থপরতা লুকিয়ে থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। ভালোবাসা যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলা যায়, তখন তাকে আর যাই হোক, ভালোবাসা বলা যায় না। ওটা ছিল মোহ, হয়তো বা প্রয়োজন।

আমার আঙুলগুলো গ্যালারিতে গেল। এক এক করে আমাদের সব ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। একসাথে কাটানো মুহূর্ত, দেওয়া কথা, দেখা স্বপ্ন—সবকিছুই আজ অর্থহীন। আমার ভেতর থেকে একটা চাপা কান্না উঠে আসতে চাইল, কিন্তু পারল না। আমার কান্নাগুলোও বোধহয় মরে গেছে। আমি আর কাঁদব না। এই ঠুনকো আবেগের জন্য আমি যথেষ্ট মূল্য দিয়েছি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ওয়ালপেপারটা বদলে ফেললাম। তারপর একে একে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, গ্যালারি—সব জায়গা থেকে রিয়ার অস্তিত্ব মুছে দিলাম। প্রতিটি ডিলিট বাটন চাপার সাথে সাথে মনে হচ্ছিল, আমি আমার অতীতের একটা অংশকে কেটে বাদ দিচ্ছি। নিজেকে হালকা লাগছিল, আবার একই সাথে ভয়ংকর রকমের একা লাগছিল। আমার আর আঁকড়ে ধরার মতো কেউ নেই, কোনো স্মৃতি নেই।
আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? আমার কোনো টাকা নেই, আশ্রয় নেই, পরিচিত কেউ নেই। শেখ বাড়ির পরিচয়ের বাইরে আমার তো কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এই বিশাল শহরে আমি এখন একা, নিঃস্ব।

উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম আমি। রাস্তার দুপাশে জীবনের কত আয়োজন! ঝলমলে দোকান, দামি গাড়ি, সুখী মানুষের আনাগোনা। এই শহরের জৌলুস যেন আমাকে উপহাস করছিল। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে আমার চোখ আটকে গেল। বছর ষাটেকের এক বৃদ্ধ, শীর্ণকায় শরীর, কিন্তু চোখেমুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তিনি একটা রিকশা টানছেন। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, রোদে পোড়া চামড়া চকচক করছে। বয়সের ভারে শরীরটা নুয়ে পড়েছে, কিন্তু তার চলার গতিতে কোনো ক্লান্তি নেই। আছে শুধু টিকে থাকার সংগ্রাম।

দৃশ্যটা আমার ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিল। আমি নিজের সাথে তার তুলনা করলাম। আমার শক্ত-সামর্থ্য শরীর, আমার বয়স আছে, শিক্ষা আছে। আর এই মুরুব্বি? তার হয়তো কিছুই নেই, শুধু আছে কাজ করার মানসিকতা। যদি এই বয়সে এসে তিনি এই কঠিন পরিশ্রম করতে পারেন, তাহলে আমি কেন পারব না? আমার আত্মসম্মান কি এতটাই ঠুনকো যে দুটো কায়িক পরিশ্রম করলেই তা ধুলোয় মিশে যাবে? যে সম্মান আমাকে দুবেলা খাবার দিতে পারে না, থাকার আশ্রয় দিতে পারে না, সেই মিথ্যে সম্মানের বোঝা বয়ে বেড়ানোর কী অর্থ?

আমার ভেতর এক নতুন জেদ চেপে বসল। আমি আর আবেগের কাছে হার মানব না। আমি আর ভাগ্যের দোহাই দিয়ে পড়ে থাকব না। আমাকে কাজ করতে হবে, বাঁচতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
আমি যখন এসব ভাবছি, তখনই রিকশাওয়ালা মুরুব্বি তার রিকশাটা আমার পাশে এনে থামালেন। আমার দিকে তাকিয়ে তার শ্রমজীবী মুখের কোণে একটা অমায়িক হাসি ফুটে উঠল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “সাহেব, কোথাও যাবেন?”

‘সাহেব’!
শব্দটা আমার কানে এসে যেন অমৃতের মতো লাগল। কাল থেকে আমি ‘হারামজাদা’, ‘ফকিন্নি’ ছাড়া আর কিছুই শুনিনি। সবাই আমাকে তাচ্ছিল্য করেছে, অবহেলা করেছে। আর এই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটা আমাকে ‘সাহেব’ বলে সম্বোধন করছে! তার এই একটা ডাকে আমার খসে পড়া আত্মবিশ্বাসটা যেন আবার একটু একটু করে জোড়া লাগতে শুরু করল। আমার ভেতরটা ভরে উঠল। এই প্রথম আমার মনে হলো, আমিও একজন মানুষ। আমারও একটা সম্মান আছে।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “চাচা, আমার কাছে তো টাকা নেই।”

আমার কথায় কোনো লজ্জা ছিল না, ছিল কেবল সততা। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার অভিজ্ঞ চোখ দুটো হয়তো আমার বিধ্বস্ত চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা গল্পটা পড়ার চেষ্টা করছিল। তিনি কী বুঝলেন, আমি জানি না। কিন্তু তারপর তিনি যা করলেন, তাতে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। তিনি রিকশার সিটটা দেখিয়ে বললেন, “ওঠেন, সাহেব। পয়সা লাগব না। চলেন, আমার লগে একটু গল্প করতে করতে যাই।”

আমি দ্বিধা নিয়েও রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশা চলতে শুরু করল। ধীরগতির এই যানটিতে বসে আমি যেন এই শহরটাকে নতুন করে দেখছিলাম। চাচার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। তিনি তার জীবনের গল্প বলছিলেন। গ্রামের বাড়ি, ছেলে-মেয়ে, অভাবের সংসার—সব মিলিয়ে তার জীবনটাও একটা সংগ্রাম। কিন্তু তার কথায় কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল কেবল স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা আর পরিশ্রমের প্রতি আস্থা।

তিনি বলছিলেন, “সাহেব, কায়িক শ্রমের মইধ্যে কোনো লজ্জা নাই। লজ্জা হইলো কাম না কইরা বইসা খাওনে, পরেরটা মাইরা খাওনে। নিজের ঘামের টাকায় যে শান্তি, তা আর কিছুতেই নাই।”

তার প্রতিটি কথা আমার বুকের ভেতর গেঁথে যাচ্ছিল। আমি যেন এক নতুন জীবন দর্শন শিখছিলাম। আমাদের গল্প চলছিল, রিকশাও চলছিল। একসময় রিকশাটা একটা গলির মুখে এসে থামল। চাচা রিকশা থেকে নেমে বললেন, “নামেন, সাহেব। এইহানেই আমার গ্যারেজ।”

আমি নেমে দাঁড়ালাম। সামনে একটা বড় টিনের চালা। ভেতরে সারি সারি রিকশা রাখা। কয়েকজন চালক জটলা করে গল্প করছে, কেউবা নিজের রিকশা পরিষ্কার করছে। ঘাম, তেল আর মানুষের একটা মিশ্র গন্ধ জায়গাটাতে। এই পরিবেশটা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমার একটুও অস্বস্তি হচ্ছিল না।

চাচা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আইজ থাইকা এইহানেই থাকবেন। একটা কামের জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত আমার লগে খাইবেন, আমার লগেই থাকবেন। একা মানুষ, কই আর যাইবেন?”
আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে এমন নিঃস্বার্থ মানুষও আছে? আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। যে কান্নাটা রিয়া বা আমার পরিবারের জন্য আসেনি, সেই কান্না আজ এই অচেনা মানুষটার ভালোবাসায় আমার বাঁধ ভেঙে দিল।

আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। শুধু মাথা নাড়লাম। শেখ বাড়ির বড় ছেলের পুরোনো জীবনটা আজ সত্যিই শেষ হলো। আর এই রিকশার গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে শুরু হলো এক নতুন রাফিদের জীবন—যে ভালোবাসতে ভয় পায়, কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করতে আবার নতুন করে শিখছে। যে জানে, টিকে থাকার লড়াইটা কঠিন, কিন্তু সে একা নয়।

চলবে।